জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ ত্রিশ ]
এই প্রথম টানা এতদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটালো সনাতন। সমাজ জীবনের বৃহত্তর পরিসরের সঙ্গে তার এই পরিচয় তাকে কত যে সমৃদ্ধ করল তা সে বুঝিয়ে কাউকে বলতে পারবে না। মা শীতলার আশীর্বাদ ছাড়া এ যে কোনদিন সম্ভব ছিল না তা ভেতর থেকে সে উপলব্ধি করতে পারছে। বাবার কাছে আজীবন মাথা নত হয়ে রইল তার জীবনের এই পরম পাওনা পাবার সুযোগ করে দেবার জন্যে। ওরা এই রুইদাস পাড়ায় বসে কুয়োর ব্যাঙের মত পৃথিবীটাকে বিচার করে। কুয়োর ভেতরে থেকে ভাবে এর চেয়ে বড় জগৎ আর হতে পারে না! প্রথাগত এবং সেইসঙ্গে সামাজিক শিক্ষাদীক্ষায় আমল না দিয়ে দিনরাত জাত কুজাত অজাত বেজাত নিয়ে গুলতানি করে যায় ওরা। অথচ বাংলার বৃহত্তর সমাজ এসবের কোন মূল্যই দেয় না। কলকাতা তথা জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত এইসব মানুষজন ভাবতেই পারে না যে এখনো সমাজে কোথাও কোথাও জাতের নামে আধিপত্যবাদিরা নিজেদের দাপট রক্ষা করার প্রয়াস জারি রেখেছে। সেইজন্যে ওদের সমাজে ওরা শিক্ষাদীক্ষার আলো ঢোকানোতে এতটা নিরুৎসাহ দেখায়। অথচ ওখানকার আলোকিত সমাজে কে কি জাতের মানুষ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই কারোর। বাঙালী অবাঙালী মানুষরা মিলেমিশে একাকার হয়ে কেমন মা দুর্গার আরাধনায় মেতে উঠেছে। একে অপরের সঙ্গে ‘কোলাকুলি’ করছে। পরস্পরের কুশল কামনা করছে। সবাই সব্বাইয়ের বাড়িতে ঢুকে বিজয়ার উৎসব পালন করছে। কে কোন জাত, কে কাকে তার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেবে না দেবে এইসব মধ্যযুগীয় চর্চায় যে তাদের কোন কাজ নেই।
কলকাতার হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের সন্তোষবাবুরা আলবাত জানে যে রতনরা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ। বর্ণাশ্রমের নিরিখে যে এরা চর্মকার মুচি সম্প্রদায় থেকে এসেছে তাও তাদের বিলক্ষণ জানা। তবু সমাজের সর্বোচ্চ বর্ণ, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ব্যানার্জী পরিবার একবারের জন্যে, তাদের মুচি সম্প্রদায়ের মতো বর্ণাশ্রমকে হাতিয়ার করে দূরে ঠেলে রাখেনি।
লক্ষ্মীপুজোর বিসর্জনের পরের দিন সনাতনরা বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দেয়। পাড়ার মানুষজন যেমন হৃদয় ভরে তাদের আশীর্বাদ করেছে তেমনি দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে ঢাকির সিধের সামগ্রী। কি না আছে তাতে! বাচ্চা ছেলেপুলেদের পরার জামা-প্যান্ট থেকে শুরু করে মায়েদের শাড়ী, ছেলেদের ধুতি প্যান্ট। কিছু পুরোনো অথচ ধুয়ে ইস্ত্রী করা, একেবারে নতুনের মতো। কিছু আনকোরা নতুন। প্রত্যেক বাড়ি থেকে পুরোনো সামগ্রীর সঙ্গে নতুন কিছু না কিছু দিয়েছে। হয়তো এখানকার রীতি- শুধু পুরোনো ব্যবহৃত জিনিস দিতে নেই, সঙ্গে নতুনও দিতে হয়! সেইসঙ্গে চাল-ডাল আলু-তেল তো আছে। সব মিলিয়ে ‘মোট’ এত বেশি হয়ে গেছে যে ওদের দু’জনের পক্ষে হাতে-কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে আছে তাদের জিয়নকাঠি, ঢাকটা নিজেই তো একটা বড় মোটের অধিকারি। সতর্ক সন্তোষবাবুর নজর এড়ালো না এই ব্যাপারটায়। এত সবকিছু হেফাজত করে নিজের চারচাকায় তুলে বাবুঘাটে তাদের পৌঁছে দিল ভদ্রলোক! রতন সনাতনদের এমন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে ফেলল মানুষটা যে এ জীবনে এনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না তাদের।
সন্তোষবাবুকে বিদায় দিয়ে সনাতনরা একটা একটা করে জিনিসভর্তি পোঁটলা তিরাশি নম্বর গাড়িতে তুলতে লাগল। ড্রাইভার সিটের পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় রাখতে থাকে ওরা। সেইসময়ই হাঁই হাঁই করে ছুটে এলো কন্ডাক্টরটা, “মাল কোথায় যাবে? এত মাল এখানে তুলছেন, মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? লোকে তো না দাঁড়াতে পারলে আমাদের গালাগাল দেবে। নামান, নামান। এখানে মাল রাখা যাবে না। অন্য গাড়িতে দেখুন। এখানে হবে না।
কন্ডাক্টরের কথায় সনাতন থমকে যায়, “বাবা, এ তো মাল নামিয়ে নিতে বলছে। কি করব এখন? এত মাল আবার নামাতে হবে?
-দাঁড়া না। ভয় পাচ্ছিস কেন। ওরা তো মাল নিয়ে যায়। নিয়ে যায়না তা তো নয়। আমাদের না হয় একটু বেশি মাল আছে। নিয়ে যাবে। দেখনা। আসলে ওরা দর বাড়াতে চাইছে। এটা ওদের স্বভাব। আমরা যাতে ওদের বাধ্য হই। তাহলে ওরা যা ভাড়া হাঁকবে তাই আমাদের দিতে হবে।
রতন শেষ পুঁটলিটা বাসে উঠাতে যাচ্ছে। সেইসময় কন্ডাক্টরটা আবার বলল,“কি হল দাদা, আমি কি বলছি কানে যাচ্ছে না বুঝি? দেখবেন, মালগুলো কেমন নামিয়ে দেবো? তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।
-আরে ভাই, কেন অমন করছো! তুমি তো এমনি নিয়ে যাবে না। তাছাড়া তোমরা যে কোনদিন বাসে মাল তোল না তা তো নয়। কি, তোল না? রোজই কিছু না কিছু মাল নিয়ে যাও, মালের ভাড়া নাও। আমরাও ভাড়া দেব। আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে তোমাদের বঞ্চিত করে মাগনা এগুলো নিয়ে যাব? চলো চলো। যা ভাড়া হয়, সেই ভাড়াই দেব। আমরা দিঘিরপাড় বাজারে নামব।
-মালের জন্যে এক’শ টাকা ভাড়া দিতে হবে। আপনাদের দু’জনের ভাড়া আলাদা। অনেক মাল আছে। এক পয়সা কম হবে না। রাজি না হলে মাল নামিয়ে নিন।
