Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১২)

জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

[ আটাশ ]


বাবুদের কথায় কিঞ্চিৎ নমনীয় হয়ে রতন বলল, “আপনারা বুদ্ধিমান মানুষ। একটু মন দিলে অবশ্যই ঢাক বাজানো শিখতে পারবেন। আমাদের মত মাথামোটারা যদি পারে, আপনারা পারবেন না তা হতে পারে না। শুধু মনটা দিলেই হবে। আমার সামনে আপনারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। ছেলেদের এমন কান্ডর কথা পাড়ায় মুখে মুখে চাউর হয়ে যেতে পাড়ার মেয়ে-বউরাও একে একে জড়ো হতে থাকে। রতন ছেলেদের কেমন করে ঢাক বাজানো শেখায় তা দেখার জন্যে মেয়েরাও উৎসুখ হয়ে পড়ে।
বাবু, এই ‘তাল’ কথাটা যে আমরা বলি, তার মানে তালি। হাততালির তালি। এই তালির জায়গাতেই তবলা ব্যবহার করা হয়। আমাদের ঢাক, বলা যায় তবলারই বড় রূপ। তবলা হাতে বাজায়। ঢাক আমরা কাঠিতে বাজাই। ঢাক তবলার থেকে এত বড় যে ওই মামুলি হাতের কারসাজি এখানে চলে না। এই তালের আবার ছানাপোনা আছে। তালি, খালি, বিভাগ, মাত্রা, বোল, ঠেকা লয়, সম আর আবর্তন।
আমরা যখন দু-হাতে তালি বাজাই, হাতদুটি প্রতি দু’বার চুমু খাবার মাঝে একবার করে বিচ্ছিন্ন হয়। এই বিচ্ছিন্নর অংশটাকে ‘খালি’ বলে। দুটি তালির মাঝের সময়ের সম্পর্ক ত্যাগ। প্রতিটি তালি বা খালিতে একটি করে সময়ের মাপ আছে। এই মাপই বলে দেয় কোন তালে ক’টি মাত্রা। মাত্রা মানে তালের বেলায় শব্দের আঘাত। এই ঢাকের কাঠি দিয়ে যে ঢাকে মারলাম তারপর টাং করে শব্দ হল, সেটাই মাত্রা। -একটা শব্দ লেখার সময় আমরা যে মাত্রা দিই তেমনটাই আর কি? এক বাবু, রতন বলার ফাঁকে কথাটা ছুড়ে দিল।
রতন তখন বলল, “আমি অতটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবু। এটুকুই আমার জানা।” সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবু বলল,“আরে রতনকে অত ক্রশ করিস না। ও তাহলে সব গুলিয়ে ফেলবে। যেটুকু ও জানে তার মধ্যেই ওকে থাকতে দে। মাঝপথে আমাদের শেখাটাই মাটি হয়ে যাবে। রতন, তুমি এবার শুরু করো। আমরা মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।”
তারপর বলি বাবু, “যখনই কোনো বাজনা শুনি জেনেবুঝে বা না বুঝে অজান্তে আমরা তাল দিই। ঘাড় নাড়ি, হাঁটু ভেঙে নেচে তাল দিই, হাতের অঙ্গভঙ্গী করি। ঠিকভাবে দেখলে বুঝতে পারব আমরা, সব জায়গায় একইভাবে তাল দিই না। মানে একইভাবে হাঁটু ভেঙে নাচি না একইভাবে তালি দিই না। কখনো ধীরে কখনো তাড়াতাড়ি। মানে তালিও খালি সেইমত নিজের জায়গা
করে নেয়।
খুব চেনা কয়েকটি তাল হচ্ছে দাদরা (৬/৩-৩), কাহারবা (৮/৪-৪), তেওড়া/রূপক (৭/৩-২-২), ঝম্পক (৫/৩-২), নবতাল (৯/৩-২-২-২), ঝাঁপতাল (১০/২-৩-২-৩), একতাল/ চৌতাল (১২-৪-৪-২-২/২-২-২-২- ২-২) আর ত্রিতাল (১৬/৪-৪-৪-৪-)।
এবার সন্তোষবাবু মুখ না খুলে পারল না,“আচ্ছা রতন, তুমি যে বলো তেমন কিছু বোঝ না। তা যেসব তালের কথা তুমি বললে তা তো বড়বড় সঙ্গীত শিক্ষায়তনের পাঠ। সেই পাঠ তুমি আমাদের দিচ্ছো। আর বলছো তুমি মুর্খ ! তোমার মত শিক্ষিত তো মনে হয় আমাদের মধ্যে কেউ নেই! তোমার মধ্যে এত গুণ। অথচ তোমার কোন অহং বোধ নেই! কত বড় মন হলে তবে মানুষ এমনটা হতে পারে। এটা একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার জানো তো রতন। এইসব ব্যাপারগুলোতে অত নজর রাখো না বলেই তোমরা অতটা সাদাসিধে। যতদিন তোমরা এইভাবে চলতে পারবে ততদিন তোমরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে। আর যেই অহংবোধ তোমাদের মধ্যে জেগে উঠবে তখনই হবে মুশকিল। তাই বলি, যেমন আছো তেমন থাকো। ভাল থাকো। হ্যাঁ, বলো রতন। কি বলছিলে। তোমাকে আমরা বারবার থামিয়ে দিয়ে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না? কিন্তু এসব না বলেও তো থাকতে পারছি না। বলো রতন, বলো।”
