Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৬)

 জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

 

এতক্ষণে রুইদাসপাড়া ফুঁড়ে তিনটে ছোকরা হেলেদুলে এদিকে আসছে দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টির নাগালে আসতে সুধা বুঝতে পারল, কারোর পায়ের চলন স্বাভাবিক নেই। প্রত্যেকেই নেশায় চুর হয়ে আছে। তা তোরা যা পারিস ছাই পাঁশ গিলগে যা। তোরা এসে আমার গরুটার একটা হিল্লে কর আগে। মুখে কোন কথা নেই। এসেই তিনজনে লেগে পড়ল কাজে। ঝপাঝপ হাত চলছে ওদের। কাজের বেলায় এরা একদম পোক্ত কারিগরের দক্ষতায় ব্যস্ত। ভূপাল কা টিফিন নিয়ে আসতে আসতে ওদের অর্ধেক কাজ শেষ। খাবার আসতে আর ওদিকে মন নেই সুধার। গপ গপ করে পুঁউরুটি খায় আর এক কামড় শশা চিবিয়ে নেয়। শেষে অবশিষ্ট শশা কঁচ কঁচ করে কামড়ে খেয়ে নেয়। এতক্ষণে যেন খিদের ছটপটানি দমে শান্ত হয় শরীরটা। খাওয়া সেরে ওদিক তাকিয়ে দেখে মুচিদেরও কাজ প্রায় শেষ ! সত্যি এই কাজের দক্ষতাটা রুইদাসদের রক্তে সবসময় মজুত থাকে। কাউকে যেন শেখাতে হয় না। কিন্তু সুধা অবাক হয়ে গেল, প্রথম থেকে যে ছেলেটা তাদের পাশে এসে বসেছিল, সে এখনো ঠিক তেমনভাবেই বসে? কারণটা তাকে না জিজ্ঞেস করে পারল না সুধা, “হ্যাঁরে খোকা! তুই সেই প্রথম থেকে এসে বসে আছিস। হাতে তো চামড়া ছাড়ানো ছুরি মজুত। অথচ তুই ওদের সঙ্গে কাজে হাত দিলি না যে? সুধার কথায় ওর যেন কোন ভাবান্তর নেই! চুপ করে গরুটার দিকে তাকিয়ে অন্যদের কাজ করা দেখে যাচ্ছে। এবার সে আগ্রহ নিয়েই সেদিকে তাকিয়ে আছে। সুধা আবার বলল,“কিরে, আমার কথার কোন উত্তর দিলি না যে?” সুধার কথাটা ওই দলের একজনের কানে যায়। সে তখন বলল, “ও চামড়ার ভাগ নেয় না। আমরা চলে গেলে কি করে কে জানে। গরুর পেট কেটে কিসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ফিরে আসে। কি খোঁজে, আমরা ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। চুপ করে থাকে। বলে না কিছু। কিছু বলে না বলে আমারও ওকে আর তেল মাখাই না। যা পারে করুকগে। আর জিজ্ঞেস করি না। লাভও নেই ওকে নিয়ে বেশি কজলাকজলি করে। তাহলে আবার যদি চামড়ার ভাগ চেয়ে বসে তো আমাদের দিতেই হবে। আমাদের ভাগে তখন কম হয়ে যাবে।” এবার সুধা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, “খোকা, তোর নাম কি রে?” সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “বাবলা। বাবলা রুইদাস। যতন রুইদাসের ছেলে আমি। চেনো তো যতনকে? ওই যে, রতন রুইদাসের ভাই। রতন আমার জ্যোঠা। সনাতন জ্যেঠতুতো দাদা।
ইতিমধ্যে ওই তিন ছেলে কাজ সেরে চামড়া নিয়ে পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। এবার বাবলা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সুধার মনে জেদ চেপে যায়, বেটা এখন গরুটার পেট কেটে কি করে সেটা দেখে তবে এখান থেকে যাবে।
ভূপাল-কা’কে বলল, “কাকা, খিদে তো মারা হল। এবার গামছা বিছিয়ে এই গাছের ছায়ায় একটুকখানি শরীরটা এলিয়ে দি আয় দু’জনে। বাড়ি যাচ্ছি, দাঁড়া। আড় চোখে দেখি আয়, ও বেটা এবার গরুটাকে নিয়ে কি করে! নিশ্চয়ই গোপন কোন রহস্য লুকিয়ে আছে, ওর এই কাজের মধ্যে। ছেলেটা যে মহা-সেয়ানা সেটা তুই বুঝতে পারছিস, ভূপাল কাকা? ও কিন্তু একদম মদ খায়নি। মদ না-খাওয়া ছেলের কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়াদের থেকে একদম আলাদা। আর দেখেছিস, ছেলেটা কথা একদম কম বলে! এই কথা কম বলা ছেলেরা মোটেই লেলাখেপা হয় না। সাহসী এবং মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে এরা। খুব সিরিয়াস হয়। সরাসরি ওদিকে তাকালে ও আমাদের লুকিয়ে কাজ করবে। ঘুমোবার ভান করে চোখ পিটপিটিয়ে দেখতে হবে, বেটা কি করছে।
