গল্প- জিজীবিষা

জিজীবিষা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

তিন টে দিন কেটে গেল তবু রুমকির একটা খবর পেলাম না।যখনই ফোন করছি তখন ই ফোন সুইচ অফ বলছে। অগত্যা দুশ্চিন্তা ছাড়া আমার হাতে আর কিছু রইল না।
আমার পতিদেব বরুন কে বললাম,হ্যাঁ গো তুমি আমাকে একবার রুমকির জেঠুর বাড়িতে নিয়ে যাবে।
বরুন বলল, রুমকির জেঠুর বাড়িতে কেন যাবে তুমি?
_ ও মা তোমাকে তো বলাই হয় নি যে রুমকি ওর বাবা মায়ের কাছে থাকে না। থাকে না বললে ভুল বলা হবে। বরং বলতে পারো ওর মা মানে ওর সৎ মা থাকতে দেয় না।
জানো রুমকি বলছিল ওর সৎ মা প্রতি মাসে ওর থেকে পাঁচ ঘরে কাজ করে যা পায় ।সেই টাকা টুকু ও কেড়ে নিয়ে নেয়। তার ওপর ঠিকঠাক করে খেতে পর্যন্ত দেয় না।
তবে রুমকির জেঠিমা টা ভালো। সকালের টিফিন,ভাত তো এর ওর ঘর থেকে খেয়ে নেয়। শুধু রাতের খাবার টুকু আর শোওয়ার জায়গা টুকুর জন্য জেঠিমার কাছে কাছে রুমকি।
বরুন বলে,কত আর মেয়েটার বয়স হবে।এই বয়স থেকে কত সংগ্ৰাম করে বাঁচছে। তবে ওদের এই ধরনের জীবন সংগ্ৰাম গুলো ওদের কে বড্ড তাড়াতাড়ি স্বাবলম্বী হতে শেখায়।
তা যা বলেছো।রুমকি গত মাসে আঠারো তে পা দিয়েছে। সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল,বীথি দিদি পোস্ট অফিসে বই খুলতে গেলে কি করতে হয় গো?
তাই নাকি? বাঃ রুমকি তো চালাক চতুর ও আছে।
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,চালাক বলে চালাক।ওর জেঠু তুতো দিদির দেওরের সঙ্গে প্রেম ও করছে।যদিও বাড়িতে কেউ কিচ্ছুটি জানে না।
বল কি গো! তবে আর রুমকি কে নিয়ে চিন্তা করো না। রসিকতা করে বলল বরুন।

