জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ সাঁইত্রিশ ]
চারজন ছাত্রীকে টিউশনি পড়াতো অলোকাদি। বেসিক ট্রেনিং পড়তে যখন চলে যাচ্ছে তখন স্কুল শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়। এবার এই মেয়েদের পড়াশোনার কি হবে? চিন্তায় পড়ে যায় সে। ছাত্রীরা এবং তাদের বাবা মায়েদেরও মাথায় হাত। অন্য যারা টিউশানি পড়ায় তারা কেউ বাড়িতে এসে এই অসময়ে তার বাসি হতে যাওয়া ছাত্রীদের পড়াতে রাজি হবে না। এদের অভিভাবকরা চেষ্টাও যে করেনি তা নয়। কিন্তু রাজি হয়নি কেউ। আর অলোকাদির মত এত কম পয়সায় বাইরের কেউ টিউশনি পড়াবে না। সেইসঙ্গে অলোকাদির মত ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর তো প্রশ্নই নেই। দু’একটা কোচিং সেন্টার অবশ্য নিমরাজি হয়েছিল, তাদের সেন্টারে এসে পড়ার জন্যে। কিন্তু বছরের মাঝপথে কোচিং সেন্টারে পড়ে কোন লাভ নেই। অলোকাদিও তাদের সেই পরামর্শ দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন যে অলোকাদি কোনভাবে চেষ্টা করলেও বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে না। কেননা সারদা মন্দিরে বেসিক ট্রেনিংয়ের গোটা ব্যাপারটাই রেসিডেন্সিয়াল। আর এই ক’টা মেয়ের পড়ানোর জন্যে তো সে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে অলোকাদি তার উৎকন্ঠার কথাটা সনাতনকে জানায়। তারপর বলে, “ভাই, তুই আমার একটা উপকার করবি? একমাত্র তুই পারিস আমার এই মরমে মরার হাত থেকে বাঁচাতে। আগে কথা দে, আমার কথা তুই রাখবি? তাহলে তোকে বলব। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি যে আরও কষ্ট পাবো। তোকে যে আমি আমার আপনজনের চোখে দেখি।”
-আপনজন কখনো আপনজনকে কষ্ট দিতে পারে দিদি? বলোই না তোমার কথাটা। তারপর দেখো, আমি সেই কথাটা রাখতে পারি কি না।
-ওই মেয়েগুলোকে তুই পড়াবি? ওদের মধ্যে দু’জন নাইনে পড়ে আর দু’জন টেনে। টেনের দু’জনের জন্যে আমার আরও বেশি চিন্তা। পরের বছর তো ওরা মাধ্যমিক দেবে। কি হল! হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস যে? ভাবছিস নাইন টেন ক্লাসের ছাত্রীদের তুই পড়াতে পারবি কি না, তাই তো? আলবাৎ পারবি তুই। পড়াশোনায় তুই অত ভাল। তুই ওদের পড়াতে পারবি না সেটা হতে পারে না। তুই পারবি। সে আস্থা তোর ওপর আমার আছে। হ্যাঁ, একটা চিন্তা তোর হতে পারে, তুই কোনদিন কাউকে টিউশানি পড়াস নি। তাই তার ধরণ-ধাঁচে তুই রপ্ত নোস। কিন্তু সেটা বা হবে কেন। একটু পাল্টা বুদ্ধি চালা না। তুই তো টিউশনি পড়েছিস। এবার তুই পড়াবি। মাস্টারমশাই তোকে যেমন নিয়মে পড়াতো সেটা মনে কর না। বুদ্ধি খাটিয়ে সেই বুদ্ধি এবার তুই মাস্টারমশাই হয়ে প্রয়োগ কর ! তাহলে ওই অনভিজ্ঞতাজনিত ভাবনা থেকে মুক্ত হতে পারবি। আবার বলছি সনাতন, তুই পারবি। সনাতনের উপর গভীর আস্থা রেখে অলোকা বলল।
সে যাতে মাঝপথে ফেলে যাওয়া তার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে তাই অলোকাদি তাকে এতটা উৎসাহ দিচ্ছে তা সনাতন খুব সহজেই বুঝে নেয়। দিদির ধারণাটা যে একদম অমূলক তাও নয়। চেষ্টা করলে সে পেরে যাবে। সেই বিশ্বাস তার নিজের ওপর আছে। কিন্তু খটকা তো অন্য জায়গায় লেগে যাচ্ছে। সেদিকটা মনে হয় অলোকাদি অত তলিয়ে ভাবে নি। সনাতন প্রস্তাবটা শোনা মাত্রই সেই কথা ভেবে, তার মাথায় তালগোল পাকাতে শুরু করে!
