Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৯)

(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

 

[একুশ]

ছেলেটা একটু হাতেধরা হতে রতনের যেন কিছুটা আর্থিক সুরাহা হচ্ছে। বাপের সাথে বসে বসে জুতো পালিশ, তাপ্পি, সেলাই সবটাতেই বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া ওর নজর আছে বলে সব কাজের ফিনিশিংটা বেশ মনে ধরার মত। এইদিকটা ও বেশি নজর রাখে তা দেখেছে রতন। এতদিন কাজ করছে, কোনদিন ভাবেনি যে এই ফিনিশিংটাও তাদের ব্যবসার আর একটা দিক। মোটামুটি সারাই-মাড়াই করলেই হল। এমনটাই ধারণা ওদের প্রজন্মের। কিন্তু একটা জুতোয়, চামড়ার তাপ্পি দিয়ে সারার পর তাপ্পির চামড়ার যে একটা খাঁজ তৈরী হোল তা বাটালির ডগা দিয়ে সুক্ষভাবে কেটে আসল জুতোর চামড়ার সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে দিয়ে সেই জুতোটা যদি একবার ভাল করে পালিশ করে দেওয়া যায়, সত্যিই মনে হয় যেন জুতোটা নতুন হয়ে গেল। এই পালিশের জন্যে পয়সা নিল, কিন্তু তা শুধু পালিশ করতে আসাদের থেকে একটু কম পয়সা। কেননা ওই খদ্দেরটা তো জুতো পালিশ করতে আসেনি, এসেছিল রিপেয়ার করতে। এতে তারা জুতো সারাইয়ের পয়সা পেল, অতিরিক্ত কিছু পেল পালিশের জন্যে। খদ্দেরও তুষ্ট মনে কোন কথা না তুলে পয়সা দিয়ে দিল। এই অতিরিক্ত সামান্য কিছু দেবার জন্যে খদ্দেরটার তো গায়ে লাগল না। অথচ তার পুরোনো জুতো নতুন নতুন লাগল। এই বুদ্ধিতে নামও করে ফেলে সনাতন। ছেলের দেখে রতনও এখন তাই করে। আয়ও ছেলের হাত ধরে বাড়ে।
দিঘিরপাড় বাজারের পলিথিন টাঙানো ফুটের দোকানেই এখন হপ্তা’ভর বসে রতন। আর পাড়া করতে যায় না। বয়স যেন আর সায় দিতে চায় না। আশেপাশে প্রায় খান দশ-বারো গ্রাম ফেরি করে ওদের রুইদাস পাড়া। কত মাইল যে সারা দিনে হাঁটতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। এই হাঁটা বয়স যেন সায় দেয় না। দোকানটা যখন আয়ের টানকে পুষিয়ে দিচ্ছে তাতে মনও আর ঠেলা মারে না পাড়া করতে। ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব কাজকর্ম শিখিয়ে দিয়েছে। কেমন করে পাড়া করতে হয়। কোন পাড়ার কোন বাড়িটা তাকে বেশি পছন্দ করে। কোন গ্রামে তার বেশি বাঁধা খদ্দের আছে। দিন তিনেক সাথে করে নিয়ে গিয়ে সব চিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। বাবুদের গিন্নিমায়েদের সঙ্গেও আলাপ করে দিয়েছে। তাদের এইসব কাজের লেনদেন গিন্নিমায়েদের সঙ্গেই বেশি। বাবুরা তো যে যার কাজেকম্মে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাড়ি থাকে গিন্নিমারা,“গিন্নিমা, এ আমার ছেলে, সনাতন। আমার তো বয়স হচ্ছে। আর হয়তো বেশিদিন পাড়া করতে শরীর সায় দেবে না। তাই ছেলেকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি। আপনারা একটু দেখবেন।”

-তা, তোমার ছেলে লেখাপড়া করেনা না? তোমাদের তো দেখি বাবার জুতো-বেতের কাজ হস্তান্তর হয় ছেলের মধ্যে। কেউ আর এর থেকে বার হতে পারল না। না হলে তোমাদের উন্নতি হবে কেমন করে। এই ছেলে, তোর নাম কি? পড়াশোনা করতে পারলি না। সেই বাপের পেশায় তুইও সওয়ার হলি ?
-ও সনাতন গো গিন্নিমা। আপনাদের আশীর্বাদে ও মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে। এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সংসারে তো বাবুদের ছেলেপিলেদের মত শুধু লেখাপড়া করলে পেট শুনবে না। এই পেট-রাহুর হম্বিতম্বি বশে রাখতে গেলে কাজ করতে হবে। কাজ সেরে যদি দম থাকে তো লেখাপড়া শিখতে পারে। তা আমার সনাতন সেই দম দেখিয়ে দিয়েছে।
এবার গিন্নিমার অবাক হবার পালা, “তুই ছেলে এই জুতো-চামড়া-বেতের কাজ করিস আবার লেখাপড়াও করিস! তাও স্টার পাওয়া ছেলে ! আর আমাদেরগুলো দেখো, খাচ্চে-দাচ্ছে আর নবাবি করে বেড়াচ্ছে। তোমার কত কপাল ভাল, রতন। তোমার ছেলে সনাতনকে দেখে অন্য ছেলেপিলেদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। ছেলেটাকে দেখেই প্রথমে আমার একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। ও যে তোমাদের জাতের অন্য ছেলেদের থেকে অন্যরকম, সেটা মনে রেখেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, লেখাপড়া করছে না কি? খুব ভাল। তুমি ভাল করে লেখাপড়া শেখো ছেলে। কখনো কোন দরকার পড়লে আমাদের বাড়ি আসবে। ওর বাবাকে বলবো, যদি তোমার হয়ে কিছু করতে পারে। তবে আমার মনে হয় রতন, এ ছেলেকে তুমি, তোমার মত পাড়ায় ঘুরিও না। ও কাজ করুক। তবে পাড়ায় ঘুরে এই হাড়-খাটুনি যদি তুমি না খাটাও মনে হয় ওর পক্ষে ভাল হবে। আমার কথা তুমি ভেবে দেখতে পারো।” এই গিন্নিমা যেমন বলল তেমন অনেক পাড়া তাকে একই রকম কথা বলেছে। ছেলেকে এই রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে পাড়া না করার মত দিয়েছে। রতন ওই পরামর্শগুলো মাথায় রেখেছে। তবে সরাসরি সনাতনকে বলেনি যে তোমাকে পাড়া করতে যেতে হবে না। মানুষের জীবন। কখন কি মোড়ে মোচড় দেয় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ও যদি নিজে থেকে যায় যাবে। না গেলে না যাবে। রতন তাকে যেমন যেতে নিষেধ করবে না, তেমন যেতেও বলবে না।
কোন কোন বাবু বাজারে তার দোকানে এসে বলে,“কি রে রতন, তুই যে আর পাড়ায় যাচ্ছিস না। তোর গিন্নিমা তো আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। কয়েকটা খোড়া আর একটা পালির বেত খুলে গেছে। রোজ আমাকে বলে, বাজারে গেলে রতনকে বলে আসবে তো, বাড়িতে আসার জন্যে? তা সময় করে একদিন যাস, আমাদের বাড়িতে। ওই বড় বড় জিনিস তো আর আমার পক্ষে বাজারে বয়ে আনা সম্ভব নয়। যেমন বাড়িতে গিয়ে সারিয়ে আসতিস, তেমন যাস।
এই ধান কাটার মরসুম এসে যাচ্ছে। খোড়া, ধান কাটানো ‘কাটা’ আগে থেকে সারিয়ে না রাখলে তখন অসুবিধায় পড়তে হবে।” রতন তখন বাবুকে বলেছিল,“বাবু আমরা বাপ-বেটার কেউ যদি যেতে না পারি তো আমার পাড়া সম্পর্কের ভাইপো, কেলে, মানে কেলোকে পাঠাবো’খন। আপনি চিনবেন ওই যে মিত্তুন রুইদাস আছে না? আমাদের বাজারের মোড়ে বটগাছ তলায় যে ছাগল কাটে। হ্যাঁ, ওই মিত্তুনের ছেলে কেলে। ওরা দু’বাপ-ব্যাটা ছাগলের মাংসের কারবার করে। ছেলে পাড়া ঘুরে ছাগল কেনে আর বাবা বাজারে সেই ছাগল কেটে মাংস বেচে। ছাগল কেনার সাথে সাথে সারাইয়ের কাজটাও কেলে করে। করতে করতে এইসব সারাইয়ে কেলের হাত এখন ভাল হয়েছে। চটপটেও আছে। ও কখনো সখনো আপনাদের পাড়াতেও যায়। বলে দেব’খন ওকে আপনাদের বাড়ি যেতে। ও গিয়ে আমার নাম বললে বুঝবেন আমি পাঠিয়েছি।