একদম দক্ষ কারিগরের মত কাজ! ফটাফট গরুটার পেট চিরে তার ভেতরে হাতটা সেঁধিয়ে দিল। খান তিনেক শকুন ইতিমধ্যে জুটে গেছে। ছেলেটা ‘ফুস্ ফুস্’ করে হাতের ছুরিটা উঁচিয়ে তাদের তাড়া করে আর নিজের কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ সেখানে হাতটা নাড়াচাড়া করে বার করে নিল হাতটা! রক্ত মাখা ডান হাতটা বাঁ হাত দিয়ে উপর দিক থেকে চেপে ধরে ঘষে নিচের দিকে টেনে সরিয়ে দিলো রক্তগুলো! আবার ডান হাতটা ঢোকালো! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাত বার করে মুঠো মেরে রইল। এবার আর হাতের মুঠো খুললো না। আগের মত বাঁ হাত দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিয়ে মুঠো খুলে চোখের দেখা দেখে নিল জিনিসটা ! সুধা, ভূপাল-কা ও সেই ফাঁকে দেখতে পেল, চকচকে হলদেটে পীতবর্ণের চার পাঁচটা শক্ত কিছু জিনিস! গরুর পেটের ভেতর এগুলো থাকে এ ছেলেটা জানে। জানতেই পারে। কিন্তু ওসব কি এমন জিনিস যে এত গোপনভাবে জোগাড় করতে হবে! নিশ্চয়ই ওগুলো রহস্যজনক দামি কিছু হবে! এইসব সাতপাঁচ ভাবনার ফাঁকেই ছেলেটা কখন গামছার খোঁটে সেগুলো বেঁধে পাঁই পাঁই করে দৌড় মারল! সুধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটা পগার পার! ওকে নাম ধরে ডাকারও ফুরসৎ দিল না! সুধা বুঝেছে, ওদের এ ব্যাপারে কিছু জানাবে না বলেই ছেলেটা চোখের পলকে তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল!
সুধা-রা দু’জন তো ‘বাবলা’ ছেলেটার কান্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল! বলল, “কি ব্যাপার বলতো ভূপাল-কা? নিশ্চয়ই ওই চ্যাপটা নুড়ি পাথর মত দেখতে জিনিসগুলোর মধ্যেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে। কোন দামি পাথরের বস্তু হবে যেটা গরুর পেটের ভেতর থাকে।” তারপর চুপ করে গিয়ে ভাবতে লাগল, এতদিন তারা কেউ এসব রহস্যের কথা জানতো না। জানার অবকাশও কোনদিন তাদের হয়নি। ওদের কোন কল্পনাতেও ছিল না। পাকেচক্রে হঠাৎ ওরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাওয়াতে দেখতে পেল। বিস্ময়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল সুধা!
-আচ্ছা ভাইপো, এখন ওই গরুর পেটের যেখান থেকে বেটা-টা ওই জিনিসগুলো বার করে নিয়ে গেল, একবার গিয়ে দেখলে হয় না? ঠিক কোন জায়গা থেকে বার করলো ওসব? বা যদি একটা আধটা ওই পাথর পড়ে থাকে তাহলে তো বোঝাই যাবে জিনিসটা কি এবং গরুর পেটের ঠিক কোন জায়গায় ওগুলো থাকে? কৌতূহলের সঙ্গে ভূপাল-কা বলল।
-জানিস ভূপাল-কা, তোর মত বোকা-হাঁদা মানুষ বলেই এই কথাগুলো বলতে পারলি। প্রথমত ওই পীতবর্ণ পাথরের মত শক্ত পদার্থ একটাও অবশিষ্ট ওখানে পড়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। যে আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটা ওগুলো নিল, নিশ্চয়ই ওর কাছে সেগুলোর গুরুত্ব সীমাহীন। সেই দ্রব্য ছিটকে ছাটকে গরুটার শরীরের ভেতর পড়ে থাকবে তা ছেলেটা হতে দেবে না। তারপর গরুর শরীরের ঠিক কোন জায়গা থেকে ওগুলো সে বার করল তা না জানলে আন্দাজে তুই কোথায় হাঁচাবি। সবই তো মাংসের ভেতর থাকে। মাংসের ঠিক কোন জায়গা থেকে কেটে নিল তা আমাদের মত গোলা লোকের খুঁজে বার করা সম্ভব না। ওসব ছাড়। এখন আমাদের জানলে ভাল হত, জিনিসটা ঠিক কি এবং কি কারণে ওর প্রতি ছেলেটার এত টান? কাজটা যে ছেলেটা প্রচন্ড গোপনীয়তার সঙ্গে করে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ফলে সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কিছুতেই বলবে না। হয়তো এটাই ওর রুজিরুটির প্রধান অবলম্বন। যেমনটা আমাদের মজুর খাটা। সন্ধ্যেবেলা দিঘিরপাড় বাজারে তো যাচ্ছি। তুইও আমার সঙ্গে থাকবি। ওর বাবা যতনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব। সে কি বলে দেখা যাক। অবশ্য যতন আমাদের না-ও বলতে পারে। ছেলের মত গোপন করে যেতে পারে। চল, বাড়ি যাই। আজ নতুন একটা রহস্য সামনে এসে হাজির হল। কিন্তু তা উদ্ধার করা হল না। কোনদিন আমাদের পক্ষে তা হবে কি না জানা যাচ্ছে না। সে না হয় তো কি করা যাবে। ওসব রুইদাসদের ব্যাপার। আমরা তো আর কোনদিন এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাব না। তাই আমাদের বেশি আগ্রহ দেখানোরও বা দরকার কি। কি বলিস তুই, ভূপালকা? বলে আবার ঘুরেফিরে সুধা বলে, “তবু নতুন একটা জিনিস দেখলাম। কি সেটা জানার জন্যে মনটা ভেতরে ভেতরে যেন গুলতানি পাকাচ্ছে?”

