(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[পনেরো]
পরেশের বউ সনকার সঙ্গে সল্টলেকের বাবুর-বাড়ির মালিক চন্দনের সম্পর্ক এখন আর ওই গতানুগতিক কাজের মাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তিগত ভাবে বাড়ির মালিকের সঙ্গে সনকার সম্পর্ক যেমন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় এসে ঠেকেছে তেমনই ওদের পরিবারেরও একজনের মত হয়ে গেছে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তরণ সনকার কাজের যোগ্যতার নিরিখে সম্ভব হয়েছে। আর পুরুষ মালিক আকৃষ্ট হয় তার যৌবনের তীব্র আর্তিতে। অবশ্যই এই সম্পর্ক বৈধতার বিচারের কষ্ঠিপাথরে সায় না নিয়েই। সেই নিয়ে চন্দনের পরিবারে ব্যাপক ঝড়ঝাপটা বয়ে যায়। রূপসা কেন চাইবে তার স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুক? তাও আবার বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে! সুস্থ সামাজিক ভাবনায় ঋদ্ধ কোন নারী কি তা মেনে নিতে পারে? পারে না। রূপসাও তাই পারেনি। রূপসা তাই প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দোষারোপ করে চলে। অবশ্য নিতান্তই সরল বিশ্বাসে স্বামীর কষ্ট লাঘবের কথা চিন্তা করে দিল্লীতে বিয়েবাড়ি যাবার সময় সনকাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। শ্বাশুড়ি-স্বামীকে দেখভাল করার জন্যে। মুহূর্ত সময়ের জন্যেও এই ভাবনা ঝিলিক মারেনি যে যুবতী ওই কাজের মেয়ের সঙ্গে চন্দন কোন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। দিল্লী থেকে ফেরার পর চন্দনের ব্যবহারে কেমন যেন বিরুদ্ধ স্রোত বয়ে যাবার লক্ষণ সে প্রত্যক্ষ করে! দিল্লী যাবার আগে তার সঙ্গে চন্দনের ব্যবহার আর পরের ব্যবহারে এতটা খটকা লাগার মত হ’ল কেন তা বুঝতে রূপসার বেশ কিছুদিন সময় লাগে। রাতের বেডরুমে স্বামীর আচরণে সে প্রথম টের পায়। বেডরুমে তার প্রতি আকর্ষণ রাতারাতি যেন কেমন তলানিতে এসে ঠেকেছে। অথচ রূপসা যে স্বামীর সঙ্গে শয্যা বিনিময়ে অপারগ তা তো নয়! বরং পূর্ণমাত্রায় আগের মতো তা বর্তমান। স্বামীর আদর খাওয়া তো দূরের কথা উল্টে অনাদরে তাকে বিদ্ধ করতে থাকে, “গায়ের কাছে সেঁটে এসে বিরক্ত করবে না তো! সরে যাও। আমার ভাল্লাগছে না। শান্তিতে একটু ঘুমোতে দাও। তোমার চোখে ঘুম নেই না কি?” চন্দনের এমন আচরণে তাজ্জব বনে যায় রূপসা! এ কোন্ চন্দনের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? এ তো সে চন্দন নয়? দাম্পত্য সম্পর্ক যে একটা নতুন বাঁকে এসে পড়েছে সেই সময়ই টের পায় রূপসা। তা আরও স্পষ্ট হল যখন ও নিশ্চিত হয়, সনকার সঙ্গে চন্দনের অবৈধ্য যৌন সম্পর্কের বাস্তবতা। মেনে নিতে পারেনি রূপসা। যেমন সুস্থ অবস্থায় কোন নারী তা পারে না। পত্রপাঠ সনকাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান দেয় সে। কিন্তু তাতে বাধ সাধে চন্দন স্বয়ং এবং রূপসার উপর শারীরিক অত্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি সে। একজন ঝি-মেয়েমানুষের সামনে এইভাবে অত্যাচারিত হওয়া, অপমানিত হওয়াটা তাৎক্ষণিক ভাবে তার মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক ছুটে দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে কার্নিশ টপকে মরণঝাঁপ দেওয়াটাই সঠিক বলে মেনে নেয় সে। কিন্তু মরণ তাকে বরণ করেনি। হাসপাতাল থেকে অবশেষে প্রাণ নিয়ে ফিরে এল ঠিকই কিন্তু সুস্থ জীবন আর ফিরে পেল না রূপসা। চলাফেরার শক্তি স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলল সে। শরীরের নীচের অংশ অবশ হয়ে রূপসা এখন তাদের বেডরুমের বিছানার স্থায়ী বাসিন্দা। যে বিছানা একদিন ছিল তার আর চন্দনের দাম্পত্য ভালবাসার স্বর্গসম।
চন্দন এখন আর এই বিছানা ছোঁয়া তো দূরের কথা, দেখতেও আসে না। বিছানাটা কেমন আছে। কতটা খারাপ আছে। তাও না। সনকার চোখের আয়নায় নাকি মাঝে মাঝে রূপসা দেখে তার অতীত দাম্পত্যের অতিথিকে। সনকাই সে কথা তাকে বলে, “বাবুকে আমি আপনার খবর দিই গো বৌদি। তখন শোনে কথাগুলো। কখনো উত্তর দেয়, কখনো চুপচাপ শুনে চলে যায়। কস্মিন কালে কিছু মনে হলে হয়তো জিজ্ঞেস করে, বৌদি কি করছে, ঘুমিয়ে না জেগে। তখন বলি, ওনার তো ঘুম-জাগায় কোন ফারাক নেই। এ প্রশ্ন করা তো মুর্খামি। যান না, একবার বৌদির সঙ্গে কথা বলে আসুন না। কথা বলতে তো অসুবিধা নেই। এই কথা বললে বলে, কথার ভাঁড়ার যে শূন্য। ওই শূন্য ভান্ডার আর পূরণ হবে না সনকা। এখন তোমার যত্নের ভাঁড়ার যতদিন না ফাঁকা হয়, তুমি বৌদিকে সেবা করে যাও সনকা। তাহলেই বৌদি ভাল থাকবে। আমাকে নিয়ে আর টানাটনি কোরোনা। আমাকে আমার মত থাকতে দাও।” সনকার বুঝতে অসুবিধা হল না, দিনের পর দিন বাবু বৌদিমণির সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করেছে তা আর সহ্য করতে না পেরেই তো সে আত্মহত্যা করতে যায়। মরণ ওকে টেনে নিলেই বরং মুক্তি পেত বৌ-টা। কত কষ্ট পাচ্ছে। এখন বাবু সেই কষ্ট দেখে আফসোস করছে। নিজের বিবেকের সঙ্গে তাকে যে নিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। বাবুর এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই তার ভেতরের যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। সনকা নিজে কি ধোয়া তুলসীপাতা! সেও তো বাবুর সঙ্গে সম-দোষে দোষী। সে যদি বাবুকে প্রশ্রয় না দিত তাহলে তো বৌদিমণির হাতছাড়া হত না বাবু! তাই বৌদিমণির এই পরিণতির দায় থেকে সেও মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাবুকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। তার এবং তার লোচনের জীবনের প্রশ্নে সে বাবুর সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য ছিল। নাহলে বাবু তাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিত। তখন তো তাকে আবার জনারণ্যে ভেসে বেড়াতে হত। কুকুর-শেয়াল ছিঁড়ে খেত তার ভরা যৌবনকে।
