Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৮)

(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )

জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

 

[আঠারো]

মিলন, মিলন-বউ মেয়ে অলোকাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ওদের সমাজে দেখতে শুনতে ভাল কোন সন্তান জন্মানোটা সত্যি সত্যি যেন মহাপাপ। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে তত যেন মেয়েটার আর সেইসঙ্গে ওদের সামনে বিপদ হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্যে কাঁছা বাগাচ্ছে। বিপ্লবকে নিয়ে এই গন্ডগোলটা না পাকালে জানাই হ’ত না পাড়ার বখাটেরা তার মেয়ের পেছনে পড়ে গেছে। আচ্ছা, কি যোগ্যতা আছে নিষ্কর্মা ওই ছোঁড়াদের? এক পয়সা রোজগার করার যোগ্যতা নেই। বাপের হোটেলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তাদের আবার সুন্দরী মেয়ে দেখে তার উপর হামলে পড়ার শখ। প্রেম করে ‘বে’ মারাবে। আরে বেটাচ্ছেলে, ‘বে’ মারিয়ে বউকে ঘরে তুলবি যে, তার আগে সেই বউয়ের ভরণ-পোষণের যোগ্যতা দেখা। দেখা মরদের জোর। তার পর তো। তা না, এদিকে ‘নোনুর’ জোর ফলাবার জন্যে উতলা হয়ে পড়েছে, হারামজাদারা ! অলোকা যদি খেঁদি-বুঁচি হত তো তাদের এই সকাল-সকাল এত বিপত্তির মধ্যে পড়তে হত না। পাড়ায় আরও তো ওর বয়সী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাবা-মা’দের তো এত ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না! অলোকা ওদের পাত্তা দিচ্ছে না বলেই মেয়েটার বদনাম দিতে হারামি বাচ্চারা বিপ্লবকে নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে দিয়েছে। আরে মেনিমুখোরা, তোরা ওই বিপ্লবের নখের যগ্যি হতে পারবি? ওর মত নম্র, ভদ্র, সভ্য ছেলে পাওয়া এ’বাজারে মুশকিল। এ-অব্দি ও লেখাপড়া যা শিখেছে তার ধারেকাছে আসা তো তোদের এ-জম্মে আর হল না। সরকারের মিড-ডে-মিলের দৌলতে কেউ তিন কেলাস কেউ চার কেলাস পর্যন্ত দৌড় দেখিয়েছিস। তোদের আবার অত বীরত্ব কিসের ? বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াবার সাহস দেখাস! এবার রাগে গরগর করতে করতে মিলন মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে অলোকা, ওই বখাটে ছেলেরা যে স্কুলে যাবার সময় তোর পেছনে লাগে তা তো তুই কোনদিন বলিসনি? আমাকে না বলিস, না বললি, তোর মা’কেও তো বলিসনি? জানতে পারলে ওদের এই বাড়-বাড়ন্ত কবে ঘুচিয়ে দিতাম? আটচালায় শয়তানদের পেড়ে ফেলে মেয়েদের পেছনে লাগার সাধ মিটিয়ে দিতাম!”
মিলনের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে বুঝে অলোকার মা বলল, “মেয়ে আমাকে ওই অভয়দের কথা একদম যে বলেনি তা নয়। আমি বলেছি, ওদের কথায়, আচার আচরণে তুই কান দিবি না। ওদের পাত্তা দিলেই ওরা মাথায় উঠবে। দেখবি একদিন দমে এলিয়ে গিয়ে ওরা চুপ মেরে যাবে। তোর পেছনে লাগার জোশ হারিয়ে ফেলবে। আর এইসব খুচখাচ কথা পুরুষদের কানে শোনালে হিতে বিপরীত হয়। তাই আমি তোমাকে জানাই নি। এখন তো দেখছি সেই ভাবনা ভুল। যা ভেবেছিলাম তার থেকে ওরা আরও বেয়াড়া দেখছি। ওর লোভে পড়ে গেছে বেহায়ারা। এখনই এসব আটকাতে না পারলে বেড়ে যেতে পারে ওদের লালসা।”
অলোকার মায়ের কথায় মিলনের ভেতরে রোখ আরও যেন চেপে বসল। ঠিক করল ব্যাপারটা যখন প্রকাশ্যে ফুটে উঠেছে তখন এটাকে ধামাচাপা দিতে গেলে একটা সময় তা আরও শক্তি সঞ্চয় করে ধামা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়বে। তখন তাকে সামাল দেওয়া তার ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তাই একে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। আটচালা বসিয়ে এর একটা বিহিত করতেই হবে। সময় নষ্ট না করে মিলন পাড়ার অন্যতম মুরুব্বি-বিচারক- নন্দ, রতনের কাছে নালিশ জানাবে মনস্থ করল। রতন এমনিতেই ব্যাপারটা জানে। ওর সামনে আর নতুন করে বেশি কথা কাপচাতে হবে না। নন্দরও আর অজানা কিছু নেই।
মিলনের নালিশ পেয়ে রতন যেন মনে মনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। ওই ছোকরাগুলো সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকবার তাকে চাপ দিয়ে আসছে আচটালা বসাবার জন্যে। তাদের মতে সেদিন বিপ্লব আর অলোকা পাড়ার মধ্যে বেলল্লাপনা হয়েছে, তাতে তাদের পাড়ার সুনাম নষ্ট হয়েছে। বে-পাড়ার ছেলে এসে পাড়ার মধ্যেই পাড়ার মেয়েকে নিয়ে ফুসফুস গুজগুজ করে জঘন্য অন্যায় কাজ করেছে। দু’জনকেই আটচালায় ডেকে বিচার করতে হবে। ছোকরাদের অভিযোগ একদম ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারছিল না সে। ওরা যে নিয়মটার কথা বলছে, তা তো আটচালা থেকেই চালু করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, “তাদের রুইদাসদের জাতের অর্থাৎ মুচি সম্প্রদায়ের জাত-কৌলিন্য ঠিক রাখতে গেলে অন্য জাতের কারোর সঙ্গে সম্বন্ধ করে হোক বা ভালবাসা করে হোক বিয়ে করা তো কোন ছার, মেলামেশাও করা যাবে না।” সেই বিধানে ওরা এই ঘটনাটা জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু ওই বিধানে তো লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও মেলামেশা করতে পারবে না, সে কথা বলা নেই। তাহলে তো পাড়ার কোন মেয়ের আর স্কুল পাঠশালায় পাঠানো যাবে না। স্কুলে পাঠালে তো ছেলেমেয়েরা মিলমিশ করেই পড়াশোনা করবে। সেই যুক্তিতে রতন অলোকার সঙ্গে পাল পাড়ার ছেলেটার কথা বলাতে কোন দোষ দেখছে না। তাছাড়া ছেলেটা তো তাকে পড়ার বই-খাতা দিতে এসেছিল। সে যদি আটচালার বিধিনিষেধের গেরোয় এই পাড়ায় না আসে তো মিলনের মেয়েকেই পর-পাড়ায় যেতে হয়। আর পাল পাড়ায় এইসব মেলামেশার কড়াকড়ির কোন বালাই নেই। অবাধে ছেলেমেয়েরা কথাবার্তা চালায়। এত গভীরে গিয়ে ভাবার ক্ষমতা যদি এইসব ছোকরাদের থাকতো তো এদের অনেক দাম হয়ে যেত। মুর্খদের সেকথা বুঝিয়ে বললেও মুর্খরা বুঝবে না। বিচারশালায় বসিয়ে ঘাড় মটকে যদি বোঝানো যায় তো তবে যদি ওরা বোঝে।
রুইদাস পাড়ার ছেলেরা তাকে যেভাবে হেনস্থা করল তা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না পালপাড়ার ছেলে বিপ্লব। হয়তো মেয়েটার রূপের প্রতি তার একটা আলগা টান জন্মেছিল। মনে মনে অলোকাকে যে সে ভালবেসে ফেলেছে, তা কিন্তু ও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। মেয়েটার থেকে ও দু’ক্লাস উঁচুতে পড়ে। টিউশানি পড়ার সময় অমর স্যার বলেছিল, “বিপ্লব, তোর তো এইচ. এসের পুরোনো টেস্ট পেপার বাড়িতে পড়ে আছে। সেটা অলোকাকে দিতে পারবি না? নাকি, অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছিস? ওর বাবা এখনো ওর জন্যে টেস্টপেপার কিনে উঠতে পারেনি। আর যে নোটসগুলো দিয়েছিলাম তার একটা জেরক্স কপি অলোকাকে দিয়ে দিস। জেরক্সের দাম আমি তোকে দিয়ে দেব। ইতিমধ্যে ওগুলো যদি কাউকে দিয়ে দিস তো তার কাছ থেকে নিয়ে জেরক্স করে ওকে দিয়ে দিস। যেহেতু তুই-অলোকা একই গ্রামে থাকিস এবং পাশের পাড়ায় থাকিস, তাই তোকে এই কাজটা আমি দিলাম।” স্যারের কথা ফেলবে, এ সাধ্য কার। এসব কোন কিছুই ও অন্য কাউকে দেয়নি। সবই তার কাছে আছে। তাই বিপ্লব এক কথায় রাজি হয়ে যায়। আর মেয়েটা যখন অলোকা, তখন মনে মনে ও খুশিই হয়। কেন খুশি তা সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না। তারপর তার মনে হল, শুধু পুরোনো টেস্ট পেপার দেওয়াটা খারাপ ব্যাপার হবে। তার কাছে যা টাকা আছে তাতে এবারের নতুন একটা টেস্টপেপার হয়ে যাবে। পুরোনোর সাথে নতুন একটা কিনে অলোকাকে দিয়ে আসবে। তাহলে আর ওর বাবাকে বইটা কেনার জন্যে টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতে হবে না। এই অবস্থায় অলোকার সামনেই তাকে যেভাবে হেনস্থা করা হ’ল। অপমানে তার সমস্ত সত্ত্বা যে মাটিতে মিশে গড়াগড়ি খেলো। কিছুতেই সে তা মেনে নিতে পারছিল না। বাড়িতে