(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
ক’দিন ধরে শিবুবাবুর সাদা বলদটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বি.ডি.ও. অফিসের পশু-ডাক্তারের কাছে কয়েকবার নিয়ে গেছে এসেরালি। সঙ্গে মণিব, শিবুবাবুও ছিল। গরুর ব্যাপারে তাকে সবসময় জড়িয়ে রাখে শিবুবাবু। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, তবু গরুটার মুখে খাবার রুচি ফেরেনি। আরও যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মন খারাপ শিবুবাবুর। সাদা আর কালো বলদ-দুটো তার ভীষণ ‘পয়া’ ছিল। কোন হেলদোল ছাড়াই বছরের পর বছর তাদের জোতে হাল টেনে গেছে অবলীলায়। যেমন তাদের তাগড়াই চেহারা তেমন গতরের তাকত। কত লোকে এদের দেখে হিংসে করেছে। আসলে আশেপাশে দু’পাঁচটা গ্রাম ঢুঁড়লেও এমন জোড়া বলদের খোঁজ মেলা ভার। দাদাগিরিও এদের দু’জনের কম ছিল না। এখন সাদাটা দমে গিয়ে দু’জনেরই দাপাদাপি থমকেছে। কালোটাও যেন তার অসুস্থ জুড়িদারের জন্যে মন মরা। নইলে ওটাই তো নাটের গুরু। বেড়ালের গলায় ঘন্টা তো ওটাই প্রথম বাঁধতে উদ্যত হয়। আর তাতে দোয়ার্কি দেবার মত কালোর সঙ্গে তাল মেলায় সাদা। ওদের যাওয়া আসার পথে অন্য কোন গরুকুলের ঘুরঘুর করার আইন নেই। বিশেষ করে কোনো জোড়া-বলদের। সেই হেলোকে তৎপর হয়ে নিজের জোড়াকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে এদের যাবার রাস্তা করে দিতেই হবে। ব্যাপারটা অন্য কোন নতুন হেলোর জানা না থাকলে বিপদ। প্রবল বেগে গুঁতিয়ে তাদের কাহিল করে তবে ক্ষান্ত হবে এরা। তখনই শুরু হয় চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি। এসেরালিকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে। মেজাজ ধরে রাখতে না পারলে কখনো কখনো নিজের ঘর সামলাতে মোটা কঞ্চির ঘায়ে এদের সারা গায়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছে সে। পরে আবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। অবলা পশু। এতটা মারধর করা তার ঠিক হয়নি। ওরা তো অমনই। ওরা কি মানুষ? শাসন করলে শুধরোবে? পুনরায় এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে ওরা এমনটাই করবে। শিবুবাবুকে সব জানিয়ে রাখে। বাবু তাকে কিছু বলে না। বাবু জানে এসেরালি গরু দুটোকে কতটা নিজের মত দেখে। শুধু বলে, “বড্ড বজ্জাত ও দুটো। নাটের গুরু তো ওই কালোটা। আর সাথীর তালে তাল না দিলে তো সাথী বিপদে পড়ে যেতে পারে, তাই সাদাটাও নেবে পড়ে রণক্ষেত্রে। দেখ এসেরালি, পশুরাও কেমন দরকারে বন্ধুর পাশে দাঁড়ায়! আমরা মানুষরা যদি এমন হতাম, সমাজজীবনটা এত জটিল হোত না।” আবার অনেকে তারিফও করেছে। বলেছে, এমন হৃষ্টপুষ্ট জোড়াবলদ পাওয়াও ভাগ্যের দরকার। জানো এসেরালি তোমার বাবুর কপাল ভাল, তাই এদের সঙ্গে সঙ্গে তোমার মত দায়িত্ববান হেলোও পেয়ে গেছে। এদের নিয়ে মনের মধ্যে তখন গর্ব উগরে উঠত শিবুবাবুর। কথার ছত্রছায়ায় তা জানানও দিয়েছে শিবুবাবু। এসেরালির নজর এড়ায়নি। গর্র তার মধ্যেও কম হয়নি। এমন জোড়া দুটোর চালনার দায়িত্ব পাওয়াটাও তো কম কথা না। তাকত বলদের তাকতওলা হেলো না হলে তাদের বশে রাখাটা অত সোজা কাজ না। তাই সুবিধে অসুবিধেয় এসেরালি কোনদিন কাজে কামাই দিলে শিবুবাবুর মাথায় হাত পড়ে যায়। এর কারণও আছে। অন্য কোন হেলো এই বলদ জোড়াকে নিয়ে হাল চষার কাজ সামাল দিতে পারে না। ওদের তালে তাল মিলিয়ে চলায় যে খাটনি তা তাদের সয় না। তাছাড়া জোড়া দুটোও অন্য হেলোর কথা শুনতে চায় না। লেজ মটকে বাঁদিকে যেতে বললে তারা ডানদিকে ছোটে। এসেরালি কিন্তু কোনদিন এদের কারোর লেজ মটকায়নি। হাল পরিচালনার এই মুদ্রাটা এরা একদম মেনে নিতে পারে না। বিদ্রোহ করবেই করবে। কাঁধে জোল, হাল সমেত তারা ছোটাছুটি লাগিয়ে দেবে। তখন কোন নিয়ম অনুশাসনকে তারা তোয়াক্কা করে না। প্রথম প্রথম এদের সামলাতে তাই এসেরালির বড্ড বেগ পেতে হয়েছিল। চিন্তায় পড়ে গেছিল সে। গরুদুটো এমন লাগামছাড়া হলে সে কাজ করবে কেমন করে ! একটা সময় মনে হয়েছিল এ’গরু নিয়ে সে হাল চষতে পারবে না। নিজের হতাশার কথা পেড়েও ছিল বাবুর কাছে। সব দেখেশুনে বাবু বলেছিল, “এসেরালি, তুমি এক কাজ করো, ওই গরুর লেজ মটকে নাঙলচষার দাওয়াইটা ত্যাগ করো। অন্য গরুর সঙ্গে আমার এই বলদজোড়াকে এক পংক্তিতে ফেলো না। তুমি ওদের সঙ্গে ভদ্রসভ্য ব্যবহার করো, ওরাও তোমায় মাথায় তুলে রাখবে। আমার গরুর রাশ আমি ভাল করে বুঝি। ‘জাবনা’ দেবার সময় হেইহুই করে যষ্টি উঁচানোর মত হাত উঁচিয়ে শাসন করতে গেলে ওরা আমাকেও রেয়াত করে না। সেটা বুঝে গিয়ে আর ওভাবে আমি ওদের উপর খবরদারি করি না। গলায়, গায়ে হাতবুলিয়ে জাবনা মাখালে ওরা একদম শান্ত ছেলের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। সরে