আশেপাশে দশ-বারোটা গ্রামে রতন জ্যাঠার যা পরিচিতি তা দেখে অবাক হয়ে যায় কেলো। তার বাবা মিত্তুনেরও এত লোকে চেনে না। তাদের পাড়ার আরও অনেকে রতন জ্যাঠার মত গ্রামে গ্রামে ঘুরে জুতো সারাই, বেতের জিনিসের সারাই বা বিক্রির কাজ করে ঠিকই। কিন্তু এনাকে লোকে যত চেনে অন্যদের সব গ্রামের সবাই চেনে না। এ দিক থেকে রতন জ্যাঠা তাকে অনেক উপকারই করেছে। কেলো বা তার বাবা, মিত্তুনে তো কেবল ছাগলের কারবার করে বেড়াতো। যে-যে গ্রামের মানুষ ছাগল পোষে সেই-সেই গ্রাম তারা ঘুরে বেড়াতো। ঘর-ঘর ঢোঁ মারা তাদের হতো না। তার ফলে অত পরিচিতিও ছিল না। ওই চেনাজানার মধ্যে যারা সারাইয়ের কথা বলত, কেবল তাদের ঘরে তাদের যাতায়াত ছিল। একটা সময় তার বাবা এই কাজের পুরোটাই তার দায়িত্বে ফেলে দেয়। আর পাড়া করে না। পায়ের কলকব্জা নড়বড়ে হয়ে আসছে তাই। এবার রতন জ্যাঠা তার খদ্দেরের কাজ কেলোকে করার সুপারিশ করাতে এখন সে মন দিয়ে দুটো কাজই করে। ছাগলের কারবার আর জুতো-বেত সারাই। ঘরে উপরি দু-চারটে পয়সাও আসতে শুরু করেছে।
নতুন এই কাজটা করতে গিয়ে কেলো, তার পুরোনো কাজে যেন কিছুটা ঢিলে দিতে শুরু করেছে। কুঁড়েমী আর কি। অত দূর দূর পাড়ার পর পাড়া তার ঘুরতে যেন আর তেমন সায় দেয় না মন। ‘ছাগল আছে গো-ও, ছাগল আছে গো-ও বলে চেল্লাতে চেল্লাতে গলা একটা সময় এমন বসে যায়। মনে হয় গলাটা শরীর থেকে খুলে পড়ে যায় আরকি! ওই সারাইয়ের কাজ করতে করতে নজর-পড়া পাড়াগুলো ঘোরার মাঝে যেসব বাড়ি ছাগল পোষে সেগুলোতে ঢোঁ মারে। এই নিয়ে বাপ ছেলের কথাকাটাকাটি যে হয় না তা নয়। মাংসর
দোকানে ছাগলের যোগানে টান পড়ে। মিত্তুনকে দোকান চালাতে তাই রাজারহাটের ছাগলহাটের থেকে ছাগল কিনে আনতে হয়। পাড়ার ছাগল একটু কম দামে পাওয়া যায় আরকি। পাড়ার বউ-ঝিদের ভুজুং-ভাজুং দিয়ে হাটের ছাগলের থেকে অনেকটা কমে সে সওদা করতে পারে, “দিদি, আপনার ছাগলের নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে। এই দেখুন, চোখের জল গালের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে। আপনার ছাগলের ব্যায়রাম হয়েছে। বিডিওর পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। না হলে সে বাঁচবে না কিন্তু। ছাগলটাকে এতটা বড় করে শেষে মরে গেলে আপনার অনেক পয়সা মাঠে মারা যাবে।” বিডিওর পশু ডাক্তার পাওয়া অত সহজ কথা না। তারপর কবে তাকে পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারবে না। ছাগলটাকে টানতে টানতে দশ কিলোমিটার হেঁটে নিয়ে গিয়ে যদি না পাওয়া যায় তো বিপত্তির অন্ত নেই। তাই সহজে পাড়ার মেয়ে বউরা ডাক্তারের কথা মুখে আনতে চায় না। সেই সুযোগ কেলো-মিত্তুনেরা নেয়। তখন ছাগল মালিক বলে, “তুমি ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করে দাওনা। তোমার যাতায়াতের খরচা দিয়ে দেবো’খন।”
-আমার অত সময় নেইগো মা-সকল। একটা কথা বলি শোনো, তোমার ছাগলের দাম আমি পাঁচ হাজার টাকা দেবো। আমাকে দিয়ে দাও। তারপর ডাক্তারবদ্যির খরচ আমি করে নেবো।
-আমার আট হাজার টাকার মাল পাঁচে ছেড়ে দেবো? তুমি পাগল আছো? ডাক্তার খরচ তোমার কত হবে গো লোকটা!
-দেখুন মা-ঠাকরুন, ডাক্তার দেখা, ওষুধ পথ্যের খরচ তো একটা আছেই। আর একটা আসল কথা তো তুমি ভাবলে না। এই রোগী ছাগলকে সারিয়ে তুলতে তো বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে? না কি বলো? তা মানুষের রোগ হলে মানুষ রোগা হয়ে যায় না ? এ পশুও তো রোগা হয়ে যাবে। ওজন কমে যাবে। পশুর ওজনের ওপর তো তার দাম। ওজন কমে গেলে দামও তো কমবে, না কি? তা তোমার রোগা ছাগল পয়সা দিয়ে কিনে যদি আমার কারবারে লস্ হয় তো সে কারবার করে আমার লাভ কি? দেখো এবার তুমি কি করবে। তোমার জিনিস আমি তো জোর করতে পারি না। এখন যা দাম পাচ্ছো, পরে তা নাও পেতে পারো। তখন আর আমাকে দুষবে না কিন্তু।
কোন ছাগলের হয়তো পেটটা ডাবরা হয়ে আছে। পেটে হয়তো জল জমেছে। এমনটা হলে ছাগল একটু হাগে। পাতলা হাগে। ছাগল যে কোন সময় পাতলা হাগতে পারে তা যারা ছাগল পোষে তারা জানে। কিন্তু কি কারণে হাগে তা তারা অতটা জানে না। অনেক সময় হেগে হেগে ছাগলটা মরেও যায়। তখন মালিক কপাল চাপড়ায়, “ছাগলটার হাগা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিক্রি করে দেওয়া যেতো তো এত টাকা তাদের ক্ষতি হত না।” সেই ধারণার সুযোগটা মিত্তুনে-কেলোরা নেয়, “মা-ঠাকরুন, তোমার ছাগলের পেট ডাবরা হয়ে গেছে। পেটের নীচে হাত দিয়ে উপরের দিকে ঠেলা মারলে ছলছল শব্দ হচ্ছে। জল জমেছে। এবার পাতলা হাগা শুরু হবে। তখন একে বাঁচানো শক্ত হয়ে যাবে। এক্ষুনি ডাক্তারের ব্যবস্থা করো।” এইসব ছাগল মোটামুটি দামাদামি করে কিছুটা কমে তারা গস্ত করতে পারে। তাতে মাংস বিক্রি করে কিছু বেশি পয়সা ঘরে তুলতে পারে। তবে যেসব ছাগল একদম টানটান সরেস মার্কা, তাদের নায্য দাম দিতেই হয়। ওখানে হুড়িয়ে-হাড়িয়ে কিছু করার জায়গা থাকে না। তবে তাতেও হাট থেকে গস্ত করা মালের থেকেও নরম দামে কেনা যায়।
বাপের গোঁত্তা খেয়ে কেলো একটু যেন টালমাটাল। সারাইয়ের কাজের সাথে সাথে পুরোনো ব্যবসাটায় জোর দিতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে যেন মন জোর পায় না। হঠাৎ তার মনে একটা অন্য মতলব বাসা বাঁধে। সেটা সে তার বাপকেও জানায় না।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেয় পাড়া করে ফেরার কালে কেলো মাঝবয়সী একটা খাসি কাঁধে করে নিয়ে এসে ঘরের দাবায় ধপাং করে ফেলে। মিত্তুনে, কেলোর মা দেখে তো অবাক, “হ্যাঁরে কেলো, এ তো মরা খাসি। এ মালটা আবার কোথায় পেলি !” ছাগলটার গায়ে হাত দিতে একটু চমকে ওঠে মিত্তুনে, “কিরে কেলো, মনে হচ্ছে ছাগলটা সবে মরেছে। এর শরীর এখনো পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যায়নি! গরম গরম। সদ্য মরা ছাগলটা তুই পেলি কোথা থেকে? যাদের ছাগল, তারা খোঁজাখুঁজি করেনি?”