বাবা-মাকে জানানোর সময় নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বিপ্লব। ছেলের কান্না দেখে মা’ও গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। বিপ্লবের মায়ের কান্নার আওয়াজ প্রকৃতিতে সওয়ার হয়ে পাশের বাড়ি টপকে এদিক ওদিকে পাড়ি দিতে লাগল। এক এক করে তাদের পাল পাড়ার অন্যরা এসে জড়ো হয় বিপ্লবদের বাড়ির উঠোনে। তাদের পাড়ার ছেলের এই অপমান অন্যরাও মেনে নিতে পারল না। এই আবহে আবার যখন সবাই শুনল, মুচিপাড়ার আটচালায় বিপ্লবকে নিয়ে বিচার বসাবার কথা বলেছে ওরা! আগুনে ঘি ফেলার মত দাউ দাউ করে রাগে জ্বলে উঠল গোটা পাল পাড়া,“শালা ছোটলোক রুইদাস, তাদের আবার এতবড় সাহস, তারা কিনা বিচার করবে আমাদের উঁচু বর্ণের ঘরের ছেলের? ও ছেলে তাদের মাস্টারের আদেশ পালন করার জন্যে ওদের পাড়ায় গিয়েছে। সে তো ওদের পাড়ার মেয়ের উপকারের জন্যে গিয়েছিল। কোথায় সেই কাজের জন্যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে। তা না করে উল্টে ছেলেটার নামে মেয়ে নিয়ে টানাটানির বদনাম দিচ্ছে? তার উপর বিপ্লবের মত লেখাপড়া করা শান্তশিষ্ট নম্র-ভদ্র ছেলেকে জড়িয়ে! এতবড় সাহস ওই ছোটলোক মুর্খ ছাগল-গরুর মাংস-চামড়া ঘাঁটা, নোংরা ঘাঁটা অচ্ছুুৎ জাতের! আমরা পালপাড়ার সবাই মিলে যাবো রুইদাস পাড়ায়। এই অপমানের জন্যে ওদের ক্ষমা চাইতে হবে। না হলে ওদের অনেক খারাপ ফলের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।”
পাল পাড়ার মান্যিগন্যি মানুষ, অনুকুল কুম্ভকার। মাটির হাঁড়ি, সরা, মালসা ছাড়াও কুমোরসজ্জার যাবতীয় জিনিস নিজের পাঁজার চুল্লিতে তৈরী করে পাইকারকে বেচে ভালই পয়সা করেছে অনুকুল পাল। ওর মত এত বড় আকারের কারবার পাড়ার কেউই করে না। আসলে অত পুঁজি সবাইয়ের নেই। অনেকে আবার তাদের উৎপাদিত মাল অনুকুল পালকে যোগান দেয়। তারপর পাড়ার মধ্যে দশের কাজে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে কোন সময় দ্বিধা করে না অনুকুল পাল। ব্যবসার লাভের পয়সা যে সবটাই নিজে খেয়ে নেয় তা নয়। তাই গ্রামের মোড়ল প্রথা উঠে গেলেও এখনও সবাই অনুকুল পালের কথা মোড়ল জ্ঞানে মানে। বিপ্লবের বিষয়টা নিয়ে পাড়ার লোকজন অনুকুল পালের কাছে গেল। পরামর্শ চাইল, তাদের এখন কি করা উচিৎ? সব কথা শুনে অনুকুল পাল বলল,“রুইদাসদের আটচালায় আমাদের যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ওখানে যাওয়া মানে আমাদের পাড়ার চরম মানহানি হওয়া। আমরা কেন ওদের বিচারের সামনে দাঁড়াবো। কি যোগ্যতা আছে ওদের, আমাদের বিচার করার? এতবড় সাহস ওরা পায় কোথা থেকে। বিপ্লব যা করেছে তাতে ওদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমাদের পাড়ার প্রতি। তা না করে দু’চারটে বখাটের মোদো মাতাল খামখেয়ালির শিকার আমরা হতে যাব কেন? দরকার হলে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। অতদূর যাবার আগে একটা কথা বলি, আমাদের দু’চারজন মুরুব্বিকে পাঠানো হোক ওদের ওই রতন, নন্দদের কাছে। ওরাই তো রুইদাস পাড়ার মাথা। কারণ জানতে চাওয়া হোক, আমাদের ছেলের কি অন্যায় সেটা খোলসা করে বলার জন্যে। তখন দেখবে, রতন-নন্দরা আমতা আমতা করতে থাকবে। পরিস্কার করে কিছু বলতে পারবে না। তখনই বোঝা যাবে ওই বখাটেদের চাপে ওরা বিচারের কথা বলেছে। আর সেই চাপ যদি ওরা সামলাতে না পারে তো আমাদের লোক বলে আসবে, রুইদাসদের আটচালায় নয়, বিচার বসবে পালপাড়ার ঠাকুর দালানে। এই কথা বললেই দেখবে, ওরা সিঁটিয়ে যাবে। বিচারশালা বসাবার জন্যে আর মাথাঝাড়া দেবার সাহস করবে না বাছাধনেরা।”
বিচারশালা বাতিল হয়েছে শুনে ক্ষেপে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় অভয়-বরেণদের মত ছোকরারা। দিনমানেই চুল্লু গলায় ঢেলে প্রথমে হামলা করতে যায় রতন-নন্দদের মত পাড়ার মুরুব্বিদের বাড়ি। কোন বাছবিচার না করে পাড়ার মা-বোনেদের সামনেই অকথ্য গালাগালি দিতে থাকে তাদের। পাড়ার আর যারা বুঝদার মানুষ, তারা সেটা মেনে নিতে পারেনি। সমবেত হয়ে তাদের ঠেলেঠুলে আটচালার দালানে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। মদের দুলুনিতে কে যে কোথায় পা ফেলে তার হিসেব কে রাখে। তবে সমান তালে মুখ দিয়ে চুল্লুর বিটকেল গন্ধের সঙ্গে বেরোতে থাকে অসহ্য সব পচাল গালাগালি। কখনো নিজেদের পাড়ার মুরুব্বিদের নিয়ে কখনো পালপাড়াকে জড়িয়ে। দুপুরে খাবার সময় হলে মানুষ যে যার মত বাড়িমুখো হতে থাকে। ভিড় পাতলা হয়ে যায়। মাতালরা কিন্তু স্বমহিমায়! অভয় আর তার অন্য স্যাঁঙাৎ মিলে মোট পাঁচজন টলমল শরীরে নির্জন আটচালা জাগিয়ে রেখেছে। হঠাৎ অভয়-মাতাল জড়ানো জিভে বলে,“চল্ সবাই, ওই শালা বিপ্লবের বিচার যখন রতন-নন্দরা করবে না তখন আমাদেরই করতে হবে। পাল পাড়ায় গিয়ে ওই শালা সতীনবেটাকে উচিৎ শিক্ষে দিয়ে আসি। এই তোদের ট্যাঁকে গরুকাটা ছুরিগুলো আছে তো? দেখে নে ভাল করে। এই দিয়ে মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর বদলে ওই সতীন-বাবার জ্যান্ত ছাল ছাড়াবো আজ।” যেমন কথা তেমন কাজ। টলতে টলতে মুখ দিয়ে পচাল ছাড়তে ছাড়তে সতীনবেটা বিপ্লবের নামে জবাই ধ্বনি দিতে দিতে ঢুকে পড়ে পালপাড়ায়। অভয়মুচিদের হামলার কথা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাল পাড়া। কেউ ভাতের থালা ফেলে, কেউ ভাত খেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, কেউ বা চান করতে করতে বা চানে যেতে যেতে ছুটে আসতে থাকে তাদের রুখে দিতে। লাঠি শাবল, কোদাল গাঁইতি তো অনেকের হাতে ছিল। ওসব দিয়ে আঘাত করলে মানুষ খুনের দায়ে পড়তে হবে। তাই মুরুব্বিরা আদেশ দিলে, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ হাঁড়ি, কলসি, সরা যাবতীয় সবকিছুর ভাঙা যার কাছে যা আছে সেই নিয়ে নিক্ষেপ করতে থাকো শত্রুর দিকে। তার আঘাতে কেটেকুটে বা মাথা ফেটে রক্ত ঝরলে বেটারা রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার কোঠরে ঢুকে যাবে।
হামলাকারি পাঁচজনই কমবেশি রক্তাক্ত হয়ে নেশা কাটিয়ে বাড়ি ফেরে ভর-দুপুরে। তাদের অবস্থা দেখে রুইদাস পাড়াও গরমাগরম হয়ে যায়! দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে কেউ আর ভাতঘুমে না গিয়ে আটচালায় এসে জড়ো হয়। দুই পাড়া যখন সম্মুখসমরে এসে দাঁড়িয়ে তখন কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা জিইয়ে রাখলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ঘোরালো হয়ে যেতে পারে। এবার যে পক্ষ যেমন সুযোগ পাবে পরস্পরের উপর হামলে পড়া-প্রবণ হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। পালেদের পয়সার গরম আছে। মুখোমুখি টক্করে গেলে ওদের সঙ্গে রুইদাসরা পেরে উঠবে না। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি হলে কে সামলাবে? অত ট্যাঁকের জোর রুইদাস পাড়ার কার আছে? পয়সা কারোর কারোর থাকলেও তারা এতসবে নিজেদের জড়াতে চায় না। তাই ঠিক হল পঞ্চায়েতকে গোটা ব্যাপারটা জানাবে। আর্জি জানাবে দু’পক্ষকে ডেকে ওরা যাতে একটা মিটমাটের রাস্তা বাতলে দেয় সেই ব্যবস্থা করার জন্যে। সেইসঙ্গে পাড়ার কাউকে না জানিয়ে যে মাতাল ছোকরারা পালপাড়ায় ঝামেলা করতে গিয়েছিল তাদের আচ্ছা করে কড়িয়ে দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে দ্বিতীয়বার এই কাজ ওরা না করে সেটা কবুল করিয়ে নেওয়া হবে। প্রথমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। তাতে তারা বাগ না মানলে চোক রাঙানো ছাড়া উপায় থাকবে না। আপোশের কথা শুনলে প্রথম ধাক্কাতেই ওরা নিশ্চয়ই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠবে। পালেদের হাতে মার খাওয়া আর অপমানের প্রতিশোধ নেবার আস্ফালন দেখাবে। কিন্তু ভাল কথায় কাজ না হলে অগত্যা আঙুল বেঁকাতে হলে তাই করতে হবে!

