(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[বারো]
নানান টানাপোড়েনের দীর্ঘ সময়ের পর রুইদাস পাড়ায় স্থায়ীভাবে নিয়মটা চালু হয়। তাতে অন্তত এই ভাগাড়ের গরু বা মরা ছাগল পড়লে তার চামড়া সংগ্রহের পর ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে অশান্তি হয় তা বন্ধ করা সম্ভব হবে। যে আগে আসুক বা পরে, যতক্ষণ পশুর শরীর থেকে চামড়া পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা না যাচ্ছে ততক্ষণে তাদের সম্প্রদায়ের যে এসে পশুকে ছুঁতে পারবে, সেও সমান অংশে চামড়ার ভাগীদার হবে। মায় নিজের গামছার এক খুঁট নিজের কাছে ধরে অন্য দিকের খুঁটটা যদি পশুর শরীর থেকে চামড়া বিচ্ছিন্ন হবার আগে ঠেকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও সে ভাগ পাবে। এখন রতনদের মত বয়স্করা যেমন খুশি, তেমন অল্পবয়সীরাও। সবাই মিলেমিশে ভাগবাঁটোয়ারা করে বেঁচেবর্তে থাকার একটা ব্যবস্থা আর কি। কিন্তু কালের গতির সঙ্গে তাল দিতে দিতে একটা ব্যাপার রতনরা টের পায়, কোন ব্যবস্থাই যেন চিরস্থায়ী এবং চিরসন্তুষ্টির ব্যবস্থা নয়। আটচালা কমিটির টাকাপয়সার দায়দায়িত্ব হাতে আসার পর রতন দেখছে দিনকে দিন কমিটির ভাঁড়ার কমতে শুরু করেছে। এক সময় যে ভাঁড়ার সবসময় টৈটুম্বুর হয়ে থাকত এখন সে তার কৌলীন্য হারাচ্ছে। কমিটির আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। একদিন কমিটির কর্তাদের নিয়ে এই পয়সাকড়ির ব্যাপারে আলোচনায় বসে ওরা। তাতে দেখা যাচ্ছে ভাগাড় থেকে যে হারে আয় আসতো তা ভীষণভাবে কমে আসছে। ভাগাড়ের পাওনা চামড়ার ভাগ ঠিকভাবে আটচালাকে লোকে দিচ্ছে না।
তাদের বয়ারিয়ার রুইদাস পাড়ার এলাকার মধ্যে পড়ে ফলতা থানার যাবতীয় ভাগাড়। শুধু ফলতা থানা কেন, কাছাকাছি যেসব থানায় তাদের মুচি সম্প্রদায় নেই, সেইসব থানার ভাগাড়ও অন্য এলাকার মুচিদের আলোচনা সাপেক্ষে তাদের আওতায় পড়বে। সব ভাগাড়ই আবার দুইভাগে ভাগ করা আছে। একভাগ নির্দিষ্ট করা আছে আটচালা কমিটির জন্যে, অন্যভাগ পাড়ার সকল বাসিন্দাদের জন্যে। কমিটির ভাগের ভাগাড়ে কোন পশু পড়লে সেই পশুর পঁচাত্তর শতাংশ চামড়া কমিটি পাবে। বাকি পঁচিশ শতাংশ পাবে যারা ওই চামড়া সংগ্রহ করতে আসবে। যে ক’জন চামড়া পাবার অধিকারী হবে তারা ওই পঁচিশ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করে নেবে। পঁচাত্তর শতাংশর এক চিমটে চামড়ার তারা ভাগ পাবে না। সবটাই যাবে কমিটির তহবিলে।
ওদের পাড়ার কাছাকাছি বলতে দৌলতপুর মৌজা আর আলমবিবি মৌজার ভাগাড় সাধারণ রুইদাস বাসিন্দাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা আছে। এই দুটো মৌজার ভাগাড়ে বিশাল এলাকার মানুষ আসে তাদের মৃত পোষ্য ফেলতে।
ফলে এখানে অন্য ভাগাড় অপেক্ষা অনেক বেশি মৃত পশু ফেলা হয়। বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে এর সুবিধা নিতে পারে তার জন্যে এই ব্যবস্থা অনেক আগে থেকে নির্দিষ্ট করা আছে। এছাড়া আর যে ছোট-মাঝারি তিন-চারটে ভাগাড় আছে, যেমন মনষার হাট বা ফতেপুর অথবা কোদালিয়া এইসবকটাই কমিটির জন্যে ঠিক করা আছে। তা সারা বছরে এইসব ছোট ভাগাড়ে যা অল্পবিস্তর পশু পড়ে তাতে কমিটির আয় পুষিয়ে যায়। এতদিন তাই হত। কিন্তু ইদানিং বছর দুই-তিন হবে সেই আয় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। রতনের আগে যারা দায়িত্বে ছিল, তারা কেউই আয়ের এই মন্থর গতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এটা তাদের দেখা উচিৎ ছিল। দেখা উচিৎ ছিল এর কারণটা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।
কমিটির কর্তাদের সেই মিটিংয়ে এটাও ঠিক হয় যে তদন্ত করে দেখতে হবে এই আয় কমে যাবার সঠিক কারণ এবং কে বা কাদের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। রতন আর নন্দকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এটা তদন্ত করার জন্যে। কারণ ওরা নিজেরা এখন আর কোন ভাগাড়ে যায় না চামড়া সংগ্রহের জন্যে। বয়সের কারণে ওরা আগের মত দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। আয়ুক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরীরের শক্তিক্ষয়ও হয়ে চলেছে। তাই এই পেশা থেকে ওরা সরে এসেছে। যেহেতু চামড়া সংগ্রহের প্রতি ওদের কোন আগ্রহ নেই তাই ওরাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারবে।
তদন্তে নেমে নন্দ-রতনের তো চক্ষু চড়কগাছ! এ যে সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে। গোপনে গোপনে ওরা মনষার হাট বা ফতেপুর-কোদালিয়ার মানুষদের সঙ্গে একান্তভাবে কথা বলেছে। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে নিয়মিত গরু-ছাগল পোষা হয়। গরুর দুধ এবং ছাগলের দুধ বা মাংস বিক্রি করেই যাদের সংসার চলে। এইসব মানুষের জীবন ওই গরু-ছাগলের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। এরা তাদের পোষ্যদের নিজের পরিবারের একজন করে নিয়ে বসবাস করে। ফলে এই মানুষগুলো কোনদিন ভাবে না যে তাদের পোষ্যরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে আর তাদের সংসারের জন্যে আয় দিতে পারবে না তখন কোন ব্যাপারিকে শুধুমাত্র অন্যের মাংস খাবার ‘আয়ের’ হিসেবে বিক্রি করে দেবে। বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে। এরা একবাক্যে গরুকে মা ভগবতী জ্ঞানে দেখে। তাই এদের বাড়ির পশু মারা গেলে ভাগাড়ে তো ফেলবেই। কোদালিয়ার এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নন্দ-রতন। রতনের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই চেনা-জানা। ওই পাড়ায় পাড়ায় ধামা-কুনকে সারাবার জন্যে ফেরি করতে দিনের পর দিন আসতে আসতে জানাশোনা হয়ে গেছে। কথায় কথায় রতনরা তাদের বাড়ির গরুর কথা তুলতে তুলসীদাস বাবু বলল, “এই তো এগারোদিন হল আমাদের বড় গাভীটা মারা গেল। ক’দিন ভ’র সে শয্যা নিয়েছিল। তা তোমাদের এক মুচি, নামটা ঠিক জানা নেই, তবে মুখচেনা, পাড়ায় বেত নিয়ে ফেরি করতে করতে দেখতে পেয়েছে আমাদের গরুটা অসুস্থ। সেই যে দেখতে পেল, তারপর প্রতিদিন এসে একবার করে ঢোঁ মেরে যেতো আমাদের গোয়ালঘরে। ও মনে হয় বুঝতে পেরেছিল যেকোন দিন গরুটা মরে যাবে। সরাসরি এসে আমাকে বলল, ‘বাবু, আপনার গরুটা মারা গেলে আপনাদের কোদালের ভাগাড়ে ফেলে দেবেন না। আমরা লোক পাঠিয়ে দেব। ওরা ওটা দৌলতপুরের ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবে। রোজই ভোরবেলা আমরা জনাচারেক লোক আসবো। দেখে যাব। মরে গেলে ওই ভোরেই আমাদের লোক এটাকে নিয়ে চলে যাবে।’ তা আমরা তো তোমাদের রুইদাসদের ভেতরে এই গরু, ভাগাড় নিয়ে কি সব আইনকানুন আছে জানি না। আমাদের পরিবারের প্রিয় এক পোষ্য মারা যাচ্ছে, তাতেই বাড়িময় শোকের আবহ। তার মধ্যে মারা গেলে তাকে কে কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে আমাদের অত মাথা ঘামাবার ফুরসৎ নেই। তুমি, রতন এখন এই কথা তুললে, তাই বললাম আরকি। তা এসব নিয়ে তোমাদের নিজেদের মধ্যে পাড়ায় কোন ঝামেলা টামেলা হচ্ছে নাকি? আমাদের কাছে তো কোদালের ভাগাড় আর দৌলতপুরের ভাগাড় সব সমান। সেইজন্যে ওসব নিয়ে আমাদের মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। প্রশ্ন করে আমাদের কোন কাজও নেই। ও তোমাদের রুইদাসদের ব্যাপার, তোমরা নিজেরা জেনেবুঝে নাওগে। আমাদের এর মধ্যে জড়িও না।”