-তা করবে না? পাড়াময় হৈ হৈ পড়ে গেছে। লোক জড়ো হয়ে গেছে, যেখানে এটা পড়ে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম লোকজনের জটলা। মরা ছাগলটা ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে একজন বলল, “দেখতো কেলো। এর ধড়ে প্রাণ এখনো জিইয়ে আছে কি না। মনে হয় তো নেই। দেখেই বললাম এ শেষ। এবার মানুষের জল্পনা, কি করে মরল জলজ্যান্ত ছাগলটা, ইত্যাদি কথা চালাচালি করতে করতে জটলা পাতলা হতে থাকে। যাদের ছাগল তারা শুধু আছে। আমি বললাম, মরা ছাগল তো তোমরা এমনিতেই মাটিতে পুতে দেবে। আমি নিয়ে যাবো ? চামড়াটা তাহলে নিতে পারি। তারা তখন আর কিছু না বলায় আমি সময় নষ্ট না করে কাঁধে ফেলে নিলাম। কাল রবিবারের বাজার। মাংসের টান থাকবে। তুমি অন্য মাংসের সঙ্গে এটাও ভোর ভোর কেটে চালিয়ে দিতে পারবে। অসুবিধা হবে না।”
– অসুবিধা হবে না কি রে! সারারাত এভাবে ছাগলটা পড়ে থাকলে এ তো শক্ত ডাঙ হয়ে যাবে। মাংসের টেস্টও পাল্টে যাবে। রেগুলার মাংসের খদ্দেররা বুঝতে পারবে এতে কোন গলদ আছে। ওই ঝুঁকি নেওয়া যায় নাকি! তুই এক কাজ কর কেলো। বাজারে চলে যা। ইদ্রিসের আইসক্রিম কারখানা থেকে দুটো ইটের সাইজের আইসক্রিম বানানোর জন্যে রাখা বরফের প্লেট নিয়ে আয়। আমার নাম বলবি, ও দিয়ে দেবে। মাংস বিক্রি না হলে ওর দোকান থেকে বরফ নিয়ে সেগুলো চাপা দিয়ে রাখি সে ইদ্রিস জানে। কোন প্রশ্ন করবে না। দাম পরে আমি দেব’খন। আমি ততক্ষণে ছাগলটার চামড়া ছাড়িয়ে পরিস্কার করি। তুই বরফটা নিয়ে আসলে কাঠের বাক্সটার নীচে পলিথিন বিছিয়ে মাংসগুলো বরফ ঢাকা দিয়ে রাখবো। সকালেও একদম টাটকা থাকবে এটা তাহলে।
প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছে কেলো। এবার লোভে পড়ে যায় এইভাবে অসৎ পথে ‘হবগা’ টাকা আয় করার জন্যে। রোজ করে না। হপ্তাহে দু’দিন এই কম্ম করে ও। তবে বহু দূর দূর গ্রাম হয় তার লক্ষ্য। কাছাকাছি হলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। অপারেশন করার আগে নির্দিষ্ট গ্রামটা বার কয়েক ঘুরে দেখে নেয় কোন বাড়িতে কটা ছাগল আছে। কোথায় চরাতে যায় ইত্যাদির খবর। তারপর সুযোগ বুঝে কলাপাতা বা কলমি শাকের সঙ্গে বিচি সমেত ধুঁতরো ফল জড়িয়ে ছাগলকে খাইয়ে দেয়। সবটাই চলে পরিস্থিতি বুঝে, নিরিবিলি সময়ে। না হলে কেউ দেখে ফেললে পাড়ার লোকের একটা মার বাইরে পড়বে না। সাফল্য বেশ কয়েকবার পেয়ে যায় কেলো। বাপ মিত্তুনেও খুশি মনে লোভের পাঁকে হাবুডুবু খেতে থাকে। একবারের জন্যেও ছেলেকে সতর্ক করে না যে এ অন্যায় কাজ। এ কাজ না করাই ভাল। বিরোধিতা না করে নীরব থেকে ছেলের কাজের সুবিধা নেওয়া মানেই তো পরোক্ষে সমর্থন করা। সেটাই করে চলল মিত্তুনে।
দূর দূরান্তের গ্রাম হলে কি হবে। লোক মুখে তো চাউর হচ্ছে ধীরে ধীরে যে কোন অজানা কারণে একটার পর একটা ছাগল মরে পড়ে থাকছে মাঠে ময়দানে। কারণ কেউ তেমন করে বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে কেলের দিনে দিনে সাফল্যের বহরে সাহসও বেড়ে যায়। এবার আশেপাশের চেনা জানা গ্রামেও নিজের হাতসাফাইয়ের বিদ্যে কাজে লাগাতে শুরু করে। তবে তা বেশি করে উঠতে পারেনি। আগের খবরগুলো এইসব গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময় চর্চা করতে করতে একটা হিসেব মানুষের মনে দেগে যায় যে এই মরা ছাগল একজনই শেষ পর্যন্ত নিয়ে চলে যায়। সেটা ওই রুইদাস পাড়ার মিত্তুনে রুইদাসের ছেলে কেলে ! কাছাকাছি গ্রামের লোক কেলেকে খুব ভাল করে চেনে। এবার তক্কে তক্কে থেকে একটা ছাগলকে শাক পাতার সঙ্গে ধুতরা ফল খাইয়ে দিতে গিয়ে বামাল সমেত হাতনাতে ধরে ফেলে কেলেকে! তারপর আচান্দা গ্রামের বল খেলার মাঠে গোল পোস্টে বেঁধে শুরু গণধোলাই।
হাওয়া এই চুরির খবর মুখে করে ছড়িয়ে দেয় দূরে কাছের গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের ঢল নামে এতদিন ধরে চলে আসা ছাগল মারার কারিগরকে দেখতে। সেইসঙ্গে উত্তম মধ্যম আছড়ে পড়ে কেলের শরীরে। এত লোক একবার করে যদি থাপ্পড় কসায় তো মরে যাবে যে চোরটা! পাড়ার কিছু সতর্ক মানুষ খবর পাঠায় পুলিশে।
রতন মরমে মরে যায়। এই চোরকে সে তার বিশ্বস্ত বাড়িতে কাজ করার জন্যে সুপারিশ করেছিল। বাবুরা এতদিন তার প্রতি যে বিশ্বাস পোষণ করেছিল তা এই কেলে চোরের হাত ধরে মাটিতে সমাধিস্থ হয়ে গেল। আফসোসের শেষ রইল না তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে। কিন্তু জানবে বা কেমন করে, মিত্তুনের ছেলে কেলে এমন অপরাধ প্রবণ ! আর জঘন্য মানুষ তো এই মিত্তুনে। সমানে সে ছেলের এই সমাজবিরোধী কাজে সায় দিয়ে এসেছে। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে বাপকেও জেলে পোরা দরকার। চোর আর চোরাই মাল গছনদার- দু’জনেই সমান দোষে দোষী। হয়তো পুলিশ তাই করবে! করুক!

