ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৫)

(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )

জন্মসূত্র

-সুব্রত হালদার 

 

[ নয় ]


নিজের কত্তা যে খেঁজুর রসের ভাঁড় ফেলে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি পরেশ-গিন্নীর। নিশান যে সারা পাড়া এখন দেখছে। পরেশগিন্নীর উৎকন্ঠা, এত বেলা হয়ে গেল, এখনও লোচনের বাবা ফিরছে না বলে। যতক্ষণে ভাগাড়ে গিয়েছে তাতে শিকারের চামড়া ছাড়িয়ে অনেক আগেই ফিরে আসার কথা। সেইজন্যে সে একবার দাবা থেকে রাস্তায় ওঠে, আবার ঘরপানে চলে যায়। আটচালার দিকে এসে লোককে তার চিন্তার কথা বলতে পারছে না। পাড়ার বউ-বাচ্চা-মরদরা সব সামনের ফাঁকা ডাঙায় শীতের সকালের মিষ্টি রোদে চান সেরে নিচ্ছে যেন। কারোর নড়াচড়ার কোন তাড়া নেই। সেখানে গিয়ে কাউকে তার খোঁজ নেবার কথা বললেই পেছনে লেগে যাবে মরদরা, “এখন রসের নাগর আসতে দেরি করছে বলে তোমার চিন্তা হচ্ছে। ঢেড়ি পিটিয়ে মানুষকে জানাচ্ছো। কিন্তু যখন নিশান দেখে কত্তা রসের ভাঁড় ফেলে দৌড় মারলো তখন তো বলোনি, দেখো গো দেখো আমার মরদটা কোথায় হারিয়ে গেল! তা তো বলবে না। যদি অন্য কেউ বলে ফেলে আমি আগে নিশান দেখেছি। ছুট মেরে তার আগে শিকার দখল করে নেয়!” তাই নিজের চিন্তা নিজের মধ্যে রেখে ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে পরেশ গিন্নী সনকা!
খানিক পরেই আটচালার দিক থেকে লোকজনের জোরে জোরে কথা বলার শব্দ কানে আসে লোচনের মায়ের! তখন সে বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছিল। ছেলে খাওয়ানো ফেলে দৌড়ে রাস্তায় উঠে আসে। দেখে, লোচনের বাপের গায়ের গেঞ্জী আর এল্টেতোলা কাপড়-গামছা সব রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। মরা গরুর ছাল ছাড়াতে তো এত রক্ত গায়ে লাগার কথা নয়! মরা জীবের শরীরে অস্ত্র ফোটালে রক্ত ফিনকি খায় না। তাই এমনভাবে রক্ত মাখামাখি হবার কথা না। কি এমন ঘটল যে সে এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরছে? কাঁধে আবার গরুর ছাল ঝুলছে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ তাকে ঘিয়ে কিসব জিজ্ঞেস করছে আর উত্তর দিতে দিতে সে বাড়ির পানে এগিয়ে আসছে! শেষমেষ কি কথা যে সে বলল, তা সে এতদূর থেকে বুঝতে পারছে না। জনা তিনেক লোক তাকে ঘিরে রেখে বাকি সব্বাই দল বেঁধে হইহই করে ছুটলো দৌলতপুরের ভাগাড় পানে! পেছন থেকে লোচনের বাপের গেঞ্জি একজন মুঠো মেরে ধরল আর দু’জন তার দুটো হাত খাপটি মেরে ধরে এদিকে আসতে লাগল। কাঁধে ঝোলানো গরুর চামড়াটা আর দেখা যাচ্ছে না। ওটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে। দলবলের কেউ ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই। আর চুপ করে থাকতে না পেরে ওদিকে পা-পা করে এগিয়ে যায় লোচনের মা। কাছাকাছি গিয়ে বলে, “ওকে ওইভাবে তোমরা পাকড়াও করে আনছো কেন? ও কি চোর, না ডাকাত? দূর থেকে ওর কাঁধে গরুর চামড়া দেখতে পেলুম, সেটা আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? তোমরা ওটা ছিনতাই করার জন্যে দলবেঁধে আটচালার সামনে রোদ পোহাচ্ছিলে বুঝি? দাও, ছেড়ে দাও ওকে? একটা ভালমানুষকে এইভাবে পাছড়া-পাছড়ি করে ধরে আনতে তোমাদের বিবেকে বাঁধলো না বুঝি? এ কেমন ধারা বিচারবুদ্ধি তোমাদের!”
এবার মুখ খুলল রতনের ভাই যতন, “তোমার কত্তা চুরি ডাকাতি করলে তবু মাফ ছিল গো গিন্নী। তার চেয়ে আরও ভয়ানক কাজ করে ফিরছে তোমার মরদ। কষ্মিন কালে কখনো গরুর ছাল ছাড়াতে গিয়ে কারোর সারা গা এমন রক্তে মাখামাখি হতে দেখেছো? সেটা তো জিজ্ঞেস করছো না, এত রক্ত কেন? সোয়ামির অক্ষত দেহ, তার পরেও সারা শরীর এতো রক্তে ভেজা কেন? মানুষ খুন করেছে তোমার কত্তা। গরুর চামড়ার জন্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের পেটের চামড়া ফালা করে ভুঁড়ি ভসকে দিয়ে বীরদর্পে বাড়ি ফিরছেন বাবু। এর চেহারা দেখে আমরা তো চমকে উঠি! একি! পরেশের সারা শরীর রক্তমাখা কেন? নিশ্চয়ই কোন অঘটন কিছু একটা ঘটেছে। আমাদের কয়েকজনের প্রথমে খটকা লাগে। যারা অতটা তলিয়ে ভাবেনি তাদের কেউ বলে, ও কিছু না। টাটকা গরু পড়লে রক্ত ছিটকে গায়ে লাগতেই পারে। আরে বাবা, ও তো ভোরবেলা খেঁজুর রস কাটতে গিয়ে নিশান দেখে ছুটেছে। অত ভোরে মরা গরুকে মানুষ কোনদিন ভাগাড়ে ফেলতে আসে না। তাহলে নিশ্চয়ই গরুটাকে আগের দিন বেলাবেলি বা সন্ধ্যেরাতে ফেলা হয়েছে। ততক্ষণে তার আর টাটকা ভাব কোথায় পাওয়া যাবে? যুক্তিটা তারপর সকলে মেনে নিয়ে একে চাপাচাপি করতে রাধাকান্তকে খুন করার কথা বেটা কবুল করে! সত্যি মিথ্যা যে কারণেই হোক। কে আগে নিশান দেখেছে, কে পরে দেখেছে তাই নিয়ে অমত হতেই পারে। তাই বলে সেই বিতর্কের এতটা ঝাল যে জলজ্যান্ত মানুষটাকে খুন করে দিতে হবে? তোর যদি সন্দেহ হয় তার জন্যে তো পাড়ার আটচালা আছে। সেখানে কথাটা বিচারে ফেলতে পারতিস। দেখতিস তার কোন বিহিত হয় কি না। অত তিরিক্ষি মেজাজ কিসের? তোর মেজাজ তুই তোর বোয়ের কাছে দেখা না। কেউ তোকে বলতে আসবে না।”
