ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১০)

(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট)
জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

[তেইশ]

অখিলদের দু’কামরা ঘরের এক কামরার একেবারে মটকা পর্যন্ত সোলার বস্তা ঠাসা। এমনকি সামনের বারান্দার অর্ধেক অংশও সোলায় ভর্তি।এখান থেকেই ও কারিগরদের দরকার মত সোলা সাপ্লাই করে। বরাবরই ওর রুইদাসদের জাত ব্যবসা ওই গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কারবার, বেতের সরঞ্জাম তৈরী করে বিক্রির কারবার একদম পছন্দ নয়। ও জ্ঞান হওয়া বয়স থেকে দেখেছে পাড়ায় একে অপরের সঙ্গে এইসব কাজ কারবার নিয়ে পরস্পরের রেষারেষি, হিংসা, খুন, মারপিট- আরও কত কি। দিঘিরপাড় স্কুলে সেভেনে পড়ার সময় চন্দ্রবড়া সাপে কেটে বাপটা মারা গেল। ফি বছর বর্ষায় এদিকে এই চন্দ্রবড়া সাপের উৎপাতে মানুষের জীবন অতীষ্ট। এই সময় মনে হয় এরা ডিম পাড়ে। রাস্তাঘাটে ঝোপঝাড়ে ছোটবড় কত যে সাপ তারা মারে তার হিসেব নেই। তবু বেটারা নিকেশ হয় না। বাপটা মরতো না যদি সময়মত পাড়ার লোক ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে নিয়ে যেত। বর্ষায় দৌলতপুর শ্মশান চড়ার ওদিক থেকে ধান রোয়ার কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় ঘাস লতাপাতা কেটে বোঝা মেরে নিয়ে আসে। ঘরে দুটো ছাগল আছে। বর্ষার ঘাস পাতা খাওয়ালে ছাগল ফলফলিয়ে বেড়ে ওঠে। মা-ছাগলের দুধ বেড়ে যায়। যাদের যাদের বাড়ি ছাগল আছে তারা সবাই তাই করে। একবার তো ঘাস পাতা ছাগলকে খাওয়াবার সময় দেখে একটা কালকেউটো সাপের কাটা লেজ তার মধ্যে! সেই শুনে তাদের বাড়ি, পাড়ার লোক উপচে পড়ে। তা দেখে এক একজন এক এক রকম মন্তব্য ছুড়ে দেয়, “অখিলের বাবার ভাগ্য ভালো কাল ব্যাটা ঘুরে ছোবল মারেনি। ওর ছোবল একবার খেলে আর মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে না। ওখানেই কাত খেয়ে পড়ে যেতে হবে।” যারা নিত্য ঘাস কাটে তাদের কেউ বলে, “না বাবা, ছাগল বাঁচাতে গিয়ে নিজে মরবো নাকি! ওই ভাতের ফেন-ভুষি যা যোগাড় করতে পারব তাই খাওয়াব। ঘাসের জঙ্গলে আর না।” আরও কত লোকের কত কি কথা।
শ্রাবণ মাস। তখন বর্ষা পূর্ণ যৌবনা। পুকুর ডোবা, নালা, খানাখন্দ জলে টৈুটুম্বুর। সেই তালে যুবতী ঘাস যেন তার রূপের ছটা ঘেসুড়ে-ঘেসুড়িদের মাতাল করে দেয়। এরা তখন নিজেদের সামলে রাখতে পারে না। শত্রু বিপদের ভয় মাথায় তুলে তারা কাস্তে হাতে নেমে পড়ে লকলকে ঘাসের বনে। তাদের যুক্তি, কপালে গেরো থাকলে তা কে খন্ডাবে। যা হবার তাই হবে। সত্যি সত্যি তাই হল! এক কোমর জলে নেমে দু’হাত পাকড়ে ঘষ ঘষ করে হাত চালিয়ে ঘাস কেটে চলেছে অখিলের বাবা, চরণ। ঘেসুড়েরা জানে, ভারি জলে কোন বিষাক্ত সাপ থাকেই না বললে চলে। তবে পুকুর বা নালা ডোবার পাড়ে সাবধানে কাজ করতে হয়। ওই আরকি! দানা যখন শেষ হয়ে আসে তখন ‘সতর্কতা’ মাথা থেকে ফসকে যায়। কাটতে কাটতে নালাটার পাড়ে চলে আসে চরণ! সঙ্গে সঙ্গে শত্রু, গোদা চন্দ্রবড়াটা কুট করে ছোবল মারে চরণের বাঁহাতের কব্জির উপর দিকটায়। বাঁ হাতে তখন মুঠো ভর্তি ফুলকো ফুলকো ঘাস। বুঝতে পারেনি চরণ। ভাবলো ভোলা পিঁপড়ের মোটা দাঁড়া কামড় দিয়েছে। ভোলা পিঁপড়ে কামড়ালেও চুঁইয়ে রক্ত পড়ে ক্ষত থেকে। সেটাই ভাবে চরণ। কাজ থামায় না। হঠাৎ দেখে শালা গোদা চন্দ্রবড়াটা সামনে দিয়ে গতর নেড়ে চলে যাচ্ছে! আর বুঝতে দেরি হয়নি চরণের, কি সর্বনাশা কান্ড ঘটিয়ে গেল ওই কাল-শত্রুটা! চন্দ্রবড়ায় কাটলে কেউটোর মত অত যন্ত্রণা হয় না বা গলগল করে রক্ত ঝরে না। তাই সে পিঁপড়ের তত্ত্ব খাড়া করে নিজেকে বোধ দিচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে তো অনেকটা সময় জীবন থেকে কেটে বেরিয়ে গেছে। তবু যা সময় আছে তার ওপর ভরসা করে ঘাসের বোঝাগুলো বেঁধে মাথায় নিয়ে ভর দুপুরে বাড়ি ফিরে ধপাস করে বোঝাটা ফেলে মা’কে বলল, “দেখতো অখিলের মা, আমার হাতে মনে হয় বিষধর কিছু কামড়েছে। কামড়ায় যখন টের পেয়েছি। ওটা ভোলা পিঁপড়ে কামড় ভেবে গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু সময় যত গড়ায় শরীর ভেতর থেকে কেমন যেন করছে মনে হল। এখন কি করি বলতো? পাড়ায় একটু খবর দে-দিকিনি। অখিলকে বল গোটাকতক মেলেরিয়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসতে। দু’হাতের তালুতে ঘষে তার রস ছোবল খাওয়া জায়গায় দিয়ে দিই।”
খবর পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যায়। যে যার মত টোটকার নিদেন দিতে থাকে। কে আবার উলকুনির শঙ্কর ওঝাকে খবর দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেও এসে ঝাড়ফুঁক চালিয়ে তার বিদ্যে ফলাতে শুরু করেছে। ভাবটা এমন, বিষ এক্ষুণি নামিয়ে দিল বলে। এদিকে রোগি আস্তে অস্তে যেন ঝিমিয়ে পড়ছে! দিঘিরপাড় স্কুলের অরুণ মাস্টার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হইহট্টগোলের শব্দ পেয়ে থমকে যায়! কারোর মুখে শোনে একজনের সাপে কেটেছে। বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া সাপ! ও তো সাংঘাতিক বিষধর সাপ! সময়মত হাসপাতালে না নিয়ে গেলে মানুষকে বাঁচানো যায় না। সেটা বুঝে অরুণ মাস্টার পায়ে তাড়া লাগিয়ে পাড়ায় ঢোকে। হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে এখানে এইসব বুজরুকি হচ্ছে দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, “এক্ষুণি তোমরা একে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।” ওঝার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই ওঝা বেটা, যতই তুই মন্ত্রপুতে মাটির সরা-মালসা ফাটিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিস। পারবি তুই, এই মানুষটার শরীর থেকে বিষধরের বিষ নামাতে? কোনদিন তোরা পেরেছিস? কোথায় হয়তো বিষহীন চিতি সাপ, মেটলে সাপ বা দাঁড়াসাপ কামড়েছে, মানুষ দেখতে পায়নি সেই সাপটাকে। ভাবে যদি কোন বিষধর কামড়ায়? তখন তোদের ডাকে। তোরা এসে মন্ত্র আউড়ে ভড়কি দিস, সাপের বিষ নামিয়ে দিয়েছিস। শুনলাম অনেকক্ষণ থেকে নাকি তুই কেরামতি করে যাচ্ছিস। রোগি তো ক্রমশ আরও নেতিয়ে পড়ছে। এই যে রুইদাসরা সব, তোমরা ওই ওঝা বেটার কি ঢ্যামনামি দেখছো। এক্ষুণি নিয়ে চলো ওকে হাসপাতালে? আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। এমনিতেই বহু দেরি হয়ে গেছে। দেখো ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের রাস্তায় যেতে যেতে না মানুষটার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যায়!”
অরুণ মাস্টারের তাড়ায় এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে চরণকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু এত ভিতরের গ্রাম থেকে একে পাকা সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবে কি করে! তারপর তো কোন গাড়ির ব্যবস্থা! পাড়া থেকে সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে কোন ভ্যান-রিক্সারও ব্যবস্থা করতে না পেরে ওরা চরণকে ধরাধরি করে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার বলে, “এ কি করছো তোমরা? সাপে কাটা রোগিকে কেউ এ’ভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়? একে একদম নাড়াচাড়া করা চলবে না। যত নাড়াচাড়া করবে তত ওর শরীরের ভেতরের রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠানামা করতে থাকবে। আর বিষ তুরন্ত মাথার দিকে উঠতে থাকবে। ওকে বিন্দুমাত্র হাঁটানো চলবে না। যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করতে হবে। কোনকিছুর উপর শুইয়ে মড়া নিয়ে যাবার মত কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে।” সঙ্গে সঙ্গে একজন বলল,“তাহলে এক কাজ করা যাক, চরণকে ধান ঝাড়া আগোড়ে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে শুইয়ে নিয়ে চলো।” ইতিমধ্যে জনা দুই ছেলে সড়ক রাস্তায় চলে গেছে কোন অটো-টেম্পো যদি যোগাড় করা যায়। কিন্তু গ্রাম এলাকায় এই ভর-দুপুরে এমনিতেই রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলে কম। তারপর অটো-টেম্পোর কথা তো বলাই বাহুল্য। এতক্ষণ হয়ে গেল, রাস্তা দিয়ে একটাও ওইসব গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না। ততক্ষণে চরণকে আনা হয়ে গেছে। অরুণ মাস্টারও সঙ্গে এসেছে। একটা সাইকেল ভ্যান ধানগাছের চারা-তোলা নিয়ে যাচ্ছিল। মাস্টার সেই ভ্যানওলাটাকে থামিয়ে অনুরোধ করে বলল, “তুমি ভাই এই সাপেকাটা রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। না হলে এ মরে যাবে। তোমার তোলা আমরা গুছিয়ে এখানে রাস্তার পাশে নামিয়ে রাখছি। ফিরে আসলে আবার আমাদের লোক তোমার ভ্যানে গুছিয়ে তুলে দেবে।” মাস্টারকে চেনে ভ্যানওলাটা। ওর ছেলে ওদের স্কুলে পড়ে। তাই মাস্টার এমন অনুরোধ করায় ও আর ‘না’ করতে পারলো না। তড়িঘড়ি সবাই মিলে তোলার বোঝা নামিয়ে চরণকে ওই কাঁথা-কম্বল সমেত ভ্যানে তুলে দিল। ভ্যানওলা বলল, “তোমাদের মধ্যে দু’জন আমার পেছনে দু’দিকে বসো। বেশি আর কাউকে ভ্যানে তোলা যাবে না। বেশি ওজন হয়ে গেলে গাড়ি গড়াবে না। আর দু’জনে দু’দিক থেকে আমার সঙ্গে প্যাডেলে চাপ দিয়ে যাবে। তাহলে গড়গড় করে গাড়ি ছুটবে।”
শেষ অবধি অরুণ মাস্টারের কথাই মিলে গেল। ঝিঙের পোল আর সরিষার হাটের মাঝামাঝি চেওড়ার কাছে যখন এল, ওরা দেখল চরণ, বিষের যন্ত্রণায় ‘উ-আঃ, মরে গেলাম’ বলে এতক্ষণ ধরে যেমন কাৎরাচ্ছিল, সেই কাৎরানি থেমে গেছে! ভ্যানওলাকে ওরা গাড়ি থামাতে বলল। ভ্যান থেকে নেমে ওরা দেখে চরণের শরীর আর নড়াচড়া করছে না। একবারে অচঞ্চল! সমস্ত শরীরটা নীল হয়ে গেছে। ডাক্তার না হলেও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে চরণ আর বেঁচে নেই! তখন ভ্যানওলাটা বলল,“আর একে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। ওখানে নিয়ে গেলেই পুলিশ কেস হয়ে যাবে। পোস্টমর্টেম হবে। তখন হাজার হেপা তোমাদের বইতে হবে। তার চেয়ে পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। দিঘিরপাড় বাজারের কুঞ্জ ডাক্তার তো পাশ করা ডাক্তার। ও ডেথ সার্টিফিকেটে কাজ হয়ে যাবে।”