[বাইশ]

পুজোর মাস-দুই তিন আগে থেকে রুইদাস পাড়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঢাকের পরিচর্যা করতে। বছরভর এরা গরুর চামড়া ‘ট্যান’ করা পালিশ করা ইত্যাদির কাজ করে চামড়া ব্যবহারের উপযুক্ত করে রাখে। তারপর নানা রকম পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন ঢাক বানানো আর পুরোনো ঢাকের মেরামতি শুরু হয় এই সময় থেকে। দুটো কাজেই চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। মোটামুটি সারা বছরের এই সময়টার জন্যে ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। দূর্গা পুজো থেকে শুরু হয় ওদের পুজোর মরশুম। তারপর লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদি চলতে থাকে। বাঙালীর বারো মাসের তেরো পার্বনের মধ্যে এই সময়গুলোই ওদের জীবনধারণের প্রধান উপায় ও অবলম্বন। এতসবের সাফল্যের টিকি কিন্তু বাঁধা হয়ে যায় এই দূর্গাপুজোর মধ্যে দিয়ে। কে কতটা ঢাক বাজানোর ডাক পাবে তা অনেকটা ঠিক হয়ে যায় দূর্গা পুজার ডাক কোথায় কে কেমনভাবে পেল-না-পেল সেটার উপর। সেইজন্যে এরা সবসময় টানটান হয়ে থাকে, কিভাবে কেমন করে কোন্ পুজোমন্ডপে সে কাজ করার সুযোগ পাবে, সেদিকে। শহর- কোলকাতার বড় ক্লাবের পুজো বা বনেদি বাড়ির পুজোর দিকে এদের টান বেশি। লক্ষ্য তো একটাই। বেশি রোজগার। তা সেই রোজগারের বহরটা ওরা কপালের উপরই ছেড়ে দেয়। সব্বাই তো আর বড় ক্লাব বা বনেদি বাড়ি ডাক পাবে না। এইসময় ওদের মত ঢাকিদের যোগান অনেক। কিন্তু পছন্দমত খরিদ্দার বা তাদের চাহিদা সীমিত। গ্রামের পুজো শহরের তুলানায় কমই হয়। বাহুল্যেও শহরের ধারেকাছে যেতে পারে না গ্রাম। তাই তারা জোয়ারের ঢেউয়ের মত শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রতন অন্যদের মত শহরে গিয়ে ঠেলাঠেলি তেমন পছন্দ করে না। কিন্তু এই বছর সনাতন হাতেধরা হতে মনটা যেন উশখুশ করে শহরে ডাকে যাবার জন্যে। দু’পয়সা যদি বেশি আয় করতে পারে। সনাতন এ বছর প্রথম তার সঙ্গে সঙ্গ দিতে রাজি হয়েছে। এ বছরই ও ঢাকের বোলের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছে। দূর্গাপুজো আর লক্ষ্মীপুজোর ঢাকের বাজনার সব বোল-তাল একদম নিখুঁতভাবে বাজাতে পারে। কাঁশির বাজনা তো ও অনেকদিন থেকে বাজাতে পারে। সেই ফাইভে যখন পড়ে তখন থেকেই আশেপাশের পাড়া বা গ্রামে বায়না পেলে ছেলেকে নিয়ে যেতো কাঁসির সঙ্গত দিতে। বড় পুজোয় অনেক খাটনি। একা সবটা বাজানো চাপের হয়ে যায়। শহরে না যাবার এটাও একটা কারণ। এবার যখন সনাতন তৈরী তখন বাপ-বেটা পাল্টাপাল্টি করে ঢাক-কাঁসরে বোল তুলতে অসুবিধা হবে না। সেই সাহসে ভর করে রতন ছেলেকে বলল, “কিরে সনাতন, এ’বছর কোলকাতায় বাজাতে যাবি? কোলকাতায় ছোট-বড় বা যেমন তেমন প্যান্ডেলেও বায়না পেলে রোজগার মন্দ হয়না রে! ওই তো দেখিস না, পাড়ার অন্যরা পুজো শেষে পোঁটলা ভর্তি করে জিনিসপত্র আর ট্যাঁক ভরে টাকা পয়সা নিয়ে ফেরে! গ্রামে থেকে আমরা তার ছিটেফোঁটাও পাই না। চল্ একবার দেখে আসি শহরের রহস্যটা কেমন। অভিজ্ঞতা মনের সঙ্গে না মিললে আর যাব না পরের বছর।”
শহরে ডাকে যেতে সনাতনের তেমন সায় ছিল না। আসলে শহরের ওই গ্যাঞ্জাম, জটিল পরিবেশ- ওর একদম মন টানে না। গাছগাছালিতে ভরা গ্রামের শান্ত শীতল আবহাওয়া। মেঠো রাস্তার দূষণমুক্ত ধুলিধূসরিত পরিবেশ। বৃষ্টিসিক্ত ধরিত্রির সোঁদা গন্ধ তাকে যেন বেঁচে থাকার অন্যরকম এক স্বাদ খুঁজে দেয়। শহুরে তপ্ত পরিবেশ, ব্যস্ততায় মোড়া যন্ত্র-জীবন যেন তাকে হাঁফ ধরিয়ে দেয়। শুধু সনাতন কেন তাদের মত গাঁয়ের মানুষের ক’জনেরই বা শহর টানে। তেমন টানে না। তবু গাঁয়ের মানুষ উদ্ভ্রান্তের মত ছোটে সেই শহরের পথে। জীবনকে জিইয়ে রাখার তাগিদ যে বড় তাগিদ। দায়ও। দায়মুক্ত হতে তাই সবাই ওদিকে ছোটে বেঁচে থাকার রসদ আহরণে। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে ‘দুয়ো’ দিয়ে রতনের চাপাচাপিতে সায় দিতে মাথা নাড়ে সনাতন। ছেলের সম্মতি পেয়ে রতন এবার খোঁজখবর চালায় পাড়ার আর যারা ফি বছর কোলকাতায় যায় তাদের কাছে, “হ্যাঁগো দিবাকর, ফি বছর তো পাড়াগাঁয়ে পুজোর বাজনা বাজাই। এবারটা ইচ্ছে হচ্ছে শহরে যাবার। কোলকাতায় গেলে, এটা তো ঠিক যে গাঁয়ে ঢাকের যা বায়না হয় তার থেকে ঢের বেশি টাকার কাজ পাব! সেই টানেই তো তোমরা পুজোর মরসুমে কোলকাতায় ছোটো। তা আমার তো এ বছর এই প্রথম। শহরের বায়না-টায়না নেবার নিয়মকানুন বা পদ্ধতি কিছুই তো আমার জানা নেই। তুমি যদি আমাকে একটু জানাও তো অজানা জায়গায় গিয়ে আমাদের আর বিপাকে পড়তে হয় না।”
সঙ্গে সঙ্গে দিবাকরের তৈরী হওয়া মুখের খাঁজগুলো দেখে রতনের বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে ওর কাছে সাহায্যের আশা, হতাশায় পরিণত হতে চলেছে। মুখের বিকৃত ভাঁজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দিবাকর বলল, “ওসব অনেক হ্যাপা গো দাদা। কোলকাতার লোক বলে কথা। ওদের সঙ্গে কাজকারবার করা অত সহজ কথা না। আচার ব্যবহার এত বাজে যে ওইসব শিক্ষিত বাবুদের চেহারা বেশভূষা দেখে বোঝাই যাবে না এরা কতটা সুযোগ সন্ধানী। আমাদের মত সাদাসিধে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ওদের একদম মিল নেই। কথার খেলাপের মস্তবড় খেলোয়াড় ওরা। তোমাকে এক বলে বায়না করে নিয়ে গেল। তারপর পুজো শেষে টাকা দেবার সময় অন্য কথা বলবে। বলবে, তোদের সঙ্গে এত
টাকা দেবার কথা হয়নি। প্রায় অর্ধেক কমিয়ে বলবে, এত টাকা কথা হয়েছে। তাছাড়া তোদের এতদিন কমিটি থেকে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করা হ’ল। নতুন ধুতি, গেঞ্জি-গামছা দেওয়া হল। ওগুলো পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি বুঝি? তারপর তোরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যে বকশিশ পেলি? সে তো আমাদের পাড়ার মানুষ দিয়েছে। পাড়ার মানুষের দেওয়া মানে কমিটিরই দেওয়া হল। সবটা জুড়লে তোরা কত টাকা এ’কদিনে আয় করলি একবার ভেবে দেখেছিস? এমন সব উটকো বাহানা চাগিয়ে তুলে আমাদের টাকা মারার ধান্ধা করে ওইসব শহুরে ধূর্ত লোকগুলো। তোমাদের মত লোক ওখানে গিয়ে খাপ খুলতে পারবে গো না দাদা। তুমি যেও না। রাম-ঠকা ঠকে যাবে।”