রাধাকান্তর শরীরের রক্তে ধোয়া পরেশ, বোয়ের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। মাথা নীচু করে শুধু একটা কথা বলল, “কোথা থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। মাথায় খুন চেপে গেল। খুন চাপিয়ে দিল ওই ব্যাটা নিজেই। গালি দিচ্ছিল আর আমার রাগ চড়ছিল। হঠাৎ ওর ছুরির আঁচড়ে আমার হাতের চামড়া চিরে রক্ত পড়তেই আর মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি। পাল্টা আঘাতে শেষ করে দিলাম ওটাকে। ওকে শেষ করেছি, এবার আমার ইহলীলা শেষ। খুনের বিধান তো ফাঁসিতে লটকানো।”
পাড়ার যারা দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে ছুটছিল, তারা হঠাৎ যাবার পথে রাস্তার উপর অমিত মুদিকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল! অমিত মুদি আবার এখানে পড়ে কেন? দেখে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। রতন তার নাকের কাছে নিজের কানের লতি ঠেকাতে টের পেল, গরম বাতাস। নিঃশ্বাস পড়ছে। হার্টফেল করে মরে যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে সে জনা তিনেককে এখানে রেখে রতন মুদিকে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে বলে বাকি সবাইকে নিয়ে ভাগাড়ের দিকে ছুট মারল। বুকে হাপর টানতে টানতে ওরা ভাগাড়ে পৌঁছে দেখল, মরা গরুর পাশে নিথর রাধাকান্তর নিশ্চিন্ত সহাবস্থান! হাতের মুঠোয় তখনও নিত্যসঙ্গী ছুরিটা ধরা। যেন মরণের পরেও জীবনচলনের হাতিয়ারকে সে যথাযথ সম্মান দিয়ে গেল।
পরেশ যেমনটি বলেছিল সব ঠিকঠাক মিলে গেছে। ধারাকান্ত এইভাবে পশুর মত মরে পড়ে থাকার দৃশ্য সহ্য করতে পারছিল না ওরা কেউই। কারোর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তো কেউ বা মনে মনে গুম হয়ে ভেতরের কষ্টটাকে সামাল দেবার চেষ্টা করছে। হাজার হোক নিজের পড়শি তো। দুবেলা চোখাচোখি, কথাবার্তা। সুখ-দুঃখের আলোচনা। আবার কখনো কথাকাটাকাটি। মদের নেশায় গালাগালি। তবু তার মধ্যে জীবনকে খুঁজে পাওয়া। আবার ভাব ভালবাসায় জড়িয়ে যাওয়া। এই নিয়েই তো তাদের জীবনের রোজনামচা। সেই জীবন প্রবাহের মধ্যে এই অন্যায় খুন-খারাপি বড্ড বেমানান। এটা এদের কেউই মেনে নিতে পারছে না। এমন অসহ্য ঘটনা যাতে দ্বিতীয়বার না ঘটে তার জন্যে তারা আটচালায় শপথ নেবে। শপথ নেবে, জীবনের সুখ- দুঃখের যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত মিলেমিশে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবার।
তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে রতন বলল, “এই অবস্থায় লাশ তো আমরা ছুঁতে পারি না। পুলিশ ছাড়া এ লাশ এখন ছোঁয়ার অধিকার কারোর নেই। থানায় খবর দিতে হবে।” বলে রতন তিন-চার জনকে ওখানে রেখে চলে এল।
দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মানুষ খুন দেখার জন্যে লোকের ভীড় হতে লাগল দেখার মত। রতনরা বুঝল, যতক্ষণ না পুলিশ এসে লাশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ এই ভীড় আটকানো যাবে না। পাড়ার দু’জনকে পাঠিয়েছে, তাড়াতাড়ি থানায় খবর দিয়ে পুলিশ নিয়ে আসার জন্যে। ততক্ষণে ওদিকে অমিত-মুদির জ্ঞান ফিরে এসেছে। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা অনুভব করে। রতনরা তাকে পাঁজা করে তুলে দেখে মাথার পেছন থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাধাকান্তকে খুন করে ফেরার পথে অমিত মুদির কাছে বাধা পেয়ে পরেশ এর মাথায় আঘাত করেনি তো? না কি ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল অমিত। নাহ। দুটোর কোনটাই নয়। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, দুর্বল রাশের মানুষ অমিত মুদি। রক্তে ভেজা পোশাকে সদ্য খুনি পরেশের মুখোমুখি হতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর কোথায় কি হ’ল তা সে আর বলতে পারবে না। রতন তাদের পাড়ার ছেলেদের ধরাধরি করে অমিতকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে রাধাকান্ত খুনি পরেশের সঙ্গে কথা বলার জন্যে পাড়ার দিকে রওনা দিল। কোন পরিস্থিতিতে পড়ে সে এই কান্ডটা ঘটালো তা জানা দরকার।