-বাবু, এছাড়া আরও কত রকম তাল আছে জানো? ধামার আছে, আড়া চৌতাল আছে, সিতারখানি, মত্ত তাল দীপচন্দি, সুরতাল, ঝুমরা, তিলওয়ারা, ঝম্পক বা রূপম, পঞ্চম সাওয়ারী, ষষ্ঠী, খেমটা, চৌতাল, আড়খেমটা এইসব। আবার দুটি তালকে ইচ্ছেমত মিলিয়ে যে তাল হয় তাকে কাওয়ালি, বিচিত্র ইত্যাদি বলে। আর একটা কথা, যেই ঢাকে আঘাত করা হচ্ছে সবকটা মারের সঙ্গে যোগ আছে একটা করে ভাগ। এইটাই হোল ‘বোল’। আর ‘ঠেকা’ হোল বোল আর ভাগের ঠিক করা তালি, খালি। এগুলো মিলিয়েই তালের জন্ম। এত সব তাল কিন্তু বাবু আমাদের ঢাকে ব্যবহার করা হয় না। নির্দিষ্ট কয়েকটাকে ধরে পুজোর ভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাক বাজানো হয়। এবার তাল ধরে ধরে আমি কেমনভাবে বাজাচ্ছি দেখুন। তারপর এক এক করে আপনারা বাজাবেন। প্রথম প্রথম কাঠি হয়তো ঠিকমত ঢাকে ঠিক ঠিক জায়গায় পড়বে না। ওই যেটাকে বলে হাতের আড় ভাঙা আর কি। কাঠি নিয়ে প্রথমে হাতের আড় ভাঙতে হয় বাজিয়ে বাজিয়ে। তারপর তালে পা দিতে হয়। আড় ভাঙার ব্যাপারটায় লজ্জার কিছু নেই। নতুন যারা ঢাকে কাঠি মারবে সকলেরই এটা হবে। এ তো সব ক্ষেত্রেই হয়। ছেলেপিলেরা কি প্রথমবার জলে নেমেই সাঁতার শিখে যায়! কত জল খেয়ে ফেলে। জল খেতে খেতে একটা সময় ছপাৎ ছপাৎ করে জল টেনে সাঁতরে পুকুর এপার ওপার করে ফেলে। এ-ও তো তাই। বাবু, আপনারা যারা হাতের আড় ভাঙতে চান এক এক করে আসুন। তারপর আমি তাল বোলের দিকে যাব।”
সন্তোষবাবুরা পরপর প্রথম ঢাক বাজানোর হাতেখড়ির বাজনা বাজাতে শুরু করে। এক এক করে এমনটা করতে করতে সময় এসে যায় বিসর্জন পুজোর। বামুন ঠাকুর ওদিক থেকে হাঁক দিয়ে দিয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের হাঁক কানে আসতেই রতন সতর্ক হয়ে যায়, “বাবু, বিসর্জনের পুজো শুরু হয়ে গেছে। ঘটের সুতো কাটার মন্ত্র শুরু হয়ে যাবে। আমাকে সেই বিসর্জনের বাজনা বাজাতে হবে। এটা তো আর আগমনীর আনন্দের বাজনা হবে না। আবার পুরোপুরি বিষাদেরও নয়। বিনয়ের তাল বোল নিয়ে কাজ করতে হবে। আপনারা আগমনীর বাজনা শুনেছেন এবার বিনয়ের শুনুন। মন দিয়ে শুনলে বুঝতে পারবেন দুটোর মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কোথায়! তারপর পার্থক্য বুঝতে পারবেন সন্ধ্যেয় ধুনুচি নাচের বাজনা আর মা’কে পরের বছর আসার জন্যে আবেদন করে মায়ের বিসর্জনের বাজনা।” বলে রতন-সনাতন চলে গেল মায়ের থানের সামনে। পরম শ্রদ্ধাভরে মা’কে প্রণাম করে ঢাকে বোল তুলতে শুরু করে দিল।
প্রত্যেক বছর সন্তোষবাবুরা শিয়ালদা থেকে ঢাকি বায়না করে নিয়ে আসে। নিয়মমাফিক তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। ঢাকিরা তাদের ঢাক বাজানোর কর্তব্য করে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। চলমান নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়েই চলে সবকিছু। কিন্তু এই ঢাক বা ঢাকির মধ্যে যে এমন মন মাতানো শিল্প আছে আর এই শিল্পের যে এমন দক্ষ শিল্পী থাকতে পারে, রতনদের সঙ্গে যোগাযোগ না হলে তাদের জানাই হতো না। হয়তো অজানা থেকে যেত সমাজ জীবনের এমন একটা সুন্দর অংশের জবরদস্ত উপস্থিতি।
ধুনুচি নাচ আজ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল রতনদের ঢাক কাঁসরের যুগলবন্দিতে জন্ম নেওয়া বোল তালের হাত ধরে। ধুনুচি নৃত্যশিল্পীরা যেন মন-মাতাল হয়ে বিরতিহীন নাচ চালাতে লাগল। রতন-সনাতনও ওদের সঙ্গে একাকারে পাগলপারা হয়ে গেল বাজনার যোগ্য সঙ্গত দিতে দিতে। তৃপ্ত মানুষ খুশিতে প্রাণ খুলে তাদের বকশিশ দিয়ে গেছে। এদের জন্যে কেউ যেন কার্পণ্যের কথা ভাবতে চায়নি। সেই কম কথা বলা গম্ভীর ভাবের ছেলেটা, সনাতনের কাঁসর বাজনাও চোখে পড়ার মত। সেও যে এতটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে পারে তা না দেখলে অজানা থেকে যেত। একটা দূর্গাপুজো কমিটির মাথায় বসার দায়দায়িত্ব যে কতটা সেইসঙ্গে মানসিক শারীরিক চাপ। তা যারা এই দায়িত্ব নেয় তারা হাড়ে হাড়ে টের পায়। কিন্তু এতকিছু সবটাই প্রাণে ধরে মেনে নেওয়া যায় যদি সার্বিক প্রচেষ্টা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। সন্তোষবাবু সেই দিক থেকে পুরোপুরি সফল এবং তৃপ্ত। এ’বছর তার এই পূর্ণ তৃপ্তি অনুভবের মূল কান্ডারী এই রতন-সনাতন, ওরা দুই বাপ-বেটা। অন্যান্যবারে এই অনুভবের মাত্রা এতটা উচ্চপর্যায়ে ছুঁতে পারেনি। তাই রতনরা যেন তার ভেতরের দুর্বলতার জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু অনুভবের কথা তো প্রকাশ্যে গলা ফাটিয়ে হাট করে দেওয়ার জিনিস নয়। ভেতরে সযত্নে লালন করার জিনিস। সেই লালনের হাত ধরে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন করে কাজ করার প্রেরণা জন্ম নেয়। প্রেরণাঋদ্ধ হয়ে সামনের যাবতীয় কাজে তখন সাফল্য ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবনা প্রশ্রয় পেতে পারে না।