দিবাকরের কথায় শহরে যাবার ইচ্ছেটা যেন থমকে গেল রতনের। এত বড়মুখ করে সে সনাতনকে রাজি করালো পুজোয় শহরে ঢাক বাজাবার জন্যে। নিমরাজি ছেলেটা শেষপর্যন্ত সায় দিল। তার মনেও নিশ্চয়ই একটা আশার আলো ফুলকি মেরেছে। সেখানে দিবাকর যদি এমন মনমরা কথা শোনায় তো ছেলেটারও শহরের মানুষজনের প্রতি একটা খারাপ ধারণা হবে। গোমড়ামুখে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে ফিরছিল রতন। উল্টোদিক থেকে পাড়ার যুবক ছেলে অভয় আসছে, সে দেখতে পায়। রতনের মনমরা মুখের ভাষা কেমন করে যেন ছেলেটা পড়তে পারে, “কি গো কাকা, মুখ ভার করে আছো কেন? তোমাকে তো কোনদিন এমন করে থাকতে দেখিনি? তাই বলছিলাম আরকি।” উত্তরে রতন বলল, “না, তেমন কিছু নয়।” তারপর হঠাৎ মনে পড়ল এই অভয়ও তো কোলকাতায় ডাকে যায় পুজোর ঢাক বাজাতে। দিবাকরের কথাটা ওর কাছে একবার ঝালাই করে নিলে হয়, “এই শোন, অভয়, তুই তো ফি বছর কোলকাতায় ডাকে যাস পুজোর ঢাক বাজাতে। আমি তো কোনদিন ওদিক মাড়ায়নি। ভাবছি এ’বছর পুজোয় কোলকাতায় ঢাক বাজাতে যাব। তা, কি রে যাব ওইসব জায়গায়? দিবাকর তো আমাকে একরাশ ভয় দেখিয়ে না যাবার পরামর্শ দিল। আমি নাকি রাম-ঠকা ঠকে যাব। সেইজন্যে ইচ্ছেটা যেন দম পাচ্ছিল না। তাই মনমরা হয়ে গেলাম।”
পাড়ার মুরুব্বিদের ওপর মনে মনে অভয়, বরেণদের রাগ এখনো ধিক ধিক জ্বলে। ওদের দাবি মত অলোকা-বিপ্লবদের কেসটা আটচালায় তুলতে দিল না ওরা। মুরুব্বিদের মধ্যে রতন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বরং বলা যেতে পারে রতনের উপরই ওদের বেশি খার। এবার অভয় বাগে পেয়েছে রতনকে। উল্টোপাল্টা বলে এমন ঘোল খাইয়ে দেবে যে বাছাধন হাড়ে হাড়ে টের পাবে। অভয়দের অবজ্ঞা করার মাশুল এবার ব্যাটাকে দিতে হবে। তাদের দুচ্ছা করার প্রতিশোধ নেবার জন্যে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ও। এবার সেই
সুযোগ এসে গেছে। কাজে লাগাতে হবে। দিবাকর শুধু তাকে কোলকাতায় ডাকে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। তাতে তো ব্যাটার বেঁচে যাবার পথ সুগম হয়ে গেল। একে তা করলে চলবে না। এমন বোয়াল মাছের ঝাঁকে ফেলতে হবে, যার খপ্পরে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়, “আরে কাকা, দিবাকর কাকা যা তোমাকে বলেছে একদম ফালতু কথা বলেছে। তুমি যাতে ওদের দলে ভিড়ে ওদের বায়নায় ভাগ বসাতে না পারো তাই অমন কথা বলে তোমাকে ভাগাতে চেয়েছে। ওইসব চুকলিবাজির কোন মানে হয় না। ভাল বায়না, খারাপ বায়না, যে যার ভাগ্যে জোটে। সেটাকে মেনে নিতে হবে। তাইবলে পাড়ারই একজন মুরুব্বি মানুষ কোলকাতায় ডাকে যেতে চাইছে, তাকে যেতে দিতে চায় না! একদম অনুচিত কাজ এটা। এর মাধ্যমে তুমি লোক চিনে নাও কাকা। কে আসলে মানুষের ভাল চায় আর কে চায় না।” দিবাকরের বিরুদ্ধে রতনকে খেপিয়ে অভয় এটাও করতে চাইল যে আটচালার ওই দুই মুরুব্বির মধ্যে যাতে একটা ভাঙন ধরানো যায়। এই দিবাকরও তাদের বিরুদ্ধে রতনদের উসকে দিয়েছিল। অভয় বলল, “কাকা, তুমি কোন জায়গার ঢাকের হাটে বসতে চাও? হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদা স্টেশন, বাবুঘাট, ধর্মতলা, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে বা দক্ষিণ কোলকাতার টালিগঞ্জ। মোটামুটি কোলকাতার এইসব ঢাকি হাটে সবাই গিয়ে বসে পাঁচ’ছ দিনের জন্যে ঢাক-ঢোল সমেত নিজেদের বিক্রি হতে। পূজামন্ডপের বাবুরা ওইসব জায়গায় এসে ঢাক-ঢোলের বায়না করে যায়। এছাড়া আরও অনেক জায়গায় ঢাকির দল, ঢোলের দল এসে জড়ো হয়। এবার তোমার কোথায় যাবার মন চায় সেটা বলতে হবে। আমি তো প্রায় সব জায়গায় বসেছি। মোটামুটি সবকটার অভিজ্ঞতা আমার আছে।”
-তাহলে তুই নিজেই বল না অভয়। কোনটা গেলে আমার সুবিধা হবে। পয়সাও একটু বেশি পাওয়া যায়।
-আমার ওপর যদি ছেড়ে দাও তাহলে বলব তুমি শিয়ালদাতে যাও। যেমন প্রচুর খরিদ্দার তেমন ঢাক-ঢোল এসে সরগরম করে দেয় গোটা স্টেশনের সামনের চত্বর। তুমি প্রথম যাচ্ছ তো। দেখবে কেমন অভিজ্ঞতা হয়। যা তোমার জীবনে হয়নি। হ্যাঁ, আর একটা কথা, একদম ভোর ভোর শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। আগে না গেলে ওই ঢাক নিয়ে দাঁড়াবার জায়গা পাবে না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি কাকা, কোন সময় ঢাক-কাঁসিকে একলা ছেড়ে পাশের অন্য কারোর জিন্মায় রেখে এদিক ওদিক যাবে না। পেচ্ছাপ করতেও না। তুমি যাবে তো সনাতন থাকবে আর সনাতন যাবে তো তুমি থাকবে। কোলকাতা খতরনাক জায়গা। বিশেষ করে ওইসব ভিড়ভাট্টা এলাকায়। চোর ছে্যঁচোড় হাত সাফাইঅলাদের স্বর্গরাজ্য ওগুলো। মুহূর্তের মধ্যে কোথা দিয়ে কখন যে অতবড় আস্ত ঢাকটাই হাওয়া করে দেবে ভাবতে পারবে না। গাল হাঁ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তখন।
অভয়ের কথায় ‘ভয়’ ‘অভয়’ দুটোই পায় রতন। আর কথা না বাড়িয়ে বুকে সাহস জুগিয়ে মনে মনে বলে,“ঠিক আছে অভয়, তুই যখন বলছিস তখন শিয়ালদাতেই আমরা যাবো। আর তো বেশিদিন নেই। ততদিনে এদিকে ঢাকটাকে সুন্দর করে টানটোন দিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে একদম নতুন করে রাখি। তুই ভরসা দিলি বলে আমিও মনে বল পেলাম। না তো দিবাকর যেভাবে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল। তোর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো এ বছর আমাদের কোলকাতায় যাওয়াই হত না।”
চলে গেল রতনবুড়ো বগল বাজাতে বাজাতে। অভয় পেছন ফিরে সেই যাওয়া দেখে আর মনে মনে মজা উপভোগ করে, “অভয় তোমায় উপকার করেছে কি অন্য কিছু করেছে তা তুমি শিয়ালদাতে গেলে বুঝতে পারবে, কাকা। এক-বছর সে গিয়েছিল ওখানে। কেঁদে কুল পায় নে। আর কোনদিন মুখেও আনে না শিয়ালদার ওদিক মাড়াবার কথা। জীবনেও আনবে না তা। তাই বলে কি ঢাকিরা ঢোলিরা ওদিকে যাচ্ছে না? যাচ্ছে। প্রচুর যাচ্ছে। ওইসব উৎপাত সামলাবার ক্ষমতা, সাহস যাদের আছে, তারা জেনেশুনে যাচ্ছে। কেউ না জেনে যাচ্ছে। কেউ লাভ করছে, কারোর লোকসান হয়ে যাচ্ছে, আবার কারোর সর্বনাশও হচ্ছে। এবার রতনকাকা, তুমি দেখো কোন্ ডাব্বায় তুমি হাবুডুবু খাবে। বুড়ো হাড়ে আর একবার পরীক্ষায় বসো।”
চতুর্থী থেকে শুরু হয় ঢাকিদের শহরে আসার প্রক্রিয়া। প্রথম বছর বলে রতনরা, বাপ-বেটা চতুর্থীতেই অভয়ের কথা মত ভোর-ভোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ভোর চারটেয় ৮৩ নং রুটের ফার্স্ট ট্রিপের বাসে সনাতনকে নিয়ে চড়ে বসে। একদম শেষে নামবে। বাবুঘাটে। সেখান থেকে শিয়ালদামুখী বাসে শিয়ালদা স্টেশন। অচেনা অজানা সময়-দরিয়ায় ভাসিয়ে দিল বাপ-বেটা নিজেদের ভাগ্যকে! সম্বল শুধু দু’জনের দুই-দুই চার হাতে চারমুঠো সাহস আর কৌতূহল!
