বিষ
-মুনমুন রাহা
আজকের রবিবারটা অন্য রবিবারগুলোর মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্ত সকালে বাজার থেকে এসে নিশিত যা খবর দিল তাতে মান্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মান্তুদের পাড়ায় অম্বিক আর তার বৌ নীতা নাকি একসাথে বিষ খেয়েছে। সকালের রান্নার লোক এসে অনেক ডাকাডাকি করেও যখন তুলতে পারেনি তখন পাড়ার ছেলেদের খবর দেয় আর তারপর তারাই দরজা ভেঙে দুটো মৃতদেহ উদ্ধার করে।
খবরটা শুনে থেকে মান্তুর মনটা কেমন যেন খচখচ করছে। খুব যে আলাপ ছিল ওদের সাথে তেমন নয়। কিন্ত নীতা মেয়েটাকে অফিস যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই দেখত মান্তু । কেমন যেন উদাস চোখে জানলার বাইরে দেখত। মুখ চেনা ছিল তাই চোখাচোখি হলে হাসি বিনিময় হত। কিন্ত ঐটুকুই। এর বেশি সেভাবে আলাপ ছিল না মান্তুর সাথে । আরও ভালো করে বলতে গেলে নীতার সাথে পাড়ার কারোরই সেভাবে আলাপ ছিল না । কেমন যেন ঘরকুনো প্রকৃতির মেয়েটা। অম্বিক বরাবরই নিজেকে নিয়েই থাকত । পাড়াতে খুব একটা মিশত না। কিন্ত সবাই ভেবেছিল ওর বৌ এসে এই দূরত্ব ঘোচাবে। কিন্ত বৌ নীতাও স্বামী অম্বিকের পথই অবলম্বন করল।
তবে মান্তু অম্বিকদের খবর মাঝেমাঝেই পেত পম্পার কাছ থেকে। পম্পা হল মান্তুদের বাসন মাজার লোক । সে আবার নীতাদের বাড়িতেও কাজ করত। সে মাঝেমাঝেই বলত অম্বিকের পয়সা থাকলেও নাকি তার মন খুব ছোট। নীতার আর অম্বিকের নাকি মিলমিশ নেই। আরও নানান কথা বলত কিন্ত মান্তু কোনোদিনই উৎসাহ দেখাত না এসব কথায়। অন্য লোকের হাঁড়ির খবর শুনতে কেমন যেন রুচিতে বাধত মান্তুর।
পরদিন সোমবার হলেও অফিস যায় নি মান্তু । ইচ্ছা একবার মায়ের কাছে যাওয়ার। পম্পা রবিবার দিন কাজে আসেনি । আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে। পম্পা একটু চুপচাপ। চোখগুলোও কেমন ফোলাফোলা। মান্তু আজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না । সব দ্বিধা দূর করে মান্তুকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে, নীতার এমন কথা শুনে কাল খুব কেঁদেছিস বুঝি ! কি করবি বল সবই নিয়তি। আচ্ছা, এই তো তুই বলতিস স্বামী স্ত্রীর বনিবনা হতো না ! তাহলে একসাথে বিষ খেল কেন? জানিস তুই কিছু? আমি অফিস যাওয়ার পথে দেখতাম নীতা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত। হ্যাঁ রে প্রেমটেম কিছু ছিল না তো? না মানে, হয়তো নীতার সেই প্রেমিকই কোন অশান্তির জেরে দুজনকে বিষ দিয়েছে! এমন তো কত কথাই শুনি আজকাল!”
পম্পা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “বৌদি, বিষ দিতে কি শুধু বাইরের লোকই লাগে? অথবা বিষ কি শুধু দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়? না গো , অনেক সময় কাছের মানুষটাই বিষ দিতে পারে । আর জান তো সব থেকে শক্তিশালী বিষ মানুষের ভিতরেই থাকে। ইচ্ছা করলেই সেই বিষ ঢেলে সামনের মানুষটার জীবন বিষাক্ত করে দিতে পারে কিছু বিষাক্ত মানুষ।”
– মানে! কি বলতে চাইছিস ?