ভাবনায় ঢুকে গিয়ে সনাতন কিছুক্ষণ কোন কথা বলে না। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে যেন। সম্বিৎ ফেরে অলোকার কথায়,“কিরে ভাই, একদম চুপ মেরে গেলি যে? আমার কথার কিছু একটা উত্তর দিবি তো, না কি! আমি যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি তোর উত্তরের জন্যে?”
-দিদি, আমি যে দিকটার কথা ভাবছি, সেটা কিন্তু ওই পড়াশোনার দিকটা নয়। টাকাপয়সার দিকও নয়। টাকাপয়সা তুমি যা নিতে সেটা দিলেও আছি, না দিলেও আছি। পয়সার দরকার আছে ঠিকই। কিন্তু বিদ্যে বেচা আমার চিন্তা ভাবনার একদম বাইরে। তাই এইসব নিয়ে আমার দিক থেকে তোমার উৎকন্ঠার কোন দরকার নেই। যেটা আমার প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন সেটা হল, আমি যাদের পড়াবো তারা তো সব্বাই ছাত্রী। আর আমি ছেলে। মেয়েরা ছেলে মাস্টারের কাছে পড়বে, সেটা তাদের গার্জেনরা মানবে? তুমি মেয়ে বলে, অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের তোমার কাছে পড়তে দিয়েছে। গার্জেনরা হয়তো চাপে পড়ে নিমরাজি হতে পারে। কিন্তু আমাদের পাড়ার মানসিকতা তো তুমি খুব ভাল করে জানো। আমার এই পড়ানোর বিষয়টা আবার শেষ পর্যন্ত আটচালায় উঠবে না তো? আমায় মেয়ে পড়ানোর অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না তো? আর একটা কথা আমার বলার আছে দিদি। আমার হাতে যা সময় আছে, তাতে চার ছাত্রীর বাড়ি চার টাইমে পড়াতে যাওয়া হয়ে উঠবে না। চারজনকে আমি একসঙ্গে পড়াতে পারি। তা সে যেকোন ছাত্রীর বাড়ি হতে পারে। অথবা তাদের কারোর বাড়ি সেই পরিস্থিতি না থাকলে আমাদের বাড়িতে তারা পড়তে আসতে পারে। আমাদের বড় দাবায়, যেখানে আমি এখনো পড়ি, সেখানে চারজন কেন, আটজনের একসাথে পড়তে বসার ব্যবস্থা করা যাবে। এই দিকগুলো একটু ভাববার ব্যাপার আছে দিদি। তুমি কিন্তু ভাববে না, এইসব কথা বলে আমি না-পড়ানোর অজুহাত দেখাচ্ছি। এগুলো তো একদম জ্বলন্ত বাস্তব কথা। একটা ছেলে, মেয়েদের পড়াতে গেলে মনের ভাবনা একটু
উদার না হলে সবকিছু খাপ খাবে কেমন করে? তুমি আমার কথাগুলো একটু ভাবো দিদি। তারপর তার একটা সমাধান আমাকে বাতলাও। তেমনভাবে আমি এগোব। মনে হয় সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারব, যদি ঠিক ঠিক পদক্ষেপ আমরা নিই।
এই সনাতন ছেলেটা কেমন বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করল। এত গভীরে গিয়ে ভাবার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। এইটুকু বয়সে সমাজ জীবনের ভাব-ভাবনায় কত যেন পরিণত হয়েছে ছেলেটা। এর যত কাছাকাছি সে আসছে তত যেন অবাক হচ্ছে। ছেলেটা যে কথাগুলো তার সামনে তুলে ধরল,তার কোনটাই উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। অলোকা খানিক চিন্তা করে তারপর বলল,“সনাতন মেয়েরা তোর কাছে পড়বে কি পড়বে না,ওই ব্যাপারটা আমি দেখছি। তিনজন গার্জেন তো আমাকে বলেছিল, অন্য ব্যবস্থা করে দিতে। আর একজন ওসব কিছু বলেনি। আমি প্রত্যেক ছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। আর ওই একসাথে চারজনকে পড়ানো যায় কি না সে বিষয়টা