বাসের ড্রাইভারের কেবিনের বাইরের প্রথম কাটা সিটের সামনে তাদের ঢাক আর লাগেজ ব্যাগটা রাখল, রতন-সনাতন। সিটদুটো আমতলায় খালি হবে। কন্ডাক্টরের কাছ থেকে জেনে ওই সিটের সামনে রতনরা বাপ-বেটা দাঁড়ালো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ আমতলায় আসবে সেই প্রত্যাশায়। আমতলায় আসার আগে কৃপারামপুরে সিট খালি হয়ে গেল। যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় আসার একটু আগে লোকে সিট ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আরকি। রতন ছেলেকে বলল জানলার ধারে বসতে। বাচ্চা ছেলে, প্রকৃতি দেখতে দেখতে কোলকাতার দিকে এগোবে। ঠাকুরপুকুর পেরলেই কোলকাতা দেখবে। ধারে না বসলে তো কোলকাতা দেখার স্বাদ মিটবে না। রতন বলল, “জানিস খোকা, বাস থেকে নামার সময় তুই কাঁসরের ঝোলাটা আর আমাদের জামাকাপড়-খাবারের ব্যাগ নিবি। আমি ঢাক নেবো। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখবি। দেখবি, কেউ যেন আবার ছিনিয়ে নিয়ে না পালায়।”
-তুমি ঠিক করে নেমো বাবা। ঢাকের যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমি ঠিক নেমে যাব। আমার জন্যে চিন্তা করতে হবে না। আর বাস একদম খালি হয়ে গেলে সবার শেষে আমরা নামব। তাহলে অত টেনশান করতে হবে না।
বাবুঘাটে নেমে রতনরা দেখে নদীর দিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় অনেকে ঢাক-ঢোল নিয়ে জড়ো হয়েছে আর যে যার মত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তা দেখে সনাতন বলল,“বাবা, ওই তো ওরা ওদিকটা ঢাক নিয়ে বসেছে। চলো, আমরাও যাই। ওদের সঙ্গে মিশে যাই। ওদের কাছে খদ্দের আসলে আমাদের কাছেও আসবে।”
-না রে খোকা। অভয় বলেছে, শিয়ালদায় প্রচুর খদ্দের আসে। ওখানে জমজমাট খুব। এখানে এই ক’জন জমেছে। নিশ্চয়ই খরিদ্দার এখানে কম আসে। কোলকাতার আদত কি জানিস, এক জায়গায় একই জিনিসের বহু দোকান। জামাকাপড়ের দোকান তো এক জায়গায় বহু জামাকাপড়ের দোকান। মশলা দোকান তো পরপর সারি দিয়ে একই দোকান। একে ‘পট্টি’ বলে। কাপড় পট্টি, মশলা পট্টি। এই ধরণের সব। এর ফলে হয়কি মানুষ স্রোতের মত ওই পট্টি বাজারে ধেয়ে আসে। এ-দোকান, সে- দোকান ঘুরে মানুষ পছন্দমত জিনিস কিনতে পারে। ঠিক আমাদের এই ঢাক-ঢোলের বেলায়ও তাই। শিয়ালদা, হাওড়া ইত্যাদি নামকরা জায়গায় প্রচুর ঢাক-ঢোল যেমন বসে তেমন মানুষও ছুটে যায় নিজেদের পছন্দের বাজনা বায়না করতে। সেইজন্যে বলছি, যেখানে অনেক লোক সমাগম সেখানে গেলে ভাল দামে আমরা বায়না পেতে পারব। চল না, আগে শিয়ালদায় যাই। ওখানে যাবার জন্যে বাড়ি থেকে মনঃস্থির করে এসেছি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে’খন।
সকাল সাতটার মধ্যে রতনরা শিয়ালদা স্টেশনের সামনে বাস থেকে নামে। ওখানেই একটু সরে এসে ফুটপাতের ওপর খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। ছেলেকে বলে, “তোর পেচ্ছাপ পেয়েছে, সনাতন? তাহলে যা। ব্যাগট্যাগ আমার কাছে দে। ওই যে, সব লোকে পেচ্ছাপ করে বার হচ্ছে। যা ওখান থেকে কাজ সেরে আয়। তুই এলে আবার আমি যাব। এইসব কাজ সেরে নিয়ে আসল কাজে গিয়ে ভাল করে মন দেওয়া যাবে। নাহলে মন ছোঁক ছোঁক করবে কখন পেচ্ছাপে যাব। ঝপাঝপ ওরা কাজ সেরে নিজেদের জিনিস নিয়ে স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। যাবার পথে পরপর সার দেওয়া চা, লুচি-কচুরির দোকান। মাথায় কালো পলিথিনের ছাউনি। বোঝাই যায় ফুটপাথে গাজোয়ারী করে বসা। ছেলেটা এমন মুখচোরা, কিছুতেই খাবার কথা বলবে না। খুব খিদে পেলেও না। রতন বলল, “কিরে খোকা এইবেলা একটু জলখাবার খেয়ে গেলে হয় না? কখন সময় পাব না পাব।” সনাতন চুপ করে থাকে। একটা দোকানের সামনে রতন ঢাকটা নামায়, “চল এই দোকানে। চা-কচুরি খেয়ে নিই।” খেতে খেতে রতন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে ঢাক, ঢোলের বাজার কেমন দাদা?”