হঠাৎ বাবার অপঘাতের মরণে অখিলদের সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। মা দিশাহারা। ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে কেমন করে সে সংসার চালাবে! তার লেখাপড়ার খরচও বা কোথা থেকে জোগাড় করবে। নিজেদের কোন চাষজমি নেই যে সেই জমি চাষ করে সারা বছরের ধান-চালের খোরাক মিটে যাবে। ও মেয়েমানুষ, ওদের জাত-কারবার, চামড়া বা বেতের কোনকিছুই জানা নেই। শেষমেষ মা পেটের টানে মেয়ে-মজুরদের দলে নাম লেখাল। সব বিষয়ে মেয়েদের কত জ্বালা। মেয়েদের কত দুচ্ছা করা স্বভাব সমাজের। দশগন্ডা তোলা ভাঙা আর দশগন্ডা পোতা সারাদিনে দু’তরফই করছে। পুরুষ-মজুর এবং মেয়ে-মজুররা। অথচ মেয়েদের বেলায় রোজগন্ডা ছেলেদের থেকে কম! কেন হবে এমন অবিচার? অথচ কোন মেয়ে-মজুরের এই বেনিয়মের কথা বলার অধিকার নেই। যে ‘বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে যাবে’ তার কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে পুরুষ জাতেরা। মেয়েরা পুরুষের সমান সমান হবে তা আবার জাত-পুরুষরা মেনে নিতে পারে নাকি! ওরা খুব ভাল করে এটা বুঝেছে যে নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কোন ঘরের মেয়ে বাইরে বার হয় না। সেই সুযোগকে ওরা কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আর পুরুষ-মজুররা কাজ বয়কট করলে যে গোটা চাষ ব্যবস্থাটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই এই পুরুষ প্রাধান্য। এই কষ্টের কথা তার মা, অখিলকে শুনিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ত। বালক অখিলের মন মায়ের আকুতিতে ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তাই বাধ্য হয়ে সে পড়া ছেড়ে দিল, “মা, আমি আর স্কুলে যাবো না। তুমি কষ্ট করে জন খেটে আমাকে পড়াবে খাওয়াবে। তোমার এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না মা। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আমিও কাজে যাব।”
-এ কি কথা বলিস বাবা? তুই কোথায় কাজে যাবি। বাচ্চা ছেলে তুই। কে তোকে কাজে নেবে! তুই স্কুল ছাড়বি না। যে করে হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব, অখিল। তুই দেখিস, যত কষ্ট হোক, তোর লেখাপড়া আমি আটকাব না।
কিন্তু মা একা ওই ক’টা টাকা জন খেটে কোথা থেকে তাদের খাওয়া-পরা আর তার লেখাপড়া শেখাবে? অখিল কিছুতেই সেই অঙ্ক মেলাতে পারছিল না। হাজার হোক নয়-নয় করে সে তো সেভেন ক্লাস অব্দি পড়ছে। একটু গাঁটগুনতির হিসেব সে তো বোঝে। এতটা বিপদে মা’কে ফেলা তার উচিত হবে না। স্কুলের টিফিন টাইমে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে ঘোরাফেরার সময় মাঝে মাঝে মোহন গোড়ের শোলা কারখানার কাজ দেখতে যেত সে। তার মত বা তার থেকে ছোট-বড় অনেক গরিব ঘরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা শোলা দিয়ে কি সুন্দর সুন্দর ঠাকুরের গয়না, মুকুট, টোপর তৈরী করছে! ভাল লাগত তার। অবাক হয়ে তাদের কাজ সে দেখতো। হঠাৎ একদিন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মোহন গোড়ের শোলার কারখানার ছবিটা! দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। মা’কে কিছু না বলে একদিন মোহন গোড়ের কাছে গিয়ে ধীর স্থির বিনয়ের সঙ্গে বলল, “কাকু, আমাকে তুমি চিনবে না। আমার বাড়ি রুইদাস পাড়ায়। চরণ রুইদাসের ছেলে আমি। বাবা সাপে কেটে মরে গেল। মা জন- খেটে আমাকে খাওয়ায়। তার ওপর আমার পড়ার খরচ মা আর চালাতে পারছে না। তোমার কারখানায় আমাকে কাজে নেবে? তুমি যা পয়সা দেবে তাতেই আমি কাজ করবো। মন দিয়ে কাজ করব। কাজে কোন ফাঁকি দেব না।”
-তা এখানে কাজ করে তুই পড়ার খরচ চালাবি তাই তো? ও গুড়ে বালি। পড়া ছেড়ে দিয়ে যদি তুই আসিস তাহলে আমি তোকে কাজে নিতে পারি। দু’নৌকায় পা দিয়ে তো চলা যায় না। ঢেউয়ের খামখেয়ালীতে নৌকো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে দু’পা চিরে গিয়ে জলে ঝপাং খেতে হবে। একটা কাজে লেগে মন ছুঁক ছুঁক করবে আর একটা কাজ কখন কিভাবে করা যায়, সেজন্যে। তাতে কোন কাজটাই মন দিয়ে করা যায় না। দু’কাজেই ফাঁকি পড়ে যায়। আর তুই বলছিস, মন দিয়ে কাজ করবি। তা কখনো হয় না। তারপর আমার এমন বাহুল্যতা নেই যে পুরো সময় কাজ না করে তিড়িং বিড়িং কিছু কাজ করে সময় কাটিয়ে চলে যাবি। আর ‘ফুল-ফুল’ রোজের পয়সা তোকে গুনে যাব। যাদের পেট চলে না তাদের পড়াটড়া তো বিলাসিতা ছাড়া আর কি? তোর বাপ
চরণ আমার জমিতেও চাষের কাজ করত। ‘লতার’ ছোবলে অকালে চলে গেল। আসলে কি জানিস, তোদের জাতটাই মুর্খ গোঁয়ার জাত। একটু যদি শিক্ষে-দীক্ষে থাকতো তো এই যুগে ওই ওঝা ডেকে বাজে সময় নষ্ট করে লোকটাকে মেরে দিত না। আর বলি কি, এদিকে পেটে ছুঁচোর ডন মারা রুখবে না বিদ্যের কচকচানিতে মজবে। এই যেমন তুই। বাপের নাড়ার গোড়ায় রস থাকলে তুই বিদ্যের মেজলায় মুখ জাবড়ে থাকতে পারতিস। সব কপাল। তোদের জাতটারই পাথরচাপা কপাল। তুই আর কি করবি। যদি কোনদিন তোদের কেউ ওই পাথর সরাবার ক্ষমতা দেখাতে পারে তবেই এই অশিক্ষের পাপ ঘুচতে পারে। চরণের মরণের খবর সব আমরা জানি। সেই চরণের ছেলে, তুই। এখন লোক নেওয়া আমার জরুরী নেই। তাই দরকার না থাকলেও তোকে কাজে নেবার কথা ভাবতে পারি। যদি আমার শর্তে রাজি থাকিস। তোর মা’র সঙ্গে কথা বলে সামনের মাস থেকে আসতে পারিস। আর একটা কথা, সবাই যেমন কাজ করে তোকেও তাই করতে হবে। আলাদা করে কারোর বেলায় কোন ছাড় নেই। পয়সার জন্যে সবাই আসে। একজনকে ছাড় দিলে আর একজন সেই সুযোগ নেবার কথা তুলে বসবে। সে ফায়দা আমি কাউকে দিতে রাজি নই।
মোহন গোড়ে যা বলল একদম ঠিক। পেটের জ্বালা মেটাবে না লেখাপড়া শিখবে! মায়ের কষ্ট অখিলের আর একদম সহ্য হয় না। সে যদি শোলা কারখানায় কাজ করে দু’দশ টাকা মায়ের হাতে দিতে পারে তো সংসারটা একটু গড়ায়। মা’কে আবার এ’কথা বললে মা কিছুতেই রাজি হবে না। সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করুক তা মা চায় না, সে তো মা আগে বলেই দিয়েছে। আবার মোহন গোড়ে এখন তাকে কাজে নিতে রাজি হয়েছে। এবার সে যদি যাবে না বলে দেয় তো পরে গেলে আর না-ও নিতে পারে। একবার মতি ঘুরে গেলে পরে আর রাজি করানো যাবে না।
রোজ ভোরে উঠে ছেলের জন্যে একটু ভাতেভাত করে নিজে এক টিফিনকারি পান্তা আর একটা পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা নিয়ে কাজে চলে যায় চপলা। পাড়ার আশেপাশে কাজ কম পায় সে। যেতে হয় অনেকটা দূরে। সেই কোদালে বা আমড়ের মাঠে। অতদূর থেকে দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় নেই। জিরোনোর সময় পাবে না। আসা-যাওয়াতেই সময় কেটে যাবে। তাই যেখানে কাজ করে সেখানেই ফাঁকা মাঠে বাবলা গাছের ছায়ায় বসে এই পান্তা খেয়ে নেয়। আঁচলের খোঁটটা পুঁটলি করে মাথায় ঠেকিয়ে একটু চোখ বুজিয়ে থাকে। বিকেলে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যের কাছাকাছি হয়ে যায়। রাত্রে একটা তরকারি আর একটু বেশি করে ভাত চাপিয়ে শান্তি করে মায়ে-পোয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। যতদিন চাষের কাজ থাকে এইভাবেই চলে চপলার দিন-চক্র। অসময়ে লোকের বাড়ি তোলা-ঝিয়ের কাজ বা অন্য যা কাজ পায় তাই করে। থেমে থাকার আইন তার জীবনের জন্যে বরাদ্দ নয়। এমনই তার পেট-সামাল দেবার তাড়া যে ছেলেটা কি করছে না করছে তা দেখার সময় নেই। শুধু কথার কথা, না বললে নয় তাই বলে, “কিরে অখিল, ঠিকমত পড়াশোনা করছিস তো? স্কুল কামাই করছিস না তো? ইদানিং তো তোকে সকাল-সন্ধ্যে বই নিয়ে বসতে দেখি না। কখন পড়িস কি জানি। আমি বাড়ি থাকি না, দেখতেও পারি না কি করছিস না-করছিস।” এ ছাড়া তার কচি ছেলেটার ভাল-মন্দ কোন কিছুই তার আঁচলের মধ্যে ধরে রাখার সুযোগ নেই।
অখিল মায়ের কথায় কোন উত্তর দেয় না। সারাদিন সোলা কারখানায় খাটনি করে সন্ধ্যে আর শরীর সায় দেয় না। শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও যায়। মা রান্না করে খেতে ডাকলে খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। আসলে অভ্যেস নেই তো এইভাবে এতটা টানা কাজ করার। সন্তানের এই অপরিচিত আচরণ চোখ এড়ায় না চপলার। মনের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল বারবার তাকে ধাক্কা দেয়! হঠাৎ ছেলের কি হল যে এমন নিয়মভাঙা আচরণ করে চলেছে? প্রশ্ন নিয়ে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ছেলের কাছ থেকে মনমত উত্তর আসে না, “ও কিছু না, মা। এমনি।” বলে একটা দায়সারা উত্তর দিয়ে চুপ করে যায়। মনটা তাই উচাটন চপলার! কি যে করে বুঝে উঠতে পারে না। বাবা থাকলে দু’জনে আলোচনা করে মনটাকে থিতু করতে পারতো। কিন্তু সে উপায় তো নেই। কাজের জায়গায় যে সব মেয়ে ওর সঙ্গে কাজ করে তাদের কাছে দুঃখের কথা বলে। তারা তাদের মত কত যুক্তি দেয়। কিন্তু চপলার মন থিতু হয় না। একবার পাশের গ্রাম, দৌলতপুরের মাঠে রোয়া ধানের ঘাস নিড়োনোর কাজে যায় ও। সেখানে তাদের পাড়ার বিন্দুর মা ও কাজে লাগে। পয়সার অভাবে মেয়েকে স্কুলের দোর দেখায়নি বিন্দুর মা। মেয়ের শরীরের হাড়গোড় শোলার মোট বইবার মত শক্ত হতেই শোলা কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেয়। মনে মনে ভেবে নেয়, মেয়ের মুখের আদল, গায়ের রং চাঁছাছোলা আছে। দামড়ি মত হলেই বিয়ের বাজারে ফেলে দেবে। অনায়াসে বিকিয়ে যাবে। এমন দেখতে মেয়ের জন্যে ছেলেরা সবসময় ছোঁক ছোঁক করে। যে মেয়ের পেছনে ছোঁকছোঁকানির বহর বেশি সেই মেয়ের বাপ-মায়ের কপাল খুলে যায়। মেয়ের বিয়ের জন্যে তেমন পয়সা খরচা করতে লাগে না। মেয়ের পক্ষ যৌতুক-নগদ দিল-দিল, না-দিল না-দিল। এমনিই হিল্লে হয়ে যায়। বিয়ের জন্যে ঘটক-ঘটকির চক্করে পড়তে হয় না।