-বৌদি আমার তো আর নীতা বৌদির বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাই। নীতা বৌদির জীবনের গল্প। খানিকটা তার কাছ থেকে শোনা কিছুটা নিজের চোখে দেখা । পম্পা শুরু করল- পম্পা মান্তুর কাছে বসে কথা বললেও তার দৃষ্টি যেন বহু দূরের। সেই দৃষ্টির দূরত্ব মাপার বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে মান্তু মন দিল পম্পার কথায়।
নীতাকে ভগবান রূপ গুনে সুন্দর করে পাঠালেও, কপালটা তার সুন্দর ছিল না । খুব কম বয়সেই বাবা মাকে হারায় নীতা । বয়স তখন মাত্র বারো বছর। আশ্রয় হয় মামার বাড়িতে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকলেও বাবা মা পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে পড়াশোনাও বিদায় নেয় নীতার জীবন থেকে। কারণ নীতার মামি মনে করতেন নীতার পিছনে পড়াশোনার জন্য টাকা নষ্ট না করে মামা যদি ঐ টাকা জমায় তবে নীতার বিয়ের একটা হিল্লে হয়। তাই বারো বছরের নীতা পড়াশোনার পাঠ ছেড়ে মামির সংসারে ঝি বৃত্তি করতে লাগল।
এসব দেখে ভিতর ভিতর বড় কষ্ট পেত নীতার দিদিমা। কিন্ত তার কিছু করার ছিল না ছেলে বৌয়ের সংসারে। তাই তিনি যা করতে পারতেন তাই করলেন। চেনা পরিচিতদের পাত্র দেখার কথা বলেন। তখনই এক পরিচিত নীতার জন্য অম্বিকের সম্বন্ধটা আনলেন। অম্বিক বেশ অবস্থা সম্পন্ন। দাদুর কাছে মানুষ ছোট বেলা থেকে । বাবা মা নেই। দাদুও বেশ কিছু বছর হল স্বর্গবাসী। তাই এ হেন ভাল সম্বন্ধ হাত ছাড়া করতে চাইলেন না নীতার দিদিমা। তাই এগারো বছরের বড় অম্বিকের সাথেই পনেরো বছরের নীতার বিয়ে হয়ে গেল।
একরাশ স্বপ্ন বুকে বেঁধে দিন বদলের আশা নিয়ে নীতা অম্বিকের সাথে তার ঘরে এল। কিন্ত নীতার সেই স্বপ্ন আশা ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। কিছুদিনের মধ্যেই অম্বিকের আসল রূপ সামনে এল। অম্বিক নীতাকে বিয়ে করেছিল কেবল তার রূপ দেখে। রূপে মজে গিয়ে নয়! বরং নীতার রূপকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে। নিজের প্রমোশনের জন্য নীতাকে বসের কাছে ঠেলে দিত। নীতা রাজি হয়নি। কিন্ত অম্বিকের মার আর অত্যাচার তাকে বাধ্য করল অম্বিকের কথা মানতে।
নীতার রূপের মোহতে অম্বিকের বসও মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসতে লাগল। প্রথম প্রথম একটু চটুল কথা। হাতে হাত রাখা। পার্টিতে বসকে নিজের কোমরে হাত দিয়ে নাচতে অনুমতি দেওয়া বা তার প্রিয় ড্রিংকটা হাতের সামনে এগিয়ে দেওয়াতেই খুশি ছিল অম্বিকের বস। তাই অম্বিকও তার কাজ হাসিল হচ্ছে দেখে এতেই সন্তুষ্ট ছিল।
কিন্ত ঐ যে কথায় আছে না, নেশা আর পাপ এদের গতি সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। বছর খানেক পরেই বসের চাহিদা বাড়তে লাগল। কেবল এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় তার মন ভরল না। সে এবার বিছানায় একান্তে পেতে চাইল নীতাকে। অম্বিকের কোন কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্ত নীতা এই প্রস্তাব শুনেই ককিয়ে উঠল। তখন সে অম্বিকের সন্তানের মা হতে চলেছে। তার এক বুক নতুন স্বপ্ন সাজিয়েছে। মা ডাক শোনার অধির অপেক্ষারত সে। অম্বিকের হাতেপায়ে পড়ল। কিছুতেই কাজ হল না দেখ নীতা এবার আত্মহত্যার ভয় দেখায় অম্বিককে। এই কথায় অম্বিক থেমে যায়। কথা বাড়ায় না। নীতা নিশ্চিন্ত হয়।
