মরিচিকা
-মুনমুন রাহা
অন্তু আজ বড় ব্যাস্ত। এবাড়ির কর্তা অর্থাত অন্তুর বিপিন মামা মেয়ে ঝুমুরের বিয়ে আজ।তিনি বড় ভরসা করেন অন্তুর উপর। অন্তুও যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে খুশি রাখার। করারই কথা বিপিন মামা বড় বিপদের সময় আশ্রয় দেন অন্তুকে। অন্তু সে ঋণ কোনদিন ভুলতে পারে নি। তাই তো আজ সানাইয়ের শব্দটা যতই তেতো লাগুক এই বিয়ে বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই সে হাসি মুখে করছে।
প্যাণ্ডেলের লোককে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল অন্তু এমন সময় ডাক পড়ল অন্দরমহল থেকে। বিপিন বাবুর স্ত্রী নয়না দেবী ডাকছেন। গায়ে হলুদ নিয়ে আসা বরের বাড়ির লোকজনের খাবারের ব্যবস্থা করতে । জলখাবারের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। অন্ত পরিবেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল। তখনই চোখ পড়ল ঝুমুরের দিকে। আজ ইচ্ছা করেই অন্তু ঝুমুরের সামনে আসেনি। কি দরকার নিজের ব্যাথা কে নিজে খোঁচানোর ! কিন্ত এখন যখন ঝুমুরের গলার আওয়াজ পেল তখন অবাধ্য চোখটাকে আর আটকাতে পারল না অন্তু।
গায়ে হলুদের জন্য তৈরী হয়েছে ঝুমুর । সেজেছে হলুদ রাঙা শাড়িতে। ভারি সুন্দর লাগছে তাকে। তার অঙ্গের সব অলঙ্কার যেন ফিকে লাগছে ঝুমুরের রূপের আলোর কাছে। হেসে হেসে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলছে সে। অন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মন দিল নিজের কাজে। ঝুমুরকে তার এখন মরিচিকার মতো মনে হয়। বড় কাঙ্খিত , কিন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
দুপুর বেলাটা অন্তু নিজের ঘরে এল । উদ্দেশ্য একটু বিশ্রাম। মানসিক, শারীরিক দুই ক্ষেত্রেই দরকার। এই ঘরে অনেকদিন পরে এল সে।
ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে আজ ।
ভেবেছিল ঘরে এসে বিশ্রাম দেবে শরীরের সাথে মনটাকেও। ঝুমুরের সামনে না থাকলে হয়তো অতীত স্মৃতির থেকে মুক্তি পাবে। কিন্ত তা আর হল কৈ! ঘরে আসতেই মাথার মধ্যে ভির করে এল একরাশ স্মৃতিকথা। এই ঘরটাই একসময় বরাদ্দ ছিল তার জন্য। প্রথম যখন অন্তু এবাড়িতে এসেছিল তখন তার বয়স খুব বেশি ছিল না । বাবা মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়ি থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল অন্তু। কিন্ত মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট হওয়ার পরেও মামা বাড়ির হতদরিদ্রতার জন্য যখন অন্তুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল তখন তার ছোট মামা নিজের বাল্য বন্ধু বিপিন বাবুকে অনুরোধ করেছিল অন্তুর পড়াশোনাতে সাহায্য করতে । বিপিন বাবু অন্তুর রেজাল্ট দেখে তাকে নিজের বাড়িতে নিজের খরচে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রথম দিকে যে মামি নয়না দেবী খুব ভাল ব্যবহার করেছিল অন্তুর সাথে তা ঠিক নয়। তবে ক্রমেই অন্তুর আর নয়না দেবীর দুজনেরই অভ্যাস হয়ে যায় দুজনের ব্যবহার।