সকলেই প্রথম ভালবাসে নিজেকে। তারপর দ্বিতীয় পছন্দ অন্য কেউ। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল, চন্দন-বাড়ির অঘোষিত মালকিন সনকা। সনকা ছাড়া এই বাড়ির সূর্য উদয় হয় না, ডুব সাঁতারও দেয় না। চন্দনবাড়ির সংসার এখন তার সংসার। পাকাপাকিভাবে বিছানা নেওয়া চন্দন-বৌদির যাবতীয় বাসি কাজ নিজের হাতে সারে সনকা। যে সনকার জন্যে রূপসা বৌদির আজ এই বিলম্বিত যাত্রাপথ সেই সনকাই এখন তার জীবন বৈতরণী পার করার একমাত্র যষ্ঠী। প্রিয় সনকা এখন তার যেন চোখেহারা সাথী। কত জন্মান্তরের সঙ্গী যেন সে রূপসা বৌদির। এখন সনকা যদি রূপসার বকলম নিয়ে চন্দনকে স্বামী ভাবনায় সময়ের সঙ্গী হয় তো রূপসার কোন আপত্তি নেই। চন্দনের তো নয়ই। তবে বৈধ্য স্ত্রী বেঁচে থাকতে তো সনকাকে বৈধ্যতা দেওয়া যায় না। তাই এতটুকু যা দূরত্ব চন্দন-সনকার। বাদবাকি যাবতীয় দাম্পত্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেওয়া নেওয়ায় একাকার এখন ওরা। হয়তো জীবনচলনের বাধ্যতায় রূপসাকে ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু রূপসার মন কি তাতে দু’হাত তুলে সায় দিতে পারে? না তা হয় না। যদি সেটাই হবে তো তখনই সে ওদের এই অবৈধ্যতাকে মেনে নিতে পারতো। তাহলে তাকে আজ এই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হ’ত না! সত্যিই রূপসা আজ এই বিকলাঙ্গ দেহটাকে বিছানায় লটকে রেখেও ভেতর থেকে মানতে পারেনি। এটা তো যে কোন বিবাহিত নারী জীবনের শাশ্বত ভাবনা। ওই বা সেই ভাবনা থেকে কেমন করে বেরিয়ে আসতে পারে? পারে না। তাই নিয়ত ও সময়ের কাছে করজোড়ে তার হৃদয়চলনকে থামিয়ে দেবার জন্যে কামনা করে চলেছে। সনকার কাছে যেমন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত জীবনের প্রেরণার নব নব উৎস। তেমনই রূপসার কাছে সব অচল পয়সা ছাড়া আর কিছু নয়। যাবতীয় অনীহা এখন তার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে শেষের সেদিনের পথ চেয়ে অপেক্ষায়। এ অপেক্ষার কবে সমাপ্তি ঘটবে তা কে জানে! কেউ জানে না। সে তো জানেই না। জানে না চন্দন-সনকা। জানে না আকাশ বাতাস, জানে না ধূলিকণাও।
চন্দন চেয়েছিল তার গর্ভ-হ্রদে একটা নতুন ভ্রুণ সাঁতার কেটে বেড়াক। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সনকা, “এ তুমি কি আবদার করে বসলে বাবু? আমরা চাকর বাকর মানুষ। কপালগুনে তোমার দেহসঙ্গী হতে পেরেছি। সেটা আমার সৌভাগ্য। এই আব্দার মেনে নিয়ে আর আমার ভাগ্যকে আকাশপানে ছুড়ে দিতে চাই না। একবার ছুড়ে দিলে পড়ার সময় আলগোছে ধরে নেবার ক্ষমতা তোমার যেমন হবে না। আমারও না। তখন আমার ভাগ্য ভূপাতিত হওয়া ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু থাকবে না। বাবু, এই জন্যেই কি তুমি আমার লোচনের চাকরির ব্যবস্থা করে সেই বিদেশ বিভুঁই, বোম্বেতে পাঠিয়ে দিলে? এই হাত জড়ো করে তোমার কাছে ভিখ্ মাঙছি বাবু। আমার কপাল আর বৌদিমণির কপাল একাকার করে দিও না। তার থেকে বরং আমি দেশের বাড়ি ফিরে যাই। বাকি সময়টা ওখানেই কাটিয়ে দেব। না না, তোমাকে ভাবতে হবে না। যতদিন বৌদিমণির প্রাণবায়ু ধুকপুক করছে, ততদিন না হয় আমি এখানে দিনপাত করলাম। আমার মনের কষ্ট এই বৌদিমণির জন্যে। আমি যদি যৌবনের ঝাপটায় তোমার সঙ্গে লটরপটর না করতাম তাহলে তো বৌদিমণির এই পরিণতি হত না। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তটা আমি করে যেতে চাই।”
তবে বাবুর কাছে সনকা চিরঋণী হয়েই থাকবে। এই বাবু তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় না দিলে তার জীবনটাও তো দরিয়ায় ভেসে ঠিকানাহীন হয়ে যেত। পোদ পাড়ার ওই বাদল শয়তানের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এই বাবুর জন্যেই। যেদিন থেকে বাবু বুঝে গেছে, ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যে বাদল আসে তা তার আত্মীয়তার কর্তব্যের দায় মেটাতে নয়, সনকার প্রতি তার যৌন লালসা চরিতার্থ করতে। তখন থেকেই বাবু এ’বাড়িতে তার আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সনকাও মন থেকে সেটা চাইছিল। তখন থেকে সনকা বাড়ির বাইরে কোন কাজে গেলে সঙ্গে বাবু থাকে। কয়েকবার আশপাশে বাদলকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেওছে সনকা। পাত্তা দেয়নি। যেন চেনেই না তাকে, এমন আচরণ করে তার গা ঘেঁষে চলে গেছে।