[ঊনিশ]

ওকে নিয়ে ওইসব আজেবাজে কান্ডকারখানা ঘটার পর থেকে অলোকা পাড়ার ছেলে-বউ ঝি-ঝিউড়ি, কারোর সঙ্গে নিতান্ত দরকার ছাড়া মেলামেশা তো দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বলে না। বাড়ির কাজকর্ম, নিজের পড়াশোনা আর দু’ভাইবোনেদের পড়িয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। পাড়ার সার্বজনীন কোন পূজা বা উৎসবেও বাড়ি থেকে বার হয় না। ওর মত একটা শিক্ষিত মেয়ে যে পাড়ায় আছে তা বোঝার উপায় নেই। অথচ বলাই যেতে পারে, এই অলোকাই রুইদাস পাড়ার গর্বের কন্ঠমালা। এ পাড়ার ইতিহাসে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং প্রথম একজন, যে স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজের চৌকাঠে পা দেবার যোগ্যতা দেখিয়েছে। বাইরের জগতে গোটা রুইদাস পাড়া ওকে নিয়ে গর্ব করে। পাড়ার বয়স্ক মুরুব্বি মানুষ, সুবোধ কাকা তো দিঘিরপাড় বাজারে মুখ ভর্তি বাতাস বুকে চালান করে ছাতি উঁচিয়ে বলে, “আমাদের মিলনের মেয়ে গো, ওই যে, মিলন, দক্ষিণমোড়ে যে জুতো সারাই করে, ধামা বেচে। ওরই মেয়ে। আমাদের রুইদাসদের ঘাড়ে যে গো-মুর্খ হয়ে থাকার ‘শাপ’ ভর করে ছিল, সেই শাপ ওই মেয়ে মোচন করল গো। এটা আমাদের কত গর্ব জানো তোমরা! এই শাপমোচনের পর এবার দেখবে পাড়ায় একে একে ছেলেপিলেরা লেখাপড়ায় মন দেবে। শিক্ষিত হবে।”
বড়দের এই ভাবনাগুলো সনাতনকে অনেকটাই উৎসাহিত করে। কিন্তু বাবার অভাবী করুণ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে আবার ‘নিরুৎসাহ’ এসে কেমন যেন মনটাকে গ্রাস করে। বাবা ওই যে নিজেকে ‘ক্রীতদাস’ বনে যাবার কথা বলল, সেটা ও কিছুতেই হজম করতে পারছে না। একজন বাবার মনে কত কষ্ট হলে নিজের মুখ দিয়ে এমন সাংঘাতিক কথা বার করতে পারে ! ছেলের পড়ার খরচ জোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতা তার বাবাকে কতটা কাঁদায়, এই কথার মধ্যে দিয়ে সে মর্মে মর্মে অনুভব করে। বুকের ভেতরটা কান্নায় যেন ডুকরে ডুকরে ওঠে। মনটা এমন থম মেরে যায় যে কোনকিছুই তার ভাল লাগে না। অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কেউ যাতে এই জল দেখে না ফেলে তাই তড়িঘড়ি হাতের কব্জির উল্টো দিকে দিয়ে মুছে নেবার চেষ্টা করে। এই জল যে তার একান্ত নিজস্ব। এ অন্য কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করার নয়। খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেও চলে যায়। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার তেমাথানি ওই ছায়াঘেরা বটের তলায় একা একা চুপচাপ বসে থাকে। হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটু দুটোর ওপর ঝুঁকে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন দখিনা বাতাসে সওয়ার হয়ে তার কানে প্রবেশ করে অমর স্যারের সেই অভয় মেশানো গলার স্বর, “যত কষ্ট হোক সনাতন, পড়াশোনা তোকে চালিয়ে যেতে হবে। তোকে বড় হতে হবে। শিক্ষিত হয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে, তোদের মত পেছিয়ে পড়া মানুষরাও সুযোগ পেলে, পারে অন্যদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে। সমাজে এগিয়ে থাকা মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে চলার ক্ষমতা তোকে দেখিয়ে দিতে হবে। তুই পারবি সনাতন। তোর মধ্যে সেই জোশ আছে। আমি সেটা দেখতে চাই। যেমনটা দেখতে পাই তোদের পাড়ার মেয়ে অলোকার মধ্যে। যত বাধা আসুক, তুই বিচলিত হবি না। দশ পা এগিয়ে যাবার লক্ষ্যে দু’পা পিছিয়ে আসার দরকার হলে তাই করবি। তবে কোন সময় পিঠটান দেবার ভাবনা স্বপ্নেও আনবি না। আবার বলছি, তুই পারবি সনাতন। আমি তোর পেছনে আছি। পিঠটান দিতে গেলেই আমার সঙ্গে তোর ধাক্কা লাগবে। আমার মুখোমুখি হলে আর তুই পিছু হটতে পারবিই না। আর, একটা মেয়ে যদি চরম প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কঠোর লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তাহলে তুই বা পারবি না কেন। তুই তো ছেলে-বাচ্চা। অলোকা তো মেয়ে। মেয়েদের কত অন্যায় নিয়মকানুনের শৃঙ্খল দিয়ে সমাজ বেঁধে রেখেছে। তার ওপর নিয়ত তাদের মান-সম্মান, সম্ভ্রমকে বাঁচিয়ে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে হয়। দেখলি না, অলোকাকে কত ঝড়ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঠান্ডা মাথায়, ভেতরের জেদকে দৃঢ়তর করে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে?”
বিকেল এসে দুপুরের জায়গা ততক্ষণে দখল করেছে। সনাতন তখনও মাটি থেকে ঠেলে ফুঁড়ে ওঠা সেই বটগাছের বড় শেকড়ের ওপর একভাবে হাঁটু মুড়ে বসে। আর সনাতনের মা, ছেলেকে বাবা-বাছাধন করে আকুতি মিনতি করে চলেছে খেতে আসার জন্যে। ছেলের তাতে কোন সাড়াশব্দ নেই। আর মা সমানে আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মোছে আর কপালের দোষের যুক্তি শোনায় চরাচরকে। ঠিক সেই সময় অলোকা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে। মা-ছেলের এই রাগ-বিরাগের চিত্রপট অলোকার চোখে পড়ে। আলোকা এসে পড়তেই ঘটনাচক্রে সনাতন মুখ তুলে তাকায়। অলোকা দেখে ছেলেটার চোখদুটো জবাফুলের মত টকটকে লাল হয়ে আছে। খানিক থমকায় অলোকা। কি ভাবলো আবার এগিয়ে চলল নিজের বাড়ির দিকে। ওদের মা-ছেলের বিরাগ যাপনের মধ্যে তার প্রবেশ করাটা ঠিক হবে না ভেবেই অলোকা কোন কথা না বলে চলে যায়। তাছাড়া এমনিতেই ও, পাড়ার কারোর সাথে আর তেমনভাবে কথা বলে না। এখানে হঠাৎ এদের মধ্যে ঢুকে পড়লে ছেলেটার মা যদি মুখের ওপর কোন কথা শুনিয়ে দেয় তো, তা তার মোটেই ভাল লাগবে না। তবু ছেলেটা যেহেতু সনাতন, পাড়ার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছেলে। মাধ্যমিকে কুড়ির মধ্যে সতেরো রাঙ্ক পাওয়া ছেলে। তাই কেন যেন তার মনটা মুহূর্তের জন্যে তার চলাচলকে থমকে দিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল জানতে, কেন সে ওইভাবে বসে আছে। তার মা-ই বা কেন তার সামনে কান্নকাটি করছে। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা ভাল কিছু নয়। কি ভাল নয় সেটা জানার ইচ্ছেটা যেন প্রবল হয়ে পড়েছিল। পরে নিজেকে সামলে নেয়। অযাচিত উৎসাহ দেখানোর ফলটা যদি তার পক্ষে না যায়?
