কলিকালে
-শচীদুলাল পাল
স্নিগ্ধ বাতাসে ও ভোরের আলো এসে চোখে লাগতে ঘুমটা ভেঙে গেলে অনিরুদ্ধ দেখলো ঘরের দরজা খোলা।
বিছানা থেকে নেমে ঘর, উঠান, বেড়ার ধার, রাস্তা খুঁজে স্ত্রীকে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত মনে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো। গতকাল রাতে স্ত্রী উশ্রীর সাথে কথাকাটি হয়েছিল।
— আমি এ বাড়িতে থাকবো না। তোমার সাথে ঘর করবো না।
— আমি তোকে ভালোবাসি।
— ভাত কাপড় দেবার মুরোদ নেই শুধু ভালোবাসি বললেই চলবে।
— আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু কি করবো বল। আয় কিছুতেই বাড়ছে না। বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে, ঘরে ঘরে পেপার দিয়ে কতটুকু আয় হয়!
কিন্তু উশ্রী যে কোথায় গেল!
এভাবে দিন দুয়েক কেটে গেল। অনিরুদ্ধ ভেবেছিলো হয়তো কোথাও আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়েছে, ফিরে আসবে। কিন্তু উশ্রি আর ফিরে আসেনি।
আজ থেকে বছর দুয়েক আগে একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে টিউশন সেরে ফেরার পথে এক গাছ তলে দেখা হয়েছিল উশ্রীর সাথে। বছর ষোলোর কুমারী সদ্য যৌবনা সুন্দরী উশ্রী কোলে বাচ্চা নিয়ে কাঁদছে।
কৌতুহল বশত কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেছিিল,
— আমি এক পুরুষের লালসার শিকার। আমি গরীব বিধবা মায়ের সন্তান। পেটের দায়ে এক বাড়িতে কাজ করতাম। আমার তখন চৌদ্দ বছর বয়স।সে বাড়ির মালিক আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে সম্ভোগ করতো দিনের পর দিন। সে অনেক টাকা দিতো। হাভাতে অবস্থা থেকে আমাদের অবস্থা সচ্ছল হয়েছিল। কিন্তু যখন পেটে বাচ্চা এলো তখন ওই শয়তানটা বলেছিল,
— বাচ্চাটাকে অন্য কোথাও অন্য শহরে জন্ম দে। অনেক টাকা দেব। তোকে বিয়ে করব। মালিকের কথামতো অন্য শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মা ও আমি থাকতাম। সেখানেই জন্ম হলো আমার বাচ্চার।
তারপর আমি ও মা একদিন বাচ্চা নিয়ে তার কাছে গেলে ‘বেশ্যা মাগী” বলে লাথি মেরে দূর করে দিলো। এখন আমার মাথার উপর এক বিরাট বোঝা। আমি অন্ধকার দেখছি। আমি বাচ্চটার মোহে আত্মহত্যা করতেও পারছিনা।
আমি তখন দয়া পরবশ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
— আমি তোকে আত্মহত্যা করতে দেব না। আমি তোকে আশ্রয় দেব।
— কিন্তু কুমারীর এই সন্তান কি তোমার পরিবার মেনে নেবে?
— আমি তোকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেব।
আমি উশ্রী আর তার সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে গেলাম। মা-বাবা দাদা-বৌদি ভাইপো-ভাইজিকে নিয়ে আমাদের পরিবার। পরিবারের সবার সামনে ঘটনাটা খুলে বললাম। সব শুনে তারা কেউ ঠাঁই দিতে রাজি হলো না। বাবা বললো,
— এই বেশ্যা মেয়েকে আমার ঘরে আশ্রয় দেব! তুই ভাবলি কি করে! মেয়েটাকে ত্যাগ কর। ছেড়ে দে।
— তা হয়না বাবা। আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি আমি বিয়ে করবো।
— বেরিয়ে যা। কুলাঙ্গার। তোর মুখ আমি দেখতে চাই না।
-এই বাড়ির কিছু অংশ আমার প্রাপ্য। সেখানে একটা ঘর নিয়ে থাকতে দাও। আমি আলাদাই থাকবো।
–এই বাড়ির ত্রিসীমার মধ্যে তুই ঢুকবি না। তোকে আমি ত্যজ্যপুত্র করলাম।
এই বলে লাথি মেরে দূর করে দিল।
এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বস্তিতে এক দরমার ঘরে আশ্রয় নিলাম দুজনে।
অষ্টাদশী উশ্রী ছিলো উগ্র যৌবনা। যতো না সুন্দরী ছিল তার চেয়ে বেশি রূপসী মনে করতো নিজেকে। সাজগোজ করতে ভালোবাসতো। বাচ্চাটাকে খাটের সাথে বেঁধে সে কোথায় যেন যেত। অনেকদিন অধিক রাতে ঘরে ফিরতো। নিত্যনতুন নিজের জন্য অত্যাধুনিক সাজপোশাক বিলাস সামগ্রী কিনতো। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতো। আমি কিছু বলতাম না।
বাচ্চাটাকে যত্ন করা, দুধ খাওয়ানো, পরিস্কার করা ইত্যাদি কাজ আমিই করতাম।
আমার কেমন যেন একটা মায়া জন্মেগেছিল বাচ্চাটার উপর।
একদিন রাত্রি আটটা নাগাদ ঘরে এসে দেখি উশ্রি ফেরেনি। কিন্তু বাচ্চাটা গেল কোথাায়! দুশ্চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হলাম। এদিক ওদিক অনেক খুঁজলাম। দেখতে পেলাম না। অনেক রাতে উশ্রী এল। মুখে মদের গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই মদ খেয়েছিস?