ঝুমুর তখন ক্লাস সেভেন। অন্তুর সাথে ঠিক বন্ধুত্ব হয়েছিল বলাটা ঠিক নয়। বরং ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া স্মার্ট ঝুমুর মফস্বলের নিরীহ এবং আপাত আনস্মার্ট অন্তুকে নানা ভাবে অপদস্থ করে বেশ মজা করত। অবশ্য তাতে অন্তু কিছু মনে করে নি কোনোদিন। তবে আস্তে আস্তে অবস্থার বদল ঘটল। বিপিন বাবুর কল্যাণে সব রকম সুযোগ সুবিধা পেয়ে অন্তু উচ্চমাধ্যমিকে তৃতীয় হল। সেইদিন ঝুমুরের চোখে অন্তু প্রথমবার নিজের জন্য কেমন একটা সম্মান দেখেছিল। কলেজের পরিবেশ আর ঝুমুরের বদান্যতায় অন্তুও বেশ স্মার্ট হয়ে উঠল ।
তারপর আস্তে আস্তে ঝুমুরের সাথে সমীকরণ গুলো কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। বন্ধুত্ব থেকে ভাললাগা তারপর ভালবাসা ।
অবশ্য এই ব্যপারে পদক্ষেপটা ঝুমুরই প্রথম নিয়েছিল। অন্তুর মধ্যে বিপিন বাবুর প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ছিল সেটাই বারবার রাশ টানত অন্তুর মনের। কিন্ত ঝুমুরের জেদ আর জোরের কাছে টিকতে পারে নি সে সব । ঝুমুর বলত,
” দেখ , কলেজে পড় ! আর গার্ল ফ্রেন্ড থাকবে না ! তাও কি হয়! লোকে কি বলবে ! আর আমারও একটা বয় ফ্রেন্ডের দরকার । না হলে বন্ধুদের সামনে মান সম্মান থাকছে না । তাই সস্তার সেন্টিমেন্ট সরিয়ে রেখে জীবনে এনজয় কর ।”
সুন্দরী রূপসী স্মার্ট ঝুমুরের ভালবাসার ডাককে অগ্রাহ্য করতে পারেনি অন্তু । মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসেছিল ঝুমুরকে। আঁকড়ে ধরেছিল মনের সবটুকু দিয়ে । তবে অন্তুর বরাবরই মনে হত ঝুমুরের যেন ভালবাসার থেকে অধিকার বোধটাই বেশি। যখন বলবে যে ভাবে বলবে সেভাবেই সব কিছু করতে হবে । বিশেষ করে ঝুমুরের বন্ধুদের সামনে অন্তুকে যেতে হলে অন্তুর জামা থেকে জুতো সবটাই পড়তে হত ঝুমুরের পছন্দের। এমন কি অন্তু কাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তাও ঠিক করত ঝুমুর । ঝুমুরের এই অধিকার প্রধান ভালবাসায় মাঝেমাঝেই হাঁপিয়ে যেত অন্তু । তবুও পরিজনের ভালবাসা না পাওয়া অন্তু তার আর ঝুমুরের সম্পর্কটাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল।
কিন্ত এই ভালবাসা যে কেবল অন্তুর কাছেই দামী ছিল তা জানা গেল কিছুদিন পরে । অন্তু তখন সবে একটা চাকরি পেয়েছে । মাইনেটা অন্তুর কাছে বেশ সন্তোষ জনক। সে আর দেরী না করে ঝুমুরকে প্রস্তাব দেয় বিয়ের। ঝুমুর তখন কলেজের লাস্ট ইয়ারে পড়ছে । বিয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে ঝুমুর । বলে ,
” তুমি ভাবলে কি করে যে তোমাকে বিয়ে করব ! তোমাকে বিয়ে করলে আমার বাবার মান সম্মান কিছু থাকবে ? “
” কিন্ত আমরা তো ভালবাসি একে অপরকে ! “
” ভালবাসা ! ” খুব অবাক হয়েছিল ঝুমুর । বলে ,
“আরে বাবা সমাজে চলতে গেলে কিছু দেখনদারী লাগে । তেমন আমার ও দরকার ছিল কাউকে বয় ফ্রেন্ড বানানো , তো ব্যাস তোমাকে তাই বলেছিলাম। এর মধ্যে এই সব ভালবাসা টালোবাসা টাইপের সেন্টিমেন্ট এনো না প্লিজ। “
