( সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ তিন ]
শিবুবাবুর বাড়ির লোকের ইচ্ছে ছিল না এতদিনের মায়ার বাঁধনে বাঁধাপড়া মৃত সাদা গরুটাকে ভাগাড়ের ফাঁকা ময়দানে ফেলে দেওয়ার। ওখানে ফেলা মানেই তো কুকুর-শেয়াল-শকুনে তাদের আদরের পোষ্যর নিথর শরীরটাকে ছিঁড়েকুটে বরবাদ করবে। আর ওপথে ওরা কেউ গেলে তা চোখ পেড়ে দেখতে হবে। অযথা মনের মধ্যে থিতু হতে থাকা কষ্ট চাগাড় দিয়ে উঠবে। এসেরালিও এই নিয়ে দ্বিধায় ছিল সবসময়। বাড়ির মানুষরা যেন তার মনের কথা খোলসা করে বলে ফেলল। তবু মুখ ফুটে সে কথা সে বলতে চাইল না। যেহেতু সে এসেরালি, তাই তার মতামত কে কেমনভাবে নেবে তা তো তার জানা নেই। এ সব মণিবদের পরিবারের আপন আপন মতামতের ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে ও তো এই বাড়ির কাজের মানুষ। আগ বাড়িয়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধন্তের ভেতর তার ঢোকা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শিবুবাবু মত দিল, “নারে এসেরালি, আমার বাড়ির লোকের সাথে আমার মত মিলছে না। তুই মুখফুটে এ ব্যাপারে তোর কোন মতামত জানাতে চাইচ্ছিস না ঠিকই তবে আমি জানি, আমার সিদ্ধান্ত তোরও মনঃপুত হবে না। আমি তো জানি, তুই তোর চাষের সঙ্গীদের কতটা ভালবাসিস। সেই ভালবাসার টানে তুইও মনমরা। তবু বলি, ওটাকে আমাদের ভাগাড়ের মাঠেই রেখে দিয়ে আয়। গ্রামের সবাই তো তাই করে। প্রত্যেকেরই তো আদরের পোষ্য একদিন না একদিন মারা যায়। কেউই এই প্রথার দ্বিমত করে না। এই তো দিনকুড়ি আগে দাস পাড়ার তপনদের গাভীটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। ওই হাতুড়ে পশু-ডাক্তারটার জন্যেই জলজ্যান্ত টগবগে গরুটাকে চলে যেতে হ’ল। আরে বাবা, মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চাটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই যখন তখন তুই কেসটা ধরে রাখলি কেন? কাছেই তো, ব্লক অফিসে পাশ করা সরকারি ডাক্তার ছিল। তাদের কাজই তো এইসব দেখাশোনা করা। দরকারে তারা গঞ্জের পশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে পারতো। সেখানে এই আপাতকালীন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্যে যাবতীয় পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি সব আছে। তা পরিস্থিতি যে তোর বিদ্যের বাইরে সেটা কবুল করে দিলেই হত! আর তপনদের বলি, ওই আনকোরা স্বঘোষিত কোয়াক পশু-ডাক্তারের ভরসায় থাকা ওর একদম সঠিক কাজ হয়নি। মধ্যিখান থেকে বেচারা পোষ্যটার প্রাণ গেল। তপনদের বাড়ির মেয়েদের কি তীব্র আফসোস! বিশেষ করে তপনের ওই বারো বছরের মেয়েটা। গরুটাকে প্রায় কোলেপিঠে করে বড় করেছে সে। মেয়েটার ছটফটানি দেখে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছিল। তা তারাই যখন সেই আদরের পশুটাকে ভাগাড়ে দিয়ে আসতে পারে তো আমাদের প্রিয় বলদটাকে ওখানে দিয়ে আসতে অসুবিধা কোথায়।
এসেরালি, বাবুর কথার উপর আর কথা বলার চেষ্টা করেনি। ও জানে বাবু যে সিদ্ধান্তটা একবার নেয় তা সহজে ফেরায় না। তবে যুক্তি দিয়ে যদি বাবুকে বোঝানো যায় তখন সে অবুঝ হয় না। বাবুর সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে। না হলে বাড়ির লোক বলার পরেও তাদের উড়িয়ে দিত না। তবু গিন্নীমা স্বামীকে বলেছিল, “তোমার কি মায়া-দয়া, মন বলে কিছু নেই? যে পশুটা এতদিন তোমাদের সংসারের জন্যে জান কবুল করে লড়ে গেল, তাকে এইভাবে বেওয়ারিশের মত ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে? হতে পারে সে পশু। এতদিন তো সংসারের একজন হয়ে সে ছিল। যখন সে গতর দিচ্ছিল তখন তোমার কাছে তার মত ভাল আর কেউ ছিল না। যেই তার সব শেষ হয়ে গেল, তার কাছ থেকে পাবার আর কিছু নেই, তখন তাকে এক কথায় ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাবতে চাইলে না! তাহলে অন্যদের সঙ্গে তোমার আর তফাৎ কি রইল? এদিকে তো কথায় কথায় নিজেকে সমাজের একজন গণ্যমান্য বলে জাহির করো। লোক মান্য করে বলে তুমি তাই ভাবো। তাতে আমার কিছু বলার নেই। তবে তোমার এই সিদ্ধান্ত আমরা মন থেকে একদম মানতে পারছি না।”