মায়ের প্রতিমা ভাসানের কাজ সেরে বাবুঘাট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে বেজে যায়। পাড়ার মায়েদের উদ্যোগে ততক্ষেণে এদিকে মন্ডপে দধিকর্মা আর সিদ্ধি সরবত প্রস্তুত। সকলকে বলা হল, স্নানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে চলে আসতে। রতনরাও তৈরী হয়ে এসে হাজির। একটা কাগজের বড় প্লেটে দধিকর্মা এবং একটা কাগজের বড়মত গ্লাসে সিদ্ধি দেওয়া হল প্রত্যেককে। খিদে তো সক্কলের পেয়েছে। পরম তৃপ্তিতে তা খেয়ে সবাই যে যার মত নিজেদের বাড়ি চলে যায়। রতনদের তারপর লুচি আলুরদম খাবার কথা বললে তারা তো আর খেতেই পারলো না। জল খেয়ে ভোর চারটে-সাড়ে চারটের সময় একটু গড়াতে গেল।
হৃদারাম ব্যানার্জী লেন জাগতে জাগতে বেলা আটটা-নটা বেজে গেল। এবার রতনদের বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করার কথা। সঙ্গে সঙ্গে রতনের সামনে ভেসে উঠল সনাতনের চার বছরের বোনের মুখটা, তার মায়ের মুখ। বাড়ি থেকে বার হবার সময় মেয়ে আর মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছিল, “যদি কাজ পায় তো বাড়ি ফেরার সময় পুজোর পোষাক তোদের জন্যে নিয়ে আসব।” বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নানটান সেরে পোষাক পরে তৈরী ওরা। অপেক্ষায় সন্তোষবাবুদের জন্যে। ঘরের বারান্দায় বিলম্বিত পায়ে চলাফেরা করছে। একজন বাবুর সঙ্গে দেখা। কোথাও যাচ্ছিল। যুগপৎ তার মেয়ের মুখ আর বাবুর, রতনের সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়াময় মেয়ের মুখখে টপকে বাবুকে বলে,“বাবু বাড়ির মানুষরা আমাদের জন্যে রাস্তাপানে তাকিয়ে থাকে, পুজোর কি বাজার আমরা তাদের জন্যে কোলকাতা থেকে করে নিয়ে আসছি। আমাদের তো দোকান থেকে নতুন পোষাক কিনে তাদের দেবার ক্ষমতা নেই। তাই যে পাড়ায় আমরা কাজ করতে যাই সেই পাড়ার মানুষদের বাড়ি বাড়ি যাই যদি কিছু তেনারা আমাদের সাহায্য করেন। তা আমরা কি পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে কিছু তোলা যোগাড় করতে পারি? যদি অনুমতি দাও তো যাই।” সঙ্গে সঙ্গে বাবু বলল,“যাও, যাবে না কেন। প্রত্যেক বছর ঢাকিরা তো যায়। তা তোমরা বা যাবে না কেন? এ’জন্যে কারোর অনুমতি লাগে না গো রতন। তুমি কোনো কিন্তু না করে বেরিয়ে পড়ো। বেলা হয়ে গেলে আবার সবাইকে নাও পেতে পারো। বিজয়ার প্রণাম করতে আবার লোকে বেরিয়ে পড়বে। আমাদের পাড়ায় এই সময় প্রণাম সারার নিয়ম-রীতি। তোমাদের বরং আর একটু আগে বার হওয়া দরকার ছিল। যাইহোক এখনই বেরিয়ে পড়ো। কোন সমস্যা হবে না।”
বাবুরা তো তাদের দু’জনের জন্যে অনেক পোষাক আসাক দিয়েছে। সপ্তমী অষ্টমী নবমী- তিন দিনের জন্যে তিন সেট করে নতুন পোষাক। বাসি পোষাক পরে মায়ের থানে যাবার নিয়ম নেই এখানে। সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানতে ঢাকিদের জন্যে এই ব্যবস্থা। তাদের বাপ-বেটার আর পুজোর পোষাকের দরকার নেই। এবার ঘরের মানুষদের নিয়ে চিন্তা রতনের। কেমন কি পাবে কে জানে। কপাল ঠুকে দু’জনে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল ঢাকের বোল তুলতে তুলতে। হ্যামলিনের বাঁশির মত যেন সেই বোলে মোহিত হয়ে পাড়ার মায়েরা, মেয়েরা বেরিয়ে পড়ল নিজেদের সামর্থমত পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে। যাদের তা নেই তারা সাধ্যমত নগদ দিয়ে দায় মেটালো। পাড়ার বাসিন্দরা এতে যে অভ্যস্ত, এমন স্বতস্ফুর্ত আচরণে ওরা বুঝে গেল। কারোর কাছেই মুখফুটে কোন আবেদন করতে হল না। ঢাকই যা বলার বলেছে আর মানুষ তা সমর্থন করেছে।