মন এবং শরীরের দিক থেকে এতটা কাহিল হয়ে পড়েছে অমিত মুদি যে, সে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। ছেলেরা ধরাধরি করে তুলে দাঁড় করাতে গেলেই সে পড়ে যাচ্ছে। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না। সেইসঙ্গে মাথা ফাটার তীব্র যন্ত্রণা। বাধ্য হয়ে সবাই মিলে আলগোছে তুলে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেল। দিঘিরপাড় বাজারের উপর দিয়েই যেতে হবে অমিত মুদির বাড়ি। বাজারে উঠতেই উজাড় হয়ে লোক অমিতকে দেখতে জড়ো হয়ে গেল। সেলুন মালিক মোহন বলল, “দাদাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি তোমরা পুতুল নাচ দেখবে? বাড়িতে কি ডাক্তার বসানো আছে? আগে ডাক্তারখানায় নিয়ে চলো। কুঞ্জ ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আর ওনার বাড়ির লোককে কেউ একজন এক্ষুণি খবর দাও। এই বিমলে, তুই বাড়ি যাবি তো? বাজার হয়ে গেছে? অমিতদার বাড়ির পাশ দিয়ে তো তোকে বাড়ি যেতে হবে। তবে আর এখানে ভীড় জমাসনি। বাড়ি যা এক্ষুণি। যাবার পথে অমিতদার বাড়িতে খবর দে। আমরা এনাকে কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার দেখে রোগীর ভাল-মন্দ বুঝে বাড়ি পাঠাবে না হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, ডাক্তার নিজেই সেটা ঠিক করবে। আমরা রোগীর ভাল-মন্দ কি বুঝবো। যেভাবে অমিতদা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, মনে হয় আঘাতটা হাল্কা কিছু নয়।”
কুঞ্জ ডাক্তার নিজের হাতে রোগী রাখতে চাইল না। মাথার আঘাতের থেকে মানসিক আঘাতটা প্রচন্ড বলে মনে হ’ল। তাই একে হাসপাতালে পাঠানোই শ্রেয় মনে করল। সেইভাবে প্রেস্ক্রিপসান লিখে বাড়ির লোককে দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলল। হাসপাতালে পাঠানোর খবর ছড়িয়ে পড়তে বাজারের লোকজন, বিশেষ করে যারা অমিতদাকে পছন্দ করে, তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। দু-একজনের উসকানিতে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল বাজারের ইয়ং দোকানদাররা। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল পরেশের উপর। ও বাড়ি আছে খবরটা জেনে ওই ছেলেরা দল বেঁধে চড়াও হতে ছুট দিল রুইদাসপাড়ার দিকে। পরেশকে উত্তম-মধ্যম ধোলাই দিয়ে তবে তারা ক্ষান্ত হবে। বাতাসের বেগে পরেশের বাড়িতে হামলা হবার খবরটা রুইদাস পাড়ায় পৌঁছে যায়। পাড়ার ছেলেরা প্রবীনদের মধ্যে রতন, নন্দকে জানায় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে তারা এখন কি করবে। কোন রাখঢাক না করে নন্দ আদেশ দিয়ে দিল, “বাজারকে রুখে দিতে হবে। প্রয়োজনে লড়াই হলে হবে। এটা আমাদের পাড়ার ইজ্জতের প্রশ্ন। বাইরের লোক এসে আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই পাড়ার মানুষকে মারধর করে যাবে তা হতে পারে না। হতেই পারে পরেশ একটা অন্যায় কাজ করেছে। সেজন্যে আমাদের কেউই তার এই কাজকে সমর্থন তো করি না। পরন্তু আইন মেতাবেক তার শাস্তির ব্যবস্থা করছে। তাই বলে আইন হাতে তুলে নেবার কোন অধিকার কারোর নেই। সেই জায়গায় বেপাড়া এসে এখানে মস্তানি করে যাবে তা হতে দেবো না আমরা।” নন্দর আদেশে পাড়ার যুবকরা ফুটতে থাকে। প্রয়োজনে লাঠিসোটা ব্যবহার করতে তারা কসুর করবে না। রুইদাসদের রোখের সামনে আর এগোতে পারলো না বাজারের ছেলেরা। পাড়ার সীমানায় ঢোকার অনেকটা আগেই তাদের থেমে যেতে হয়। এবার ওরা নন্দদের সঙ্গে যুক্তিতর্কের মধ্যে তর্জা সীমাবদ্ধ রাখে। নন্দরা সেটা জিইয়ে রাখে থানা থেকে পুলিশ না আসা পর্যন্ত। খুনের খবরটা পুলিশকে জানাতে থানা আর পা ঘষাঘষি না করে জিপ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে।

[ দশ ]


কি করে যে এই হাস্যকর নিয়মটা তাদের সমাজে এতদিন চালু ছিল তা রতনরা নিজেরাও তলিয়ে কোনদিন ভাবেনি। বছরের পর বছর একটা নিয়ম চালু আছে। সবাই এখনও তা মেনে চলছে। পরেশ রুইদাসের হাতে রাধাকান্ত ঋষিদাস খুন হবার পর যেন মাতব্বরদের টনক নড়ে।
কার কোথায় বর্তমান অবস্থান কেউ জানে না। নিশান উড়ছে আকাশে। এবার বিচারটা করবে কে যে, দাবিদারদের মধ্যে কে আগে দেখেছে? তবু এতদিন নিশান দেখে যে আগে ভাগাড়ে যেতে পেরেছে, অন্যরা ধরে নিয়েছে সে আগে দেখেছে বলেই না আগে যেতে পেরেছে! কিন্তু যে আগে দেখেছে বলে দাবি করে তাদের মহার্ঘটা দখল নিল, অন্যরা তলিয়ে দেখল না দখলদারের অবস্থানটা তখন ঠিক কোথায় ছিল? রাধাকান্ত খুন না হলে হয়তো এই অনিয়মটা নিয়ে এখনো কোন প্রশ্ন উঠত না।
অন্য মতের কেউ কেউ বলে, আসলে এখনকার মত এত ঘর মানুষের বাস তো এ পাড়ায় সে সময় ছিল না। ওই রতনের ঠাকুরদা, নন্দদের পূর্বপুরুষ, রাধাকান্তরা আর দিবাকরের তিন পুরুষের বাস সেই সাবেক কাল থেকে। কেউ বলে চম্পা বুড়ি বলে আরও একজন থাকতো। চম্পা বুড়ির বর কালো রুহিদাস মরে যাবার পর তার দুই ছেলে বিহারের চম্পামারিতে পাশোয়ানদের চামড়ার কারখানায় কাজে গিয়ে আর দেশে ফেরেনি। প্রথম প্রথম নাকি ছেলেদুটো মায়ের জন্যে মানি অর্ডারে কুড়ি টাকা করে মাসে পাঠাতো। তাতে বুড়ির সারা মাস টেনেটুনে চলে যেত। হঠাৎ কি হল কে জানে, আর টাকা পাঠায় না। তারা আসেও না দেশে। চোখের দেখা একবার মাকে দেখতেও এল না কেউ। মা কেমন আছে। বেঁচে না মরে আছে। পাড়ার লোক কে বা আছে যে উদ্যোগী হয়ে খরচ করে সেই সুদূর বিহারে বুড়ির ছেলেদের খোঁজ করতে যাবে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যাবার পয়সা বা কে দেবে। সবারই তো ‘ভাঁড়ে মা ভবানি।’ তা ওই কালো রুহিদাসের ছেলেদুটো আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে তা পাড়ার কেউ জানে না। শেষমেষ বুড়ি পেটের জ্বালা সামলাতে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে ফিরতে শুরু করল। তাতে যা চলছিল, চলছিল। হঠাৎ একদিন বুড়ি ভিক্ষে ফিরে হাতে কাস্তেটা নিয়ে কুমোর পাড়ার সনৎ পালের পুকুর-ডোবায় গেল কলমি শাক কাটতে। আনাজপাতি সেদিন ভিক্ষেতে জোটেনি। ওই কলমি শাক সেদ্ধ আর ভাত নুন মাখিয়ে খাবে ঠিক করে। কয়েক আঁটি শাক কাটা তখন হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা খরিস কেউটো পেছন থেকে ফোঁস ফোঁস গর্জে মারল তার কোমরে ছোবল! কেউটে ছোবল মেরেছে বুঝতে পেরে বুড়ি পেছন দিকে কোঁচড়ের কাপড় দিয়ে চেপে চিৎকার করতে করতে পাড়ায় ছুটে আসে। পাড়ার মেয়ে-মদ্দ জড়ো হয়ে যায়! প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে সাইকেল ভ্যানে পাঠিয়ে দেয় ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের অভিমুখে। বুড়ির বেঁচে থাকার ‘দানা’ আর কপালে ছিল না। ভ্যানে যেতে যেতে ঝিঙের পোলের কাছে বুড়ির সারা শরীর নীল হয়ে নিঃশ্বাস থেমে যায়। রতনের ঠাকুরদা গল্প করতো, পায়ে-টায়ে সাপ কামড়ালে ঘরোয়া চিকিৎসায় কখনো সখনো কাজ হয়। বিষরক্ত মাথায় উঠতে দেরি হয়। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে শরীরে ওষুধ পড়লে বেঁচে যায় রোগী। কিন্তু কোমরে কামড়ে সেই সময় পাওয়া যায় না! কোমর থেকে মাথার দূরত্ব আর কত যোজন হবে। ওখানে ছোবল মারলে মানুষের মরণ রোখা দায়। সেই চম্পা বুড়ি মারা যাবার পর সবাই ধরে নেয় তাদের বংশ লোপাট হয়ে গেছে। তাই ওদের আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না কেউ। ওই বিন্দে ঋষিদের বাড়ির দক্ষিণ পানে যে মাটির ঢিবি মতন জায়গাটা পড়ে আছে, ওখানে নাকি চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। অবশ্য ওই জায়গাটা এখনও দাবিদারহীন হয়ে পড়ে আছে। এখনকার কেউ বলতে পারবে না ওই পোড়ো ঝোপটা কাদের। তাই পাড়ার সবাই ধরে নেয় ওখানেই চম্পাবুড়ির বাড়ি ছিল। বুড়ির ছেলেপুলে বা নাতি-নাতনিরা কেউ যদি কোনদিন দেশে ফেরে তো তাদের জায়গা তারা ভোগ করবে। তখন ওই ক’ঘর। আর এখন তো বেড়ে বেড়ে সত্তর-ঘর নিয়ে পাড়া জমজমাট। সব যে বংশ বিস্তারে এত ভীড় তা কিন্তু নয়। কেউ শ্বশুর-সম্পত্তি পেয়ে ঘর জামাই হয়ে থেকে গেছে। কেউ বা মাতুল সম্পত্তির অধিকারি হয়েছে। ওই মিত্তুনে তো মামারবাড়ির বখরার সবটাই পেয়েছে। ওর মা, মিত্তুনের দাদুর একমাত্র মেয়ে। বুড়ো উপরে চলে যেতে ওরা মায়ে পোয়ে সেই ঝিঙ্কির হাট থেকে বাস তুলে দিয়ে এখানে চলে আসে। মিত্তুনের বাবা শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার রেল লাইনে মদের নেশায় টলমল পায়ে লাইন পার হতে গিয়ে পা ফসকে লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারহীন দেহ নিয়ে লাইন থেকে উঠে পড়ার আগেই আপ-ডায়মন্ডহারবার লোকালে কাটা পড়ে। ওই তো, রোজ খাটলে রোজ খাবার জোটে। মদের নেশা আবার সেই রোজগারে ভাগ বসায়। দেড়-শতক খোড়ো ঘরে বাস। তা সেই একমাত্র রোজগেরে লোক চলে গেলে তাদের মায়ে-বেটায় চলে কেমন করে। তবু বাপের একটা পুকুর আর চাষের বিঘে খানেক জমি রয়েছে। সেই ভরসায় ওই বাস বিকিয়ে মিত্তুনের মা ছেলের হাত ধরে বাপের বাড়ি ওঠে। তাই ভাগাড়ের চামড়া সংগ্রহ করার চাহিদাও সে সময়ের মানুষের তেমন ছিল না। অনেকে আগ্রহও দেখাতো না। যারা আগ্রহ দেখাতো, তারাই বেশি খেয়াল রাখতো এ সবের। কিন্তু এখন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সাথে সাথে চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে রোজগারের সুযোগের অভাব। ফলে আয়ের যেখানে যেটুকু সুযোগ আছে, দলবেঁধে সবাই সেদিকে হামলে পড়ছে। একটা পদক্ষেপকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। সেখান থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছে। যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর না এলেই ঝিমমেরে থাকা প্রতিবাদ তেড়েফুঁড়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। বাড়ছে রেষারেষি। যার অনিবার্য পরিণতি, কলহ বিবাদ। আর এই বিবাদ মিমাংসার জন্যে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে পাড়ার আটচালাকে।
বিশ দিন আগে আটচালার খুঁটিতে নোটিশ লটকে দেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজের ওপর কঞ্চির পেন দিয়ে আলতার লাল কালিতে লেখা হয়েছে। শিরোনামে লেখা জরুরী সভা। শেষে পাড়ার মেয়ে-মদ্দ সকলকে উপস্থিত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যে অনুপস্থিত থাকবে, পরে তার কোন কথা শোনা হবে না। সভায় যা মানতে বলা হবে তাই সব্বাইকে মাথা পেতে নিতে হবে। আলোচনার বিষয় ‘ভাগাড়ের চামড়ার বখরা।’