[পঁয়ত্রিশ]

হেড়ো পাগলার রকমসকম দেখে তাজ্জব বনে যায় অখিল! থমকে যায় তার চলার পথ। “এই হেড়ো, ওঠ বেটা” বলে গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠতে ধড়ফড়িয়ে উঠে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। আবার একই ঢঙে অখিল বলে, “আমাকে দেখে উঁকিঝুঁকি মারছিলিস কেন, বল?” ভয় পেয়ে যায় হেড়ো। এবার হাত জড়ো করে বলে, “আমার কোন দোষ নেই অখিল দাদা ! ওই নোচে আর বিন্দে মদ খেতে দিয়ে আমাকে তোমার ওপর নজর রাখতে বলেছে। কখন তুমি বাড়ি ফেরো সেটা জানাতে বলেছে। বলতে পারলে এবার চুল্লুর সঙ্গে মাংসও খাওয়াবে বলেছে। সেই লোভে সারা রাত আমি এখানে জেগে বসে আছি, তুমি কখন আসো তাই চৌকি দিচ্ছি।”
হেড়োর কথায় মাথা গরম হয়ে যায় অখিলের। বলে, “মদ-মাংসের লোভে তুই আমার পেছনে পড়েছিস। ধরা পড়ে গেলি। এবার আমি যদি তোকে ‘কেলিয়ে বৃন্দাবন’ দেখিয়ে দিই? এখন তোর নোচে-বিন্দে বাঁচাতে আসবে তো? শালা, আমি তোকে খেতে দিই না? যখন দেখা হয় বলিস, অখিল দাদা, আজ খাওয়া হয়নি। দশটা টাকা দাও যা হোক কিছু কিনে খাবো। এবার তুই ‘খেতে পাসনি বলে’ একবার আমার কাছে হাত পাতিস। দেখবি, তোর কি হাল করি। বেইমান কোথাকার!” ভয় পেয়ে যায় অখিলের কথায় হেড়ো পাগলা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমার নামে ওদের কাছে কিছু বলবো না অখিল দাদা। আমাকে কিচ্ছু বোলো না। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দাও অখিল দাদা।” অখিলের রাগ তখনও যেন কমতে চায় না। আবার বলে,“শালা পাগলা। এই সময় তো ভাল মানুষের মত বেশ ভাল ভাল কথা বলছিস। ওই কথায় বলে না,‘নিজের ভাল পাগলেও বোঝে।’ তুই শালা তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তোকে বলে রাখছি হেড়ো, আমার কথা যদি তোর মুখ দিয়ে কখনো বার হয়, তোকে কিন্তু আমি ছেড়ে দেব না। ছাড়! পা-ছাড় শালা পাগলা-কেষ্ট।” বলে অখিল বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
যেতে যেতে ভাবে, ও তো পাগলের মরণ। কখন কি খেয়ালে থাকে তার কোন ঠিক আছে না কি! ও আবার নোচে-বিন্দের খপ্পরে পড়লে তাদের লোক হয়ে যাবে। মারব ধরব বলে যদি ভয় দেখায় বা কাছের লোকের অভিনয় করে মদ গিলিয়ে দেয় তো কেল্লা ফতে। যা দেখেছে সব বলে দেবে। দেবে দেবে! কি আর করা যাবে। ঝামেলা হামলে পড়ে তার ঘাড়ে উঠতে চাইলে তখন চুপ করে থাকা যাবে না তো। কঠোর হাতে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তার জন্যে অখিল বিন্দুমাত্র ভীত নয়। কারোর ঘরের চালে তার পুঁইশাখ তোলা নেই যে তাদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে থাকতে হবে। এক নম্বর হল, রেখা বউ তার কারিগর। তারপর সে এখন বিপদে পড়ে আছে। মানুষ হিসেবে এবং তার কাজের ঠিকেদার হিসেবে বিপদগ্রস্থ এই মানুষের পাশে সে দাঁড়াবে না? তাতেও মানুষের আপত্তি! আসলে এইসব নিষ্কর্মাদের আপত্তির কারণ অন্য জায়গায়। তার মত আইবুড়ো রসালো ছেলেটা শেষে কি না একটা বিধবা বোয়ের সঙ্গে জুটে গেল! সত্যি গেল কি না গেল তার প্রমাণ দেওয়া পরের কথা। এখন তো তকমাটা তার গায়ে সেঁটে ফায়দা লোটা যেতে পারে। অখিলের কাছ থেকে ফায়দা লোটা অত যে সহজ নয় সেটা সময় বলে দেবে। তাছাড়া যদি সে ওই বিধবা বউটাকে ভালই বাসে। তাতে