যেতে বললে সঙ্গে সঙ্গে আদেশ তালিম করবে। তুমিও তাই করো, দেখবে তোমার কাছে ওরা কত আপনজনের মত হয়ে যাবে।” বলদ জোড়া সামলানোর এই বিদ্যেটা তো আর অন্য আনকোরা হেলোরা জানেনা। না জানার কারণে তাদের হেনস্থা হতে হয়। এই কারণেই তার উপর এত ভরসা শিবুবাবুর। চাষের কাজ শেষ হলে আর তো জমি চষার তেমন কোন কাজ থাকে না। হেলোরও দরকার হয় না। তাই বলে অন্য মালিকের মত শিবুবাবু তার বাঁধা হেলোকে ‘কাজ নেই’ বলে বেকার করে দেয় না। অসময়ে ডাঙা জমিতে সব্জির অল্পস্বল্প হালের কাজ ছাড়াও অন্য কাজে সারা বছর জড়িয়ে রাখে। তাতে দিনমজুর হেলো, এসেরালিরও আর কাজ পাওয়ার জন্যে গ্রামে গ্রামে ফিরি করতে হয় না। বাবু যেমন অসময়ে তাকে দেখে, সেও সময়ে বাবুর পাশে থেকে মন জুগিয়ে যায়। শিবুবাবুর ঘরের লোকেদের একজন হয়ে গেছে সে।
এবার সাদাটা জাবরকাটাও বন্ধ করে দিল। উঠে দাঁড়ায়ও না। এসেরালি কতবার চেষ্টা করল দাঁড় করাতে। কিন্তু গরুটার নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করেও আর নিজের ওই বিশাল শরীরটাকে তুলে ধরতে পারছে না। এসেরালির কথা এরা দু’জন খুব শোনে। ওরা ওকেই পালনকর্তা হিসেবে মানে। আর এসেরালি মানে শিবুবাবুকে। সাদা-জন তার মনিবের কথা শোনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। আসলে খাচ্ছে না তো কিছুই। গায়ে জোর পাবে কোথা থেকে। পেটে কিছু থাকলে তবে তো জাবর কাটবে, শরীরকে শক্তির রসদ যোগাবে।
বাড়ি সুদ্ধ সকলের মন খারাপ সাদা বলদের জন্যে। আর হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে না। ডাক্তারের কোন ওষুধ কাজ করছে না। ডাক্তারও কোন আশ্বাস দিতে পারল না। শুধু বলল,“যাবার সময় হয়ে গেলে কার সাধ্য আটকানো যায়। আমরা তো শুধু মনের বোধ দেবার জন্যে চেষ্টা করতে পারি মাত্র। প্রবীণ এই পশুটার মাড়ির দাঁতের অবস্থান জানান দিচ্ছে পৃথিবীর আলো বাতাস আর বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। তাই একে বেশি করে মায়ার বাঁধনে বেঁধে লাভ নেই। মন থেকে পোষ্যের প্রতি মায়া ছিন্ন করা সত্যিই কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। তবু যা অনিবার্য তাকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই।”
সেদিন বিকেল থেকে শুধু ডেকেই চলেছে গরুটা। কাকে ডাকছে কে জানে! এতদিন শরীর খারাপ করেছে, কোনদিন এইভাবে ও ডাকাডাকি করেনি। বলদ গরুরা এমনিতেই কম ডাকে। তারপর এদের মত তেজীরা তো তেমন নয়ই। ওর ডাক শুনে এবার কালোটাও ডাকতে শুরু করেছে। তবে এর মত তারস্বরে এবং সবসময় ডাকছে না কালো জন। ওরা হয়তো নিজেদের ডাকের মাধ্যমে মনের কথা আদান-প্রদান করছে! মানুষরা যার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসেরালির মনটা এবার কেমন যেন ‘কু’ ডাকতে শুরু করেছে। দিগন্তে সূর্য লাল-গোলাপী আলো ছড়িয়ে জানান দিয়ে যাচ্ছে ঘুমের দেশে চলে যাবার কথা। চরাচরে অন্ধকার নিজের স্থান দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় গৃহস্থের বাড়ির আলোর ছটা যেন ক্ষীণ চেষ্টা করছে অন্ধকারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্তকে রুখে দেবার জন্যে। শিবুবাবু বলল, “এসেরালি, এবার তুমি বাড়ি যাও। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। তোমাকে আবার অন্ধকার ফুঁড়ে অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। আমরা বাড়ির সবাই মিলে রাতে পালা করে গোয়ালঘরে অবলাটাকে পাহারা দিই। ‘হাম্বা হাম্বা’ করে মনঃকষ্টর কথা কি বলছে তা তো বোঝা যায় না। হয়তো অন্তিম সময় আমাদের সবাইকে ওর পাশে এসে থাকতে বলছে। ঠিক শেষ সময় মানুষ যেমন করে। মনঃকষ্ট এবং আত্মার ইচ্ছে, মানুষ আর পশুর মধ্যে আলাদা কিছু হয় বলে তো মনে হয় না। শুধু আমাদের মুখে ভাষা আছে তাই আমারা বুঝতে পারি, আর ওদের তা নেই।”
ইতস্তত করে বাড়ি ফেরার কথা মাথায় আনতেই এবার এসেরালির বুকের ভেতরটায় কে যেন সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। কে আর দেবে। ভেতরে যে দাপাদাপি করে সে! সেই মনপবনটা! ইতস্ততর কারণটা এবার যেন ওর ভেতরে চাগাড় দিয়ে উঠল। তার আদরের পশুটার এই অন্তিম সময়ে সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? তা হয় নাকি! গলার স্বর দৃঢ় করে এসেরালি বলল, “বাবু, আজ আর আমি বাড়ি যাবো না। বাজারে নাসির চাচার দোকানে বলে আসি, আজ রাতে বাড়ি যাবো না। বাবুর বাড়ি থাকবো। বাড়ির ওরা যেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে।” দিঘিরপাড় বাজারে ওদের পড়শি নাসির চাচার বিড়ির দোকান। জরুরী কোন খবরাখবর বাড়িতে দেবার থাকলে নাসির চাচাকে দিয়ে পাঠায় এসেরালি। বাবুও যেন ভেতরে ভেতরে চাইছিল, এসেরালি আজ রাতটা তার হাতের তালুর মত চেনা পশুটার পাশে থাকুক। তা এসেরালি নিজে থেকে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ না করলে তো জোর করতে পারে না। সে’কথা ও প্রকাশ করতেই বাবু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “তবে যা, রাত বাড়নমুখো, নাসির যদি দোকান বন্ধ করে চলে যায় তো তোর বাড়িতে আর খবর দিতে পারবি না। বাড়ি তখন চিন্তায় খোঁজখুঁজি শুরু করে এখান পর্যন্ত ছুটে চলে আসতে পারে।” এবার এসেরালি বাবুকে আশ্বস্ত করে বলল, এখন সবে সন্ধেরাত। চাচার দোকান বন্ধ হতে হতে রাত ন’টা হয়ে যায়। গরুটার গাল থেকে ঝরে পড়া লালাগুলো একটু ধুইয়ে-মুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