এত মানুষের সাহায্য-ভালবাসা পাবে তা রতনরা কল্পনা করতে পারেনি। ওদের মনে হচ্ছে মানুষ এত যে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাবার দান করেছে তা তারা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে তো? সেইসঙ্গে নগদ দানের পরিমাণও ভাবনার অতীত ছিল। খুশিতে দু’বাপ-বেটার মন টগবগ করে ফুটতে থাকে। রতনের মনে হয় এই দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদেরও কিছু দেয়া দরকার। কিন্তু তারা তো ছাপোষা মানুষ। এই বাবুদের দেবার মত কিই বা সম্বল তাদের আছে। একমাত্র গতর দান করার সামর্থ ছাড়া আর তো কিছু নেই। রতন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করা যায় বলতো খোকা? এরা প্রাণ উজাড় করে আমাদের এতকিছু দিল। আমরা কি ওদের কিছু দিতে পারি না?” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমাদের যা সম্বল সেটাই দিতে পারি আমরা। এক কাজ করলে হয় বাবা। আরও দু’দিন আমরা যদি এখানে থেকে মা লক্ষ্মীর পুজো সেরে যাই? হ্যাঁ, অবশ্যই এই পুজোয় ঢাক বাজানোর জন্যে আমরা কোন পয়সা নেব না। বাবুরা হয়তো পয়সা না নেবার প্রস্তাবে সায় দিতে চাইবে না। কিন্তু এই জায়গায়, গতর খাটানো জায়গায় আমরা বাবুদের থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে। অতএব এখানেই আমরা বাবুদের উপর জবরদস্তি করতে পারি। তুমি এই প্রস্তাবটা বাবুদের দাও। এইসব কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল বলে সন্তোষবাবু আজকের দিনটা কাটিয়ে যেতে বলেছে। মাঝে আর একটা দিন বাদ দিলে পরের দিন লক্ষ্মী পুজো। এজন্যেও তো বাবুদের ঢাক বায়না করতে হয়। আমরা থেকে গেলে বাবুদের আর ছুটোছুটি করতে হবে না। অবশ্য অনেক পুজো প্যান্ডেল লক্ষ্মী পুজোর জন্যে ঢাক বা ঢোল বায়না করে না। এমনি ঠাকুরপুজোর কাঁসর-ঘন্টাতেই কাজ সেরে নেয়। তা এই বাবুরা কি করে তা তো আমাদের জানা নেই। নাই জানা থাক। আমরা যদি উপযাচক হয়ে ঢাক বাজাই তাতে তো বাবুদের অসুবিধা হবার কথা না। তুমি বরং সন্তোষবাবুকে ডেকে সে কথাটা বলো। হয়তো এই ক’দিন আমাদের জন্যে খাবার ব্যবস্থা বাবুদের করতে হবে। একটা খরচ অবশ্য ওনাদের বাড়বে। তা তেমন হলে না হয় আমরা আমাদের পয়সাতেই হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে আসব। কোন অসুবিধা হবে না। ওনারা আমাদের জন্যে এত করল, আর আমরা এটুকু কষ্ট করতে পারবো না?”
সনাতনের কথা মনে ধরে রতনের। সন্তোষবাবু তো ওদের প্রস্তাবে রতনদের বকবে না বুকে জড়িয়ে ধরবে, সেই দোদুল্যমানতায় কিছুক্ষণের জন্যে থমকে যায়, “এ তুমি কি কথা বলছো সনাতন! তোমাদের মনের এই উদারতা আমাদের ভুলবার নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক, লক্ষ্মী পুজোয় আমরা ঢাক বায়না করি না। তাই বলে তোমরা গতরে খাটবে অথচ কোন পারিশ্রমিক নেবে না তা যদি হয় তো মা লক্ষ্মীও তো আমাদের ক্ষমা করবে না। এ হয় না রতন। এ কিছুতেই হতে পারে না। এতটা অমানবিক আমরা হতে পারবো না। -তার মানে কালই আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলছেন? কিন্তু এই প্রস্তাবটা আমার যতটা নয় তার থেকে বেশি সনাতনের। ও বাচ্চা ছেলে, মনের ভেতর থেকে এমন কথাটা জোর দিয়ে বলে ফেলেছে। কেবল আপনাদের এত ভালবাসায় প্রণাম জানাবার জন্যেই। ঠিক আছে বাবু। তাহলে কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাব। আমাদের ইচ্ছেকে দাম দিতে গিয়ে আপনাকে আবার আপনাদের কমিটির কাছে হয়তো জবাবদিহি করতে হতে পারে। সেটাও তো আমরা হতে দিতে পারি না।
-আহাঃ তা নয় রতন। আমাদের কমিটির সব্বাই সমমনের। এখানে ভিন্ন চিন্তার কিছু নেই। আমি যেটা বলি সেটা আমার নিজস্ব কথা নয়। আমাদের সকলের। ওদিকটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের পাড়ার জন্যে আমি গর্বিত।
-তাহলে বাবু, আমার কথা যদি একটু মন দিয়ে শোনেন। আমার ছেলে যে কথাটা বলেছে সেটা আমারও মনের কথা। আপনারা ‘না’ করবেন না। ধরেই নিন না এটা আমাদের পক্ষ থেকে মায়ের চরণে বরণডালা অর্পণ! আমরা ছোট মানুষ বলে মায়ের আরাধনায় এটুকু অংশ নিতে পারি না! এতটাই আমরা অযোগ্য, বাবু?