নিজের বউয়ের কাছে একপ্রকার ধমকই খেল শিবুবাবু। বাবুর চোখমুখ সঙ্গে সঙ্গে থমথমে হয়ে গেল। চোখ লাল! রেগে গেলে বাবু এমনটা হয়ে যায়। সেটা এসেরালি অভিজ্ঞতা থেকে জানে। এবার বাবুর দিক থেকে আগুনের গোলা না ছোটে। সেই আশঙ্কায় এসেরালি সন্ত্রস্ত হয়ে একধারে অপেক্ষায় রইল, সময় ব্যয় না করে বাবুর কড়া আদেশ তালিমের জন্যে। রাগী বাবু এখন যা করতে বলবে, কারোর কথা না শুনে সে তাই করতে প্রস্তুত! কিন্তু না! সে পথে তার বাবু, শিবুবাবু এবার হাঁটল না। আসলে শিবুবাবু বুঝেছিল, গরুটা মারা যাওয়ায় সে যেমন দুঃখ পেয়েছে, বাড়ির আর সবাইও একই রকম মনঃকষ্টে আছে। মায় এসেরালিও। তাই এখন ইটের বদলে পাটকেল মারার সময় নয়। মানুষের মন পেতে গেলে মন দিয়ে তা জয় করতে হবে। বাবু তাই শান্তভাবে গিন্নীমা সহ বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “প্রবাদটা আমরা সবাই জানি, জ্যান্ত হাতির দাম যেমন লাখ টাকা, তেমনই মরা হাতির দামও তাই। জীবন্ত হাতি যেমন আমাদের কাছে বহুমূল্যবান, তেমন মৃত হাতিও। গরু হাতির থেকে চেহারায় ছোট বলে কিন্তু ওদের ছোট চোখে দেখার উপায় নেই। ওরা ওই হাতির মতই জীবন্ত এবং মৃত, মানুষের কাছে সমান মূল্যবান। এ ব্যাপারটা সাধারণ ভাবে আমরা তলিয়ে দেখিনা তাই তার প্রকৃত মূল্যায়ন আমাদের কাছে নেই। গরুকে মায়ার মোড়কে জড়িয়ে আমরা কবর বা মাটি চাপা দিয়ে তার অন্তিম কাজ সমাধা করে দিতেই পারি। এটা তো অতি সরল ঐকিক নিয়মের অঙ্কের হিসেব হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের স্মৃতি থেকে কখন যেন হারিয়ে যাবে। একটা সময় তার অস্তিত্বের কথা বেমালুম চাপা পড়ে যাবে। আমরা আমাদের নিকটাত্মীয়ের কথা মনে রাখি না তো একটা পোষ্য। আমি যে কথগুলো নিছক কথার-কথা বলছি না, তা একটু ভেবে দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে। আর যদি ওই গরুটাকে আমরা ভাগাড়ে ফেলে দিই, মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা বড় রূঢ়। কিন্তু ওই গরুটা ভাগাড়ে ফেললে প্রথমেই ছুটে আসবে আমাদের সমাজের আমাদেরই মত একদল মানুষ। ওই যে দেখোনা, পাশের গ্রাম, বয়ারিয়ার রুইদাসরা। ভাগাড়ে মরা গরু-ছাগল পড়ার সংবাদ যদি একবার ওদের কানে চলে যায় তো রক্ষে নেই। হামলে পড়বে ওই মরা গরুটার উপর! এর মানেটা কি? ওরা কিন্তু ওই মরা গরুর মাংস শকুনের মত ছেঁড়াছেঁড়ি বা ভাগাভাগি করে নেবার জন্যে আসে না। ওরা ওই গরুটার চামড়া নিতে আসে। আর এই চামড়া নিয়ে তারা তাদের জীবিকার কিছুটা উপায় খুঁজে পায়। চামড়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে শোধন করে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে ওরা। ঘুরিয়ে সেই আমাদের গরুর চামড়া কিন্তু আমরা ব্যবহার করি। আমরা যে চামড়ার জুতো, বা চামড়ার ব্যাগ বা অন্য কোন ব্যবহারের উপযোগী জিনিস আমাদের দৈনন্দিন কাজে লাগাই তার কিছুটা তো আমাদের এই গরুর চামড়া থেকে হবে। এই রুইদাস বা মুচি-চর্মকারদের হাত ধরেই তো সেটা আমাদের কাছে আসে। তাহলে তোমরা একবার বোঝার চেষ্টা করো যে, আমাদের গরু মরার পরেও আমাদের কত কাজে লাগে। আমরা উপকৃত হচ্ছি এর দ্বারা। শুধু আমরা নই, ওই মুচিরাও এদের চামড়ার নানান দ্রব্য তৈরী করে পেটের ভাত জোগাড় করছে। বেঁচে বর্তে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে এসেরালির চোখের সামনে ভেসে উঠল, ভাগাড়ে গরু পড়লে তার আশেপাশের আকাশের মাথায় বড় বড় শকুনের চক্কর মারা দৃশ্য, “শুধু আমরা একাই ফায়দা নিচ্ছি না কিন্তু বাবু। আমাদের মত জান-প্রাণ নিয়ে টিকে থাকা আর এক প্রাণীজাতীও উপকৃত হচ্ছে। ওই যে গো বাবু, শকুনদের কথা বলছি।”
শকুনের কথা কানে আসতেই এসেরালিকে থামিয়ে দিয়ে শিবুবাবু বলল, “তোর কথা তো চাঁদ-সূর্যর মত সত্যি কথা রে এসেরালি। ওই শকুনরা কোথায় থাকে কে জানে। ভাগাড়ে একবার গরু পড়লে দূরদূরান্ত থেকে ঠিক তাদের নজরে পড়ে যায়। আসলে কি জানিস, পেটের জ্বালা তো সবার। তোর আমার মুচিদের যেমন, তেমন শকুনদেরও। ওরা প্রাণীকুলের মরা মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে বলা যায়। মরা মাংস ওদের ভীষণ প্রিয়। তাই পেটের দায়ে ওরা এখানে ছুটে আসে। এমনিতে কথায় বলে না, “শকুনের লক্ষ্য ভাগাড়ের দিকে।”