গোয়ালঘরে বাবু একটা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করেছিল। লম্প বা হারিকেনের আলোয় সবকিছু নজরে আসতে অসুবিধা হচ্ছিল। মধ্যরাত হবে, বাবু তার সঙ্গে ছিল। এসেরালি বলল, “বাবু, এবার আপনি ঘরে চলে যান। শুয়ে পড়ুন। আমি আছি। সেরকম হলে বৈঠকখানার বিছানায় আমি গিয়ে শুয়ে পড়বখন।” কিন্তু এসেরালি ভাল করে জানে আজ সারারাত তার দু’চোখের পাতা এক হবেনা। হ্যাজাকের তীব্র আলোয় ও দেখতে পাচ্ছে গরুটার চোখদুটো কেমন ড্যামড্যামে হয়ে আছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে, যেন সেই চোখদুটো তার দিকেই তাকিয়ে কি সব বলতে চাইছে। এতক্ষণ ধরে যে স্বরে সে ডেকে চলেছিল এবার তার বহর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাম্বা ডাকটা অনেক পরে পরে ভেতর থেকে যেন কত কষ্টে বেরিয়ে আসছে। ওই মায়াময় চোখদুটো এসেরালির দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে, ভেতরটা কেমন যেন ডুকরে উঠছে! কালোটার দিকে একবার চোখ পড়ল এসেরালির। বেচারা! তারও চোখে ঘুম নেই। জাবরকাটা বন্ধ করে ঠায় তার সহদরের দিকে চেয়ে রয়েছে। চোখের কোণে জলে ভেজা রেখা হ্যাজাকের তীব্র আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখে চোখ পড়তে সে একবার হাম্বা করে তার প্রভুকে ভেতরের দুঃখটা যেন ভাগ করে নিতে চাইল। এবার এসেরালি আর নিজের চোখের জলকে ধরে রাখতে পারল না। লুঙ্গির খোঁট দিয়ে চোখের কোণের পানিটাকে সামাল দিয়ে কালোটার পাশে গিয়ে তার গলায়, মাথায় মুখে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল। পশু হলেও এমন তাদের মনের ক্রিয়া, এসেরালির গায়ের আরো কাছাকাছি চলে এসে তার গা ঘুনতে থাকল। ঠিক যেমন মানুষের পরমাত্মীয় বিয়োগের মুহূর্তে মানুষ করে থাকে। আর নিজেকে সামাল দিতে পারল না ও। পুরুষমানুষের ডুকরে ওঠা কান্না বাতাসে সওয়ার হয়ে চরাচরে ভেসে যেতে লাগল। বাতাসের সেই বার্তা শিবুবাবুর কান ছুঁয়ে গেল কি না কে জানে। নির্ঘুম বাবুর ভেতরটাও হয়তো এসেরালির মত ডুকরে উঠেছিল! বাবু টর্চের তীব্র আলো ছড়িয়ে তড়কো পায়ে এসেরালির নাম করে হাঁক দিতে দিতে এদিকে চলে এল, “কি হয়েছে রে এসেরালি? অমন করে তুই চিৎকার করে কেঁদে উঠলি কেন? দাঁড়া দাঁড়া, আমি যাচ্ছি দাঁড়া!”
[ দুই ]
প্রাচীন ওই দীর্ঘ বটগাছটা আর তাকে কেন্দ্র করে তার চৌহদ্দির নীলাকাশ। এরা যেন ওদের জীবন চলনের অভিমুখ। দৈনন্দিন আশা-নিরাশার কেতন যেমন তারা ওড়াবে, তারই তালে তাল দিয়ে গড়ায় ওদের দিনরাতের আহ্নিক গতি। ওদের রুইদাস পাড়া থেকে সেই প্রায় সিকি কিলোমিটার দূরে দৌলতপুরের শেষ সীমানায় গলা উঁচিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেই প্রবীন বটবৃক্ষ। সকাল-দুপুর-বিকেল, ওদের পাড়া ফুরসৎ পেলেই তীব্র দৃষ্টিতে নিশানা ফেলে সেই বটের শীর্ষপট সংলগ্ন নীলিমায়। তাদের শ্যেন দৃষ্টি খুঁজে ফেরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সেই শ্যেনেদের উপস্থিতি। ওদের উপস্থিতি টের পেলেই চনমনিয়ে ওঠে রুইদাস পাড়ার ভিতর-বাহির সব অঞ্চল।
বটবৃক্ষ লাগোয়া প্রশস্ত ফাঁকা জায়গাটা দৌলতপুরের ছেলেপুলেদের খেলার মাঠ। বিকেল হলেই গমগম করে এই মাঠ এলাকা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এখানে ছুটে আসে স্বস্তির শ্বাস নিতে। ছোটরা খেলার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় খেলাধুলা করছে। বউ-বোন-মায়েরা এদিকে ওদিকে হাঁটাচলা ছুটোছুটি করে। দিনের ক্লান্তি দূর করে আনন্দসুখ আত্মস্থ করে। কেউ কেউ আবার দখিনা বাতাস বুকভরে গ্রহণ করার জন্যে ওই সুশীতল বটের তলায় আশ্রয় নেয়। খেলায় খেলায় ক্লান্ত ছেলেপিলেদের তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে এসে চিত হয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে, আবার খেলা-যুদ্ধে সামিল হবার জন্যে।
