Site icon আলাপী মন

গল্প- সাদা বেনারসি

সাদা বেনারসি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

একি কাণ্ড গো! নিজের বিয়ে তে কেউ সাদা বেনারসি পরে? বেশি বয়সে বিয়ে হওয়ার জন্য ছোট পিসি মনির মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে।
হীরা পিসির মুখ থেকে এমন ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি হীরা পিসিকে বললাম, কারোর সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করার আগে একবার ভাবা উচিত নয় কি পিসি মনি?
হীরা পিসি ভ্রু কুঁচকে বলল,মানে কি বলতে চাইছিস তুই বুলা? আমি কি এমন ভুল বললাম? বাঙালি ঘরের বিয়ের কনে সাদা বেনারসি পরে কি বিয়ের পিঁড়িতে বসছে কোনোদিন? আমি তো বাবা এই প্রথম দেখলাম এমন দৃশ্য তাও আমাদের মতো যৌথ পরিবারে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, হীরা পিসি ছোট পিসির সাদা বেনারসি পরার পিছনে একটা ইতিহাস আছে ।যেটা বোধহয় তোমার কান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় নি এতদিনে ও। ঘটনা টা তাহলে শোনো তুমি , তোমার বিয়ের বৌভাতের দিন আমি দেখি ছোট পিসি ঠাম্মা প্রায় পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলো বাইরে থেকে। কি ব্যাপার তা দেখতে আমি ছোট পিসির ঘরে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ভিতর থেকে দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে ছোট পিসি ঠাম্মা।আমি যদিও ঠাম্মা শব্দ টা ব্যবহার করি না।আমি শুধু ছোট পিসি বলি।
খিল এঁটে দেওয়া র এই কথা টা শুনে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে মেজ পিসি ঠাম্মা বিশাখা বলে উঠেছিল,সে কি কথা রে! এমন অসময়ে দরজায় খিল এঁটে দেওয়া কি কথা!
চল তো বুলা আমার সঙ্গে তোর ছোট পিসি মনির ঘরে একবার। হঠাৎ মেয়েটার কি হলো একবার জিজ্ঞেস করে আসি।
এই তো সন্ধ্যা বেলায় লাল বেনারসি পরে , খোঁপায় বেল ফুলের মালা জড়িয়ে কি সুন্দর করে সাজলো।কি মিষ্টি দেখতে লাগছিল আমার ছোট বোন টাকে।
আমার দাদুরা পাঁচ বোন এবং ছয় ভাই।বড় পিসি ঠাম্মা ফাল্গুনীর মেয়ে হীরা এবং বড় দাদু মানে আমার দাদুর বড় ছেলে মানিক এবং অরুন্ধতী এরা তিনজনে সমবয়সী। আর আমি হলাম সেই মানিকের মেয়ে বুলা।
বড় পিসি ঠাম্মার মেয়ে হীরা এবং ছোট পিসি ঠাম্মা অরুন্ধতী একসাথে পড়াশোনা করেছে একি স্কুল থেকে।মাসী বোন ঝি এর মধ্যে ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়ে বেশ কম্পিটিশন লেগেই থাকত।
তবে কলেজে ওঠার পর হঠাৎ করেই হীরা পিসির বিয়ে হয়ে যায় এক অধ্যাপক পাত্রের সঙ্গে।আসলে হীরা পিসির রূপের ছটা ও দেখার মতো।যেমন ফর্সা তেমন চোখ মুখ।
সেদিনটা ছিল হীরা পিসির বৌভাত। তাই ছোট পিসি অরুন্ধতী ঠিক করেছিল বেনারসি শাড়ি পরে বৌভাত খেতে যাবে। তাই সে তার মেজ দি বিশাখার বিয়ের লাল বেনারসি টা পরেছিল। কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিয়েছিল।
মেজ পিসি ঠাম্মা বারবার দরজায় ধাক্কা মারার পর থমথমে মুখে ছোট পিসি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। বেনারসি র ভারি আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। খোঁপার বেল ফুলের মালা টাও যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শতরঞ্জি র ওপর। চোখের কাজল,আই লাইনার গেছে একেবারে থেবড়ে।
অরুন্ধতীর এমন আলুথালু বেশ দেখে বিশাখা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু স্বরে বলেছিল,বোন তোর সাজগোজ এর একি অবস্থা করেছিস? সেই সন্ধ্যা বেলা থেকে রেডি হচ্ছিস।আর এখন সব নিজের হাতে ভন্ডুল করে দিলি?