গমগমে আটচালা। একে একে পাড়ার প্রায় সব মানুষই জড়ো হয়ে গেছে। এখনো পাতলা হয়ে দু-একজন করে আসছে। আনুষ্ঠানিক সভা শুরু হবার আগেই রতনের ভাই, যতন মদ্যপ অবস্থায় বেসামাল জিভে চেল্লাতে শুরু করে, “ভাগাড়ের চামড়ার বখরার নতুন কোন নিয়ম আমরা মানছি না মানবো না। বছর বছর ধরে যেমন চলে আসছে তেমন চলবে। কোন শালা ভালমানুষের পো’র ক্ষমতা নেই এই চলতি নিয়ম জলাঞ্জলি দেয়। যে শালা আগে নিশান দেখবে সে শালা ভাগাড়ের অধিকারী হবে। এই শালা রতন-নন্দরা যত নষ্টের গোড়া। শালারা বুড়ো হচ্ছে। চোখের মাথা খাচ্ছে আর নিজেদের আখের গোছাতে নতুন নতুন নিয়ম বাতলাচ্ছে। ওই সব শালাদের পোঁ..ও.. !” গালাগাল পুরোটা মুখ থেকে বার করার আগেই রতন ছুটে এসে তার ভায়ের মুখে সপাটে মারে এক চড়! দাদার হাতে চড় খেয়ে যতন ভিমরি খেয়ে পড়ে যায়। মুখের সামনে খাওয়া চড়ের অভিঘাতে যতনের ঠোঁটের সাথে দাঁতের ঠোক্করে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। অন্যরা গামছা ভিজিয়ে ঠান্ডা জল ক্ষত জায়গায় চেপে ধরে। ততক্ষণে ঠোঁটটা ফুলে ঢোল। যতনের টলমল শরীরটাকে ধরে দু’জন ছোকরা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। এসেই ছোকরা দুটো হম্বিতম্বি করতে থাকে, “এইভাবে যতনকে মারা উচিৎ হয়নি রতনদার। নেশার ঘোরে ও কি বলছে না বলছে তা কি ওর খেয়াল আছে। চুল্লু পেটে নিয়ে সবাই কি নিজেকে সামলে নিতে পারে? পারে না।” এবার অনেকে মিলে ওই দুই ছোকরাকে চুপ করে যেতে বলে। ওরা যে যতনের এক গেলাশের দোস্ত তা সবাই জানে। তাই যতনের আঘাত ওদের গায়ে লাগে। কিন্তু ওরাও যদি গেলাশের দোস্তের পক্ষ নিয়ে সমানে কেচাল করে তো যতনের পরিণতি তাদেরও হবে বলে কড়কে দিতে দুটোতে চুপ মেরে যায়।
মিটিংয়ের আগে যেহেতু নিজেকে জড়িয়ে একটা আজেবাজে ঘটনা ঘটে গেল, তাই রতন আর বেশি উদ্যোগ নিয়ে সভা পরিচালনায় এগিয়ে আসলো না। মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে রইল। নন্দকে বলল, “তোমরা আজ মিটিংটা চলিয়ে নাও। আমার ভাল লাগছে না। মন ভাল নেই। মাথাও গরম। তাই আবার কোথায় কি বলে ফেলব বা করে ফেলব। তখন সবাই আমাকে দুষবে। হাজার হোক নিজের মায়ের পেটের ভাই তো। এমন মারলুম রক্তারক্তি হয়ে গেল। আমি তো এটা চাইনি। গাধাটা এমন কান্ড করতে শুরু করল, আমি নিজেকে সামলে নিতে পারলুম না। সমাজে আমারও তো একটা মান আছে।”
নন্দ আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইল না রতনকে। সে পাড়ার বয়স্ক মানুষ সুবোধ কাকাকে বলল, “কাকা, তুমি তো পাড়ার একজন মুরুব্বি মানুষ। তুমিই বলো, এই বিচ্ছিরি নিয়ম এখনো চলতে দেওয়া উচিৎ কি না। সবাই মানছে এই কালা নিয়ম চলা উচিৎ নয়। তবুও চলে আসছে। যা হবার হয়ে গেছে। যে কারণেই হোক এতদিন কেউ প্রতিবাদ করেনি। বা এখনকার মত জোট বেঁধে কিছু বলেনি। পুরোনো মানুষ হিসেবে তুমিই এর একটা উপায় বাতলে দাও। তুমি যা নিদান দেবে সেটাই আমরা মাথা পেতে নেবো।” এবার নন্দ সভায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, “কি গো বাপ-সকল মা-সকল, সুবোধ কাকা যা বিধান দেবে তোমরা সকলে মানবে তো? না কি মানবে না। যদি না মানো তো আগে থেকে বলো। যে বা যারা বলতে আসবে তাদেরই উপর দায় চাপবে সঠিক নিদান দেওয়ার।”
এই কথার পর কেউ আর ওইসব ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইল না। এমনিতেই সভার আগে একটা যাচ্ছেতাই ঘটনা ঘটে গেল। তারপর আবার কে ওই ঝামেলার মধ্যে মাথা গলাতে যাবে। কয়েক মুহূর্ত সভা একদম চুপ। আবার নন্দ বলল, “কি হল, সব চুপ কেন? কিছু তো একটা বলতে হবে। চুপচাপ থাকার জন্যে তো সবাই কাজ ফেলে এখানে আসেনি। বলতেই হবে, সুবোধ কাকার কথা আমরা মানবো কি মানবো না?” এবার আরও গলা চড়িয়ে বলল, “কি, মানবো কি মানবো না?” এবার সভা আর চুপ করে রইল না। সব্বাই একবাক্যে নন্দর কথায় সায় দিয়ে বলল, “মানবো মানবো। সুবোধ কাকা যেটা বলবে, সেটাই আমরা মানবো।”
সুবোধ কাকার বয়স হলে কি হবে। এখনও যথেষ্ঠ শক্ত ঠকঠকে বুড়ো। কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সে দ্বিধা করে না। তাই ওর ওপরে পাড়ার সবাই আস্থা রাখে। এবার শান্ত সভায় মসৃণ গলায় বলল, “আমি আর কি বলি। দিনকাল পাল্টেছে। আমার মতের সঙ্গে এ’কালের মতের মিল হবার তো কথা না। একটা কিছু বলে ফেললে তোমরাই আবার পরে আমাকে শাপ শাপান্ত করবে। বুড়ো বয়সে আর অন্যের অভিশাপ কুড়িয়ে কাজ নেই। তোমরা সব বাপ সকল, এত মানুষ আছো। তোমরাই ঠিক করে নাও গো। আমাকে ছাড়ান দাও।”