সনকার সঙ্গে চন্দন বাবুর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠতা ছুঁয়েছে তার ছেলে লোচনের ওপর বাবুর নজরও পড়েছে ততটাই আগ্রহের সঙ্গে। বাবুর চেষ্টাতেই লোচন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষিত হতে পেরেছিল। না হলে তার তো মুর্খ হয়ে বেঁচে থাকার লিখন দেগে দেওয়া ছিল। বাপ জেলে। নিরুপায় সনকার ক্ষমতা তখন কোথায়, ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার? ছেলের সেই ভবিতব্য খন্ডন করেছে এই চন্দন বাবুই। যে মানুষটা তার জন্যে এতটা করতে পারে তো সেই মানুষটাকে তার বয়ে যাওয়া যৌবন যদি উজাড় করে সে দেয় তাতে তার অন্যায়টা বা কোথায়! সনকা তো সেখানে অন্যায় কিছু দেখে না। না, রূপসা বৌদির কথা তুলেছিল সনকা। তাদের সঙ্গে দেহজ ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে বৌদির কথা তুলেছে সনকা, “আমার শরীরের ওপর তোমার এত লোভ কেন গো বাবু? অত সুন্দরী বৌদিমণি থাকতে। আমি এক পাড়া গাঁয়ের মেয়ে। অবহেলায় যার জীবন-যৌবন কাটে। তার প্রতি তোমার এত লোভ কেন? আমাকে পেয়ে তুমি এমন করছো যেন জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েমানুষের সঙ্গ পেলে তুমি। কেন, বৌদিমণি তোমাকে সুখ দিতে পারেনে? তা তো হয় না। তাহলে তোমাদের ছেলেটা হল কেমন করে? পুরুলিয়ার মিশনে তোমাদের ছেলেটা যে পড়ে, সে কি তোমাদের দু’জনের বাচ্চা না? না কি আমার মত অন্য কোন সনকা তুমি জুটিয়ে রেখেছো। ও তার গর্ভে জন্মেছে?” এই কথা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় চন্দন বাবুর! সনকার শরীর ছেড়ে উঠে পড়ে চোখ কটমট করে বলে, “এই কথা তুমি দু’বার আর বলবে না। ও আমার আদরের সন্তান। ওকে আমরা, আমি-রূপসা মন থেকে চেয়ে পৃথিবীতে এনেছি। তুমি না জেনে সাংঘাতিক একটা খারাপ কথা বলে ফেলেছো সনকা। এবারের মত তুমি ছাড় পেয়ে গেলে, তোমার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়েছি বলে। কোন আলগা কথা আমার নামে বলে ফেললে আমি মাফ করে দিতে পারি। আমার সন্তানের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন কথা বলার সাহস তুমি দেখাবে না, সনকা।”
এমন সুন্দর ঘনিষ্ট মুহূর্তটা এই সন্তানের কথাটা তুলে যেন জোলো হয়ে গেল। দু’জনেই অতৃপ্ত মনে যেন ফুঁসতে থাকে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরিবেশকে স্বাভাবিক করতে প্রাণ ভরে জড়িয়ে ধরে বাবুকে, “বাবু, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ক্ষমা চাইছি বাবু। একবারের জন্যে আমাকে ক্ষমাঘেন্না করে দাও। দু’বার আর মুখ থেকে কু’কথা বার হবে না। কথা দিলাম বাবু।”
সনকার স্বীকারোক্তিতে গলে জল হয়ে গেল চন্দন। সনকার উত্তুঙ্গ দু’বুকের পেলব স্পর্শ তাকে যেন পুনরায় উত্তেজনায় শিহরিত করে তুলতে থাকে। চন্দনের সেই শিহরণ সনকা আহরণ করতে করতে কখন যেন পরস্পর পরস্পরের মধ্যে হারিয়ে যায়। সনকাতে নিঃস্ব হয়ে চন্দন তৃপ্ত হয়ে বলে “তুমি যে বৌদিমণির কথা প্রথমে তুলেছিলে, সেই কথায় টান দিয়ে বলি, আমি তো কোনদিন তোমার বৌদিমণিকে অসন্তুষ্ট করিনি। বরং বৌদিমণি সবসময় আমাকে পূর্ণ ভাবে নিঃস্ব করতে পারেনি। যেটা তুমি পারো। তোমাতে আমি তাই সন্তুষ্ট। তবে তোমার বৌদিমণিকে আমি পূর্ণ মাত্রায় তুষ্ট করে এসেছি। এখনও করতে আমার কোন বাধা নেই। বাধা আসছে তোমার বৌদির দিক থেকে। আসলেও এখানে আমার কিছু করার নেই। সমস্যাটা তোমার বৌদিরই।”
বোম্বেতে চাকরিটা ভালোভাবেই করতে পারছে লোচন। ওখানকার পরিবেশটা ও মানিয়ে নিতে পেরেছে। প্রথম প্রথম কোলকাতার কথা খুব বলত। এখন আর বলে না। আসতে বললে আসতেও চায় না। চন্দনবাবু এ কাজটা দেখে না দিলে ও কোথায় কি করতো কে জানে। ছেলে ওখানে ভালো আছে, তাতেই মা সনকার মন ভাল। আরও মন ভাল হয়ে যায় যখন ও ওখানকার একটা মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে চায় খবরটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় সনকা। এবার মা’কে নিজের কাছে রাখতে চায় লোচন। কিন্তু চাইলেই তো সবসময় সবকিছু পাওয়া যায় না। সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়টার জন্যে ছেলেকে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিল সনকা।
[ষোল]
পরেশের ছেলে লোচন যা প্রস্তাব দিল, তারপর অনুকুল কুম্ভকারের ওই জমি কিনতে অস্বীকার করার আর অবকাশ থাকল না। ও যে দাম দেবে সেই দামেই সে বিক্রি করতে রাজি। তাই বলে তো আর সেই সুযোগ নিয়ে একটা যাচ্ছেতাই দাম দেবার কথা বলতে পারে না। হয়তো বাজার চলতি দাম থেকে কিছুটা কম দাম সে দিতে পারে। বাজার চলতি বলতে এই রুইদাস পাড়া এলাকার মধ্যে সম্প্রতি যে দামে জমি বা বাস্তু বেচা কেনা হয়েছে, হিসেবটা সেই নিয়মেই হতে চায়। কেননা, আশপাশের জায়গা থেকে এখানকার জায়গার দাম অনেকটাই কম হবার কথা। প্রথমত এখানকার জমির চাহিদা কম। গরিব পরিবারের বাস এখানে। অন্যান্য জায়গার মত অত দাম দিয়ে কেনার আর্থিক ক্ষমতা এইসব মুচিদের কারোর নেই। আর বাইরের লোক মরতে এই অজ পাড়ার ভেতরে কেন কিনতে যাবে? এখানে পয়সা ঢেলে তো কোন আয় তার থেকে পাওয়া যাবে না। অনুকুলও অমন জায়গা কিনে তার থেকে এক কানাকড়িও আয় করতে পারবে না। ওই বাঁজা জমিতে বসত ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না, যেমনটা পরেশরা ছিল। তবু এই বাচ্চা ছেলেটার আকুতি আর ওর অসহায় মায়ের মুখের কথা ভেবে তাদের উপকার করতে সে কেনার কথা ভাবছে। মানে টাকাটা জলে ফেলতে যাচ্ছে। এরপর আবার রুইদাসদের মধ্যে যে টাকাপয়সায় একটু সড়গড় তাকে তেলাতে হবে, কেনার জন্যে। তবে তার কারবারের আসল টাকা উদ্ধার হবে। লাভ তো দূর অস্ত। বরং বলা যায় পয়সা দিয়ে জেনেশুনে অযথা ঝামেলা কেনা আর কি। তবু সে নিমরাজি। তবে তার আগে ওদের আটচালার মাতব্বরদের সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চায়। না হলে কেনার পর ওরা যদি তাকে হুড়িয়ে দেয় তো, ‘কানাকেষ্টর ঘটি বাটি সব যাবে।’ অন্যের উপকার করতে যাওয়ার সুড়সুড়ি ঘুচে যাবে।