রতনদের বুঝতে কষ্ট হল না যে এখনকার পড়শি ছেলেপুলেরা কতটা স্বার্থপর হয়ে পড়েছে। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কতটা নিরাপদ থাকে সেদিকে তাদের আসল লক্ষ্য। তাতে সমষ্টির উন্নতির ভাবনা চুলোয় যাক। কমিটির ভাগাড়ে ফেললে তো ছিটেফোঁটা চামড়া ভাগ পাবে। তাই ওখানে যাতে না পড়ে তার জন্যে কত আগে থেকে এরা সতর্ক থাকে! ভেবে তাজ্জব রতনরা! আরে বাব্বা, আটচালা-কমিটি বেঁচে না থাকলে তোদের সমাজ এক লহমায় কোথায় ওলটপালট হয়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়বে সে খেয়াল তোরা রেখেছিস? থাকবে তোদের গর্ব করার মত এই সামাজিক কৌলীন্য? থাকবে না। এই সমাজ ব্যাভিচারে, অনাচারে ভরে যাবে। বর্ণশঙ্করে পরিণত হবে তোদের রুইদাসরা। তখন তোরা আর বুক বাজিয়ে বলতে পারবি না আমরা রুইদাস, ঋষিদাস, রুহিদাস বা ঋষি-মুচি সম্প্রদায়ের মানুষ। পোদে কৈবর্ত্যে মিলেমিশে তোদের জাতটা ঘেঁটে একেবারে ‘ঘ’ হয়ে যেতে তাহলে আর বেশি সময় নেবে না রে ব্যাটাচ্ছেলেরা!
এক ভাগাড়ের গরু চালাকি করে অন্য ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে আখের গোছানোর মত জঘন্য অপরাধ যে বা যারা করেছে বা করছে তাদের ছেড়ে কথা বলা হবে না। ক্ষিপ্ত রতন-নন্দদের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। অপরাধীদের খুঁজে বার করে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যে জীবনে আর কেউ এই নোংরা কাজ করতে গেলে দু’বার ভাববে। যে ভাগাড় এলাকার গরু মরেছে তার গতি তো সেই ভাগাড়ে হবে। চিরকাল তারা এটা দেখে এসেছে এবং তার মান্যতা দিয়েছে। এমনিতেই কমিটির বরাদ্দে যে ভাগাড়গুলো আছে সেখানে গরু সাধারণের জন্যে নির্দিষ্ট ভাগাড়গুলো থেকে অনেক কমই পড়ে। তা সেখানেও শয়তানদের নজর গিয়ে পড়েছে! এর থেকে দুঃখজনক অবস্থা আর কি বা হতে পারে।
এইসব নিয়ে ফাঁকা আটচালার সিঁড়িতে বসে নন্দ, রতন আলোচনা করছে। এমন সময় সুবোধ কাকা তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হন্তদন্ত হয়ে রতন কোমর থেকে পিঠটা উঁচিয়ে ডাক দিল, “কাকা, এদিকে একটু আসো না। তোমার কাছ থেকে একটু পরামর্শ নিই। এখন আমাদের কি করার তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। বড়ই অনাচার হয়ে চলেছে আমাদের পাড়ায়। একটা কিছু কড়া সিদ্ধান্তে আমাদের আসতেই হবে। নাহলে সমাজটাকে আর ধরে রাখা যাবে না। তোমরাই তখন বলতে থাকবে, আমাদের সময় তো এমনটা হতো না। তোমরা, রতনরা পাড়ার মাতব্বরির ভার নেবার পর থেকে মানুষগুলো এমন বেলাগাম হয়ে পড়েছে। আমাদের ব্যর্থতাই তখন তোমরা আঙুল তুলে দেখাবার চেষ্টা করবে। তাতে অবশ্য তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। যা হচ্ছে সেটাই তোমরা বলবে। কিন্তু কাকা, সময় থাকতে আমাদের লাটাই গোটাতেই হবে। তুমি এসো কাকা, আমাদের কাছে একটু বসো। একটু আলোচনা সেরে নিই। কোথায় যাচ্ছিলে কাকা, তুমি? কোন দরকারে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিলে? না এমনি এমনি পা ছাড়াচ্ছিলে? তাই যদি হয় তাহলে একটুকুন বসো কাকা।”
রতনদের কাছে সব শুনে চোখ বড় বড় করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুবোধ কাকা। তারপর কাকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁরে রতন এও সম্ভব? আমরা মুচিরা গরিব হতে পারি। খিদে ভুলতে চুল্লু, দেশি মদ গলায় ঢালতে পারি। এইসব ছাইপাঁস গিলে নিজেদের পিলে জ্বালিয়ে দিতে পারি। সেই নিয়ে যা বদনাম হয় সেগুলোও গোগ্রাসে গিলে নিতে পারি। কিন্তু গর্ব করে বলি আমরা চোর নই। ফেরেব্বাজ নই, মিথ্যুক নই। আমরা বেইমান নই। সেই আমাদের এই মুচি জাত কি না এমন ফেরেব্বাজি কাজে ঢুকে পড়েছে! কেবলমাত্র নিজের নিজের আখের গোছাবার জন্যে! সমষ্টির মুখের দিকে একবারও তাকাবার কথা ভাবলো না! এটা তো সত্যিই সর্বনাশা প্রবণতা। এটাকে আটকাতেই হবে। নন্দ, রতন, তোমাদের বলছি, আমি জীবিত থাকতে থাকতে যেন এই নোংরামো বন্ধ হয়েছে দেখে যেতে পারি। তবে তোমাদের একটা কথা বলব, ওই তুলসীবাবুর মুখের কথায় বা অন্য কারোর কাছে শোনা কথায় কাউকে শাস্তি দিও না বাবা। যদিও কাজটা বড়ই শক্ত। তবু তা করতে হবে। তোমাদের কিছু একান্ত বিশ্বস্ত লোককে এ কাজে নিযুক্ত করতে হবে। কমিটির আওতায় যে ভাগাড়গুলো আছে সেই এলাকাগুলোতে সেইসব ছেলেপিলেদের গোপনে চৌকী দিতে পাঠাতে হবে। দেখতে হবে কারোর বাড়িতে অসুস্থ কোন গরু-ছাগল আছে কি না। থাকলে আরও সুক্ষ্মভাবে সেই অসুস্থ পশুর পরিণতি কি হল লক্ষ্য রাখতে হবে। আর একদিকে নজর দিতে হবে, আমাদের পাড়ার কোন কোন বেটাছেলে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতে যায়। ফেরি তারা করুক। এটা তো আমাদের জীবন জীবিকার একটা দিক। কিন্তু ওই ফেরির নাম করেই, আমার মন ঠাওর করছে, তারা অন্যায়গুলো করে চলেছে। তাদের পেছনে চৌকি দিতে হবে। তবে তারা যেন ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে না পারে। তাহলে রতন দেখবে একদম হাতেনাতে তোমরা অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারবে। তখন আটচালা যদি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তো কারোর কিছু বলার থাকবে না।” এরপর খানিক দম নিয়ে সুবোধ কাকা আবার বলল, “দেখো বাবা, আমি যে তোমাদের বুদ্ধিগুলো দিলাম তা যেন আমার নামে বাজারে চাউর করে দিও না। তাহলে যাদের স্বার্থে ঘা লাগছে তারা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। দিনকাল বড়ই খারাপ গো বাপেরা। ভীমরুল চাকে ঢিল মারলে তুরন্ত ভীমরুল তার প্রতিশোধ নিতে ধেয়ে আসে আক্রমণকারীর দিকে। এ তো আর মৌচাক নয় যে তার কামড় সহ্য করা যাবে। দিনে দিনে কি কাল এল রে বাপেরা!”