অলোকা চলে যাবার পরই সনাতন বটের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মা তার আদরমাখা হাতটা বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। সনাতন নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরে। মা তার পেছু পেছু এগিয়ে যায়। উঠোন থেকে দাবায় ওঠা সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে বসে পড়ে সনাতন। ঘুঁটের ছাই দিয়ে মাজা চকচকে কাঁসার ঘটিটা দাবায় রাখা বালতির জলে চুবিয়ে এক ঘটি জল নিয়ে ছেলের মুখ চোখে জল হাত বুলিয়ে ভাল করে ধুয়ে দেয় মা। বামুন ঠাকুরের কাছ থেকে কেনা কমদামী জালি পাতলা গামছা দিয়ে ছেলের মুখ চোখের ভেজা জল পরম মমতায় মুছিয়ে দিয়ে বলে, “বয়ে যাওয়া বেলায় আর ভাত খেতে হবে না। গরমে মুগের ডালটা টকসি টকসি লাগছে। আলুভাতেটা মাখা ছিল না বলে এখনো টকেনি। এখন মুড়ি খা। সন্ধ্যে গরম ভাতেভাত করে দেব’খন। মুড়ি খেয়ে একটু গড়িয়ে নে। শরীরটা ধকল খেয়েছে। একটু শুয়ে না নিলে কাহিল হয়ে যাবি।”
কলের জলে মুড়ি ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রাখে সনাতনের মা, পুষ্প। ভেজানো মুড়ি হাতের আঙুলের ছাকনিতে তুলে পেতলের কাঁশি-বাটিতে রাখে। ভেজানো মুড়িতে উপর উপর চার চিমটে ধুলো চিনি ছড়িয়ে দিয়ে সনাতনের সামনে ধরে,“আমি খাইয়ে দেব বাবা? তুই বস। আমি খাইয়ে দিই। তুই নিজের হাতে খেতে গেলে আবার তোকে হাত ধুতে উঠতে হবে।” মায়ের কথায় চুপ থাকে ছেলে। চুপ থেকে সম্মতি জানায়।
এই ভেজানো হাতে-ছাঁকা মুড়ি এরা দুই বাপ-বেটা খুব পছন্দ করে। মুড়ির উপর একটু চিনির ধুলো ছড়িয়ে দিলে পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে নিতে পারে। বড় দানার চিনির তো দাম বেশি। অত বড়লোকী চাল দেখানোতে ওদের কাজ নেই। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে আর কি। পুষ্প এই খাওয়াটা শ্বশুরবাড়িতে এসে শিখেছে। খুব একটা যে আহামরি মুখোরোচক খাবার তা সে জোর দিয়ে বলতে পারবে না। আবার একদম খেতে পারবে না তাও কিন্তু নয়। প্রথম প্রথম পুষ্পর খেতে একটু অস্বস্তি হ’ত। এখন খারাপ লাগে না। সনাতনের বাবা তো বলে, “ভেজানো মুড়ি ছেঁকে তুলে চিনি অথবা নুন-লঙ্কা দিয়ে খেতে খারাপ লাগে না। আর এই খাবার একদম শুদ্ধ খাবার। মুড়ি জলে ভিজিয়ে রাখলে মুড়ির গায়ে যে বালির ধুলো লেগে থাকে তা ধুয়ে জলের তলায় নেমে যায়। শুকনো মুড়ি খেলে যেটা হবার নয়। পেট ঠান্ডাও করে এই খাবার। সেটা পুষ্প দেখেছে। মুড়ি ছেঁকে নেবার পর জলের তলায় অনেক কালো কালো ময়লা পড়ে থাকে। ওদের বাপেরবাড়ি এই খাবারের চল নেই। মালদার হরিশচন্দ্রপুরের বাপের বাড়ি থেকে বাবা প্রথম যখন মেয়ের বাড়ি আসে, পুষ্প খাইয়েছিল এই খাবার। একটা বাটিতে চিনি দিয়ে আর একটায় নুন-লঙ্কা দিয়ে। অল্প অল্প করেই দিয়েছিল। বাবা তো প্রথমে এই খাবার দেখে বিষ্ময়ে বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল, “এটা কি খাবার রে মা? প্রথম ভাবলাম এটা চিড়ে ভেজানো। কিন্তু না-তো! এ তো মুড়ি? মুড়ি আবার এমন করে খাওয়া যায়?” মৃদু হেসে পুষ্প বলেছিল,“দুটো বাটিতে দু’রকম ভাবে তৈরী। খেয়ে দেখো, কেমন লাগে?” তা বাবা দুটোই খেয়েছিল। চিনির থেকে নুন-লঙ্কা মাখানোটা বাবার বেশি পছন্দ হয়েছিল, “বাঃ ভালই খেলাম রে মা নতুন খাবারটা। তোর মা’কে গিয়ে গল্প করব। তবে চিনির থেকে নোনতা ঝালটা পছন্দ হ’ল।” সনাতনের বাবাও নোনতা-ঝালটাই বেশি সময় চায়। আর তার উল্টো, ছেলেটা। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদটাই ওর ভীষণ প্রিয়।
নিজ হাতে পরম মমতায় ছেলেকে খাইয়ে দেয় পুষ্প। পছন্দের খাবার পেয়ে আর ‘না’ করেনি সনাতন। মায়ের দেয়া অমৃত তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নেয়। কাঁসার ভারি গ্লাসে এক গ্লাস জল মায়ের হাত থেকে নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে নিয়ে বলে, “মা, এখন শুতে গেলে আমার চলবে না। অলোকাদিদের বাড়ি যাবো। খুব দরকার আছে। না গেলে আমার চলবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করা যাবে না।” ছেলের কথায় অবাক হয়ে যায় পুষ্প,“সে কি রে! হঠাৎ ওদের বাড়ি যাবি যে? কোনদিন তো তুই ওদের বাড়ি যাসনি? তাছাড়া ও তো পাড়ার কারোর সঙ্গে কথা বলে না। নিজের গোমরে থাকে। পাড়ার প্রথম শিক্ষিত মেয়ে। আর সবাই গো-মুখ্যু। তুই গেলে তোকে পাত্তা দেবে? তা হঠাৎ কি দরকার পড়ল ওর সঙ্গে? আমার তো মনে হয় ওদের বাড়িতে তোকে ঢুকতেই দেবে না! তা তখন তো ও তোর-আমার সামনে দিয়েই কলেজ থেকে ফিরল। দরকারটা তখনই তো সেরে নিতে পারতিস। সন্ধ্যে হয়ে এল। এই সময় লোকের বাড়ি যাওয়াটা ঠিক? ওদের বাড়ি পাল পাড়ার ওই ছেলেটা যাওয়া নিয়ে কত-না ঝামেলা অশান্তি হয়ে গেল। এখনো তার দাগ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। কোনদিন যাবে বলে মনেও হয় না। তারপর তুইও বড় হচ্ছিস!”
মায়ের কথায় বিরক্ত হয় সনাতন, “না- জেনেশুনে কারোর নামে আজেবাজে কথা বলা ঠিক না, মা। লেখাপড়া তো তোমার ছেলেও শিখছে। তাহলে তোমার কথা মত তোমার ছেলেরও তো গোমরে মাটিতে পা না পড়াই উচিৎ। কেউ যদি তোমার ছেলের নামে এমন কথা বলে তাহলে তুমি সেকথা হজম করতে পারবে মা? আমার দরকারে আমি যাচ্ছি। তা সে যদি সেই দরকার মেটাতে না পারে, না পারবে। আমার তাতে কিছু মনে করার নেই তো? আর এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো অলোকাদি আমার থেকে চার বছরের বড়। তোমাদের কাছেই এ’কথা আমার শোনা। সন্ধ্যে ছাড়া কখন যাবো ওদের বাড়ি? সক্কাল হলেই তো অলোকাদি কলেজ যাবার তোড়জোড় শুরু করে দেবে। আবার সেই কবে রবিবার আসবে তবে। অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না। তোমার সনাতনের প্রতি এই বিশ্বাসটা তুমি রাখতে পারো মা।” ছেলের কথার পিঠে আর কথা চাপাতে চাইল না পুষ্প। শুধু বলল, “বেশি রাত করিসনি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে চলে আসিস।”
পাড়ার মূল রাস্তা থেকে বাঁয়ে ঘুরে অলোকাদিদের বাড়িমুখো হলেই ওদের বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোনটা পড়ে। ফাঁকা নিকোনো উঠোন পেরিয়ে তবে মাটির উঁচু দাবায় ওঠা যায়। কেউ উঠোনে পা দিলেই বাড়ির দাবা থেকে তা দেখা যায়। সনাতন ওদিকে নামতে উঠোনের দিকের বাল্বের আলো জ্বলে উঠল। সেই আলো ভেদ করে সনাতন বাড়ির দিকের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ওর উল্টোদিকের সবাই ওকে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনকে দেখে অলোকা দাবার উপরে পইটের সামনে এসে দাঁড়ায়,“কি রে সনাতন, তুই হঠাৎ আমাদের বাড়ি? কোনদিন তো আসিসনি?” অলোকাদির এমন কথার জন্যে তৈরী ছিল না সনাতন। অপ্রস্তুতে থমকে যায় সে। গলাটা যেন শুকনো হয়ে গেল হঠাৎ। কি বলবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। কিন্তু প্রশ্ন যেমনটাই হোক উত্তর তো তাকে দিতেই হবে। তাই গলা ফুঁড়ে বার না হতে চাওয়া কথা জোর করে ফোটাতে গিয়ে ফসফস করে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল! কি শব্দ তা সে নিজেই বুঝতে পারল না। বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গলা খাকরি দিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে অলোকাদি।” সঙ্গে সঙ্গে অলোকা বলল, “তা উঠোনে দাঁড়িয়ে কি কথা বলবি, উপরে দাবায় উঠে আয়।”
দাবায় উঠতে পাট-দড়ির দোলা দেখিয়ে অলোকাদি বলল, “এই দোলাটায় তুই বস, সনাতন।”
-তুমি বসো দিদি। আমি দাঁড়িয়ে আছি।
-এই বোকা, তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস। তোকে বসতে না দিয়ে আমি বসে পড়বো? সে আবার হয় নাকি!