অরুন্ধতীর বক্ষদেশ এর দ্রুত ওঠানামা দেখে বেশ যাচ্ছে সে ভীষন রকমের রেগে আছে।রাগে,অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে চোখ গুলো জবা ফুলের মতো লাল করে ও ফেলেছিল।
বিশাখার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষন। তারপর বলেছিল,মেজ দি আমার কি অপরাধ বলতে পারিস কেন আমি হীরার ছোট মাসী হলাম?
অস্ফুট স্বরে বিশাখা বলে,মানে?
আমি রেডি হয়ে কনে যাত্রীর গাড়িতে বসে ছিলাম।কোথা থেকে মানিক এসে বলে, ছোট পিসি তোমার কি এমন লাল টুকটুকে বেনারসি, খোঁপায় বেল ফুলের মালা এইসব দিয়ে সাজা চলে? হীরার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলবে কি!যতই হোক তুমি তো এখন মাসী শাশুড়ি হয়ে গেছো। শাশুড়ির সাজ কি এমন হয়?
মানিকের কথা শুনে ওখানে আরো যারা ছিল তারা ও বলে উঠল,সব সাজগোজ এর একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে।বয়স যাইহোক অরুন্ধতী তুই যে এখন মাসী শাশুড়ি হিসাবে হীরার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস সেটা ভুলে গেলে চলবে না।
পাশ থেকে মানিক দার বৌ বলল, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো র চেষ্টা করছে গো আমাদের অরুন্ধতী।ওর যে আদৌ কোন দিন বিয়ে হবে কিনা কে জানে? তাই বোধহয় এমন সাজগোজ করেছে আজ।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে ছোট পিসি মনি আবার কেঁদে ফেলেছিল।আর সেই থেকেই ছোট পিসি মনি ডিপ কালারের শাড়ি পরা ও ছেড়ে দিয়েছিল।
তাই বলে নিজের বিয়েতে ও এমন সাদা বেনারসি পরে বসে কেউ? দুঃখ মেশানো গলায় বলল হীরা পিসি।
আমি বললাম, এখন বুঝতে পারি পারিবারিক সম্পর্কের গন্ডীর মধ্যে আমাদের সাজ পোশাক ও জড়িয়ে আছে যেন তাই না হীরা পিসি? অনেক পরিবারে এখন যদিও পরিবর্তন এর আলো ঢুকে পড়েছে। সেখানে শাশুড়ি,বৌমা একসাথে নাইটি, চুড়িদার পরে ।
কিন্তু আমাদের পরিবারে এখন ও গুমোট হাওয়া। এখন ও আমরা যৌথ পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ততটা খুঁজি না।যতটা নিষ্ঠা খুঁজি সম্পর্কের বাহ্যিক আচার আচরণের মধ্যে।
আমার কথা গুলো শুনে হীরা পিসি বলে,সে কি রে এত সব কান্ড হয়েছিল আমার বিয়ের সময়। বৌভাতের দিন ছোট মাসীর শরীর খারাপ হয়েছিল এটাই আমাকে বলেছিল সবাই। এত বছর পর বুঝতে পারলাম এর পিছনে অন্য গল্প ছিল।
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর হীরা পিসি ছোট পিসির ঘরে গেল।গিয়েই ছোট পিসিকে জড়িয়ে ধরে বলল,আজ তোমার নিজের বিয়ে তে ও সাদা বেনারসি পরবে ছোট মাসী?
ছোট পিসি লাজুক হাসি দিয়ে বলল,একে তো চল্লিশ বছরে বিয়ের পিঁড়িতে বসছি ,তার ওপর তোর বর মানে আমার জামাই ও এসেছে । সেখানে কি ভালো দেখায় শাশুড়ি হয়ে লাল বেনারসি পরে ঘুরে বেড়াতে।
হীরা পিসি বিরক্ত হয়ে বলে,শোনো ছোট মাসী যৌথ পরিবারের এই জগা খিচুড়ি মার্কা সম্পর্কের জেরে কি নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হবে নাকি।আমি শুধু মাত্র তোমার বোন ঝি হই তা নয় কিন্তু।আমি তোমার বান্ধবী ও হই।আর সেই বন্ধুত্বের জোরে বলছি,যতই তুমি সম্পর্কের দিক থেকে শাশুড়ি হয়ে যাও না কেন সাদা বেনারসি পরে নয়,লাল বেনারসি পরে ই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে আজ।
মনের সব দ্বন্দ্ব দ্বিধা কে দূরে সরিয়ে দিয়ে এবং হীরার মতো উদার মনষ্কা বোন ঝি কে পাশে পেয়ে অরুন্ধতী কুড়ি বছর পর আবার পরল মেজ দি বিশাখার সেই লাল বেনারসি টা।যৌথ পরিবারের জটিল সম্পর্কের সীমানা কে অতিক্রম করে অরুন্ধতী আজ ফুরফুরে মেজাজে শুরু করল তার বৈবাহিক জীবন।

Exit mobile version