অন্যের কি যায় আসে? হ্যাঁ,ওদের যায় আসে। সেটা অখিল খুব ভাল করে জানে। নিজেদের বন্নের মেয়ে ছেড়ে অন্য জাতের মেয়ের আঁচলে মুখ ঢাকলে তো তাদের জাতের একটা মেয়ের হিল্লে হল না। তার উপর জাত খুইয়ে দিল! এ যে জঘন্য অপরাধ, তাদের মত স্বঘোষিত গোঁয়ার অন্ধ জাতভক্তদের কাছে। কিন্তু দিনকাল যে পাল্টে যাচ্ছে। জাতের নামে হুজ্জুতি যে এখনকার ছেলেপুলেরা মানছে না। তা ওই সাবেকী মুরুব্বিদের মগজে এখনো ঢোকেনি। এবার সময় এসেছে তা তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেবার। ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘোরাবার সময় শেষ। এখন প্রতিপক্ষ ময়দানে এসে গেছে। মুখোমুখি দাঁড়াতে তারা প্রস্তুত।
বাড়িতে এসে ঘন্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে নেয় অখিল। মাকে বলে রেখেছিল, সকাল সকাল রান্না করে দিতে। কোলকাতায় যাবে। মায়ের ডাকে উঠে চানটান সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। মা ভাত বেড়ে দিলে, খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় ও। ভোর ভোর যাবার কথা ছিল। কিন্তু শরীর টানতে পারল না। তাই দেরি হয়ে গেল বার হতে। দেরিই যখন হল, তখন ভাবল, তাহলে যাবার সময় রেখা বউয়ের বাড়ি একবার চক্কর দিয়ে পালপাড়ার কারিগরদের কাজ কতটা কি হল দেখে নিয়ে কোলকাতায় রওনা দেবে। উত্তম ভ্যানয়ালা সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে গেল কি না সেটাও একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন। এগুলো মেয়েদের কাজ না। এইজন্যে বাড়িতে একটা ছেলে থাকা দরকার।
ভাবনা মত অখিল রেখা বউদের বাড়ি যাবার পথ ধরল। আটচালার কাছাকাছি আসতে দেখে দূরে তাদের পাড়ার ওই তেমাথানি মোড়, যেটা গ্রামের মেন রাস্তার সঙ্গে জুড়েছে, সেখানে বড় বটগাছ তলায় জনা চারেক বসে আছে। ওরা কার জন্যে ওখানে জড়ো হয়েছে তা অখিল বিলক্ষণ বুঝতে পারে। দলে নোচে-বিন্দেও আছে। আর আছে দুই জাতরক্ষার ধ্বজাধারী মুরুব্বি, দিবাকর রুইদাস আর নিত্যানন্দ ঋষিদাস! ওদের দেখে থমকে যায় সে। ওখান দিয়ে গেলেই ওরা তাকে ধরবে। কি বলবে তা তার জানা নেই। তবে
ভালোবাসবে না তা সে নিশ্চিত। তাকে বিরক্ত করার জন্যেই ওৎ পেতে আছে ওখানে। সক্কাল বেলা। শান্ত খোলা মনে কাজে বেরোচ্ছে। এখনই যদি ও ওদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে তো সারা দিনটা তার মাটি হয়ে যাবে। সব কাজ চৌপাট হয়ে যাবে। তাই ঠিক করল এদিক দিয়ে না গিয়ে উল্টো রাস্তা ধরে আগে পালপাড়ার কাজটা দেখে তারপর রেখা বউদের বাড়িতে একটু তদারকি করে কোলকাতায় রওনা দেবে। ভাবনা মত পেছন ফিরতেই বিন্দে জোর গলায় হাঁক পাড়লো, “এই অখিল, ওখলে। আমাদের দেখে পিছু হটছিস নাকি রে? ভয় পেয়েছিস বুঝি। এভাবে পালিয়ে ক’দিন বাঁচবি? ধরা তো তোকে একদিন আমাদের কাছে দিতেই হবে।” অখিল যেটা চাইছিল না, পরিস্থিতি মনে হয় সেই দিকেই এগোচ্ছে। শালা নেশাখোর বিন্দের কথায় হু হু করে মাথা তার গরম হয়ে উঠল। নাঃ এদের সমঝে না দিলে চলছে না দেখছি। সত্যি তো, পিছু না হঠে মুখোমুখি হওয়াই সঠিক পথ। রাগে সমস্ত শরীর টগবগ করে ফুটতে লাগল তার। এবার বড় বড় পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে হঠাৎ রেখা