কন্ডাক্টরটরের কথায় চমকে ওঠে সনাতন! বলে কি এই লোকটা! বাস ভাড়া যেখানে কুড়ি টাকা। সেখানে মালের ভাড়া এক’শ টাকা! লোকটার মুখে আটকালো না এই টাকার কথা বলতে! আর চুপ করে থাকতে না পেরে সনাতন বলল,“যে জায়গায় মালগুলো আছে সেখানে ক’টা মানুষ দাঁড়াতে পারে একবার বলবেন? বড়জোর দু’জন ? তা দু’জনের ভাড়া হয় কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ। সেখানে আপনি এক’শ টাকা চাইছেন?” এরপর আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল সনাতন। রতন তাকে থামিয়ে দিয়ে কন্ডাক্টরকে বলল, “দেখো ভাই, আমাদের দেখে তোমার মনে হচ্ছে আমরা বোকা-হাঁদা লোক। তাই তুমি এই অবান্তর কথা বলছো, তাই না? ওটা ভেব না। আমাদের তুমি জোর করে নামিয়ে দিলে আমরা হয়তো নেমে যাব। কিন্তু ওই জায়গায় হয় দুটো লোক দাঁড়াবে। অথবা অন্য কেউ ওখানে মাল রাখবে। তাদের কাছ থেকে তুমি ওই এক’শ টাকা আদায় করতে পারবে তো? যদি পারো, সাহস দাও আমাদের তাহলে আমরা নেমে যাচ্ছি। আমারা নিশ্চিত তুমি তা পারবে না। তাই খামোকা কেন ঝগড়াঝাটির দিকে যাচ্ছো। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কি ঝগড়াঝাটির সম্পর্ক? নাকি তোমার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা আছে? আপোশে মাঝমাঝি একটা কিছু করে নাও। আমাদের দু’জনের ভাড়া বাদে মালের জন্যে আমরা পঞ্চাশ টাকা দেব। তুমি ‘না’ কোরো না, ভাই।”
রতনের যুক্তিযুক্ত কথায় কন্ডাক্টর যেন একটু নরম হয়। পাল্টা কোন আক্রমণাত্মক কথা না বলে বলল,“পঞ্চাশ টাকায় হবে না। আপনি বলছেন, তাই কুড়ি টাকা কমিয়ে দিচ্ছি। আশি টাকা দেবেন। এর থেকে এক পয়সা কম হবে না।”
-আচ্ছা বাবা, তোমার কথা থাক, আমার কথাও থাক। তুমি ষাট টাকা নিও। আর যদি অন্য কেউ মাল নিয়ে ওঠে তো আমাদের মোটের ওপর রেখে দিয়ো। আমাদের কোন ঠুনকো মাল নেই যে তার উপর চাপালে ভেঙেটেঙে যেতে পারে। তাহলে তোমার পুষিয়ে যাবে। আর এতটা রাস্তা, একদম মাল নিয়ে কোন যাত্রী উঠবে না তা তো হবার নয়।
ওদের দু-বাপ-বেটা মালের ডাঁইয়ের সামনের দুটো সিটে বসে সেগুলো লক্ষ্য রাখতে রাখতে চলল। সনাতন জানালার দিকে বসে কলকাতা দেখে আসতে আসতে আবার হঠাৎ হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের এতদিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এলো। ভেসে এলো সন্তোষবাবুর মুখ। ওখানকার মানুষজনের কত কথা। কত আনন্দঘন চিত্র। হঠাৎ সনাতন তার বাবাকে বলে,“বাবা, এখানে এতদিন থেকে একটা ব্যাপার আমার মনে লোহার পেরেক দিয়ে গভীর আঁচড় কাটার মত দাগ দেগে বসল। দেখেছো, এখানে জাত বেজাত উঁচুনীচুর
বিচার কেমন একাকার হয়ে বসে আছে? সব জাতের মানুষ ওখানে আছে। আনন্দ স্ফুর্তি করছে। মেলামেশা করছে। এমনকি সামাজিক আত্মীয়তার সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আর আমরা সেই জাত নিয়ে কি না কড়া অনুশাসন চালিয়ে যাচ্ছি। আজও। সেই বর্ণাশ্রমের ছুৎমার্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। এটা না পারলে আমাদের রুইদাস তো সেই মধ্যযুগের বর্বর রুহিদাস হয়েই রয়ে যাব। না, আমি বলছি না যে আমাদের জাতটা সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাক। সেটা আমরা হতে দেব না। কিন্তু জাতকে ভাঙিয়ে একদল গোঁড়া লোক ফায়দা তুলে যাবে, তা হতে পারে না। ওইসব মনগড়া গোঁড়ামি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে বাবা। আমার এখন খুবই খারাপ লাগে বাবা, তুমি সেই রুহিদাসদের আটচালার অন্যতম একজন মাতব্বর। যেকথা বলছি, তুমি আমার বাবা। তুমি এই মাতব্বরির কাজটা ছেড়ে দাও। আটচালায় যাও। সেটা বারণ করছি না। কিন্তু কলকাতার এখানকার মত আধুনিক মন নিয়ে আটচালায় যাও। বর্ণাশ্রমের লালন থেকে বিরত থাকো। তোমার মত বুঝদার মানুষ যদি আস্তে আস্তে এর বিরোধিতা করতে শুরু করে, দেখবে একদিন আমরা আমাদের সত্ত্বাকে সগর্বে জীবিত রেখেও কত উন্নতি করতে পারছি।”
-তুই আমার মনের কথাই বললি রে সনাতন। সেই থেকে আমিও ঠিক এই কথাগুলোই মনের ভেতর আওড়াচ্ছিলাম। কাজটা ভীষণ শক্ত। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এই অচলায়তনকে ভাঙতে গেলে। তবু একটা কিছু তো করতে হবে।
বাবা যে একই মত পোষণ করছে তাতে সনাতন মনে মনে আশ্বস্ত হয়। বাবার এই বোধে সে নিজেকে গর্বিত বোধ করে। সনাতন মনে মনে যেন শপথ নিয়ে ফেলে যে তাদের সমাজকে এই মধ্যযুগীয় ভাবনা থেকে বার করে আনতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হবে। মুছে সাফ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, সমাজ মনে জমে থাকা যাবতীয় ময়লা। এইসব ভাবতে ভাবতে আর একটা কথা তার মনে জেগে উঠল তার বাবাকে বলার জন্যে,“আর একটা কথা কি জানো তো বাবা? অভয় আমাদের বেকায়দায় ফেলার জন্যে ষঢ়যন্ত্র করে শিয়ালদায় পাঠিয়েছিল। প্রথম দিকে যারপরনাই অপমান আর অপদস্থ আমাদের হতে হয়েছিল ঠিকই। সেদিক থেকে হয়তো ও সফল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভয়ের শাপ আমাদের কাছে ‘বরে’ পরিণত হল। ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’ সেই প্রবাদটাই আমাদের বেলায় খেটে গেল। কিন্তু মনে মনে যে ও এখনো বগল বাজাচ্ছে- আমাদের বিপত্তিতে ফেলার কথা ভেবে। তা আমি নিশ্চিত। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে ওকে আচ্ছা করে কড়িয়ে দেব, এইভাবে আমাদের বিপদে ফেলার জন্যে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওকে কিছু একটা দিয়ে পুরস্কৃত করব। ওর জন্যেই যে জীবনের একটা নতুন দিকের সন্ধান আমরা পেলাম। যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করলাম তা এমনিভাবে কোনদিন হয়তো আমাদের পাওয়া হয়ে উঠতো না। সেই দিক থেকে অভয় আমাদের প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করে ফেলল ওর অজ্ঞানে এবং অজান্তেই।