নন্দ তখন সুবোধ কাকাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, “না না কাকা, তোমাকে কেউ…!” হঠাৎ সেই কথার ফাঁকে পেছন থেকে একজন ফুট কেটে বলে উঠল, “বুড়ো ভাম এবার নিজের দর বাড়াচ্ছে রে!” সঙ্গে সঙ্গে গোটা আটচালা গুনগুনিয়ে উঠল! বুঝি সভা এবার পন্ড হতে না বসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নন্দ চেঁচিয়ে উঠল, “পেছন থেকে কে ফুট কাটলো রে? কে? কে? এই কেলে, তোদের ওদিক থেকে কথাটা ঠিকরে এলো। কে বলল কথাটা? মান্যি লোককে মান্য করতে জানিস না তো সমাজে আছিস কেন? পাড়া থেকে দূর করে দেবো বলে দিচ্ছি। কে কথাটা বলল বল?” পাড়া ছাড়ার হুঙ্কারে কেলে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি না। হেড়ো পাগলা।” সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার লাঠিটা নিয়ে হেড়ো পাগলার দিকে তেড়ে গেল নন্দ, “শালা, হারামি, পাগলামির জায়গা পাওনি না? কে ওকে এখানে ডেকেছে, রে?” নন্দর তাড়া খেয়ে পাঁই পাঁই করে সভা ছেড়ে পালায় পাগলা। ও পাগলার কথা ছাড়ান দাও কাকা। বলো, কাকা, আমরা এখন কি করবো।” সেই থেকেই সুবোধ কাকার কথা মত এই চার-পাঁচ বছর ধরে, ‘যে আগে এসে গরু ছুঁতে পারবে সেই হবে সেই গরুর চামড়ার মালিক’ নিয়মটা চালু হয়। তখনকার মত একবাক্যে সবাই তা মেনেও নেয়। আসলে মানুষ এতবছরের একটা কালা নিয়ম, ‘নিশান যে আগে দেখবে, সেই চামড়ার অধিকারি হবে’ থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিল তখন। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে এটাও একটা কালা নিয়ম। ‘জোর যার মুলুক তার’ হয়ে যাচ্ছে। জোরের দাপটে অশক্তরা ভাগাড়ের অধিকার হারাচ্ছে। এ চলতে পারে না। এ আর এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে তারা।

[ এগারো ]


কথাটা গ্রামীন জনপদের অনেক জায়গার চালু কথা যে ‘স্বামীগৃহই হল মেয়েদের জীবনের স্থায়ী পূন্যভূম।’ দশ বছর হয়ে গেল পরেশের বউ সনকাকে আটচালার বিধানে গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছে। মাঝে মাঝেই মনটা ডুকরে ওঠে, তার সেই স্বামীর লীলাভুমে একবার ঘুরে আসতে। চোখের দেখা দেখে আসতে। ঘড়বাড়ি তো এতদিনে ঝোপজঙ্গলে টৈটুম্বুর। ভেতরে ঢোকার উপায় থাকবে না। তবু বাইরে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে থেকে অশান্ত মনকে একটু বোধ দেওয়া যায়। তার প্রিয় শ্বশুরালয়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঘ্রাণ নিলে মনটা যেন তৃপ্ত হয়। আবার কোথা থেকে যেন অভিমানি মন শক্ত হয়ে রুখে দেয় তার সেই দুর্বল চিত্তকে। না, যে পাড়া স্বামীছিন্ন এক অসহায় যুবতী নারীকে শিশু সন্তান সমেত গ্রামছাড়া করে, সে পাড়ায় সে আর ঢুকবে না। আবার ভাবে, লোচনের বাপের জন্মভিটে ওটা। ওর বাপ যদি কোনদিন জেল থেকে ছাড়া পায় তো সে প্রথমেই তার ভিটেতেই উঠবে। সে মেয়েমানুষ। ভিন গোত্রের মেয়ে। ওই ভিটের ওপর তার হয়তো নাড়িছেঁড়া টান নেই ঠিকই। কিন্তু আজন্ম যে মানুষটা একটা জায়গায় কাটালো, সে তো কিছুতেই তা ভুলতে পারবে না। আর স্বামী এলে বউকে তো আসতেই হবে। স্বামী-সংসারেই তো মেয়েদের জীবনের সার্থকতা। স্বামীর ঘর না পেলে মেয়েমানুষের জনমই বৃথা। সেদিক থেকে সনকার কপাল যে মন্দ নয় তা বলা যায়। স্বামী-সংসারেও তো তার কোন বিরাগ ছিল না। অভাব অনটনের মধ্যেও দিন চলছিল। স্বামী তার কোনদিন বারমুখো ছিল না। সনকার দিন তাই নিশ্চিন্তেই কাটছিল। কি একটা আচমকা ভুলচুক করে ফেলল লোচনের বাপ। সে ভুলের আর মাপ হল না। থানা-পুলিশের সাথে সাথে পাড়ার মাতব্বরাও মেতে উঠল ওই ভাল মানুষটাকে গারদে পুরতে। সেইসঙ্গে তাদের মায়ে-বেটারও শাস্তির বিধান দিয়ে বসল। এত বেয়াড়া মনের মানুষ এরা কেন তা কে জানে।
তাদের রুইদাস পাড়ার মানুষ এক রকম আর এই শহরের জীবনযাত্রা আর এক রকম। কোলকাতার সল্টলেকের সমাজ ব্যবস্থা আর তাদের গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থার যেন কোন দিক থেকে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে কেউ কারোর তেমনভাবে খোঁজ খবর রাখে না। একই বাড়িতে, পাশের দরজার ফ্ল্যাটের লোক একে অপরকে চেনে না জানে না। চেষ্টাই করে না কেউ। যে যার মত ব্যস্ততায় দিন কাটায়। হয়তো কোন সময় মুখোমুখি হয়ে পড়লে দেঁতো হাসি হেসে ঘাড় কাত করে মনুষ্যেতর জীব যে তারা নয় তার নজির রাখার চেষ্টা করে। সনকাদের গ্রামীণ রক্ষণশীল জীবন থেকে এই জীবন হয়তো মনে হবে এক খোলা হাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে দিন কাটার জীবন। সেই দিক থেকে সংস্কারমুক্ত এক স্বাধীন জীবন সে যেন খুঁজে পেয়েছে বলতে পারে। সেই স্বাধীনতার পাদানিতে পা দিয়েই তো সে এখন আর গ্রামের ঘোমটাটানা পরেশ রুইদাসের লাজুক বউ নেই। চটপটে বেপরোয়া যেমন খুশি সাজো, যেমন খুশি চলো’র সনকাদি বনে গিয়ে শহুরে আর্দ্রতায় সিক্ত হয়ে রসেবসে দিন কাটাচ্ছে।