বউয়ের মুখটা তার মুখের সামনে ভেসে উঠল। রেখা বউ তাকে বলেছিল, “ঠিকাদার বাবু, আপনি আমাদের বাড়ি ঘন ঘন আসেন। ওরা নিশ্চয়ই ভাবছে আপনার সঙ্গে আমি জুটে আছি। তাই আপনার পাড়ার লোকেরা এটা ভাল চোখে দেখে না। প্রথমত আমি স্বল্প বয়সী বিধবা। তার উপর আমরা বেজাত তো। আপনাদের জাতের লোকেরা বড্ড জাত-বেজাত মান্য করে চলে। আপনি একা মানুষ। রাত বিরেতে একা একা যাতায়াত করেন। তাই যখন তখন ওরা আপনার বিপদ ঘটিয়ে দিতে পারে। ওরা কেউ কোন কথা বললে, তাদের কথায় আপনি কান লাগিয়ে মাথা গরম করবেন না।” সঙ্গে সঙ্গে অখিলের উথলে ওঠা রক্ত থিতিয়ে যেতে লাগল। ভেবে নিল, মেয়েরা অল্পেতেই ভয় পেয়ে আপনজনকে সাবধান হতে বলে। অখিল ওদের দেখে বিন্দুমাত্র ডরায় না। তবু এই সাত-সকালে ওদের কোন নরম গরম কথায় সে মাথা গরম করবে না। কথা বলার প্রয়োজন হলে ঠান্ডা মাথায় বিনয়ের সঙ্গে ওদের সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজে চলে যাবে। কিন্তু ও জানে, ওরা তা চাইবে না। ওরা চাইবে আমি ওদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কথার পিঠে কথা চাপিয়ে পরিবেশ গরম করে তুলি। তেমাথানি রাস্তায় পাড়া-বেপাড়ার লোক জড়ো হয়ে যাক। তার নামে অপবাদ তুলে সেটা চাউর করে দিক সর্বত্র। সেই সুযোগ ওদের সে করে দেবে না নিশ্চিত হয়ে বিন্দের ডাকেই পিছু না হটে সামনে এগিয়ে গেল। পাড়ার অন্যতম দুই মুরুব্বি, দিবাকর আর নিত্যানন্দদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে কিছু বলবে, নিত্যানন্দ কাকা?” অখিল হঠাৎ নোচে-বিন্দেদের কিছু না বলে তার নাম ধরে সরাসরি প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে যায় নিত্যানন্দ! তাকে ডাকল বিন্দে। আর সেই বিন্দেকে এড়িয়ে কথা বলতে চাইলো তার সঙ্গে? অখিলের কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে বলল,“না বাবা। আমার কিছু বলার নেই তোমাকে। এখন কাজে বেরোচ্ছ বুঝি?” উত্তরে অখিল বলল, “হ্যাঁ কাকা। জরুরী কাজে কোলকাতায় যেতে হবে। তার আগে আমার কারিগরদের বাড়ি বাড়ি একবার যেতে হবে। তারা সব কাজ কতটা কি করল। দেখে নিতে হচ্ছে। মহাজনদের তাড়া আছে। সময়মত না কাজ দিতে পারলে ওরা, মাড়োয়াড়িরা ভীষণ ট্যাঁকখোর। উল্টোপাল্টা কথা বলে। টাকা কেটে রাখে। সেই সুযোগটা আমি ওদের দিতে চাই না। তাই প্রথমে কোনদিকে যাব ভাবতে ভাবতে তখন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আবার ঠিক করলাম, আগে মন্ডল পাড়ার ভীষ্মর বোয়ের বাড়ি হয়ে পাল পড়ায় যাব। সেখান থেকে কোলকাতা।” সঙ্গে সঙ্গে নিত্যানন্দ বলল, “আমার বৌমাও তাই বলছিল। অখিলদাদার মালটা আজকেই রেডি করে দিতে হবে। নিয়ে যাবে। ঠিক আছে বাবা তুমি যাও তোমার কাজে।”
অখিল ইচ্ছে করেই এই চালটা দিল। বিন্দেদের পাত্তা না দিয়ে নিত্যানন্দ কাকাকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। তার কাছে যে ওদের টিকি বাঁধা আছে। অখিল কাজ দেয় বলে ওনার ছেলের বউ কাজ পায়। সংসারে আয় হয়। সেই আয়েই ঘরে বসে বসে বুড়োর যত নফরচফর। অখিল কাজ বন্ধ করে দিলে যাবতীয় তেলানী শুকিয়ে বাতাসের কাঁধে ভর করে হাওয়া হয়ে যাবে। আর দিবাকর কাকা? ওর দশাও একদম নিত্যানন্দ কাকার মত। বিন্দে, নোচেদের মত ছ্যাবলামো করলে ওদের চলবে নাকি!