রতনের এমন ধারালো যুক্তির সামনে সন্তোষবাবু আর প্রতিযুক্তির জাল বেছাতে চাইল না, “রতন, তোমার ভেতরে এত গুণ! তোমার উন্নতিতে কেউই বেশিদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এগিয়ে যাও রতন, তোমরা।” বলে সন্তোষবাবু পাড়ার ঘরে ঘরে গলা ছেড়ে বলে আসতে গেল, “রতনরা লক্ষ্মীপুজোয় ঢাক বাজাবে। এবারের লক্ষ্মীপুজো হবে অন্যরকম আঙ্গিকে। এবারের পুজোর নবপ্রেরণা রতন-সনাতন। ওরা নিজ উদ্যোগে এই পুজোয় নব-প্রয়াস দিতে চলেছে।”

[ ঊনত্রিশ ]

কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি আসতে মা বলল, “কচি পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেছে। ‘পেতেনের’ ওপর তোর একটা বইয়ের ভেতর অর্ধেকটা ঢুকিয়ে রাখা আছে। দেখে নিস, কে কি লিখে পাঠালো।” চিঠির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অলোকা! ওর নামে চিঠি? কে চিঠি পাঠাবে ওকে! ও তো কাউকে কোনদিন চিঠি পাঠায়নি বা কাউকে চিঠি লিখতে বলেনি! মা আবার ওইরকম করে কথাটা বলল কেন? মা কি বাঁকা চোখে কথাটা বলল? যদি কোন ছেলে বদ মন নিয়ে তাকে চিঠি লেখে! মানে প্রেমপত্র-টত্র আর কি। মা নিশ্চয়ই তেমনটা ভেবেই বলেছে। মনটা উচাটন হয়ে উঠল, চিঠিটা পড়ার জন্যে। পোষাক না খুলে যেমন তেমন করে উঠুনের ‘পজরা’র কাছে রাখা বালতির জলে হাত মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘরে চলে যায়। বিকেল হলে তো, দিনমান যতই চেষ্টা করুক তাদের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষমতা তার নেই। মাটির মোটা দেয়ালের ঘরটায় সোজাসুজি দুটো বাঁশের বাঁখারির আড়াই হাত লম্বা আর দেড় হাত চওড়া জানালা। ওইদিকটায় কাঠের তক্তপোশের বিছানা। অতি কষ্টে রোদ্দুর না, তার ছটা, আলোর রূপ ধারণ করে বিছানায় উপস্থিতি জানান দেয়। ঘরের মাঝামাঝি থাকা বড় পেতেনটা কোনোদিন এইসময় তাকে কাছে পাবার আশা করে না। বাবার বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা নিয়ে খস খস করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে আগুনের জন্ম দেয়। সদ্যভূমিষ্ঠ আগুনের সাহায্য নিয়ে মায়ের বলে দেয়া ঠিকানা মত বইটার ভেতর থেকে চিঠির খামের বেরিয়ে থাকা অংশটা টেনে বার করে বাইরে চলে আসে। দাবায় টাঙানো দোলায় বসে খস করে খামের মাথার দিকের একটা অংশ সন্তর্পনে ছিঁড়ে ফেলে। যাতে খামের ভেতরে থাকা কাগজের কোন অংশ ছিঁড়ে না যায়। তাড়াতাড়ি কাগজের মোড়াটা খুলতে দেখে, সরিষার মা সারদা মন্দির থেকে এসেছে চিঠিটা। এতক্ষণে যে অজানা আতঙ্কমাখা মন নিয়ে ব্যস্ত ছিল তা থিতু হল। না, মায়ের ভাবনায়- বদ মতলবে কেউ তাকে চিঠি দেয়নি। চিঠিটা পুরো পড়ে এবার মনটা যেন তৃপ্ত হ’ল। সে সিলেক্ট হয়েছে, সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিং পড়ার জন্যে। শুধুমাত্র মেয়েদের এখানে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হবার জন্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হায়ার সেকেন্ডারীতে অলোকার ভাল রেজাল্টের সুবাদে এই সুযোগ সে পেয়েছে। এবার দশ দিনের মধ্যে তাকে জানিয়ে দিতে হবে, সে ভর্তি হবে কি না। অলোকার তো মনেই ছিল না বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে সে আবেদন করেছিল। খবরের কাগজ তো সে কোনদিন দেখেনি। পাবে কোথায়। এমনি পেটে ভাত জোটে না যাদের, তাদের আবার খবরের কাগজ পয়সা দিয়ে কিনে পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কি! বিপ্লবদা সেদিন দিঘিরপাড় বাজারের বাস স্টপে তার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। কলেজ ছুটির পর বাস থেকে নামতে বিপ্লবদা বলল, “তোমার সাথে কথা আছে অলোকা। প্রদ্যুতের চা দোকানের ওইদিকে মুচিষা রোডের ফাঁকা জায়গাটায় চলো। এখানে মোড়ে লোকজনের হট্টগোলে ভাল করে কথা বলা যাবে না।” বলে বিপ্লবদা হন হন করে সেই দিকে এগিয়ে চলল। বাস থেকে নামতেই এমন কথা শুনে অলোকা একটু যেন থতমত খেয়ে যায়। কেন, বিপ্লদা কি কথা বলবে যেটা এখানে বলা যাবে না? অমন করে দু’একটা কথা বলে ওদিকে চলতে লাগল? তাহলে কোন মন্দ খবর নয় তো? তাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে আবার কোন জটলা হচ্ছে না তো তাদের পাড়ায়? আসলে মানুষের মন তো। এমন আবহাওয়ায় প্রথমে মন ‘কু’ ডাকের দিকে ধায়। অবশ্য তা নাও হতে পারে। কোন ভাল কথা থাকতে পারে। একটু সময় নিয়ে হয়তো কথা বলতে হবে তাই এই ভিড় থেকে সরে গিয়ে নিরালায় কথা বলতে চাইছে। এদিকে তো আবার ওদের পাড়ার লোকেদের জুতো সারাই, পালিশ, ধামা-খোড়ার সারানোর দোকান আছে। এমন সব মানুষদের মন তো সবসময় প্যাঁচ কষে। কখন কি ভেবে নেয় বলা মুশকিল। একটু এদিকে ওদিক তাকিয়ে তাদের পাড়ার কেউ কাছাকাছি আছে কি না বা পাড়ার ওই দোকানদাররা তার দিকে তাকাচ্ছে কি না খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে খানিক পরেই অলোকা বিপ্লবদা যেদিকে গেল সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওর জন্যে মুচিষা রোডে অপেক্ষা করছে সে।