মানে ভ্রু জোড়া বেঁকিয়ে বললাম,মানে?
মানে অতি সোজা।রুমকি বিয়ে টিয়ে করে বসে নি তো?
আমি রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বললাম,এই রে বাবা। তাহলে আমি এখন কি করব? তিন দিন তো হয়েই গেল।আর কদিন রুমকির পথ চেয়ে বসে থাকবো।প্লিজ লক্ষ্মী টি। আমাকে আজ সন্ধ্যা বেলায় একবার নিয়ে চলো ওর জেঠিমার বাড়ি। ইচ্ছে তো করছে তুমি অফিস বের হলেই আমি বেরিয়ে পড়ি ওর জেঠুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তো কোনদিন ও নীচু পাড়ায় যাই নি।ওর জেঠুর বাড়ি টাও চিনি না।
ঠিক আছে ঠিক আছে।এত উতলা হয়ে লাভ নেই।আমি অফিস থেকে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো ক্ষণ।
বরুন অফিসে বের হয়ে গেলে আমি আবার রুমকির নাম্বার টা ডায়েল করলাম। অপর প্রান্ত থেকে রিং আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমার হৃদ যন্ত্রটা যেন লাফাতে শুরু করলো।
কিন্তু আমার আনন্দ নিমেষে নিরানন্দে পরিনত হল। রিং হয়ে হয়ে ফোন টা থেমে গেল।যেমন অন্ধকারে ছিলাম ঠিক তেমনি অন্ধকারে রইলাম।
ঘর দোর পরিষ্কার করে স্নান সেরে পূজায় বসলাম।ফুল দিয়ে ঠাকুর কে সাজাতে সাজাতে আবার মনে পড়ল রুমকির কথা।এর ওর বাড়ি থেকে আমার জন্য পলিথিন ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতো।আর বলত,দিদি আমার তো নিজের ঘর নেই যে ঠাকুরের আসন পারবো। আমার হয়ে তুমি ই ফুল গুলো ঠাকুর কে দিয়ে দিও।
আমি বেশ বুঝতে পারতাম রুমকির একটা নিজস্ব ঘরের লোভ আছে। ছোট থেকেই আশ্রিতা হয়ে কাটছে যে ওর জীবন। আশ্রিতা দের জীবনে ভালোবাসা কম অনুকম্পা থাকে বেশি।
পূজো সেরে সোফায় বসে একটা মাসিক ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার মোবাইল টা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে ফুটে উঠল রুমকির ছবি ও নাম।
তাড়াতাড়ি পত্রিকা টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোবাইল টা হাতে তুলে নিয়ে বললাম,হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, দিদি আমি রুমকি বলছি।
হ্যাঁ রে রুমকি তোর ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ দিদি শরীর ঠিক আছে।
তাহলে তিন দিন ধরে কাজে এলে নি না কেন?
একটু একটু আমতা আমতা করে রুমকি বলল,দিদি আমি বিয়ে করে ফেলেছি।
বলিস কি রে!তা কাকে বিয়ে করলি?
তোমাকে বলেছিলাম না আগে। আমার জেঠ তুতো দিদির দেওরের কথা।ওকেই বিয়ে করলাম।
এ তো খুব আনন্দের খবর রে।
না দিদি আনন্দ করে তো আর বিয়ে টা করতে পারলাম না।
মানে?
আসলে আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে চুপিচুপি বিয়ে টা করলাম।
কেন রে? তোর জেঠুর মেয়ে তো সব জানতো তোদের ব্যাপারে।
দিদি আর কি করবে? দিদি ওর শাশুড়ি কে বলেছিল আমাদের সম্পর্কের কথা। তাই শুনে বুড়ি বলল, আমার ছোট ছেলের বিয়ে তে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা বর পণ চাই। তবেই তোমার খুড়তুতো বোন কে আমি ঘরে তুলব।
তারপর?
তারপর আর কি। আমার বাবা তো থেকে ও নেই।জেঠু ও বললো , আমার পক্ষে এতগুলো টাকা বর পণ দেওয়া সম্ভব নয়। তখন আমার বর অজিত একটা উপায় বের করল।
কি উপায়? অবাক হয়ে বললাম আমি?
অজিত বলল,রুমকি চল আমরা ঘর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তাহলে তো আর বর পণ দিতে হবে না।তারপর কোথায় ঘর ভাড়া করে থাকবো।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমার মতো অভাগী কে বিয়ে করার জন্য কোনো ছেলে নিজের ঘর ও ছাড়তে রাজি ! সেদিন রাতে জেঠিমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমার করনীয় কি? আকাশ পাতাল ভাববার পর ঠিক করলাম, আমার আবার জেঠুর ঘর ছাড়তে ভয় কিসের? নিজের সব খরচ নিজেই করি। শুধু রাত টুকু জেঠুর বাড়িতে ঠাঁই নিই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,রুমকি এখন কোথায় আছিস তাহলে?
দিদি দূর্গাপুর ইসটেশনের কাছে যে বস্তি আছে সেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি।
তা বেশ।তাহলে আগামীকাল একবার আয় বর কে নিয়ে।দেখা করে যাস একবার।
পরেরদিন অজিতের সাইকেলের সামনে বসে রুমকি এলো আমাদের বাড়িতে। সিঁথি তে মোটা সিঁদুর,হাতে শাঁখা পলা পরে কি সুন্দর দেখাচ্ছে যেন রুমকি কে।
রুমকি একগাল হেসে আমাকে বলল,দিদি আমাকে বউ এর সাজে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি ও রসিকতা করে বললাম,তোর বর এখন ও বলে নি মনে হচ্ছে।
রুমকি মুচকি হেসে বললো,ওর তো দুচোখে এক প্রেম ঝরছে।না হলে আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতো।
অজিত লাজুক হাসি দিয়ে বললো,দিদি তোমার বোন টার মন টা পরিষ্কার নয়। কেবল ফালতু কথা বলে।
আমি অজিত কে বললাম, রুমকি কিন্তু তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।ও এখন আর কারোর আশ্রিতা নয়।ও এখন তোমার ঘরের ঘরনী। মেয়েটাকে তোমার প্রেম দিয়ে সারাজীবন আগলে রেখ ভাই।

Loading

Leave A Comment