আটচালা যখন তাকে গ্রামছাড়ার নিদান শত আকুতি মিনতিতেও ফিরিয়ে নিল না তখন সনকা বুঝেই গেছিল ওখানে তার আর বাস করাই যাবে না। গ্রাম তাকে ছাড়তেই হবে। তা এখন সে একা মেয়েমানুষ বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যাবে! দিশাহারা চোখ তখন হঠাৎ আটকে গেল পোদপাড়ার বাদলের চোখে। তার চোখে ঠেকনা রেখে চোখ ফেলল বাদলের বন্ধু দুলাল রুইদাসের চোখে। ওরা দু’জনেই লোচনের বাবার এক পেয়ালার বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে তাদের বাড়ি আসতে আসতেই অজান্তে কখন যেন দুলাল রুইদাসকে তার মনের এক কোণে ঠাঁই দিয়ে ফেলে। আর দুলালও মনে হয় তার মনের ভেতরের রসায়ন ধরে ফেলেছিল। সনকা ধরা পড়ে গেছিল দুলালের কাছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে লোচনের বাপের চোখের আড়ালে তার বুকে হাতও দিয়েছে। প্রতিবাদ করতে পারেনি সনকা। সাবধানে তার হাতটা চেপে লাজুক চোখে সরিয়েও দিয়েছে। সেই হাতধরাধরি তখনও ভুলতে পারেনি দুলাল। ওর বাপ জেলে যাবার পরও তার খোঁজ নিয়ে গেছে সে। ফিরে যাবার সময় বলে গেছিল, “কোন দরকার হলে আমাকে খবর দিও। আমার সাধ্যমত আমি তোমার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করব। আমাকে জানাতে কোন কিন্তু কিন্তু করবে না। আমার মনের মণিকোঠায় সবসময় তুমি জ্বলজ্বল করছো।”
তাদের সংসারে এই প্রবল ঝড়ঝাপটার মধ্যে দুলালকে নিয়ে তার পরকীয়া প্রেমের ঢেউ কখন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সত্যিই তো, সংসারে যখন অভাব এসে বাসা বাঁধে। যুবতী নারীর সতীত্ব যখন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায় তখন এইসব পরকীয়া-টরকীয়া কোথায় যেন বাষ্প হয়ে উবে যায়। জীবন থেকে সনকা সেটা মর্মে মর্মে ঠাওর করতে পারছে। নিজের জীবনের এই দুই প্রবল ধাক্কা থেকে উদ্ধার পাওয়াই এখন তার প্রধান কাজ। মন তাই হাতড়াতে হাতড়াতে বাদলের হাত ধরে দুলালের মুখটা ভেসে উঠল তার সামনে। সুতোর মত সেই হাল্কা টানের খুঁট ধরে বাদলের মারফত খবর দিয়েছিল দুলালদাকে, “আমাকে তুমি বাঁচাও দুলালদা। ধু ধু জলাশয়ে আমি এখন হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি আমার পাশে না দাঁড়ালে এই শিশুটাকে নিয়ে আমার সলিল সমাধির ভবিতব্য কেউ রুখতে পারবে না। এরা, মানে আমাদের এই রুইদাস পাড়ার আটচালা নিদান দিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। যে অন্যায় করেছে তার তো জেল জরিমানা হয়েছে। অন্যায়ের শাস্তি সে পেয়েছে। তা আমি কি অন্যায় করলাম। আমার এই দু’বছরের শিশুটা কাকে খুন করল, যে তাকে গ্রাম ছাড়তে হবে? কত আকুতি জানালাম। কোন কাজ হল না। পাড়া আমাকে ছাড়তেই হবে। এখন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কি খাবো? গ্রামের এই মানুষগুলো কেমন মানুষ? এদের হৃদয় বলে কি কিচ্ছু নেই! আমরা গ্রামে থাকলে নাকি আমাদের খুনে বাড়ির ছোঁয়ায় পাড়ার অন্য লোকের মানুষ খুন করার প্রবৃত্তি জেগে উঠবে। তাই আমরা পাড়ার শত্রু। প্রথম রাতেই বেড়াল মারার মত প্রথম চটকাতেই শত্রু-বীজ নিকেশ করা দরকার। তাই মাতব্বরদের এই বিধান। তুমি একবার বলেছিলে না দুলালদা, বিপদে পড়লে আমাকে খবর দিও? তাই তোমার কথা প্রথমেই আমার মনে পড়ল। আমার একটা হিল্লে তুমি করে দাও দাদা। কথা দিচ্ছি, তোমার উপকার আমি ভুলে যাবো না। আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। সময়মত সেই ঋণ আমি শোধ করব।”
পরেশের বোয়ের শেষ কথাটায় কয়েকবার যেন পায়ের রক্ত মাথায় আর মাথার রক্ত পায়ে চলকে চলকে ওঠা-নামা করে গেল দুলালের। স্বামী-ছাড়া পরেশের বউ, সনকার গায়ে জড়ানো পোষাক ভেদ করে সে যেন তার শরীরের উত্তুঙ্গ যৌবন পরখ করে নিল একবার। সঙ্গে সঙ্গে চনমনিয়ে উঠল তার মনের ভেতরটা! বাইরে পরেশের বোয়ের এই শাস্তির বিরুদ্ধে সে গলা তাড়লেও মনে মনে খুশিই হয়েছে সে। গ্রাম থেকে একবার মেয়েটাকে বার করে আনতে পারলে সে তো তারই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তখন ভালবাসা দিয়ে তাকে যেমন খুশি তেমনভাবে পেতে পারবে। পরকীয়া প্রেমের কারণে তাদের পাড়ার আটচালার কোপে আর তাকে পড়তে হবে না। বড্ড কট্টর এখানকার রুইদাসরা। সনকাকে আশ্বাস দিয়ে সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ল দুলাল। যাবার সময় বলে গেল, “শুনছো লোচনের মা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে তোমার একটা হিল্লে করতে পারি তার ব্যবস্থা করছি। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার হাতে তো তিনমাস সময় আছে। অতদিন সময় আমি নেব না। দেখো না, খুব শিগ্গিরই তুমি পাড়ার মুখে নুড়ো জ্বেলে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে আসতে পারবে। সে ক্ষমতা যে এই দুলাল মুচির আছে তা সে দেখিয়ে দিয়ে তবে থামবে। রুইদাস পাড়া ভাবছে পরেশকে যেমন শাস্তি পেতে হচ্ছে তেমনই তার বউকেও শাস্তি দিয়ে বগল বাজাবে। তুমি জেনে রাখো সনকা, সে গুড়ে বালি। তুমি দেখে নেবে, পাড়া ছাড়ার সময় তোমার পায়ের ধুলোবালি ওদের চোখে ঠিকরে পড়ে চোখ করকর করে অঝোর ধারায় জল পড়বে। তখন বুঝবে কি ভুল ওরা করেছে।”