চপলা ছেলের কথা তুলতে বিন্দুর মা বলে, “কিগো চপলা-বউ, তুমি জানো না? তোমার ছেলে তো ওই মোহন গোড়ের সোলার কারখানায় কাজে যায়! কেন, ছেলে তোমাকে বলেনি? কেমন তারা ছেলে তোমার গো? আমার মেয়ে বিন্দুও মোহনের ওখানে কাজ করে। মেয়ে তোমার ছেলের গল্প করে বলে জানলুম। তোমার ছেলের মাথায় নাকি ভাল বুদ্ধি। মোহন তোমার ছেলের কাজে খুব খুশি। এত অল্প কয়েকদিনে এত সুন্দর কাজ ধরে নিতে নাকি আজ পর্যন্ত কোন কারিগর পারেনি। যেটা তোমার ছেলে পেরেছে। আর এতো ভাল ছেলে নাকি, সবাই ছুটি হয়ে বাড়ি চলে গেলেও তোমার ছেলে যায় না। এমন কাজ শিখে নেবার তাগিদ তার। তাতে হয় কি, আমার মেয়ের মত অন্য যারা কাজ করে তাদের অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। মালিক তোমার ছেলেকে দেখিয়ে এদের উপর খচর খচর করে, “ওই তো অখিল সবে কাজে ঢুকেছে। এখনো একমাস হয়নি। আর ক’দিন হলে মাস পূর্ণ হবে। এই নতুন ছেলেটা যদি একটু বেশি কাজ করে তো তোরা করতে পারবি না কেন? হতেই পারে ছুটির সময় হয়ে গেছে। একটু বেশি কাজ করলে কি তোদের গতর ক্ষয়ে যাবে? মালিক বাঁচলে তবে তো তোরা কাজ পাবি। বাঁচবি।” তোমার ছেলে এটা কিন্তু ঠিক কাজ করছে না।” বলো তো এখন কি ঝামেলায় পড়ে গেল আমার মেয়েরা ? ভালই ছিল ওরা। এখন তোমার ছেলে ঢুকে ওদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। তুমি বউ, তোমার ছেলেকে বলে দিও, যেমন কাজের টাইম তেমনটি সময় মেনে যেন ও কাজ করে। কেন, বেশি কাজ করলে কি মোহন গোড়ে বেশি পয়সা দেবে? দেবে না। তাহলে বেশি কাজ করতে যাবে কেন লোকে? মান সরম খুইয়ে মেয়েরা পরের দোরে কাজে যাচ্ছে পয়সার জন্যে তো, না কি? ওই যে মালিকরা যেমন বলে, পয়সার দান-সত্র খুলে তারা বসে নেই যে কাজে ফাঁকি দিয়ে ‘সই-সই’ মানে সমান সমান পয়সা নিয়ে চলে যাবে! আর মজুরদের গতর বুঝি মাগনা? বেগার বেগার গতরের রস শুষে নেবে! না গো অখিলের মা, কথাগুলো তোমাকে বিঁধে বলছি না। তুমি আমি তো একই গোত্রের মানুষ। তোমার আমার বুকের জ্বালা কথায় কথায় উগরে দিলাম। তুমি যেন আবার গায়ে মেখে নিউনি। শুধু তোমার ছেলেকে বলতে বলছি, কেন ও এত মাগনা খাটতে যাবে। বুদ্ধি করে, গতর বাঁচিয়ে চললে তবে না বেশিদিন লড়াই চালাতে পারবে। না হলে যে অকালে বুড়িয়ে যেতে হবে।”
বিন্দুর মায়ের কাছে ছেলের কান্ডকারখানা শুনে চপলার মন যেন থম মেরে যায়! নিজের জীবনের জন্যে এতবড় একটা পরিবর্তনের কথা ছেলেটা ঠিক করে নিল! পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে গেল! একবারও মা’কে সে কথা জানাল না? তোকে তো বলেছিলাম বাবা, যত কষ্ট হোক আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব। পড়াশোনা করে তুই বড় হবি। তখন আর সারা জীবন ওই বাপ-ঠাকুর্দার মত চামড়া, জুতো, বেত আর লোকের বাড়ি জন মজুর খাটা- এইসব নিয়ে জীবন কাটাতে হবে না। তুই মায়ের কথা শুনলি না বাবা! বুঝেছি তুই নিজের ভালোর কথা না ভেবে মায়ের কষ্টের কথা ভেবেছিস। মায়ের এত কষ্ট তোর সহ্য হচ্ছে না। বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত যে মা ঘর থেকে বার হয়নি, সেই মা এখন লোকের বাড়ি ঝি-জন খাটছে সেটা তুই মেনে নিতে পারছিস না। কিন্তু বাবা-মায়ের তো এটা কর্তব্য বাবা, সন্তানদের মানুষ করা? সেই দায়িত্ব-কর্তব্য বাবা যখন বেঁচে নেই তখন মা’কে তো করতেই হবে। এটাই তো ভবিতব্য। আমি তো সেটাই করতে চেয়েছি বাবা! তাছাড়া তোর জীবনের জন্যে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত, তুই নিয়ে ফেললি, মা’কে জানাবার বোধ মনে জাগল না! জানি, তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস, একথা মা’কে বললে মা বাধা দেবে। তাই বলে তুই মা’কে জানাবি না! ঠিক আছে। মা’কে যেমন জানাসনি তেমন মা-ও তোর কাছে জানতে চাইবে না। যতক্ষণ না তুই মুখ ফুটে মা’কে বলছিস ততক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে খাপটি মেরে মা থাকবে তোর মুখ ফোটার অপেক্ষায়। আগ বাড়িয়ে জেনেও বা কি লাভ। এখন বাধা দিয়েও তো কোন কাজ হবে না। যা সিদ্ধান্ত তো তুই নিয়েই ফেলেছিস। আর পিছিয়ে আসার কোন রাস্তা নেই।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে অখিল। মোহন গোড়ে যা টাকা দেবে বলেছিল তার থেকে একটু বেশি টাকা দিয়েছে। ওর কাজে খুশি হয়েই দিয়েছে। মাইনেটা দেবার সময় একথা তাকে বলেছে। অখিলও মনে মনে আনন্দ পেয়েছে, তার কাজের জন্যে সে পুরস্কৃত হয়েছে। তার জীবনের প্রথম আয়ের টাকার একটা পয়সা সে খরচ করবে না। সবটাই মায়ের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু কি বলে সে মা’কে টাকাটা দেবে? সে তো মায়ের সঙ্গে শঠতা করেছে। মা’কে না জানিয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগেছে পয়সা রোজগারের জন্যে। সংসারের একটু সুসার হবার জন্যে। মায়ের হাড়ভাঙা কষ্ট লাঘব করার জন্যে। মা’কে বলবে, আর তোমাকে লোকের বাড়ি ঝি খাটতে যেতে হবে না, মা। আমার বড়ই শরমে লাগে। এখন আমি রোজগার করছি আর তুমি টুকটাক কিছু করলে দু’জনের চলে যাবে। পরে আরও বেশি আয় করতে পারলে তখন তোমাকে বাড়ির বাইরে রোজগারের জন্যে বেরোতে দেব না আমি। তুমি দেখে নিও মা, আমি একদিন তোমার সংসারে আলো ফুটিয়ে তুলবই। সেই জেদ এখন অখিলের মনে সবমসয় কাজ করে চলে।

[চব্বিশ]

স্টেশনের সেই লোকটার কথামত মেপে মেপে এগিয়ে সনাতনরা দুটো চা দোকানের মাঝের ফাঁকটায় কালো পলিথিন পর্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা ইতস্তত করে পর্দা সরিয়ে সটান ভেতরে চলে যাবে, না এই চা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করবে? কি করবে ঠিক করতে পারছিল না। ওদের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে দোকানদার বলল, “কি ব্যাপার, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন, কোথায় যাবেন? ওদিকে কিছু নেই। এদিকে আসুন। এদিকে আসুন। চা খাবেন তো দোকানের সামনে দাঁড়ান।” সঙ্গে সঙ্গে রতন দোকানদারটার কথা লুফে নিল, “হ্যাঁ, দিন তো আমাদের দু’কাপ চা আর দুটো করে টোস্ট বিস্কুট। চা-টা একটু কড়া করে বানাবেন।” বলে সে মনে মনে ভাবল,চা খেতে খেতে দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে না হয় ছেনো স্যারের ডেরার কথা জানতে চাইলে ভাল হবে। ভাল মুখে তখন দোকানদারটা তাদের সঙ্গে কথা বলবে। না হলে শুকনো মুখে কে আর ভালো কথা বলতে চায়। ওই শুকনো কথাই ঠিকরে বার হবে। এবার ছেলেকে বলে,“নে বাবা, অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সেই সাত সকালে যা কচুড়ি ঘুঘনি আর চা খেয়েছিলাম। একটু চা বিস্কুট খেয়ে গলা ভেজাই।” চা খেতে খেতে রতন দোকানদারের কানের কাছে মুখটা বাড়িয়ে বলল,“দাদা, ছেনো স্যারের অফিসটা এইদিকে পড়বে? পর্দা সরিয়ে এই গলির ভেতরে না?” দোকানদারটা আরও দুটো খদ্দের ছাড়তে ব্যস্ত তখন। কোন কথা বলল না। রতনদেরও তখন চা খাওয়া শেষ হয়নি। যেই রতনরা চায়ের খুরি রাখার ভাঙা বালতিতে টং করে ছুঁড়ে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে সে ইশারা করে পর্দাটা সরিয়ে হাতছানি দিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একেবারে ছেনোর ডেরার দাবায় তুলে দিয়ে তড়কো পায়ে চলে এল। রতন পেছন ফিরে তাকে দেখতে গিয়ে দেখে সে একেবারে সেই কালো পর্দার কাছে পৌঁছে গেছে। ভাবছিল, লোকটাকে বলবে, ছোনো স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার কথা। তা আর হল না। ভ্যাবাচ্যাকা মেরে দাবায় দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে ভেতর থেকে ছেনোর এক স্যাঙাৎ হাঁক পাড়ল, “কে, কি দরকার? নতুন মুরগি মনে হচ্ছে? বাইরে না, স্যার ভেতরে। ভেতরে এসো। এই যে আমাদের ছেনো স্যার। সিংহাসনে আসীন। কি আর্জি তোমার জানাও। মঞ্জুর হলে, মাল ঠেকাও, নাম্বার নিয়ে কেটে পড়ো। কোন রাখ- রাখ ঢাক-ঢাক ছেনো স্যারের কাছে নেই। সাফ-সাফ কথা ফটাফট কাজ। কাজ শেষ, ফুটে যাও।”
রতনদের সব কথা শুনে ক্ষেপে লাল হাতকাটা ছেনো মস্তান! চোখ পাকিয়ে বলে, “তোমাদের এত বড় সাহস, কোন হাভাতে গাঁ থেকে শহরে এসে আবার আমার অনুমতি পাওয়া পাবলিকের সঙ্গে মারপিট করতে যাও? সত্যিই তোমাদের কপাল ভালো, তারা আমার এখানে এসে কমপ্লেন করেনি। ওরা তো ওর ঠোঁট ফাটিয়েছে। আমার লোক গেলে তো হাত পা গুঁড়ো করে হসপিটালের সামনে ফেলে রেখে দিয়ে আসতো। তা এখানে এই প্রথম বুঝি? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। নিয়মকানুন জানে না বলেই লড়াই করার সাহস দেখিয়েছে। প্রথম বছর খাতায় নাম তোলার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। তারপর প্রত্যেক বছর নম্বর নেবার জন্যে দু’হাজার করে দিতে হবে। না হলে পুজোয় এই শিয়ালদা স্টেশনে কারোর বসার আইন নেই। এখানে ছেনোর কথাই আইন। আর ছেনোর কথাই শেষ কথা। কোন পুলিশের বাপের সাহস নেই এখানে নাক গলায়। পুলিশের বাবার সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থা করা আছে। এই টাকা আমরা একা খাই না। ধাপে ধাপে নীচ থেকে মাথা পর্যন্ত সকলকে হিস্সা ঠেকিয়ে আমাদের খেতে হয়। তাই খরচা একটু বেশি পড়ে যায়। কিন্তু এতে আমাদের কিছু করার নেই।”
হাতকাটা ছেনো মস্তানের কথায় বোবা মেরে যায় রতন। বড় বড় চোখে অবাক হয়ে ছেনোর দিকে তাকিয়ে থাকে সনাতন! মনে মনে ভাবে, এরা মানুষ, না মানুষের পোষাকে একদল অমানুষ বিচরণ করছে। রতনের চোখ টলটলে জলে ভরে যায়, “বাবু আমি কোথায় পাবো অত টাকা! ওই টাকা যদি আমার থাকবে তো এত কষ্ট করে এখানে আসবো কেন দু’পায়সা রোজগার করতে? আমাদের বাপ ছেলেকে কেটে ফেললেও দু’হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। তার থেকে আবার আজকের পথ খরচ আর চা জলখাবার খেতে কিছু খরচ হয়ে গেছে। জানা ছিল না। তাহলে হয়তো ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে এখানে আসতাম। এবারটা মাপ করে দিন, স্যার। কথা দিচ্ছি, সামনের সালে এসে বাকি টাকা সমেত সবটাই মিটিয়ে দেব। বায়না না পাওয়া পর্যন্ত খাইদাই ইত্যাদির খরচা আছে। সেটুকু বাদ দিয়ে যা আছে তা না হয় দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে একটা নম্বর দিন স্যার। সেই সকাল সাতটা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে। কাজের কাজ কিছুই করতে পারলাম না। আপনি যদি দয়া করেন তো!”