সময় করে একদিন অনুকুল কুম্ভকার তার চাকিঘরের বসার জায়গায় কিছু দরকারি কথা আলোচনার জন্যে নন্দ আর রতনকে আসতে বলল। যেহেতু আলোচনাটা ব্যক্তিগত পরিসরে। সরাসরি রতনদের আটচালার সঙ্গে যুক্ত নয়। তাই ওদের আটচালায় কথা বলাটা ঠিক হবে না বলেই তার বাড়িতে আসতে বলা। সেটা রাতনরা মেনেও নেয়। অনুকুলের সঙ্গে পরেশের ছেলে লোচনের জমি বিক্রির জন্যে এগিয়ে চলার এত কথা রতনরা জানতো না। লোচন ওদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে কুমোর পাড়ায় না গিয়ে বড় পাকারাস্তা ধরে উল্টোদিক দিয়ে অনুকুলদের বাড়িতে কথা বলে সেই পথেই চলে যেত। অনুকুলের কাছেই প্রথম সেই কথা জানতে পারে রতনরা।
পরেশের ছেলে তোমাকে তাদের বাস্তুজমি বেচলে আমাদের কোন আপত্তি নেই অনুকুল দা। সে তো আমাদের কমিটির পাশ করা কথা যে রুইদাসদের কেউই সরাসরি পরেশের বাস্তু কিনতে পারবে না। বাইরের কেউ কিনলে, তার কাছ থেকে যদি কারোর সামর্থ থাকে তবে তাদের পাড়ার কেউ কিনতে পারে। তবে অবশ্যই যে কিনেছে সে যদি কোন চাপের কাছে মাথা নীচু না করে কাউকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় তবে। কিন্তু এর পরও একটা কথা আছে দাদা। কথা হল কি, পরেশের ছেলে লোচন ওই জমি বিক্রি করার অধিকারী কি না। আমরা যতটুকু জানি, জমিটা পরেশের বাবার। সেই সূত্রে পরেশই ওটার প্রথম হকদার। তা প্রথম হকদার, পরেশ তো মরে যায়নি। দিব্য বেঁচে আছে এবং খুনের দায়ে জেল খাটছে। পরেশ যদি মরে যেত, তখন না হয় পরবর্তী ওয়ারিশন হত এই লোচন। তুমি যে জমিটা কিনবে, দলিলে তো পরেশের সই থাকবে না। থাকবে তার ছেলের। বড় জোর ছেলের মায়ের। সেটা আইনত সাব্যস্ত হবে কি না ভাল করে জেনে তবে কেনা দরকার। আমাদের এই কথাটা বলার কারণ, ওই জমিটায় তো তুমি বাসের জন্যে বাড়ি বানাতে যাবে না। তোমার এখানে এতবড় মহল-বাড়ি। তাহলে খদ্দের পেলে তুমি সেটা বিক্রিই করবে। কিনবে আমাদের পাড়ারই কেউ। যে কিনবে সে যাতে ফাঁপরে পড়ে না যায় সেটাও দেখা দরকার। পরেশের তো আমরণ যাবজ্জীবন হয়নি। শুধু যাবজ্জীবন। তা আমাদের দেশের যা আইন তাতে যদি ইতিমধ্যে ও জেলে মরে না যায় তাহলে একদিন না একদিন ও ছাড়া পাবে। তখন এসে পরেশ যদি তার জায়গা দাবি করে বসে? বলে, আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলে কি করে জায়গা বেচে? এ বেআইনী। তখন তো যে কিনবে আবার আইনী ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। তখন তার ছেলে-বউ ওকে কতটা সামলাতে পারবে সেটা তো ওরাই ভাল করে বলতে পারবে। সেসব কথা পরেশের ছেলের সঙ্গে ভাল করে বলে তবে কেনা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। কথাগুলোর উপর বেশ চাপ দিয়ে রতন বলল।
রতন শেষ করতেই নন্দ বলল, “দেখতে দেখতে তো চোদ্দ বছর হয়ে গেল পরেশের জেল খাটা। মনে হয় আর বেশিদিন ওকে জেলে থাকতে হবে না। সেটা উকিলের সঙ্গে কথা বললে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার যতটুকু জানা, পরেশ এবার ছাড়া পেতে পারে। আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখলে মনে হয় ভাল হবে। এতদিন তো পড়ে আছে জায়গাটা। আরও ছ’মাস কি এক বছর না হয় অপেক্ষা করবে পরেশের ছেলে। এবার তুমি দেখো অনুকুলদা। কি করবে। তবে এই অসুবিধাগুলো না কাটিয়ে তুমি জায়গা কিনলে পরে বিক্রি করতে তুমি পারবে না। জেনেশুনে ওই ঝামেলার মধ্যে আমাদের পাড়ার কেউ ঢুকতে যাবে না। এরা সব গরিবগুর্বো মানুষ। পয়সা দিয়ে কেউ বিপদ কিনতে যাবে না।”
রতন আর নন্দের কথায় অনুকুল কুম্ভকার বেশ ধন্ধে পড়ে যায়। রতনরা যে একেবারে উড়িয়ে দেবার মত কথা বলল তা কিন্তু নয়। ওর টাকা আছে বলে তো জেনেশুনে তা বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পারে না। খেটে টাকা রোজগার করতে হয়। সত্যি তো। জেলখাটা পরেশের সঙ্গে তার ছেলে বউয়ের সম্পর্ক তো বহুদিন বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন তার গ্রামের সঙ্গে। এতদিন ওর ছেলে বউ একরকম জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার আগে অন্যভাবে চলেছে। এখন আবার সেই পুরোনো জীবনে ফিরে আসা ওদের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। পরেশের জীবনের ছন্দও তো ওলটপালট হয়ে গেছে। জেলখাটা আসামীর মন ফাঁকায় এসে কি রূপ নেবে তা একমাত্র সময়ই বলতে পারে। পরেশের ছেলে লোচন আবার বোম্বেতে কাজের সূত্রে থাকে। সেখানকার আধুনিক চালচলন কোলকাতার থেকেও অন্যরকম। সেই মন, কোলকাতায় ওর মায়ের মন আর জেল ফেরত পরেশের মন কত যে ফারাক অভ্যাসে অবস্থান করছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাই ভাল করে না বুঝে না শুনে তার পক্ষে এগোনো আর সম্ভব নয়। লোচন তাড়াহুড়ো করতেই পারে। তাই বলে সে তার তালে ভিড়ে গেলে চলবে না। ব্যবসায়িক চাল এখানে তাকে চালতেই হবে।