এই বিন্দে একসময় অখিলের এক নম্বর বন্ধু ছিল। একই বয়সী ওরা। নোচেও ওদের সমবয়সী। তখন অখিল মোহন গোড়ের শোলা কারখানায় কাজ করত। দিন মজুরী নিয়ে বাড়ি ফিরতো। বিন্দে সে সময় পাড়ায় টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াতো। অখিল বন্ধু বিন্দেকে বলেছিল, মোহনের কারখানায় যদি কাজ করতে সে ইচ্ছে করে তাহলে মালিককে বলে কয়ে কাজে লাগিয়ে দিতে পারে। হাতে দুটো পয়সা এলে মনও খুশ থাকে। সংসারে দু’চার পয়সা দিতে পারে। অনেকটা বড় হয়েও অখিল সেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর টান তখনও জোরদার ছিল। কিন্তু ছেলেটা এঁচোড়ে পেকে গেল। পাড়ার উঠতি মেয়েদের পেছনে সময় কাটিয়ে জীবন গড়ার সময়কে হেলাফেলা করল। একদিন হঠাৎ বিন্দে তার কাছে এসে বলে, “অখিল তুই আমার মান বাঁচা। আমাকে তিরিশটা টাকা ধার দে। পরশু তোকে শোধ দিয়ে দেব। না হলে মুক্তির কাছে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আজ ওকে ফতেপুরে শীতলা টকিজে সিনেমা দেখাব বলেছিলাম। ভুলেই গেছি। সেজেগুজে ও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার কাছে একটা কানাকড়ি নেই!”
-মুক্তির সঙ্গে তুই প্রেম করছিস? ও তো সবে সিক্সে পড়ে!
-কি করবো বল। ওকে আমার ভাল লেগে গেল। আমি সাহস নিয়ে সরাসরি ওকে ভালোবাসার কথা বললাম। সেদিন ও ‘ধ্যাৎ’ বলে দৌড়ে পালালো! দিন কয়েক পর বট গাছ তলায় আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। স্কুল যাবার সময় হয়ে গেছে। মুক্তি এবার স্কুলে যাবে। অবশেষে অপেক্ষায় পাশ! স্কুলের পথে ওর পেছন পেছন কথা বলতে বলতে অনেকটা গেলাম। ও কিন্তু কোন কথা বলছে না। শেষে বললাম,“কই, তুমি উত্তর দিচ্ছ না যে আমার কথায়?” তখন ও বলল, “প্রেম করতে এসেছো, খাওয়াবার ক্ষমতা আছে? আগে সেটা বলো।”
-তোমার জন্যে আমি প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি।
বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তারপর ট্যাঁক থেকে গরুর চামড়া কাটা ছুরি বার করে বিন্দে বলল, “তুমি চাইলে এইটা আমি আমার পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারি। তোমাকে আমি এতটা ভালোবাসি। আর বউ হলে বউকে খেতে দেয়া তো কোন ছার। দরকার হলে নিজে না খেয়ে বউকে খাওয়াব।”
বিন্দের এমন পণে সক্রিয় হয়ে মুক্তি বলল, “না না বাবা ! মানুষ খুনের দায় আমি নিতে পারব না। আমাকে ভালবাসতে গিয়ে তুমি যদি মরে যাও তা আমার ধর্মে সইবে না। ঠিক আছে, তুমি যা চাও তাই হবে।” এই বলে মুক্তি খিলখিলিয়ে হাসি দিয়ে স্কুলের পথে দৌড় মারল।
তাদের প্রেম পর্বের খন্ড কথা শুনিয়ে বিন্দে কাতরভাবে অখিলকে বলল,“জানিস অখিল, সেই থেকে মুক্তি আমার। মুক্তি আমার ধ্যান জ্ঞান। আমার ইহকাল- পরকাল। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারব না। এখন ওই তিরিশটা টাকা দিয়ে তুই আমার মান বাঁচা অখিল।”
শালা বিন্দে, হারামজাদা! দিনকতক মুক্তির সঙ্গে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে একদিন সন্ধ্যের মুখে পাড়ার ছোকরাদের হাতে ধরা পড়ল। রতন কাকার গোয়াল ঘরের পাশে খড়কাটার পাশ কামরায় বিন্দে আর মুক্তি নাকি দু’জনে চুরি-চামারি করে শরীর দেয়ানেয়া করছিল। ব্যাস! পাড়ায় চেঁচামেচি হইচই, লোকজড়ো। ছোকরারা এক কাপড়ে দু’জনকে জড়িয়ে আটচালায় এনে হাজির! তাদের দাবি আজ রাতেই এদের ‘ধরে বিয়ে’ দেওয়া হবে। ডাক পড়ল উভয়ের বাবা মায়ের। ছেলের বাবা পন-পাওনা