সঙ্গে সঙ্গে অলোকাদির মা রান্নাঘর থেকে বলল,“অলোকা তুই ঘরের ভেতর থেকে মোড়াটা নিয়ে ওর সামনে বস। ও দোলায় বসবে আর তুই দাঁড়িয়ে থাকবি, তাতে ও কিন্তু কিন্তু করছে। ঘরের দরজার ডানদিকে ওটা আছে। নিয়ে আয়।”
মোড়াটা নিয়ে সনাতনের সামনে বসতে বসতে অলোকা বলল,“কি দরকারে এসেছিস বল।”
সনাতন তারপরও চুপ করে থাকে। কিভাবে কথাটা অলোকাদির সামনে পাড়বে তা বুঝে উঠতৈ পারছে না যেন। উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পেপারের কথা বলার আগে বিপ্লবদার নামটা তুলবে না কি! বিপ্লবদার নাম করে বললে সহজেই অলোকাদি বুঝে যাবে ঠিক কোন বইটা সে চাইছে। কেননা ওটা বিপ্লবদা ওকে দিয়েছিল। আর এইটা দিতে এসেই তো দুই পাড়ার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল। এখনো সড়গড় হয়নি। তাহলে আবার অলোকাদির মনটা বিগড়ে যাবে না তো? এখন বিপ্লবদার প্রতি অলোকাদির ধারণা বা সম্পর্ক কেমন তা তো জানা নেই। ভাল সম্পর্ক থাকলে ভাল কথা। আর যদি তা না হয় তো তার কপাল মন্দ। আবার অলোকাদি কথা তোলে, “কিরে ছেলে, আমার সঙ্গে দরকার আছে বললি, আর কি দরকার তা বলতে পারছিস না? সে আবার কেমন কথা! মনে হচ্ছে কথাটা বলতে তোর ভয় ভয় করছে। আরে বাবা আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখে ভয়ে চুপ করে আছিস?” সনাতন দেখল এরপর আর চুপ মেরে থাকাটা ঠিক কাজ হবে না। অন্যকিছু ভাবতে পারে অলোকাদি। সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেতর থেকে একটা বল পেয়ে গেল। বলল, “দিদি, তোমার উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টপেপারটা আমাকে দেবে? নতুন টেস্টপেপার বাবা কিনে দিতে পারবে না। অমর স্যার ভাল করে টেস্টপেপার প্র্যাক্টিস করতে বলেছে। এখন টেস্টপেপার কোথায় পাই? বন্ধুদের অনেকের কাছে চেয়েছি। কিছুদিনের জন্যে চেয়েছিলাম। রাতদিন করে পড়ে ফেরত দেব বলেছিলাম। এক সপ্তাহের জন্যেও কেউ দিল না। তাই ভাবলাম তুমি উচ্চমাধ্যমিকের সময় যে টেস্টপেপারে প্র্যাকটিস করেছো সেটা যদি পাই তবু কিছুটা কাজে দিতে পারে। পুরোনো হলেও, সেখানে তো অনেক প্রশ্ন-উত্তর আছে। বইয়ের চ্যাপটার তো পাল্টায়নি। তোমাদের সময় যে চ্যাপটারগুলো ছিল এখনো তাই আছে। শুধু বাংলার টেক্সট বইয়ে খান দুই গল্প পাল্টেছে।”
তার কাছে টেস্টপেপার আছে তা সনাতন জানলো কেমন করে? যেহেতু সে উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গেছে এবং এ’সময় সবাই এই বই ব্যবহার করে, সেই ভাবনায় আন্দাজে তার কাছে এটা আছে ধরে নিয়ে এসেছে? না কি, তার জীবনের সেই কালো দিনটার কথা ছেলেটা ভাল করেই জানে? বিপ্লবের তাদের বাড়িতে আসার কথা, তাকে বিষয় করে পাড়ার বদমায়েশদের টানাহেঁচড়া করা। সব ঘটনা জেনেই কি সনাতন এসেছে? সনাতন বইটা চাওয়ার পর খানিক চুপ করে থেকে কথাগুলো ভাবল অলোকা। তারপর দু’হাতের আঙুলের ফাঁকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া চুলগুলো গুছিয়ে পেছনের দিকে ফেলে বলল, “আমার কাছে টেস্টপেপার আছে তুই জানলি কি করে, সনাতন? ওটা কিনে দেবার সামর্থ আমার বাবার তো ছিল না। তোর বাবার মত অবস্থা আমার বাবারও। তোকে কেউ কি বলেছে?”
অলোকাদির এমন পাল্টা প্রশ্নে সনাতন কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণের জন্যে মনটা ওকে থমকে দেয়। ঠিক কি বললে অলোকাদি কিছু মনে করবে না সেসব সাত সতেরো ভাবতে থাকে। কিন্তু জুতসই কোন তোষামোদি কথা সে খুঁজে পেল না। বড়ই বিড়ম্বনার ব্যাপার। আসলে একটা ঠিক কথাকে চাপা দিতে গিয়ে অনেকগুলো বেঠিক কথা সাজাতে হয়। আর শেষ পর্যন্ত অন্যপক্ষ নিশ্চিতও হয়ে যায় যে সে ঠিক কথা বলছে না। তাতে নিজেকে ছোট হতে হয়। তাই সত্যি কথাই বলতে চাইল সনাতন, “জানো তো অলোকাদি, সেই যে তোমাকে জড়িয়ে বিপ্লবদার সঙ্গে পাড়ায় ঝামেলা হয়েছিল না, তখন এই টেস্টপেপার-টেস্টপেপার কথা খুব চাউর হয়ে গেছিল। যারা চাউর করছিল তারা কিন্তু টেস্টপেপার কি, খায় না মাখে তার কিচ্ছু জানে না। সবই তো ‘ক’ অক্ষর গো মাংস’র দল। মাধ্যমিকে আমি টেস্টপেপার ঘেঁটেছি, তাই ওটা আমার মাথায় থেকে গেছিল। এখন আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম কেমন করে টেস্টপেপার জোগাড় করি। নিরুপায়ে তাই তোমার পুরোনোটা নিয়েই কাজ চালিয়ে দেব ভাবি। বিপ্লবদার কথা তুললাম বলে তুমি কিছু মনে করলে, দিদি? আমি কিন্তু ইতস্তত করছিলাম বিপ্লবদার নামটা তুলতে। তোমাকে তুষ্ট রাখতে ঘুরিয়ে অন্য কথা বলা যায় কি না ভাবছিলাম। কিন্তু মিথ্যা বলতে বাঁধছিল। তাই সত্যিটা বলে দিলাম।”
কিঞ্চিৎ উদাসী হয়ে গেল যেন অলোকাদি, তার কথায়। শূন্যে দৃষ্টি উঁচিয়ে অলোকাদি বলল,“কি আর মনে করবো বল ভাই। যা সত্যি তা সত্যিই। সেটা কখনো মিথ্যা হয়ে নবরূপ নিতে পারে না। এটা তুই তো মানবি যে বিপ্লবদার মত সমকক্ষ একটা ছেলে আমাদের এই রুইদাস পাড়ায় পাওয়া যাবে না। আমাদের পাড়া কেন, ওদের পাল পাড়াতেও পাওয়া যাবে না। আমাকে কত উপকার করেছে তা আমি জানি। ও যদি আমার পাশে না থাকতো তো আমি নিজেদের চেষ্টায় এতটা লেখাপড়া করতে পারতাম না। অসম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে। কত বই-খাতা-নোটস্ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে জানিস? তার নখের যোগ্য হতে পারবে রুইদাস পাড়ার ওইসব অসভ্যগুলো? ওরাই আবার আমাকে পেতে চায়। কতবড় স্পর্ধা ! তোর কথায় আমার মনে করার কি আছে। বরং আমি খুশি হয়েছি, তুই সত্যি কথাটা বলতে পেরেছিস বলে। পাড়ার ছেলে হিসেবে তোরও সবটা জানা দরকার। তাই তুই ছোট হলেও বড় দিদির কথা তোকে বললাম। আর একটা কথা কি জানিস তো সনাতন, তোর জীবনখাত আর আমার, বলা যেতে পারে প্রায় একই খাতে বইছে। তোকে যেমন অভাবের সঙ্গে, বদ্ধ সমাজের সঙ্গে লড়ে এগোতে হচ্ছে, আমারও তাই। মেয়ে হিসেবে আমার সমস্যা আরও অনেকটা বেশি এই যা। দিনমানে হলেও, আমি যে এই একা একা বাড়ির বাইরে বার হতে পারছি, কলেজে যেতে পারছি। তা তো আমার কত-জন্মের সৌভাগ্য। এই সেদিন পর্যন্ত। আমাদের মায়েদের সময়। মেয়েদের, আমাদের মত একা বাইরে পা বাড়াবার আইন ছিল? সেই দুঃসাহস কেউ দেখালে সেই মেয়ের জীবন সমাজের কাছে বলি প্রদত্ত হয়ে যেত। তুলনামূলকভাবে আমাদের রুইদাসপাড়া এই ব্যাপারে বলা যেতে পারে এই হালে করে একটু সাবালক হয়েছে। পাড়ার লোকজন, মুরুব্বিরা রুজি রোগারের তাড়নায় বাইরে এদিক সেদিক বার হতে বাধ্য হচ্ছে। বৃহত্তর সমাজে মেলামেশা করছে বলে বদ্ধতা থেকে কিঞ্চিৎ খোলা মন হতে পেরেছে। এখন বাদ দে ওসব। যে কথা বলছিলাম, আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বটগাছ তলায় অমন হতাশ এবং মনঃকষ্টে বসে আছিস দেখে আমি বুঝেছিলাম তোর লড়াইটা কত প্রকট। অসহায় তোর মা ছেলের এই কষ্টে মুহ্যমান। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে ক্ষণিকের জন্যে আমি থমকে গেছিলাম। নিজেকে ধরে রাখতে পারব না বলে আমি কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। আমারই বা কত ক্ষমতা বল। তোর চলাফেরা, লেখাপড়ার সব খবর রাখার চেষ্টা করি আমি। হয়তো সবটা সবসময় জেনে উঠতে পারিনি। তবু চেষ্টা জারি রাখি। মাধ্যমিকে তুই অত ভাল রেজাল্ট করেছিস। তা কি আমাদের কম গর্বের বিষয়। তবু পাড়ার কেউ তোর পাশে এসে দাঁড়ায় না। যার সামর্থ আছে সেও না। আর যার নেই সে তো নয়ই। কিন্তু এই নেই-ওয়ালারা তো মানসিক শক্তি, সাহস যোগাতে পারে। সেই বোধেরও কত অভাব। সবসময় কেমন করে চুল্লু, মদ পাওয়া যায় সেই চিন্তায় দিন কাবারে ব্যস্ত থাকলে আর সুস্থ চিন্তা তাদের মধ্যে আসবে কেমন করে! তুই আমাদের বাড়ি এসে ঠিক কাজটাই করেছিস। আমার পক্ষে তোর পড়াশোনায় যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব আমি করব। প্রয়োজন হলেই তুই আমার কাছে চলে আসবি। কোন দ্বিধা করবি না। আমার কাছে দুটো টেস্ট পেপার আছে। দুটোই বিপ্লবদা দিয়েছিল। একটা পুরোনো, আর একটা নতুন কিনে দিয়েছিল বিপ্লবদা। সঙ্গে অমর স্যারের দেওয়া ভাল ভাল কিছু নোটস্ও আমাকে দিয়েছিল। এখন টেস্টপেপার দুটো নিয়ে যা। নোটগুলো অন্য দিন নিয়ে যাস। এদিক ওদিক সব খাতা-বইয়ের ভেতর লুকিয়ে আছে। গুছিয়ে একসাথে করে নিই। সামনের রবিবার তুই আসিস।

পেয়ে যাবি। ভাল করে পড়। মাধ্যমিকের থেকে উচ্চমাধ্যমিক আরও টাফ্। সেটা তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। দেখা গেছে অনেকে মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট করেও উচ্চমাধ্যমিকে সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। সেটা মাথায় রেখে এগোবি। তবে পাশাপাশি একটা কথা মনে রাখবি, আমরা কিন্তু ছাপোষা ঘরের ছেলেমেয়ে। তারপর তুই ছেলে। বড় হচ্ছিস। অভাবী সংসারে বাবার একটু হাতেধরা হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল হয়ে শুধু বইয়ে মুখগুঁজে থাকার কপাল আমাদের নয় রে সনাতন। সংসারকে বাঁচাতে তোকে বাবার সঙ্গও দিতে হবে। বাবার কষ্টের মুখটার দিকেও তোকে তাকাতে হবে। প্রচুর প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে। সবটার সঙ্গেই লড়াই করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মনে জোর রাখ। দেখবি সাফল্য তোর কাছে ধরা না দিয়ে পারবে না। সাফল্য কিন্তু উপযুক্ত পাত্রে ধরা দেবার জন্যে সবসময় মুখিয়ে থাকে। জাত-বেজাত গরিব-ধনীর কোন ছুৎমার্গ তার নেই।”
কথায় কথায় অনেকটা সময় চলে যায়। রাস্তা থেকে এক ব্যাটারির কমদামী চর্টলাইটের টিমটিমে আলো এসে পড়ে অলোকাদের উঠোনে। সনাতনের মায়ের গলা ঠিকরে আসে এদিকে, “সনাতন, সনাতন! সনাতন?”