রতনের কথা থামিয়ে আরও কড়া সুরে ছেনো বলে,“সব শালা শুয়োরের বাচ্চা প্রথম এসে এমন কাঁদুনি গায়। আগে ওই কাঁদুনিতে গলে গিয়ে অনেক ঠকেছি। আর না। শালা মাগির পো’রা বড় পার্টি ধরে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে পরের বছর আর এ চত্বর মাড়ায় না। সরাসরি সেই প্যান্ডেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফায়দা খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আঙুল চুষছি। কোন প্যান্ডেলে কে যাচ্ছে তা তো আমাদের চৌকি দেওয়া কাজ নয়। এটা আমার এলাকা আমার কথাই শেষ কথা। অন্য এলাকায় আমার খবরদারি চলবে কেন। ঝাড় খেয়ে যেতে হবে না? অতএব যা হবে পাকাপাকি হবে। নগদানগদি হবে। ধারবাকির খপ্পরে আর ছেনো পড়ে না। তুমি বুড়ো, এই শর্তে যদি রাজি থাকো মাল ফেল, নাম্বার নাও। না তো এক্ষুণি কেটে পড়ো। সামনের বছর মাল জোগাড় করে আসবে নম্বর পাবে। নিয়ম তো এখন জেনে গেলে। অপেক্ষা করো একটা বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। বেশিরভাগ ধূর পার্টি তাই করে। তোমরাও করবে। যাও, ফোটো। আমার অনেক কাজ আছে। তোমার সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করলে আমার চলবে না।”
হাতকাটা ছেনোর ডেরায় দরকষাকষি করতে করতে কখন সন্ধ্যা নেবে গেছে বুঝতে পারেনি রতন। বাইরে বেরিয়ে দেখে দিনমান গ্রাস করে নিয়েছে কোলকাতার বিজলি আলোগুলো। এখন ওরা কোথায় যাবে? আর তো বাড়ি ফেরার উপায় নেই। রাতটা এখানে কোথাও পার করতে হবে। রতনের মনে হল, ওই নম্বারওলা ঢাকিরা তো বাড়ি যাবে না। এখানে কোথাও থাকবে। দূর থেকে তক্কে থাকবে কোথায় ওরা রাত কাটায়। হাতকাটা ছেনোর থেকে নম্বর নিয়েছে নিজেদের বিকানোর জন্যে। রাত কাটাকানোর জন্যে আবার কোন ছেনো মস্তানের দয়ার খপ্পরে পড়তে হবে কি না কে জানে! স্টেশনের ওদিকে গিয়ে দেখল, এলাকা আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। যত রাত বাড়ছে স্টেশনের ভেতর চত্বরে সাধারণ যাত্রীর ভিড় পাতলা হচ্ছে। সেই পাতলা হওয়া স্টেশনের মেঝে চলে যাচ্ছে এলাকার যত ঠাঁইহীনদের দখলে। ঢাকি ঢোলিদের মিছিলও সেদিকে ধেয়ে চলেছে। রতন বলল,“চল সনাতন আগে স্টেশনের মেঝেয় আমরা সকালের মত দখল করি। তারপর দেখা যাক কি হয় না হয়। মনে হয় এখানে ছেনোর কারসাজি নেই। কেননা এখানে তাদের জাতের লোক ছাড়াও অন্য জাতের লোকের ভিড় কম নয়। এই স্টেশনের ছাউনি কত নিরাশ্রয় মানুষের রাতের আশ্রয়স্থল। ভিখিরি ভবঘুরে পাগল-ছাগল চোর-ছিনতাইবাজ, ফেরেপবাজ- সব জাতের মানুষ এই আশ্রয়স্থলে এসে একাকার হয়ে যায় যেন।
টিকিট ক্ষেত্রের বাইরে, যেখানে টিকিট কাউন্টার, টী-স্টল ইত্যাদি আছে তার বিশাল দৈত্যাকার ছাদের তলায় একটা চওড়া পিলারকে ঠেকনা নিয়ে বসে রতনরা। ওদের আগে আরও অনেকে ইতিমধ্যে জায়গা দখল করে বসে গেছে। রাত তখন দশটা। খিদেতে পেটটা মোচড় দিচ্ছে। ওর খিদে লেগেছে মানে ছেলেটারও তো তাই হবার কথা। উঠতি কাঁচা বয়সের ছেলে। ওদের খিদে আরও বেশি হবার কথা। কিন্তু এমন ছেলে, কোন সময় মুখফুটে বলবে না যে তার খিদে পেয়েছে। অথচ খেতে দিলে না করবে না। গোগ্রাসে খেয়ে নেবে। আসলে ও চায় না ওর কারণে ওর বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ুক। চাহিদাকে ঘাড় মুড়ে দমিয়ে রাখতে ওস্তাদ ছেলেটা! রতন বলল, “খোকা, আমি এখানে এগুলো পাহারা দিচ্ছি। এই নে পয়সা। তুই এক ছুটে গিয়ে দু’জনের জন্যে ওই সামনের দোকান থেকে তড়কা-রুটি নিয়ে চলে আয়। দেরি করবি না। তাহলে আমি আবার চিন্তায় পড়ে যাব। বিদেশ বিভুঁইয়ে পদে পদে বিপদ মুখিয়ে আছে হামলে পড়ার জন্যে। যা, যাবি আর আসবি। আর একটা জলের বোতল নিস।” একটু থেমে আবার বলে,“না, থাক। ওই জলের ট্যাপ দেখা যাচ্ছে। জলের কাজটা ওখান থেকেই সেরে নেব। আলতু ফালতু পয়সা খরচ করলে হবে না। অসময়ের জন্যে টাকা সাশ্রয় করে রাখা দরকার।”
রাত সাড়ে বারোটা। চোখে ঘুম নেই। আতঙ্ক যদি প্রতি মুহূর্তকে গ্রাস করে রাখে তো ঘুম আসবে কেমন করে ! একটা মেল ট্রেন বিকট একটা ভোঁ-ও দিয়ে ন’নাম্বার স্টেশনে এসে থামলো। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে স্টেশন চত্বরের এই বিশাল অংশ দখল করে রাখা রাতের আশ্রিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ! কাঁইমাই, হই হই, বাবা গো মেরো না উঠে যাচ্ছি বলে সমবেত একটা শব্দঝড় গোটা এলাকাকে ত্রস্ত করে তুলল। কাঁচা ঘুমভাঙা মানুষরা যে যার মত তল্পিতল্পা নিয়ে স্টেশনের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় এসে জড়ো হতে থাকে। তখনও পুলিশ তাদের দিকে আসেনি। আতঙ্কতাড়িত রতনরাও তখন ত্রাহি ত্রাহি রবে ছুটে বেরিয়ে পড়ে। দূর থেকে দেখে তাদের ওদিকে পুলিশ গেল না। যারা নিত্যদিনের আশ্রিত তারা কিন্তু ওই এলাকা থেকে উঠল না। ওরা এসবে অভিজ্ঞ। পুলিশ কোন দিক থেকে কতটা রাস্তা ফাঁকা করবে তা তাদের জানা। ওই ফাঁকা করা জায়গা মেল ট্রেনের যাত্রীদের যাওয়া আসার রাস্তা করে দেওয়া হল। রেল কোম্পানীর কাছে এই আশ্রয় নেওয়া বিনি পয়সার লোকেদের থেকে পয়সা দিয়ে আসা যাত্রীদের স্বচ্ছন্দটার দেখভাল করা জরুরী। তাই এই ব্যবস্থা। আনকোরা রতনদের তা অজানা। তাই তারা পলিয়ে যায়। আধ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এলে রতন ফিরে আসে। কিন্তু অচিরেই যে তাদের ছেড়ে আসা শূন্য জায়গা বেদখল হয়ে যাবে তা তারা ভাবেনি। এটাই যে পাবলিক প্লেসের আদত, তা তারা জানবে কেমন করে! জায়গাটা তাদের কাছে বেশ নিরাপদ আর স্বস্তিদায়ক ছিল। কিন্তু উপায় আর কই। বাধ্য হয়ে অন্যদের মত সেই পুলিশে খালি করে দেওয়া জায়গার আপাত নিরাপদ এক পিলারের কোণ তারা নির্দিষ্ট করে থিতু হয়। বেঁজির মত মুখ উঁচু করে মাঝে মাঝে দূরে প্লাটফর্মের দিকে তাকায় আর বসে থাকে। যদি আবার মেলগাড়ী ঢোকে তো পুলিশের তাড়া খাওয়ার আগেই পালাতে হবে। গড়িমসি করলেই পুলিশের রুলের ঘা, খাবারের মেনুর মত হজম করে নিতে হবে। জেনেবুঝে রতন তা করতে যাবে কেন? প্লাটফর্মের বড় ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো পাঁচে এসে টিক করল। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটা মেয়ের চিৎকার, হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে এল ওদের এদিকে! এদিকে টপকে আরও ওইদিকে। ওইদিকের লোকেরাও বেঁজির মত মাথা উচিঁয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলল চিৎকারের উৎস খোঁজে! রতন বলল,“ওই দেখ খোকা, ওদিকে একটা মেয়ে কেমন অসহায়ের মত চিৎকার করে যাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও বলে। নিশ্চয়ই ওর কোন বিপদ হয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গে একদল লোকের সমবেত হইচই শুরু হয়ে গেল। সনাতন বাপকে কিছু না বলে দৌড় দিল ওইদিকে। রতনের ‘খোকা-খোকা’ চিৎকারে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! রতন পড়েছে মহা ফাঁপরে। এত মালপত্র ফেলে ও যেতেও পারছে না ছেলেকে সামলাবার জন্যে। এইসব আপাত শান্ত চরিত্রের ছেলেদের নিয়ে বাপ-মায়ের যেন বিড়ম্বনার শেষ নেই। হঠাৎ কি দেখল না দেখল, মাথায় এমন পোকা কিলবিল করে উঠল যে তার বাড় সামলানো দায় ! তার এই উৎকন্ঠা অবশ্য বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখতে দেয়নি সনাতন। একটু পরেই ফিরে আসে, “জানো বাবা, কি বিচ্ছিরি অবস্থা! একটা কম বয়সী ভবঘুরে মেয়ের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর একটা ভবঘুরে। মেয়েটা তাকে চায় না আর সে বেপরোয়া। পুলিশ এসে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যায়।” সনাতন বাপকে গপ্প শুনিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলে কি হবে, রতনের রাগ কিন্তু কমে না,“তুই হুট করে আমাকে কিছু না বলে ওদিকে ছুট মারলি? মনে হচ্ছে যেন এইসব পরিবেশ পরিস্থিতির সবটাই তোর জানা? আমার নিষেধকে পাত্তাই দিলি না? যদি অঘটন কিছু ঘটে যায় তখন আমি পারবো সামলাতে? এইভাবে আমার কথা না শুনে এদিক ওদিক চলে যাস না। তোকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয়। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মায়ের কাছে কি কৈফিয়ৎ দেব? আমিও যে জীবনযুদ্ধে হেরে ভূত হয়ে যাবো।”
-ভুল হয়ে গেছে বাবা। আর এমন হবে না। তুমি দুঃখ পেও না। যা করব, তোমার পরামর্শ নিয়েই করব।
তাদের কাছাকাছি, একটু তফাতে। হঠাৎ একটা লোক উঠে পড়ে চোর চোর বলে একজনকে তাড়া করে ছুটছে, “আমার ব্যাগ ফেরত দে, ফেরত দে বলছি। না হলে তোর কপালে বহুৎ কষ্ট আছে !” অবস্থা বেগতিক দেখে চোরটা লোকটার ব্যাগ ফেলে ছুট মারে। আশেপাশে যত লোক ঘুমিয়ে বা শুয়ে ছিল সবাই তঠস্থ হয়ে উঠে বসে পড়ল। সনাতন বলল,“বাবা এখন বুঝতে পারছি, কেন তুমি সবসময় আমাদের ব্যাগ-প্যাঁটরা সামলে রাখতে বলো। এখন তো তাই দেখলাম। একটু অসতর্ক হলেই আমাদের জিনিস আর আমাদের থাকবে না। চোর ছিনতাইবাজদের দখলে চলে যাবে। কি আজব এইসব জায়গা! এখানে ভাগ্য বিড়ম্বনায় না এসে পড়লে জানাই হতো না এমন পৃথিবীর কথা ! এরকম আরও কত অজানা পৃথিবী আমাদের দেখতে হবে কে জানে!”