নাঃ , কথা গুলো মেনে নিতে পারে নি অন্তু। জীবনের প্রথম ভালবাসার নারীকে বাঁধতে চেয়েছিল আপ্রান। অন্তুর নাছোড় জেদ দেখে ঝুমুর কটাক্ষ করে তাকে। বলে ,
” তোমার স্বপ্ন কোনদিনও পূর্ণ হবে না অন্তু। তুমি ঙ কি ভেবেছিলে আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার সম্পত্তি হাতাবে! তা হচ্ছে না । তোমার মতো একজন ছেলেকে আমি বিয়ে করতে যাবই বা কেন? আমার বাবার আশ্রিতকে বিয়ে করার ভিমরতি আমার হয় নি। তাই তোমার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে । “
কথা গুলোর মধ্যে যে লুকনো বিষের ফলা ছিল তা সেদিন ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল অন্তুর সব স্বপ্ন গুলোকে। অন্তু আর ঝুমুর কে বোঝাতে যায় নি সে সত্যিই কি স্বপ্ন দেখেছিল । কোন সম্পত্তির লোভে নয় বরং একটু ভালবাসার আকাঙ্খাতেই ঝুমুর কে তার জীবনে চেয়েছিল অন্তু । এরপর অন্তু চাকরির অজুহাতে চলে যায় ঝুমুরদের বাড়ি থেকে। তবে ঝুমুরের সাথে যাই হোক বিপিন মামার উপকারের কথা ভোলে নি অন্তু। তাই বিপিন মামা যখনই অন্তুকে ডেকেছেন কোন কাজে অন্তু এক কথায় চলে এসেছে। কিছুদিন আগে অন্তু এবাড়িতে এসে জেনেছিল ঝুমুরের বিয়ে পাকা হওয়ার কথা । বিপিন মামা দেখেছিলেন তার হবু জামাইয়ের ছবি। বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হচ্ছে ঝুমুরের। অবশ্য বিয়ের পর জামাই আর মেয়ে বিপিন মামার বাড়িতেই থাকবে । এমনই ইচ্ছা ঝুমুরের, আর জামাই তো ঝুমুরের কথাতেই ওঠে বসে তাই তারও কোন আপত্তি নেই। এসব কথা বিপিন বাবুই গর্ব করে জানিয়েছিলেন অন্তুকে। ঝুমুরের বিয়ের কথাতে বুকটা মুচড়ে উঠেছিল ঠিকই তবে মনে হয়েছিল এই ছেলেই ঝুমুরের জন্য আদর্শ। যে ঝুমুরের প্রতি কথার তামিল করতে পারবে । এরপর অন্তুর আবার ডাক পড়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠানটা সামলে দেওয়ার জন্য। আসলে বিপিন মামার অর্থ বল থাকলেও ভরসার লোক বলতে অন্তুই। অন্তুও না করে নি , যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করছে সে ।
আজ একলা ঘরে অন্তুর মনে হচ্ছিল অন্যরকম কিছু কথা । আচ্ছা যদি ঝুমুর সেদিন তার প্রস্তাব মেনে নিত! যদি সত্যিই তাদের বিয়ে হত ! তবে অন্তু হয়তো তখন খুশি হত ঠিকই কিন্ত সুখী হত কি ? না কি ঝুমুর কে সুখী করতে পারত ! অন্তু বোধহয় নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সারা জীবন কেবলমাত্র ঝুমুরের দাস হতে পারত না ! আর তাতে অন্তু বা ঝুমুর কেউই সুখী হত না। তাই যে যদি গুলো হয় নি তা বোধহয় ভালোই হয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ। মিষ্টি আনতে যেতে হবে যে ! তাই আবার ডাক পড়েছে অন্তুর। অন্তু মনের ভিতর থাকা সব যদি গুলোকে পুরোনো ঘরের অন্ধকারে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসে । ঠিক করে আর ছুটবে না মরিচিকার পিছনে। এবার পালা সামনে তাকানোর।