নিয়েও ওদের সঙ্গে কথা বলছি। ওরা এখন অসুবিধায় পড়ে গেছে। সম্মানজনক যে কোন প্রস্তাবে ওদের রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। হয়তো হয়েও যাবে। মেয়েদের কারোর বাড়িতে যদি সেই সুযোগ না থাকে তো তোর বাড়িতেই পড়াবি। তবে ওই পাড়া, আটচালা- এই ব্যাপারটা তো আমার এক্তিয়ারের বাইরে। ওই ব্যাপারটা তোকেই সামলাতে হবে। তার জন্যে যদি তোর সাথে আমাকে যেতে হয়, আমি রাজি আছি। চলে যাব।”
অলোকার কথায় সায় দিয়ে সনাতন বলল,“ঠিক আছে দিদি। পাড়া আটচালার দিকটা আমি দেখছি। আর তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আশাকরি চেষ্টা জারি রাখলে আমি সফল হব।”
সনাতন প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে তার বাবা রতনের সঙ্গে আলোচনা করল। ওর বাবা বলল,“টিউশনি পড়াবি, সেটা তো ভাল কথা। এতে বুদ্ধি চকচকে হয়। পুরোনো পড়া চর্চায় না থাকলে পুরোনো লোহার মত তাতে জঙ লাগে। জঙধরা লোহা ক্রমাগত ঘষতে ঘষতে যেমন চকচকে হয়ে যায়, তেমনটা আরকি। একমাত্র টিউশানিই স্মৃতির সেই জঙ ঘষে মেজে ঝাঁ চকচকে করে তুলতে পারে। তাতে হবে কি, তুমি যখন উঁচু ক্লাসে উঠবে সেটা কাজে লাগবে। সে তো এক কথা। কিন্তু মেয়েদের পড়ানো নিয়েই তোমার বেলায় চিন্তা তো থেকেই যায়। তা একটা কথা বলি বাবা, পড়ানো শুরু করার আগে বিষয়টার একটা ফয়সালা করে নেওয়া সঠিক কাজ হবে। আমি নিজে সরাসরি বললে ওরা ভাববে নিজের ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছে। অন্য কেউ হলে বেঁকে বসতো। তাই তুমিই যাবে। তুমি যাবে নন্দ কাকার কাছে। সুবোধ কাকার কাছে। আর যাবে নিত্যানন্দ আর দিবাকরের কাছে। কাউকেই বিস্তারিত কিছু বলতে হবে না। শুধু বলবে, আপনারা অনুমতি দিলে আমি পাড়ার মেধাবী কয়েকটা মেয়ের পড়াতে পারি। তাদের বাবা-মা আমাকে খুব করে অনুরোধ করছে। এবার পাড়ার আপনাদের মত সম্মানীয় মানুষদের অনুমতি ছাড়া আমি ছেলে হয়ে কেমন করে মেয়েদের পড়াতে পারি। তারপর পাড়ার অন্য লোক এই নিয়ে যদি নিন্দেমন্দ কোন কথা বলে তাহলে মেয়েদের গায়ে বদনামের কালি লেগে যাবে। সেটা তো ঠিক কাজ হবে না তাই। দেখবে, এই কথা বললে ওরা নিজেরা মনে মনে গর্ব বোধ করবে। কোন দ্বিধা না রেখে তোমাকে আশীর্বাদ দিয়ে দেবে। ওদের নাড়ির গতি আমার খুব ভাল করে জানা। তারপরও অবশ্য পাড়ায় যারা সবসময় মানুষের খুঁত ধরে বেড়ায় তাদের চপচপানি এড়ানো যাবে না। সেটা বন্ধ করতে তখন আর আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হবে না। এই মুরুব্বিরাই সব সামলে নেবে। নিন্দেমন্দের কালো পাঁক-জল বেশিদূর গড়াতে দেবে না।”
বাড়ির বড়রা যে সত্যিই মাথার উপর ছাদ। সনাতন তার বাবাকে দিয়ে প্রমাণ পেল। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। পাড়ার সিনিয়র মানুষদের অনুমতি নিয়ে সে তাদের বাড়িতেই মেয়েদের পড়ানো শুরু করে দিল। এদিকে যখন সনাতন পাড়া সামলাচ্ছে, ওদিকে অলোকাদি মেয়েদের দিকটা একদম ঠিকঠাক ভাবে সামলে দিয়েছে। খুশি মনে অলোকাদি তাকে বলেছে,“কি জানিস, আসলে ছেলেটা যেহেতু সনাতন রুইদাস, তাই আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমার অতিরিক্ত কোন মেহনত করতে হল না। প্রত্যেক গার্জেন আমার প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত খুশি মনে মেনে নিয়েছে। মানুষ যে তোকে এতটা স্নেহের এবং ভালোবাসার চোখে দেখে তা জানা ছিল না আমার। তুইও জানিস না। তোর জানার দরকারও নেই। তুই তোর মত থাক। যাক! তবে গার্জেনরা একটা কথা বলেছে, সনাতন যেন ওই ব্যাচটায় অন্তত কোন ছেলেকে না পড়ায়। ওটা মেয়েদেরই ব্যাচ হিসেবে পড়ায়। তার উত্তরে আমি বলেছি,“এই একটাই ব্যাচ ও পড়াবে, তাও আমার অনুরোধে। টিউশনি ও পড়ায় না। ওর হাতে অত সময়ও নেই। সামনে ওর নিজেরই এইচ.এস. পরীক্ষা। সময় কোথায় অত ওর। তারপর বাবাকে সাহায্য করার জন্যে বাবার দোকানে ওকে নিত্য বসতে হয়।” এরপর কয়েকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে অলোকা আবার বলল, “এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে সারদা মন্দিরে পড়তে যেতে পারব। আমার মনটা এত হাল্কা লাগছে যে কি বলব।”
নাইনের দুটো মেয়ে আশাতীত ভাল রেজাল্ট করে ক্লাস টেনে উঠেছে। আর অন্য যে দু’জন টেনে পড়ে তারা টেস্ট পরীক্ষায় এক চান্সে উতরে গিয়েছে
যথেষ্ট ভাল নম্বর নিয়ে। এদের সকলের গার্জেন দারুণ খুশি মেয়েরা এতটা উন্নতি করায়। গার্জেনরা বলে, সনাতনের হাতে পড়ে মেয়েরা এতটা ভাল ফল করতে পারল। সংবাদটা অলোকাদির কানেও যায়। সনাতনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে অলোকাদি। সেই কথাটা বিপ্লবদার মাধ্যমে জেনেছে সে। বিপ্লবদা বলে,“এখন তো তোরই জয়জয়কার রে সনাতন। ওই চারটে মেয়ের বাবারা তো পাড়া মাত করে বেড়াচ্ছে তোর পড়ানোর গুনের কথা বলে। আমারও কানে এসেছে।” খুশিতে সনাতন বলল,“আমি আমার সাধ্যমত যতটা পারি ওদের কোচিং দিয়েছি। ওরা সেগুলো ধরতে পেরেছে বলেই তো পরীক্ষায় ঠিকঠাক লিখেছে। আমার থেকে যোগ্যতা ওদেরই বেশি। তাই বাহবা যদি পেতেই হয় তাহলে সেটা প্রাপ্য মেয়েদেরই।”
সুন্দরী নাইন থেকে টেনে উঠেছে। এবারও সে সনাতন স্যারের কাছে পড়বে। ওর বাবা চেয়েছিল, যেহেতু মেয়ে পরের বছর মাধ্যমিক দেবে, তাই স্কুলের অভিজ্ঞ মাস্টারের কাছে টিউশনি পড়ানোর জন্যে। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে। সে তার বাবাকে বলে,“সনাতন স্যারের মত অত গুছিয়ে সুন্দর করে স্কুলের কোন মাস্টার পড়াতে পারে না। স্যার একবার বুঝিয়ে দিলে মাথার মধ্যে একদম গেঁথে থাকে সেই পড়া। আর স্কুলের যে স্যারের কথা তুমি বলছো, ও স্যার তো নিজের মত হুড়মুড়িয়ে বকর বকর করে চলে যায়। ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টা বুঝলো কি না বুঝলো সে দিকে নজর তার থাকে না। পড়াও তেমন ধরতে চায় না। আবার পরের দিন অন্য চ্যাপ্টারে চলে গেল। কেউ যদি নিজে থেকে না-বুঝতে পারা কোন বিষয় নিয়ে জানতে চায় তখনও একই ঢঙে বলবে, এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো? তারপর বকার ভয়ে কেউ সাহস করে বলে না যে ‘বুঝতে পারেনি।’ এমন স্যারের কাছে পড়লে আমার ভাল রেজাল্ট কিছুতেই হবে না। তুমি ওই স্যারের কাছে আমাকে টিউশনি পড়তে যেতে বোলো না বাবা। সনাতন স্যারের কাছে যেমন পড়ছি, তেমন পড়তে চাই। এই স্যারই আমার কাছে ঠিক আছে।” সুন্দরীর অন্য বন্ধুটা সনাতন স্যারের কাছ থেকে ছেড়ে গিয়ে ওই স্কুলের স্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়তে গেল। আর যে দু’জন মাধ্যমিক ফাইনাল দেবে, টেস্ট পরীক্ষার পর তারা আর বিশেষ আসে না। মাঝে সাঝে কোথাও আটকালে দেখে নিয়ে যায়। সনাতন নিজে থেকেই বলেছে, তাদের প্রয়োজন হলে কোন দ্বিধা না করে যেকোন ডাউট ক্লিয়ার করে যেতে।
একজন ছাত্রীর জন্যে তার এতটা সময় ব্যয় করা কতটা সঠিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সনাতন। এতে এমনিতেই নিজের পড়ার টাইম কাটতে হয় তাকে। তাও, চারজন ছিল বলে মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একজনের জন্যে সেটা করা তো মুশকিল। সুন্দরীকে বলেছিল সে যে, তার একার জন্যে এতটা সময় ব্যয় করা সম্ভব নয়। সে যেন অন্য কোথাও খোঁজ খবর করে ভাল স্যার দেখে চলে যায়।
মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না সুন্দরী। আকাশ থেকে পড়ার মত বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,“আপনি আমাকে পড়াবেন না স্যার? আমি তাহলে কোথায় যাব? বাবা তো আমাকে স্কুলের ইংরেজী স্যারের কাছে পড়তে বলেছিল। আমি যেতে রাজি হইনি, আপনার কাছে পড়বো বলে। বাবা বলে দিলে হয়তো এখনও গেলে সেখানে ভর্তি হতে পারব। কিন্তু আমি সেখানে যাব না। আপনি যদি আমাকে না পড়ান তো আমি পড়া ছেড়ে দেব।” বলে ফোঁসফোঁসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সেই শুরু আর যেন শেষ হতে চায় না! ফোঁসফোঁসানি শব্দ অবশেষে বন্ধ হলে কি হবে সমানে আন্দোলিত হতে থাকা দু’বুক জানান দিচ্ছে, তার ভেতরের কান্না তখনও সমানে জারি রয়েছে। সেই অন্দোলনকে আপাতত দমন করার জন্যে সনাতন অবশেষে বলতে বাধ্য হল যে,“ঠিক আছে। এখন তুমি চুপ করো। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়। তুমি যেমন মাধ্যমিক দেবে সামনের বছর। আমি তেমনি এই বছরই উচ্চমাধ্যমিক দেব। আমারও তো পড়ার টাইমটা বার করতে হবে। অলোকাদি তোমাদের পড়ার মাঝপথে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল বলে সেই গ্যাপটা আমি পূরণ করার জন্যে তোমাদের পড়াতে রাজি হয়েছিলাম। তার মানে তো এই নয় যে, আমি পেশাগতভাবে পড়াতেই থাকব। তারপর তোমার একার জন্যে আমার সময় কাটিয়ে দেব কেমন করে সেটাই তো ভেবে উঠতে পারছি না। আবার তুমি বলছো, আমি না পড়ালে পড়া ছেড়ে দেবে। এটাও তো বোকা বোকা সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কোন মানে হয় না। আমাকে দু’চারদিন সময় দাও। তারপর আমি তোমাকে না হয় ফাইনাল জানিয়ে দেব।”