না পেলে এ বিয়েতে রাজি নয়। ছেলের বাপের কথা, “এটা ঠিক, আজ হঠাৎ করে তো এসব জোগাড় করা সম্ভব নয়। অন্তত আজ কথা দিতে হবে মেয়ের বাপকে যে তিন মাসের মধ্যে ছেলের তিনটে, মানে ঘড়ি-অংটি-বোতাম আর মেয়ের তিনটে, হাতে-কানে-গলায় সোনার গয়না যৌতুক হিসেবে এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা তারা দিতে রাজি। বর পক্ষের কথায় মেয়ে পক্ষের তো কপালে হাত। তারা নিজেরা ঠিক মত দু’বেলা খাবার জোটাতে পারে না। এত বর-পন-যৌতুক তারা তিন মাস কেন তিরিশ বছরেও জোগাড় করতে পারবে না। পাত্র-পাত্রী নিজেরা প্রেম করেছে মেলামেশা করেছে। ওরাই বুঝুক কি করবে। তবে আমার মেয়ের সর্বনাশ যদি ওই ছেলে করে থাকে তো আমরা ছেড়ে কথা বলব না। আটচালা যদি এর একটা বিহিত না করে তো থানা-পুলিশ আমরা করব!
শেষ পর্যন্ত আটচালার নিদানে ওই রাত্রেই দিঘিরপাড়ের জামা কাপড় দোকানদার, বাসু ঘোষের বাড়ি গিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে বিয়ের সাজসজ্জা বাকিতে নিয়ে যায়। ধারের টাকাটা দেবে পাত্রপক্ষ। জামিনদার হল, আটচালা। পাত্রপক্ষ কথা খেলাপ করলে আটচালার ফান্ড থেকে আপাতত সেই ধার শোধ করা হবে। তারপর আটচালা বিন্দেদের কাছ থেকে আদায় করে নেবে।
এমন বিয়ে ওদের রুইদাস পাড়ায় আখচার আগে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিন্দে তো তবু ভালো। ভদ্রসদ্র ভাবে একটা বিয়ে হয়েছিল। আর ওই নোচে! ও তো আর এক ‘ঢেমনা’। ও নাকি পাড়ার সুবোধ কাকার নাতনি, আরতির প্রেমে পড়েছে।
আরতির যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন ওর বাপ অকালে কলেরায় মরে যায়। দাদু, সুবোধ কাকা তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করছে। প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে, ছেড়ে দেয় পড়া। দাদুর ঢাক-ঢোল তৈরী বা সারাইয়ের কাজে যোগান দিয়ে দিন কাটায়। শরীর ‘রঙিন হবার’ সময়কাল পার করে আরও বছর দুয়েক পেরিয়েছে তার বয়স তখন। সেই সময় থেকেই নোচে তার পেছনে পড়ে যায়। আরতি তাকে নাকি পাত্তাই দেয় না। কিন্তু নোচের গোঁ, ওকে সে বউ করে ঘরে তুলবে। যখন তখন রাস্তাঘাটে মেয়েটাকে বিরক্ত করতো। আর পাড়ায় একদল নিষ্কর্মা ছেলে ছিল, যারা এইসব অকর্মাকে ধরার জন্যে ওৎ পেতে থাকতো। নোচে একদিন রাত্রে আরতির শোবার ঘরের বাইরে জানলা দিয়ে ফিসফিস করে ডাকছে, “আরতি, তুমি একটু উঠে বাইরে আসবে? তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার আছে। অনেক কথা আছে আমার। তোমাকে সেকথা না বললে আমার রাতের পর রাত ঘুম হচ্ছে না। না-ঘুমে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আরতি। তুমি চাও, এইভাবে তিলে তিলে শরীর খারাপ হতে হতে আমি মরে যাই? আমার এই অকাল মরণের জন্যে তুমিই কিন্তু দায়ী থাকবে আরতি।”
নোচের এই উস্কানীমূলক কথাগুলো পেছন থেকে চৌকী দেওয়া পাড়ার ছেলেরা শুনছিল। ঘরের ভেতর থেকে অবশ্য আরতির কোন গলার শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। নিশ্চয়ই বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখন সে। গভীর রাত। সেটাই স্বাভাবিক। এবার পাড়ার ছেলেরা তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। এখানে ওই মেয়েটার ঘরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন তাকে বিরক্ত করছিল, তার কৈফিয়ৎ চায়। নোচে সাফ কথা জানিয়ে দেয়, সে আরতিকে বিয়ে করবে। খুব ভালোবাসে সে আরতিকে। ও