বোম্বে থেকে অনুকুল কুম্ভকারকে ফোন করলে লোচন অবগত হয় তাদের বাস্তুজমির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে অনুকুলের আশঙ্কার কথা। অত অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে চাইছে না অনুকুল কুম্ভকার। ওনাদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন প্রশ্ন আসতে পারে তা একদম ভাবতে পারেনি লোচন। তার বাবা সমেত তাদের পরিবারের কাছে ওই জমি এখন বদ্ধভূমি ছাড়া আর কিছু নয়। সেই জমি বেচে দিলে বাবা বাধা দেবে তা হতে পারে না। সে বা তার মা ছাড়া বাবার এই পৃথিবীতে আর কে আছে। আর বাবা জেল থেকে ছাড়া পেলে কোনদিন সে বাবাকে ওই গ্রামে নিয়ে যাবে না। মানুষ-খুনি বলে লোকে তার বাবাকে দুয়ো দেবে, তা প্রাণ থাকতে সে মেনে নিতে পারবে না। অত ছোট্ট বেলায় বাবা তাকে ছেড়ে মা’কে ছেড়ে জেল খাটতে বাধ্য হয়েছিল। বাবার মুখ অনেক বড় হয়ে সে চিনেছে। জেলে নিয়ে গিয়ে মা তাকে চিনিয়ে দিয়েছে বাবার মুখ। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, “তোর বাবার মত শান্ত কর্মঠ ভাল মানুষ ওই পাড়ায় কম ছিল রে বাপ। ওই গরু কাটা, ছুরি, ইনবাইস, কুরপি আরও কত কি এইসব নিয়েই মুচিদের দিন কাটে। ওটাই তাদের জীবন জীবিকার প্রধান পথ। তা সংসারের জন্যেই তো তোর বাবা কাজ করতে ভাগাড়ে গিয়েছিলো। পেটের জ্বালা মেটাতে ঘটনাক্রমে তোর বাবা একটা ভুল করে ফেলেছিল। সেটা মেনেও নিয়েছিল সে। কিন্তু দেশের আইন, সমাজ তাকে খুনি হিসেবেই দেগে দিল। কেন এমন কাজ ওই শান্ত মানুষটা করে ফেলল সেসব তখন কেউ বিচার করে দেখল না। অথচ এই মানুষটা রাগের বসে অকাজটা করে ফেলেছে স্বীকার করে সকলের কাছে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। কেউ ক্ষমাভিক্ষা দিল না। তোর বাবাকে জেলের ঘানি টানতে বাধ্য করালো এরা। পাড়ার একটা মানুষও কথার-কথায় আমাদের ওপর দরদ দেখালো না। দেখালে আমাকে তিন মাসের মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নিদান দেয়? কারোর হৃদেতে একটু দয়াও হল না যে, এই মেয়েটা চার বছরের একটা শিশুকে নিয়ে কার কাছে যাবে, কোথায় দাঁড়াবে? তোর বাপের, আমার বাপেরবাড়ির তিনকুলের কোন আত্মীয় বেঁচে নেই যে তাদের দাবায় গিয়ে দাঁড়াবো। তোকে নিয়ে আমি ভেসে গেলাম অকুল দরিয়ায়। ওই দুলাল কাকার হাত ধরে এই চন্দনবাবু যদি আমাদের ঠাঁই না দিত, কুকুর-শেয়ালে আমাদের মায়ে-পোয়ের জীবন ছিঁড়েকুটে ছিবড়ে করে শেষ করে দিত। একদিন না একদিন তোর বাবা তো জেল থেকে ছাড়া পাবেই। জেলে পচে মরে গেলে আলাদা কথা। উপরঅলা এই পোড়া কপালে কি রেখেছে জানি না। তবে যদি ফিরে আসে তো বাবাকে তোর কাছে আশ্রয় দিস বাপ। আমিও আর তোকে ছেড়ে এখানে পড়ে থাকবো না। তিন জনে নতুন করে আবার সংসার পাতবো।” সেই নির্বিবাদী ভালমানুষটা, আমার বাপ কিনা আমাদের কাজের বিরোধিতা করবে! এটা কোনদিন হয়? তেমন প্রয়োজন হলে অনুকুল কাকাকে, বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জেলে নিয়ে যাবো। বাবার সামনে কথা বলিয়ে দেবো! তাহলে তো তখন আর আপত্তি থাকবে না। হয়তো কয়েদখানায় থাকার জন্যে জমির দলিলে বাবার সই দেয়াতে বিধিনিষেধ থাকতে পারে। অমন ঝুঁকি সে নিতেও চায় না। তখন হিতে বিপরীত হলে অন্য বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে ওরা। দরকার কি। বাবার যে আপত্তি নেই, সেই কথাটা ওনার সামনে মুখ ফুটে বাবা বললেই তো হল। একবার মুখ ফুটে বলে পরে অস্বীকার করবে এমন মানুষ পরেশ রুইদাস নয়।
অনুকুল কুম্ভকারের সঙ্গে তো কয়েকবার দেখা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি পেশের পর শেষ পর্যন্ত রাজি করতে সক্ষম হয় লোচন। রাজি হয় অনুকুল কুম্ভকার তাদের জায়গাটা কিনতে। তা হঠাৎ আবার এই মালিকানার প্রশ্নটা তুলল কেন বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই তাদের রুইদাস পাড়ার কেউ তার কান কামড়েছে। হয়তো বাবাকে যারা পছন্দ করে না তাদের কেউ এমন কাজটা করেছে। তারা চায় না পরেশের ছেলে তাদের বাস্তু বেচে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলে দেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যে সফল হবে না তা লোচন নিশ্চিত। বোম্বে থেকেই ফোন লাগালো অনুকুল কুম্ভকারকে, “কাকা, আমি মা এবং বাবার অনুমতি নিয়েই এই জমি বিক্রির কাজে হাত দিয়েছি। জেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে বাবার সঙ্গে কথা বলে বাবার মতামত নিয়েছি। এর পরও যদি আপনার কোন প্রশ্ন থাকে তো সরাসরি বাবার সঙ্গে আপনার কথা বলিয়ে দিতে পারি। তাহলে আপনাকে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখে জেলে আসতে হবে। আপনি সেটা করতে চাইলে আমাকে বলবেন। আর তা না করে যদি আমাকে বিশ্বাস করেন তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটা রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করুন। জেনেশুনে আপনাকে বিপাকে ফেলার কোন ভাবনা আমার নেই। তাছাড়া সেটা আমি বা করতে যাব কেন। আপনি কি আমার শত্রু? না, তা তো নয়। আপনি আমার বিপদে পাশে দাঁড়ানো উপকারি স্বজন। স্বজনের ক্ষতি কোন সভ্য মানুষ চাইতে পারে না। তাছাড়া আপনার কথা মা খুব বলে। মা বলে, পয়সা তো অনেক মানুষের থাকে। বেশির ভাগেরই দম্ভে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু মা বলে, আপনি ঠিক তার উল্টো মনের মানুষ। সব মানুষের সঙ্গে আপনি, আপন মানুষের মত ব্যবহার করেন। এমন যে মানুষ, সেই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে পাপ তো হবেই সেইসঙ্গে তারও একদিন না একদিন ক্ষতি হবে। সেই শিক্ষাই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি, কাকা।”