সঙ্গে সঙ্গে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ায় অলোকা, “ওই তোর মা ডাকছে সনাতন। যা। অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছিস। চলে যা। রবিবার আসিস।” সনাতন দোলা থেকে উঠে টেস্টপেপার দুটো বাঁ-হাতে নিয়ে সাড়া দিল,“যাচ্ছি মা ! আলোটা এদিকে ধরো। অলোকাদি, আসছি। রবিবার সন্ধ্যে উপচে আসব। ওইদিন দুপুরে বাবার সঙ্গে হাটে যাবো ধামা-পালি বেচতে।”

[কুড়ি]

বাবার ‘হাতে-ধরা’ হতে মাঝে মাঝে সময় পেলেই সনাতন দিঘিরপাড়ে জুতো সারাই দোকানে বসে। জুতোর কোন ধরণের সারাইয়ে কত দাম, তা সে দোকানে থেকে থেকে শিখে গেছে। ইনবাইসের শুঁড়ের ভেতর জুতোর ছেঁড়া অংশটা ঢুকিয়ে বাটালি দিয়ে ধুম ধুম করে কেঁটকী মেরে সারাইয়ে সবচেয়ে সস্তা পড়ে। তারপর ফোঁড়-সূতো দিয়ে সেলাইয়ে একটু বেশি দাম পড়ে। সবচেয়ে দামী সারাই হল, চামড়া জুড়ে জুতো সারাই। একটু বাবুবাবু দেখতে খদ্দের হলে, সনাতন দেখেছে, তার বাবা জিজ্ঞেস করে,“চামড়া দিয়ে সেলাই করে দেব বাবু? মজবুত হবে। অনেকদিন টিকে যাবে। তবে কেঁটকীর থেকে দাম বেশি পড়বে। আর কেঁটকী সেলাইয়ের কোন গ্যারান্টি নেই। আপনার জুতোর শরীরের যা হাল, এতে সূতো দিয়ে সেলাই করলে, সেলাই ধরে রাখা যাবে। ফেঁসে যাবে না জুতোর শরীর।” কেউ বাবার কথায় রাজি হয়, কেউ না হয়ে বলে, “ও তুমি কেঁটকী মেরেই দাও রতন। এ জুতোর আয়ু হয়ে এসেছে। অত যত্ন ওর কপালে সইবে না।” আর পথ চলতি মহিলা খদ্দের? যত জন, তত রকম ভাবনা। তারা এত ব্যস্ত যে চমড়া দিয়ে তাপ্পি মারার সময় তাদের হাতে নেই। জুতোর শোল থেকে খুলে বেরিয়ে গেছে উপরের অংশ। আঠা খুলে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে জুতোটা নতুন। বাবা বলল, “দিদিমণি, এ তো নতুন জুতো। কেঁটকী মারলে শোল-চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন চামড়া জুড়ে সেলাই করে দিই। দশ টাকা লাগবে।” ব্যস্ততায় খরিদ্দার বলল, “কেঁটকী তিন টাকা আর সেলাই দশ? একটাকা বেশি নাও, চারটাকা দেব। চামড়া দিয়ে সারিয়ে দাও।
-না দিদিমণি। হবে না। বলছেন যখন তখন আট টাকা দেবেন। আমার চামড়ার দাম আছে না?
-ঠিক আছে, তোমার দামী চামড়া তোমার কাছে রাখো। কেঁটকীই মারো। আমার তাড়া আছে। কোন রকমে বাড়িতে যেতে পারলেই হল। আবার এই ফালতু জুতো পায়ে গলাবো নাকি!
খদ্দের চলে গেলে রতন ছেলেকে বলল, “দেখবি, ওই মেয়েটা ফের ওই জুতো পরেই বাইরে বার হবে। কেঁটকী আর ক’দিন সামলে রাখবে। দু’চার দিনের মধ্যেই হার মানবে সে। মেয়েটাকে আমি চিনি। আলুপোতায় বাড়ি। হাঁটা পথে এখান থেকে আধ ঘন্টা সময় লাগে। তার উপর রাস্তা উবলো খাবলা।” কথাটা বলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় রতন,“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি রে বাবা। মিলিয়ে নিস কথাটা। আর চামড়ার কথা উপযাচক হয়ে কেন খদ্দেরকে বলি জানিস, এতে দুটো পয়সা চোখে দেখা যায়। ব্যবসার এটা একটা কৌশল। মানুষকে না ঠকিয়ে যদি একটু বেশি আয় করা যায় সেটাতে তো কোন অন্যায় নেই!”
সেদিনটাও রবিবার ছিল। সনাতন বাবার সাথে দোকানে। ও দেখল, সেই মেয়েটাই ‘রতনদা রতনদা’ বলে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে,“রতনদা, জুতোটা ছিঁড়ে গেছে। সেরে দাও না। বড্ড তাড়া আছে। বাড়ি ফিরতে হবে।” সনাতন দেখল, সেই জুতোটাই, যেটা সেদিন তার বাবা কেঁটকী মেরে সারিয়ে দিয়েছিল। ওর বাবা আর কোন কথা না বাড়িয়ে কয়েকটা কেঁটকী ধপাং ধপাং করে মারতে শুরু করে দেয়। ব্যস্ত খরিদ্দার, তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে। তাই তারও ব্যস্ততার অন্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বলল,“কি করছো রতনদা। কেঁটকী মারছো কেন? আমি তোমাকে কেঁটকী মারতে বললাম? কেঁটকী মারলে তো আবার তা খুলে যাবে। মাঝ পাথে ছেঁড়া জুতো পায়ে ন্যংচাতে ন্যংচাতে আসা। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার। সব ছেলেরা তাকিয়ে থাকে। ইস্ যাচ্ছেতাই ব্যাপার। চামড়া দিয়ে সেলাই করে দাও ভাল করে। দেখবে, যেন কেঁটকীর মত রাস্তাঘাটে সেলাই খুলে না যায়।”
এবার একটু বিরক্ত হল রতন, “আপনি তো দিদিমণি বলেননি যে চামড়া দিয়ে সেলাই করতে হবে। তাড়া আছে বললেন। সেলাই করতে হলে তো আমাকে সময় দিতে হবে। সে সময় তো আপনার কাছে নেই! এখন তো দুটো কেঁটকী আমার মারা হয়ে গেছে। কি করবো এখন?”
-ও দুটো খুলে সেলাই করে দাও। বাব্বা, আবার ওই কেঁটকীর চক্করে আমি যাই। তুমি সেলাই করে দাও রতনদা। আমি অপেক্ষা করছি।
-আমার যে দুটো কেঁটকী নষ্ট হয়ে গেল। তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আপনি দেবেন তো? তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
এবার মেয়েটা নরম হয়ে বলল, “ছেড়ে দাও রতনদা। ওর দাম নিয়ে আর চাপাচাপি কোরো না। দেখো আমরা তো তোমার বাঁধা খদ্দের বলো? সুবিধে অসুবিধে হলে আমরা কি অন্য কোথাও যাই? যাই না। তোমার কাছেই আসি।” রতন আর কথা বাড়ালো না। কারবারে সবসময় চুলচেরা হিসেব করলে হয় না। কোনটায় লাভ কম কোনটায় পুষিয়ে যায়।
পাশে সনাতন তখন একটা খদ্দেরের বুট পালিশ করছিল। খদ্দের ছেড়ে রতন বলল,“দেখলি খোকা, আমার কথা মিলে গেল তো। এরকম কত ধরণের খদ্দের সামলাতে হয় দেখ। তুই তখন আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলিস। কেন, তা আমি বুঝিনি মনে করেছিস ? বুঝেছি। ভাবছিলিস বাবা মেয়েটার কাছ থেকে কেঁটকীর দাম নিল না কেন? আমাদের দোকানের তাহলে তো লস্ হয়ে গেল! তোর ভাবনায় ভুল নেই। কিন্তু অনেক সময় মানুষকে দরকারে একটু পিছিয়ে গেলে দোষের কিছু না রে। আখেরে সেটা ভালই হয়। এগিয়ে যাবার রাস্তা খুলে দেয় ওই পিছড়েবর্গ। দেখবি, ওই মেয়েটা দরকারে আমাদের কাছেই আসবে। এই যে ওর কাছ থেকে দাম কম নিলাম, আমার প্রতি ওর বিশ্বাসটা পাকা হয়ে গেল যে রতন জুতোওলা এক পয়সার মা বাপ না। একটা ভাল ভাবনা আমাদের প্রতি ওর মনে পাকা হয়ে রইল। ওই খদ্দেরটাই আমাদের হয়ে অন্য খদ্দেরকে সুপারিশ করবে। তাই বলে সবসময় ঢালাও ছাড় দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেটা আমরা পারবো কেন। আমাদের ছোট্ট কলিজা। বেশি ধকল সইতে পারবো না।”
একটা অফিসবাবু বুট পালিশ করতে দিয়ে বাজার করতে গেছে। সনাতন সেটা পালিশ করে কাঠের বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ছেলের পালিশ দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হয় রতন। এই কাজটা ছেলে ভালই রপ্ত করেছে। চকচক করছে জুতোটা। ওর সামনে মুখ রাখলে মুখ দেখা যাচ্ছে। ওর মনে এই ধারণাটা হয়েছে যে কাজ ভাল করলে তাদের কারবারে সুনাম হবে আর খদ্দের বাড়বে। তাই এত যত্ন করে কাজটা করেছে। অবশ্য কালির সাথে ক্রিম পালিশ হয়েছে বলে এতটা ভাল হয়েছে। সব খদ্দের তো আবার ক্রিম পালিশের পয়সা দিতে চায় না। ক্রিম পালিশের একটু দাম বেশি। এমনি কালির পালিশ আট টাকা আর ক্রিমে বারো টাকা। এই চার টাকার জন্যে লোকে যেন মুর্ছা যায় আরকি। সেই জন্যে রতন আগে থেকে ঝগড়া করে নেয়, শুধু কালির পালিশ না ক্রিম পালিশ। ক্রিম হলে আরও চার টাকা বেশি দিতে হবে বাবু। এই বাবুর সঙ্গেও আগে থেকে কথা ভেঙে নিয়েছে। ক্রিম পালিশে রাজি হয়েছে। ছেলেটাও যত্ন করে কাজটা করে দিয়েছে। আসলে ক্রিমে ওদের একটু লাভ হয়। তাই খদ্দেরের সঙ্গে ওরা নিজে থেকেই কথা পেড়ে নেয়। জোর দেয় ক্রিমে, যদি রাজি হয় আর কি…
অফিসবাবু, তার জুতো পালিশ দেখে খুশি হয়ে নীরবে হাসে, “বারে রতন, বেশ চকচকে করে পালিশ করেছিস তো!”