এক সময় এই সেই খেলার মাঠ আরও প্রশস্ত করার তাগিদ আসে গ্রামের ক্লাবের কর্মকর্তাদের। তার জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে থাকা প্রাচীন এবং বিশাল এই বটগাছটাকে হত্যা করে চিহ্নহীন করার। গাছটার কাছ থেকে খেলাধূলা করতে আসা বা একটু শ্বাস নিতে আসা মানুষ এত উপকৃত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে তার যে অপূরণীয় অবদান, এই কর্মকর্তারা যেন বেমালুম উড়িয়ে দিতে চাইল। তার থেকে তারা গুরুত্ব দিল মাঠ দৈর্ঘে প্রস্থে আরও চওড়া করার বাসনাকে! প্রস্তাবটা কানে কানে চাউর হয়ে গেল আশপাশের গ্রামগুলোতে। স্তম্ভিত সমস্ত গ্রামের মানুষ! পরিকল্পনা বাতিল করার আবেদন আসতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। কান ছুঁয়ে গেল প্রশাসনের। কিন্তু সেখানেও অদৃশ্য কোন শক্তির প্রভাবে প্রশাসনের দ্রুত সক্রিয় হবার কোন আঁচ পাওয়া গেল না। উৎকন্ঠা নিয়ে ক্রমাগত অপেক্ষা এবং ধৈর্য পরীক্ষার সামনে এসে দাঁড়ালো রুইদাস পাড়ার মানুষজন। তাদের জীবন-চলনের কেতন যে গাছ উড়িয়ে যায়, তার পতন মানে তো তাদেরও জীবন পতনের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়া। তা তারা কেমন করে মেনে নেবে! শত অনুরোধ উপরোধে যদি ক্লাব নিরস্ত না হয় তো তারাও সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল হতে দ্বিধা করবে না। হতেই পারে জায়গাটা ওই দৌলতপুরের সীমানায় অবস্থিত। ওর মালিকানা কিন্তু ওই ক্লাবের নয়। তাদের দখলে আছে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে জায়গাটা সরকারি ভেস্টেড। সেই অর্থে ওটা সরকারি জায়গা। সরকারের জায়গা মানে ওর উপর অধিকার তাহলে সকল নাগরিকের। রুইদাসদেরও। সরকারি জায়গা কারোর দখলে থাকা মানে সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। সেই হিসেবে একটা সমাজের দিনপাত এবং সংস্কার যে ক্রিয়াকর্মের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল তাকে সম্মান দিতে তারা তো বাধ্য। মানবিকতার এই পাঠ যদি তারা না নিয়ে থাকে তো জোর করে, বলপূর্বক সেই পাঠ তাদের কানে পশিয়ে দিতে তারা বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না।
রতনরা ক্লাবকে পই পই করে বুঝিয়েছে, “বাবুরা, এই গাছ তোমরা যদি কেটে দাও তো আমরা পথে বসবো। এই গাছের নিশানা নির্দিষ্ট করে দেয় আমাদের রুজিরোজগারের হালহকিকৎ। ব্যপারটা কি, কেমন করে এই গাছ আমাদের জীবনের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে, তোমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে চাই না বাবু। এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব এবং গোপনীয় সংকেত। কানাঘুষো তোমরা তার কিছুটা জানো। তার বিস্তারিত জেনে তোমাদের কোন কাজে আসবে না। শুধুমুধু আমাদের সমাজের নিজস্ব এক গোপনীয় প্রক্রিয়া তোমরা জেনে হাসাহাসি করবে আর আমরা অপমানিত বোধ করবো। কেবল আমরা যেটা অনুরোধ করছি তা তোমরা মেনে নাও। আর তোমাদের যদি সত্যি কোন ত্রিনয়ন থাকে তাহলে আমাদের দিকে একটু খেয়াল রেখো। দিনের আলোর মত তোমাদের সব প্রশ্ন বা কৌতূহল হাট হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। আসলে আমরা ‘রুইদাস’। তোমাদের তথাকথিত উচ্চজনের কাছে ছোট অন্তজ সম্প্রদায়ের মানুষ। বরাবর তাই তোমরা আমাদের উপেক্ষা করে এসেছো। আমাদের সম্পর্কে কোন আগ্রহ কোনদিন তোমরা দেখাও নি। তাই জানবে না আমরা কে, কেমন আমাদের চলন বলন। তোমরা শুধু জানো আমরা ভাগাড়ের গরু-ছাগলের ছাল ছাড়াই। তার ছাল চামড়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছেড়ি করি। বাজারে ছাগলের মাংস বিক্রি করি। আমরা পাড়ায় পাড়ায় বাবুদের ছেঁড়া জুতো সারাই। বেতের ধামা, সের, কুনকে, পালি বানাই। তোমরা আদেশ করলে সেগুলো সারিয়ে দিয়ে যাই। হাটে বাজারে বড়-মানুষদের পায়ের জুতো পালিশ করে চকচকে করে দিই বাইরেটা। ভেতরটা পড়ার যোগ্যতা বা সাহস আমাদের নেই! তবে এটা ঠিক বাবুরা, একটা সময় তোমরা আমাদের দিকে বেশ নজর দাও। সেটা স্বীকার না করলে আমাদের পাপ হবে। ওই পূজা-পার্বন, উৎসবের মরশুমে। আমাদের ঢাক কাঁসির উপস্থিতি সেসময় তোমাদের কাছে অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। হ্যাঁ তোমরা তখন আমাদের যারপরনাই খাতির যত্ন করো। খেতে দাও। নতুন নতুন জামা ধূতি পরিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রায় একরকম উচ্ছগ্য করো। পুজো শেষে বাড়ির ছেলেপুলেদের, বউদের জন্যে তোমাদের বাড়ির উচ্ছিষ্ট পুরোনো জামা কাপড় দাও। অবশ্য এটাও ঠিক, গরিব মানুষ আমরা, এই সময় ছাড়া এগুলো চাওয়া পাওয়ার সুযোগ আমাদের থাকে না। চাইলে তোমরা দেবেও না। মুখ করে ভাগিয়ে দেবে বা চাঁদ সদাগরের মনসাপুজো করার মতো বাঁ হাতে এক আধটা ছুড়ে দেবে। হ্যাঁ, অভাবি আমরা সেসময় চাই-ও। ঘরে আমাদের বাচ্চা-বউরা পথপানে চাতকের মত চেয়ে থাকে, পুজো শেষে কখন তাদের বাবা বা স্বামী বাড়ি ফিরবে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তারা মুখে এক-ঝিলিক হাসি ফোটাবে। বাবুর বাড়ি থেকে চেয়ে-চিনতে আনা জামা-প্যান্ট, শাড়ী-কাপড় তারা গায়ে চড়াবে। পুজোর ভাল পোষাক পুজো শেষে গায়ে চড়িয়ে উৎসবের রেশ কাটার আগেই তা উপভোগ করবে। পরিবারের এই তৃপ্তি আমাদের মনকেও ছুঁয়ে যায় গো বাবু। তাই তোমাদের কাছে হাত পাতি, তোমরাও দাও। এই পর্যন্ত। এর বাইরে এতটুকুও তোমরা আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখাও না। তাই তোমরা জানো না আমরা কেন আমাদের জীবন-পূজারী এই গাছকে নিধন করতে তোমাদের নিষেধ করছি।”