লোচনের এমন গুছোনো কথায় সন্তুষ্ট হয় অনুকুল। এর পর আর কোন কথা না তুলে বলল, “ঠিক আছে। মুহুরির সঙ্গে কথা বলে কাগজপত্র তৈরী করে তোমাকে আমি খবর দিচ্ছি। সেইমত তুমি মা’কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
[সতেরো]
ছেলেটার জন্যে রতনের যেন চিন্তার শেষ নেই। এবারে আবার মাধ্যমিকটা পাশ করতে সেই চিন্তা আরও বেড়ে গেল। সে নাকি পড়া ছাড়বে না। ইলেভেনে ভর্তি হবে। কথাটা শুনেই রতনের মাথায় হাত! বলে কি রে ‘গোহর ব্যাটা’! টেনেটুনে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে কত কষ্টে এতটা পড়াতে পেরেছে সে। এর পর আবার! ও ভাবছিল এবার ছেলেকে নিজের কাজে টেনে নেবে। আর পেরে উঠছে না। বয়সটাও আস্তে আস্তে চোখ বুজোনোর সময়কে ছুঁতে দৌড়চ্ছে। সনাতনের মায়ের সাথে সেই কথাটাই হচ্ছিল, “আর আমার একার পক্ষে সংসার টেনে নিয়ে চলা যাচ্ছে না গো। ছেলেটা এবার তো একটু হাতে ধরা হয়েছে। পাশও করল একটা। অনেকটাই হয়েছে। এই পাড়ায় ওই মিলনের মেয়ে অলোকার পর এখনো কেউ মাধ্যমিক টপকাতে পারেনি। তোমার সনাতন আবার প্রথম কুড়ির মধ্যে সতেরো। গর্বের কথা। গর্ব হচ্ছে আমার। কিন্তু এই গর্ব বুকে আগলে বসে থাকলে তো পেট শুনবে না। এই রাক্ষসটাকে তো সময় মেনে চাহিদা পূরণ করে যেতে হবে। ছেলেকে এবার ঢাক বাজানো, গরুর চামড়া ছাড়ানো, জুতো তৈরী, সেলাই সব আমাদের মুচিদের যা কাজ, সবটাই আস্তে আস্তে শিখিয়ে দিতে হবে। আর ওই কুনকে, সের, পালি বা ধামা বোনার কাজগুলো চলতে ফিরতে শিখিয়ে দিলে চলবে। ও যা মাথাওয়ালা ছেলে, কয়েকবার দেখিয়ে দিলেই ওগুলো পেরে যাবে। এখন অতটা জরুরী নয় ওগুলোর কাজ রপ্ত করার। তাছাড়া এইসব বেতের কাজের এখন তো আর বাজার তেমন নেই বললেই চলে। প্লাস্টিকের ড্রাম, বাটি ইত্যাদি উঠে গিয়ে বেতের জিনিস কেউ আর কিনতে চায় না। বেত তো অত সস্তার জিনিস নয় যে প্লাস্টিকের দামে বিকোবে! মানুষ সব আজকাল কম দামের জিনিস খোঁজে। কিন্তু প্লাস্টিক যে মানুষকে কত ক্ষতি করে তা সকলে জেনে বুঝেও সেই আগুনে হাত বাড়ায়। তা মানুষের ভালমন্দ মানুষ বুঝবে’খন। নিজের ভাল কিসে হয় সেটাই এখন আমাদের লাখটাকার প্রশ্ন। সংসারের হাতে ধরার মত করে দিতে যেটুকু এখন শেখানো দরকার সেইগুলোই ছেলেটাকে শেখাবো ঠিক করে আছি। এতদিন ধরে এই যখন তার ভাবনা-পরিকল্পনা, ওই একটা বাক্যে তার সবটায় জল ঢেলে দিল বেটা আমার! এখন আমি কোথায় যাই, কি করে বোঝাই যে তোদের ঘরের ছেলেপিলেদের বেশি লেখাপড়া করতে নেই। বেশি পড়া শিখলেও কেউ তোকে চাকরি দেবে না। নীচু জাতকে বাবু জাতেরা ঘেন্না করে। তার উপর আমরা চর্মকার-মুচি। হিন্দু হয়ে গরুর চামড়া-মাংস ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমাদেরকে তো বাবুরা দেখতেই পারে না। চোখের বিষ। সেই আমাদের পোলা হয়ে তোরা লেখাপড়া শিখে ওই বাবুদের পাশের চেয়ারে বসে আফিসে চাকরি করবি? এ কোনদিন সম্ভব না রে বাপ। কেন শুনবে বেটা, এই প্রায় মুর্খ বাপের কথা। শিক্ষিত মাস্টারের কথা শুনবে! আর ওই মাস্টাগুলোও হয়েছে তেমন। ওরাই ওর মাথাটা খাচ্ছে। বিশেষ করে অমর স্যারটা। সনাতন মাধ্যমিকে সতেরো হয়েছে। লেখাপড়ায় এত ভাল। পরিবার এবং অন্যদের একটু সাহায্য পেলে অনেক উপরে উঠতে পারবে ও। তারপর সরকারি সংরক্ষণের সুযোগে তরতর করে এগিয়ে যাবে। এদের উৎসাহ দেবার জন্যেই তো সরকার সমাজের এই পিছিয়ে পড়া অংশের উচ্চ শিক্ষায় বা চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের ঘরের ছেলে, উজ্জ্বল সম্ভাবনা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সে কেন পড়া চালিয়ে যাবে না। যতই অভাব-কষ্ট থাক, পড়াশোনা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে হবে সনাতনকে।”
অমর স্যার কিছু বললেই যেন ছেলেটা তা বেদবাক্য ধরে নেয়। একবার যদি কোন কথা এর মাথায় গুঁজে দেয় তো বেটাচ্ছেলেকে কার বাপের সাধ্যি সেখান থেকে বার করে আনতে পারে! আমাদের মত গরিব ঘরে এসব মানায় নাকি? এই মাধ্যমিকের সময় কি চাপটাই না খেতে হল। একবার বলল, “একটা ছাত্রবন্ধু আনতে হবে বাবা।” তো একসপ্তা পরেই বলে বসল, “আমাকে টেস্ট পেপার কিনতে হবে। অমর স্যার বলেছে। টেস্ট পেপার দেখে প্র্যাকটিস না করলে নাকি ভাল রেজাল্ট করা যাবে না।” বলল তো তাই মাধ্যমিকের সময়! তা উঠোউঠি এইরকম বই কেনার চাপ দিলে সেও বা তার দাম জোগায় কোথা থেকে! কাজের বাজার তো একদম যাচ্ছেতাই। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ধামা পালি সারাই, বিক্রী করে যা সামান্য কিছু রোজগার হয় তাতে একবেলা একসন্ধে পেটে দিয়ে দিন চলে। পাড়া ফিরি করার কাজে কি মোটা পয়সা পাওয়া যায়? যায় না। সেটা বোঝে না ছেলেটা। ওই মাস্টারটাও। রেগেমেগে একদিন সনাতনকে বলেছিল, বাপ কি হাড়ভাঙা খাটনি খেটে দু’পায়সা ঘরে আনে জানিস তো। তার পর এই বই-ফই কেনার চাপ দিলে আমি পারবো কেন? তাও যদি আমার কথা না শুনিস তাহলে এক কাজ কর, আমাকেই বিক্রি করে দে? তাতে যদি তোর চাহিদা মত টাকা পাস তো নিয়ে নে? ক্রীতদাস হয়ে যাই। ছেলে যখন আমার তখন তার মানুষ করার দায়ও বাবার থাকে। তোর অমর স্যার তো জানে আমাদের বাড়ির অবস্থা কেমন। তার পর কেমন করে চাপ দেয় রে? কেমন-তারা মাস্টার, ওই লোকটা?”