— হ্যাঁ। বেশ করেছি।
— বাচ্চাটা কোথায়?
— বেচে দিয়েছি।
— মানে!
— মানে বিক্রি করে দিয়েছি।
এই দ্যাখো কত টাকা।
বাঁচতে গেলে টাকা চাই। বুঝলে। আমি আমার যৌবন এমন ভাবে হেলায় তোমার কাছে গচ্ছিত রাখতে পারব না।
— আমি তোকে আশ্রয় দিতে গিয়ে আমার মা-বাবা, সংসার, বংশ, স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি সব ত্যাগ করলাম। আর তুই কিনা টাকার জন্য নিজেকে আর বাচ্চাটাকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিলি!
সেই থেকে বুঝতে পেরেছিলাম উশ্রী উগ্র যৌবনা দেহ স্বর্বস্ব এক মেয়ে।তার মন বলে কিচ্ছু নেই। সে আমার সাথে ছলনা করেছে।
তবুও তাকে আমি ভালোবাসতাম।তার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়েছিলাম।
কোনো দিন প্রতিবাদ করিনি।
ওর পাপের টাকা কোনো দিন ছুঁইনি। আমার স্বল্প আয়ে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিন আমার সংসার ছেড়ে আমার বুকে তীর মেরে কোথায় যে চলে গেলো।
কিন্তু তার এই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিনি।
বস্তির লোকেদের সাথে রঙ মিস্তিরির কাজ করি। প্রায় প্রতিদিন কাজ থাকে। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে অতীত ভুলবার চেষ্টা করি।
এক ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত হলাম। সেখানে বছরভর নানান অনুষ্ঠান হতো। খুব স্বল্প সংখ্যক লোকজন আসতো। মানুষের সনাতন ধর্মের প্রতি টান একেবারে তলানিতে। একদিন এক ধর্মীয় উৎসবের অনুষ্ঠানে এক প্রবচন প্রবক্তা বলছিলেন কলিযুগ প্রসঙ্গে —
কলিযুগ হল হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ। অন্য যুগগুলো হল সত্যযুগ, ক্রেতাযুগ ও দ্বাপরযুগ। বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে, যেদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন সেদিন থেকেই পৃথিবীতে কলিযুগের সুচনা হয়েছে। পুরানে আছে—
ছলনা, মিথ্যা, আলস্য, নিদ্রা, হিংসা, দুঃখ, সুখ, ভীতি, দীনতা
লোভ, শঠতা, ঠকবাজি, অমানবিকতা কলি যুগের বৈশিষ্ট।
বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সব কিছু সৃষ্টি করেন এবং কলিযুগে সমস্ত কিছু ধ্বংস করেন। বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী কম ধনের অধিকারী হয়ে মানুষ এই যুগে বেশি অহংকার করবে। ধর্মের জন্য অর্থ খরচ করবে না। ধর্ম গ্রন্থের ওপর মানুষের আকর্ষণ থাকবে না।মাতা পিতাকে মানবে না।
পুত্র পিতাকে হত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে কুণ্ঠিত হবে না। ধর্ম অনুসারে কেউ বিবাহিত থাকবে না। স্ত্রীলোকেরা নিজেকে সুন্দরী মনে করবে। ধনহীন পতিকে মহিলারা ত্যাগ করবে। আর ধনবান পুরুষরা সেই নারী গনের স্বামী হবেন।
কলিযুগে মানুষ ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় না করে কেবল গৃহ নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করবে। মানুষ পরকালের চিন্তা না করে কেবল অর্থ উপার্জনের চিন্তায় মগ্ন থাকবে। কলিযুগের নারীরা সাধারণত স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবে এবং পুরুষেরা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করতে অভিলাষী হবে।
অসমর্থ মানুষেরা ধনহীন হয়ে পেটের জ্বালা ও ক্লেশ ভোগ করবে। কলিযুগে মানুষ যা কিছু ভোজন করবে। কলিকালে স্ত্রীলোকেরা নিতান্তই লোভী হবে, বহু ভোজনশীলা হবে। মহিলারা অনায়াসে পতি আজ্ঞা অবহেলা করবে।
নারীরা নিজের দেহ পোশাকে ব্যস্ত থাকবে, কঠোর ও মিথ্যা কথা বলবে। কলিকালে চোদ্দ থেকে ষোল বছরের বালকরা সহবাসে, বারো থেকে চোদ্দ বছরের বালিকারা সন্তান প্রসব করবে। কলিকালে মানুষের বুদ্ধি অতি অল্প হবে, তাদের ইন্দ্রিয় প্রভৃতি অতিশয় অপবিত্র হবে।
যখন পাষণ্ড লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে তখন সমাজের ভালো লোকেরা কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকবে না। সুন্দরী স্ত্রী যার তার সাথে বন্ধুত্ব করবে।
একদিন কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি।দেখলাম পাড়ারই এক বাড়ির সামনে জটলা। বাড়ির মালিক মারা গেছে। তার শব পড়ে আছে।
মৃতদেহ স্টিফ হয়ে গেছে। সকাল থেকে বেশ কয়েকজন ডাক্তার এসে ফিরে গেছে। কেউ ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছে না।
লোকটা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত ছিল। ঘরে স্ত্রী, যোয়ান মেয়ে ও ছেলে।
লোকে বলাবলি করছে, লোকটার ছেলেটা বোনের সাথে এক বিছানায় শুতো। ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলিত হতো। লোকটা প্রতিবাদ করতো। তীব্র প্রতিবাদ করায় গতকাল রাতে তুলকালাম ঝগড়াঝাটি হয়েছে। পাড়ার লোকেরা শুনেছে। অবশেষে গতকাল রাতে স্ত্রী পুত্র কন্যা মিলে গলা টিপে লোকটাকে মেরে দিয়েছে। সকালবেলা শুনলো লোকজন রাতে চলে গেলে এক হাতুড়ে ডাক্তার এসে অনেক টাকা নিয়ে নরম্যাল ডেথ সার্টিফিকেট দিলে পাড়ার লোকজনের সহায়তায় রাতারাতি শ্মশানে নির্বিঘ্নে দাহ সম্পন্ন করেছে।
আমি রঙ মিস্ত্রির কাজ করি এক বড়ো প্রমোটারের অধীনে। একদিন এক নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কাজ করছি। হঠাৎ অত্যাধুনিক সাজে স্বল্পবাস পরিহিতা এক মেয়ের উপর নজর পড়লো। গাড়ি থেকে নামছে। সাথে এক মধ্য বয়সী ধোপদুরস্ত লোক। দূর থেকে দেখলেও চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওইতো উশ্রী। ফর্সা সুন্দরী উশ্রী আরও সুন্দর হয়েছে। পরিপুষ্ট নির্মেদ শরীর। শরীরে এক চমক, এক মাদকতা। এই দুবছরে অনেক পরিবর্তন।
পাশের এক বিল্ডিংএ যাচ্ছে।
উশ্রী অশালীন পোশাকে লোকটার ঘনিষ্ঠ হয়ে এক ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। আমি দূর থেকে নিয়মিত অনুসরণ করে ও আবাসনের এক সিকিউরিটি গার্ডের সাথে ভাব করে জানতে পারলাম —
উশ্রী এক নষ্ট মেয়ে শুধু নয় এক চিটিংবাজ। এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে তার শিশু পুত্রটিকে অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছিলো। পরে বেইমানি করে জোর জবরদস্তি করে শিশুটিকে ছিনিয়ে এনে অন্য একজনকে মোটা টাকায় বিক্রি করে। ফ্ল্যাট কিনেছে, গাড়ি কিনেছে। বহু টাকার মালকিন। এখন সে এক কুখ্যাত মাফিয়ার রক্ষিতা। অশিক্ষিত মাফিয়াটি এ অঞ্চলের বেতাজ বাদশা। তার এই প্রকাশ্য ব্যভিচার এই আবাসনের সবাই সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে।উশ্রীকে সবাই ভয় করে।
-আচ্ছা। ওই যে লোকটা উশ্রীকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো সেই কি মাফিয়া?
–না। উনি মাফিয়া নন। উনি এক বিখ্যাত শিল্পপতি। উশ্রীর নতুন শিকার।
-কেউ কিছু বলে না?
-বলবে কি? এখন উশ্রী ধন ও মদমত্তে গর্বিত এই হাজার ফ্ল্যাট সমৃদ্ধ আবাসন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তার অঙ্গুলিহেলনে সবাই উঠবোস করে।