রতনের এত কথাতেও ক্লাবের বাবুদের মুখের ভাবে আশার কোন ফুলকি দেখতে পেল না। ওর কথায় বাবুরা কি বলে তার জন্যে খানিক অপেক্ষায় থাকল রতন। কিন্তু ও-পক্ষ কোন উচ্চবাচ্য না করায় রতন এবার যেন ভেতর থেকে শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। গলার স্বর মজবুত করে বলল, “তবে বাবু এটা ঠিক, তোমরা যদি আমাদের কথা না নাও তো আমরাও ছেড়ে কথা কইব না। এটা আমাদের জীবন-জীবিকার এক অপরিহার্য প্রশ্ন। রুখে আমরা দাঁড়াবই। তোমাদের কোন প্রভাব প্রতিপত্তি এখানে খাপ খুলতে পারবে না। তার জন্যে যেখানে যেতে হয়, যতদূর যেতে হয় আমরা যাবো।” এবার রতনদের কথা ক্লাবের বাবুরা মন দিয়ে শোনে। “সামনের মিটিংয়ে তোমাদের কথা আমরা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবো। কিন্তু আমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, এই গাছটা তোমাদের এতো কি কাজে আসে? তোমাদের পাড়া থেকে এ তো অনেক দূরে। তাছাড়া তোমাদের ওদিকের কেউ এখানে খেলাধূলা করতে আসে না। বুঝতে পারছি তোমরা কারণটা মুখ ফুটে আমাদের বলতে চাইছো না। তা চাইছো না যখন আর চাপাচাপি করবো না। তবে তার কারণটা আমরা যেভাবেই হোক জানার চেষ্টা করবো। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য আমাদের গ্রামেরও অনেকে এই গাছ কাটার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বিশেষ করে মাঠে খেলাধূলা করতে আসা মানুষজন এমনকি ছেলেছোকরারাও। ওদের বিশ্রামের সুন্দর জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে তা তারা মেনে নিতে পারছে না। তবে ক্লাবের মুখের উপর এদের কারোর কথা বলার প্রবণতা নেই বলেই নিজেদের গুঞ্জনের মধ্যে প্রতিবাদগুলো দেয়ানেয়া করছে। এই দেয়ানেয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমাদের কানে আসছে। সেইজন্যে এই সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনা করার একটা বাতাবরণও তৈরী হয়েছে। দেখা যাক, অধিকাংশ সদস্য যদি তোমাদের মতে মত দেয় তো গাছকাটা বন্ধ থাকবে। নাহলে বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সম্মুখে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।”
ভোরবেলা দক্ষিণের ফাঁকা মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে এসে প্রথম নজরে আসে রতন রুইদাসের! তাদের জীবন নিশান দৌলতপুরের খেলার মাঠের সেই দিগন্ত ছুঁতে উদ্যত বটগাছটার মাথায় দলবেঁধে ওরা বসে! ওদের আগমনে রতনরা ধরেই নেয় গাছের তলায় ভাগাড়ে গরু পড়েছে। কোন বারেই ওদের সেই ধারণা ভূল প্রমাণিত হয়নি। প্রাতঃকৃত্য মাথায় তুলে চুপিসাড়ে সে মারল ছুট সেই দিকে। রতনের মত ওখানকার সব মদ্দর কাছে সবসময় একটা ধারালো ছুরি কোমরে জড়ানো থাকে। ওরা কোন সময়ের জন্যে ঝুঁকি নিতে চায় না। কখন যে গাছটা তার আকাশ-নিশান ওড়াবে তার কোন ঠিক নেই। তাই ওরা এত সাবধানী। নিশান উড়লেই ওদের ছুট মারতে হয়। এটা নাকি ওদের কর্তব্য। না হলে অধর্ম হয়। ওদের কাজ শেষ না করলে আবার ওই শ্যেনের দল খেতে আসতে পারবে না। ওই গাছের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকবে।
কর্তব্য পালনের দায় রতন, নন্দ বা দিবাকর, কারোর একার নয়, রুইদাসদের সকলের। তাহলে রতন নিশানা দেখে চুপিসাড়ে একাই দৌড় দিল কেন? সেটা রতন-নন্দরা খুব ভাল করে জানে। এখন রতন সবার আগে নিশানা নজর করেছে তাই সে নীরব-দৌড় দিয়েছে। নিশান দেখে তার আগে যদি কেউ গিয়ে গরুটাকে একবার ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলে গোটা গরুর চামড়াটা তার দখলে চলে যাবে! রতনের জায়গায় নন্দ বা দিবাকর বা রুইদাসদের অন্য যে কোন মরদ হলে সেও তার মালিক হয়ে যাবে।এটা একটা নিয়ম, ওদের মধ্যে কালে কালে চলে আসছে। মনে হবে যেন এই গোপনীয়তায় তাদের অধিকার আছে। কেউ এজন্যে কাউকে তার কাজে বাধা বা দোষারোপ করে না।