রতনের কথায় কেঁদে ফেলেছিল সনাতন। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে আর বই কেনার কথা বলে বাবাকে চাপ দেয় নি। অমর স্যার নিজের চেষ্টায়, গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি করে দেয়। সনাতন মনের ভেতর গুমরে গুমরে আওড়েছে, “আমি ভাল করে পড়তে চাইলেও পড়তে পারব না। আমরা গরিব বলে যেন আমাদের পড়ার অধিকার নেই ! বাবার বা কি দোষ। তাদের পেটে দুটো দানা জোটাতেই বাবা হিমসিম খাচ্ছে। মা এদিক ওদিক থেকে লোকের গরুর গোবর জোগাড় করে ঘুঁটে বানিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বেচে কিছু পয়সা বাবার সংসারে জোগান দেয়। সেই সংসার আবার তার পড়ার খরচ যোগাবে কেমন করে! কিন্তু অমর স্যার বলেছে, পড়া ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তাকে বড় হতে হবে। সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের মত ছোট জাতের, গরিব ঘরের সন্তানরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তুই পারবি সনাতন। তোর হাত দিয়েই সেই কাজ হবে। যত বাধা আসুক। দমে গেলে চলবে না। তুই জানবি, বাধা তোর আসবেই এবং সেই বাধা তোকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অমর স্যারের কথা সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে চায়। কিন্তু সেটা কেমন করে, তা তো সে বুঝে উঠতে পারছে না। উচ্চ মাধ্যমিকের একটা টেস্ট পেপার এখনো সে জোগাড় করে উঠতে পারল না।
হঠাৎ সনাতনের চোখের সামনে ভেসে উঠল পূব-পাড়ার ওই অলোকাদির মুখটা! তাদের বাড়ি থেকে পূব দিকে আট-দশটা বাড়ি পরে অলোকাদিদের বাড়ি। পাশের পাল পাড়ার বিপ্লবদা পড়তো অলোকাদির দু’ক্লাস উঁচুতে। অলোকাদিকে বিপ্লবদার পছন্দ হয়েছিল কি না কে জানে! মনে মনে ভালবাসতোও হয়তো। অসম্ভব কিছু নয়। না হলে পড়া দেখিয়ে দেবার ছুতোয় ঘনঘন এ’পাড়ায় ও আসবে কেন। এমনিতে পালপাড়ার লোকেরা একটু নাক উঁচু। লেখাপড়া, টাকাপয়সা, সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা রুইদাসদের ওরা কেমন যেন বাঁকা চোখে দেখে। তাই নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওরা তাদের রুইদাসপাড়া মাড়ায় না। অথচ বিপ্লবদা, তার পুরোনো একটা টেস্টপেপার আর সেইসঙ্গে একটা নতুন টেস্টপেপার, কিছু নোটস অলোকাদিকে দিতে এসেছিল। তাছাড়া ওগুলো দরকারও অলোকাদির। বরং অলোকাদির তার প্রয়োজন মেটাতে বিপ্লবদার বাড়ি যাওয়া উচিৎ। সাধারণ ভাবনায় এটাই হবার কথা। কিন্তু এখানে তার উল্টো। অলোকাদির প্রতি বিপ্লবদার ভাললাগা বা ভালবাসার টান না থাকলে এই উল্টোপুরাণ হয় কেমন করে। আসলে অলোকাদিকে দেখতে খুব সুন্দর। দুপুরে পাড়ার মেয়েমহল বড়-পুকুরের সান বাঁধানো ঘাটে বাসন মাজা আর আড্ডার সময় প্রায়ই অলোকাদির কথা পাড়ে। দেরি হচ্ছে বলে পুকুরঘাটে তার মা’কে ডাকতে গিয়ে কথাগুলো শুনেছে সনাতন, “মিলন রুইদাসের মেয়ে, ওই অলোকাটা, যেমন ফর্সা তেমন মাজাঘসা মুখের বাহার। রুইদাসদের ‘বাজার ছাড়া’ মেয়ে। কি করে ওদের গর্ভে এই সুন্দরীটা এলো কে জানে। রুইদাসদের কোন মেয়ে-পোলা তো এত চকচকে না? সব তো কেলে-কুসুন্ড আর ফিঙে ফর্সা।” একজন আবার মাথার ঘোমটায় মুখ আড়াল করে শরীর দুলিয়ে ফুট কেটে বলল, “কি জানি বাবা, মেয়ের মা’র চালচলন ঠিক ছিল কি না কে জানে! ঠিক থাকলে ভাল। ভগবান ভ’র করেছে তাই অমন সুন্দরী মেয়ে বিইয়েছে।”
অলোকাদি এখন হরিণডাঙ্গার কাছে হেলেগাছিতে ‘সাধন চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে’ বাংলা অনার্স নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে আর বিপ্লবদা ডায়মন্ড হারবার ‘ফরিক চাঁদ কলেজে’ ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ে। ওই বই-নোটস্গুলো তো এখন আর অলোকাদির কাজে লাগবে না। নিশ্চয়ই ওগুলো অলোকাদির কাছে পড়ে আছে। অলোকাদি ইতিমধ্যে অন্য কাউকে দিয়ে দিলে বা দেবে বলে কথা দিয়ে থাকলে তো তার ভাগ্যে আর জুটল না। ওই বই জোগাড় করা নিয়ে তাহলে তার কপালে অনেক কষ্ট আছে। আর দেরি না করে কলেজ থেকে অলোকাদি ফিরলে সন্ধ্যেবেলাই ওদের বাড়ি যাবে সে।
সেবার অলোকাদি আর বিপ্লবদার মধ্যে এই টেস্ট পেপার-বই আর নোটস্- টোটস্ দেয়া নেয়া নিয়ে জানাজানি হয়ে যেতে সে কি গন্ডগোল! পাল পাড়া আর রুইদাস পাড়ার মধ্যে বলা যায় আড়াআড়ি বিভাজন যেন হয়ে যেতে বসল। বিপ্লবদা উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে বাংলার নোটস্ আর টেস্ট পেপার নিয়ে অলোকাদিকে দিতে এসেছিল সেদিন। এইসব পড়াটড়া নিয়ে আলোচনা করতে করতে সন্ধ্যেটা একটু ভারি হয়ে গেছিল তা ওরা বুঝতে পারেনি। তক্কে তক্কে ছিল পাড়ার বখাটেরা। বিপ্লবদা, অলোকাদিদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। পেছনে অলোকাদি টেঁপি-লম্পোর আলো ধরেছে। মাটির ঘরের উঁচু বারান্দা থেকে সিঁড়ি ভাঙতে যাতে বিপ্লবদার অসুবিধা না হয়। তাছাড়া ক’দিন ভ’র বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের সামনের উঠোনটা কাদা প্যাচ প্যাচে হয়ে গেছিল। পা-পা মাপ করে ইট বেছানো আছে উঠোনে। কাদা মাড়ানো থেকে পার পেতে। একটু আলো না ধরলে অন্ধকারে হোঁচট খেতে পারে বিপ্লবদা। নিজের শরীরটা একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে অলোকাদি বিপ্লবদার দিকে টেঁপির আলোটা বাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বলছে, “সাবধানে দেখে ইটে পা রাখো বিপ্লবদা। না হলে পায়ে ঠোক্কর লেগে কাদায় পা পড়ে যেতে পারে। অলোকাদি সেই মুহূর্তে হয়তো বিপ্লবদার একটু কাছাকাছি এসে পড়েছিল। খানিক তফাতে রাস্তার উপর অন্ধকারে পাড়ার ওরা ওৎ পেতে ছিল ওদের দু’জনের ঠিক এইরকম কোন একটা প্রায় অন্তরঙ্গের মুহূর্তের জন্যে। অন্ধকারের ভেতরে চোখ ফুঁড়ে তারা ধরেই নিয়েছিল বিপ্লবদা, অলোকাদিকে জড়িয়ে ধরেছে! সঙ্গে সঙ্গে চৌকী-অলারা হই হই করে তাদের উঠোনে নেমে এসে তাদের ঘিরে ধরে। হঠাৎ এমন ঘটনায় চমকে ওঠে অলোকাদিরা। থরথর করে কাঁপতে থাকে বিপ্লবদা। তারা যা সন্দেহ করছে তা যে কিছুই না, বারবার অলোকাদিরা দু’জনেই বলার পরও পাড়ার ওরা কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়। বিপ্লবদা বেলেল্লাপনা করছিল অলোকাদির সঙ্গে। এই বদনাম থেকে তারা কিছুতেই পিছোতে রাজি নয়। এই জঘন্য কাজের জন্যে