কোন এলাকায় কোথায় ভাগাড় আছে তা ওদের নখদর্পনে। সেই দূর আকাশ থেকে ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেইসব ভাগাড় অঞ্চলের দিকে। তা আমাদের গরুকে যদি আমরা মাটিতে গোর দিয়ে দিই এরাও বা প্রাণ ধরে রাখে কেমন করে। পরিবেশে প্রাণ ধারণের অধিকার সবার আছে রে এসেরালি। সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর ব্যবস্থা করেই জীব সৃষ্টি করেছে। তার জন্যে সৃষ্টিকর্তাই খাদ্যশৃঙ্খলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু কি জানিস এসেরালি, দিন যত এগোচ্ছে মানুষ যত আধুনিক সভ্যতার দিকে পা বাড়াচ্ছে। একটা অশনি সংকেত কিন্তু আমাদের সামনে এসে উঁকি মারছে। হয়তো আমাদের এই চলতি জীবন- ছন্দ আমরা আর ধরে রাখতে পারব না। চাষবাষের ক্ষেত্রে যেভাবে আধুনিক মেশিনপত্র বাজারে এসে পড়ছে, বেশি দূরে নয় সেই দিন, যে দিন ওই মেশিনই চাষ আবাদের সব কাজ করে দেবে। অবলুপ্তির আর সেই দিন বেশি বাকি নেই যেদিন মানুষের নিজ হাতে করা এখনকার এই নাঙল-জোল-গরু দিয়ে মাটি চষা, ধান বোনা, ধান কাটা, ঝাড়া। সব-সব সবকিছুই মেশিন করে দেবে। এতে হবে কি বল তো এসেরালি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গৃহপালিত পশুরাও একটা দিন অবলুপ্তির তালিকায় স্থান করে নেবে। ওদের সাথে সাথে মানুষও অস্তিত্বর সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। যদি তাড়াতাড়ি চলে যাই তাহলে হয়তো আমি তা দেখে যেত পারবো না। আমার আর ক’দিন। দেখতে দেখতে ষাট তো টপকে দিলাম। কিন্তু তোদের কি হবে! বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো সেই হাহাকারের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আমাদের দেশে চাষ-আবাদ করার জন্য বলদ গরু আর হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। একধামা চালে একটা কুরুই খুঁজে পাবার মত ধুঁড়ে, মানে সন্ধানে বেড়াতে হবে ওই বলদ জোড়ার জন্যে। যে দু’চার গাছা থাকবে তাদের ডাক অবশ্য আকাশছোঁয়া হবে, এটা ঠিক। তাছাড়া যত এ্যঁড়া বাছুর হবে, সব বড় হবে মাংস জোগান দেবার জন্যে। বগনা বাছুর বা গাভীরা অবশ্য আদরে বেঁচে বর্তে থাকবে, তারা দুধ দেয় বলে। এতে হবে কি বলতো এসেরালি, তোদের মত হেলো বা অন্য চাষীরা আর তেমন কাজ পাবে না। হেলোরা তো সত্যি সত্যি হারিয়েই যাবে। এসেরালি হেলো, জব্বর হেলো বলে এখন তোর যে কদর তা আর থাকবে না। আমার সামনের দৃষ্টি সেই কথারই আভাষ দেয়। তবে এসেরালি এখনই তোর ভেঙে পড়ার দরকার নেই। তুই আর একটা তাগড়াই বলদের খোঁজ কর। সে যেন আমাদের কালোটার সঙ্গে জোঝার ক্ষমতা রাখে। আমি যদ্দিন আছি তোর কাজ হারাবার ভয় নেই। আমি বেঁচে থাকতে আমার হালের কাঁড়া আমি নষ্ট করব না। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমার বংশধররা যদি তা ধরে রাখতে না পারে তো যা হবার তাই হবে।”
যে কথা বলতে বলতে শিবুবাবু অন্য টানে ফিরে গেছিল, সেখান থেকে ফিরে এসে বলল, “হ্যাঁ কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। বলছিলাম কি শুধু শকুনরা যে ভাগাড়ের মাংস খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকে তা তো নয়, রাতের বেলা হুক্কা হু ডাকে সদলবলে শেয়ালেরা যেভাবে এখানে আনন্দের আসর বসায় তা তো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। শেয়ালেরা এখানে নিজেদের খাবার অনেকটা পেয়ে যায় বলেই না আমাদের বাড়ির হাঁস মুরগি ছাগলরা ওদের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়। রেহাই একদম পায় তা বলা যাবে না। ওই হেংলা জাতটা সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। তবু ভাগাড় না থাকলে ওদের অত্যাচারে পাড়ার চোখে ঘুম ছুটে যেত। জানিস এসেরালি, এবার সেই ঘুম ছুটে যাবার দিন আগুয়ান। সমাজে গরু না থাকলে ভাগাড়ও যে কান্নায় ভাসাবে। তার সাথে সাথে পরিবেশের যে খাদ্যশৃঙ্খল সেখানেও জবরদস্ত হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে যাবে। পরিবেশের জন্যে মহামূল্যবান এই শকুন বলে প্রাণীটাই পৃথিবীতে লুপ্তপ্রায় জাতি বনে না যায়।”
বাবুর কথায় এসেরালি বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। প্রাণীরা তো যাবে। সমাজ থেকে বলদ বিলীন হয়ে গেলে তাদেরই বা কি হবে। তাদের মত হেলো শ্রেণীটারও কি সমাধি ঘটবে? তাহলে সে খাবে কি! সংসার নিয়ে ছোট ছোট ছেলেপুলেদের পেটে চার-ছ’টা দানা বা জোগাবে কেমন করে! এই বয়সে চাষের কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজ তার জানা নেই। নতুন করে কাজ শেখার সেই সুযোগই বা কে দেবে?