হাজার হোক বয়স তো দিনে দিনে কমে না, বাড়ে। বাড়তে বাড়তে শেষের সে দিনে এসে ঠেক খাবে, যেদিন পৃথিবীর আলো-বাতাসের সব মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মত চলে যেতে হবে। রতনের বয়সের অভিমুখ এখন পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে। তাই সেদিনের সেই যৌবনের গতিতে এখন অনেকটা ভাটার টান। এই ভাটার সুযোগ নিয়ে কোন যুবক ছোঁড়া যদি তাকে টপকে চলে যায় তো তার কপালে ভোঁ-ভাঁ! একবার পেছন ফিরে তাকায়, অন্য কোন ছোঁড়া ছুট মেরে এদিকে ধেয়ে আসছে কি না। আবার সামনে এগোয়। বয়সের সঙ্গে দেহ-মনের এই লড়াই জারি রাখা তার পক্ষে আর যেন সম্ভব হচ্ছে না। তবু মনকে লাঠি বানিয়ে সেই লাঠিতে ভর করে এগিয়ে চলে সে। সবার আগে তাকে গরুটাকে ছুঁতেই হবে। হাতে কাজকম্ম বাড়ন্ত। আয়ে ভাটা। কাজের মরসুমের জমানো টাকা কটা নেড়ে চেড়ে এখন দিন চলে। এই গরুর চামড়াটা পেলে আবার কিছুদিন সংসার-গাড়ির চাকা গড়ানো যাবে। পা চালিয়ে এগোচ্ছে। চোখ কিন্তু চরকির মত চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন দিক থেকে ফুস করে কেউ যদি উদয় হয়ে তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দেয় তো হয়ে গেল। সব আশা ভরসা মাঠে মারা যাবার দাখিল হয়ে যাবে তাহলে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও সে যুদ্ধ জারি রাখে। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র সম মেদিনী।’ আসলে এমনটা ভাবনার কারণ একদম অমূলক নয়। অতীতে এমন অনেক ঘটনার নজির তাদের পাড়ায় অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে। বিশেষ করে ওদের মত ভারি বয়সের মানুষরা শিকার হয়েছে তাদের থেকে অল্প বয়সী ছেলে ছোকরাদের দ্বারা। সেইজন্যে বেশিরভাগ বয়স গড়ানো মানুষ আর এই টানাপোড়েনের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চায় না। আগে ভাগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে দেয়। নিশান দেখলেই আর বকের মত শক্ত হয়ে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে না। রতন এই ভাবনার শরিক হলেও এতদিনের অভ্যেসকে সহজে যেন বশে আনতে পারছে না। তাই এই নিশান-দৌড়।
যা ভাবনা ঠিক তাই, যেন বিধান হয়েছিল আগে থেকে। হঠাৎ রতনের চোখে পড়ল, দৌলতপুর ঘেঁষা তাদের গ্রামের কোরোঙ্গা পাড়ার রাস্তার গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একজন ছোকরা হন-হন করে এদিকে আসছে! এমন সময় অন্য কে বা আসবে। নিশ্চয়ই তার প্রতিপক্ষ কেউ হবে। রতন আরও জোরে পা চালাবার চেষ্টা করল। ব্যাস! ওই চেষ্টাই তার কপাল পোড়ালো। রাস্তায় পড়ে থাকা গোবরের তালে পা পড়ে হড়কে একদম চিৎপটাং! পড়ল তো পড়ল, পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়ল রাস্তার পাশে নয়ানজুলিতে। তবু সে হার মানার পাত্র নয় যেন। পড়ে গিয়ে কোথায় লেগেছে না লেগেছে সে বিচার পরে হবে। ঝপাঝপ সেখান থেকে উঠে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাঃ, পারল না সে। ভাগাড়ে-পড়া গরুর কাছে গিয়ে দেখে ওই মিত্তুনের জোয়ান ছেলে কেলে, গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই সময় ওরা কেউ কারোর সঙ্গে বাক্যালাপ করে না। নিজের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। গরুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি ছাড়িয়ে নেবার পর অন্য কথা। হতাশ রতন তাই কেলের সঙ্গে কোন কথা না পেড়ে মন খারাপ করে ফিরতি পথে বাড়িমুখো হয়। ফিরতে ফিরতে রতন ভাবে, এমন নিয়ম যদি সমাজে চলতে থাকে তাহলে তো কোন বয়স্ক মানুষ কোনদিন চামড়ার অধিকারী হতে পারবে না। অথচ রতনের, তার সংসারের তো পেট-পোঁদ আছে। তার উপরই সবটাই নির্ভর। ওদের সংসার তাহলে কেমন করে চলবে? এ নিয়ম আর চলতে দিলে হবে না। এই নিয়মের বাইরে একটা যুক্তিযুক্ত নিয়ম তৈরী করা অবশ্যই দরকার। সমাজে শুধু কম বয়সী আর ছেলে ছোকরারা বেঁচে থাকবে আর কর্মঠ বয়স্করা পেটে কিল মেরে পড়ে থাকবে তা তো হতে পারে না। নিয়ম পাল্টানোর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনাগুলো মনেমনে বিড়বিড় করতে করতে রতন বাড়ির দিকে আসতে থাকে। এবার বাহ্যে ফেরার কথা মনে পড়ে। কিন্তু বেলা অনেকটা উপরে উঠে গেছে। মেয়েমদ্দরা সব এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছে। আর ফাঁকায় বাহ্যে ফেরা হবে না। পাড়ার বাঁশ বাগানের আড়ালে নালায় বাঁশ খাটানো পায়খানায় বসতে হবে।