শাস্তি পেতে হবে বিপ্লবদাকে। আটচালায় বিচার হবে বিপ্লবদার। বেলেল্লাপনার জন্যে মোটা টাকার ফাইন করা হবে। এইসব হুল্লোড়ের খবর হাওয়ার বেগে উড়ে বেড়ালো গোটা পাড়ায়। একে একে লোক জড়ো হতে থাকে। কিন্তু পাড়ার মধ্যে মুরুব্বি বুঝদার লোকও তো আছে। তাদের মধ্যে সনাতনের বাবা রতনও আছে। ভীড় কাটিয়ে সনাতনের বাবা চলে যায় অলোকাদির বাড়িতে। যাবার সময় বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যায় অলোকাদিকে। অলোকাদির বাবা-মা’র সঙ্গে সব কথা আলোচনা করে বোঝা যায় ব্যপারটা পাড়ার ছোকরারা যেভাবে চাউর করেছে তা সঠিক নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে এত লোকজনকে তো সহজে বোধ মানানো যাবে না। চাউর হয়ে যাওয়া কথাগুলো ভুল তা সহজে মানুষকে বোঝানো যাবে না। আর কিছু মানুষ আছে যারা আবার ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করবে। এই সুযোগে অলোকার বাবা, মিলনের সঙ্গে যার পুরোনো ‘আকছা আকছি’ আছে তারা শোধ তোলার চেষ্টা করবে। আর ঝগড়াঝাটি একজনের সঙ্গে আর একজনের বা একাধিক কারোর সঙ্গে টুকটাক থাকতেই পারে, থাকেও। গ্রামের এমন মানুষ নেই বললেই চলে, যার সাথে অন্য কারোর কোনদিন বিবাদ বা কথাকাটাকাটি হয়নি। তাতে একে অপরের মনে আঘাত লাগতেই পারে। কেউ সেটা ভুলে যায় বা মেনে নেয়, কেউ নেয় না। মনের মধ্যে তা পুষে রেখে দেয়। সুযোগ পেলে সে তার মনের ঝাল মেটাবার চেষ্টা করে। তবু রতন আপাতত গ্যাঞ্জাম হটাবার জন্যে ভীড়কে বলল, “ঠিক আছে, তোমাদের আর্জি মত আটচালা বসানো হবে। এই গন্ডগোলের একটা বিহিত করা হবে। এখন সবাই শান্ত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাও। বিপ্লবও বলেছে, সে তার বাড়ির সঙ্গে কথা বলে যেদিন আপনাদের আটচালা বসবে, সেদিন আমাদের পক্ষও হাজির হবে। মিলন, তার মেয়ে অলোকাকে বিচারে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে ভীড় থেকে দক্ষিণ পাড়ার সুদর্শন ঋষির ছেলে, অভয় বলল, “কেন, অলোকা আটচালায় পাবলিকের সামনে আসতে যাবে কেন? ওর তো কোন অন্যায় নেই। ওই বিপ্লব ব্যাটা বেপাড়া থেকে এখানে এসে আমাদের পাড়ার মেয়েকে ফুঁসলে নিতে এসেছে। অন্যায় ওর। অলোকা আটচালায় আসবে না। বিচার হবে বিপ্লবকে নিয়ে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। কড়া শাস্তি। তাহলে আর দ্বিতীয়বার বেপাড়ার কোন ছ্যাঁচড়া আমাদের রুইদাস পাড়ার মেয়েদের দেখে ছোঁক ছোঁক করার সাহস পাবে না।” অভয়ের কথায় একদম পেছন থেকে তাকে ভেঞ্চি কেটে রে রে করে ওঠে বরেণ, “এই ব্যাটা ওভে, তুই ওই মেয়েটাকে আড়াল করতে চাইছিস কেন? এক হাতে তালি বাজে, না-রে? দু’পক্ষের কথা শুনে তবে তো বিচারক সঠিক বিচার করবে। আটচালায় দু’জনের কথাই শুনতে হবে। না হলে ‘এ্যাকেনে’ বিচার হয়ে যাবে। ঝাড় খেয়ে যাবে অন্য পাড়ার ছেলেটা। আর তুই কেন মেয়েটাকে সমক্ষে আনতে চাইছিস না তা কি আমরা জানিনা বুঝি। ওর প্রতি তোর লোভ আছে তা পাড়ার কে না জানে? অলোকা স্কুলে বার হলেই তেমাথানি মোড়ের বটগাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকিস, তা কার না চোখে পড়েছে। গলায় গামছার মুড়ির ঝোলা ঝুলিয়ে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তা চিবোতে চিবোতে তার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে থাকিসনি? অলোকার সাথে কথা বলার জন্যে ওকে দেখলেই বিষধরের মত কেমন হিস হিস করিস তাও সবাই দেখেছে। যেন নাগালে পেলেই তাকে ছোবল মারে আর কি! সে কথা যদি আটচালায় কেউ পাড়ে তাই তোর এই মাতব্বরি। সেটা আমরা বুঝিনা বুঝি? শালা দুনিয়ার ধান্ধাবাজ কোথাকার! মানুষকে বোকা বানাতে চায়।”
এত লোকের সামনে হাটে হাঁড়ি ভাঙতেই অভয় রাগে গরগর করতে থাকে আর ফুঁসে উঠে তেড়ে যায় বরেণের দিকে, “শালা শুয়োরের বাচ্চা, তুই প্রমাণ করতে পারবি, আমি অলোকার পেছনে লাগি? কেউ কারোর দিকে তাকালেই তার উদ্দেশ্য খারাপ? তুই কি করে জানলি, আমি অলোকার দিকে তাকাই? তাহলে তুইও নিশ্চয়ই ওর দিকে তাকাস? তোর কথাতেই প্রমাণ হয়ে গেল তোরও উদ্দেশ্য খারাপ। নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়লি তো-ও? ওই কথা আছে না, “চালুনির পোঁদ ঝর ঝর করে, আবার চালুনি ছুঁচের বিচার করে?” তোকে সাবধান করে দিচ্ছি বরেণ, ফের যদি তুই ওই শান্তশিষ্ট গোবেচারা মেয়েটার দিকে তোর লালসার চোখ ফেলিস তো প্রচুর খেসারত দিতে হবে তোকে। শালা ঢ্যামনার বাচ্চা! ফালতু এত লোকের সামনে আমাকে তুই অপমান করলি? দাঁড়া শালা, তোকে দেখাচ্ছি মজা। একটা শক্ত ঘুষি বাগিয়ে বরেণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অভয়। বরেণও ছাড়ার পো নয়। পাঁজা মেরে অভয়কে ধরে পাছড়ে মাটিতে ফেলে সিনেমার ঢঙে তার বুকে লাথি তুলতে যাবার আগেই অন্যরা ধরে ফেলে তাকে। ওদের দু’জনের মারপিট সামলাতেই এবার ভিড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিৎকার চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই ফাঁকে যারা এসব পছন্দ করে না, তারা পাতলা হয়ে যায়। যুযুধান দু’জনকে অন্যরা যে যার বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। তখনও অভয়ের ফোঁসফোঁসানি দমেনি, “এই আমার মায়ের দিব্যি রে শালা বরেণ, তোকে আমি ছাড়বো না। তুই বিষ-পতঙ্গ, ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরেছিস। তার হাত থেকে তোর রেহাই নেই। এই আমি তোর পেছনে পড়ে গেলাম। অলোকার কেসের সাথে সাথে তোর এই চোরপুট্টিরও একটা বিহিত না করে আমি থামছি না।” ততক্ষণে ভিড় ফাঁকা। রতন এবার বিপ্লবকে তাদের পাড়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই ছোকরারা যেভাবে রুখেছে, মনে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে আটচালায় বসার একটা ব্যবস্থা না করে ছাড়বে না। ভাবছিলাম এই নিয়ে আর ‘কলাগাছের থোঁড় কচলানিতে’ কাজ নেই। যত কচলাবে তত জল-রস বার হবে। কিন্তু কতটা কি পরিস্থিতি হবে তা দু-একদিন না গেলে বোঝা যাবে না। যদি তোমাকে ডাকতে বাধ্য হতে হয় তো তোমাকে বসতে হবে আমাদের আটচালার বিচারের সামনে। তবে মেয়ের বাড়ির লোকরা যখন তোমার বিরুদ্ধে নয়, তখন তোমার কোন অসুবিধা হবার কথা না। তাই তোমার ভয়েরও কিছু নেই। তবু দেখো আটচালা বিচারটা কোন দিকে ঠেলা মারে? জোয়ারে, না ভাটায়!”
ক্রমশ…