তারপর হঠাৎই নীতার প্রতি অম্বিকের ভালবাসা আদর যত্ন বেড়ে যায়। মা হতে চলেছে বলে নীতার যত্নের ত্রুটি রাখে না সে। নীতা খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করে । ভাবে যাক, সে তার স্বামীর ভালবাসা না পেলেও তার সন্তান নিশ্চয়ই তার বাবার ভালবাসা পাবে । যে আগত সন্তানের জন্য অম্বিকের এত যত্ন , সেই সন্তান ভুমিষ্ট হলে না জানি কি করবে অম্বিক ! সুখের দিনের ভাবনায় আবার বুক বাঁধল নীতা। কিন্ত বোকা মেয়েটা এটা জানত না যে ছল কপট এইভাবেই আসে আশা ভরসার রূপ নিয়ে।
নির্বিঘ্নে কাটল দুটো সপ্তাহ। একদিন সন্ধ্যার সময় অম্বিক নীতাকে বলে তার বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে। আর অম্বিক চায় নীতা যেন তার সাথে যায়। নীতা খুব খুশি হয়েছিল। এতদিন পার্টি মানেই অফিস পার্টি । বসের নোংরা হাতের ছোঁয়া আর লালসার দৃষ্টি দেখে এসেছে নীতা। তাই এমন ঘরোয়া পার্টিতে যাওয়ার কথা শুনে দ্বিমত করে না নীতা।
নির্দ্বিধায় সে অম্বিকের সাথে যায় পার্টিতে। বাড়িটা ছিল অম্বিকের বসের বাগান বাড়ি । অম্বিকের ষড়যন্ত্রে সেদিন নীতার উপর সারা রাত অত্যাচার চালানোর সুযোগ পেল অম্বিকের বস ও তার কিছু বন্ধুরা। সকালে নীতা যখন ঘরে ফিরল তখন সে জীবন্ত একটা লাশ ছাড়া কিছু নয়। আমি কাজ করতে গিয়ে দেখলাম নীতার দু’পা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তধারা। সব কথা শুনে শিউরে উঠলাম আমি । বুঝলাম নীতার গর্ভপাত হয়েছে। আমি আকুল হয়ে কাঁদলাম। কারণ আমি তো জানি নীতার কত আশা ছিল এই সন্তানকে নিয়ে। কিন্ত অদ্ভুত, নীতার চোখে এক ফোঁটা জল নেই। যেন একটা মৃতদেহ।
অনেকক্ষণ পর আমাকে নীতা বলে, “পম্পাদি একটু বিষ এনে দিতে পার ? ভাল বিষ, যেন আমার সম্পর্কের মতো ভেজাল না হয়। অনেক পুণ্য করার বৃথা চেষ্টা করলাম। এবার পাপ করতে চাই। ঐ জানোয়ারটাকে যদি আমি নিজে হাতে শাস্তি না দি তবে আমার সন্তান যেখানেই থাকুক শান্তি পাবে না।”
আমারও মনে জেদ চেপে গেল। বললাম নিশ্চয়ই দেব। আর দেরি না করে এনে দিলাম কিছু সেঁকো বিষ। আমি অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমার বিষ চিনতে ভুল হয় না। তাই বারবার সাবধান করে এলাম বড় সাংঘাতিক বিষ। কিন্ত আমি বুঝিনি নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ দিয়ে সেই খাবার নিজেও খাবে। ও তো অম্বিকের জন্যই আনতে বলেছিল এই বিষ কিন্ত নিজে কেন খেল কে জানে?”
চুপ করল পম্পা। মান্তুর দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। সে জেন কিছুটা আপন মনেই বলে, “নীতা কি আজ মরেছে রে? নীতা তো সেদিনই মরে গেছিল যেদিন অম্বিকের কুচক্রে তার বস আর বসের বন্ধুরা মিলে ওর শরীরটাকে বিষিয়ে দিযেছিল। সেই বিষের এত জ্বালা যে ভিতরের ছোট্ট প্রাণটাও সেই বিষ সইতে পারেনি। নীতা তবুও নিজের মতদেহটাকে টেনে বাড়িতে এনেছিল বোধহয় অম্বিককে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। ওর কাজ শেষ করে ও নিজের শরীর থেকে মুক্তি নিয়েছে। হয়তো এই বিষাক্ত দুনিয়ার বাইরে ওর সন্তানের সাথে ওর আবার দেখা হবে!
যদিও আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্ত পরিস্থিতির চাপে। আর মানসিক যন্ত্রণায় নীতা কতটা মানসিক ভাবে সুস্থ ছিল আমার তাই নিয়ে খানিকটা সংশয় আছে । তবে একটাই শান্তি যে অম্বিকের মতো একটু জানোয়ার শাস্তি পেল। ইংরেজীতে একটা কথা আছে , চোখের বদলে চোখ। আর এখানে বিষের বদলে বিষ। অম্বিক যেমন নিজের বিষ দিয়ে নীতার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমনই নীতা অম্বিকের খাবারে বিষ মিশিয়ে শাস্তি দিল তাকে।