এটা তো একটা ‘বাঁজা’ নিয়ম। এই নিয়মটা অবশ্য খুব বেশি দিনের নয়। তিন কি চার বছরের পুরোনো। এক বিবেচনাহীন নিয়মকে রুখে দিতে গিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি এর জন্ম দেওয়া হয়। এখনকার মত একটু তলিয়ে দেখলে হয়তো সে সময় এটা চালু হোত না। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, একেও সমাধি দিতে হবে। আর যাকে সমাধিস্থ করার জন্যে এই নিয়মের জন্ম তার কথা ভাবলে এখনো গুমরে থাকা রাগ মাথায় চড়ে বসে যেন। সে সময়ের নিয়মটা ছিলো পুরোপুরি একপেশে। যে আগে ‘নিশান’ দেখবে সেই পাবে গরুর পুরো চামড়ার ভাগ। কিন্তু কে আগে দেখেছে, এবং সেই দাবী সত্য, তা সাব্যস্ত করবে কে? নন্দ দক্ষিণ মাঠে তো রতন পুবে বা দিবাকর হাটে বাজারের যাবার রাস্তায়। প্রকৃত ভাবে দক্ষিণ মাঠ থেকে নন্দ আগে দেখলেও সেখান থেকে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট লাগবেই লাগবে। অথচ দিবাকর রতনের থেকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরেও দেখতে পেলে সে বাজারের রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছে যাবে। যেহেতু দিবাকর আগে পৌঁছে গেছে অথএব পুরো চামড়ার অধিকার বর্তাচ্ছে দিবাকরের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের চলতি নিয়মে ‘সবার আগে নিশান-দেখা’ নন্দ হন্তদন্ত হয়ে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে গেলে লাগবে নিজেদের মধ্যে লড়াই। নন্দ যতই বলুক সে যে কুড়ি মিনিট আগে দেখেছে, সেই সত্যি কথাটা সে প্রমাণ করবে কেমন করে দিবাকরের কাছে ? জীবন ধারনের তাগিদ তো সকলের। যে পুরো চামড়ার অধিকারী হবে তার সামনেই তো মোটা আয়ের হাতছানি ঘুরপাক খাচ্ছে। যে পাচ্ছে, তার থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় তার জন্যে লড়াই তো সে করবেই। আর যে বা যারা না-পাওয়ার দলে রয়ে গেল তারাও পাওয়ার জন্যে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাতে দ্বিধা করবে না। এই দ্বন্দ্বে পড়েই তো বিশাল ঝগড়া-ঝাটি, মারপিট এবং শেষে খুন-খারাপি পর্যন্ত হয়ে গেল। এই চরম পরিস্থিতি এড়াতে আবার পাড়ায় সকলে বসে নতুন নিয়ম চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়।
নিত্যানন্দর বাবা, রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হয়েছিল লোচন রুইদাসের বাবা পরেশের হাতে। বিচারে, খুনের দায়ে পরেশ রুইদাসের ফাঁসির সাজা হয়ে গেল। পরে আপিল মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির সাজা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয় পরেশ রুইদাসের। পাড়ার মানুষদের কাছে লোচন রুইদাসদের পরিবার খুনে পরিবার হিসেবে দেগে গেল।
পূর্বপুরুষ থেকে এদের পাড়ায় আট-চালের একটা বড় বাফারা, মানে ফাঁকা সরকারি দালান ঘর আছে। সেখানেই পাড়ার যাবতীয় বিরোধ মিমাংসা বা ভালমন্দ কোন সরকারি আলোচনা হয়ে থাকে। আড্ডা, ক্যারাম,তাস খেলা তো যখন তখন চলে। সব্বাই এই দালানঘরকে আটচালা বলে চেনে। আটচালায় কোন দেয়াল নেই। চারিদিক ফাঁকা। কেবল শক্তপোক্ত শালখুঁটি আর বাঁশখুঁটির ঠেকনা দিয়ে পাকা বাঁশের আড়া-কাঁচি দু’থাকে চার-চার করে আটটা চালে তৈরী। গ্রামে এমন কাঠামো শৈলীতে অনেক বাড়ি আছে। তবে তাতে দেয়াল থাকে। এখানকার আটচালায় যা নেই। বদলে চারফুট উচ্চতায় পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়ালের মত ঘেরা আছে। গোটা কাঠামো টেকসই করার জন্যে আলকাতরা দিয়ে লেপে দেওয়া আছে। সেই আটচালার বিধানে চার বছরের শিশু লোচনকে ট্যাঁকে বেঁধে তার মা’কে গ্রামছাড়া হতে হয়েছিল। আর তাদের পাড়ামুখো হতে দেখেনি কেউ। বড় হয়ে লোচন প্রায় জলের দরে তাদের সেই অভিশপ্ত জায়গা বেচতে বাধ্য হয়। জলের দরে বেচার কারণ, খুনে পরিবারের জায়গা, মানুষের কাছে অপয়া জায়গা। তাই সরাসরি সেই জায়গা পাড়ার কেউ কিনতে চাইল না। অগত্যা পাশের কুমোর পাড়ার অনুকুল কুম্ভকারের কাছে এসে লোচন অনুনয় বিনয় করল যদি তাদের বাস্তুটা ওরা যা দাম দেবার সামর্থ, তাই দিয়ে যেন কিনে নেয়। কিন্তু অনুকুল কুম্ভকার বলল, “আরে বাবু, তোদের রুইদাসদের পাড়ায় বাস্তু জায়গা কিনে আমরা কি বাস করতে যাবো? কি হবে আমার, ওই পতিত জায়গাটা। ওটা আমার কাছে বাঁজা জায়গা ছাড়া আর কিছু না। না পারবো ঘর বানাতে, না পারবো চাষবাস করতে। চাষের জমি হলে না হয় ভাবা যেত। আমরা ও জায়গা নিয়ে ব্যবসার টাকা আটক রাখতে পারবো না রে, তুই অন্য কারোর কাছে যা। দেখ তারা কি বলে।” কিন্তু লোচন তো নাছোড়বান্দা। কুমোরদের মধ্যে এই অনুকুল কুম্ভকারই মাটির হাঁড়ি-কলসির ব্যবসা করে কাঁড়ি পয়সা করেছে। ওর এই ব্যবসার কপাল এখন তুঙ্গে। কুমোরদের কেউই ওর মত ফুলে ফেঁপে উঠতে পারেনি। এই অঢেল টাকা থেকে কিছুটা তার জমি কেনার জন্যে সরিয়ে দিলে ওর ব্যবসায় কোন আঁচড় লাগবে না। তাছাড়া পয়সাওলাকে সবাই একটু সমীহ করে চলে। আরও কয়েকজন কুমোরবাড়ি লোচন যে ঢুঁ মারেনি তা নয়। তারা একদম ঘাড় পাততে চায়নি। বরং উল্টে পাশ কাটায় অনুকুলবাবুর দিকে ঢেসিয়ে, “আমাদের ‘বন্নে’র মানে জাতের মধ্যে তোমার ওই জমি কিনলে একমাত্র অনুকুল কুম্ভকারই কিনতে পারবে। সাগর থেকে একফোঁটা জল তুলে নিলে অনুকুলবাবুর সম্পদের আড়ে-বহরে কোন প্রভাব পড়বে না। তুমি ওকে গিয়ে ভাল করে পাকড়াও। তারপর মানুষটাও খারাপ নয়। দয়ালু মন। ওই মনটাকে ভেজাতে তোমার বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এবার দেখাও তোমার কেরামতি।”