“ভাল। যান, ওই ডানদিক বেঁকে স্টেশনের চত্বরে ঢুকে যান। দেখবেন আপনার মত কত লোক এতক্ষণে এসে জুটে গেছে। খেয়ে দেয়ে আর কোথাও দেরি করবেন না। দাঁড়াবার জায়গা পাবেন না।”
আর কথা না বাড়িয়ে রতনরা দ্রুত টিফিন সেরে রওনা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে খান দশেক ঢাকি-ঢোলির দল এসে গেছে। জনা তিনেক তাদের মত ঢাকি আর বাদবাকী সব ঢোল পার্টি। ওরাই তো ভিড় বাড়িয়ে দিয়েছে। এক একটা ঢোল পার্টি তো তিনজনের কম হয়না। বাঁশি নিয়ে চারজন। আর ঢাকিরা দু’জন। ঢাক আর কাঁশি। কোন কোন ঢাকির দলে অবশ্য দু’জন বা তিন’জন ঢাক থাকে। তাবে কাঁশি একজন। দু’জন থাকে, তা খুব কম। লাইনের সবশেষে যে দল দাঁড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় রতনরা। সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোকটা বলে, “এখানে না, এখানে না। এখানে লোক আছে। তফাতে যান। উড়ে এসে জুড়ে বসতে এসেছে। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে জানেন তো? যান, দূরে সরে যান?” লোকটার কথায় থমকে যায় রতন! পাল্টা বলে, “কেন,আমি তো আগে এসেছি। আমার পরে যে আসবে সে পরে দাঁড়াবে? আপনার লোক কোথায়? দেখছি না তো!” এবার লোকটা আরও বিরক্ত হয়ে বলল, “যা বলছি শুনুন। না হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। বলছি তো আমার লোক আছে। যখন আসবে দেখতে পাবেন।”
রতন আর কথা বাড়ালো না। নতুন এসেছে। কোথায় কি ব্যাপার আছে বুঝতে পারছে না। আসা মাত্রই লোকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রথমেই মেজাজ খিঁচে গেলে, সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। সব গোলমাল হয়ে যাবে। পাশের লোকটার কথামত যতটা তফাত করে দাঁড়াতে বলল ততটাই দূরে ওরা দাঁড়াল। বেলা তখন এগারোটার মত হবে। হঠাৎ খানতিনেক ঢোলের দল হুড়মুড়িয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল, “ও দাদা, এ’বছর ‘বউনি বছর’ বুঝি? কেটে পড়ুন এখান থেকে। নাম্বার আছে, নাম্বার? কত নাম্বার আপনার, দেখান দেখি?” রতনকে জিজ্ঞেস করে সেই আগের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের লাস্ট নাম্বার কত, পনেরো? আমার
ষোল। সরুন, সরুন। সরে যান। সেই দূরে গিয়ে দাঁড়ান। নাম্বার নেই মানে হটে যান।” এবার বিস্ময়ে রতন জিজ্ঞেস করল,“হটে যাব কোথায়? সেইখানটায় প্রথমে দাঁড়িয়েছিলাম। ওনারা বলল এখানে দাঁড়াতে। আবার আপনি হটতে বলছেন। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছি না।”
-আপনাকে অত বোঝাবার জন্যে আমরা এখানে আসিনি। পয়সা কামাতে এসেছি। যা বলছি তাই করুন। নাম্বার নেই তো আপনার কোন ঠাঁই নেই। কেটে পড়ুন। তফাতে যান, তফাতে।
কোথায় কি হচ্ছে, রতন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দল দল আসে আর রোয়াব দেখিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়। পাল্টা রোয়াব রতন দেখাতে পারে। কিন্তু এদের এই রোয়াবের রহস্য তো তার জানা নেই। তার বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে বড় কোন বিপদে পড়ে যাবে না তো? এবার মনের মধ্যে আতঙ্ক বাসা বাঁধতে থাকে। এ কোথায় এসে ওরা পড়ল রে বাবা! কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছে না। আবার কি সব নম্বর টম্বরের কথা বলছে লোকগুলো! কোথা থেকে এরা নম্বর পাচ্ছে, কারা নম্বর দিচ্ছে। কেউ তো খোলসা করে কিছুই বলতে চাইছে না। সরকার থেকে এমন কোন ব্যবস্থা থাকলে তো অভয় তাকে শিখিয়ে দিত। সে তো এসবের কিছু বলেনি ! আতঙ্কিত হয়েই এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,“হ্যাঁরে সনাতন, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বলতো বাবা? আমার তো মোটেই ভাল ঠেকছে না। তুই কিছু বুঝতে পারছিস? মানে, কেউ ঢাক ঢোল কাঁশি বাঁশি নিয়ে এখানে এলো আর বায়নার জন্যে মুক্ত আকাশে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে অত সোজা সরল হিসেবের নয়। সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে।” বাবার মনে এমন সন্ত্রস্ত ভাব দেখে সনাতনও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। ভাবল, বাবাকে সাহস যোগাতে হবে। লোকের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে তাকেও মুখ খুলতে হবে। কিন্তু অন্যায় কিছু দেখলে তো তার মাথা গরম হয়ে যায়। সরাসরি প্রতিবাদ করা ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প কিছু থাকে না। তখন আবার বাবা তাকে সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়। সে তো পরের কথা, এখন এই ব্যাপারটার পেছনে অন্য কোন শক্তি কাজ করছে নিশ্চয়ই। নাহলে লোকগুলো নাম্বার বা কোথা থেকে পাচ্ছে আর এত মেজাজ দেখানোর সাহস বা এরা পায় কেমন করে ! তারপর এরা তাদের খুলে কিছু বলছে না। বললে ওরা সেইভাবে না হয় এগোতে পারে। সনাতন বুঝতে পারে ঘটনাগুলো চুপকে চুপকে হচ্ছে। তাই কেউ প্রকাশ্যে খোলসা করে কিছু বলতে চাইছে না। সেইভাবেই সবাইকে বলা আছে নিশ্চয়ই, “জানো বাবা, এই ঘটনার পেছনে অন্য কোন বড় শক্তি কাজ করছে। এই যে নাম্বারের কথা ওরা বলছে, এটা কোন সরকারি ব্যবস্থা নয়। তাহলে সরকার আগে থেকে মানুষকে জানাতো। আর এই লোকগুলো খোলসা করে সব বলে দিত। কিন্তু এই জায়গা তো সরকারি জায়গা। এখানে যে কোন মানুষ আসতে পারে। আমাদের বারবার হটিয়ে দিয়ে এই লোকগুলো যে জায়গা দখল করে নিচ্ছে তা তো পুরোপুরি বেআইনী কাজ করছে। অন্যায় করছে। অন্যায় করছে আবার চোখ রাঙাচ্ছে। আর আমরা সেই চোখ রাঙানিতে বারবার পিছু হঠছি। ওই ‘চোরের মা’র বড় গলা’র’ মত আরকি। ওই তো পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। ওদের গিয়ে বললে হয় না বাবা, আমাদের এই লোকগুলো এখানে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শুধু ওরাই ঢাক ঢোল বাজাবে। আমরা বাজাবো না? পেট শুধু ওদের আছে, আমাদের নেই? আমরা বানের জলে ভেসে এসেছি বুঝি? সরকারি জায়গায় ওরা হটিয়ে দেবার কে? তুমি এখানে দাঁড়াও বাবা। আমি ওই পুলিশদের কাছে নালিশ জানাই। দেখি ওরা কি করে। ওরা প্রশাসনের লোক। নিশ্চয়ই আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেবে।”
সনাতন পুলিশদের গিয়ে বলতে একজন তো ক্ষেপে তার দিকে হাতের রুলবাড়ি উঁচিয়ে ধেয়ে এলো, “একটুখানি ফোচকে, আবার বড় বড় কথা! সরকারি জায়গা, সবার বসার হক আছে। যা, হটে যা। তোদের ওইসব ফালতু কথা শোনার জন্যে আমরা এখানে ডিউটি করছি না। জানিস, সরকারি জায়গায় বসতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগে? তা তোদের আছে? এমন লাঠিপেটা করব না, একদম এলাকা ছাড়া করে দেবো।” পুলিশটা হঠাৎ তার ওপর অমন করে ক্ষেপে যেতে থতমত খেয়ে যায় সনাতন। তার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে। মনে হচ্ছে পা বাড়াতে গেলে সে উল্টে পড়ে যাবে। মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বাবার কাছে ফিরে আসে। মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে। সেই সময় হঠাৎ অনেকগুলো লোক হুড়মুড়িয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। লাইনের পেছনে তাদের বাপ বেটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হাতে নাম্বারের কাগজটা নিয়ে পরপর নাম্বার মিলিয়ে দাঁড়াতে থাকে। তাদের ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিতে রাগ তার মাথায় চড়ে বসে! সে তখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার সামনের দু’জনকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়,“শালা, সেই সকাল সাতটা থেকে আমরা এখানে এসে লাইন দিচ্ছি আর এক একটা দল এসে আমাদের জোর করে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা জায়গা দখল করে নিচ্ছে? গায়ের জোর আমাদেরও আছে। কিচ্ছু বলিনি বলে ভেবেছে ধুর পার্টি না?”