আমতলায় এসে গাড়ি থামল। এখানে সব বাসই প্রায় অর্ধেক খালি হয়ে যায়। সনাতনদেরটাও তাই। গাড়ি চলা শুরু করতে কন্ডাক্টর এলো তাদের কাছে ভাড়ার টাকা নিতে। বাবার কথামত সনাতন নিজের কাঁধ ব্যাগটা কোলে রেখে তার ভেতর থেকে চুক্তিমত ভাড়ার টাকা দিল। কন্ডাক্টর শুধু তাদের দু’জনের ভাড়ার টিকিট দিয়ে চলে যায়। মালের ভাড়ার জন্যে যে টাকা দিল তার টিকিট দিল না। টিকিট তো টাকা দেবার রসিদের মত। তাহলে সে যা টাকা দিল তার পুরো রসিদ তো কন্ডাক্টরের দেবার কথা। সেই ভেবে সে সিট থেকে উঠে কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাবে, সেই সময় তার বাবা হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিল,“কন্ডাক্টরকে ডাকতে যাচ্ছিস, মালের ভাড়ার টিকিট চাইবি বলে তো? আমি ঠিকই ধরেছি। আরে বোকা, মালের ভাড়ার টিকিট ওরা কেউ দেয় না। ওই টাকা ওদের হিসেবের বাইরে। মালিককে মালের ভাড়ার টাকা ওরা দেয় না। ওই টাকা ড্রাইভার- কন্ডাক্টর ভাগ করে নেয়। এটাই এখানকার রীতি। এটা বাসের মালিকেরও জানা। এই ছাড়টা মালিকরা ওদের দিয়ে রেখেছে। নাহলে ওরা ভাড়া থেকে টাকা হাতসাফাই করবে। ওদের তো জলপানির একটা খরচ আছে। সেটা তো মালিকরা আলাদা করে ওদের দেয় না। কেউ কেউ আবার প্যাসেঞ্জারের ভাড়ার টিকিটও দেয় না। যেমন এই কন্ডাক্টর আমাদের দিয়েছে।”
বাবা, সনাতনকে হাত ধরে সিটে বসিয়ে দেবার পর তার হাতে থাকা টিকিট দুটো ব্যাগে রাখতে গিয়ে সেই খবরের কাগজটা তার চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনটা আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠে! হয়তো এমন দিন এবার থেকে তার আরও আসতে পারে। বা এর থেকে আরও ভালো দিনও আসতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রথম পাওয়া এমন আনন্দর সঙ্গে আর কোন খুশির সময় মেলানো যাবে না। খবরের কাগজটা আবার একবার ভাঁজ খুলে দেখে নেয় তার সোনালী দিনটা ধরে রাখার চিহ্নটা। বিখ্যাত বেঙ্গল পেন্টস প্রত্যেক বছর দূর্গা পূজায় বিভিন্ন পর্যায়ে- প্যান্ডেল, প্রতিমা সজ্জা, আলোক সজ্জা, বাদ্য পরিবেশন ইত্যাদির শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করে থাকে। মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পাবার জন্যে পুজোর সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা সবসময় সেই প্রচেষ্টা করে যায়। রতন-সনাতনদের সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না। বিচারকরা তো কাউকে না জানিয়েই তাদের মত বিচারের কাজ করে চলে যায়। রতনরা ভাবতেই পারেনি তাদের ঢাক বাজনার বিষয় কোনো বিচারে স্থান পেতে পারে। হঠাৎ নবমীর দিন
সন্তোষবাবুরা দলবল মিলে হইহই করে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তাদের কাছে ছুটে এলো, “দেখো রতন, সনাতন- তোমাদের ঢাক-কাঁশি বাজনার ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে! আমাদের পুজো কমিটির মান-সম্মান তোমরা কত উঁচুতে তুলে দিয়েছো! তোমাদের বাজনার পটুতায় তোমরা এ’বছর বিচারকদের বিচারে কলকাতার মধ্যে সেরা হয়েছো। তোমাদের সাথে সাথে আমাদের পুজো প্যান্ডেলের নাম কাগজে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। সত্যিই রতন, তোমাদের বাজনার গুণের অন্ত নেই। যোগ্য শিল্পী যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে। আজ আমাদের কি আনন্দের দিন! প্রত্যেক বছর আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই, কোন পর্যায়ে যদি একটা পুরস্কার পেতে পারি কি না। এখনো পর্যন্ত সেই সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এই তোমাদের হাত ধরে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছুঁতে পারলাম।” বলে হঠাৎ একটা বিশাল চিৎকার করে সন্তোষবাবু বলে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর রতন-সনাতন!” সঙ্গে সঙ্গে সমবেত মানুষজন বলে উঠল, “হিপ হিপ হুররে!” বার তিনেক এইভাবে তাদের নামে সুখ্যাতি যখন করল, সনাতনের বাবা আনন্দে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ডুকরে ডুকরে যেন পাগলের মত কাঁন্না শুরু করে দিল! পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে সনাতন তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“বাবা, কাঁদছো কেন। আজ তো আনন্দের দিন আমাদের। এসো চোখ মুছে বাবুদের সঙ্গে আমরাও আনন্দ করি। তোমার মন ফুঁড়ে শ্রেষ্ঠ বোল তোমার ঢাকে তোলো। সেই তালে আমিও কাঁসর বাজাই আর বাবুদের নাচের পায়ে পা মিলিয়ে যাই।” আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রতন ঢাকের কাঠি হাতে নিয়ে নিল। কতক্ষণ যে সেই বাজনার বোল চরাচরে ডানা মেলে খেলে বেড়াতে লাগল তা দুই বাপ-বেটার যেন কোন হুঁশই নেই! শেষ পর্যন্ত সন্তোষবাবুদের জোরাজুরিতে রতনরা বিরত হতে বাধ্য হল, “রতন-সনাতন, এবার তো আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে হবে না কি? খাওয়া দাওয়া আমরা সবাই করবো তো এবার! বেলা যে গড়াতে শুরু করেছে। কিছুটা পরেই তো নবমীর সন্ধ্যারতির আরাধনায় মগ্ন হতে হবে। চলো রতন, চান খাওয়া করে নিই আমরা। সামান্যর জন্য হলেও একটু বিশ্রাম না নিলে শরীর সায় দেবে কেন!”
সনাতন মনে মনে ভাবল, দিঘিরপাড়ে যারা এই পত্রিকা দেখেছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের ছবি নজর করেছে। এলাকার রুইদাস পাড়ার লোকের ছবি বাংলার প্রথমসারির খবরের কাগজে বেরিয়েছে দেখে তাদেরও খুশি হবার কথা। হয়েছেও নিশ্চয়ই। কিন্তু এ সংবাদ যে তাদের রুইদাস পাড়ার ‘গন্ডি’ টপকাবে না সে বিষয় সনাতন নিশ্চিত। কি করেই বা টপকাবে? যে পাড়া শিক্ষাদীক্ষাকে জীবনের মূল মন্ত্র করে সন্তানদের মানুষ করে না তাদের কাছে এই ছবি দেখা আর অন্ধের হস্তি দর্শন সমার্থক। তাতে অবশ্য সনাতনের কিচ্ছু যায় আসে না। পাড়ায় তাদের নাম বেশি ফাটলে বরং মদওয়ালাদের ডানচোখ নাচবে। তাদের প্রতি ঈর্ষায় জ্বলতে থাকবে। আর সেই জ্বলন নিবৃত্ত করতে ঢকঢক করে চুল্লু গলায় চালান করে দিয়ে বিরামহীন খিস্তিখেউড় শুরু করে দেবে। নিজেদের ব্যর্থতাকে এইভাবেই ওরা তোল্লা দিয়ে যায়। তাকে দমন করে সাফল্যের সু-বাতাস গায়ে মাখতে এখনো তারা শিখে উঠতে পারলো না।