এবার নিরুপায়ে অনুকুলবাবুর হাত ধরে বলে, “বাবু, অনেকের দোর ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত তোমার কাছে এসেছি। পাড়ায় ভালমানুষ হিসেবে, পরোপকারি হিসেবে তোমার নাম যশ আছে। তুমি যদি আমায় ফিরিয়ে দাও তো আমি আর কোথায় যাই। আর কারোর দোরে যাবার রাস্তা আমার সামনে নেই। তুমি আমার দিকে একটু মুখ তুলে চাও কাকা। তুমি যদি ওই জায়গা নাই-ই ব্যবহার করতে পারো তো পরে আমাদের পাড়ার অন্য কাউকে বেচে দেবে। তুমি একবার কিনলে জায়গাটা শুদ্ধ হয়ে যাবে। ওটা যে ‘খুনেদের জায়গা’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন এ’পাড়ায় যে পয়সা করেছে, তোমার কাছ থেকে তারও জায়গা কিনতে কোন বাধা থাকবে না। তখন সে তো আর একজন ‘খুনে’ পরিবারের কাছ থেকে জায়গা কিনছে না। ভাল মানুষের কাছ থেকে কিনছে। আর যে দরে তুমি আমার কাছ থেকে কিনছো তার থেকে অনেক বেশি দর তুমি হাঁকলে তাতেও ওরা মুখ ফেরাবে না। কেননা আমাদের ভদ্রাসনটা তো একদম পাড়ার আটচালার পাশেই না? গমগমে জায়গা। পাড়ার আর কোথাও তো দু’দন্ড হাত-পা ছড়িয়ে সময় কাটাবার জায়গা নেই। এই আটচালাটাই একরকম বলা যায় এ’পাড়ার এজমালি সম্পত্তি। তাই দিনরাত লোক এখানে আড্ডা দেয়, রেডিও নিয়ে গান শোনে। সুখ-দুঃখের গল্প করে। ভাল-মন্দ কথা-চালাচালি করে।” এই ‘ভাল-মন্দ কথা চালাচালির’ কথা বলতেই অনুকুল মৃদু ধমক দিয়ে লোচনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর বলিস না। ওই আটচালাতেই তো বিন্দের মা আর যতনের মা গ্যাঁট হয়ে বসে আশু আর চোনোর বউয়ের কেচ্চা নিয়ে সমালোচনার ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল। একটু দূরে কমলেরর মা আড়-কানে শুনে লাগিয়ে দিয়েছিল চোনোর কানে! সেই নিয়ে কি লঙ্কা কান্ডটা না ঘটে গেল তোদের পাড়ায়। শেষ পর্যন্ত আটচালায় বাঁখারির বেড়া বানিয়ে সেটা বন্ধ করে দিতে হল।” অনুকুলের কথার রেশ ধরে লোচন বলল, “তাতে কি আর পাড়ায় কেচ্চা বন্ধ হয়েছে কাকা, হয়নি। সে অনেক গপ্প আছে। আজ না, সময়-ফুরসৎ হলে পরে অনেক কাহিনী তোমাকে বলবখন। হ্যাঁ, যে কথা তোমাকে বলছিলাম, “আটচালার জন্যে ওই জায়গার সামনে অনেকটা প্রশস্ত হাওদাখানা। আলো-বাতাস সবসময় খেলে বেড়ায়। আমাদের এই জায়গাটার ওপর পাড়ার কয়েকজনের লোভ আছে। শুধু আমাদের জায়গাটা ‘খুনি পরিবারের জায়গা, গ্রামের কেউ কিনতে পারবে না’ বলে মাতব্বরদের হুলিয়ার জন্যে পাড়ার কেউ সাহস করে কিনতে পারছে না। তুমি নিলেই দেখবে তোমার কাছে কতজন এসে হামলে পড়বে জায়গাটা নেবার জন্যে। এ’জায়গা নিলে তোমার ঠকা হবে না গো কাকা।”
লোচনের এই যুক্তিটা এবার মাথায় ঢোকে অনুকুল কুম্ভকারের। অনুকুল এবারে লোচনের বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে কিছুটা সন্ধানী বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বলে, “তুমি যখন এত করে বলছো তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমাকে জমিটা কিনতে হবে। তোমাদের পাড়ার লোকের যা মতিগতি তা তো অন্য মানুষের মত স্বাভাবিক মনের নয়। এত উগ্র মনের মানুষদের মধ্যে আমাকে পড়তে হবে। তারপর পেটে দু’এক পাঁইট চোলাই পড়লে তো আর রক্ষে নেই। ওই মাতাল-জাঁতালদের মোকাবিলা করাই একটা বিশাল ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। সেই ঝুঁকির মূল্য তোমাকে দিতে হবে লোচন। তুমি যা দাম চাইছো তা তোমাকে বিবেচনা করতে হবে। অত দাম আমি দিতে পারবো না। আমি কুমোর পাড়ার লোক তোমাদের রুইদাস পাড়ায় জমি কিনে মনে হচ্ছে স্বস্তিতে থাকতে পারবো না। ঝামেলা আমাকে পোহাতেই হবে।”
অনুকুলের কথায় লোচন চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এমনিতেই কম দামে জায়গাটা ছাড়তে হচ্ছে। অনুকুলকাকা আমার বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে। ভাবছে আমি বুঝছি না। কিন্তু এখন তার কিই বা করার আছে। জমি তো তাকে ছাড়তেই হবে। আধাকড়িতে হলেও ছেড়ে দিতে হবে। না হলে ওই জমি লুঠপাঠ হয়ে যাবে। অনুকুলকাকা যখন নিতে রাজি হয়েছে তখন ওর শর্তকে মেনে নিতে হবে। কিছু তো করার নেই, “ঠিক আছে কাকা, আমার যা দাম তা তো আমি তোমাকে বলেছি। এবার যে টাকা দিলে তোমার ধর্মে সইবে তাই দাও। একটু মনে মনে আহত হয়েই আমি কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা আমি এখন খন্দে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই সবটাই তোমার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম। কবে দস্তখত করতে হবে বোলো। তবে যা করার তাড়াতাড়ি করবে কাকা। আমার আর দেরি করার উপায় নেই।”
ক্রমশ……….