প্রসঙ্গে

প্রসঙ্গে – বসন্ত যাপন

বসন্ত যাপন
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

বসন্ত এসে গেছে- বাতাসে নিয়মভাঙার চোরাটান। শহরের অলিগলিতে উদাসী হাওয়ায়,ঝরে পড়া শুকনো পাতার খসখস শব্দে মনকেমনের বার্তা। কে যেন বলতে থাকে, ওরে গৃহবাসী খোলো দ্বার,চলো বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু সংসারের জাঁতাকলে, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে কী অতই সহজ, হুট্ বলতে বেরিয়ে পড়া! তাহলে উপায়! উতলাচিত্ত ভ্রমণপিপাসুর কি কেবল, মনখারাপই সম্বল! উঁহু,দুর্গমগিরি, কান্তারমরু পার হয়ে যাওয়া বাঙালি অত সহজে হার মানবে না। সে মনে মনে বলে-
“আমারে তুমি দাবায়ে রাখতে পারবা না”
তার কাছে বই রয়েছে না! ভ্রমণ কাহিনী!
খুব সম্প্রতি এমনই একখানা বই এসেছে আমার হাতে। ইচ্ছুক পাঠক আমার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়তেই পারেন।
কিন্তু কোথায়? কেন, এই তো কাছেই শান্তিনিকেতনে।
কী বললেন সে জায়গা অনেকবার ঘোরা? আরে না না আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে নিয়ে যাবো এমন এক জায়গায়, দোল অথবা পৌষ উৎসব দেখে ফেরা মানুষজন যেটির হদিশ পান নি মোটেও। এই বইটি আপনাকে দেবে অচিনপুর আবিষ্কারের আনন্দ। বইটির নাম হলো
“সদা থাকো আনন্দে…শান্তিনিকেতনে”
বইটির লেখক, আদতে উত্তর কলকাতার বাসিন্দা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
তুখোড় ছাত্র,শ্রী দীপঙ্কর রায় মহাশয় যখন বিশ্বভারতীতে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে শান্তিনিকেতনবাসী হলেন,তখন তাঁর মোটেও মন বসতো না সেখানে, সদাই নিজেকে ‘বহিরাগত’ ভেবে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার ভাবনা মনে চেপে বসতো,তারপর কে জানে কোন মন্ত্রবলে,প্রকৃতির ডাক পৌঁছলো, তাঁর কাছে। ছুটির দিনগুলিতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকলেন। ধীরে ধীরে একদিকে যেমন পরিচয় হতে থাকলো,ফকির বাউলদের সঙ্গে, ঠিক তেমনই প্রকৃতি তাঁর কাছে হাট করে খুলে দিল তার দুয়ারখানি। লেখক হদিশ পেয়ে গেলেন অগাধ রত্নভান্ডারের । “তাঁর কাছে খুলে যেতে থাকে,প্রকৃতির এক নতুন ও আশ্চর্য জগৎ, তিনি আবিষ্কার করেন অজস্র নতুন গাছ,সম্পূর্ণ অচেনা সব পাখি, জোনাকি পোকার মিলনোৎসব, বসন্তের গন্ধ, খোয়াই এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য,”- কলকাতায় বসে যার খোঁজ পাওয়া দুষ্কর।

চলুন তাহলে বেরিয়েই পড়া যাক, লেখকের হাত ধরে এগিয়ে‌ যাই অচিনপুর আবিষ্কারে।
আচ্ছা,কেউ কি কোনোদিন আপনাকে কথা দিয়েছিল, হলুদ পলাশ এনে দেবে বলে, অথচ দেয়নি! দুঃখ পাবেন না, কবি তো কবেই বলিয়াছেন,
“কেউ কথা রাখে না”- তার চাইতে নিজেই খুঁজে নিন না, সেই গাছ, চলুন বেরিয়ে পড়ি অপুর মতো “কল্পনার উড়ানে।”