-আমি করিনি বাবু, আমার ছেলে করেছে। তাছাড়া ক্রিম পালিশে একটু সুন্দর দেখতেও হয়। চামড়াও ভাল থাকে। তার উপর কারিগরের কব্জির টানটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
-তোর ছেলেটা তাহলে ভালই হাতেধরা হয়েছে বল, রতন?
-তা একটু হয়েছে। বাপের যুগ তো আস্তে আস্তে খতমের দিকে। এবার তো ছেলেদের যুগ। সবকিছু বুঝে না নিলে চলবে কেন? তারপর সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলে,“টাকাটা বাবুর কাছ থেকে নিয়ে নে খোকা।

টাকাটা নিয়ে সনাতন বলে, “আর দু’টাকা দিন বাবু। বারো টাকা।” বলে ওই দশ টাকার নোট হাতে নিয়ে, তার হাতটা বাবুর দিকে বাড়িয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবুটা বলে, “কি বলছিস, আরও দু’টাকা কিসের? উল্টে তুই আমাকে দু’টাকা ফেরত দিবি। জুতো পালিশ তো আট টাকা। বারো টাকা আবার কবে হল! দে, আমাকে দু’টাকা ফেরত?” সঙ্গে সঙ্গে রতন বলে, “না বাবু, ক্রিম পালিশ বারো টাকা। আর এমনি কালির পালিশ আট টাকা। আপনাকে তো ক্রিম পালিশ করে দেওয়া হয়েছে। আপনার সঙ্গে আগে থেকে কথা ভেঙে নেওয়া হয়েছে। আপনি রাজি হয়েছেন বলেই তো আমরা ক্রিম পালিশ করেছি।” এবার অবজ্ঞার ছলে লোকটা বলে,“তুই ছাড় তো ক্রিম পালিশের গপ্প। সব সমান। সামান্য দু’চার টাকার মায়া ছাড়তে পারছিস না বল্? দে, আমায় দু’টাকা ফেরত দে। এই ছেলেটা, হাত নামা। তোর বাপকে বল্ দু’টাকা ফেরত দিতে।” বাপের সঙ্গে এই কথাকাটাকাটি সনাতন একদম মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। আচ্ছা বেয়াড়া লোক তো! কথা বলে কাজ করা হয়েছে। এখন উল্টো গাইছে? এবার সনাতন বলল, “না বাবু, আপনাকে আরও দু’টাকা দিতেই হবে। আমাদের গতরে খাটা পয়সা। মাগনা আপনাকে ছেড়ে দেব না। দিন বাবু দিন, আর দু’টাকা দিন। দু’টাকা ছাড়া যাবে না। আপনারা বাবু লোক। অফিস কাছারি করেন। আপনি এই ক’টা টাকার মায়া ছাড়তে পারছেন না। উল্টে আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষকে ‘মায়া-ছাড়ার’ নিদান দিচ্ছেন! আচ্ছা ‘তরফের’ মানুষ তো আপনি!” এই “আচ্ছা তরফের মানুষ” কথাটা বলতেই আঁতে ঘা লেগে যায় বাবুর! ক্ষেপে লাল চোখ করে বলে,“শালা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা। গাল টিপলে দুধ বার হবে। তুই আমাকে ব্যঙ্গ করিস। দে শালা দে আমার দু’টাকা ফেরত দে। ভেবেছিলাম টাকাটা ছেড়ে দেব। এ তো দেখছি ‘তায়বাড়া’। খুব রোখ দেখছি এর। একে তো ছাড়া যাবে না!” এবার সনাতন আর মাথার ঠিক রাখতে পারে না। টগবগে উঠতি যুবক। বিনা অন্যায়ে তাকে জাত তুলে ছোটলোক বলায় ওর মনে আঘাত লাগে খুব। দোকান ছেড়ে উঠে লোকটার কাছ থেকে জুতো জোড়া ছিনিয়ে নিয়ে বলে, “টাকা দেবেন তারপর জুতো নিয়ে যাবেন। আমরা ছোটলোক রুইদাস বাচ্চা কে না জানে। এত যদি এদের ওপর ঘেন্না তো আসেন কেন এদের সেবা নিতে। নিজের কাজ নিজে করবেন। কোনদিন আর আসবেন না আমাদের দোকানে। আপনার মত খরিদ্দার না এলেও আমাদের চলে যাবে। আমরা ঠিক খেতে পাবো।” তার হাত থেকে জুতো কেড়ে নেওয়ায় আরও অপমানিত হয় লোকটা, “শালা ছোটলোকের বাচ্চা, তোর এত বড় সাহস, আমার হাত থেকে জুতো কেড়ে নিস? জীবনে এই জুতো পায়ে গলাবার যোগ্য হতে পারবি না। এর দাম কত জানিস। বাটার ‘মোকাসিনো’ জুতো কত দাম তোর বাপেরও জানা নেই। দে শালার বেটা আমার জুতো?” বলে সনাতনের হাত টানতে থাকে। সনাতনও নাছোড়। তার শান্ত ছেলেটা ক্ষেপে গেছে দেখে রতনও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাবুটাকে থামাতে চেষ্টা করে বলে,“সনাতন ত্যাগ দে ওই দু’চার টাকার মায়া। আমাদের মুখ্যুসুখ্যু পেয়ে কত বাবু ওরকম ঠকিয়ে যায়।” ইতিমধ্যে চেঁচামেচিতে বাজারের লোক জড়ো হতে থাকে। লোকের মুখে মুখে ঘটনাটা চাউর হতে সমবেত লোক জুতোবাবুকে নিয়ে নানান বিরূপ টিপ্পনী শুরু করে দেয়, “শালা চোরের মায়ের বড় গলা রে। গরিবের পয়সা মেরে আবার হম্বিতম্বি করতে কসুর করে না। মানুষের মদত পেয়ে সনাতন আরও নাছোড়বান্দা হয়ে যায়। রোখ চেপে যায় ওর মধ্যে। পুরো পয়সা না দিলে সে জুতো হাতছাড়া করবে না। শেষপর্যন্ত মানুষের চাপে পুরো টাকা দিতে বাধ্য হয় জুতোবাবু।
ঘটনাটার কথা লোকের মুখে সওয়ার হয়ে রুইদাসপাড়া ছেয়ে যায়। সনাতনের মত নির্বিবাদী ছেলে এখন পাড়ার সকলের মুখে মুখে। তাদের জাতের অপমানের প্রকাশ্য প্রতিবাদ সনাতনের মত মুখচোরা ছেলে যে করতে পারে তা যেন কারোরই ধারণায় ছিল না। ওকে নিয়ে গর্ববোধ করতে থাকে সবাই। সনাতন কিন্তু ব্যাপারটায় গর্ব করার মত কিছু দেখতে পায় না। উল্টে বরং ও চিন্তা করতে থাকে, এতটা প্রতিবাদী হওয়াটা মনে হয় তার ঠিক হল না। শান্ত পুকুরে যেন একটা বড় আধলা ইট ফেলে দিল সে। সেই ইটের অভিঘাতে সে এখন বাজারে, পাড়ায় ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে তো সে আর হিরো বনে যেতে পারে না। ওই জুতোবাবুর পক্ষে যারা তারা তো তাকে বাঁকা চোখে দেখবেই। বাঁকা চোখে দেখা মানেই তার অমঙ্গলের ভাবনা ওরা করতে থাকবে। সুযোগ পেলে ক্ষতিসাধন করতে তাদের বাধবে না। কিন্তু তাদের মত গরিব ঘরের পক্ষে সেই ক্ষতির অভিঘাত সে কেমন করে সামলাবে। এমনিতেই দুবেলা পেটের অন্ন জোগাতে বাবা হিমসিম খায়। তো উটকো কোন ঝামেলা ঘাড়ে চাপলে কি হবে ! বাবা তো একদম গুম হয়ে রয়েছে। সে যে কোন অন্যায় করেনি তা বাবা ভাল করে বুঝেছে। তাই তার এই রুখে দাঁড়ানোতে বাধা দিয়ে কোন কথা বলেনি। ছেলেকে সামাল দিয়ে গেছে। কিন্তু বাবার চিন্তা যে অন্য জায়গায় তা সে খুব ভাল করে বুঝতে পারছে। বাবা ভাবছে এইসব নিয়ে যদি কোন উটকো বিপদ হামলে পড়ে তো সামলাবে কেমন করে। সেই চিন্তা সনাতনেরও। তাই তার মনে হচ্ছে অত জেদ না করলেই হয়তো হত। ছেড়ে দিলেই হত ওই চারটে টাকা। কিন্তু আবার ভাবে, প্রশ্নটা তো চার টাকার নয়। প্রশ্নটা তাদের আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানিতে। তারা মুচি, গরিব, তথাকথিত নিচু জাত। তা সমাজের কে না জানে। তাই বলে ওই জাত তুলে, গরিবীর সুযোগ নিয়ে তাদের ওইরকম কুৎসিৎভাবে ঘেন্না করার অধিকার তো কারোর নেই! সে তো পড়েছে, ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’ তাহলে এই মহান কথাটা একদম ফালতু? মানুষ হিসেবে তাদের তো একটা ন্যুনতম সম্মান পাবার অধিকার আছে। সেই অধিকারে আঘাত পেলে সে রুখে দাঁড়াবে না? রুখে দাঁড়িয়ে কি সে ভুল করেছে? নিশ্চয়ই করেনি। বরং সেজন্যে সে গর্বিত। কিন্তু ওই যে। ওরা গরিব। ওদের অর্থ নেই। ওরা আর্থিকভাবে দুর্বল। তাই ওরা সমাজের একশ্রেণীর পচা পয়সাওলাদের দ্বারা পদদলিত। অবহেলিত। তবু যেন এই অবহেলা, বঞ্চনার কথা তাদের মুখ ফুটে বলার অধিকার নেই!