[ চার ]
পরেশ রুইদাস নিজের জীবিকার হাতিয়ার, কোমরে থাকা গরু-ছাগলের চামড়া কাটা ছুরি দিয়েই খুন করেছিল রাধাকান্ত ঋষিদাসকে। ওদের রুইদাস পাড়ার ইতিহাসে এই প্রথম কোন খুনের ঘটনা ঘটল। সেটা মেয়ে-মদ্দ সমেত পাড়ার কেউই মেনে নিতে পারেনি। তার থেকেও বড় কথা তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার সেই ‘গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো’ ছুরি দিয়ে মানুষ কাটা! তাদের সমাজ এই ছুরি বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সমর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। ভগবানের কাছে এই ছুরি পূজিত। তা দিয়ে কেউ কোনভাবে কোন অপরাধমূলক কাজ করতে পারে না।
মতামতটা এককভাবে প্রকাশ্যে কেউ তুলছে না। অথচ পাড়া প্রতিবেশীর মুখে মুখে চাউর হয়ে চলেছে। পাড়ার মাতব্বর, রতন-নন্দদের কানেও সেটা চলে যায়। রতনের বউয়ের কাছ থেকে রতন প্রথম শোনে। নন্দর কাছে কথাটা পাড়তে সে রতনকে বলে, “হ্যাঁ রে রতন, আটচালার কাছ দিয়ে আসার সময় আমি ব্যাপারটা শুনতে পাই। একদল বউ আটচালায় বসে এইসব কথা নিয়ে গুলতানি করছিল। তা ওরা যা বলছে, খুব একটা আজেবাজে কিছু বলছেনা রে। ঠিকই তো, যে হাতিয়ার ঠাকুরের কাছে সঁপে পুজো দিয়ে আমরা মানত করি। ঠাকুর যেন চিরকাল এই হাতিয়ার সচল রাখে। তাহলে আমরা বেঁচেবর্তে থাকতে পারি। সেটার অপব্যবহার করা একদম ঠিক কাজ না। পরেশ যে অন্যায় কাজ করেছে তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। এমনিতে দেশের আইনের দিক থেকে সে অপরাধী গণ্য হওয়ায় তার জেল-জরিমানা হয়েছে। সে তো একটা দিক। আর একটা অন্যায় করেছে, অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার না করে পরেশ অহরহ আমাদের ট্যাঁকে রাখা জীবিকা রক্ষার অস্ত্র অপব্যবহার করেছে। আটচালায় আমাদের বসতে হবে রতন। এই অপব্যবহার আটকাতে পাড়াকে একটা আদেশ শোনাতে হবে। না হলে অন্য কেউ আবার এই অন্যায় করে বসতে পারে।”
নন্দর কথা পুরোপুরি সমর্থন করল রতন। তারপর ও মনে মনে ভাবতে লাগল, পরেশ রুইদাস মানুষটা কিন্তু কোনদিন খুন-খারাপি করার মত হ্যাঁকাতে মানুষ ছিল না। মানুষের সঙ্গে কোনদিন মুখ তুলে চেঁচামেচি বা ঝগড়া করতে তাকে কেউ দেখেনি। বরং উল্টে হেসে-খেলে সকলের সাথে ভাব-ভালবাসা রেখে চলে। তাই খুনে-পরেশের পরিবারকে যখন গ্রাম ছাড়ার নিদেন আটচালা থেকে দেওয়া হ’ল, তার পরের দিনই পরেশের বউ বলেছিল, রতনকেই হাত ধরে বলেছিল, “ঠাকুরপো, তোমরা শুধু ওর খুন করাটা দেখলে। আমি তো বলছি না ও কাজটা ঠিক করেছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া ওর ঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু ও কি কোনদিন এরকম বেয়াড়া চরিত্রের মানুষ ছিল। তোমরা তো ওর সঙ্গে মেলামেশা করতে। জ্বালাধরা বুক নিয়ে ভুলবশত একটা বাজে কাজ সে করে ফেলেছে। কিন্তু কেন করেছে সেটা কেউ একবার তলিয়ে দেখল না, শালিশিতে আমি কতবার সেই কথাটা বলতে চেয়েছি। কিন্তু সকলের তার ওপর এত রাগ যে তার হয়ে বলা কোন কথা কেউ কানে তুলতে চাইল না। তুমি বুঝদার মানুষ হিসেবে আলাদা করে তোমাকেও বোঝাতে চাইলাম। ওদের চাপে তুমিও আমার দিকে নজর দিয়েও মুখ ঘুরিয়ে নিলে। জানো ওইসময় সাতদিন আমাদের সংসারে কারোর পেটে চালের দানাও পড়েনি। এবারের বর্ষায় জমিজিরেত বৃষ্টির জমা জলে সব পচে হেজে গেছে। সে তো সকলের গেছে। চাষ না হলে আর খোরোয় ধান তোলা, ধান ঝাড়ার কাজ হবে কি করে। সেটা তোমরাও দেখতে পাচ্ছো। বলতে গেলে কারোরই মাঠের কাজ নেই। নগদ পয়সার টান। শীতের ‘তাইচুন’ চাষ শুরু হলে তবে কাজ পাওয়া যাবে। আর খেঁজুর গাছ কাটা সবে শুরু হয়েছে। যে দু’চারটে পয়সা হাতে আসছে তা দেনার গব্বে ঢুকে যাচ্ছে। চাষ বেয়নে লোকের হাতেও পয়সার টান। বেত কাঁধে চড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঢুঁ মারতে মারতে কাহিল। তবু কেউ আর কাজ করায় না। দু’বছরের ছেলে লোচন যখন ‘কি খাবো কি খাবো বলে’ আমার কাছে চেল্লায় তখন তার বাপের মাথা গরম হয়ে ওঠে। এমন এক ধমক দেয় ছেলেকে। সে তো চমকে উঠে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলে। গাল ফুলে ফোঁপাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোলের বাচ্চাটাকে সামলাতে আমি আমার শুকনো বুক দুটো পাল্টাপাল্টি ওর মুখে গুঁজে ধরে থাকি। কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে যায় বাচ্চাটা। অপদার্থ মা আমিও চোখের জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেই দেখে আর বাড়িতে থির থাকতে পারে না বাপটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। সন্ধ্যের আগে কাঁধে বেত আর হাতে বাটালি নিয়ে খালি হাতে ফিরে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে মাখা নীচু করে দাওয়ায় বসে থাকে। আমি মেয়েমানুষ আর কি করি। লোকের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা ভাতের ফ্যান ওনার জন্যে একটু রেখে দিই। শরীরের ধকল থিতিয়ে গায়ের ঘামটা মিলিয়ে গেলে বলি, “এই ফ্যানটুকু চুঁচে খেয়ে নাও। আজও রান্নাবান্না কিছু হয়নি। কচু শাকের ঘ্যাঁট আর কাঠখোলা কলমি শাকের ভাজা আছে। চান সেরে এসে খেয়ে নেবে।”
খুনে-পরেশের বোয়ের কথা শুনতে শুনতে রতন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ভাবছিল, পরেশটা তখন খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। সত্যি তো, এটা তো সে দেখেছে রান্না চড়াবার আগেই রান্নাঘরে তার বউয়ের হাতে পরেশের বউ একটা ডেকচি ধরিয়ে দিয়ে বলছে, “তোমাদের ভাতের ফ্যান ঝাড়া হয়ে গেলে তা এই ডেকচিতে ঢেলে রান্নাঘরের দরজার একপাশে রেখে দিও। সময়মত এসে আমি নিয়ে যাবো।” বউটা তখন তারপর কি বলে চলেছে তার আওয়াজ কানে ঢুকলেও, কি বলছে তা ভেতরে যেন সেঁধাচ্ছিল না। হঠাৎ মুখ ফুটে মেয়েমানুষের করুণ আওয়াজের কান্না তার ভেতরে ধাক্কা মারতে সম্বিৎ ফেরে রতনের। কাঁদতে কাঁদতে পরেশের বউ বলছে, “সারারাত তো দু’চোখ এক করল না মানুষটা। পেটের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মরদের চোখ না বুজলে মেয়েমানুষ কেমন করে ঘুমকে বশ মানাবে। সেও রাতজাগা। শীতের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই খেঁজুররস কাটার হেঁসো আর কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিন আর একটু পরে বার হয়। সেও তখন বিছানা ছেড়ে উঠোন ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। তারপর ঘর-দাবা নিকোন দেবে। আস্তে আস্তে এ পাড়া, পালপাড়া থেকে এক এক করে রস খাবার জন্যে আমাদের দাবায় জড়ো হতে শুরু করেছে। আমি ঘর-দালান, উঠোন পরিস্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওরা নেশা চটকে এক একজন একেক রকম বকর বকর করতে করতে একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের উঠোন ছাড়তে শুরু করে। অন্য ঠেকে যাবার কথা বলে চলে যায়। পাল পাড়ার নিতাই আরও খানিক বসে যেদিকে ওর বাপ রস কাটতে গেছে সেই গাছের গোড়াতে খোঁজ করতে চলে যায়। আমি ‘কু’ কিছু না ভেবে আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তারপর তো শুনি ওই ভাগাড়েই রাধাকান্তর সঙ্গে মারপিট করতে করতে তার বুকে ছুরি চালিয়ে দেয় লোচনের বাপ। ঘরে ফিরতে দেখি ধস্তাধস্তিতে তারও ডান হাতের দাবনার কাছ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ম্যালেরিয়া গাছের পাতা কচলে তার রস সমেত দলানো পাতা চেপে নেকড়া দিয়ে বেঁধে রক্ত বন্ধ করি আমি। কে আগে নিশান দেখেছে চামড়াটা কার পাওনা হবে তার চুলচেরা বিচার পরে হতে পারতো। তাই বলে মানুষ খুনের কাজটা ঠিক করেনি লোচনের বাপ। ছালটা ছাড়িয়ে এসে আটচালায় বিচার-শালিশি বসাতে পারতো ওরা। আসলে ক’দিনের জীবনযন্ত্রণা ওকে দিশাহারা করে তুলেছে। কিছুতেই ও চামড়াটা হাতছাড়া করতে দিতে চায়নি। রাধাকান্তও গোঁও ধরে, বলে ও নাকি আগে নিশান দেখেছে। রাধাকান্ত ছিল দিঘিরপাড় বাজারে। তখন ও রাতে অমিত মুদির দোকান মুনতে যেতো। ভোরে পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ও নাকি প্রথম শকুনের চক্করমারা নিশান দেখেছে। বিবাদ শুরু এই নিয়ে। কে আগে নিশান দেখেছে। কে দেবে তার প্রমাণ! কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। এবার রতন ঠাকুরপো তুমি বলো, লোচনের বাপ কি ভাগাড়ে গিয়েছিল রাধাকান্তর বুকে ছুরি বসাতে না গরুর চামড়া ছাড়াতে। এক কাজে গেল আর এক কাজ করে ফেলল লোকটা। আমি এখন কি করি, কোথায় যাই। তোমরা আমাদের পাড়া ছাড়ার নিদান দিলে! ওই দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি তো এখন জলে ভাসলুম গো ঠাকুরপো। এই শিশুটার মুখ চেয়ে আমার প্রতি একটু দয়া করতে পারলে না তোমরা! পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে, ঠাকুরপো?”