[ তেরো ]
দুলাল লোকটাকে তাদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেওয়াটা এখন মনে হচ্ছে সঠিক কাজ হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তার এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না চন্দনের। যেভাবে মেয়েটা ওই দুলালের হাত ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। মনে হল যেন একই মায়ের নাড়িকাটা দুই ভাইবোন। কোনদিন বাড়ি থেকে বাইরে বার হয়নি পাড়াগাঁয়ের এই বোন। স্বামী বেয়নে কোলের শিশুটাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে বাড়ির বাইরে বার হয়েছে। “বোন ভয় পেয়ে কান্নকাটি করছে। ছলছল চোখে বলেছিল দুলাল।” আবেগটা সক্রিয় হয়ে পড়ল। তাই মেয়েটার কান্না বন্ধ করার জন্যে সেদিন প্রস্তাবটা দিয়েছিল চন্দন। এখন তো মনে হচ্ছে ওগুলো সবই তাদের অভিনয়। বিশেষ করে তাদের দু’জনের ঘোষিত সম্পর্কটা। মর্নিং ওয়াকের সময় এ.-ই. ব্লকের বক্সিবাবুকে বলেছিল তাদের কাজের লোকের সমস্যার কথা। বক্সিবাবু বলেছিলেন, ঠিক আছে চন্দন, আমাদের কাজের মেয়ে নমিতাকে বলব’খন যদি তাদের দেশের বাড়ি থেকে কোন কাজের মেয়ে জোগাড় করে দিতে পারে। সেই নমিতাই দুলালের মারফত সনকাকে জোগাড় করে দেয়। এখন তো মনে হচ্ছে এই দুলাল দালালির মত কাজ করেছে। যদিও সে পেশাদার দালাল নয়। দুলালেরও খোঁজ সে নিয়েছে। বৈঠকখানায় একটা পেপারের দোকানে সে কাজ করে। গ্রামের বাড়ি-টাড়ি সব ঠিক আছে। সনকাদের এলাকাতেই তার বাড়ি।
শীতের দুপুরে টিফিনটাইম উপভোগ করতে দলবল নিয়ে চন্দন নিক্কোপার্কে গেল। অভ্যাসমত বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা দৃশ্যে চোখ আটকাতে চমকে ওঠে সে! চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায়। অন্যরা সমস্বরে বলে ওঠে, “কি হল চন্দনদা, দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? চলুন!” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে পা পা করে এগিয়ে চলে। এক মহিলা, যে চন্দনের বেশি নেওটা, সে বলল,“চন্দনদা, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলেন যে? আচ্ছা, হঠাৎ আপনার কি হল বলুন তো? কি এমন হল! আমাদের মধ্যে কেউ কিছু বলেছে নাকি যে আপনি এমন চুপ হয়ে গেলেন? আমাদের কথার কোন উত্তরও দিচ্ছেন না। ধুর! ভাল্লাগে না।” বলে মেয়েটাও গোমড়া মুখ করে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। চন্দন দেখল, এবার আর চুপ করে থাকা চলে না। পরিস্থিতি তাহলে অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে চন্দন বলল, “আরে ভাই আমাকে কেউই কোন কিছু বলেনি। যার জন্যে তোমরা সব চিন্তায় পড়ে যাচ্ছো। হঠাৎ একটা ঘটনার কথা মনে পড়তে থমকে গেছিলাম। কথাটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। ভুলে গেছিলাম কাজটা করতে। বাকি রয়ে গেছে। তাই সেটা মনে পড়তে থমকে যাই। ওসব ছাড়ো। পরে সামলে নেওয়া যাবে। এখন চলো। সবাই মিলে গরম কফি খাওয়া যাক। সেইসঙ্গে কড়া করে বেগুনিভাজা।”
অফিসে ফিরে আর আগের মত কাজে মন বসাতে পারছিল না চন্দন। নিক্কোপার্কের দেখা দৃশ্যটা বারবার তার চোখের সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে। রূপসা তাহলে ওদের সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিল তা তো দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। সনকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে দুলাল! আর সনকা তার মাথার চুলে বিলি কেটে লাজুক মুখে কত কি বলে চলেছে। ওদের মধ্যে পরকীয়া প্রেম যে গাঢ় থেকে গাঢ়তর তা এই ছবিতে পরিস্কার। স্বামী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও সনকা পরপুরুষের সঙ্গে প্রেমালাপে মসগুল। স্বামী যে জীবিত তার প্রমাণ ওর মাথার সিঁদুর। অথচ সনকা স্বামীর ব্যাপারটা তাদের খোলসা করে বলেনি কোনদিন। চন্দন জিজ্ঞেসও করেছিল সনকাকে। কিন্তু তার উত্তর ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ও’ব্যাপারে একটা ধোঁয়াশা সে রেখেই দিয়েছে। হয় ও স্বামী বিচ্ছিন্না অথবা কোন কারণে স্বামীর সঙ্গে ও থাকে না। ছেলে কোলে করে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে যখন এসেছে তখন আবার ঘটা করে সতী সাজতে সিঁদুর পরার মানে কি! ও যে সতী নয়, সেই ভাবনা চন্দনের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। হঠাৎ ওর মনে হ’ল লোভনীয় টোপ ফেললে মাছটা গিলতে পারে টোপটা। সত্যিই সনকার শরীরের এমন টান যে শুধু দুলাল কেন দুলালের থেকেও আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে সময় নেবে না। মুখের কাটিংও মনে ধরার মত। অবচেতনে চন্দনের মনও যেন ধরা দিতে উতলা হয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল, দুলালের ব্যাপারটা সনকার কাছে জানতে চাইবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে সনকার মন থেকে সে হাজার যোজন দূরে চলে যাবে। ওকে পেতে গেলে আস্তে আস্তে ফন্দি করে দুলালকে তার কাছ থেকে দূরে সরাতে হবে। কাছে টানতে হবে সনকাকে। যুগপৎ সবটাই চলবে রূপসার অগোচরে।