দিঘিরপাড়ে বাস স্টপে স্বাভাবিক সময় থেকে একটু বেশি সময়ই দাঁড়িয়ে রইল বাস। রতন-সনাতন ব্যস্ত তাদের জিনিসপত্র এক এক করে নামাতে। সেই দৃশ্যে বাজারের অনেকের কৌতূহলী চোখ আটকে যায়। কৌতূহল তো হবেই। রুইদাস পাড়ার লোক বাস থেকে কি এত জিনিসপত্র নামায়। কয়েকজন কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েও যায়। বাস চলে যেতে চরাচর আড়ালমুক্ত হলে সনাতন যেন একবুক স্বস্তির বাতাস টেনে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে মিলিয়ে নিতে চায় আগের দেখার সঙ্গে বর্তমানের। রতন বলল, “খোকা, ওই মহাদেব কাকার রোল দোকানের পাশে উত্তমের ভ্যনটা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডেকে আন বাবা।” এত মাল ভ্যান ছাড়া বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না তারা বিলক্ষণ জানে। সনাতন পা চালিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে যেতে যেতেই শুনতে পায় একজন বাবু তার বাবার নাম ধরে বলছে, “কি গো রতন। কাগজে যে তোমাদের বাপ-বেটার নাম দিয়ে-ছবি বার হল। তোমরা ঢাকের বাজনা বাজানোর বিভাগে কোলকাতার মধ্যে প্রথম হয়েছো দেখে খুব খুশি হয়েছি আমরা। বাঃ খুব ভালো। ভালো লাগছে, আমাদের এলাকার মানুষের গুণের কথা ফলাও করে কাগজে প্রকাশ পাবার জন্যে। খুব ভাল হয়েছে। তোমার ছেলেও প্রশংসিত হয়েছে দেখলাম।”
দৌলতপুরের হালদার বাড়ির সুবিরবাবু যখন বাজারের মাঝে গর্বের সঙ্গে গলা চড়িয়ে বলছে তখন সেখানে জড়ো হয়ে থাকা লোকজন শুনে একটু অবাকই হয়ে যায়! ভাবনাটা, কই, তারা তো এত বড় খবরটার কিছুই জানে না? ক’জন লোক আর অত খুঁটিয়ে পেপার পড়ে। সনাতনরাও কি নিয়ম করে খবরের কাগজে চোখ বোলায়? বোলায় না। এখন নেহাত তাদের ছবি কাগজে ছাড়া হয়েছে বলে তারা পেপার-চর্চা করছে। যারা নিয়ম করে পড়ে তারা জানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে মুখে বাজারে চাউর হয়ে যায় রতনদের গুণকীর্তন। প্রায় ভিড় জমে যায় রতন আর বাস থেকে নামিয়ে রাখা তাদের মালপাটকে ঘিরে। কৌতূহলী মানুষের মন কত দিকে যে ধেয়ে যায়, কে বলতে পারে। কেউ ভাবছে রুইদাস পাড়ার লোকটা এত মাল কোথা থেকে আমদানি করল? দু’নম্বরি কিছু নয় তো? যখন আবার তাদের সু-কীর্তির কথা বলাবলি হচ্ছে তখন কেউ বলছে, এতে অনেক জিনিস আছে। পুরস্কার পেয়েছে ওরা ঢাক বাজিয়ে। পেপারে ছাপা হয়েছে ওদের নাম-ছবি! সনাতন দেখল এই মালপাট এক্ষুণি ভ্যানে বোঝাই করে এখান থেকে না সরালে এই ভিড় আর লোক চর্চা চলতেই থাকবে। আর বিলম্ব না করে সে মালগুলো উত্তমের ভ্যানে তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
উত্তমের সাইকেল ভ্যান রুইদাস পাড়ার সীমানা মাড়িয়ে সনাতনদের বাড়ির সামনাসামনি রাস্তায় এসে থামল। রাস্তা থেকে ঢালু পথে গাড়িটা নামানোর জন্যে সনাতন ভ্যানের পেছনটা টেনে ধরে আস্তে আস্তে নামাচ্ছে। সেই সময় অলোকাদি কলেজ থেকে ফিরছিলো। ঢাল থেকে নামতেই অলোকাদি সনাতনকে বলল, “সনাতন একটু দাঁড়া? তোরা তো সাংঘাতিক এক কান্ড করে ফেলেছিস রে। কাগজে খবরটা দেখে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল তোকে একটু আদর করে দিই। সত্যি তুই-কাকা মিলে আমাদের রুইদাসদের গর্ব করার মত কাজ করে ফেলেছিস। রুইদাসদের ইতিহাসে কোনদিন কারোর নাম এভাবে কাগজে ছাপা হয়নি। কি ভালো যে লাগছে না আমার! গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।”
-তুমি খবরটা কোথা থেকে জানলে অলোকাদি? এ সংবাদটা তো শুধু খবরের কাগজে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই কলেজ লাইব্রেরীর খবরের কাগজ পড়ো? তাছাড়া আর জানবে কেমন করে।
অলোকাদি এবার রাস্তা থেকে নেমে সনাতনের কানের কাছে এসে বলল,“না রে, তোর বিপ্লবদা আমাকে কাগজটা এনে দিল। বলল, তোমাদের পাড়ার সনাতন আর তার বাবার ছবি কাগজে বেরিয়েছে। ঢাক বাজিয়ে পুরস্কার পেয়েছে ওরা। এই দেখো, দেখো, কেমন ফলাও করে এখানে ছাপিয়েছে! আমাদের বয়ারিয়া গ্রামের মানুষের এমন খবরে সকলের গর্ব বোধ হচ্ছে। তারপর এরা একদম তোমাদের পাড়ার লোক। তোমাকে না জানিয়ে আর থাকতে পারলাম না। তাই দিঘিরপাড় বাসস্টপে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্যে। সন্ধ্যেয় তুমি কোচিং করে বাড়ি ফিরলে তোমার হাতে এটা দেব বলে। এই নাও। এটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাল করে সংবাদটা পড়ো। পারলে তোমাদের পাড়ার লোকদের জানিও। এদের কীর্তিকথা!” তা আমি আর পাড়ার কাকে জানাব। মা বাবাকে বললাম। মা বাবা শুনে আর তোমাদের ছবি দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। বাবা বলে, রতন আমাদের গ্রামের নাম উজ্জ্বল করে দিল। গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানী- সক্কলে আমাদের গ্রামের নাম জেনে গেল। এ কম খুশির কথা!” যাঃ আর তোকে আটকে রাখব না। অতদূর থেকে আসছিস। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করগে।” আর একটা কথা, বলে সনাতনের কানের কাছে গিয়ে অলোকাদি বলল,“মা আজ নাড়ু বানিয়েছে। আমাদের বাড়ি যাস। তোকে খাওয়াবো। তোর পুরস্কারের সম্মানে আমার তরফে পুরস্কার!”
-তুমি এখন কোথা থেকে আসছো দিদি? কলেজ থেকে? এখন তো পুজোর ছুটি। খুলবে ভাইফোঁটার পর। তোমাদের কলেজে আবার অন্য নিয়ম?
-হ্যাঁ রে ভাই। পুজোর ছুটি ঠিকই আছে। তবে ছুটিতে যাতে পড়া পেছিয়ে না যায় তাই অনার্স ক্লাসগুলোর জন্যে স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে কলেজ। তাই যেতে হচ্ছে।
-কলকাতা থেকে তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি অলোকাদি। তোমাকে জিনিসটা আমি দেব। তুমি কিন্তু ওটা নিতে ‘না’ করবে না। ভালোবেসে আমি তোমাকে দেব। যখন তোমাদের বাড়ি যাব সেটা নিয়ে যাব। ভালোবাসার জিনিস ফিরিয়ে দিতে নেই। না হলে যে প্রাণভরে দিতে চায় তাকে কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়। নেবে দিদি?