পরেশের বোয়ের পাড়া না-ছাড়ার সেই করুণ আকুতি তখন রতনের ভেতরকে দুমড়ে দিতে থাকে। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। গলার স্বরযন্ত্রর উপর শক্ত কিছু যেন টোপলা হয়ে আটকে আছে। পাড়ার সকলে এক মত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে একা বা সে আর নন্দ মিলে এটা করেনি। শুধু সে সিদ্ধান্তটা সকলের হয়ে আটচালার সামনে তুলে ধরেছে। তাই সব দোষ যেন তার ঘাড়ে এসে পড়ছে। একবার মনে হচ্ছে, সত্যি তো ওই অসহায় মেয়েমানুষটা দুধের শিশুটাকে নিয়ে যাবেই বা কোথায়। আবার ভাবছে, এদের পাড়াছাড়া না করলে জেল থেকে ওই খুনেটা ছাড়া পেলে তো আবার বউ-বাচ্চার কাছে এই পাড়াতেই ফিরবে। শুনেছে জেল ফেরত আসামীরা নাকি বেশিরভাগই ভীষণ বেপরোয়া হয়ে যায়। পুনরায় অপরাধ ঘটানোর সাহস জেল থেকে জুগিয়ে নিয়ে আসে। সংশোধনাগারে শুদ্ধ না হয়ে এসে আরও দাগী অপরাধী বনে যায়। কেউ কেউ আবার শুধরেও যায়। তবে তা নাকি খুবই নগণ্য। তা তাদের পরেশ যদি সেই নগণ্যর মধ্যে না থাকে তো পাড়ার পক্ষে আরও বিপদ! তার থেকে বরং বিপদের বীজ মূল থেকে উৎপাটন করাই ঠিক কাজ হবে। এই ভাবনা ভেতরে ভেতরে জারিয়ে রতন যেন নিজেকে মনে মনে শক্ত করে নিতে পারল। পরেশের বউকে বলল, “না গো লোচনের মা। তুমি আলাদা করে আমার কাছে আর্জি জানাচ্ছো বটে, তবে এখানে আমার কিচ্ছু করার নেই। হয়তো আমি আটচালায় তোমাদের রায়টা শুনিয়েছি। কিন্তু তুমি তো দেখেছো, এই রায় আমাদের দু’একজনের নয়। পাড়ার সকলে তাতে মত দিয়েছে। পাড়ার মত উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই।”
রতন দেখল তার রায় শোনার পর আর একটা শব্দও ব্যয় করল না পরেশের বউ। আটচালা থেকে হনহন করে পাশে তার ঘরে চলে গেল। বাচ্চাটার কান্নার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিল। হয়তো তার খিদে পেয়েছে। হয়তো দু’বছরের প্রায়-শুকনো বুক দুটো তার মুখে গুঁজে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
পরেশের বউকে পাড়া ছাড়ার জন্যে তিনমাস সময় দিয়েছিল আটচালা। এই সময়ের মধ্যেই পাড়া ছাড়তে হবে তাকে। কোথায় যাবে কি করবে তার দায় আটচালার নয়। নিদানটায় রতন মন থেকে বেশ দ্বিধায় ছিল। সত্যি তো, ওই ভরা যৌবন নিয়ে মেয়েটা যাবে কোথায়। নিজের বোয়ের মুখটা ভেসে উঠল। ভেসে উঠল তার তিন বছরের সনাতনের হাসি খিলখিলে মুখটা। কষ্ট হচ্ছে রতনের ভেতরটা। কিন্তু সেই কষ্টটা বাইরে ওগরাতে পারছে না। এ তো আর এক অর্ন্তজ্বালা বাসা বাঁধল তার মধ্যে। পরেশের বোয়ের যৌবন যদি নাকাল হয় তো তার দায় সেও তো এড়াতে পারবে না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে চুপ মেরে রইল। একদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না রতন। সনাতনের মা’কে মনের কথা উগরে দিল। সনাতনের মা-ও স্বামীর মতে মত দিয়ে বলল, “ঠিকই তো, অপরাধ করল যে জন সে তো শাস্তি পেয়েছে। ফাঁসিতে লটকাতে লটকাতে তা রদ হয়ে যাবৎজীবন হয়েছে। তারপর তার ঘরের নিরাপরাধ প্রাণীগুলো শাস্তি পাবে কেন? তারা কি অন্যায় করল! এক অপরাধে দু’দফায় শাস্তি কেন? এটা পুলিশ-সরকারের দেখা উচিত। তোমাদের আটচালা এই নিদান দিয়ে একদম ঠিক কাজ করেনি। লোচনের মা থানায় যাচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তার এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে দেখে থানা কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারবে না। তারা এর একটা বিহিত করতই।” সনাতনের মায়ের কথায় সায় দিয়েও রতন বলল, “মরিয়া পরেশের বউ গিয়েছিল থানায়। নালিশ জানিয়েছিল আমাদের আটচালার বিরুদ্ধে। কিন্তু থানা কোন উচ্চবাচ্য করল না। যেহেতু সিদ্ধান্তটা আটচালার। ওরা জানে আটচালার সিদ্ধান্ত মানে সারা পাড়ার লোক একমত হয়ে নিদানটা দিয়েছে। তাই পাড়ার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করলে পাড়া যদি খেপে গিয়ে থানায় হামলা করে বসে? সেই ঝুঁকি থানা নিতে চাইল না। ঘাপটি মেরে বসে গেল। তারা খুব ভাল করে জানে ওই মুখ্যুসুখ্যু মেয়েমানুষটা থানা টপকে উপরে নালিশ জানাবার সাহস দেখাবে না। হয়তো সে জানেও না যে থানার বিরুদ্ধেও কোথাও নালিশ জানানো যায়।”
সত্যিই জানা নেই লোচনের মায়ের। রতনরাও তা জানিয়ে ঘোলা জল আরও ঘোলা করতে চাইল না। একজনের বিপদে পাশে না দাঁড়ানোটা ঠিক কাজ নয় জেনেও রতন চুপ মেরে গেল শুধু তার বউ-বাচ্চার মুখ চেয়ে। আটচালার বিরুদ্ধে কথা বলে যদি তার উপর আটচালার খাঁড়া এসে পড়ে? পরেশের ভরা যৌবনা বোয়ের সঙ্গে তার কোন গোপন সম্পর্কের কথা তুলে যদি তাকেও পাড়া ছাড়ার নিদান আটচালা দিয়ে বসে? এইসব পরকিয়ার ঘটনায় আগে তো দুই জোড়াকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে আটচালা। আটচালা পাড়াটাকে একদম শুদ্ধ মঠ-মন্দির করে রাখতে চায়। এখানে কোন বেলেল্লাপনা চলবে না। কিন্তু এত শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও পাড়ায় কি পরকিয়া প্রেম ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে? যায়নি। গোপনে রাসখেলা সমানে জারি রয়েছে। কথায় বলে না, ‘চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে, যদি না পড়ে ধরা।’ এখানেও তাই, ধরা পড়লে তখন সে অসচ্চরিত্র, না পড়লে সাধু ! রতন একটা জিনিস ভেবে কুল পায় না, আটচালার এত কড়া শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও যৌবন কেমন করে এত বেপরোয়া, ছন্নছাড়া হয়! এটা কি প্রকৃতির সহজাত প্রবণতা! যুগে যুগে যা কোনদিন কোন নিয়মনীতি দিয়ে বশে রাখতে পারেনি!
সেদিনের পর থেকে পরেশের বউ রোজ ভোরবেলা বাচ্চাটাকে কাঁখে বেঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফেরে সন্ধ্যে অনেকটা পার করে রাতের কাছাকাছি। পাড়ার মেয়েমানুষদের কানে কানে কানাকানি হয়ে কথাটা রতনের কানে এসেছে, পরেশের বউ নাকি কোলকাতার কোন বাবুর বাড়ি কাজে যায়। বাচ্চাটাকে সারাদিন রাখার জন্যে এবং সেও দিনমানে কাজের ফাঁকে ছেলের পাশে থেকে কিছুক্ষণ জিরেনের জন্যে বাবুরা তাদের সিঁড়ির নীচে ছোট্ট একটা কুঠরী দিয়েছে। কথাটা নিশ্চয়ই পরেশের বউ পাড়ার মেয়েদের কারোর কাছে গল্প করেছে। না হলে মেয়েরা বা জানবে কেমন করে। রতনের মনে হল পরেশের বোয়ের এই কাজটা মনে ধরেছে। তাই কোনদিন কাজে কামাই দিত না। মানবিকতার খাতিরে গ্রাম ছাড়ার জন্যে ওকে তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছিল। একা মেয়েছেলে, সাত দিনের নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলাটা অন্যায় কাজ হবে। তাকে গুছিয়ে নিতে সময় দেওয়া দরকার। আটচালা থেকে কেউ আবার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গ্রামছাড়ার কথা তুলেছিল। শেষমেষ ওই তিন মাস ওকে সময় দেওয়া সাব্যস্ত হয়। কিন্তু রতনের মনে হল এই নিদানের বিরুদ্ধে অপমানে ক্ষুব্ধ পরেশের বউ আটচালার মুখে বিষ্ঠা ঢেলে তিরিশ দিন গড়াতে না গড়াতেই পাড়ার আদেশ তামিল করল। একমাস গড়ানোর আগেই হঠাৎ দেখা গেল পরেশের বউকে ছেলে কাঁখে জড়িয়ে আর রাতে বাড়ি ফিরছে না ! সেই যে তালা দিয়ে গেল আর সে তালা খুলতে এল না।