দুলাল-সনকাকে সেই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর থেকে যখনই চন্দনরা নিক্কোপার্কে আসে তার সেই দৃশ্যটা অমনি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তখনই চন্দন অন্যমনস্ক। এই অন্যমনস্কতাকে সঙ্গী করে ওরা পার্ক থেকে ফিরছিল। সদলবলেই ফিরছিল। চন্দন তখন রাস্তা পার হবার জন্যে হাত নেড়ে সকলকে সিগন্যাল দিতেই সবাই মিলে এপার থেকে ওপারে যাবার কালেই একটা দ্রুতগামী বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে! কপাল ভালো বাইকটা সরাসরি কারোর ঘাড়ে চেপে বসেনি। দলের এক ফাঁকটায় সে ঢুকে পড়ে। তাতে ওদের কারোর প্রাণহানির সম্ভাবনা থেকে রেহাই পায়। তবে অল্প-বিস্তর রক্তারক্তি চোট পায় কমবেশি সকলেই। মন্দ কপাল, চন্দন পড়ে গেলে তার বাঁ পা ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। প্রথম ক’দিন হাসপাতাল তারপর বাড়িতে ছ’মাসের জন্যে বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। ওর এই বিপদে রুপসা-সনকা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেবাযত্ন করতে থাকে। সনকা যখনই তার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, চন্দন মনে মনে ভাবে এই মেয়েটাকে নিয়ে তার মধ্যে পাপ চিন্তা প্রবেশ করেছিল। উপরওয়ালা তাই সেই পাপের শাস্তি এইভাবে দিয়ে শিক্ষা দিল, স্বচ্ছ মন এবং সঠিক পথে চললে অমঙ্গল মানুষকে ছুঁতে পারে না।
ডাক্তারের দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই চন্দনের পায়ের প্লাস্টার কেটে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে লাঠির উপর ভর করে হাঁটাচলা অভ্যাস করার পর্ব এসে যায়। কিন্তু তার জন্যে কারোর সাহায্য দরকার। কখনো রূপসা কখনো সনকা, যার যেমন কাজের ফাঁকে ফুরসৎ হয় চন্দনকে হাঁটতে সাহায্য করে। সেই সুবাদে দুই রমনীর শরীরের পেলব ঘ্রাণ তাকে অতিরিক্ত সতেজ করতে সাহায্য করে বইকি। বিশেষ করে ইতিপূর্বের অধরা যুবতী সনকার শরীরের মরমী স্পর্শ! যেমনটি প্রথম প্রথম রূপসার স্পর্শ তাকে মাতাল করে দিত। রূপসার সেই স্পর্শর একঘেয়েমি এখন আর তাকে তেমন মাতিয়ে তুলতে পারে না। যেমন পারছে সনকা। সনকার ভেতরটা তার স্পর্শে কতটা দোলন দেয় তা তো চন্দনের বোঝার অতীত। তবে কিছুটা ইঙ্গিত যেন উঁকি দেয় তার প্রতি সনকার সেবার একাগ্রতার বহরে। তাহলে তো চন্দন এটাও ভাবতে পারে যে এই দুর্ঘটনা ওর কাছে শাপে বর হয়েছে! এই অঘটনের জন্যেই সে সনকাকে এত কাছে পেয়েছে এবং তা কোনরকম ফন্দিফিকির না করেই!
সনকার কাজে চন্দনের বাড়ির সকলেই সন্তুষ্ট। রূপসা তো তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ, “জানো তো, গ্রামের মেয়ে সনকাকে প্রথম প্রথম যতটা অকেজো হবে বলে মনে হয়েছিল এখন দেখছি আমার সেই ধারণা একদম ভুল। সনকা, ওর কাজের মধ্যে দিয়ে আমার সেই ভুল খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাঙিয়ে দিয়েছে। যেভাবে ও তোমাকে সেবাযত্ন করেছে এবং তা একান্ত আপনজনের মত ভেবে করেছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। শুধু করেছে না, এখনো করছে। ও যেন পণ করেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও তোমাকে অফিস পাঠিয়ে তবে ছাড়বে। ডাক্তারের অনুমানের আগেই তোমাকে অফিস পাঠিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় যে ও। অথচ দেখো মেয়েটা একবারও মুখ ফুটে সে কথা বলে না। মুখ ফুটে কোনদিন অসন্তোষ প্রকাশ তো করেই না। ওই অসন্তোষ, অনিচ্ছা, অনীহা- এসব যেন ওর ধাতে নেই। খুব ভাল একটা কাজের মেয়েকে আমরা পেয়েছি। এত ভাল মেয়ে, অথচ দেখো, ভাল করে তার স্বামীর ঘর করা হল না। ভাবছি তুমি অফিসে জয়েন করার পর সেই মাসেই ওর বেতনটা বাড়িয়ে দেবো। দশ থেকে এগারো হাজার করে দেবো। আমরা দু’জন কাজে বেরিয়ে গেলে বাড়ির সব দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দেবো ভাবছি। কি, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? তোমার কি মনে হয়? আমার তো মনে হয় এ মেয়ে তেমন মেয়ে নয়। এক হাঁড়ি ভাতের একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় হাঁড়ির ভেতর অন্যসব চালের অবস্থা কেমন।”
সনকার প্রতি রূপসার এই দরাজ সুপারিশে এবার মনে মনে প্রমাদ গোনে চন্দন। এবার তার কপালের পরত পেঁয়াজের খোসার মত একটা একটা করে খুলছে। খুলতে খুলতে একসময় তার সেই ইপ্সিত রসাল বিন্দুতে মনে হয় একদিন পৌঁছোতে সক্ষম হবে। যতটা সম্ভব ভেতরের সরস ঢেউকে সামাল দিয়ে চন্দন বলল, “হ্যাঁ রূপসা। তোমার থার্ড আইয়ের পর্যবেক্ষণকে তারিফ না করে পারা যায় না। এই জন্যেই তো তুমি আমার যোগ্য স্ত্রী। তোমার মতের সঙ্গে আমি পুরোপুরি এক মত।”
ছোট ভায়ের বিয়েতে রূপসাকে দিন পনেরোর জন্যে দিল্লী যেতে হচ্ছে। অফিস ছুটি মঞ্জুর করেছে। এই ছুটি পেয়ে যারপরনাই খুশি রূপসা। মঞ্জুর হবে কি না তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিল সে। ভায়ের বিয়েতে আনন্দ করতে পারবে না, সেই আতঙ্কে ক’দিন ভর মন ভার করে রেখেছিল। বাবুর দেখাশোনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব সনকার উপর দিয়ে গেল। চন্দনের দেখভালে যে কোন ত্রুটি হবে না, সে বিশ্বাস সনকার ওপর রাখে রূপসা। অবশ্য রূপসা দিল্লী যাবার আগে আগেই চন্দন অফিসে জয়েন করে ফেলেছে। কিন্তু এই সন্ধিক্ষণেই তো সদ্য সেরে ওঠা রোগীর প্রতি আরও বেশি করে নজর রাখা দরকার। সামান্য পান থেকে চুন খসলেই আবার কোন শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রবল। সনকাকে বলে গেছে রূপসা, “দেখো, বাবু বাইরে বেরোবার সময় যেন স্টিলের চারপেয়ে লাঠিটা নিতে ভুলে না যায়। ডাক্তার এখন ওটাকে সবসময় সঙ্গে রাখতে বলেছে। যতই হাড় জুড়ে যাক, এখনই পুরোপুরি পায়ের উপর চাপ দেওয়া যাবে না।”