অলোকা যেতেই একটা খবরের কাগজ বের করল বিপ্লবদা। যত্ন নিয়ে আস্তে আস্তে কাগজটার ভাঁজ খুলে অলোকার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সরিষা মা সারদা মন্দিরের বিজ্ঞাপন এটা। বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্যে ছাত্রীদের আবেদন করতে বলা আছে এতে। তোমার তো এইচ.এসে ভাল রেজাল্ট আছে। ওরা যা নম্বর চেয়েছে তোমার তার থেকে অনেক বেশি আছে। তুমি দরখাস্ত করলেই মনে হয় চান্স পেয়ে যাবে।”
-বেসিক ট্রেনিং? ওটা কি ট্রেনিং সেটাই তো জানি না। ও করে আমার কি হবে। কলেজে পড়তে পড়তে এটা আবার কি করে পড়বো! কিছুই তো বুঝতে পারছি না, বিপ্লবদা।
-প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা করার জন্যে এই ট্রেনিংটা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। মেয়েদের জন্যে আমাদের এদিকে ওই সরিষায় ‘মা সারদা মন্দিরে’ পড়ানো হয়। ভাল রেজাল্ট করা ছাত্রী ছাড়া যে-সে ওখানে পড়ার সুযোগ পায় না। তা তোমার রেজাল্ট অনেকটাই ভাল বলে আমার মনে হল তুমি দরখাস্ত করতে পারো। তাই বিজ্ঞাপনের এই কাগজটা তোমাকে দিতে ডেকেছিলাম।
আর এটাতে পাশ করলেই সরকারি প্রাইমারী স্কুলে চাকরি, বলতে পারো প্রায় নিশ্চিত। এখন সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং না থাকলে প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করার জন্যে অ্যাপ্লাই করা যাবে না।
-কিন্তু আমি যদি দরখাস্ত করি তো আমার বি.এ. পড়ার কি হবে? এক বছর তো পড়া হয়ে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে চলেছি। আর এক বছর পার করলেই থার্ড ইয়ার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তখন গ্র্যাজুয়েট হয়ে যেতে পারবো।
-তারপর? তারপর কি করবে? চাকরি করবে? মাস্টারির চাকরি? সেখানে কাজ পেতে গেলে তো আবার বি.এড. ট্রেনিং পাশ করতে হবে। আর এই বি.এড. ট্রেনিং পাশ করলেই যে তুমি কোন হাইস্কুলে কাজ পাবে এই গ্যারান্টি তোমায় কেউ দিতে পারবে না। হাইস্কুলের থেকে প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে চাকরির সুযোগও বেশি। সে জায়গায় হাইস্কুল ক’টা আছে তুমি আমাকে কড় গুনে বলো তো? আর প্রাইমারী স্কুল বলতে পারো প্রায় সব গ্রামে আছে।
-তাহলে তুমি এখন আমাকে ঠিক কি করতে বলো? খোলাখুলি বুঝিয়ে বলো। আমি কি তাহলে এখানে চান্স পেলে কলেজে পড়া ছেড়ে দেব? সেটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে না তো? ওই ট্রেনিংটা নিয়ে আমি পাশ করে বেরিয়ে আসতে পারব?
-সেটা তো পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে। সেই নিশ্চয়তা আমি কেমন করে দেব যে তুমি পাশ করবেই? মন দিয়ে পড়াশোনা করলে কেউ ফেল করে? বোকা বোকা প্রশ্নর কোন মানে হয় না। তবে হ্যাঁ, এই ট্রেনিং কোর্সটা আমি যতটুকু জানি বেশ শক্ত। আমার চেনাজানা যারা আগে ট্রেনিংটা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে শোনা। তবে আমার মনে হয় তুমি পেরে যাবে। এক বছরের কোর্স। আবাসিক। ওখানে থেকে পড়াশোনা করতে হবে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যাবে না। পেপারে সব ডিটেলস-এ লেখা আছে। বাড়িতে গিয়ে ভাল করে আগে পড়ো। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার নেবে।
-আমার তো কেমন ভয় ভয় করছে। একটা বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কি জানি! তারপর পাশ করতে পারব কি না। না পারলে এ-কুল ও-কুল দু-কুল চলে যাবে।
-ঝুঁকি না নিলে এগোনো যায় নাকি, অলোকা? এই যে তুমি তোমাদের ওই পরিবেশ থেকে যুদ্ধ করে পড়াশোনায় এতটা এগোতে পেরেছো। ঝুঁকি নিয়েছিলে বলেই তো পেরেছো। ঝুঁকি প্রত্যেক মানুষকে নিতে হয় এবং হবে। না হলে পেছনে পড়ে থাকতে হবে। আর একটা কথা, এখানে পড়তে এসে তুমি কি ক্লাস ফোর-ফাইভের কোর্স পড়বার আশা করো? নিশ্চয়ই না? যত উপরে উঠবে কড়া সাবজেক্টের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এই ট্রেনিংয়ে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক অত্যন্ত বেশি। ড্রয়ইং, হাতের কাজ ইত্যাদি অনেকটাই করতে হয়। আমি জানি এ’সবে তুমি একটু মাটো আছো। সেদিকটা তোমার ভাবতে হবে না। ওই প্রজেক্ট, ড্রয়ইং- ট্রয়ইংটা আমি তোমাকে হেল্প করে দেব’খন। সপ্তাহে একদিন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় ওরা। ডায়মন্ডহারবারের কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি সরিষায় নেমে তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব। যা কাজ থাকবে আমাকে দিয়ে দেবে। আমি সেগুলো রেডি করে আবার তোমাকে দিয়ে আসব। না না, তুমি ভেব না এটা কোন চিটিং করা হচ্ছে। সবাই এইভাবেই পাশ করে আসছে। তুমি দেখবে’খন তোমাদের ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রীই এমনটা করছে। তারপর অন্য বিষয়গুলো সব তোমার কেরামতি। তুমি যেমন তৈরী হবে তেমন ফল পাবে। ওখানে বাড়ির লোকের কোন হাত নেই।