খেলার মাঠের গায়ে,পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে,লক্ষ্য রাখুন।এইখানেই কোথাও নানা গাছের ভীড়ে লুকিয়ে রয়েছে হলুদ পলাশের গাছ।না, না টানা হেঁচড়া করে ডাল ভেঙে নয়,মাটিতে ঘাসের উপরে পড়ে থাকা হলুদ পলাশক’টি সংগ্রহ করে নিন,হয়তো তারা অপেক্ষায় ছিল আপনারই জন্য।
রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলুন, সামনেই পড়বে আশ্চর্য রকম পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রাম, কুটিরগুলির দেওয়ালে দারুণ সুন্দর সব আলপনা ,মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন তো , লেখক জানিয়ে দেবেন, এই তো কিছুদিন আগেই বাঁধনা পরবে আঁকা হয়েছিল,সুচারু চিত্রগুলি।
কোন‌ও এক বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, গৃহকর্তার অনুমতি নিয়ে, ছবি তুলে নিন না যতোগুলো ইচ্ছে।
চাইলে দাওয়ায় গিয়ে বসতেও পারেন, কথায় কথায় জেনে নিতে পারেন কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে,পরিযায়ী পাখিদের অস্থায়ী ঠিকানা যে ঝিল, তার পথ নির্দেশ। শাল শিমুলের জঙ্গলে নৈঃশব্দের জগতে কেবলই পাখির ডাক। পক্ষীপ্রেমিকরা হয়তো একেবারে নিরাশ হবেন না। ঘুরতে ঘুরতে সহসা নজরে পড়তে পারে জঙ্গলের‌ ফাঁ‌কে বিকেলের রোদ ঝলমলে রাঙা খোয়াই।
সন্ধ্যের আগে ফেরার পথ ধরুন, সেটি যদি দোলের দিন হয়, তাহলে, সঠিক দিক নির্দেশ নিয়ে পৌছে যান পথের ধারে গড়ে ওঠা ইটালিয়ান দিদির তৈরী নাট্যগ্রামে অথবা ফ্রান্সপ্রবাসী বাউলের আখড়ায়।
রাত বাড়লে মাথার উপরে পূর্ণচাঁদের মায়ায় পথনির্দেশ খুঁজে নিয়ে ফিরুন নিজের আস্তানায়‌।
শান্তিনিকেতনে যাবেন অথচ খোয়াই দেখবেন না তা,ও কি হয়! ছেলেবেলায় যে লীলা মজুমদারের হাত ধরে অজস্রবার গিয়েছিলেন হীরের ফুল ,পক্ষীরাজ ঘোড়া আর হলদে পাখির পালক খুঁজতে, আজ সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ান তার সামনে। দেখে আসুন রূপকথার বাইরে ঢেউ খেলানো ঊষর মাটি, গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় যেন তার ঝকঝকে আলোতে আগুন ধরেছে। দেখে নিন তার আদিম রূপ। জানা আছে কি, এই খোয়াই, একদা প্রস্তর যুগের মানুষের বাসভূমি ছিল! খননকার্যে পাওয়া পাথরের অস্ত্রগুলি,আজ তার প্রমাণ দেয়।
কেবল রুক্ষপ্রান্তর নয়, এই খোয়াইয়ের ঈর্ষণীয় বায়োডাইভার্সিটিও পর্যবেক্ষণের বিষয়, কারণ এই খোয়াইকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়েটল্যান্ড-জল বইবার খাত। এখানেই রয়েছে প্রচুর কাজুবাদাম,আকাশমণি, শিশু, পলাশ, আমলকির বন। এখানে নানা জাতের প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে, হেমন্তে আসে হাজারে হাজারে‌ পাখি। এইখানেই আপনি পেতে পারেন অরণ্য‌ভ্রমণের স্বাদ।
অলমিতি বিস্তরেণ, শুধু শেষ করার আগে বলে যাই, ইচ্ছে হলে নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন বইটি, কারণ এই বইটি একবার পড়ে তৃপ্তি হয় না, তাছাড়া অরণ্যভ্রমণই একমাত্র বিষয়বস্তু নয়,আপনি চাইলে বাউল সংস্কৃতি, পৌষমেলা, নববর্ষ উদযাপন, বাইশে শ্রাবণ ইত্যাদি আরো অনেক অনেক বিষয়ের তথ্যমূলক এবং মনোগ্রাহী নিবন্ধ পাঠের আনন্দ পেতে পারেন।

( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ- এই লেখাটি শুধুই আমার একটি ভালো লাগা বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া)

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page