সারা রাত তো রতন-সনাতন দু’বাপবেটা দু’চোখ বুজিয়ে শরীরকে থিতু করতে পারল না। বড় ঘড়িতে চোখ পড়তে সনাতন দেখে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে তিনটে থেকে হেলিয়ে তিনটে পঁয়ত্রিশের দিকে এগোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবাকে বলল,“বাবা একটু পরেই আজকের সূর্য জন্ম নেবে। আমাদের তো তৈরী হতে হবে। কখন পুলিশ তাড়া করবে জানি না। এইবেলা আমি দেখে আসব, কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে? ভোররাতে সবাই ঘুমে মশগুল। এখন কোথাও ঠোক্কর না খেয়ে সবটা ঘুরেঘারে দেখে নেওয়া যাবে।” ঠিক সেইসময় সেই পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের ওপ্রান্ত থেকে একটা সুরেলা মেয়েলী কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে,“আমার রাত পোহালো …!” ধীরে ধীরে সুরটা মনে হচ্ছে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। থমকে গেল সনাতন। আহা, কি অপূর্ব কন্ঠ! দু-পা এগিয়ে দেখতে গেল কে গানটা গাইছে! সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা পেছন থেকে তার জামা টেনে ধরে বলল, “এগিয়ে গিয়ে দেখার কি আছে। ও তো এদিকেই আসছে। বস এখানে চুপচাপ!” বলে রতন নিজেও বসল এবং ছেলেকেও টেনে বসিয়ে দিল। এখন গোটা এলাকা শান্ত নিশ্চল। মনে হচ্ছে যেন চরাচর মোহিত হয়ে রয়েছে এই সুরসাগরে অবগাহন করে। একটা শতচ্ছিন্ন মলিন বেশের মেয়ে। সবাই তো একে পাগল বলবে। কিন্তু এ কি সত্যিই পাগল? পাগল আবার এত নিখুঁতভাবে গান গাইতে পারে নাকি! হয়তো পারে। তাই হয়তো এত অনিয়ম অনাচারের মলিনতার উপর এই সুর, শুদ্ধতার প্রলেপ দিয়ে চরাচরে সমতার বার্তা দিয়ে যায়। সনাতন বলে, “এবার যাই বাবা। দেখে আসি কোথায় বাথরুম পায়খানা আছে। এগুলো সেরে একেবারে আমরা এখানে থেকে বেরিয়ে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে ওর মন ভেতর থেকে তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “কোথায় যাব আমরা?” তা তো তার জানা নেই ! তবে সে এটা নিশ্চিত করেছে যে এখান থেকে বেরিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না। লড়াই তো তার শেষ হয়নি। লড়াইয়ের ময়দান এখনো তাদের জন্যে উন্মুক্ত আছে। হারা বা জেতা, দুটোর কোনটা না দেখে তো তার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ফিরবে না।
পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বাথরুমের কাজ সেরে চানঘরে চানটান করে রতন সনাতন বেরিয়ে পড়ে শিয়ালদা স্টেশন থেকে। বড় ঘড়িতে তখন সকাল পাঁচটা। প্লাটফর্মের বাইরে বিশাল বিশাল সিঁড়ি নেমে গেছে সামনের বিশাল চাতালে পা দেবার জন্যে। যেখানে গতকাল সারাদিন তারা নিজেদের জায়গা
করে নেবার জন্যে লড়াই করে ব্যর্থ হয়। সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে খানিক ডানদিক সরে নিরাপদ ধাপে এসে ওদের ঢাক-ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে বসে সনাতনরা। সিঁড়ির এই জায়গা দিয়ে যাতে বাধাহীন ওঠানামা করা যায় সেদিকটা খেয়াল রেখে মালপত্র রাখে ওরা। টিকিট কাউন্টারের ঘর, অনুসন্ধান অফিসঘর এই ধাপের সোজাসুজি। ফলে মানুষের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এখান দিয়ে নামার উপায় নেই। এখানে বসলে কাউকে নামা ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে হয় না। ফলে অকেজো সব্বাই এখানে এসে বসে অক্লেশে সময়কে গিলে খেতে পারে। আরও প্রায় ঘন্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রতন বলল,“চল খোকা, এবার একটু চা জলখাবার খেয়ে নেওয়া যাক। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওদিকের চা-কচুরির দোকান খুলে গেছে।” বাবার কথামত সনাতন প্রস্তুত হচ্ছিল গোছগাছ করে সব জিনিসপত্র নিয়ে নেবার জন্যে। ঠিক সেইসময় পেছন থেকে একজনের কর্কশ গলার স্বর ঠিকরে এল তাদের দিকে, “ভেবেছিলে তোমাদের আমরা চিনতে পারব না! ছেনো স্যারের দলবল একবার যাকে দেখে, তার থোবড়া দ্বিতীয়বার দেখার দরকার করে না। সেই থোবড়া তাদের খুপরিতে পাকাপাকিভাবে গেঁথে যায়। উবে যাবার উপায় থাকে না। তোরা এখনো এখানে ঘুরঘুর করছিস? কালই তো ছেনো স্যার তোদের এলাকা ছাড়তে বলেছিল। আবার বুঝি জায়গা দখলের ধান্দা করছিস?” রতন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কথা ফোটার আগেই লোকটা বলল, “চোপ শালা! গাওনা গাওয়ার জায়গা পাওনা। এসব বাহানা জেনে বুঝে আমরা পাকা খয়ের হয়ে গেছি। ছেনো স্যার ঠিক বলেছে। বলেছে, আয়-তো একবার এলাকাটা টহল মেরে। কোন শালা পুঁটির বাচ্চা ধান্দা করার ফিকির করছে কি না? স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল! শালা বক-তপস্যির মত ওত পেতে আছিস! কখন সুযোগ পাবো। জায়গা দখল করব, এ্যাঁ? দশ গুনবো। এর মধ্যে এলাকা ছাড়া না হলে বাপ-বেটাকে কেলিয়ে কোমর ভেঙে ডাস্টবিনে ফেলে দেবো। কোন বাপের বেটা তোদের রক্ষা করতে আসবে না। যা শালা!” বলেই আরও গলার স্বর চড়িয়ে এক দুই করে কড় গুনতে শুরু করে লোকটা! আর আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা ছিল তারা ঠায় তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উপভোগ করছে কেমন তৎপরতায় তারা তামতুড়কি নিয়ে সরে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ওরা কত জঘন্য অপরাধে অপরাধী! মরমে যেন মরে যাচ্ছে সনাতন! তারা তো কারোর ক্ষতি করার জন্যে এখানে আসেনি। এখন এখানে বসেও নেই। অথচ কেমনভাবে তীব্র অপমানে বিধ্বস্ত হতে হচ্ছে তাদের। কাদের কাছে? না যারা ঘোষিত সমাজবিরোধী, তাদের কাছে। তার জীবনে এর চেয়ে খারাপ দিন আর আসবে বলে মনে হয় না। তাদের গ্রাম জীবনে অনেক অভাব অনটন আছে। পাশের বাড়ি বা পাড়ার কারোর সঙ্গে খিটিমিটি আছে। পরস্পরের মধ্যে মারামারির ঘটনাও আছে। আবার সমাধানও আছে। দুই বিবাদী পক্ষের মধ্যে মিলমিশেরও বিধান আছে। কিন্তু নিজের চরিত্রের এমন অবদমন সেখানে কোথাও নেই। মনের মধ্যে এমন সব কষ্টের বোঝা বইতে বইতে ওরা শিয়ালদা স্টেশন এলাকা ছেড়ে বাসস্টপের কাছে এসে দাঁড়ায়। বাবা বলেছিল, চা-জলখাবার খাবার কথা। কিন্তু দুর্বিসহ এই পরিস্থিতিতে সেই খাবার ইচ্ছে একদম উধাও হয়ে গেল। বাবাও আর সেকথা মুখে আনছে না। বাবা যেন একদম গুম হয়ে গেছে। মুখে স্বর চলে না। তার চেয়েও মনে হয় আরও বেশি আঘাত পেয়েছে বাবা। পাবেই তো। যে মানুষটা গ্রামে এত সম্মান পায়। অন্যের অন্যায়ের ন্যায্য বিচার দেবার ব্রতে ব্রতী অহরহ। সেই মানুষটাকে সমাজের একজন নিকৃষ্টতম অপরাধী প্রকাশ্য জনসমক্ষে ন্যায়ের বিধান দিয়ে অপমানে ভূতলে মিশিয়ে দেয়! তার মন কেমন করে শক্ত থাকবে। ভেঙে চুরমার তো হবেই।
বাসস্টপে কতক্ষণ ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারল না। বাবা ঢাক কাঁধে আর ও ব্যাগ-প্যাঁটরা কাঁধে। কাঁধ যে টনটন করছে। এবার বাবা বলল, “চল বাপ, বাবুঘাটের বাস ধরি। বাড়ি যাই। আমাদের মত লোকের জন্যে কোলকাতা নয় রে বাপ।” বাবার এই কথাগুলোর মধ্যে যেন মনঃস্তাপের ঝরণা ঝরে পড়ছিল। সনাতন এই ঝরণার জল মাটিতে ফেলতে চায় না। তাতে যে ধরিত্রি মায়ের অকল্যাণ হবে। তাই বাবার মনঃস্তাপ নিজে গলাধ্যকরণ করে বলল, “আমরা বাড়ি যাবো না বাবা। পুজোর এখনো দু’দিন বাকি। বাড়ি যাবার সময় পেরিয়ে যায়নি। চলো, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের দিকে এগোই।”
শিয়ালদহ থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে ওরা কলেজস্ট্রীটের দিকে এগোতে থাকে। এই রাস্তার কোথায় কি আছে তা কিন্তু বাপ-বেটা কারোর জানা নেই। অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে সময়কে ছেড়ে দিয়ে হাঁটা চলতে থাকে। চলতে চলতে সনাতন অন্য কথা ভাবতে থাকে। তারা যদি হেরে গিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ওই শয়তান, অভয়! সনাতন এখন নিশ্চিত, অভয় সবকিছু জেনেবুঝেই তাদের এই গোলকধাঁধার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ও চেয়েছে এরা বিপদে পড়ুক। আর একেবারে নাস্তানাবুদ বিপর্যস্ত হয়ে গ্রামে ফিরে আসুক। অভয়ের এই দুর্বুদ্ধির কারণও এখন সনাতনের কাছে পরিস্কার। বাবা অতটা তলিয়ে হয়তো দেখছে না। তাই এই ভাবনা বাবার মধ্যে হয়তো কাজ করছে না। পাড়ার আটচালার বিচারক দলে তার বাবা। বরং বলা যায় বিচার-কর্তা। বিচারকদের অনেকে অনেক মন্তব্য করে আলোচনার সময়। কিন্তু বাবার কথাই শেষপর্যন্ত সেখানে সাব্যস্ত হয়। বিচারের ফল তো যে পক্ষে যাবে সে বা তারা খুশি হবে। আর বিপক্ষের লোক অখুশি তো হবেই। এই অখুশির লোকগুলোর কাছে বিচারকরা নিশ্চয়ই আদর পাবে না। মনে মনে তাদের উপর রাগ পোষণ করে থাকবে। এমন কোন বিচারে অভয়রা নিশ্চয়ই হারের দলে কোনসময় পড়েছে। সুযোগ বুঝে ও বিচারক কর্তা, রতন রুইদাসকে ফাঁপরে ফেলতে এমন ফন্দি এঁটেছে। সনাতনের এই ভাবনা অন্যথা হবার নয়। কিন্তু ও কিছুতেই অভয়ের কাছে তার বাবার মাথা নীচু করতে দেবে না। এক অর্থে হয়তো অভয় সাফল্য পেয়েছে তাদের এই অপদস্ত হওয়ার ঘটনায়। কিন্তু তা তো সে জানতে পারেনি। অসময়ে বাড়ি ফিরলে তখন সে নিশ্চিত হয়ে যাবে, তার চাতুরি কাজ দিয়েছে। কিন্তু তারা তো কারোর কোনদিন ক্ষতি করেনি এবং বাবা কোনদিন অন্যায় কোন কাজ করেনি। মা শীতলা এই অসময়ে নিশ্চয়ই তাদের পক্ষে থাকবে। এ’ব্যাপারে সনাতনের বিশ্বাস অটুট। হার মানার জন্যে সে লড়াইয়ের ময়দানে নামেনি। সাফল্যের মুখ তাকে দেখতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা চারমাথার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করে বাঁদিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে চলল। সাইনবোর্ড দেখে ওর মন পুলকে ভরে উঠল। কলেজস্ট্রীট এটা! এখানে তাহলে যাবতীয় বই পাওয়া যায়! বাঃ কি মজা। এই নামটা কতবার তার স্বপ্নে ঘোরাফেরা করেছে। তার সব পড়ার বই, গল্পের বই, বড়বড় সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাসের বই- সব, সব এখানে মেলে। যা বই চাইবে সব পাবে। যদি কোনদিন বড় হয় তো সে এখানে আসবেই। রোজগার করে প্রাণ খুলে মনের মত বই কিনবে। একটু এগোতেই ডানদিকে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ! তারপর হেয়ার স্কুল! এই সবকটাই সে ইতিহাসের বইয়ে পড়েছে। আর সেই সাধনার ধন তার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে! হেয়ার স্কুলের গা ধরেই আবার কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। ইতিহাসখ্যাত এই হাসপাতালে কত মানুষ গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসে চিকিৎসা করাতে। বাবাকে দেখিয়ে বলল, “দেখো বাবা। এটা মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল। মানুষের বড় কোন অসুখ হলে এখানে সামান্য খরচে বা বিনা পয়সায় ভর্তি হওয়া যায়। গরিব মানুষরা সব এখানে আসে অসুখ সারাতে।
একটা বড় মোড়ে এসে দাঁড়ালো ওরা। কোথাও লেখা বউবাজার মোড়, কোথাও বি.বি.গাঙ্গুলী স্ট্রীট ! জায়গাটা একটু প্রশস্ত মত। সামনের দিকে একটু দূরে একটা পুজোর প্যান্ডেল। রতন বলল, “বাবা, খিদে পেয়েছে। অনেকটা পথ হেঁটে শরীর আনচান করছে। চলো না, ওই দিকটায় যাই। ওখানে ফুটপাথে লুচি ভাজা হচ্ছে। লুচি-চা একটু খেয়ে নিই।” রতন এখন ছেলের ইচ্ছেকে সম্বল করে মন্ত্রপুতের মত পথ চলছে। তেমন কিছু কথা না বলে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। টিফিন সেরে আবার সেই চারমাথার মোড়ের প্রশস্ত জায়গার একটা নিরাপদ কোনমোচড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোঁটলার ভেতর থেকে মলিন জলের বোতলটা বার করে দু’জনেই ঢকঢক করে জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়ে ছাতিকে শান্ত করল। সনাতন বলল,“বাবা, ঢাকের কাঠি বার করো। এখানে আমরা ঢাক বাজাবো। তোমার সেরা বাজনা এখানে তুমি বাজাবে। সেই তালে সঙ্গত দিয়ে আমি কাঁশিতে তাল মেলাবো। প্রথমে আগমনির তালে তাল ঠুকবে। মা দূর্গার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে হবে সেই তাল ঠোকা। আমাদের থামা চলবে না বাবা। কখন আমরা থামব তা আমরা নিজেরা আগে থেকে বলতে পারব না। আমরা যে জাত ঢাকি তা এলাকার মানুষকে বুজিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ এটাও ঠিক, শহর কোলকাতার কত মানুষ। কত ধরণের মনের চলাচল তাদের। অনেকে হয়তো বিরক্তও হবে। আবার যারা বোঝার তারা নিশ্চয়ই বুঝবে। বুঝলেই কদর করবে।
কতক্ষণ যে তারা এই ঢাক বাজিয়ে চলেছে তার হিসেব নেই। কেননা তাদের কাছে তো কোন ঘড়ি নেই। কাঁসর বাজাতে বাজাতে সনাতনের আঙুলে ফোসকা পড়ে তা আবার গেলে গিয়ে জ্বালা করতে শুরু করেছে। তবু সে থামার পাত্র নয়। একটা আঙুলের গলাসি দমে যায় তো আর একটা। তারপর আর একটা। একটার পর একটা তার অঙ্গ হার মানলেও মনকে কিছুতেই হারতে দিতে চায় না সে। বাবা তো পেশাদার মানুষ। সে জানে সারাদিন বাজাতে বললে বাবা না থেমেই বাজিয়ে যাবে। কিন্তু সে তো একদম আনকোরা। সবে বাবার কাছে কাঁসরের তালজ্ঞান শিখেছে। ঢাকের তালও শিখছে। পুরো শেখা শিখে উঠতে পারেনি। আরও সময় লাগবে।
একটা সময় হঠাৎ সাদা ধপধপে ট্রাউজার পাঞ্জাবী পরা তিনজন বাবুলোক পাশ থেকে এসে তাদের ঘিরে ধরে! সনাতনরা তো সাধনার নিষ্ঠায় নিজেদের তাল লয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। সামনে এসে কেউ দাঁড়ালে হয়তো তাদের দৃষ্টিগোচর হত। কিন্তু পাশ দিয়ে এসে অকস্মাৎ এমনভাবে দাঁড়াল, সনাতনরা দু’জনেই চমকে ওঠে! থেমে যায় তাদের বাজনা। একজন বাবু
বলল,“ঠিক আছে থামো থামো। অনেকক্ষণ ধরে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। এবার একটু জিরোও। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সেই বেলা ন’টা থেকে তোমরা ঢাক বাজাচ্ছো। আমরা লক্ষ্য করছি। এতক্ষণ টানা কেউ ঢাক বাজাতে পারে তা তো আমাদের জানা ছিল না। তারপর ঢাকের তাল যে এত সুরেলা এবং স্যুদিং হতে পারে তাও তো আমাদের কল্পনার বাইরে। আমরা তো জানি ঢাক মানে শুধু ধ্যান তারাক্কা নাচের বাজনা আর আরতির বাজনা। এ
বাজনা কিসের বাজনা?” বাবুর প্রশ্নের উত্তরে রতন বিনয়ের সঙ্গে বলল,“বাবু এটা আগমনির বাজনা। মা দশভূজার আগমনকে স্বাগত জানাতে এই প্রার্থনার তাল। একমাত্র মা মর্ত্যে আসার মুহূর্তে এই বাজনা বাজানো যায়। অন্যসময় কেউ বাজায় না। যারা এই তাল বাজাতে জানে, এই ব্যাপারে তারা সতর্ক। যখন তখন বাজাবে না। এই সময়টা তো সবায়ের হয়ে ওঠে না। ঢাকিরাও সবসময় মুডে থাকে না। তাই হয়তো আপনাদের শোনা হয়ে ওঠেনি।” আর এক বাবু বলল,“তা তোমরা হঠাৎ এখানে ফুটে দাঁড়িয়ে বাজাতে এলে কেন? এখানে তো কেউ কোনদিন এভাবে ঢাক বাজাতে আসে না? আমাদের ওই হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গা পূজা এই বছর পঁচাত্তরে পড়ল। আবাল্য আমরা কোনদিন তো দেখিনি, আমাদের আগের সিনিয়ররাও কেউ কোনদিন এখানে এভাবে বাজনা বাজাতে দেখেছে বলে মনে হয় না। আমরা তো তৈরী হচ্ছিলাম শিয়ালদা স্টেশনের ঢাকের ঠেকে যাবো বলে। ওখান থেকেই বরাবর আমরা ঢাকি বায়না করে আনি। তা তোমরা কোথা থেকে আসছো?”