-বেশ দামি দামি কথা বলতে শিখেছিস তো তুই, সনাতন। আচ্ছা, ঠিক আছে। সেটা দেখা যাবে। হ্যাঁ, আসল কথাটা তো তোকে জিজ্ঞাসা করা হল না। আমি কিরকম যা-তা দেখ। ওটা আমাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তা কলকাতায় তোদের কোন অসুবিধা হয়নি তো? কোনদিন তো তুই কলকাতায় যাসনি। এই প্রথম।” একটু থেমে আবার অলোকাদি বলল,“কষ্ট আর হবে না? কাকাও শুনেছি এই প্রথম কলকাতায় ঢাক বাজাতে গেল। কষ্ট তো হয়েইছে। আমার মন সেটাই বলছে। তবে তোরা বাপে-ছেলে যা সহনশীল। তোরা সেই অসুবিধাগুলো সামলাতে সক্ষম হয়েছিস বলেই এই সাফল্য পেয়েছিস। এ’ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
[ একত্রিশ ]
যতক্ষণ না রেখা বউয়ের শ্বশুরের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ সে কারবারের কোন কাজই করতে পারবে না। রেখাবউ চেয়েছিল বাড়ির কাজের ফাঁকে কারবারের কাজ যতটা পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু অখিলই তাতে বাধ সাজে। অশৌচ না কাটা পর্যন্ত ঠাকুরের গয়নার কাজে ছোঁয়াছুঁয়ি করা যায় না। শাস্ত্রের বিধানে বাধে। বেমানানও। শোকবিহ্বল এক মহিলার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এমন নির্দয় কাজ করানোয় অখিলের বিবেক সায় দেয় নি। তাতে তার কারবারের লাভালাভে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়বে। পড়বে-পড়বে! তাতে কি? পালপাড়ার স্কুলে পড়া মেয়ে ঊষা, রেখা বউয়ের কাছাকাছি বুদ্ধি ধরে। সেও এই জটিল কাজ অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। এখন তার পুজোর দীর্ঘ ছুটি। স্কুল যাবার জন্যে অন্য সময় তার বেশি কাজ করা হয়ে ওঠে না। এখন সে অনেকটা বেশি কাজ তুলতে পারে। রেখা বউয়ের বরাদ্দ কাজের কিছুটা ওই মেয়েটাকে দিয়ে সে করাচ্ছে। তবে সে রেখা বউয়ের মত অত পাকাপোক্তভাবে দ্রুততার সঙ্গে কাজ নামাতে পারে না। কাজের ফিনিশিংও রেখা বউয়ের মত নয়। এই নকশার কাজটা সেইজন্যে জমে যাচ্ছে। যাচ্ছে যাক। শ্বশুরের কাজ মিটে গেলে রেখা বউ সুদে-আসলে তা মিটিয়ে দেবে। সে আস্থা তার উপর অখিলের আছে।
ভীষ্মর বাপের কাজে টানা তিনদিন সারাক্ষণই রেখা বউদের বাড়িতে থেকে সবকিছু তদারকি করেছে অখিল। মাঝে কোন ফুরসতে কারিগরদের বাড়িতে গিয়েছে কাজের খোঁজ খবর নিতে বা অন্য প্রয়োজনে। যতই ছোট করে গরিবীয়ানায় কাজ করা হোক না কেন তা সম্পন্ন করতে তো একটা খরচ আছে। সেই খরচও যোগান দেবার সামর্থ রেখা বউদের ছিল না। অখিলই মুশকিল আসান হয়ে তাদের সামনে হাজির হল বলেই সবকিছু সামাল দেওয়া গেল। রেখা বউয়ের তাই অখিলের প্রতি কৃতজ্ঞতার যেন অন্ত নেই। ভাল মনের মানুষ না হলে এবং সেই মানুষটার হৃদয় থেকে সাড়া না দিলে আচমকা কেউ এইভাবে অর্থ দিয়ে এবং গতর দান করে তাদের সমস্যার সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। তার সঙ্গে এই মানুষটার কিসের সম্পর্ক? কারিগর আর ঠিকাদারের সম্পর্ক ছাড়া তো আর কিছু না। সে তো সাধারণ নিয়ম মেনে অসুবিধায় পড়া কারিগরকে এককালীন কিছু নগদ হাতে ধরিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলতে পারতো। তার স্বামীর বেলায় যেমন হয়েছিল তেমনি এবারও, কাজের মজুরী থেকে তা আস্তে আস্তে কাটান করে সেই ধার শোধ করে দিতে পারতো। ও শুনেছে লোকে নিখিল ঠিকাদারের এই কাজের জন্যে গুনগুন ফুসফুস করে বেড়াচ্ছে। বিধবা বউয়ের ওপর লোভে পড়ে গেছে রুইদাস পাড়ার এই ছেলেটা। তাই ও, বিধবাটার বাড়ি ঘনঘন আসা যাওয়া করে। কিন্তু সে তো কোনদিন অখিলবাবুর চোখে মুখে লোভীর রেখা ফুটে উঠতে দেখেনি! কক্ষনো এমন ব্যবহার সে তার সঙ্গে করেনি, যেটা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তার প্রতি ওই লোকটার নজর পড়ে গেছে। বরং এমন সভ্য ব্যবহার সে ছাড়া অন্য কারোর কাছে পায় নি। আর নিন্দুকরা যত তাদের নিয়ে অপচর্চা করে, ওই ভাল-মানুষটার প্রতি তার ভাবনা যেন বেশি করে পেয়ে বসে। মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় দিতে তাকে যেন উৎসাহিত করে। এমনিতে ওনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখানোর জন্যে তার এগিয়ে আসার কথা না। সে একজন স্বামীখেকো মেয়েমানুষ। তিনকুলে তার কেউ আর বেঁচে নেই। এই এক আধমরা সদ্যবিধবা বুড়িটা এখন তার জীবনের ছাতা হয়ে নড়াচড়া করছে। এ চলে গেলে তার ভবিষ্যৎ কোন খাতে বইবে তা তার অজানা। তার মত একজন দায়বতী, অচ্ছ্যুৎ যুবতী বিধবার উপর কোন জলজ্যান্ত টগবগে যুবকের দুর্বলতা থাকতে পারে তা সে ভাবতেই পায় না। মানুষ যতই তাদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চালিয়ে যাক না কেন। নিজের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে এই ভাবনা তার মনেও আনা উচিত নয়। একজনের সরলতার সুযোগকে কাজে লাগাতে এমন আত্মপর সে হতে পারবে না। মানুষটাকে তার সম্মানীয় আরাধ্য পুরুষ ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে চায় না। তার প্রতি সে যদি কোন দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে তো তা হবে মানুষটার প্রতি তার চরম অবিচার। এমন এক বড় মনের মানুষকে কেন সে অন্য রঙে রঙিন করার প্রয়াসে সচেষ্ট হতে যাবে! যাবে না সে। এটা তার ধর্ম। এ ধর্ম থেকে সে বিচ্যুত হতে চায় না।
নিয়মভঙ্গের দিন বাড়ির যাবতীয় কাজ সারতে সারতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। পরের দিন অখিলকে কোলকাতায় যেতে হবে। মহাজনের তলব এসেছে। আর সে এই কাজগুলো শেষ করে না গেলে সব পড়ে থাকবে। ডেকরেটরকে একদিনের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। সাইকেল ভ্যানকে বলে রেখেছে। সক্কাল হলেই সে এগুলো নিয়ে ডেকরেটরের ঘরে পৌঁছে দেবে। রাত তখন প্রায় একটার কাঁটা পেরিয়ে দুটোর দিকে টিকটিক করে এগোচ্ছে। রেখা বউয়ের বুড়ি শাশুড়ি পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। রেখা বউকে সব বুঝিয়ে বলে, বাড়ির দিকে পা বাড়াবে ঠিক করে এগিয়ে গেল অখিল, “রেখা বউ, আমি তাহলে এখন বাড়ি যাচ্ছি। আমার যা কাজ করার সব করে গুছিয়ে রেখেছি। সকালে উত্তম ভ্যানওয়ালা এসে ডেকরেটরের মালগুলো সব নিয়ে যাবে। কাল আর দেখা হবে না। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তোমরা সব সাবধানে থাকবে।” কথাগুলো বলে অখিল পেছন ফিরতেই রেখা বউ তার হাতটা টেনে ধরে! রেখা বউয়ের পেলব হাতের স্পর্শ তার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন উতলা হয়ে ওঠানামা করতে লাগল। উথাল পাথাল হতে থাকে ভেতরটা! দ্রুত রক্ত চলাচলে তার শরীরের রোমকুপের গোড়াগুলো ভিজে ভিজে মনে হতে লাগল ! জীবনে এই প্রথম কোন সুন্দরী যুবতীর স্পর্শ সে অনুভব করল। এ অনুভবে যে এমন মাদকতা আছে তা আগে কখনো জানা হয়ে ওঠেনি তার। মনে হচ্ছিল যেন এমন স্পর্শসুখ সে যদি আজীবন পেত, তার জীবন হয়তো সার্থক হয়ে যেত। রেখা বউয়ের হাতটা জোর করে না ছাড়িয়েই তার ছোঁয়াকে হৃদয়ের সঙ্গে একাকার করে নিতে নিতে প্রশ্নমুখো হয়ে ঘুরে প্রকৃতির মুখোমুখি হল। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ থেকে ভেসে এল কথাটা, “অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। যতই কাছাকাছি বাড়ি হোক না কেন। বর্ষার রাত। অনবরত ঝিমঝিম টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বর্ষায় পাড়াগাঁয়ের রাতের রাস্তা একদম ভাল থাকে না। পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করে শিকার ধরার জন্যে। ঠিকাদার বাবু আমি এখন তোমাকে এই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারবো না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় আমি পাল্টে দিচ্ছি। তুমি এ’ঘরে একটু গড়িয়ে নাও। সময় এখন রাত দুটোর কাছাকাছি। এ’পাশ ও’পাশ ফিরতে ফিরতেই ভোর হয়ে আসবে। অন্ধকার ফুঁড়ে ভোর উঁকি দিলেই না হয় বাড়ি চলে যেও। তবে এখন না। আমি পাশের ঘরে শাশুড়ি মায়ের কাছে শুতে যাচ্ছি।”
-নতুন বিছানায় শুলে আমার ঘুম আসে না। উশখুশ করেই রাত কাবার হয়ে যাবে। বাড়ি গেলে তবু কিছুটা ঘুমোনো যাবে।
-ঘুমোনোর জন্যে তো আমি শুতে বলছি না, সময় কাটাবার জন্যে। জেনেশুনে আমি বিপদের রাস্তায় তোমাকে ঠেলে দিতে পারবো না ঠিকাদারবাবু। যে ‘লতায়’ কেটে আমার জীবনে এতবড় সর্বনাশ ঘনিয়ে এলো, সেই লতাকে আমি আবার দ্বিতীয়বার আমার আর এক আপনজনের ‘আয়ের’ হতে দিতে পারি না।
-আমার কাছে টর্চ লাইট আছে। রাস্তা দেখে সাবধানে চলে যেতে পারবো। তাছাড়া আমার মত ডাকাবুকো ছেলেকে ছোবল মারতে এলে সাপ বেটাকে দু’বার ভেবে দেখতে হবে।
-ওইরকম সাহসী ছিল তোমার দাদা। আমার কথা শুনতো না। বলতো,“আমাকে কাটবে এমন সাপ এখনো জন্মায়নি। ও ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সাবধানী।” সেই সাবধানী পুরুষই লতার ছোবলে জীবন দিল তো? ঠিকাদার বাবু, দেখছি তুমিও সেই তেনার মত কথা বলছো। এমন কথা আমার বুকে বড়ো বাজে। বলে, রেখা বউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অখিলের হাত থেকে নিজের হাতটা আলগা করে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল! এরপর অখিলের পক্ষে আর সম্ভব হল না রেখা বউদের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের বর্ষার রাতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। বসে পড়ল রেখা বউয়ের বিছানার উপর। সঙ্গে সঙ্গে আর সময় নষ্ট না করে রেখা বউ ‘পোটমান’ থেকে কাচা চাদর আর বালিশের ওয়াড় বার করে বিছানায় পেতে দিয়ে বাইরের দরজায় খিল আটকে পাশে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। শাশুড়ির পাশে রেখা শুলো বটে, কিন্তু দু’চোখ কিছুতেই এক করতে পারল না। এই প্রথম তাদের বাড়িতে একজন অবিবাহিত বাইরের পুরুষ শুয়েছে। রেখা তাকে জোর করে শুইয়েছে বলা যেতে পারে। কিন্তু এই কাজটা কি সে ঠিক কাজ করেছে? হলই বা সে বিধবা। কিন্তু তার শরীর তো যৌবনে টৈটুম্বুর। উনিশ বছরের মেয়েরা যেমনটা হয়। এই সময় এখনো কত মেয়ের বিয়ে হয় না। বিশেষ করে যারা কলেজে-টলেজের মত উঁচু ক্লাসে পড়ে। সেও যদি লেখাপড়া চালিয়ে যেত তো এখন কলেজে পড়ত। ‘কোদালের’ স্কুলে সিক্স অব্দি পড়ার পর মা আর পড়াতে পারল না। ওখানে আর ক্লাস ছিল না। এখন হয়েছে। তখন পড়তে গেলে তাকে বাইরের স্কুল, ওই ফতেপুর-দোস্তপুর বা মনসারহাট স্কুলে পড়তে যেতে হত। অত খরচ মা যোগাতে পারবে না। ছাড়তে হল পড়াশোনা। তা এই উনিশ-কুড়ি বয়সটা যে মেয়েদের পরিপূর্ণভাবে রূপরস ফুটে ওঠার বয়স। ঠিকাদারবাবুর মত যুবক পুরুষ তাদের ঘরে রাত কাটাচ্ছে! খবরটা পাড়াগাঁয়ে একবার চাউর হয়ে গেলে তার চরিত্র নিয়ে যে জল ঘুলিয়ে স্বচ্ছতার লেশমাত্র রাখবে না তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এসবের জন্যে তার থেকেও ওই মানুষটার উপর চাপ ভয়ানকভাবে এসে পড়বে। অথচ মানুষটার কোন দোষ নেই। আমার কাজ শেষ করার জন্যে এতটা রাত পর্যন্ত তাকে থাকতে হয়েছে। হয়তো এমন কোন বদনামের আশঙ্কায় ঠিকাদারবাবু ওই গভীর রাতেই বাড়ি চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু তাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি! পাছে অন্যকিছু ভেবে বসে! আমার আর অন্য কি ভাবার আছে। আমার তো, বলতে গেলে জীবনের ইচ্ছা আশা আকাঙ্খা বলে আর অবশিষ্ট কিছু রইল না। বিগত-যৌবনাদের মত এলিয়ে পড়া জীবনই এখন আমার ভবিতব্য। ঠিকাদারবাবু যদি তার ভাললাগার কথা টাগরা থেকে বারই করে ফেলতো, তাতেও তার কোন ভাবান্তর হত না। এই অভাগীর কপাল যে পোড়া, সেটা তো অনেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। তা এমন যে মানুষ। যে তাদের উপকার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার শঙ্কার কথা সে ভাববে না? না ভাবাটাই তো নির্লজ্জতা, নির্মমতার পরিচয়। একদিন এমনই শঙ্কার কথা সে তার ভীষ্মকে শুনিয়েছিল। সে শোনেনি তার কথা। চরম বিপর্যয় ঘটল তাদের জীবনে। আবার সেই শঙ্কা যখন তার মনে জাগল এমন এক বিপদহরণ বন্ধুকে নিয়ে, তখন সে তো পদক্ষেপ করবেই। ভীষ্ম তার কথা মানেনি। ঠিকাদারবাবু মেনেছে। লোকের বদনাম আগে না অমূল্য জীবন আগে! রেখা যা করেছে সঠিক কাজই করেছে। তাতে কে কি ভাবলো-না-ভাবলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। কই, তার বিপদে তো ওই গুলতানিপ্রিয় মানুষদের কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না? একজন সংবেদনশীল ভাল মানুষ ছুটে এল বলেই না তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পেল! এমন মানুষের গায়ে যদি কেউ বদনামের পাঁক লেপতে আসে তা সে কখনোই মুখ বুজে মেনে নেবে না। তার পাশে সে দাঁড়াবে। নিজের চরিত্রের বদনামও তাকে দমাতে পারবে না।