নীচের সিঁড়ি ঘরের পাশে ছোট্ট সার্ভেন্ট কোয়ার্টার সনকার জন্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু চন্দনকে নিয়ত দেখাশোনার জন্যে দোতলা থেকে তাকে ডাকাডাকি করা বা সনকারও বারবার উপর-নীচ করা কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। তাই রূপসাই ঠিক করে দেয় দোতলার পশ্চিম বারান্দার প্রান্তে ফাঁকা পড়ে থাকা বড় ঘরে সনকাকে থাকার জন্যে। সনকা তার ছেলেকে নিয়ে ওখানে থাকবে এবার থেকে। তাহলে বাবুকেও চোখে চোখে রাখতে পারবে। বুড়ো শাশুড়ির পক্ষে সেই লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময়টাই উনি ঠাকুরঘরে কাটান। এটা ওনার বহুদিনের অভ্যেস। অতএব সনকাই এখন ওদের ভরসা। প্রত্যেক দিনই অফিস বেরোবার সময় এই লাঠি নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে সনকার সঙ্গে ঝুলপেটাপেটি হয় চন্দনের, “বাবু, আবার সেই লাঠি না নিয়ে অফিস যাচ্ছো? বৌদি পই পই করে আমাকে বলে গেছে, তুই দেখবি সনকা, বাবু যেন ওটা ফেলে না চলে যায়। তাছাড়া ও ইচ্ছে করেও না নিতে পারে। তোর ওপর ভার দিয়ে গেলাম। সেটা করতে দিবি না। ভীষণ তেড়েল লোক আছে তোর বাবু। সব কিছুতেই গাজোয়ারী করে। এই জন্যেই তো আমার সঙ্গে যখন তখন লাগে।” তারপরও কথা না শুনে এগোতে গেলে সনকা লাঠিটা নিয়ে ওর সামনে পথ আটকায়, “আগে এটা হাতে ধরো তারপর বার হবে। বৌদি আমার ভরসায় আপনাকে রেখে গেছে।”
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই চন্দন লক্ষ্য করছে প্রথম যখন সনকা তাদের বাড়ি আসে তখন যে শুকনো-শাকনা মত ছিল এই বাড়িতে আসার পর ভাল খাওয়াদাওয়া এবং খুশবন্দ মনে থাকার ফলে তার চেহারার ভোলই পাল্টে গেছে। বাড়িতে ছাওয়ায় থেকে থেকে যেমন শরীরের রঙ চকচকে হয়ে গেছে তেমনি গড়নও ভরভরন্ত এবং আকর্ষণীয়ভাবে টানটান হয়েছে। মনে মনে তার যৌবনের প্রতি লাগামহীন ঝোঁক পেয়ে বসছে। কিন্তু সম্ভ্রমের বাঁধন তাকে আটকে রেখেছিল। এখন সনকার এই ব্যবহার তার যাবতীয় বাঁধনকে যেন ছিঁড়েমিড়ে ছারখার হয়ে গেল! অধৈর্য চন্দন সনকার ফুটন্ত যৌবনকে সপাটে নিজের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়, “বৌদি যখন ভরসা করে আমাকে তোমার কাছে রেখে গেছে তখন বৌদির সমস্ত কাজটাই তো তোমাকে বকলম দিয়েছে। আঃ কি সুন্দর তুমি সনকা। ওঁ হুঁ! বাধা দিও না সনকা। আরও কিছুক্ষণ তোমার শরীরের এই মাতাল করা ওম আমাকে গ্রহণ করতে দাও। এরপর সনকার সমগ্র মুখমন্ডলে উপর্যুপরি চুমু এঁকে দিতে থাকে চন্দন। ক্ষান্ত হওয়ার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সনকা তখন যেন চন্দনকে বাধা দেবার যাবতীয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চন্দনের ভালবাসার অভিঘাতে সনকা আস্তে আস্তে যেন শিথীল হতে থাকে। অফিস যাওয়া বন্ধ করে চন্দন এখন তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কোন কিছুতেই সনকার আপত্তি নেই!
[চোদ্দ]
সুবোধ কাকার পরামর্শগুলো মনে ধরে রতন-নন্দদের। এর আগে পর্যন্ত ওরা দ্বিধায় ছিল কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। রতন বলল, “এই জন্যে কথায় আছে ‘তিন মাথা যার বুদ্ধি নেবে তার’। সুবোধ কাকার কথাগুলো আমাদের মাথায়ও আসেনি। নন্দ, আমার মনে হয় এই ধান্দাবাজদের পাকড়াও করতে গেলে এমন লোককে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দিতে হবে যারা ইদানিং আর ভাগাড়ের ওদিক মাড়ায় না। তুই আমি বাদে পাড়ার আর কারা কারা ভাগাড়ের কাজ করে না সেটা তুই ভাল করে খোঁজ খবর নে নন্দ। শুধু ভাগাড়ে কাজ করে না, এই যুক্তিতে কাউকে কাজে লাগানো যাবে না। তাকে কমিটির বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজনও হতে হবে। না হলে সব পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। তাছাড়া আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। যারা এত ঘোরাঘুরি করবে তাদের তো একটু জলখাবারের খরচা দিতে হবে। কেবল মুখে জালতি বেঁধে গরু-পাক খাওয়ালে তো চলবে না। ওটা না দিলে কাজ করতে ওরা উৎসাহও দেখাতে চাইবে না। চক্ষুলজ্জায় কমিটির কথা শুনে হয়তো কাজ করতে যাবে। কিন্তু সে কাজ মন থেকে হবে না। কখনো হয়তো দেখা যাবে, তারা কাজে যাচ্ছি বলে পাড়া থেকে বার হ’ল কিন্তু গেল না। নিজের অন্য কোন কাজে চলে গেল। আমরা কিন্তু তখন তাকে জোর করতে পারবো না। এটা তোকে মাথায় রাখতে হবে নন্দ।” এরপর নন্দ কি একটা বলতে যাচ্ছিল, রতন তার কথার উপর কথা চাপিয়ে আবার বলল, “আমাদের দিনু ঋষি রে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখেছি, ও ওই ভাগাড়ে গিয়ে গরুকাটা, চামড়ার ভাগ নিয়ে আকচা-আকচি একদম পছন্দ করে না। তাই জীবনে ওকে ভাগাড়মুখি হতে দেখিনি আমরা। সারা জীবন চাষবাস আর চাষের কাজ না থাকলে বাড়িতে ধামা-খোড়া, কুনকে, পালি সহ অন্য বেতের কাজ করে সংসার চালায়। আটচালা নতুন করে তৈরীর সময় প্রায় রোজই এক-দু ঘন্টা গায়ে-গতরে খেটে দিয়েছে। সে তো তুই জানিস, নন্দ। আর সেই ইট চুরির ঘটনার কথা তোর মনে আছে! আটচালার ভিত গাঁথার সময় প্রায়ই দু’চারটে করে ইট চুরি যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তো বোঝাই যাচ্ছিল না। ওই দিনুই প্রথম ঠাওর করে ব্যাপারটা! তুই, আমি সবাই চিন্তিত। একে চেয়েচিন্তে ইট, বালি জোগাড় করে এটা তৈরী করা হচ্ছে। সেখানেও যদি কেউ এইসব চোরটামি করে কার না গায়ে রাগ ধরে। দিনের বেলা কারোর সাহস হবে না এ কাজ করার। এইসব চুরি চামারি হচ্ছে বলে রাতেও আমরা পাহারার ব্যবস্থা করলাম। তবুও চুরি আটকানো যাচ্ছে না। ঘটনাটা দিনুরও মনে আঘাত লেগেছে। ওর ওই আঘাত লাগাটা কিন্তু ও কাউকে ফেচকায়নি। ও চিন্তা করেছে, দিনমানে চুরি হবার