-আমরা বাবু সেই ফলতা থানা এলাকা থেকে আসছি। এখানে এসে এই ফুটপাথে ঢাক বাজাবার জন্যে সেই সুদূর গাঁ থেকে আসিনি। এসেছিলাম আপনারা যেখান থেকে ঢাক বায়না করেন সেখানে। বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে রতনের। আর বলতে পারল না সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সনাতন শিয়ালদায় তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কান্ডগুলো সবিস্তারে বলতে, বাবুরা অবাক!
এক বাবু বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “ওখানে এই গরিবগুর্বো মানুষদের নিয়ে সমাজবিরোধীরা এইভাবে নোংরামো করে? ঠিকই তো, এদের সঙ্গে পুলিশের এক শ্রেণীর অসাধু লোক যুক্ত না থাকলে এভাবে এরা ফুলেফেঁপে উঠতে পারে না। অথচ দেখো, আমরা প্রত্যেক বছর যাচ্ছি ঢাক-ঢোল বায়না করছি, পুজো করছি। মনে হচ্ছে যেন সবই কেমন স্বচ্ছ সরলরেখায় বয়ে চলেছে জীবনস্রোত! বাইরের এই স্বচ্ছতার অন্তরালে যে এমন নির্মম অস্বচ্ছ কালো আর এক বিবর্ণ স্রোত বয়ে চলেছে তা ক’জনেরই বা নজর কাড়ে। এরা এইভাবে এখানে এসে না পড়লে তো সমাজের এই মলিন দিকটা আমাদের জানা হয়ে উঠতো না।” এই বাবুর বলা শেষে প্রথম বাবু বলল,“তা তোমরা কি আমাদের হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের পুজোর বাজনা বাজানোর বায়না নেবে? যদি নাও তো বলো। তোমাদেরকেই এ বছর আমরা নিয়ে যাব। শিয়ালদাতে যাব না।”
-আমরা তো বাবু বায়না পাবার জন্যেই মায়ের সাধনা করে চলেছিলাম। তা, মা আমাদের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে সাড়া দিয়েছে। আপনারা তো বাবু মায়ের
মাধ্যম হয়ে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। মায়ের আদেশ ফিরিয়ে দেবার স্পর্ধা আমাদের নেই বাবু।
-তুমি তো বেশ ভাল কথা বলতে পারো হে! পেটে কিছু না থাকলে এই জ্ঞান জন্মায় না। যাই হোক, তাহলে আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক। আমরা পাঁচদিনের জন্যে তোমাদের পাঁচ হাজার টাকা দেবো। ষষ্ঠী থেকে দশমী। আজকের পঞ্চমী। আজকের দিনের জন্যে তোমাদের কোন টাকা পয়সা দেবার অনুমতি আমাদের নেই। আর আমাদের দর্শক এবং পাড়ার অধিবাসীদের যদি তোমরা তোমাদের হাতযশে মাতিয়ে দিতে পারো তো যথেষ্ট পরিমান বকশিশ পড়েই রইল তোমাদের জন্যে। ওটা তোমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব পাওনা। ওখানে কেউ ভাগ বসাতে যাবে না। তবে আজকের থাকা খাওয়াটা তোমরা আমাদের থেকে পাবে। কোন অসুবিধা হবে না। আর পারলে সন্ধ্যের দিকে একটু আগমনির বাজনা শুনিয়ো আমাদের পাড়ার মানুষজনের। মনে হচ্ছে তোমাদের হাত ধরে আমাদের এবারের পুজো ভালই হবে। এবার কাজের জায়গায় তোমাদের দক্ষতা দেখতে চাই।

[ পঁচিশ ]

সময়ের সঙ্গে সখ্যতা করতে করতে জীবনযুদ্ধে দাঁড় টেনে অখিলও এগিয়ে চলেছে। মায়ের পুরোপুরি হাতেধরা হয়ে গেছে ও। আর মা’কে লোকের বাড়ি কাজে যেতে দেয় না। ওর হাত ধরে মোহন গোড়ের ব্যবসা এখন রমরমা। মোহন গোড়ে, ওর কারবার পরিচালনায় অনেকটাই অখিলের ওপর নির্ভর করে। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন মোহন বলল,“অখিল তুই এক কাজ কর। কতদিন আর আমার কারবারের মুখের দিকে চেয়ে তুই দিন কাটাবি। আমারও তো বয়স হচ্ছে। আমার সঙ্গে তুইও নতুন একটা ব্যবসা খুলে বস। আমার, তোর- দুটো কারবার দেখভাল কর। তাহলে আমরা দু’জনেই দুই কারবারের মালিক হবো। অথচ দু’জনে একসাথে কাজ করবো। বুঝতে পারলি না তো আমার কথা? শোন তবে তোকে খুলে বলি। আমার কারখানার বাইরে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে বসে যে মেয়েরা শোলার কাজ করতে পারে তা তো আমার বুদ্ধিতে জন্মায়নি। আমরা শোলা তাদের ঘরে ঘরে বিনে পয়সায় সাপ্লাই দিয়ে আসি আর মেয়েরা বাড়িতে বসে ড্রয়ইং মত কাজ করে। যেমন কাজ তেমন মজুরী পায় তারা। সবটাই তোর মাথার ওই খুপরির কেরামতি। তোর জন্যেই আমার কারবারের এই বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু আমি আর এতবড় কারবার সামলাতে পারছি না। বুড়ো হয়েছি। কবে হঠাৎ যদি টপকে যাই ! তখন এত লোক সব জলে পড়ে হাবুডুবু খাবে। তাই বলি সময় থাকতে কারখানার বাইরের এই কারবারটা তুই স্বাধীনভাবে দেখাশোনা কর। কারবারের এই অংশের মালিক তুই হয়ে যা। আমি তোকে লিখে দিচ্ছি। বড়বাজার থেকে আমার সঙ্গে তোরও শোলা আসবে। তুই তোরটা নিয়ে বাড়িতে গুদাম করবি। সেখান থেকে কারিগর দিয়ে কাজ করে আবার আমার চালানের সঙ্গে না হয় তোর মালটাও যাবে। পরে আস্তে আস্তে তুই নিজে চালান করে মাল ডেলিভারী করবি।”
মোহন গোড়ের এই সিদ্ধান্ত অখিলের ভাগ্যের চলন নতুন অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যের চাকা উত্তরোত্তর গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে। নিজের পাড়া টপকে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও বাড়িয়ে দেয় তার কারবারের বিস্তার। বছর দুয়েকের মধ্যে নিজের কারবারের নামে চালান কেটে মাল ডেলিভারীও করতে থাকে। তবে হ্যাঁ, তার কারবারের গুরু, মোহন গোড়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা পূর্ণ মাত্রায় বজায় থাকে। নিজের কারবারের সাথে সাথে গুরুর কারবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা সে কোনদিন ভাবেনি। ভাবলে তার দিক থেকে কোন বাধা ছিল না। বা মোহন গোড়ের কিছু করার ছিল না। কিন্তু সে তা করেনি। করলে গুরুর কারবারটাই বন্ধ হয়ে যেত। ও দুই জগতের একচ্ছত্রপতি মালিক বনে যেতে পারতো। কেননা মোহনের কোন ছেলে নেই। একটা মাত্র মেয়ে। বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেছে তার। বাইরের অজানা লোকেরা জানে অখিলই মোহনের ছেলে। কেননা গুরু লোকের কাছে কথায় কথায় অখিলকে তার ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাতে অবশ্য অখিলের কোন আপত্তি নেই। নিজের সন্তান জ্ঞানেই তো গুরু তাকে কারবার শিখিয়েছে, বড় করেছে। অখিলের মা চপলাও তাকে বলেছে,“যে মানুষটা তোর জীবনের আলো দেখিয়ে এগিয়ে দিয়েছে, তাকে কোনদিন পেছনে ফেলে যাসনি বাবা। তাহলে মহাকাল কোনদিন তোর কোন ক্ষতি করার জন্যে পিছু নেবে না। তুই মসৃণভাবে তোর পথে এগিয়ে যেতে পারবি।”
নিজের প্রচেষ্টায় নিজের রোজগারে দু’কামরা ঘর-বারান্দা নিয়ে অখিলের পাকা বাড়ি। স্বচ্ছলভাবেই মা-ছেলের দিন চলে যায়। পাড়ায়, বাইরের পাড়ায় মেয়েদের ঘরে বসে শোলার কাজ পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে অখিল। রোজগারের একটা পথ পেয়েছে মেয়েরা। অবসর সময় আর তাদের হেলায় কাটিয়ে দিতে হচ্ছে না। সেই পটভূমে পাড়ায় বে-পাড়ায় নারী মহলে এখন অখিলের নামডাক ভালই। একটা রেষারেষি ভাবও আছে এই মহলে, কে কেমনভাবে অখিলের কত কাছের লোক হতে পারে। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে যদি বাড়তি কাজ আদায় করে নিতে পারে। রোজগারটা তাহলে একটু বেশি হয়। অখিল এখন এদের আশা-ভরসার স্থল। তাই যে যার কোলে ঝোল টানার তাগিদেই এই পারস্পরিক প্রচেষ্টা।
মেয়ে মহলের এই আলোড়ন অখিল স্বজ্ঞানেই উপভোগ করে। পছন্দও করে। যত এরা তাকে বিষয় করে চর্চা করবে ততই তার নামডাক পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে। নিয়মের হাত ধরে তার আয়ের রাস্তাও বাড়তে থাকবে। অখিলের এখন আশেপাশের পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত। শোলার গাঁট পাঠানো আবার তা থেকে তৈরী টোপর, ঠাকুরের গয়না ডেলিভারি নিয়ে আসা। হিসেব করে কারিগরদের মজুরি দেওয়া। এতসব কাজ সুষ্ঠভাবে করতে গেলে ছুটোছুটি তো তাকে করতেই হবে। সাইকেল নিয়ে পোঁও পোঁও করে ঘুরে বেড়ানো তার নৈমিত্যিক কাজের মধ্যে পড়ে। অনেক কারিগর আবার কাজ করে দেবার শর্তে আগাম দাদনও নিয়ে নেয়। তবে অখিল তাদের কাছ থেকে সুদটুদ দাবি করে না। সেও তো একদিন এমন অভাবি ছিল। তাই সেই জ্বালার সঙ্গে সে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। কোন্ পরিস্থিতি মানুষকে কোন্ সর্বনাশা পাঁকে চুবিয়ে দেবে তা কেউ বলতে পারে না।
সবে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ির ঘর সংসার সামলাচ্ছে মন্ডল পাড়ায় তার কারিগর, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা। কতদিন হবে বিয়ে, এগারো কি বারো মাস। তার মধ্যে অখিলের সঙ্গে কাজের সুবাদে আলাপ হয়তো মাস ছয়েক। ভীষ্ম, ওই সাইকেল ভ্যান টানে আর চাষের সময় জন খেটে খায়। ভরা শ্রাবণের ধারায় এলাকার পুকুর ঘাট ভরভরন্ত। উঁচু ডাঙা জায়গাগুলো যেটুকু জেগে আছে এই যা। সকাল সাতটায় চাষের কাজে হাজিরা দিতে হবে। ভোর ভোর উঠে তাই রোজই ঘুমচোখ কচলাতে কচলাতে বাঁশঝাড়ে বাহ্যে ফিরতে যায় ভীষ্ম। ভীষ্মর মত পাড়ার অনেক বেটাছেলে যায়। এটাই এইসব গ্রাম পাড়া এলাকার দস্তুর। বাহ্যে বসে হঠাৎ পেছনে ফোঁস ফোঁস শব্দে চমকে ওঠে ভীষ্ম! গ্রামের ছেলে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি কিসের শব্দ ওটা! ধড়ফড়িয়ে উঠে পালাতে গিয়ে কাল কেউটের লেজে পা পড়তেই একটা মোক্ষম ছোবল এসে পড়ে ওর উরুর কাছে! চিৎকার করতে করতে ভীষ্ম পাড়ায় ছুটে আসে। কিন্তু সময়টা তো চরাচর আড়গোড় ভাঙার সময়। এত ভোরে মানুষ ঘুম চটকায় উঠে নিজেকে সামলে নিতে নিতেই সেই ফাঁকে ভোরের সূর্য আরও অনেকটা পথ এগিয়ে যায়। লোক ডাকাডাকি করে ভীষ্মরই সাইকেল ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আজকাল মানুষ ঠকে ঠকে আর ওঝার খপ্পরে পড়া থেকে সাবধান হয়ে গেছে। বর্ষা এলেই গ্রামেগঞ্জে নানা বিষধর সাপের উপদ্রবে মানুষ অতীষ্ঠ। তাই ধাক্কা খেয়ে মানুষ অভিজ্ঞও হয়ে গেছে কিভাবে তাকে মোকাবিলা করে নিজেদের বাঁচানো যায়। ফলে সাপে কেটে মৃত্যুর হার আগের থেকে কিছুটা হলেও কমেছে। তবে ডাক্তাররা ভীষ্মকে রেখার সংসারে ফেরত পাঠাতে পারল না। কাল কেউটের বিষ যে সাংঘাতিক শক্তিধর। ডাক্তারদের, ওর সঙ্গে লড়াই করার সময় বড্ড কম দেয়। ছোবল মারার সঙ্গে সঙ্গে তুরন্ত হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে পৌঁছতে পারলে তবে ডাক্তাররা লড়াই করে জিততে পারে। প্রায় টানা দু’সপ্তা হাসপাতালে কেউটের বিষের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অবশেষে ভীষ্ম নীল হয়ে যায়! অকাল বিধবা হয়ে পড়ে যুবতী-বধু, রেখা। স্বামীর সৎকার, তারপর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ। এত খরচ রেখা পাবে কোথা থেকে! বৃদ্ধ শ্বশুর বিছানায় পড়ে। আর উঠতে পারবে না। গামুইদের কাঁধে চেপে একেবারে চেলাকাঠে ওঠার ভবিতব্য তার। কোমর নুইয়ে যতটা পারে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য করে যায় শাশুড়ী। ভীষ্মই ছিল তাদের সংসার-রথের সারথি। কত রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল ও রেখাকে নিয়ে।