নিশ্চুপ চরাচরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের বাড়িঘরও নীরবতার পাঠ নিতে তেমনই মনোযোগী। কেবল দেয়ালঘড়ির কাঁটাটা টিকটিক করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে। রেখার চোখ পড়ল সেদিকে। কখন যেন রাত তিনটের ঘর গড়িয়ে গিয়েছে তার বড় কাঁটাটা! নির্ঘুমে, নিয়ানো আঁচের মত গরম হয়ে যাওয়া চোখদুটোকে আর প্রশ্রয় দিতে চাইল না। বড়বড় চোখ করে তাকে দমাবার জন্যে বিছানায় উঠে বসল। আর শুয়ে থাকা যাবে না। চারটের দিকে কাঁটা ছুটলে ‘ভোরের ঘুম ভাঙার’ সময় এসে পড়বে। তার আগেই ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিতে হবে। বিষাক্ত লতারা অর্থাৎ সাপেরা তখন আর ‘যম’ হয়ে রাস্তায় চৌকি দেবে না। যে যার গর্ত-ঘরে শুতে চলে যাবে রাত জাগার ক্লান্তি মেটাবার জন্যে। এতক্ষণে শাশুড়ি ঘুম কেটে চোখ চেয়ে দেখে রেখা তার বিছানায়, “তুই এ’ঘরে কখন এসে শুলি-রে বউ? ভয় পেয়েছিস? তা পেতে পারিস। কচি মেয়ে তুই। এই বয়সে কত মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে ঘুময়। তারপর এমন পোড়া কপালী হলে তো ভয় পাবেই। তা এখনো তো আলো ফোটেনি। ভোর হতে দেরি আছে। উঠে বসে রইলি কেন, শুয়ে পড় বউ। আমার আর ঘুম আসবে না। আমি তোকে ডেকে দেব’খন। ক’দিন কত না ধকল তোর ওপর দিয়ে গেল। আর রুইদাস পাড়ার ওই ছোকরাটা! রুইদাসদের ঘরে উপরওয়ালা ওকে পাঠালে কি হবে। বড় মাপের মন ছেলেটার। আকাশের মত বড় ওর অন্তর। উপর থেকে যে দেখার দেখছে রে মা। সেই ওকে তোর মত হতভাগিনীর কাছে পাঠিয়েছে। মঙ্গলময় ওর মঙ্গল করবে। কত রাতে বাড়ি গেল রে ছেলেটা? আমার তো আর সবকিছু দেখা হয়ে উঠল না। বুড়ো মানুষ। শরীরটা ধড়ফড় করছিল। তাই শুয়ে থেকে থেকে কখন চোখ লেগেগেছিল। সে খাওয়া দাওয়া করে গেছে তো রে বউ?” আর কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিকাদার বাবুর নামে। শাশুড়িকে থামিয়ে রেখা ফিসফিসিয়ে বলল,“তুমি চুপ করো মা। সে বাড়ি যায়নি। ও’ঘরে ঘুমোচ্ছে। শুনতে পাবে তোমার কথাগুলো। আমি অত রাতে ওকে বাড়ি যেতে দিইনি।”
-ঠিক করেছিস বউ। একদম ঠিক কাজ করেছিস। আহা রে! বেচারা আমার। পর-বাড়ির জন্যে কি খাটান না খাটল এই তিন দিন। ওর ভাল হবে, তুই দেখে নিস বউ।
শাশুড়ি-বউ কথা বলতে বলতে ভোর হওয়ার মুখে এসে দাঁড়ায়। চারটে বাজতে যাচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে রেখা বলল, “মা, এবার ঠিকাদারবাবুকে ডেকে দিই। আলো ফোটার আগে আগেই বাড়ি চলে যাবে বলেছে। পাড়া জেগে গেলে অনেক কু-কথা চাউর হবে। প্রথম সকালের কাজের কাজিরা এবার বাহ্যে ফিরতে বার হবে।” এই বলে ও’ঘরে গিয়ে দেখে ঠিকাদার বাবু দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ক’দিনের খাটাখাটনির শরীর এমন বিশ্রামই চাইছিল। কিন্তু তবু নির্দয় হতে হবে রেখাকে। অমন শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে হবে তাকে। তাছাড়া কি করার আছে তার? না হলে যে তাদের আবার অন্য পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। সেটাও তো ঠিক না। তখন আবার ঠিকাদার বাবু তাকে দুষবে। তার থেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়াই কাজের কাজ হবে। বার তিনেক ডাক দিল ঘুম থেকে ওঠার জন্যে। কোন সাড়া নেই। এবার কি করে সে? গা ঠেলে না ডাকলে তো এ ঘুম ভাঙবে না। ঘুমের গভীরে এখন এ। সরাসরি গায়ে হাত দেবে? সেটা কি তার মত মেয়ের পক্ষে ঠিক হবে? অন্য কিছু ভাববে না তো? বর-খাকি বউটা গায়ে-পড়া হয়ে তাকে ঠেলাঠেলি করছে, ভেবে নেবে না তো? তাহলে এক কাজ করা যাক। হাতে হাত দিয়ে চাপ দিলে অন্যরকম কিছু মানে করবে না নিশ্চয়ই ! হাতে হাত দিতেই পারে সে। যেমন হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছিল রাতে বাড়ি যেতে দেবে না বলে।
হঠাৎ এক আদরমাখা ছোঁয়ার অনুভূতি তাকে যেন পরম তৃপ্তি দান করে চলেছে! ঘুমের ঘোরে সেই অনুভবকে সে যেন কিছুতেই নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে না। তাই সে তার প্রতিক্রিয়া জাগতিকভাবে দিতে একদম পছন্দ করছে না। একবার এই পাওয়া থেকে তাল কেটে গেলে যদি আর তা ফিরে না আসে! ঘুমে-জাগরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখন অখিল। কিন্তু অনুভবে সুখের অস্তিত্ব তো ক্ষণস্থায়ী। তাই হয়তো রেখা বউয়ের স্পর্শের সাথে গলার বাড়তি স্বরে চমক ভাঙে অখিলের ! উঠে বসে ধরফড়িয়ে! কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে রেখা বউ, “আমার ওপর রাগ করবে না ঠিকাদার বাবু। জানি ক’দিনের কঠিন পরিশ্রমে তোমার শরীর বড়ই ক্লান্ত। তাছাড়া এখনও তো সকাল হয়নি। ঘুম ভাঙার সময়ও নয়। অসময়ে ডেকে দিতে বাধ্য হলাম। আলো ফুটে গেলে লোকে দেখে ফেলবে তুমি আমাদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছ। তখন আর এক বিপত্তি। তাই অসময়ে জাগিয়ে তুলতে আসা।” অখিল তার প্রতি বিরক্ত হয়নি। অখিলের চোখ মুখের ভাষা পড়ে বুঝতে পারে রেখা। গোঁফের কাছে হাল্কা হাসির রেখা। কি অনুভবে এই হাসির ফুলকি কে জানে! এবার সে মজা করে বলল,“কখন থেকে হাতে ঠেলা দিয়ে ডাকাডাকি করছি। কোন সাড়া নেই। যেন মটকা মেরে পড়ে আছে। জোরে ডাক দিয়ে ডাকতে তারপর তাড়াতাড়ি করে উঠলে। ভাবলাম কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। রাগে কি না কি বলে বকাবকি করবে আমায়। তাই ভয় পেয়ে যাই। কিছুই তো বললে না। বাঁচলাম। অন্ধকার পাতলা হতে শুরু করেছে। পুবাকাশ থেকে এবার ভোরের আলোর ছটা উঁকি মারবে। একটু চা করে দেব? চা খেয়ে যেতে? আবার তো সকাল সকাল কলকাতায় ছুটতে হবে বলেছিলে।”
তুমি কেমন করে বুঝবে রেখা বউ! তোমার এই স্পর্শের মহিমায় কি সুখ আমাকে পাইয়ে দিলে। হতে পারে এই স্পর্শ তোমার কাছে নিতান্ত কর্ম প্রয়াস মাত্র। কিন্তু আমার কাছে যে এ যুগান্তরের পরম প্রাপ্তি। হয়তো কত কাল ধরে এই পাওনার খোঁজে ফিরি করে চলেছি। এতদিনে তা পাবার জন্যে সাফল্যের কয়েক ধাপ এগোতে পেরেছি। তুমি এসব এখনো বোঝোনি রেখা বউ। তাই আমার এই অনুভবে তোমার অনুভব এখনো একাকার হয়ে উঠতে পারেনি। এমন ভাবনার ঘোর থেকে যেন কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইছে না অখিল। তাই রেখা বউয়ের কোন কথার উত্তর না দিয়ে পুলকে মনকে জারিয়ে রাখতে চাইছে। হোক ভোর হোক সকাল। নাই বা হল তার কলকাতায় যাওয়া আজ। এমন পরমপ্রিয় পরশ-সুখের ওই ভোর, সকাল, কলকাতার কাছে চাইলে তারা তাকে দিতে পারবে? পারবে না। পারবে না যখন তখন ওসবে ধ্যান দিয়ে তার কি লাভ! ওদিকে ধ্যান দিলেই হারিয়ে যাবে এ অনুভূতি। এই হারিয়ে যাবার ভাবনা অখিলের ইন্দ্রিয়কে যেন হঠাৎ সজাগ করে তোলে! দু’হাত জড়ো করে চোখ মুখে বুলিয়ে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে বসে বিছানায়। এতক্ষণের নিরিক্ষণে রেখা বুঝতে পারে তার ঠিকাদার বাবুর ঘুমের ঘোর কাটতে চলেছে,“কি গো বাবু। তখন থেকে কথাগুলো যে বললাম, একটাও বুঝি কানে পশেনি ? একটু চা করে দেবো বাবু ? তাড়াতাড়ি তৈরী করে আনছি। ওই পেতল-ঘটিতে জল আছে। চট করে চোখ-মুখ ধুয়ে নাও তুমি। শুকনো মুখে বাড়ি থেকে বার হতে নেই। গৃহস্থের অকল্যাণ হয় তাতে।” এই কথাটা যেন কত যোজন দূর থেকে আকাশবাণীর মত তার কানে এসে বাজলো! হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়া এমন কথা একমাত্র তারই জন্যে কিনা কে বলতে পারে! যে বলে সে তার নিতান্ত আপনজন ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। এমন জনের কথা অখিল না মেনে পারবে কেন! আর অখিল সঙ্গে সঙ্গে সময় নষ্ট না করে ঘটির জল নিয়ে বারান্দার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল।