নয়। রাতেও পাহারা। তাহলে চুরি হচ্ছেটা কখন? আর চুরি করছেটা কে? গবেষণা করে একটা দিন ভোরবেলা চৌকী দিতেই দিনু চোরবেটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে! ধরা পড়তে জানা গেলো ওই ব্যাটা পাঁড় মাতাল সুফলে কান্ডটা করছিল। কিন্তু ওই সুফলে মাতাল ইট নিয়ে তো ঘর বাঁধবে না। ও নিশ্চয়ই চুল্লু সাঁটাবার জন্যে কাউকে সেই ইট বেচে। এবার ওই গছনদারকে ধরতে হবে। আটচালার উল্টোদিকে দেশমালা ঠাকুর থানের বারান্দায় নিয়ে এসে মাতালটাকে উত্তম-মধ্যম দিতেই মুখ ফসকে বমি করে দেয় গছনদারের নামটা। পোদপাড়ার রুইলের কাজ এটা। রুইলের ছিটেবেড়া ঘরের পেছনে সব চোরাই ইট পাওয়া যায়। তারপর তো নন্দ, তুই পঞ্চায়েতে নালিশ জানিয়ে সব ইট উদ্ধার করলি। রুইলেটা বেঁচে গেল, ও আমাদের আটচালার আওতায় পড়ে না বলে। চোরাই মাল গছনের জন্যে থানায় চালান করা যেত। পঞ্চায়েত বলল, লঘু পাপে গুরুদন্ড দিয়ে দরকার নেই। ওকে ফাইন করে আর দু-চার ঘা ধরিয়ে আমরা কবুল করিয়ে নিচ্ছি, যাতে দু’বার সে এই কাজটা না করে। তা নন্দ, যেটা তোকে বলার জন্যে এত পুরোনো ঘটনা জাবর কাটলাম সেটা হচ্ছে দিনুর মধ্যে কোন অপরাধের রহস্য খুঁজে বার করার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। ওর ওই ক্ষমতাকে এখানে আমরা যদি কাজে লাগাই তাহলে মনে হয় সফল হতে পারি। কারা কারা চুকলিবাজি করে কমিটির ভাগাড়ের গরু সাধারণের ভাগাড়ে চালান করছে ধরে ফেলতে পারবো। আটচালাকে ও মন থেকে পছন্দ করে। দেখা হলে দিনুকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস। আমার কথা ও শোনে। দিনুকে রাজি করানোর ভারটা আমি নিচ্ছি।”
রতনের কথায় আশ্বস্ত হয় নন্দ। কিন্তু দিনুর একার দিয়ে এতবড় এলাকা নজর রাখা অসুবিধা। আর একজন অন্তত কাউকে জোগাড় করতে হবে। আর কাকে পাওয়া যায়, কাকে পাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে করতে রতনের হঠাৎ মনে পড়ল সুভাষের কথা। সুভাষ ওর শালীর ছেলে। উঠতি যুবক। এখনো সংসার-ধর্ম করেনি। বাজারে ওর জুতো সারাই, পালিশ, চামড়ার ব্যাগ বিক্রির দোকান। ভাগাড়ে গিয়ে ওইসব কাজকর্ম ওর একদম পছন্দ নয়। তাই সুযোগ এলেও কোনদিন ও ভাগাড়মুখো হয়নি। নন্দর নেওটা ও। মেসোর কথা সুভাষ ফেলে না। নিজের বাবা কি বলছে না বলছে তাতে তার কোন হেলদোল নেই। তবে নন্দ কোনকিছু বললে গুরুত্ব দিয়ে সেই কথা পালন করে। সুভাষকে ও এই কাজে লাগাবে ঠিক করে। দোকান বন্ধ করে বাড়িতে খেতে আসার সময় সারা দুপুরটা ও ফাঁকা থাকে। আবার সেই সন্ধ্যে ছ’টায় দোকান খোলে। এই তিনচার ঘন্টা দিব্বি ও কাজটা করতে পারবে। রতনকে বলে, “আর একজনকে পেয়ে গেছি রতন। আমার শালীর ছেলে, সুভাষ। ও একদম এই কাজে উপযুক্ত হবে। আমি বললে আমার কথা ও ফেলতে পারবে না। ওর ওপর আমরা নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি।”
নন্দ আর একজন পাহারাদারকে পেয়ে গেছে। তাদের গোয়েন্দাগিরির লোকের আকাল আপাতত মিটল বটে। তবে রতনের আর একটা কথা মনে জিগির টেনে বসল। দিনু বা নন্দর শালীর ছেলে সুভাষ তো তাদের পাড়ার ছেলে। এদের তো অপরাধীরা আলবাৎ চেনে। তাহলে দিনু-সুভাষকে দেখলে ওরা তো সাবধান হয়ে যাবে। চোর ধরা পড়বে না। কিছুটা টান টান হয়ে রতন নন্দকে বলল, “হ্যাঁরে নন্দ, দিনু-সুভাষদের বিনা কারণে ঘোরাঘুরি করলে তো বদমায়েশগুলো বুঝে যাবে, অন্য কোন মতলবে ওরা ঘোরাঘুরি করছে। কথায় বলে না, ‘চোরের মন বোঁচকার তন’ মানে বোঁচকার দিকে। ওরা বুঝে নেবে কমিটি তাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। সাবধান হয়ে যাবে। এভাবে এগোলে তো আমরা কোনদিন অপরাধী পাকড়াও করতে পারবো না। আমার তো মনে হচ্ছে সুবোধকাকার বুদ্ধি, গলে জল হয়ে যাবে। কাজের কাজ হবে না। তুই অন্য কোন কৌশল বার কর নন্দ।”
রতনের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নন্দ। খানিক চিন্তায় পড়ে যায় সে। রতন যে কথাটা বলল, তা তো একদম ফেলে দেবার মত নয়। কিন্তু গোয়েন্দগিরি ছাড়া তাদের সামনে তো আর কোন রাস্তা খোলা নেই। ভুবন জুড়ে সব অপরাধের কিনারা তো হয় এই গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে। তাই এই কৌশল ঠিক আছে। তবে একটা ভাবনা তার মাথায় চলকে উঠছে যেন। তাদের দুই গোয়েন্দাকে সাদামাটাভাবে ছেড়ে দিলে হবে না। ভোল বদল করতে হবে দিনু সুভাষকে। নতুন বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে পকেট থেকে ম্যাচিসটা বার করে হাতে ধরা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে নন্দ বলল, “এই রতন, অত হুটহাট ঘাবড়ে গেলে চলবে না। শোন, এই বুদ্ধিটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। দিনু সুভাষকেও বেত, ইনবাইশ, কুরপি হাতে পাড়ায় ছেড়ে দিতে হবে। ওরাও চোরেদের মত পাড়ায় পাড়ায় ধামা, সের, কুনকে, জুতো ইত্যাদি সারার জন্যে ওই সরঞ্জামগুলো হাতে নিয়ে ঘুরবে। কাজ পেলে কাজ করবে। তবে ওদের মূল কাজ কিন্তু গোয়েন্দাগিরি। লোকের সামগ্রী সারাইয়ের কাজ নয়। তাহলে আমাদের কাজ হাসিল করা যাবে। আর আমাদের সুভাষ তো এসব কাজে ওস্তাদ। আশেপাশের গ্রামের মানুষ দেখে, বাজারে ও এই কাজই করে। অতএব সাধারণ মানুষ তো ধরতেই পারবে না যে সুভাষ মুচি ঢঙ করে হকারি করছে পাড়ায় পাড়ায়। আসল ধান্ধা অন্য।”
খুব গোপনে এবং সন্তর্পণে গোয়েন্দাগিরিটা চলতে লাগল। দিন পনেরো হয়ে গেল দিনু-সুভাষ গ্রামে গ্রামে ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে নজর রেখে চলেছে।