প্রথম দেখাতেই ও যেন রেখার প্রেমে পড়ে গেছিল! ও সাইকেল ভ্যানে করে আলাদাতপুর থেকে কাঠের গুঁড়ি নিয়ে উলকুনী গ্রাম হয়ে যাবে ফতেপুরে কাঠ চেরাই কাখানায়। মধ্য দুপুরের বৈশাখী সূর্য পুড়িয়ে যেন খাক করে দিচ্ছিল চরাচর! আলাদাতপুর পেরিয়ে উলকুনী গ্রামের রাস্তায় পড়ে তেমাথানী মোড়ে ওর কাঠ বোঝাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। তেষ্টাতে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। আর টানতে পারছিল না গাড়ি। একটু তফাতে একটা কঞ্চির ছিটেবেড়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা মেয়ে মাটির কলসি কাঁখে জল নিয়ে আসছিল। মেয়েটা কাছে আসতেই চোখ যেন দাঁড়িয়ে যায় ভীষ্মর। আস্তে আস্তে সে কাঁখের কলসিটা নিয়ে ওই মলিন আস্তানার ভেতর চলে যায়। ভীষ্ম থমকে থাকে সেখানে! ছাতিফাটা তেষ্টা যেন মুহূর্তে উবে গিয়ে শীতল হয়ে যায় ভেতরটা। এই ঘরে এত অপরূপা একটা কন্যার বাস! ঘরটার বাইরে একটু তফাতে তিন ঝিঁকের মাটির উনুনে ধান সেদ্ধ করছে একটা বেওয়া মেয়েমানুষ। মনে হয় লোকের ধান সেদ্ধ-শুকনো করে ভাঙিয়ে চাল করে ফেরত দেয়, যার ধান তাদের। আর ভাঙানো ধান থেকে কুলোয় পাছড়ে তুঁষ আর খুঁদ আলাদা করে সেই খুঁদ আর ধান ভাঙানোর বানি, অর্থাৎ মজুরি চালের মালিকের কাছ থেকে যা পায় তাই দিয়ে এদের সংসার চলে। ভীষ্ম নিশ্চিত ইনি এই উর্বশী রমণীর মা। কাছে গিয়ে বলল,“একটু ঠান্ডা জল খাওয়াবেন মা? তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আর ভ্যান টানতে পারছি না।” উত্তরে ব্যস্ত হয়ে মহিলা বলল,“একটু বসো বাবা। মেয়েটা জল আনতে গেছে সেই হালদার পাড়ায়। অনেকটা দূর। অনেকক্ষণ গেছে। আসার সময় হয়েছে। ও এলেই তোমাকে টিউকলের ঠান্ডা জল দিচ্ছি।” সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্ম বলল, “একটা মেয়ে কাঁখে এক কলসি জল নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ও কি তোমার মেয়ে, মা?” ভীষ্মর কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে মা বলল,“রেখা তুই এসেছিস? তবে এক গেলাস জল আর দুটো নকুলদানা হাতে নিয়ে ওই খোকাটাকে দে তো মা! তেষ্টায় বেচারার ছাতি ফেটে যাচ্ছে! আহা রে, কাঠফাটা গরমে বড় কষ্ট। দে মা তাড়াতাড়ি। তেষ্টারে তুষ্ট করলে পুণ্য হয় রে মা। সেই পুণ্যি জলে যায় না। অনেক সময় উপরওয়ালা ভেক ধরে তোর কাছে আসতে পারে। তোর মন পরীক্ষা করতে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তোর আর পেছন ফিরে তাকাতে হবেনে রে মা। তোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। ভাল পাত্রে বিয়ে তোর হবেই হবে। এই কথাটা বলে রাখলুম।”
একটা মোটা কাঁসার গ্লাসে জল আর ছোট্ট ঠাকুরপুজোর মতো রেকাবে গড়াগড়ি খাওয়া কয়েকটা নকুলদানা নিয়ে মেয়েটা ভীষ্মর সামনে এসে দাঁড়ালো! এক আসমান বিস্ময় নিয়ে জলের গ্লাসটা নেবার জন্যে হাতটা বাড়ালো ভীষ্ম! কিন্তু সেই গ্লাস পর্যন্ত তার হাত যেন পৌঁছাচ্ছে না। অথচ তার কত যুগ আগে যেন তার চোখ ছুঁয়ে গেছে রেখার চোখের অন্তরে। দু’জনের চোখ অন্য কোন দিশায় যেন আর সরছে না। দুজনের দুটো হাতও সেই দূরত্বে অপেক্ষায়। দুটো হাতের দূরত্ব হয়তো এক আঙুলও হবে না, ইঞ্চিকাঠি দিয়ে মাপলে। তবু সেই ফারাক যেন মনে হচ্ছে কত যোজন! মায়ের কথায় থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে দু’প্রান্তের দুটো হাত,“কিরে মা দিলি বেচারাকে এক আঁজলা জল? খাও বাবা খাও। আত্মার জ্বলন দমন করো। মা শীতলা তৃপ্ত হোক।”
সেদিনের পর থেকে ভীষ্ম যখনই ওই রাস্তা মাড়ায় তখনই তেষ্টার তাড়া থাকুক বা না থাকুক একবার থমকে যায় রেখার মায়ের বাড়ি,“কই গো মা ঠাকরুণ, কি করছো। ভাল আছো তো? সব খবর কুশল তো? বাড়িতে কাউকে দেখছি না কেন মা? সব গেল কোথায়?” এ ছেলে যে রেখার খোঁজ করছে তা কে না বোঝে। রেখার মা তো আলবাৎ বুঝবে, “সে মেয়ে এখন ঘরে নেই গো বাপ। হিমে হালদারের জমিতে মুগ কড়াই তুলতে গেছে। সেই কোন ভোর থাকতে গেছে। এখন বেলা মাথায় ওঠার টাইম হয়ে এলো। এত বেলায় তো কড়াই তোলা যায় না। পাকা কড়াইয়ের খোসা এখন মড়মড়ে হয়ে গেছে। ছিঁড়তে গেলেই হাতের মধ্যেই খোসা ফেটে চৌচির হয়ে সব কড়াই ভুঁয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। হয়তো হিমে হালদারের বাড়িতে আছে। কড়াই খোড়া মেপে, সব মাপ বুঝিয়ে দিয়ে তবে না আসতে হবে। এক খোড়া কড়াই তোলার মজুরী পাঁচ টাকা। তাও আবার বলে কি না, খোড়া চূড়া মাপ করে দিতে হবে। তাতে আমি সায় দিইনি। হ্যাঁ খোড়ার মুখ বরাবর থেকে একটু উঁচুর দিকে ঢাল করে দিতে পারি। তা না আবার পাহাড়-মাথা চায়। কত্তো সাধ। মেয়েকে বলেছিলুম, অত কষ্ট করে তাহলে তোকে কড়াই তুলতে হবে নে। গতর খুইয়ে পয়সা পাব না তো কি হবে অত খেটে? তবে রাজি হয় হিমে হালদার। তোমাদের ওদিকে ক’পয়সা দেয় গো বাবা, এক খোড়ায়? আমাদের এদিকের মালিকদের যেন বড্ড হাত টান। কাজের লোকেদের জন্যে হাত উপুড় করতে এদের কি যে কষ্ট হয় তা বুঝে উঠতে পারিনি।”
ওই টুকটুকে মেয়েটা রোদে পুড়ে মুগ কড়াই তুললে ওর নরম শরীরের চামড়া তো ট্যান হয়ে খয়ের হয়ে যাবে? কেউ তখন ওর রূপে আর মাতাল হবে না। ভাবনাটা নিজের ভেতর তোলপাড় করে উঠতেই ব্যস্ত হয়ে ভীষ্ম বলল, “ও মা, মেয়েটাকে তুমি এত খাটিও না। আজকাল বড্ড জ্বালাপোড়া রোদ। ও কি আমাদের মত পুরুষ মানুষ, যে রোদের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখবে? ওর শরীরের জেল্লা পাংসে হয়ে গেলে তোমার যেমন কষ্ট হবে, তেমন আমারও ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাবে।”
-কি করবো বলো বাপ। সংসারে আলগা পয়সাও তো দরকার। না খাটলে কোথায় পাব। কে দেবে। বাপটা তো, সেই মেয়েটার যখন চার বছর বয়স, বউ-মেয়েকে অথৈ জলে ভাসিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল। কত খোঁজাখুঁজি করলাম। জনসমুদ্রে জাল ফেলে, পোলো মেরে কত হাঁচালাম। পেলাম না। মানুষটা কত ভাল ছিল। আমাদের দুই মা-মেয়েকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতো। সেবার কাজে যাবার সময় বলল, “রেখার মা, খিদিরপুরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ পেয়েছি। গ্রামে কখন কাজ হয় কখন হয় না। শহরে সবসময় কত অট্টালিকা হচ্ছে। ওখানে জোগাড়ের কাজের অভাব নেই। করতে পারলেই হবে। এই যাচ্ছি, মাস খানেক পর বাড়ি ফিরব। এক মাসের সংসার খরচের টাকা রেখে গেছি। চিন্তা করবে না আমার জন্যে। মেয়েকে নিয়ে তুমি সাবধানে থেকো।” বারো বছর পর পাড়ার মেয়েরা ধরে বেঁধে মা কালীর থানে নিয়ে
গিয়ে আমার হাতের শাঁখা ভেঙে, মাথার সিঁদুর মুছে থান পরিয়ে দিল। সেই যে থান ধরলাম এখনো তাই পরণে জ্বলজ্বল করছে। তবু কেন জানিনা বাবা, আমার মন যেন সায় দেয় না। মনে হয় এই বুঝি রেখার বাপ এসে ডাকল, “রেখার মা, কোথায় গো। এক গেলাস ঠান্ডা জল দও তো! গগনভেদি তেজে বুকের ছাতি যেন হাহাকার করছে।” তুমি কিছু মনে কোরো না বাপ। আমার ছেলের মত তুমি। তুমি মা বলে আমার কাছে প্রথম দিন যখন জল চাইলে না? আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল! কার গলা এটা? রেখার বাপ নাকি? তোমায় দেখে তবে হৃদপিন্ডের নাচন-কোঁদন বন্ধ হল।