ওইদিন সন্ধ্যেবেলা কথামত অলোকাদিদের বাড়ি যায় সনাতন। অলোকাদি তখন রান্নাঘরে। সেখান থেকেই বলল, “সনাতন দোলায় বস। আমি যাচ্ছি। এই হাতের কাজটা সেরে নিই। তোর তাড়া নেই তো?” একটু ব্যস্ত হয়ে তখনই সনাতন বলল, “না না দিদি। তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি কাজ সেরে এসো। আমার তাড়া নেই। আমি ততক্ষণে এই দোলাতে নাড়া খাই। নাড়া খেলে গায়ে হাওয়া লাগে।” দোলনাড়া খেতে খেতে সনাতন দেখে অলোকাদি একটা বাটিতে কি যেন নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মোড়াটা বাঁহাতে নিয়ে ডান হাতে বাটিটা নিয়ে ওর সামনে বসল,“এই নে সনাতন, নাড়ু খা। চৈতে নাড়ু মা বানাচ্ছিল। আমি মাকে হেল্প করছিলাম। গরম গরম। খেতে ভাল লাগবে। আমি খেয়েছি। সবটাই তোর। আমার জন্যে তোর ব্যস্ত হতে হবে না।” বলে সনাতনের হাতে নাড়ুর বাটিটা তুলে দিল, অলোকা। সনাতন তৃপ্তি ভরে নাড়ু খেতে থাকে। অলোকা আত্মতৃপ্তিতে তা উপভোগ করে। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল, তোর এই তৃপ্তি আমার হৃদয়কে যেন আনন্দে ভরিয়ে তুলল।” সনাতন খেতে খেতে খুশি মুখে বলল, সত্যি দিদি, আমার মনটাও আনন্দে ভরে উঠল। কতদিন এই চৈতে নাড়ু খাইনি। এসব তো আমাদের কাছে বিলাসিতা। দু’মুঠো ভাত যোগাতে যারা হিমসিম তাদের সংসারে নাড়ু বানানো তো স্বপ্ন। ইচ্ছে থাকলেও মা’র সামর্থ নেই।” সনাতনের কথায় পরিবেশটা যেন একটু ভারি হয়ে গেল। সেটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে অলোকা বলল,“তোর সব নোটস এখনো খোঁজা হয়ে ওঠেনি। আসলে কলেজে একটা প্রজেক্ট জমা দেবার তাড়া ছিল। সেটা জমা দিতেই হবে। নাহলে নাম্বার কাটা যাবে। তা তুই আসবি বলে সামনাসামনি হাতের কাছে যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো টেবিলে রাখা আছে। দিচ্ছি তোকে। ততক্ষণ তুই এগুলো দেখ। একসাথে তো সব পড়া যায় না। এগুলো দেখতে দেখতে ততক্ষণে আমি অন্যসব খুঁজে রেখে দেব। পরে নিয়ে যাস বা রাস্তায় দেখা হলে আমি তোকে বলে দেব’খন।
তখন নিয়ে আসবি। দাঁড়া, খা ততক্ষণ। নোটগুলো আমি ঘর থেকে নিয়ে আসি।” একটা পলিথিনের প্যাকেটে ওগুলো নিয়ে অলোকাদি এল। ভারি প্যাকেট দেখে সনাতন বলল,“দিদি, এতো প্রচুর নোটস্। এর পরেও আরও আছে ! দিদি, তোমার অত ব্যস্ত হতে হবে না। আগে আমি এগুলো পড়ে শেষ করি, তারপর অন্যগুলো তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাব। আজ তাহলে আসি দিদি।” বলে সনাতন দোলা থেকে উঠতে যাবে, সেই সময় কৌতূহলী দৃষ্টিতে অলোকা বলল,“হ্যাঁরে সনাতন, আজ তোকে নিয়ে বাজারে কি গন্ডগোল হয়েছে রে? পাড়ার লোক সব তোকে নিয়ে আলোচনা করছে? কলেজ থেকে আসতে আসতে আটচালায় জটলা হয়ে লোকে তোর কথা বলাবলি করছে। ঘরে আসতে আমার মা-ও একই কথা বলল?”
আবার দোলাতে কঁ-চ করে বসে পড়ল সনাতন। ঘটনার সবিস্তার বিবরণ দিয়ে সনাতন মন্তব্য করল, “আচ্ছা দিদি, তুমি বলো, আমরা গরিব, মুচি তথা নীচু জাত বলে কি আমাদের কোন মান সম্মান থাকতে পারে না? লোকটা ঘেন্নার দৃষ্টিতে আমার সঙ্গে আচরণ করছে ! তখনই আমার মধ্যে জেদ চেপে যায়। আমিও লোকটাকে সহজে ছাড়িনি। লোকটাকে ভুল স্বীকার করিয়েছি, পুরো পয়সাও আদায় করেছি। পরে ভাবলাম দিদি, এতটা করা মনে হয় আমার ঠিক হ’ল না। আমার পক্ষে এটা বাড়াবাড়ি হ’ল কি না কে জানে। ওই বাবু লোকটা তো আমাকে কোনদিন ভাল চোখে দেখবে না। এক বাজার লোকের সামনে অপমানিত হতে হয়েছে তাকে। ও কি সহজে আমাকে ছেড়ে দেবে ! কি জানি, কি হবে! আমরা গরিব ঘরের ছেলে। ওই পয়সাওলাদের সঙ্গে যুঝবো কেমন করে! যদি লোকটা থানায় কেসমেস করে দেয়! অলোকা দেখলো ছেলেটা বেশ ভয় খেয়ে গেছে। কিন্তু এত ভয় পাবার তো কোন কারণ নেই? ওকে সাহস দিয়ে ভয় কাটানো দরকার, “এই সনাতন, তুই অত দমে যাচ্ছিস কেন। তুই তো কোন অন্যায় করিসনি। সেটা তো বাজারের সব মানুষ জানে। মানুষই তো বাধ্য করিয়েছে লোকটাকে ভুল স্বীকার করাতে। লোকটা তোর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে মানুষই তোর পাশে দাঁড়াবে। তোর বিরুদ্ধে কোনকিছুই তখন ধোপে টিকবে না। ভয় পাওয়া মানে তো হেরে বসে থাকা। চেতনাকে টলমল করে দেওয়া। তোর মধ্যে শিক্ষা ছিল বলেই তোর চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের রুইদাসরা এইভাবে পয়সাওলাদের কাছে মাথা নত করে এসেছে। সেই শিক্ষা রুইদাসরা এতদিন পায়নি বলেই এটা হয়ে এসেছে। তোর সঙ্গে তোর বাবাও তো ছিল। যেটা তুই করতে পারলি সেটা তোর বাবা করতে পারতো। পারতো না। সেই শিক্ষা তোর বাবা পেয়ে উঠতে পারেনি তাই সম্ভব হয়নি। যা বাড়ি যা। বুকের বলের উপর ভর করে এগিয়ে যা।”
অলোকাদিদির কথায় সনাতনের মনের ভেতর যেন একটা আশার আলো ফুটে ওঠে। ভাবে এইরকম করে তো এর আগে তাকে কেউ বলেনি ! অমর স্যার তার পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু তার জীবন চলনের যন্ত্রণা, বাধাবিপত্তি থেকে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার প্রেরণা এই প্রথম সে অলোকাদির কাছ থেকে পেল। মনের যাবতীয় দুর্বলতা, ভীতি যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। দিদির প্রতি কৃতজ্ঞতাভরা অভিব্যক্তিতে বলল,“দিদি, আজ আসি। রাত হয়ে যাচ্ছে। মা না হলে আবার ডাকতে আসবে। দিদি, আর একটা কথা বলি। তুমি অন্যভাবে নেবে না তো?”
-আরে ভাই বল না। দিদি বলে যখন ডেকেছিস তখন ভায়ের কথায় দিদি অন্যরকম কিছু ভাববে কেন! মন খুলে বল।
-না দিদি, সেরকম কিছু নয়। মাঝে মাঝে আমি কিন্তু দিদি, তোমার কাছে আসবো। তোমার মূল্যবান পরামর্শ আমার চাই। যখনই দরকার পড়বে আমি আসবো। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?
-এই পাগল ছেলে। অত বিনয়ের কি আছে। আমি বাড়ি থাকলে তোর যখন মনে হবে চলে আসবি। পরীক্ষার পড়ার ব্যাপারেও কোন জানার থাকলে চলে আসবি। আমার সাধ্যমত আমি তোকে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করব। একদম ইতস্তত করবি না। তোর জন্যে আমাদের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা।

ক্রমশ… 

Exit mobile version