তার ছেলে এমনি শান্তশিষ্ট। কিন্তু অন্যায় দেখলে ভেতরে ভেতরে ও কেমন গোমরাতে থাকে। তার উপর সেই অন্যায়কারি যদি সরাসরি তাকে জড়িয়ে অপকর্ম করে তো ও মাথা ঠিক রাখতে পারে না। কিন্তু সব জায়গায় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায় না। নিজের জীবন বিপন্ন হবার জোগাড় হতে পারে, সেই বুদ্ধি তখন তার কাজ করে না। রতন এবার প্রমাদ গুনতে থাকে। কি না কি ক্ষতি তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। যে লোকটা সনাতনের ঠেলাতে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এই রক্ত দেখে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সন্ডা সন্ডা চেহারা। সেখানে সনাতন ছিপছিপে রোগা। মল্লযুদ্ধে সন্ডাটার কাছে সে পেরে উঠবে কেন! ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ডাটা সপাটে সনাতনের থুতনিতে মারলো এক ঘুসি! ছেলের নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। তাই দেখে রতন বিকট জোরে চিৎকার করতে শুরু করল! আশপাশ থেকে লোক জড়ো হয়ে গেল। যে তিনজন পুলিশ কাছাকাছি এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল তারা এখন হাওয়া! কোন পুলিশের দেখা নেই। ভিড়ের মধ্যে একজন রুমাল ভিজিয়ে সনাতনের মুখে চেপে ধরল। একজন আবার দৌড়ে ফেরিওলার কাছ থেকে একটা আইসক্রিম এনে ওই ভিজে রুমালে জড়িয়ে সনাতনের গোটা মুখ বুলিয়ে দিয়ে রতনকে বলল, “আপনি এইভাবে ওর সারা মুখে খানিকক্ষণ বুলিয়ে দিন। একটু পরেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। জড়ো হওয়া লোকজন এই মারপিটের কারণ শুনতে শুনতে একজন রতনকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে নম্বর নেই তবু আপনি এখানে এসে গুঁতোগুঁতি করছেন কেন? আপনি জানেন না, নম্বর ছাড়া এখানে দাঁড়ানো যায় না? শুধু আজ কেন ষষ্ঠি-সপ্তমী এসে গেলেও কেউ আপনাকে দাঁড়াতে দেবে না। আপনি লাথ খেতেই থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মোক্ষম লাথ খাবেন ‘হাতকাটা ছেনোর’লোকের কাছে।”
-সেইটাই তো আমি সেই সকাল থেকে জানতে চাইছিলাম, ওই নম্বর ব্যাপারটা কি? কিন্তু কেউ আমাকে খোলসা করে বলতে চায়নি। আমি তো এ’বছর এই প্রথম এখানে এসেছি। আগে কোনদিন আসিনি। তাই এখানকার আদবকায়দা আমার জানা নেই। লোক শুধু খেদিয়েই চলেছে আমাদের।
সনাতনের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে মনে হয় লোকটার মনে একটু দয়া জেগেছিল। তাই রতনদের ভিড় থেকে আলাদা করে ডেকে ফাঁকায় নিয়ে এলো, “এই ছেলেটা আপনার কে হয়? নিশ্চয়ই ছেলে? না কি?” রতন হ্যাঁ বলতে লোকটা বলল, “এই ব্যাপারটা একদমই বেআইনী এবং গোপন ব্যাপার। সেইজন্যে কেউ আপনাকে খুলে কিছু বলবে না। নিষেধ আছে। যে বলতে যাবে, তার বিপদ। আমিও যদি প্রকাশ্যে বলি আমারও বিপদ। আমাদের ঢোল পার্টির নম্বর বাইশ। বাচ্চাটার নাকেমুখে রক্ত দেখে মনটা খারাপ লাগল। এর বয়সী আমারও ছেলে আছে। আমাদের দলেই আছে। এখন দেখালে আপনি এই জায়গা থেকে বুঝতে পারবেন না। ছেলেটাকে দেখে আমার ছেলের মুখটা ভেসে উঠল। তাই উপযাচক হয়ে আপনাদের ফাঁকায় ডেকে আনলাম। আপনারা কিছুই জানেন না। না জানলে এইভাবে আপনাদের উপর আঘাত আসতেই থাকবে। শুনুন, ‘হাতকাটা ছেনো’কে মস্তানি ফি না দিয়ে কোন ঢাক বা ঢোলের দলের এখানে দাঁড়াবার আইন নেই। এটা শিয়ালদা স্টেশনের মস্তান, হাতকাটা ছেনো-মস্তানের আইন। পুলিশী আইন এ’চত্বরে চলে না। পুলিশ এখানে ‘গোপাল ঠাকুর’। এই যে মারপিট হল, আপনাদের প্রতিপক্ষ ছেনোর কাছে নালিশ জানাতে যায়নি বলে রক্ষে। না হলে ওর স্যাঙাতরা এসে উত্তম মধ্যম কেলিয়ে এই এলাকা ছাড়া করে দিত আপনাদের। এর পরেও যদি আপনারা এখানে দাঁড়াতে চান তাহলে বলি, ওই যে বড় গেট দেখতে পাচ্ছেন। ওখান দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবেন। পা গুনে দশ পা এগোবেন। তারপর ডানদিকে দেখবেন কালো পলিথিন টাঙানো পরপর দুটো চা দোকান আছে। ওই চা দোকান দুটোর মাঝে ফুট চারেকের ফাঁক আছে। ওই ফাঁকটা কালো পলিথিনের পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দাটা সরিয়ে আধ মিনিট এগোলে এন. আর. এস. হাসপাতালের পাঁচিলের গা ঘেঁসে একটা ক্লাবঘর মত আছে। সামনে দু’ফুটের বারান্দা, তারপর ঘর। ঘরটা আলোতে ঝলমল করছে। টিভি চলছে। আট-দশটা জিনস্ পরা ছেলে হইহুল্লোড় করছে। আর একজন একটা কাঠের চেয়ারে বাদশার মত বসে আছে। চোখদুটো তার টকটকে লাল। সবসময় চুল্লুতে চুর হয়ে আছে। ওখানে গিয়ে শুধু বলবেন, আমি নম্বর নিতে এসেছি। তারপর যা বলার ওরা সব আপনাকে জামাই আদর করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর একটা কথা, যদি চারফুটের গলিটা চিনতে না পারেন তো যে কোন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবেন ছেনো স্যারের অফিসটা কোথায় ? সঙ্গে সঙ্গে সেই দোকানদার, দোকানের খদ্দের ফেলে ‘ঠাট’ মানে দোকানের ভেতরে তার বসার জায়গা থেকে নেমে এসে আপনাকে দেখিয়ে দেবে, ছেনো স্যারের অফিস! যান, আপনার তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় সটকে পড়ুন এখান থেকে। অধিকার আদায় করে আবার বুক উঁচিয়ে ফিরে আসুন। দাঁড়িয়ে পড়ুন আপনার জন্যে নির্দিষ্ট নম্বরে। তখন আর কোন ‘মা-কা-লালের’ মানে মায়ের ব্যাটার সাহস হবে না আপনাকে বাধা দেবে।”
মার খেয়ে ছেলেটার দুটো ঠোঁটই ফুলে টোবলা হয়ে গেছে। দু’পয়সা রোজগার করতে এসে এ’ভাবে ওরা অপদস্ত হবে তা কল্পনাই করতে পারেনি, রতন। কষ্টে ভেতরটা যেন কঁকিয়ে উঠছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে আরও যেন দুমড়ে পড়ে মনটা। একবার মনে হচ্ছে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। দরকার নেই টাকা রোজগার করে। পাড়াগাঁয়ে থেকে যা রোজগার হয় তাই ভাল। বেশি লোভে কাজ নেই। আবার মনে হয়, মার যখন খেয়েছি তখন এর শেষ দেখে তবে যাবো। লড়াই না করে ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়া ভীরুতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবু ছেলেটা কি বলে একবার জিজ্ঞেস করে দেখা যাক, “হ্যাঁরে খোকা, এখন কি করা যায় বলতো? বাড়ি ফিরে যাবো, না হাতকাটা ছেনোর ডেরায় যাব? তুই কি বলিস?”
-বাবা, এসেছি, অপদস্ত হয়েছি, মার খেয়েছি। দু’পয়সা রোজগার করার জন্যে। পেটের দায়ে। অত সহজে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে তো জীবন ভর পালিয়ে বেড়াতে হবে। লড়াই না করে কে বেঁচে আছে বাবা? পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আমরা মানুষ। গরিব মানুষ থেকে বড়লোক পয়সাওলা মানুষ। কে না লড়াই করছে। তা আমরা কেন লড়াই না করে ফিরে যাব? তাহলে তো অভয়রা আমাদের দেখে হাসবে। ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি বলে টিটকারি করবে। হারার আগে হেরে বসে থাকাটা ঠিক হবে না বাবা। চলো আমরা হাতকাটা ছেনোর কাছে যাই। দেখি, ওর কি কেরামতি। তারপর না হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। তবে অত সহজে আমরা বাড়ি ফিরছি না বাবা। সাহস বুকে নিয়ে এগোলে দেখবে, মা শীতলা আমাদের ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে। আসার সময় আমার মা তো বলে দিয়েছে, বিপদে মা শীতলাকে ডাকবি। মা ঠিক তোদের পাশে এসে দাঁড়াবে। যাবতীয় বাধাকে জয় করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

ক্রমশ….. 

Exit mobile version