ভীষ্ম কেন ঘন ঘন তাদের ঘরের দাবায় এসে বসে তা রেখার মায়ের ধরতে কষ্ট হয় না। রেখাকে দেখার পর থেকে ওর এই আনাগোনা। সেটা ভীষ্মরও অজানা নয়। ও যে রেখাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই রেখার কষ্ট ওর বুকে যেন দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি ঠোকে। রেখা কষ্ট করবে কেন? ওর কষ্ট সে বুক পেতে নেবে। তাই আর রাখঢাক না করে ভীষ্ম একদিন রেখার মা’কে বলল,“মা, তোমার মেয়ের ভাগ্য-মালা আমার গলায় ঝুলিয়ে দেবে? আমি সারা জীবন সোনার মালার মত তাকে আগলে রাখব। মেয়েকে নিয়ে তোমার আর কোন চিন্তা করতে হবে না। একটা কানাকড়িও এই বিয়ের জন্যে তোমার খরচা করতে হবে না। খরচা করে আমরাই কনে সাজিয়ে তোমার মেয়েকে ঘরে তুলব।” ভীষ্মর কথায় অবাক হয়নি রেখার মা। ওর মনের ভাষা অনেক আগেই তো সে পড়ে নিয়েছে। তাই সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “জানো বাবা, কত ছোকরা এই মেয়েকে বিয়ে করার কথা আমার কাছে তুলেছে? আসলে আমার রেখা একটু মাজাঘষা দেখতে বলে সক্কলের নজরে পড়ে যায়। কেউ যৌতুক চায়, কেউ চায় না। কেউ আবার সুন্দরের লোভে মেতে উঠে ছটফট করে। কিন্তু কারোর মন আমার মনকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তাই ওগুলোকে আমল দিইনি। দাবায় বসতেও বলিনি। জোর করে বসলে জল-নকুলদানা খাইয়ে অতিথি বিদেয় করি। কিন্তু একটা কথা কি জানো বাবা ভীষ্ম, তোমার মত কেউ কোনদিন আমাকে ‘মা’ বলে ডাকেনি। ছেলের মুখ থেকে মা-ডাকের লোভ আমার কাছে বাঁধনছেঁড়া লোভ। রেখার বাপের কাছে সেই লোভের কথা সরমের গুলি মেরে বলেওছিলাম। রাজি হয়েছিল ওর বাপ। খোকার মুখ থেকে মা-ডাক ও আমাকে শোনার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেই লোভ এখনো আমার ভেতর তাড়া করে বেড়ায়। তা তুমি সেই প্রথম দিন যখন ‘মা’ ডাক দিয়ে আমার কাছে ছাতির জ্বলন থামাবার জন্যে জল চাইলে। সেই ডাক, আমার বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সেই অতৃপ্ত বাসনা যেন নতুন রূপ নিয়ে জন্ম নিল। তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম এতদিন চেয়ে ফেরা আমার ‘মা’ ডাক। একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে তোমার সোনার মালা তুমি গলায় ঝুলিয়ে ঘরে তোল। আমার রেখাও যে তোমার গলায় ঝুলে পড়ার জন্যে আলাপের সেই প্রথম দিন থেকে তপস্যা করে যাচ্ছে। সন্তানের মনের কথা সবার আগে মা ছাড়া আর কে বুঝবে। মেয়ের একটা হিল্লে করে আমি এই বাস তুলে দিয়ে আমার দাদার বাড়ি চলে যাব, শিলিগুড়িতে। দাদার বয়স হয়েছে। তার দেখার লোক নেই। দুটো ভাইপো-বউ তাকে ঠিকমত দেখে না। অনেক দিন থেকে আমাকে ওখানে যেতে বলছে। কিন্তু মেয়ের একটা ব্যবস্থা না করে আমি যাই কেমন করে। আর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরা তখন আমাদের বোঝা মনে করবে। খেতে পায়নে তাই ননদ সংসার নিয়ে এখানে উঠেছে। দাদা বলেছে, “তুই চলে আয় বোন। আর তোকে ফিরতে হবে না। মরে যাবার আগে তোর একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা আমি করে যাব। তা মেয়ে যদি মনে করে ওখানে গিয়ে আমাকে দেখে আসবে, যাবে। আমারও মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হলে ডেকে পাঠাব। আর মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকে গেল।”
রেখার জীবনের এই খন্ডকথা শুনতে শুনতে একেবারে যেন বিবশ হয়ে যায় অখিল। তার জীবন অনেক অভাব অনটন, উত্থান পতনের সাক্ষী। ছেলে বলে লড়াই করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। মেয়েরা যে লড়াই করতে পারে না তা নয়। কিন্তু মেয়েদের লড়াইয়ের পথে বড্ড কাঁটা বিছানো। তাই বেশিরভাগ মেয়ে কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আর এগোতে পারে না। প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। ভীষ্মর সঙ্গে রেখাও তো জীবনযুদ্ধ জয় করার জন্যে লড়াই জারি রেখেছিল। কিন্তু মাঝপথে ভীষ্মর মরণ-কাঁটার মোক্ষম আঘাতে সে তো এখন দিগভ্রান্ত! কে ওর সামনে হাওয়া-মোরগ হয়ে সঠিক পথের নিশানা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে? অখিলেরও তা অজানা। তবে মনের সাহসের ওপর ভর করে অখিল বলল, “রেখা-বউ, তুমি অত ঝিমিয়ে পোড়ো না। এক্ষুণি দমে গেলে, জীবনধারণের জন্যে দম কোথায় পাবে? সেই দম তো তোমাকে ধরে রাখতে হবে এবং অর্জনও করতে হবে। বুকে সাহসের জন্ম দাও। তোমরা তো জন্মদাত্রী। অনেক সাহসের জন্ম দাও। দেখবে ঠিক খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারবে। আপাতত আমি তোমাকে ভীষ্মদাদার সৎকারের খরচ আর শ্রাদ্ধশান্তির জন্যে যা যা লাগে সামলে দিচ্ছি। না, রেখা বউ। তুমি ভেবো না দানসত্র খুলে বসেছি আমি। ওইটা করলেই লোকে ‘কু’ ভাবনা এদিক ওদিক সর্বত্র চালান করে দেবে। এই ভাবনা চালানে লোকে ক্লান্ত হয় না। বরং আরও উৎসাহ ভরে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তোমার কাজের মজুরি থেকে কাটান দিয়ে দিও। সুদখোরদের মত সুদ আদায়ের ধান্দা করব না। আর টাকা শোধ দেবার জন্যে চাপাচাপিও করবো না। যেমনটি পারবে তেমন ভাবেই কাটান করে দিও। শুধু মন দিয়ে নিখুঁত করে তোমার কাজটা করে যেও। সেটা অবশ্য তোমাকে বলতে হবে না। সে পরীক্ষায় তুমি পাশ অনেক আগেই করে গেছো। হ্যাঁ, আর একটা কথা রেখা বউ। কোলকাতা থেকে আরও সুন্দর সুন্দর ড্রইং এসেছে। তবে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে সেগুলোকে ঠাকুরের গয়নায় রূপ দিতে হবে। সবাই এটা পারবে না। বেশিরভাগ কারিগর তো মাথামোটা। সরু মাথারাও কুঁড়েমি করে মাথা ঘামাতে চায় না। তুমি সে গোত্রের নও তা আমি জানি। তোমাকে দিয়ে পরখ করতে চাই এই অর্ডার আমি সাহসের সঙ্গে নেব কি না। এই আঁকা দেখে দেখে কয়েকটাকে গয়নার রূপ দেবার চেষ্টা করো দিকিনি রেখা বউ ? তুমি যদি পারো তো তোমার দাম আরও বেড়ে যাবে। আর সকল কারিগর থেকে তুমি উঁচু জাতে উঠে যাবে। দামি কারিগর তো তখন দামি মজুরি দাবি করতেই পারে। আর সেই দাবি মানতে আমি নারাজ হব না। ভীষ্ম দাদার কাজ সব মিটে যাক। ইতিমধ্যে আমি কোলকাতায় যাচ্ছি। গুরুর আর আমার- দু’জনেরই অনেক মাল জমে গেছে। ডেলিভারি দিতে কোলকাতায় যাবার তাড়া পড়ে গেছে। সেইসময় ওই নকশা আমি নিয়ে আসবো। কোলকাতার মহাজন আমার উপর মনে হচ্ছে ভরসা করতে পারছে না। ভাবছে, এত শক্ত নকশার কাজ হয়তো আমার দ্বারা হবে না। মহাজনের সেই ভুল আমি ভাঙাতে চাই। আর একবার আমার গয়না মঞ্জুর হয়ে গেলে আমিও দাম হাঁকিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব। ওরা মনে হয় আরও অনেক কারখানার মালিককে দেখিয়েছে। তেমন দক্ষ কারিগর তাদের হাতে নেই বলে হয়তো তারা নাকচ করে দিয়েছে। তাই আমাকেও ওই ‘নাকচের’ দলে ফেলে দিয়ে একবার শুধু ধর্মের ডাক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার আর আমার সামনে সে’কথা তোলেনি। আর আমি তো এঁটেলচিমড়ে। ওই ড্রইং আমি দেখাতে বলেছি। হেলাফেলা করে আমাকে দু’বার দেয়নি। শেষদিন জোর করে চাপ দিয়ে বলে এসেছি। তোমার উপর ভরসা করে আমি বড়মুখ করে সেই চাপ দিয়েছি রেখা বউ। এখন আমরা দু’জনেই পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। এ পরীক্ষায় আমরা পাশ করবোই। তুমি দেখে নিও। আর তার জন্যে আমার যেটুকু হাত লাগাতে বলবে আমি লাগাব। পিছু হটবো না।”
স্বামীর মৃত্যুর খবর শিলিগুড়িতে মায়ের কাছে ‘তার’ পাঠিয়ে জানিয়েছিল রেখা। অখিলই সব ব্যবস্থা করেছিল। পত্রপাঠ মা’কে চলে আসার কথা বলেছিল রেখা। কিন্তু ভীষ্মর শ্রাদ্ধের কাজের সময় এসে গেল তবু মা এল না। কেন এল না মা, এই নিয়ে নানান প্রশ্ন এবং দুশ্চিন্তা রেখার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। মা কি একেবারে তার দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে ! স্বামী মারা যাবার পর আবার যদি মেয়ে তার ঘাড়ে চাপে তাই? না কি অন্য কোন কারণ? তাদের বিয়ের মাস চারেক পর মা বড় মামার কাছে চলে যায়। সেই থেকে একবারও মা মেয়ের খবর নেয়নি। ভীষ্ম অবশ্য বার দুই মা’কে তার পাঠিয়ে খোঁজ
নিয়েছিল। আবার ভাবছে, মা ভাল আছে তো? না কি, মা একা আসতে পারবে না বলে আর জামাইয়ের শ্রাদ্ধের কাজে আসতে পারছে না। তাই যদি হবে তো মা পাল্টা তারে তাকে জানাতে পারতো! সম্ভব হলে রেখা কাউকে বলে কয়ে শিলিগুড়িতে পাঠাতে পারতো! সে মনে বোধ পেতো। এইসব নিয়ে বড়ই মনঃকষ্টে আছে রেখা। ভীষ্মর কাজ মেটার পর একটা চিঠি এল তার ঠিকানায় বড় মামার বাড়ি থেকে। ওরা সময়মতই তাদের সব খবর পেয়েছে। কিন্তু তার মা’কে সেই সংবাদটা দিতে পারেনি। মানে দেবার মত পরিস্থিতি মায়ের ছিল না। সেই সময় ডেঙ্গী জ্বরে মায়ের এত বাড়াবাড়ি যে রোগির হুঁশ পর্যন্ত ছিল না। সেই বেহুঁশ অবস্থাতেই মা ভীষ্মদের দেশে পাড়ি দিয়ে দিল!
বড় মামার বাড়ি থেকে চিঠিটা পাবার পর রেখার বুকের ছাতি যেন যন্ত্রণার আগুনে ফেটে চৌচির হতে যাবার পরিস্থিতি হয়ে গেল। মনে হ’ল গলা ফাটিয়ে হাট করে চিৎকার করে সেই আগুন চরাচরে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু তার জন্যে কে অপেক্ষায় আছে এই চিৎকার শোনার! কেউ নেই। দিগন্ত পেরিয়ে আদিগন্ত অতিক্রম করলেও কেউ শোনার নেই। অখিলকে দিয়ে চিঠিটা পড়ানোর পর সেটা তার হাত থেকে ছোঁও মেরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি লাঠি হাতে কোমর নুইয়ে নুইয়ে এসে বৌমার এই অবস্থা দেখে বিহ্বলে বয়সী ফোঁটা ফোঁটা আগুন জল ফেলতে ফেলতে বলল, “তোর জীবন পারের সাঁকো আর কেউ রইলো না রে মা। আমরা এই বুড়ো বুড়ি তো ভীষ্মর কাছে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আছি। আজ না হয় কাল ! আমরা পৃথিবী থেকে উবে যাবার সাথে সাথে তুই যে তাহলে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবি রে মা! আমাদের মরণ তো নিশ্চিন্ত মরণ হবে না রে মা! এই অতৃপ্ত মরণ কত জন্মের পাপ তা কে জানে! বুক ধড়ফড়িয়ে আবার ঠক ঠক করে মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর বিছানার দিকে ফিরে গেল ভীষ্মর মা।
অখিল, তার বাবার অকালমুত্যুর যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে। সেই মৃত্যুর পরিণতির নির্মমতা জীবন দিয়ে পরখ করেছে। কিন্তু আজ ও এই যে পরিস্থিতির সাক্ষী হল তা শুধু দুর্বিসহই নয়, তার কল্পনারও অতীত। বিপর্যয়ের এমন পর্যায়গুলো কেন যে মানুষের জীবনে আসে কে জানে! রেখা বউয়ের জীবনযন্ত্রণা তাকে যেন আরও বিচলিত করে তুলল। এই মেয়েটার জীবন তো সবে শুরু হ’ল। তার থেকেও কম বয়স মেয়েটার। পাপ-পূণ্যের কতটুকু বা মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়েছে এ! তবে এ কেন এত কষ্ট পেতে যাবে। আর অখিলের মত একটা সমর্থ যুবক তার স্বচ্ছ চোখ দিয়ে দেখার পরও এটা মেনে নেবে? প্রশ্নগুলোর মিশেলে ভেতর থেকে উগরে ওঠা গভীর যন্ত্রণাগুলো তাকে বিহ্বল করে তোলে। নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কি এখানে কিচ্ছু করার নেই?

 

ক্রমশ… 

Loading

Leave A Comment