রাজি না হলে সে আত্মহত্যা করবে বলে পণ করে। ভালবাসার কারণে জ্বলজ্যান্ত টগবগে একটা ছেলে আত্মহত্যা করেবে তা কেমন করে হয় ! ছেলেরা কেউ তা চায় না। ওই রাতেই ডাক পড়ল পাড়ার মুরুব্বিদের। ডাক পড়ল আরতির দাদু, সুবোধ কাকা এবং নোচের বাবা মায়ের। সাব্যস্ত হল, নোচের সঙ্গে আরতির বিয়ে দেওয়া হবে, এই রাত্রেই। তবে কোন বরপণ দিতে হবে না মেয়ের পক্ষ থেকে। গরিব সুবোধ কাকা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। বাপ মরা মেয়েটা যে তার গলগ্রহ হয়ে আছে। এই মওকায় যদি মেয়েটার একটা উপায় হয়ে যায় মন্দ কি! আরতির মা, শ্বশুরের কথায় সায় না দিয়ে বলে, “ওইরকম বাজে ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আমার একদম মন নেই। মেয়েও এ ছেলেকে পছন্দ করে না। এ বিয়ে তুমি বন্ধ করো বাবা।” তখন রেগে গিয়ে আরতির দাদু তার মাকে বলে,“তাহলে মেয়ের বিয়ের দায় তোমাকে নিতে হবে। ওর বিয়ের বোঝা আমি এই বুড়ো কাঁধে বইতে পারব না।” তখন বাধ্য হয়ে আরতির মা বলে, “তা আমি মেয়েমানুষ, মেয়ের বিয়ের দায় কেমন করে নেব। তাই যদি তোমার ইচ্ছে তাহলে তাই হোক। সবাই মিলে মেয়েটাকে আমরা দরিয়ায় ভাসিয়ে দিই। ভাসতে ভাসতে উল্টো স্রোতে যদি মেয়েটা আবার তোমার ডেরায় ফিরে আসে তার দায় কিন্তু তোমাকে নিতে হবে বাবা? আমি ঘুম থেকে তুলে দিচ্ছি তোমার নাতনিকে।” বলে আটচালা থেকে তরতরিয়ে বাড়িতে চলে এসে মেয়েকে ডাকে, “এই আরতি, ওঠ! অনেক ঘুমিয়েছিস। আর ঘুমোতে হবে না। ওঠ! ওঠ! তোর বিয়ে! ওঠ! ওদিকে লোকজন সব বাজারে গেছে, বিয়ের সাজ আনতে। মুখ ধুয়ে টুয়ে রেডি হয়ে নে। বাজার থেকে বিয়ের সাজ নিয়ে আসলেই কনে সাজে আটচালায় যেতে হবে। নোচের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে তোর দাদু আর পাড়ার লোকজন। তোর, আমার ইচ্ছাকে ওরা ‘ধরতার’ মধ্যে আনতে চাইছে না।”
কিভাবে রোজগার করে জীবনে বড় হওয়া যায় সেই ভাবনা নেই। কিন্তু অপরিণত বয়সে যখন তখন বিয়ে করার ভাবনায় রুইদাস পাড়া মশগুল। মেয়েদের চাওয়া পাওয়ার এরা কোন দাম দেয় না। কেউ এই অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলে সমবেতভাবে তার উপর চাপ দিয়ে দমিয়ে দেওয়া হয়। ওদের পাড়ার বেশিরভাগ মেয়েই পাড়ার মধ্যে থেকে যায়, পাড়ার কোন না কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে। আটচালার তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
বরং তাকে মদত দিয়ে যায়। আটচালা তথাকথিত মুরুব্বি বিচারকদের কথা, তারা কিছুতেই চায় না তাদের জাত, ‘বর্ণ-শঙ্কর জাতে’ পরিণত হোক। সংসারের ঘানি আর টানতে পারছিল না বিন্দে। পারবে কেমন করে। আগে তো নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। তার পরে তো বিয়ে! একদিন বউ পিটিয়ে, গরুর চামড়া কাটা ছুরি দিয়ে বোয়ের হাতে ‘চ্যাঁ’ দিয়ে সেই রক্ত হাতে নিয়ে ছুটে এসেছে অখিলের কাছে, বিন্দে শালাটা! বলে, চাল কিনে আনতে পারিনি বলে মুক্তি যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি দিচ্ছিল। সহ্য হচ্ছিল না। চুল্লু খেয়েছিলাম, মাথায় খুন চেপে গিয়ে এই ভুল কান্ডটা করে ফেলিছি অখিল। তুই আমাকে কিছু টাকা ধার দে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই বউকে।” কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অখিল বিন্দের গালে সপাটে একটা চড় কসিয়ে বলে,“শালা শুয়োরের বাচ্চা!”
ক্রমশ…

Exit mobile version