বিপ্লবদার কথায় দোনা-মোনায় পড়ে গেল অলোকা। একদিকে গ্র্যাজুয়েট হবার মোহ। অন্যদিকে চাকরির ট্রেনিং। বিপ্লবদা তাকে জোর করছে এই ট্রেনিংটা নেবার জন্যে। এমন সুযোগ নাকি সবসময় আসে না। সব বছর এটা পড়ানো হয় না। কোন বছর হবে তা কেউ বলতে পারে না। পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে জানতে হয়। আর একটা সাংঘাতিক বাস্তব কথা বিপ্লবদা তাকে বলল, যেটা শুনে সে অবাক হয়ে গেল ! বিপ্লবদা এতটা ভেতর থেকে কথাগুলো তাকে বলছে? তাকে নিয়ে, তাদের সংসারকে নিয়ে ও এতটা গভীরে গিয়ে চিন্তা ভাবনা করে! কোন রাখঢাক না করে বলেই ফেলল বিপ্লবদা, “দেখো অলোকা, আমরা নিতান্তই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ বা গরিব ঘরের মানুষ। আমাদের মত ঘরের মানুষরা লেখপড়া শেখে কিসের জন্যে? শুধুই কি জ্ঞান অর্জনের জন্যে? বিদ্যের সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা কি ঘরে বসে সেগুলো ধুয়ে জল খেয়ে বেঁচে থাকব? থাকব না। লেখাপড়ার মাধ্যমে যেমন জ্ঞান অর্জিত হবে। এ তো সর্বকালের সত্য কথা। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা যাতে হয় বিশেষত সেই লক্ষ্য আমাদের সামনে সবসময় থাকবে। এই কোর্সটা করে যদি তুমি চাকরি পাও তো তোমাদের সংসারটাকে এই সর্বগ্রাসী অনটন থেকে মুক্ত করতে পারবে। তাতে তুমি যেমন বাঁচবে। তেমনি দিনরাত পয়সা পয়সা করে হাহুতাশ করা থেকে রেহাই পাবে তোমাদের সংসার। চাকরি করতে করতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে পড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রমাণ ভুরি ভুরি আছে। প্রাইমারী স্কুলের কাজটা নিয়ে তারপর তো তোমার আর কোন পিছুটান থাকছে না। বুক চিতিয়ে তখন তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও।
কে তোমাকে মানা করেছে সেটা করতে? তখন তোমার ওই গ্র্যাজুয়েট না হওয়ার আক্ষেপ আর থাকবে না। তারপর মাস্টার ডিগ্রী করো। আরো করো। ময়দান তো তখন তোমার জন্যে ওপেন। প্রাইমারী স্কুলের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুলে, সেখান থেকে কলেজ-মাস্টার। কোন বাধা নেই। মনে জেদ থাকলে, সেই জেদের সঙ্গে সংগত দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে সব হবে। তবে শুরুর পথ সঠিক বাছতে হবে। তবেই সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।”
এত ভালো ভালো কথা বলল বিপ্লবদা। একটা কথাও যুক্তি দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে না অলোকা। তবু যেন কলেজের আকর্ষণ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কলেজের ম্যাম-স্যারেদের সঙ্গে ক্লাসের পড়াশোনার আদানপ্রদান। বাংলা ক্লাসের কল্যাণী ম্যাম্ তাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখে। প্রথমত সে সমাজের এক অন্তজ শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। তারপর ক্লাসে ম্যামের সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর তার কাছ থেকে পেয়ে যায় বলেই তাকে এতটা পছন্দ করে। বলা যেতে পারে যেন মায়ের আদর সে এই ম্যামের কাছ থেকে পায়। এই ম্যামকে সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। আর ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে মিলমিশ। কত মত বিনিময়। এতসব আকর্ষণ আঠার মত তাকে চিপটে ধরে আছে যেন। এখন সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সে কিছুতেই কলেজ ছেড়ে দিতে পারবে না। বিপ্লবদা ওই যে বলল না, তাদের মত গরিব ঘরে লেখাপড়ার মাধ্যমে শুধু জ্ঞান অর্জনের থেকে আর্থিক স্বয়ম্ভরতা আশু জরুরী। কিন্তু তার মন যেন আর্থিক বিষয়টাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না। একটা বদ বুদ্ধি মুহূর্তের জন্যে তাকে যেন উসকে দিতে উদ্যত হল! সারদা মন্দিরে এই ভর্তির চিঠিটা যদি সে নষ্ট করে দেয় তো কেউ জানতে পারবে না তার চান্স পাবার কথা। বিপ্লবদাও নয়। বিপ্লবদাকে এই চিঠিটা ও না দেখালে তো জানতে পারছে না সে। তাহলে আর কারোর কাছে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। আর সরিষা মা সারদা মন্দিরে গিয়ে কেউ জানতে যাবে না তার চান্স পাবার বিষয় নিয়ে। দিলেই-হয় এটা নষ্ট করে! আর এর বোঝাটা সে যেন বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। ভাবনার ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে, যখন সে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে চাইছে, তখনই রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক সমুদ্রের ঢেউয়ের মত তার উপর আছড়ে পড়ল যেন,“কিরে মা অলোকা? এতক্ষণ ধরে ওই চিঠির খামটা হাতে ধরে দোলায় বসে বসে ভাবছিস কি? কলেজ থেকে এলি। কোথায় পুকুরঘাটে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে একটু কিছু মুখে দিবি। তা না, চুপচাপ বসে কি যে আগডুম বাগডুম চিন্তা করছিস কি জানি! যা-না মা, কলেজের জামা-কাপড় ছেড়ে কিছু পেটে দে-না! এতক্ষণ পেট খালি দিলে, পিত্তি পড়ে যাবে যে পেটে। তখন আর এক বিপত্তি হবে।” বলতে বলতে অলোকার মা ওদিক থেকে তার কাছে আসতে থাকে। দোলাতে বসেই অলোকার চোখ আটকে গেল মায়ের সামনের দিকে আঁচলের শাড়িটার খানিক ছেঁড়া অংশের দিকে! শাড়ির এই ছিঁড়ে যাওয়া অংশের দিকে কিন্তু প্রায়ই ওর চোখ পড়ে। গরিবের বাড়ির বৌ-ঝিদের এমন ছেঁড়া জীর্ণ পোশাক পরাটা ওদের গা-সওয়া ব্যাপার। এতে মনে তেমন আঁক কাটে না। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে যখন জ্ঞান আর ক্ষুধা-অভাবের দ্বন্দ্বে দ্বিতীয়টাকে পাশে সরিয়ে বিদ্যা-জ্ঞানকে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত হচ্ছিল। আগুনের ছেঁকা লাগার মত বুকের ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠল! তাদের অভাবী সংসার মায়ের জন্যে একটা আস্ত শাড়ি জোটাতে পারছে না। কতদিন ধরে মা এমন পোশাক পরে দিন কাটায়। ব্যাপারটা বাবার মাথায় সবসময় কাজ করে। বাবা চেষ্টায় থাকে অবিরত। কিন্তু অক্ষমতা বাবাকে বারবার থমকে দেয়।
এখন কি করবে অলোকা? বুকে ক্রমাগত অভাবের ছ্যাঁকা সহ্য করে শুধুমাত্র জ্ঞানের পেছনে দৌড়বে তো? চিঠিটা কি তাহলে- একটু আগে যেটা ছিঁড়ে ফেলতে সে উদ্যত হচ্ছিল, সেই উদ্যোগ জারি রাখবে তো? এমন অসম যুদ্ধ যেন সে আর জারি রাখতে পারছিল না। চিঠিটা খামের ভেতর ঢুকিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর চলে গেল। কলেজে যাওয়া বাইরের পোশাকেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। মা ততক্ষণে এসে দেখে মেয়ে দোলায় বসে নেই, “এই তো এখানে বসে ছিল মেয়েটা? গেল কোথায় আবার! ঝুলন্ত দোলা বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে মেয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে। আলো আঁধারিতে বুঝতে পারছে না মেয়ে বিছানায় শুয়ে ঠিক কি করছে। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখে, মেয়ের শরীর কান্নায় ঝাঁকা দিয়ে উঠছে,“কি হল রে মা? তুই অমন করে কাঁদছিস কেন? ওই চিঠিটা পড়ার পর থেকে দেখছি তুই কেমন করছিস! কি আছে ওই চিঠিতে? ওটা যদি তোকে এতো কষ্ট দেয় তো ছিঁড়ে ফেলে দে-না। ঝামেলা চুকে যায়। কোথা থেকে চিঠিটা এসেছে, কে পাঠিয়েছে আমাকে বলবি? তাহলে তোর বাবাকে দিয়ে খোঁজ লাগাবো, চিঠি পাঠানদারটা কেমন তারা? আমার মেয়েকে কাঁদায় কেন? সামান্য এক চিলতে কাগজের গায়ে এত জোর!” মায়ের কথায় আর শুয়ে থাকতে পারলো না অলোকা। বিছানায় উঠে বসে বলল,“তুমি চুপ করো মা। না জেনেবুঝে কিসব বোকার মত কথা বলো? চিঠিটা ছিঁড়ে সব ঝামেলা ঝক্কি শেষ হয়ে যাবে? এসব তুমি বুঝবে না। এই নিয়ে একদম চেঁচামেচি করতে যেও না। এখন তুমি যাও মা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। এখন আমার খিদে নেই। একটু পরে আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার কাজ করো গে।” গম্ভীরভাবে অলোকা কথাগুলো বলার পর মা আর মেয়ের বিড়ম্বনা বাড়াতে
চাইল না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মা জানে, তার লেখাপড়া জানা মেয়ের সঙ্গে যুক্তি তর্কে পেরে উঠবে না। সেকথা মা অনেকবার কবুল করেছে। সত্যি তো। চিঠির এ’সবের বিষয় মা বুঝবে কি করে। বুঝিয়ে বললেও বুঝবে না। এক কথার মানে উল্টো বুঝে ভুলভাল কান্ড করে বসবে। তাই অলোকা তার মা’কে এর মধ্যে মাথা গলাতে দিতে চাইল না। কিন্তু পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে তাতে তো দেখা যাচ্ছে তার জীবনে বিপ্লবদার পরামর্শ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বিপ্লবদা এটাও সেদিন বলেছিল, “দেখো অলোকা, সময় প্রতি মুহূর্ত সবাইকে ছুঁয়ে চলে যায়। ও কোন মুহূর্তের ভগ্নাংশেও কারোর জন্যে অপেক্ষা করে না। কিন্তু এই চলার পথে যে তার সঙ্গী হতে চায়, তাকে সে সাদরে সঙ্গ দেয়। এখন সময় তোমাকে বলছে এই বেসিক ট্রেনিংয়ের ফর্ম যত্নের সঙ্গে ভর্তি করতে। আগেও বলেছি, আবার বলছি, যদি তুমি এই সময়কে হেলায় বইয়ে দাও তো সময় কিন্তু আর ফিরে আসবে না। পরে মাথা খুঁড়লেও সে এখনকার এই রূপ নিয়ে তোমার সামনে হাজির হবে না। তাই বলছি, যা গ্রহণযোগ্য তাকে গ্রহণ করো। আর যা নয় তাকে বর্জন করো।”
বিপ্লবদার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন ভেতর থেকে একটা তাড়া তাকে ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে তুলে দিল। কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা মনের যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! তার থেকে কিছুটা বড় বিপ্লবদা। এখনো ‘লোক’ হয়ে যাবার বয়স হয়নি। অথচ এই বয়সে কত পরিণত চিন্তাভাবনা তার। বাস্তবকে এত ভাল করে চেনার শক্তি সে পেল কোথা থেকে কে জানে! ও যেন ‘সূর্য’ হয়ে তার জীবনে অবিরত আলো দান করে যায়। অথচ এই সূর্যকে কত হেলায় দলন-পিড়ন করেছে তাদের পাড়ার ওই মুর্খ- মাতালরা! কলেজের পোশাক ছেড়ে পুকুরঘাটে চলে গেল অলোকা। সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে রান্নাঘরে গেল মায়ের কাছে, “মা, ওই রতন কাকার ছেলে গো, সনাতন। ওকে একটু খবর দিতে পারবে? বলবে আমি ওকে ডেকেছি? আর বলবে, যদি এখন ব্যস্ত থাকে তো কাজ সেরে সময় করে যেন অবশ্যই আসে। খুব দরকার! ভুলে যেন না যায়।”

ক্রমশ…. 

Exit mobile version