ওরা দেখতে পাচ্ছে, মধ্য পাড়ার সুফলে, আর দক্ষিণ পাড়ার গদাই আর ছেনোর চলাফেরা আচার আচরণ নিটোল ফেরিওয়ালার মত নয়। শুধুই যদি জুতো-ধামা-কুন্কে ইত্যাদি সারাইয়ের জন্যে এরা পাড়া ঘুরতো তো অন্যরকম তাদের চোখ-মুখের,শরীরের ভাষা হ’ত। যেমন তাদের পাড়ার অন্যরা করে। তাই ওরা ঠিক করল, এই তিনজনের উপর তাদের নজর-জালটা ফেলে যেতে হবে। ওদের পেছন-পেছন গোপনে পাহারা দিয়ে যেতে হবে। যে পাড়ায় এবং যে বাড়িতে ওরা অকারণে একটু বেশি ঠেক নেবে, সেখানেই ওরা ছুটে যাবে। সেটা অবশ্যই অত্যন্ত গোপনে। সুফলেরা টের পেলে গোটা পরিকল্পনাটা মাটি হয়ে যাবে। দিনুরা ঠিক করল, কোন পাড়ায় ওরা দু’জন একসাথে ঢুকবে না। সুফলেরা যেমন বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোরে, ওরাও তেমন তাদের পেছু নেবে, পাড়া ফেরির ভান করে।
সুফলে, গদাই আর ছেনোর মধ্যে এই ছেনোটা খুব ধূর্ত। সুফলে, গদাইয়ের মাথায় এটা নেই বা ভাবতে পারে না ওদের এই অপকর্মের পেছনো কেউ চালাক দিতে পারে। কিন্তু ছেনোটা একদম পাক্কা ছেঁচ্চোড়। সরলসিধে মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করাটা ওর পেশা। লোক ঠকিয়ে কামাই করে ওর সংসার চলে। ধরা পড়ে কতবার যে গণধোলাই খেতে হয়েছে। বাজারে পাঁচ’শ আলু কিনে ব্যাগে ঢোকানোর অছিলায় দুটো আলু দোকানের আলুর ঢিবিতে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়ে আর চার-পাঁচটা আলু তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। ব্যস্ত দোকানদারের সব সময় এই হাতসাফাইয়ের দিকে নজর থাকে না। কিন্তু পাঁচবার এমন করতে করতে একদিন তো নজরে এসে যাবে! তাই হল। সেই নিয়ে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, লোক জড়ো, মারপিট! দোকানদার বলল, “শালা, মুচির বাচ্চা! ক’দিন ভ’র আমি তক্কে তক্কে আছি। কিছুতেই হাতেনাতে ধরা যাচ্ছিল না। এবার শালা তুই যাবি কোথায়?” বলে উত্তম-মধ্যম কসিয়ে দিল ছেনো চোরকে। এবার বাজারে যেমন হয়। এক এক লোকের এক এক মত। কেউ আবার সেই মার দেখে ছেনোর পক্ষ নিয়ে নিল, “ছেনো যে তোর দোকানের আলু হাত সাফাই করেছে, তার প্রমাণ কি? কে সাক্ষী আছে?” এটা ঠিক আজকাল ছাপোষা খদ্দেররা ওইসব সাক্ষী-টাক্ষীর ঝুট ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায় না। এড়িয়ে যায় এসব। চোখে দেখেও সে লোক আলু দোকানদারের পক্ষে কথা না বলে গা সটকে যায়। দোকানদার সাক্ষী পায় না। তখন ছেনোর হয়ে কথা বলা অতি উৎসাহিরা দোকানদারের উপর চড়াও হয়। এই নিয়ে কত কেচাল হ’ল সেবার। একবার তো কাপড় দোকানে কাপড় বাছাবাছি করতে করতে কোন ফাঁকে একটা শাড়ী তার ব্যাগে সেঁধিয়ে নেয়। দূর থেকে ক্যাশে বসে থাকা দোকানের মালিকের চোখে পড়ে যায়। ছেনো চোরকে দোকান মালিক হাত বেঁধে বাজার কমিটির কাছে বামাল সমেত হাজির করে। ছেনোর এইসব কান্ডকারখানায় তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যায় বাজারের মানুষজনের কাছে। বাজার কমিটির বিচারের সময় রুইদাসরা কেউই অবশ্য ছেনোর পক্ষে যায় নি। পাঁচখুরো করে মাথায় আলকাতরা মাখিয়ে, নাকখত খাইয়ে, চরম সাবধান করে রেহাই দেয় তাকে। সেসব যদি মনে রাখতো তো ফিরেফিত্যে আর ও এই কাজ করতে আসতো না। শালার গায়ে গন্ডারের চামড়া। পাবলিকের পেটানি ওই যতক্ষণ কে ততক্ষণ। কিছুই মনে রাখে না। গায়ের ব্যথা মরে গেলে সব ধোলাইয়ের কথা ভুলে যায়। মনটাকে যে মানি’র জায়গায় উতরে দিতে হয়, তবেই মানুষের কাছে নিজের মর্যাদা টিকে থাকে সেসব ভাবনা ওই ছেনো শালার নেই।
বেশ কিছুদিন এইভাবে চলতে চলতে ছেনো ঠাওর করে, যেখানেই ও যায়, ওই শালা সুভাষ বেটাকে দেখা যায়! মনে কিন্তু কিন্তু ভাব চাগাড় দেয় তার! ওই শালা কমিটির মাতব্বর, রতনের শালীর বেটা সুভাষকে রোজ, এই ক’দিন ভ’র দেখতে পায় কেন? পাড়ার আর তো কাউকে দেখা যায় না? তাহলে কি সুভাষটা কমিটির টিকটিকি? ছেনো তো বলতে গেলে পেশাদার চোর-ছ্যাঁচোড়। অপকর্ম করার সাথে সাথে সাবধনী মনকেও সজাগ রাখে। বিভিন্ন সময় ধরা পড়ে, মার খেয়ে, অপমানিত হয়ে এই বোধে ও এখন সক্রিয়। তাই সুভাষের গতিবিধি ওর ভাল লাগল না। এবার সুভাষকে ও সন্দেহ করতে লাগল। নিশ্চয়ই ও শালা কমিটির টিকটিকি। শিবপুরে একটা বাড়িতে গাই গরুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ব্লকের ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বয়স হয়েছে। বুড়ো দাঁতে আর ও জাবর কাটতে পারছে না। এইভাবে যতদিন বাঁচে, বাঁচুক। এখানে আর আনতে হবে না। ব্লক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় ওই বাড়ির বুড়োটার সঙ্গে দেখা হতে ছেনো তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে। তখনই ছেনো বুড়োর হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা ধরো কাকা। গরুটা মরে গেলে তোমরা যেখানে সেখানের ভাগাড়ে ফেলবে না। আমি নিয়ে চলে যাবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া রোজই আমি তোমার গরুটা কেমন আছে দেখে যাবো।” এরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার স্বর নামিয়ে বলে, “কাকা, আমাদের আর কেউ যদি আসে তাদের পাত্তা দেবে না। আর কেউ তোমাদের গরুর খোঁজ খবর নিতে আসলে আমাকে জানিও। একদম পাত্তা দেবে না কাকা, তাকে। পরে আর কিছু টাকা তোমাকে দেব’খন।” ছেনো আরও টাকা দেবার লোভ দেখালে ওই বুড়োটা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় তার কথায়। অভাবী মানুষটা এই গরু নেড়েচেড়ে দিন চালায়। তার আবার ব্যামো। গরুটা থেকে সে আর কোন আয় করতে পারবে না। এমন সময় ছেলেটার টাকার লোভ বুড়ো সামলাতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও করেনি যে এই টাকা কেন দিচ্ছে ছেলেটা। নিশ্চয়ই ছেলেটার কোন অভিসন্ধি আছে। অতশত ভেবে তার কাজ নেই। যাদের মাথা ফেটেছে তারা চুন খুঁজে নেবেখন।