আটচালার পাশেই তো পরেশ রুইদাসের বাড়ি। বাড়ির সামনে পেছনে বেশ খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা আছে। সাকুল্যে জায়গাটা হয়তো খুব বেশি নয়। কাঠা আড়াই-তিনেক হবে। কিন্তু অতটা জায়গার মধ্যে এক কামরা ঘর, একটা পাশকামরা আর সামনে দাওয়া নিয়ে ছোট্ট বাড়ি বলে মনে হয় অনেকটা জায়গা। সেই জায়গায় টুকটাক মরসুমী শব্জিও ফলাতো পরেশের বউ। বহুদিন ব্যবহার না করে করে জায়গাটা পোড়ো হয়ে গেছে। জঙ্গল গজাতে গজাতে এখন ওখানে মানুষ ঢুকতে ভয় করে। আর ঘরের ভেতর কত না সাপখোপের বিছের বা অন্য বিষাক্ত পোকামাকড়ের আস্তানা হয়েছে কে জানে। যেহেতু পাশেই আটচালা, দিনে রাতে পাড়ার সবাই এখানে বসে, আড্ডা দেয় তাই ভয় করে হঠাৎ ওই জঙ্গল ফুঁড়ে কোন বিষধর না আক্রমণ করে! তাই কেউ কেউ কথা তুলতে শুরু করেছে, পরেশের ওই পোড়ো জায়গাটা আটচালা দখল করে নিক। পরে যখন ওরা কেউ জায়গার দাবি নিয়ে আসবে তখন তাকে মূল্য ধরে দিলে চলবে। ওই গোটা জায়গা নিয়ে আটচালাটা বড় করে তৈরী করা হোক। তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে সকলে বসতে পারে, গড়াগড়ি খেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জঙ্গলের হাত থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যায়। নাহলে আটচালায় এসে কারোর কোন ক্ষতি হলে পরেশের বউ দায় নেবে নাকি? ও আবার কি দায় নেবে, ক্ষতি তো যার হবার হয়ে যাবে। সে ক্ষতি আর পূরণ হবার না।
রতন-নন্দরা দেখল, এই জঙ্গল জঙ্গল করে অজুহাত দেখিয়ে সত্যি সত্যি না একদিন কেউ জায়গাটা দখল করে নেয়। এটা খুবই অনুচিত কাজ হবে। ওরা নিশ্চিত, এই জায়গার টানে ওদের কেউ না কেউ একদিন এদিকে আসবে। বেদখল হলেই জায়গার অধিকার দাবি করবে। থানা-পুলিশ, আইন-আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে আর এক নতুন বিপত্তি এসে জুটবে। তার থেকে আটচালা থেকে এই পোড়ো জায়গাটা নিয়ে একটা বিধান দেওয়া ভাল। সেই ভাবনা মত একদিন আটচালা বসে সিদ্ধান্ত নিল, খুনে পরেশের ওই জায়গা পাড়ার কেউ কোনদিন সরাসরি পরেশের বউ বা তার কোন বংশধরের কাছ থেকে কিনতে পারবে না। যে সেই অপচেষ্টা করবে তাকেও পাড়াছাড়া করা হবে। আটচালাও ওই জায়গা দখল বা কেনাকাটার মধ্যে যাবে না। ওটা পরেশের ভদ্রাসন। পরেশের রায়ত সম্পত্তি। পরেশ জেলখাটার মেয়াদ শেষে যদি বেঁচে থাকে তো সে ঠিক করবে বা তার বংশধর কেউ ভাববে, কি করা যায় ওটা নিয়ে। বসবাস তো ওদের কেউ করতে পারবে না। একমাত্র আটচালার জন্যে বা বেপাড়ার কাউকে যদি তারা ওই জায়গা লিখে দেয় তো তার একটা হিল্লে হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের কথা উঠতে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আটচালা থেকে খরচ করে বছরে একবার জঙ্গল পরিস্কার করা হবে। সেই খরচের হিসেব রেখে দেওয়া হবে। ওই জায়গা যখন ওরা সাফকোবলা করতে আসবে তখন কড়ায় গন্ডায় তা হিসেব করে নিয়ে নেওয়া হবে। জঙ্গল সাফাইয়ের পয়সা দিতে অস্বীকার করলে যে জায়গা কিনবে তাকে দখল নিতে দেওয়া হবে না। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে চুপিসাড়ে জায়গাটা হাতবদল হয়ে যাবে আমরা নাও বুঝতে পারি। কিন্তু দখল তো সেই ক্রেতাকে নিতে আসতে হবে। তখন আদর করে তাকে বলা হবে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর!’ জঙ্গল সাফাইয়ের খরচা মেটাও, জায়গার দখল নাও। এখানে কোন ওজর আপত্তি খাটবে না। আটচালার পাশের জায়গা জঙ্গল হয়ে থাকবে। আর সাপ বিছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে, তারপর? সবসময় এখানে লোক বসে। সাপের কামড়ে কেউ যদি মরে যায় ক্ষতিটা কার হবে?
ক্রমশ…..