ইতিমধ্যে সনাতন মাস্টারের ছাত্রীরা আশাতীত রেজাল্ট যে করেছে সেটা ছাত্র সমাজে চাউর হয়ে গেছে। তারপর চাউর হয়েছে তার অমায়িক ভদ্র আচরণের প্রসঙ্গও। অভিভাবক মহলেও সেটা বেশ প্রচার পেয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে একের পর এক গার্জেন সনাতনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। এমনকি বাজারে সনাতনের বাবার দোকানেও তার সঙ্গে অনেকে দেখা করতে আসে, তার মেয়েকে পড়াতে চেয়ে। সনাতনের বাবা, রতন এতে বেশ খুশি বোধ করে। তার ছেলের কাছে কত ভদ্রলোকেরা এসে অনুরোধ করছে, তাদের মেয়েদের পড়াবার জন্যে। এটা কি কম ভাললাগার ব্যাপার ! আবেগে ছেলেকে জিজ্ঞেস না করেই রতন কাউকে কাউকে বলে দেয়, তার ছেলে পড়াবে। আমি বলে দেবো’খন, তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। বাবার কাছ থেকে পরে শুনে সনাতন একটু দ্বিধা বোধ করে, কিন্তু গুরুজন, বাবাকে কিছু বলে না। ও বোঝে বাবা চাইছে সে পড়াক। সংসারে কিছু আয় বাড়ুক। অবশেষে একরকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় সে। রাজি হয়ে যায় পড়াতে। সুন্দরীকেও সেটা জানিয়ে দিতে তার সে কি আনন্দ! সুন্দরীর আনন্দের এতটা বহিঃপ্রকাশ দেখে থমকে যায় সনাতন! অন্য ভাবনা মনের মধ্যে না প্রশ্রয় দিয়ে এড়িয়ে যায় সুন্দরীর তার অতি-আগ্রহপনা ভাবনাকে। এক এক করে সুন্দরীকে নিয়ে ছয়জন ছাত্রী হয়ে যায়। তিনজন ছাত্রও আসে পড়ার প্রস্তাব নিয়ে। সনাতন এককথায় তাদের ফিরিয়ে দেয়,“মেয়েদের ব্যাচের সঙ্গে ছেলেদের আমি পড়াই না। আর ছেলেদের জন্যে আলাদা ব্যাচ খোলার আমার কোন অভিপ্রায় নেই। তাহলে আমার নিজের পড়ার দফারফা হয়ে যাবে। নিজের ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। উচিৎ ও নয়।” তাদের নিরাশ করতে বাধ্য হয়েছে সনাতন।
সনাতন স্যারের কাছে পুরোনো ছাত্রী সুন্দরী। তাই এখানে সে অন্য সকলের থেকে বেশি সপ্রতিভ। ভাবটা এমন দেখায়, স্যারের প্রতি তার আধিপত্য অন্যদের থেকে বেশি। তাই আবদারের বহরও চোখে পড়ার মত। সনাতনের একটা সুবিধা হয়েছে, সব ছাত্রীই ক্লাস টেনের। ভিন্ন ক্লাসের হলে যে পড়া আলাদা আলাদা করে দেখাতে হত তার। তবে একা সুন্দরীর দাপটে তার যেন নাজেহাল হবার উপক্রম। সুন্দরী তাদের পাড়ার মেয়ে। সনাতনদের চারটে বাড়ির পরে তাদের বাড়ি। যে চ্যাপ্টারের পড়া আগের দিন শেষ করে দিয়েছে। পরের দিন নতুন পড়া ধরার কথা, হঠাৎ সুন্দরী বলে বসলো,“স্যার আগের পড়াটা আর একবার ঝালিয়ে দিন। আমার বুঝতে একটু খটমট লাগছে। ও বুঝে গেছে যে স্যারকে এটা বললে স্যার সেটা ক্লিয়ার না করে নতুন পড়ায় যাবে না। অন্য ছাত্রীদের ইচ্ছা নতুনে যাবার। সুন্দরী তা মানতে নারাজ। জোর খাটাতে থাকে স্যারের উপর। অগত্যা অন্যদের বুঝিয়ে স্যার বাধ্য হয় পুরোনোকে ঘষামাজা করতে।
সেবার পরপর দু’দিন পড়ানো বন্ধ ছিল। সনাতন স্যারের পেটের গন্ডগোল। সুন্দরী, স্যারের মায়ের কাছ থেকে জেনেছে স্যারের ডিসেন্ট্রি হয়েছে। শোনামাত্রই দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে আধঘন্টার মধ্যে একপাঁজা ‘থানকুনি পাতা’ এনে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলে,“এর রস স্যারকে খাওয়াবে কাকিমা। আর থানকুনি পাতার ঝোল করে দেবে। আমার মা বলেছিল, কয়েকবার খেলেই এতে আমাশয় ধরে যাবে। স্যারের কষ্ট কমে যাবে!” বলে সঙ্গে সঙ্গে টানা দৌড় দিয়ে চলে যায় তাদের বাড়ির দিকে। সুন্দরীর এই আচরণে সনাতনের মা হাঁ করে একগাদা প্রশ্ন-মুখে দৌড়তে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ক্রমশ….