ছেনোরা এই ধারণাটা করে ফেলেছে যে, তাদের পেছনে কমিটির লোক লেগে পড়েছে। নাহলে ওই শালা সুভাষ তো কষ্মিন কালে পাড়া করত না। বরাবরই বাজারে জুতো-টুতো সারাই করত। ওদিকে দিনুটা আবার সুফলে গদাইদের পেছনে পড়ে গেছে। যে দিনু সারা জীবন চাষবাস আর বাড়িতে ধামা-টামা বানিয়ে এলো, হঠাৎ সে পাড়ায় সারাইয়ের কাজে নেমে পড়ল! এটা বিশ্বাস করা যে মুশকিল হয়ে পড়ছে। ওই দুই শালাই আটচালা কমিটির টিকটিকি। আটচালা ওই দুটোকে তাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেনোরাও ছেড়ে কথা বলার ছাবাল নয়। ওরা তিনজনে ষাট করে ওই দুই শালাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা দেবে, জীবনে আর এই টিকটিকিগিরি করার নাম করবে না। সাথে সাথে ওদের মাধ্যমে আটচালা কমিটিকেও আচ্ছারকম সমঝে দেওয়া যাবে।
কোদালিয়া সরকারি ভাগাড় এলাকার কয়েকটা গ্রাম ছেনো কাজ ফেরি করে। মনষার হাট আর ফতেপুর সুফলে-গদাইয়ের। ওরা তিনজনে আলোচনা করে এই ফেরি করার ব্যবস্থা করেছে। ছেনো ভাল করে লক্ষ্য করেছে, সুভাষ টিকটিকিও ওই ছেনোর কোদালিয়া এলাকার বাইরে যায় না। যদি সুভাষের আসল উদ্দেশ্য হকারি নয়, অন্যকিছু, বা খোলসা করে বললে ছেনোর পেছনে চালাক দেওয়া তাহলে তো ওর আরও অন্য এলাকায় ঘোরার কথা। কিন্ত ও শালা তা করে না। অন্য দিনের মত এদিনও ছেনো তার এলাকায় কাজ করে টুক করে গা আড়াল দেয়। দেখে যে জায়গায় ছেনো গেছে গোপনে তা লক্ষ্য করে ঠিক সেই সেই গ্রামে টিকটিকি সুভাষ যাচ্ছে। একটা বাড়িতে সুভাষ গিয়ে ছেনোর মত কিছুটা ঘোরাঘুরি করার সময় ওই পাড়ার কয়েকজন ছোকরা তাকে ঘিরে ফেলে ‘ছাগল চোর ছাগল চোর’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। সুভাষকে আর এগোতে দেয় না। তখন ও ভয় পেয়ে যায়! ওর মনে হয়, গতিক ভাল না। ছেলেরা চেঁচিয়ে লোক জোগাড় করে তাকে ছাগলচোর বদনাম দিয়ে গণধোলাই দেবার ফন্দি করছে। হ্যাঁ, ঠিক কথা যে ওই বাড়িতে তিনচারটে ছাগল ঘোরাঘুরি করছিল। ও সেদিক তাকিয়ে ছিল। যেমনটা ছেনো করেছিল। পরখ করার চেষ্টা করছিল, ছেনো ওইভাবে কেন ছাগলগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। তার দিক থেকে ছাগল চুরির তো কোন প্রশ্নই ছিল না। সে কথা সে ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টাও করছে। কিন্তু তারা তার কোন কথাই শুনতে চাইছে না। তাকে চোর সাব্যস্ত করে পেটানোই যে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য! ভয়ে সে তাদের বেড়া ফুঁড়ে ছুট মারার চেষ্টা করতেই ধরে গণধোলাই দিতে শুরু করে! মার খেতে খেতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সুভাষ! মরে গেছে ভেবে থানা পুলিশের ভয়ে এবার যারা ওখানে জড়ো হয়েছিল সব্বাই কেটে পড়ে! খবর যায় থানায় এবং সঙ্গে সঙ্গে আটচালা কমিটিতেও। সাধু সেজে ছেনোই প্রথম হান্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে কমিটিকে খবরটা দেয়। কমিটি প্রথমেই থানায় খবর পাঠায় আর ছেনোকে আটচালার সামনে পাকুড় গাছের সাথে পিচমোড়া করে বেঁধে সুভাষকে উদ্ধার করতে ছুটে যায়। রতন-নন্দরা কোদালিয়ায় গিয়ে দেখে ওখানকার কিছু সহানুভূতিশীল মানুষ সেবাশুশ্রুষা করে সুভাষের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে। গরম দুধ খাইয়েছে। শরীরের যেসব জায়গায় মারের চোটে ছড়েছাড়ে গেছে সেখানে ডেটোল জলে ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। এমনটা দেখে রতনরা অবাক হয়ে ভাবল, প্রদীপের নীচ যতটা অন্ধকারে ঢাকে, তার থেকে প্রদীপের শিখা অনেক, অনেকগুণ বেশি আলো বিস্তার করে থাকে। পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যা কালোর থেকে বেশি বলেই এখনও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি। স্বমহিমায় সে তার অস্তিত্বকে জানান দিয়ে মনুষ্য বাসের উপযুক্ত করে রেখেছে।
রতনরা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারল ছেনো কোদালিয়ার কিছু মাতাল জাঁতালকে মদ খাইয়ে আর পয়সার লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্র করে সুভাষকে মার খাইয়েছে। অসুস্থ সুভাষকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেনো চোরের উপর। সেই বাঁধন অবস্থায় জরুরী আটচালা বসিয়ে ছেনোকে জল-বিছুটির ছিটকি দিয়ে মারের বিধান আদায় করে নিয়ে চড়াও হয়ে তার উপর। যতক্ষণ না ছেনো তার দোষ কবুল করল ততক্ষণ চলল এই বিছুটি পেটা। একটা সময় নেতিয়ে পড়ে ছেনো। তবু মার থামে না। শেষে পুলিশ এসে ছেনোকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। ছেনোর পরিণতি দেখে সুফলে-গদাই সেই যে গ্রামছাড়া হল, বছর ঘুরে গেল, তারা এখনো গ্রামে পা রাখার সাহস দেখাল না। অথচ পাড়ায় খবর আছে, ওদের একজন পদ্মপুকুরে অন্যজন ঝিনকি গ্রামে আত্মীয়র বাড়ি রয়েছে। লোক মারফত কমিটি চেষ্টা করেছে তাদের গ্রামে ফিরিয়ে আনতে। দোষ কবুল করলে তাদের শাস্তি মুকুব করা হবে আটচালার এই বিধানটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সেই কথা কমিটিকে বলেছিল বলেই তাদের কথার মান রাখতে এই বিধান দেওয়া হয়। কিন্তু ছেনোর পরিণতির কথা ভেবে তারা এখনো কমিটির উপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাদের জানা নেই কেমন করে কবে তারা বাড়ি ফিরবে?
ক্রমশ…