রেখা বউয়ের হাতে বানানো চা খাবার পর কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়া ঝিমোনো শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল। ভেতর থেকে তাড়া এল বাড়ি যাবার জন্যে। “আর দেরি করা যাবে না।” রেখা বউকে সে কথা জানাতে রেখা কাল বিলম্ব না করে বাইরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “সাবধানে যেও ঠিকাদারবাবু।” বলে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অখিলের চলে যাওয়া দেখতে লাগল। কি মনে করে অখিল একবার পেছন ফিরে তাকাল। দেখে রেখা বউ এখনো তার চলে যাওয়া কত উদাস নয়নে নিরিক্ষণ করে চলেছে। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা কয়েকবার কেমন যেন ধকধক করে উঠল! তার ভেতরটা এমন করে উঠল কেন? রেখা বউ বা তার দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকে নিয়ে কি ভাবছে? তারও ভেতরটা তেমন উতলা না হলে এমনটা অখিলের বা হতে যাবে কেন। রেখা বউ কি তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে? অখিলের মনও কি সেই কথা বলতে চাইছে যে “আমিও তোমাকে ভালবাসি, রেখাবউ” কিন্তু সে তো মেয়েমানুষ। তার উপর আবার বিধবা। সরাসরি তাকে অখিল কেমন করে ভালবাসার কথা বলবে, সেটা তো বুঝে উঠতে পারছে না। জোর করে তো আর ভালবাসা আদায় করা যায় না। অপরপক্ষের অন্তরের ডাক আসা দরকার। এই ভোররাতে মমতাভরা ছোঁয়া আর যত্ন নিয়ে চা করে তাকে খেতে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই ডাকের ইঙ্গিত দিয়ে দিল সে! কি জানি! সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অখিলের।
রেখা বউদের বাড়ি থেকে তার বার হতে দেখলে লোকে অনেক কথা বলতে পারে। তাই রেখা বউ তাকে ভোরের জন্ম হবার আগেই আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে অখিলকে বাড়ি যাওয়াতে সায় দেয়। অখিলও রেখা বউয়ের কথা মাথায় রেখে সেই সায়ে তার সায় মিলিয়ে দেয়। মেয়েদের চরিত্র নিয়ে রসালো চর্চা চিরদিনই পছন্দ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অকেজো মানুষ জনেরা। তার উপর রেখা বউয়ের মত বিধবা যুবতী যদি সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় তো কথাই নেই। অখিল তাই বাইরের চরাচরের অলক্ষ্যেই দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তার বিশ্বাস তাকে কেউ এখনো দেখতে পায় নি। এইসময় কোন মানুষের বাইরে বার হবার কথা নয়। এটা এমন একটা সময় যখন নিশাচরেরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় আর প্রাতঃভ্রমণকারীরা প্রস্তুতি নেয় এবং অপেক্ষা করে ভোরের চোখ আর একটু বড় করে খোলার জন্যে। তবুও অখিল পুরোপুরি আশ্বস্ত যেন হতে পারছে না। ওর বিশ্বাস কোনভাবেই তার এই রাত্রিবাস এবং সকলের অগোচরে এমন সময় নিজের বাড়ি চলে যাবার ঘটনা মানুষকে এড়াতে পারবে না। ওর মনে হয়, তার এই চলনদৃশ্য আর কেউ দেখুক না দেখুক
চরাচরের চোখকে তো সে এড়াতে পারছে না। লোকে বলে না
-দেওয়ালেরও কান আছে। তেমন তার মনে হয় চরাচরেরও ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ আছে। ওর চোখের আয়না দিয়েই সংবাদটা মানুষের কান কোন না কোন সময় ছুঁয়ে যাবে। সে যায় তো তার বা কি করার আছে। অখিল রুইদাস তাতে ভীত নয়। ও ভীত নয় আটচালার কামচোর নিন্দুক একদল অকর্মণ্য মাথাদের আলোচনা সমাচোলনায়। দিন যত এগোচ্ছে, দিনযাপনের পদ্ধতিরও পরিবর্তন হচ্ছে। আগেকার যুগের সেই অচলায়তন সমাজব্যবস্থা আর চলতে পারে না। তাদের সমাজের মত যারা সেই সাবেক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে, তারাই অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। উন্নত আধুনিক সমাজ থেকে তারা দূর আরও দূরে সরে যাচ্ছে। আটচালা তাকে এই কাজের জন্যে কৈফিয়ৎ চাইলে সে কৈফিয়ৎ দেবে। গর্বের সঙ্গে দেবে। তার এই ভাবনার কথা জোর দিয়ে সকলের সামনে প্রচার করবে। তারপর দেখা যাবে কি শাস্তি তারা তাকে দেবার সাহস দেখায়। তাদের সমাজে তার মত প্রজন্মের যুবক যুবতীরা চায় সেই মধ্যযুগীয় সমাজ ভাবনা থেকে মুক্ত হতে। আসলে প্রথম এই ভাবনা সমাজের সামনে তুলে ধরার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। তাই নবযুগের ভাবনা এখনকার যুগের হৃদয় থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে সময় দিতে হচ্ছে। সেই উপযুক্ত সময়, যে সময় শুধু আধুনিক চিন্তা ভাবনার স্ফুলিঙ্গ দেশলাই কাঠির মত যদি কেউ ঠিকরে বার করতে পারে, সেই সময়ের। তেমন হলে অখিলই প্রথম সেই দেশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে দেবার সাহস দেখাবে। তারপর আর তার একা হয়ে থাকতে হবে না। এ বিশ্বাস তার পুরোপুরি আছে।
গ্রামের মেন রাস্তা থেকে তাদের রুইদাস পাড়ার দিকে ঢাল হয়ে নেমে যাওয়া গড়ান রাস্তা কয়েক পা দ্রুত চালান দেবার পর ধীর পদে এগোতে থাকে অখিল। একটু এগোলেই বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে পাড়ার আটচালা। ওটার ভেতরে টিমটিমে বাল্বের আলো চরাচরের সীমাবদ্ধ অংশে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। হঠাৎ অখিল দেখতে পেল, সেই আলোর ছটায় কে যেন আটচালার আড়াইফুটি ঘেরা দেয়ালে মাথা লুকলো! কে? কে ওখানে? বলে গলা চড়াল অখিল। কোন সাড়া নেই। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে দেখে তাদের পাড়ার হেড়ো পাগলা! দেয়াল ঘেঁষে কাত্ হয়ে শুয়ে। টুকটুক করে আবার তার একটা পা নড়ছে! মটকা মেরে শুয়ে আছে,“এই শালা হেড়ো! ওঠ? ভাবছিস আমি বুঝতে পারব না, তুই মটকা মেরে শুয়ে ঘুমের ভান করে আছিস, তাই না? দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কি দেখছিলিস? শালা পাগলার মরণ! ওঠ শালা”
ক্রমশ…