মাসে একবার সনকার সঙ্গে দেখা করতে যায় দুলাল। সল্টলেকের যে বাড়িতে সনকাকে কাজে লাগিয়েছে, সেই বাবুর সঙ্গে দুলালের কথা হয়েছে। বাবু বলেছে, “দুলালবাবু আপনি মাসে মাসে এসে দেখে যাবেন আপনার বোন কেমন আছে। আমরা তাকে কষ্টে রেখেছি না ভালভাবে আছে। একবার তো আসবেনই, মনে হলে অন্য কোন দিনও ঘুরে যেতে পারেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই তাতে। বোনকে নিয়ে একটু শহরটা ঘুরিয়ে দেখালেন। মার্কেটে নিয়ে গেলেন। এতে সনকার মনটাও ভাল থাকবে। কাজের চাপে আমাদের বাড়ির কারোর তো সে সময় হয়ে ওঠে না। সনকার মন ভাল থাকলে কাজেও সহজে মন বসাতে পারে। তাতে আখেরে আমাদেরই লাভ।”
বাবুর কথায় দুলালেরও মনটা উতলা হয়ে ওঠে। বাবুর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে সে। এবার সনকাকে মাসে এক বা দু’দিন নিজের মত কাছে পেতে আর কোন অসুবিধা হবে না। মনের ইচ্ছে মত সে তাকে তার ভালবাসা উজাড় করে দিতে পারবে। তাছাড়া শুধু তারই বা কেন, সনকারও তো যৌবন বলে কিছু আছে। তার ডগমগে ভরভরন্ত শরীরের চাহিদা দুলালকে উজাড় করার ইচ্ছে সে আকারে ইঙ্গিতে কতবার প্রকাশ করেছে। সুযোগের খোঁজে ছিল। এতদিনে খোঁজ মিলেছে।
নিক্কো পার্কের পাশেই চন্দনবাবুদের মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর অফিস। দীর্ঘ সময় কাজের পর একঘেয়েমী কাটাবার জন্যে চন্দনবাবুরা কিছুক্ষণের জন্যে নিক্কো পার্কের ভেতর কাছাকাছি এদিক ওদিক ঘুরে আসে। সেই ফাঁকে দুপুরের টিফিনটাও সেরে নেয়। ওদের দলে মেয়ে কলিগেরই আধিক্য। চন্দনবাবু সব্বাইয়ের পছন্দের মানুষ। যেমন রসিক তেমন সপ্রতিভ। চন্দনবাবুও মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে এবং স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ওরা, বিশেষ করে শীতকালটা এদিকে আসে বেশি। শীতে রোদের উষ্ণতার সঙ্গে নারীসঙ্গের ওমের যৌথ মিলনে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি সে খুঁজে পায়। এ সুখ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই নিয়ে অন্য পুরুষ কলিগরা তাকে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। কিন্তু তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে তো জোর করে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে যাচ্ছে না। মেয়েরা তার সঙ্গ পেয়ে খুশি হয়। তাই তারা তাকে সঙ্গে নেয়। সে এই সঙ্গ পেতে পছন্দও করে। নারীর পেলব সঙ্গ কোন্ পুরুষ আর অপছন্দ করে। কিন্তু পছন্দ করলেই তো হবে না। তাদের কাছে আকর্ষনীয় হবার যোগ্যতা থাকা দরকার। সেটা আবার সব পুরুষের মধ্যে থাকে না। তাই তারা চন্দনকে দেখে আফসোস করে।
প্রায় প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে দুলাল আসে তাদের বাড়ি। সনকার খোঁজ খবর নেয় আর সনকার সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে খানিকক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে ছোট্ট লোচনকে ঘুম পাড়িয়ে দুজনেই বেরিয়ে যায়। সময়টা ঠিক দুপুর বেলা। বাড়ির সব কাজটাজ সেরে বাড়ির মানুষরা যখন বিশ্রামে যায়, তখন। আর দুলাল কোনসময় ছুটির দিন, মানে শনিবার বা রবিবার আসে না। কাজের দিন এবং দেখা গেছে সোমবার বা মঙ্গলবার। রূপসা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। চন্দন তো আর ওই সময় বাড়ি থাকে না। তাই তার এসব চাক্ষুশ করার সুযোগও নেই। রূপসাই স্বামীর কানে সনকার ব্যাপারটা তুলেছে। রূপসা বলছিল, “ওই দুলাল বলে লোকটা, যে সনকার দাদা বলে পরিচয় দিয়েছে। ওই লোকটা বাড়িতে আসলেই সনকার চোখ মুখের ভাষা, চলনবলন কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। যেটা সত্যিকারের নিজের ভাইবোন হলে হবার কথা না। বেশ কয়েকদিন ধরে আমি সেটা লক্ষ্য করছি। তোমাকে বলিনি। এখন প্রায় নিশ্চিত যে ওদের মধ্যে অন্যরকম কোন নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে। দুলাল আসলেই সনকা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কোনো কাজ যদি বাকি থেকে যায় তা সেরেসুরে নেবার। তারপর বেরোবার জন্যে সাজগোজের যা বাহার, আমরাও অতটা দেখাতে পারি না। যাকগে। ওটা ওর নিজের ব্যাপার। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের নাক গলিয়ে কাজ নেই। যে জন্যে আমাদের বাড়ি ওর আসা, সেই কাজগুলো সময়মত এবং ঠিকঠাক পেলেই হল। না হলে অত টাকা দিয়ে আমরা ওকে সর্বক্ষণের কাজের লোক হিসেবে রাখব কেন। থাকা খাওয়া নিয়ে দশ দশটি হাজার টাকা। কম কথা নয়। ওদের কাছে তো এই টাকা পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়া। আমি শুধু তোমাকে ব্যাপারটা শুনিয়ে রাখলাম। বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তা বাড়ির মালিককে সময়মত জানিয়ে রাখা দরকার। যদি কখনো কোন ঘটন-অঘটন ঘটে যায়?” তখন কি হবে?”

ক্রমশ…. 

Loading

Leave A Comment