কবিতার পারিপার্শ্বিক, বীজতলা ও তুমি
– সুনির্মল বসু
কত সহজেই কবিতা তুমি কোনো কোনো দিন আমার কাছে সহজ ভাবে ধরা দাও,
কত কত দিন তোমার কাছে মাথা খুঁড়েও তোমার দেখা পাই না,
তখন আমি নদীর কাছে যাই, সবুজ বনানীর মধ্যে হাঁটি, এভাবেই কত সকাল বিকেল হয়ে যায় যে মাটি,
মাঝে মাঝে বড় একা লাগে,
মাঝে মাঝে মনে হয় মাঠের শেষে কত দিন ঠাঁয় তাল গাছের মতো একলা দাঁড়িয়ে আছি,
বাবা মা কবেই চলে গেছেন, অশৌচ পালন করেছি,
দিনগুলো পেরিয়ে গেল,
অশৌচ আজও প্রতিদিন,
বুকের মধ্যকার শূন্যতা শোক ভুলতে দেয় না,
তাই আমি পেছনে হাঁটি,
ভালোবাসা খুঁজি, অন্যের বাবা-মায়ের মাঝে,
শৈশব কেটেছে মাটির ঘরে,
বাঁশ বাগান, কাঠবাদাম গাছের মাথায় আজও আমার স্মৃতিতে বসে আছে ঢাউস একটা চিল,
ঠান্ডা পুকুর, রাস্তার পাশে বসবার মাচা,
সর্ষে খেতে পাখি ধরতে যাওয়া,
মাঠ থেকে শালিক পাখি ধরে আনা,
জামরুল গাছের নিচে জ্যোৎসনার রাতে লুকোচুরি খেলা, কীসব মুগ্ধকর দিন,
কবিতা আমার কাছে সহজ ভাবে ধরা না দিলে,
জ্যোৎস্নার রাতে আমি আজও পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়াই, মাটির ঘরটিকে ছুঁয়ে দেখি,
জনান্তিকে কেউ বলে, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন,
মনে মনে বলি, আমি ভালোবাসা খুঁজছি,
কেন,
এখানে কেটেছে আমার অভাবের দিন, তাই,
এই মাটিতে ভালোবাসা প্রোথিত, কিভাবে,
এই ধানক্ষেতে ছুটে গেছি কত অসংখ্য বার, মাটির প্রাণ,
উহু , ভালোবাসার টান, তাই নাকি,
শারদ দিনে এখানে বাজতো মহালয়ার সুর,
আর, মোড়ল কাকু এই পথ ধরে মাঠ থেকে মান কচু তুলে আনতেন,
সব মনে আছে আপনার,
আছে, আছে, সব মনে আছে,
কেমন করে,
আমার বীজতলা,
কত সহজেই কবিতা তুমি কোনো কোনো দিন আমার কাছে সহজ ভাবে ধরা দাও,
কত কত দিন তোমার কাছে মাথা খুঁড়েও তোমার দেখা পাই না,
তখন আমি কুয়োতলা পেরিয়ে দোলনচাঁপার বাগান ছাড়িয়ে
তারার আলোর মালা পরা রাতে মাধবী বনের পাশে এসে দাঁড়াই,
তখন সুস্মিতা তোমাকে মনে পড়ে,
তোমাকে খুব মনে পড়ে,
বিকেলের আলো হয়ে শেষ বিকেলের আলোয়
সবুজ বন পেরিয়ে তুমি হেঁটে আসতে,
বিলের জলে তখন পদ্মশালুক, শীতের সন্ধ্যায়
এক ঝাঁক পাখির ঘরে ফেরার পালা,
অথচ, আমাদের তখন নিজস্ব ঘর নেই,
ঘরবাড়ি না থাকলে, মানুষেরা হাহাকার,
ভাঙাচোরা সংসার দারিদ্র নিয়ে ঠাট্টা করে,
পাখি ওড়া সেই সব দিন, অভাবের পাশাপাশি
ভালোবাসার ভরা সংসার দেখেছি,
অন্ধকার সেই জীবনে তুমি এলে, রাতের জোছনা হয়ে,
আমার দিনরাত্রি বদলে গেল,
আমি তোমাকে ভালোবাসতাম,
তুমি আমাকে ভালবাসতে কিনা, কোনোদিন সে কথা জানা হয়নি,
তোমাকে ভালোবাসলাম, সেই থেকে কবিতা আমার কাছে এলো,
আমার আকাশ বাতাস বদলে গেল, চারপাশের পৃথিবীর সব মানুষকে উপন্যাসের চরিত্র মনে হতো,
মানুষকে নিয়ে আমি কবিতা লিখেছি, পাশাপাশি এসেছে প্রকৃতি, দুর্গা ঠাকুরের পেছনে যেমন চালচিত্র থাকে,
কবিতা না থাকলে, আমার নিজস্ব একটা পৃথিবী থাকতো না, আমার নিভৃত মনের আকাশ জুড়ে থাকে কবিতায়,
মরতে মরতে প্রতিদিন আমি কবিতার তীরভূমিতে এসে সংসারের উত্তাল ঢেউ কাটিয়ে উঠি,
শিরীষ বন, গাব গাছের জঙ্গল, সর্ষে ক্ষেতের শেষ সীমানা পর্যন্ত শঙ্খচিল পাখির ডানার সঙ্গে আমার কবিতা যায়,
পাহাড়ে সমুদ্রে নগরে বন্দরে, শহরের প্রকাশ্য রাজপথে, উড়ালপুলের মাথায় নিওন আলোর নিচে
আমি কবিতা খুঁজে যাই,
শুধু কি কবিতাকেই খুঁজি, নাকি কবিতার মধ্যে
সুস্মিতা, তোমাকে,
একদিন আমাকে একলা ফেলে তুমি চলে গেলে
ঘর কন্যা করতে,
আমি আজও তোমার কথা ভাবি,
না পাওয়ার বেদনাগুলো আজ আর আমাকে কাঁদায় না,
ঝরা বকুল ফুলের গন্ধ নিয়ে আজও নিজের মতো করে আমার একলা পৃথিবীতে বেঁচে আছি,
গাছপালা রোদ্দুর, শিশুর পবিত্র মুখ, ভালোবাসার মানুষদের সংলাপ, আজও আমাকে বাঁচায়,
কত সহজেই কবিতা কোনো কোনো দিন তুমি আমার কাছে ধরা দাও, কত কত দিন হাজারবার মাথা খুঁড়লেও, তোমার দেখা পাই না,
তখন আমার ভালবাসার মাটির বাড়ি, আমার প্রিয় মানুষেরা, এমন কি সুস্মিতা, তোমার টানা টানা চোখ, আমাকে কবিতা লেখায়,
আমার ভেতরে ভালবাসার পৃথিবীটা জেগে ওঠে,
সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে বীজ তলা সমৃদ্ধ হয়,
বিশ্বাস করো ,আমি তখন কবিতায় কবিতায় ভুবন ভরিয়ে দিতে পারি,
আমার মধ্যে তখন অজস্র না বলা কথা প্রকাশের অপেক্ষায় বাঙময় হয়ে ওঠে,
আমার বলতে ইচ্ছে করে, শৃন্যনতু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা।