ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (১৯)

জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

[ আটত্রিশ ]

দিদিমা তাকে এমন করে বাড়ি চলে যাবার কথা বলাতে বাবলা মনে বেশ কষ্ট পায়। কি ভেবে দিদিমা তাকে কথাগুলো বলল, ও বুঝে উঠতে পারছে না। বাবলা খুব ভাল করে জানে, মামা-মামী দিদিমাকে কোনদিন খেতে পরতে দেবে না। দাদু মারা যাবার পর বাড়ির সম্পত্তি তার নামে লিখে দিতে বলেছিল মামা। বাবলা জেনেছে, মামীর বুদ্ধিতেই মামা, দিদিমাকে বলেছিল। দিদিমা রাজি হয়নি। বলেছিল, “বাস্তুর কিছুটা অংশ আমি বাবলাকে দিতে চাই। সেই এতটুকু বয়স থেকে ওকে আমি মানুষ করেছি। এটাকেই ও নিজের বাড়ি বলে মানে। তুই যদি তাতে রাজি হোস তাহলে তোদের মামা-ভাগ্না দু’জনের নামে বাস্তুর সম্পত্তি ভাগাভাগি করে লিখে দিতে পারি।” রাজি হয়নি মামা। ভীষণ রেগে গিয়ে মামা তার মাকে বলেছিল, “মরার সময় কে তোর মুখে জল দেয় আমি দেখব। মেয়ের ঘরের নাতি। ওরা কোনদিন আপন হতে পারে না। সম্পত্তি নিয়ে সেটা বিক্রী করে কেটে পড়বে। এই ছেলের পায়ে এসে শেষ পর্যন্ত মাথা খুঁড়তে হবে। তখন তোর কি হাল করি আমি, দেখবি!”
মামার এমন হুমকির সামনে দিদিমা কিন্তু একদম দমে যায়নি। বুড়ি শিরদাঁড়া শক্ত করে সেদিন বলেছিল, “তোকে ওই কাজটা করতে যাবার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। সেই কামনা ভগবানের কাছে আমি করছি।” বলে বুড়ি, দিদিমা, তার আদরের নাতিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। আর তার কিছুদিন পরেই এই বাস্তুর অর্ধেক অংশ বাবলার নামে লিখে দেয়, দিদা। সেই দিদিমাকে সে কিনা ‘জলে’ ফেলে দিয়ে স্বার্থপরের মত চলে যাবে? তার আদরের দিদাকে নির্দয় মামার হিংসার আগুনে সঁপে দেবে ! এ কোনদিন সে জীবন থাকতে করতে পারবে না। মন-খারাপি হৃদয়ে সে পাশের ঘরে চলে গিয়ে গোমড়া মুখে বসে থাকে ! দিদিমার বুঝতে অসুবিধা হল না তার প্রিয় দাদাভাই রেগে গেছে তার উপর। আস্তে আস্তে নাতির কাছে গিয়ে তার মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “দাদা, আমার ভুল হয়ে গেছে রে। এখান থেকে চলে যাবার কথাটা তোকে বলা আমার একদম ভুল হয়েছে। বুড়ো মানুষ তো। কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ভাবলাম কচি ছেলে তুই। এত কষ্ট করবি। আমার মনটা যেন তখন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু তোর মন কি চায় সেটাও আমার ভাবা দরকার ছিল।” মাথায় হাতের আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “দাদা, গরুটা বিক্রি করে যা টাকা হয়েছিল সেটা দিয়ে এতদিন সংসার চালিয়ে এখন আমার কাছে হাজার দুই টাকা পড়ে আছে। ওটা তুই নিয়ে যা। দেখ, ওটা দিয়ে কি কারবার করা যায়।” দিদার কথায় অবাক হয়ে মুখ তুলে বাবলা বলল, “ওই ক’টা টাকা নিয়ে নিলে সংসার চলবে কেমন করে, দিদা?”
-কেন, ব্যবসা করে লাভ করবি তো। সেই টাকায় আমাদের দু’জনের সংসার তালেগোলে ঠিক চলে যাবে, দাদাভাই।
-কিন্তু যদি লাভ না করতে পারি? তখন তো শুকিয়ে থাকতে হবে। ও টাকা আমি নেব না, দিদা। বিনা পুঁজিতে কি কারবার করা যায় তুমি সেই বুদ্ধিটা দাও না দিদি? সুবোধ বলেছে, ট্রেন এমন একটা জায়গা, সেখানে যে জিনিস নিয়ে কারবার করবি, সেটা বিক্রী হবে। কত ধরনের, কত রুচির মানুষ এই ট্রেনে যাতায়াত করে, তা এই হকারি করতে না এলে আমি জানতে পারতাম না। তা দিদা, বিনা পুঁজিতে কি জিনিস নিয়ে আমি কাজ করতে পারি, কি জানি! কিছুতেই বুদ্ধিটা মাথায় আসছে না।”
খানিক চুপ থেকে দিদা বলল, “একটা কাজ কর দাদা। কাশেম মিঞার বিল ভর্তি হয়ে লকলক করছে কাঁড়ি কাঁড়ি কলমি শাক। ওই শাক আমি কেটে নিয়ে এসে ধুয়ে ধায়ে সুন্দর করে গুছিয়ে আঁটি বেঁধে দেবো। আমাদের বেতের বড় খোড়ায় করে তুই ওই টাটকা শাক সকাল সকাল ফাঁকা ট্রেনে ফিরি করবি। সব গেরস্ত বাড়ি এই শাক ভাজা-তরকারি করে খায়। মনে হয় তোর এই টাটকা শাক দেখলে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। দেখনা একবার চেষ্টা করে। তোর কপালে শিকে ছিঁড়তেও পারে।”
দিদিমার বুদ্ধি মন্ত্রের মত যে কাজ করে যাবে তা বাবলা কল্পনাও করতে পারেনি। সুবোধরা তো নয়ই। ওরা মনে মনে হেসেছিল বাবলার এই কান্ড দেখে। তবে বাবলা যাতে দমে না যায় তাই মুখ ফুটে কিছু বলেনি তাকে। যত দিন এগোয়, বাবলার কলমি শাক তত জনপ্রিয় হতে থাকে। বিনা পুঁজির কারবার। দিদিমা কাশেম মিঞার বিল থেকে শাক কেটে আনে আর নাতি ট্রেনে হকারি করে। ভালই আয় হতে থাকে। সংসার চালিয়ে বেশ কিছু টাকা জমতেও থাকে।
সেদিন অন্য খরিদ্দারের সঙ্গে এক সাধুবাবাও হাত বাড়াল, বাবলার কলমি শাক কেনার জন্যে। সাধুবাবা দুটো শাকের আঁটি নিয়ে গেটের মুখে ডানদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবলা অন্য খরিদ্দার সামলে সাধুবাবার কাছে গেল শাকের দাম নিতে। সকালের ফাঁকা ফাঁকা রেলগাড়ী। সাধুবাবা দাম দিতে দিতে বাবলাকে বলল, “তুমি তো পল্লী-গাঁয়ের ছেলে। কয়েকটা গাছের মূল আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে? না, মাগনা নেব না তোমার কাছ থেকে। আমার কিছু আফলা বিল্ব মূল মানে যে বেলগাছের তখনও কোন ফল ধরেনি, সেই গাছের মূল আর অনন্ত মূল খুব দরকার। যে লোকটা আমাকে এগুলো দিয়ে যায়, কেন জানিনা, সে আর আসছে না। খুব অসুবিধায় পড়ে গেছি। গ্রামের ছেলে তুমি। চেষ্টা করলে জোগাড় করে দিতে পারবে। আর যদি তুমি বরাবর আমাকে এগুলো জোগাড় করে দিতে পারো তাহলে তোমাকেই পাকাপাকি অর্ডার দেব। শুধু এই দুটো নয়, আরও অনেক জিনিসের বরাত তোমাকে দিতে পারি। যদি তুমি ঠিক ঠিক কথা রেখে কাজ করতে পারো। সেটা পরের কথা। এখন দেখো এই দুটো মূল তুমি জোগাড় করতে পারো কি না। আবার তিন দিন পরে এই গাড়িতে এই কামরায় তুমি আমাকে দেখতে পাবে।”
কথাটা শুনে বাবলার জানার কৌতূহল হল এগুলো ঠিক কি কাজে লাগে। যেটা নিয়ে সে কাজ করবে, তার গুনাগুন জানাটা জরুরী। ভবিষ্যতে তার কাজে লাগতে পারে। তাই সাধুবাবার সামনে হাত জড়ো করে বলল, “প্রভু, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, অপরাধ নেবেন না? আমার খুব জানার ইচ্ছে করছে, তাই।”
-তুমি কিশোর। নিষ্পাপ। বলো তুমি কি জানতে চাও।
-এগুলো মানুষের কি কাজে লাগে একটু আমাকে বলবেন? সাধুবাবা মুচকি হেসে বলল,“গরীব মানুষরা, যাদের বিভিন্ন দরকারে পাথর ধারণ করার জন্যে জ্যোতিষীরা সুপারিশ করে তাদের পক্ষে সবসময় দামি দামি পাথর কেনা সম্ভব হয় না। তাদের জন্যে পরিবর্ত হিসেবে এই বৃক্ষমূল দেওয়া হয়। অবশ্য পাথরের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় পরিবর্ত ধাতুও। সেটা যদিও পাথরের থেকে কম দাম কিন্তু বৃক্ষমূলের থেকে অনেকটাই বেশি। সবসময় ওই সম্পন্নহীন মানুষদের সেগুলোও কেনার ক্ষমতা থাকে না। এই মূলই তাদের ভরসা। যেমন ধরো এই যে তোমাকে আফলা বিল্ব মূলের কথা বললাম। ‘রবি’ গ্রহের জন্যে কাজ করে। ওর পরিবর্ত ধাতু হল, তামা। আর পাথর হোল চুনী এবং আরও কয়েকটা পাথর। তেমনি অনন্ত মূলের পরিবর্ত ধাতু হচ্ছে তামা। বিল্ব মূল এবং অনন্ত মূল- এই দুই মূলের বদলে তামা ব্যবহার করা যায়। অনন্ত মূলের রত্ন বা পাথর হল, প্রবাল। মঙ্গল গ্রহের জন্যে এই মূল-রত্ন লাগে।
সাধুবাবার কথা শেষ হতে হতে পরবর্তী স্টেশন এসে যায়। এই কামরা থেকে তাকে অন্য কামরায় যেতে হবে। বাবলা হাত জড়ো করে সাধুবাবার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে নেমে পরের কামরায় চলে যায়।
কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দিদিমাকে সাধুবাবার সব গল্প শোনায় বাবলা। বলে, “দিদা, এই মূলগুলো কোথায় পাওয়া যায় তুমি জানো? আমি যদি এগুলো জোগাড় করে দিতে পারি তাহলে আমাকে পয়সা দেবে বলেছে সাধুবাবা। আর কথা রাখলে বরাবরের জন্যে আমার কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে এগুলো কিনবে। আমার ব্যবসার আর একটা নতুন ডাল গজাবে তাহলে।”
নাতির কথায় খুশি হয়ে দিদিমা বলল, “হ্যাঁ রে দাদা। তোর কত চাই বল না। সব আমি জোগাড় করে দেব। তোর কোন চিন্তা নেই। কবে লাগবে, ঠিক তার আগের দিন শুধু তুই আমাকে বলবি। আমি জোগাড় করে সাফ-সুতরো করে রেখে দেব।”
বুদ্ধিটা দিদিমাই তার কানে ঢুকিয়েছিল। সাধুবাবা যেদিন যেদিন বলে সেদিন ওই দু’ধরণের মূল দেয় বাবলা। সঙ্গে সঙ্গে পয়সাও পেয়ে যায়। দিদিমা বলল, “দাদা, তুই এক কাজ কর, আমি যা মূল জোগাড় করে আনি সাধুবাবা তো সবটা নেয় না। বাকিটা ঘরে পড়ে থেকে থেকে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। যে জিনিসটা মানুষকে দিলে পয়সা পাওয়া যায়, সেটা যদি এ’ভাবে শুকিয়ে নষ্ট হয় তো বড্ড গায়ে লাগে। আর আমি কত কষ্ট করে এগুলো জোগাড় করি। যদি কাজে লাগে তো আনন্দ পাই। তা দাদা, তুই এই শাকের খোড়াতেই এই মূলগুলো নিয়ে যা। মানুষকে জানাবি, কলমি শাক ছাড়াও তার কাছে বিল্ব মূল, অনন্ত মূল পাওয়া যায়। আর এই মূলের গুনাগুন যা সাধুবাবার কাছ থেকে জেনেছিস, সেসবই মানুষকে বোঝাবি। দেখবি, কেউ না কেউ তা কিনে নেবে। সাধুবাবা যা দাম দেয় তার থেকে বেশি দামেই তুই বিক্রী করতে পারবি।” বাবলা, দিদিমার কথা শুনতেই হাতনাতে তার ফল পেয়ে যায়। প্রথম দিনেই যা মূল নিয়ে গেছিল সবটাই বিকিয়ে যায়। খুশিতে টগবগ করে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার কি ভাল দিদা! তোমার কথা শুনলে আমার কোন অভাব হবে না।” আদরের নাতির কথায় ভাবে গদগদ হয়ে দিদিমা বলে, “আরে দাদা, ছাড় আমাকে। এভাবে জাপটে থাকলে আমার যে দম বন্ধ হয়ে যাবে। বুড়ো মানুষ, তোর মত যৌবনের ওই দম আর আমার আছে নাকি!”
একজন খরিদ্দার চার আঁটি কলমি শাক নিয়ে তারপর বাবলার খোড়াতে গাছের মূল দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ক্ষিরিকা মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল আছে? নেই তো মনে হচ্ছে। দু’রকমের মূল আছে। কাল ওই দুটো মূল আমাকে এনে দিতে পারবে? খুব দরকার। পয়সার জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।” হকারি করতে করতে বাবলা এখন একটু চটপটে হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, “এই দুটো মূল কেন চাইছেন? কেউ আপনাকে জোগাড় করতে বলেছে না কি?”
-হ্যাঁ, আমার জন্যে জ্যোতিষী, মুক্তা, মুনস্টোন বা এগেট এই তিনটে পাথরের মধ্যে যেকোন একটা পরতে বলেছে। আমার হাতের রেখায় চন্দ্র দুর্বল। ওটা কাটাতে গেলে এগুলোর একটা পরতে হবে। তা স্টোন কেনার পয়সা নেই। তখন রূপা-ধাতু পরতে বলে। শুনেছি, পাথর ধাতুর বদলে গাছের শেকড় বা ডালেও কাজ হয়। সেকথা বলতে জ্যোতিষী আমার জন্যে এই ক্ষিরিকা মূল আর আমার বৌয়ের জন্যে বৃদ্ধদ্দারককের মূল মাদুলিতে করে পরতে বলেছে। বৌয়ের আবার বুধ গ্রহের দোষ পড়েছে।
-ঠিক আছে। আপনি কাল নয় পরশু পেয়ে যাবেন। তবে আমার কাছে যা মূল আছে তার থেকে একটু বেশি পয়সা লাগবে। আপনি যে মূলগুলোর কথা বললেন ওগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায় না। আমাকেও খরচা করে জোগাড় করতে হবে, তাই।
বাবলার খোড়ার ঝাঁকায় এখন কলমি শাকের সাথে সাথে বিল্ব মূল, ক্ষিরিকা মূল, অনন্ত মূল আর বৃদ্ধদ্দারককের মূল থাকে।
সাধুবাবার চোখে একদিন তা পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাবলাকে বলে, “তুমি তাহলে এখন এই শাকের সাথে সাথে গাছের মূল-টুলও বিক্রী করছো? বাঃ ভালোই হল। আমার দরকারে তোমার কাছ থেকে নিতে পারব।” তারপর খানিক চুপ থেকে আবার বলল,“খোকা, তুমি এক কাজ করতে পারো তো… সব গ্রহের মূল তো তুমি তোমার ঝাঁকায় রাখতে পারো। এগুলো যখন জোগাড় করতে পারছো, তাহলে অন্যগুলোও পারবে। যেমন বৃহস্পতির জন্যে বামনহাটির মূল বা ব্রহ্মজৈষ্ঠীর মূল। এর পরিবর্ত ধাতু হোল, সোনা আর রত্ন হোল পোখরাজ বা হলুদ টোপাজ। শুক্রর জন্যে রামবাসকের মূল। ধাতু, প্লাটিনাম, রত্ন, হীরা, জারকোন বা ওপাল। শনিদেবের জন্যে শ্বেতবেড়ালার মূল। ধাতু, লোহা। রত্ন, নীলা, এমিথিস্ট, নীল টোপাজ বা তানজানাইট। সব শেষে রাহুর জন্যে শ্বেত চন্দনের মূল। ধাতু, লোহা বা স্টীল। রত্ন, গোমেদ। আর কেতুর জন্যে অশ্বগন্ধার মূল। ধাতু, স্টীল আর রত্ন, ক্যাটস্ আই বা টাইগার আই। আসলে, আগেও বলেছি তোমাকে যে ধাতু বা রত্ন এত দামি যে স্বল্প সামর্থের আমজনতা তার খরচা কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখন আমরা মানুষকে মূলের কথা বলে থাকি।”
বাবলা সাধুবাবাকে বলল, “আপনার হাত দেখার চেম্বার কোথায় সাধুবাবা? এই মূলগুলো যোগাড় করে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তো। এত জিনিস জোগাড় করে আপনার সঙ্গে কবে দেখা হবে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকলে তো সব নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম। এ’কথা বললাম বলে আমাকে ভুল বুঝবেন না সাধুবাবা।”
-আরে বাবা না না। তুমি তো ঠিক কথাই বলেছো। আমি বলার আগেই তুমি আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। আমি নিজেই বলতাম, আমার ওখানে এগুলো পৌঁছে দেবার জন্যে। না বাবা, আমার কোন চেম্বার নেই। বহরমপুরের মন্দির রোডের তারা-মা মন্দিরের আমি সেবাইত। ওখানেই আমি ভক্তদের কল্যাণে হাতের রেখা বিচার করে মূল-পাথর দিই। কোষ্ঠী বিচার করি। ওখানে ‘শাস্ত্রীবাবার তারা-মা মন্দির’ কোথায় খোঁজ করলে ভক্তরা আমার মন্দিরে তোমাকে পৌঁছে দেবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। পথে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে যাকে দেখতে পাবে তাকেই বলবে। সেই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর যেদিন যাবে সেদিন ওখানেই প্রসাদ পেয়ে যাবে। খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।” বেশ জাগ্রত ঢঙে সাধুবাবা বলল।
সময় যত এগিয়েছে বাবলা তার ব্যবসা তত উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে নিয়ে চলেছে। তার বিপদের বন্ধু সুবোধের থেকেও এখন সে ভাল আয় করতে পারছে। কলমি শাকের চেয়ে এই শেকড়-জড়িবুটি বিক্রীতে তার আয় অনেকটা বেড়ে গেছে। কলমি শাকের কারবারে এখন তার যেন মন কম টানছে। কিন্তু এই শাকের কারবারই তো বন্ধু, সুবোধের মত পথপ্রদর্শক। তাই ছেড়ে দিতেও মন জবরদস্ত সায় দেয় না। ট্রেনের ডেইলী প্যাসেঞ্জারর্স মহলে সে ‘শাক হকার’ বলে পরিচিত হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে ইদানিং শাক কম করে আনে। দিদিমাকে সে কত খাটাবে। এদিকে শাক তুলবে আবার শেকড় জড়িবুটি জোগাড় করবে। বুড়ো মানুষটা যেন আর পারছে না। দিদার এই হাড়ভাঙা খাটনি দেখে মাঝে মাঝে তার মনটা কেমন দমে যায়। হঠাৎ যদি এই মানুষটার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায় তো সে অথৈ জলে পড়ে যাবে। এই মানুষটাকে তাই সে ‘মুলো-বাড়ি করতে চায় না। বেগুন-বাড়ি’ করে রাখতে চায়। মুলো চাষের বাগানে যখন মুলো উপযুক্ত হয়ে যায় তখন সব মুলোকে চাটি সমেত উপড়ে নিতে হয়। নাহলে বুড়ো হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু বেগুন বাগানের বেগুন বহুদিন ফল দিয়ে যায়। চাষী তাই বেগুন বাগানকে খুব যত্ন-পরিচর্যায় রাখে। এই বেগুন বাগানের মত যত্নে সে তার দিদাকে রাখতে চায়। সেইজন্যে ইদানিং যেসব মূল-জড়িবুটি অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়, সেগুলো দিদাকে আনতে বারণ করেছে বাবলা। মালদার টাউন মার্কেটে জড়িবুটির একটা দোকানের সে সন্ধান পেয়েছে। সেই দোকানদারকে সে অর্ডার দিয়ে আনায়। তাতে একটু বেশি তার খরচ হয়ে যায় ঠিক। লাভ ভাগাভাগি হয়ে যায়। দিদার বেলায় যেটা হত না। কিন্তু সব সময় লাভের লোভে জড়িয়ে পড়লে চলবে কেন।
শেকড় জড়িবুটির যোগান দিতে দিতে বহরমপুরের তারা-মা মন্দিরের সাধুবাবার সঙ্গে বাবলার ভালই জানাশোনা হয়ে গেছে। একদিন সাধুবাবা বলল, “বাবলা, এতদিন তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় কিন্তু এখনও তোমার বাড়িটা কোথায় জানা হল না। সবসময় তো তোমার সঙ্গে আমার ট্রেনেই যোগাযোগ হয়। যেন এই ট্রেনই তোমার বাড়ি-ঘর। কিন্তু তা তো নয়। এতদিন আমার জিজ্ঞেসই করা হয়নি। এটা ঠিক হয়নি। আসলে কি জানো তো, ট্রেনে বাসে নিত্যদিন কত মানুষের সঙ্গে আলাপ, কথাবার্তা হয়। তাই বলে সঙ্গে সঙ্গে তার খোলের খবর জানতে চাওয়াটাও সবাই ঠিকভাবে নেয় না। পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে তবেই এসব সমীচিন বলে মনে হয়।” সাধুবাবার কথায় ইতস্তত না করেই বাবলা বলল, “আমার বাড়ি মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়। আমি আমার দিদার সঙ্গে থাকি। দাদু মারা গেছে অনেক আগে। দাদু-দিদাই আমাকে মানুষ করেছে। এখন আমার দিদাই আমার জীবনের অবলম্বন। আমি যে এতটা কাজ করতে পারছি, তার পেছনে সবটাই আমার দিদার অবদান। নাহলে আমি পারতামই না। সবটাই দিদা সংগ্রহ করে। আমি শুধু গলাবাজি করে ট্রেনে বিক্রী করি।”
-হরিশচন্দ্রপুরের হরিজন পাড়ায়? ওখানে সবই তো চর্মকার-রুইদাসদের বাস! তুমি তাহলে রুইদাস সম্প্রদায়ের? অবাক দৃষ্টিতে সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল!
-হ্যাঁ, সাধুবাবা। আমরা জাতিতে চর্মকার-মুচি। আমাদের আসল বাড়ি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা থানার বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ায়। আমার বাবা-মা ওখানে থাকে। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন না হওয়ায় একদম ছোট্ট বেলায় দাদু মানুষ করবে বলে আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে। সেই থেকে আমি এখানে। আগে তো ওখানে যেতাম না। দাদু মারা যাবার পর এখন হাতে কাজ কম থাকলে মাঝে মাঝে আমি ফলতায় যাই। আবার চলে আসি। একা দিদাকে ফেলে বাইরে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারি না। মন কেমন করে।
ওরা জাতিতে চর্মকার জানতে পেরে বাবলার প্রতি আরও আগ্রহ বেড়ে গেল সাধুবাবার। বহুদিন ধরে যে জিনিসটার জন্যে প্রতি পদে পদে বিশেষ কয়েকজন জ্যোতিষীর গাম্ভীর্যের কাছে অবনত হতে হচ্ছে এবার বোধ হয় সেই গ্লানি থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারবে। কেননা এই জিনিসটা এতটাই দুষ্প্রাপ্য যে হাতেগোনা কয়েকজন জ্যোতিষী তাকে হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে। আর নিজেদের আধিপত্য জারি রাখতে এই কয়েকজন কিছুতেই জিনিসটা কোথা থেকে জোগাড় করল তার ঠিক-ঠিকানা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সংগ্রহে রেখেছে। তবে সাধুবাবা জানতে পেরেছে যে এটা একমাত্র চর্মকাররাই সংগ্রহ করতে সক্ষম। রুইদাস-চর্মকাররাই একমাত্র ভাগাড়ে গরুর চামড়া সংগ্রহ করতে যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই জানে না যে গরুর পেটে এমন একটা দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্লভ দ্রব্য পাওয়া যায়। ওই দু-একজনই নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতটাই গোপনে জিনিসটা সংগ্রহ করে যে তাদের জাতভাইরাও এব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছে। সেই সূত্রে সাধুবাবা বহুবার ওই মালদার হরিশচন্দ্রপুরের হরিজনপাড়ায় গিয়েছে। কিন্তু ওখানকার কোন চর্মকার তাকে শঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া কোন চর্মকারই এই জিনিসটার বিষয়ে সম্যক অবগত নয়! বলে,“সে কি জিনিস আমাদের জানা নেই সাধুবাবা। আপনি মনে হয় ভুল করে আমাদের কাছে এসেছেন। কেউ ভুলভাল কিছু বলেছে আর সেই কথা শুনে আপনি কষ্ট করে আমাদের এখানে ছুটে এসেছেন।” ওদের কথায় কিন্তু সাধুবাবা বিন্দুমাত্র হতাশ হয় নি। খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে এর হালহকিকত জানাতে পারে। এই যে মাঝে মাঝেই বহরমপুর থেকে মালদার এদিকে ছুটে আসে, তা একমাত্র এরই উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই দুর্লভ ব্যক্তি যে অজান্তেই তার কাছে ধরা দিয়ে ফেলেছে। বাবলা ছেলেটাকে সে আর কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। এই ছেলেটা কিচ্ছু না জেনেও যেভাবে শেকড় জড়িবুটির কারবারের গোটা ব্যাপারটই স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজের করায়ত্বের মধ্যে এনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তেমনি এই দুর্লভ জিনিসটাও সে চেষ্টা করলে সংগ্রহ করতে পারবে। সেই বিশ্বাস এই ছেলেটার উপর তার আছে। ছেলেটা তার যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বাসটা দিয়ে অর্জন করাতে পেরেছে।
যেহেতু এখানকার রুইদাসরা এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তাই তাদের কাছে ব্যাপারটা ভাঙতে চাইল না সাধুবাবা। কেননা এরা কেউই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হল না। তাছাড়া চেনাজানা না থাকলে এমন অতি গোপনীয় ব্যাপারগুলো জানানোও উচিত নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বাবলা ছেলেটাকে এই গোপন তথ্য জানানো যেতে পারে। সেদিন বাবলা সাধুবাবার কাছে অর্ডারমত জড়িবুটি, শেকড় ডেলিভারী দিতে এলে বলল, “বাবলা, আজ তোমার এখন বাড়ি যাওয়া যাবে না। মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করে বিশ্রাম নাও। তোমার সাথে অনেক জরুরী কথা আছে আমার। আমি মন্দিরের কাজ সেরে হাল্কা হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি তোমার কাছে।”
হঠাৎ সাধুবাবা এমন কথা বলায় বিস্মিত হয় বাবলা! সাধুবাবা এমন কথা তাকে কোনদিন বলে না তো ! তার সঙ্গে কি এমন দরকার থাকতে পারে সাধুবাবার? এদের সব কতরকম কাজ কারবার থাকে। কোন আজেবাজে কাজে তাকে জড়িয়ে দেবে না তো? এককাঁড়ি প্রশ্ন মনের মধ্যে প্রসব করে টানটান হয়ে বাবলা অপেক্ষা করছে সাধুবাবার জন্যে। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছে। তেমন কিছু বললে, যেটা তার পক্ষে ভাল হবে না বলে মনে হলে আর কোনদিন এই সাধুবাবার সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে না। দরকার নেই তার অত পয়সার লোভ করে। তাতে বরং তার কলমি শাক বেচে দিন কাটিয়ে দেওয়াটা অনেক শান্তির।
মনের মধ্যে এমন সাতপাঁচ জাবর কাটতে কাটতে দেখে সাধুবাবার তার কাছে আসছে। একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে সাধুবাবা তার সামনে এসে বসলো। বসার আগে ঘরের দরজার ছিটকিনিটা আটকে দিতে চমকে উঠেছিল বাবলা ! সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে নিজেকে সামলে নিল।
বাবলার সামনে নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে সাধুবাবা বলল, “বাবলা, তোমাকে কয়েকটা গোপন কথা জানাতে চাই। তার আগে তোমাকে তারা মায়ের পা ছুঁয়ে বলতে হবে, এই খবর তুমি আর দ্বিতীয় কাউকে জানাবে না। যদি জানাও তো মা তোমার বহুৎ অনিষ্ট করে দেবে।” বলে সাধুবাবা নামাবলীর ভেতর থেকে তারা মায়ের ছবিটা বার করে বাবলার সামনে ধরল।
সাধুবাবার কথায় বাবলা বুঝল তার খারাপ কিছু হবে এমন কথা সাধুবাবা তাকে বলতে আসেনি। নিশ্চয় এমন কোন গোপন কথা আছে যেটা বিশ্বাস করে সাধুবাবা তাকেই কেবল বলতে চাইছে। তাই মায়ের পায়ে হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিতে চাইছে।
মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সাধুবাবা যা যা করতে বলল বাবলা তাই করে সাধুবাবার মুখের দিকে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে তাকিয়ে রইল। বাবলার উপর সন্তুষ্ট হয়ে সাধুবাবা বলল,“তুমিই উপযুক্ত ছেলে যে এই দুরুহ কাজটা নিরাপদে করতে পারবে। যদি তুমি তাতে সফল হও তাহলে তোমার মাধ্যমে আমার মন্দিরের যেমন শ্রীবৃদ্ধি হবে, সাথে সাথে তোমার জীবনের উন্নতির একটা নতুন দিক খুলে যাবে। আর্থিকভাবে তুমি অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে। তার জন্যে এই কাজটাকে তোমার ধ্যানজ্ঞান করে নিতে হবে। আর আমার আশীর্বাদ রইল। তুমি সফল হবে।”
তার সম্বন্ধে এত উচ্চ প্রশংসা করায় সাধুবাবার প্রতি অন্য এক আন্তরিক আনুগত্য মনের মধ্যে খেলে বেড়াতে লাগল বাবলার। তার আর্থিক উন্নতির আশ্বাস দিচ্ছে সাধুবাবা ! তাহলে খারাপ কিছু কাজ সাধুবাবা তাকে দিয়ে করাতে পারে। এই চিন্তা যে প্রথমে করছিল সেটা ভুল ভাবনা ছিল তার। সেই বিশ্বাস মনে পোষণ করে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বাবলা বলল,“কি কাজটা আমাকে করতে হবে বলবেন সাধুবাবা? আপনার কোন কাজ তো আমি এতদিন পর্যন্ত এড়িয়ে যাইনি। এখনও যাব না। যেমন যেমনটি বলবেন ঠিক সেই কাজটাই আমি করব। আপনি যেমন আমাকে বিশ্বাস করেছেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখার চেষ্টা করব। অন্যথা হবে না।”
বাবলার প্রতিশ্রুতিতে তৃপ্ত হয় সাধুবাবা। মনে ভাবে, এবার কথাটা ছেলেটাকে বলা যেতে পারে। তারপর নিজের ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা কাঁচের বয়াম বার করল। বাবলা দেখতে পাচ্ছে, বয়ামটার ভেতর পীত বর্ণের থেবড়ানো গোলাকার একটা রঙিন পদার্থ। এই জিনিসটাকে নিয়ে সাধুবাবার এত আগ্রহ? কি এটা? কি কাজে লাগে! এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন তার মনের ভেতর তালগোল পাকাতে থাকে? বিষ্ময় এবং যুগপৎ মুচকি হেসে সাধুবাবা জিনিসটা বয়াম থেকে বার করে হাতের তালুতে নিয়ে বাবলার সামনে ধরল! বাবলাও বিস্ময়াবনত হয়ে সেটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,“এটা কি জিনিস সাধুবাবা? এই প্রথম আমি এমন জিনিসটা দেখছি। মনে হচ্ছে তো এটা দুস্প্রাপ্য কোন বস্তু! এটার সম্বন্ধে কি আমাকে এত কথা বললেন?
-হ্যাঁ, এটাকে নিয়েই এত কথা! আর এটার জন্যে তুমিই আমার তুরুপের তাস! এই রঙিন দুর্লভ দ্রব্যটার নাম ‘গোরোচনা!’ বহুমুখী এর কার্যক্ষমতা। যারা এর গুণের পরিচয় জানে তাদের কাছে এই বিস্ময় বস্তুটা একাধারে যেমন বহুমূল্য তেমনই আকর্ষণীয়! আর যারা জানে না, তাদের কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। এই যেমন তোমার কাছে। এই দ্রব্যটার সম্বন্ধে তুমি কিছুই জানো না। এখন যদি তোমার হাতে এটা তুলে দিই তুমি অকামের বস্তু বিবেচনায় অবহেলায় কোথাও নির্বাসিত করবে একে। তোমার মতো সব মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। সবেমাত্র এর সঙ্গে তুমি পরিচিত হতে চলেছ। এখনো সম্পূর্ণ কিছু জানতে পারোনি। পারলে একে তুমি স্বর্ণমুদ্রার থেকেও আদরে গ্রহণ করবে।” যারপরনাই কৌতূহলোদ্দীপক চিত্তে সাধুবাবা বলল।
ঠিক ততটাই উৎকন্ঠার সঙ্গে এবার বাবলা বলল, “আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন সাধুবাবা। মনে হচ্ছে তো এটা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় ঠিক ততটাই কাজের জিনিস হবে। আপনি সেটা না জানালে আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়। সবটাই আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। যদি জানান তাহলে জানব এবং আপনার কথা মত আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি কাজ করতে পারব, এতটুকু ভরসা আপনাকে আমি দিতে পারি। গোরোচনার প্রতি ভেতরে ভেতরে তীব্র আগ্রহকে বাইরে প্রকাশ না করে হাল্কা ভাবনায় বাবলা বলল।”
বাবলার জিনিসটার প্রতি আগ্রহ ঠিক কত, সেটা এতক্ষণ ধরে পরখ করার জন্যে এতটা কথা চালাচালি করল সাধুবাবা। বুঝলো, না, ছেলেটাকে নির্বাচন করে সে ভুল করেনি। এর দ্বারাই তার কার্যসিদ্ধি হবে। তবে ছেলেটাকেও সে ঠকাবে না। ওর উপযুক্ত পাওনা সে দিতে কুন্ঠা করবে না। ওকে বঞ্চিত করা মানে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়ে যাবে। দিন যত গড়াবে ছেলেটার জিনিসটার প্রতি দখল বাড়বে। একবার যদি বুঝতে পারে যে তাকে সাধুবাবা ঠকাচ্ছে তখন ও আর তার কাছে পড়ে থাকবে না। অন্য ঠিকানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে এবং সন্ধান পেয়েও যাবে। তার মত কত সাধুবাবা আছে, এইরকম ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যোগাযোগে যুক্ত হতে বেশি কসরত করতে হবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধুবাবা বলল, “পাথরসম শক্ত এই গোরোচনা বস্তুটা কতরকম যে কাজে লাগে তা এককথায় এবং একবারে তোমাকে বলে শেষ করতে পারব না। সময় সময় তুমি আমার কাছ থেকে সবই জানতে পারবে। আচ্ছা, তোমার জানা আছে কি যে যেকোন পাথর শোধন করে তবে মানুষকে পরতে বলে জ্যোতিষীরা? সংগ্রহ করে আনা পাথর আংটিতে লাগিয়ে সরাসরি মানুষের আঙুলে পরিয়ে দিলে কাজ হয় না। তাকে শোধন অর্থাৎ বিশুদ্ধ করতে হয়। এক এক পাথরের শোধন প্রক্রিয়া আবার ভিন্নভাবে করতে হয়। আমরা যে গোমেদ পাথরের কথা বলি। শেকড়, জড়িবুটি নিয়ে যখন নাড়াঘাটা করছো, গোমেদ বা অন্য সব পাথরের নাম তোমার জানা এটা বলা যায়। সেই গোমেদ পাথর শোধনের জন্যে এই গোরোচনা মিশ্রিত জল প্রয়োজন হয়। এটা ছাড়া এই পাথর শুদ্ধ হয় না। আর বলেছি তো তোমাকে, গোমেদ কোন গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া গোরোচনার বহুগুণের আর একটা গুন তোমাকে জানাচ্ছি। এখন আমার হাতে আর তেমন সময় নেই। তোমার সঙ্গে আরও কথা সারা আমার প্রয়োজন। শুধু গুনাগুণ বলতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে। আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নানারকমের টনিকের প্রয়োজন হয়। এই গোরোচনা অন্যতম এক টনিক এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধেরও কাজ করে। তাছাড়া আমরা যে তিলক কাটি না? এই জিনিসটা ‘খল-নোড়া’ দিয়ে চূর্ণ করে কপালে চন্দনের তিলক কাটার মত রঙিন তিলক কাটার কাজে লাগে।”
খানিক চুপ থেকে সুধাবাবা আবার বলল, “এবার যে কথাটা তোমাকে আমার বলা। সেটা হল, তোমরা তো জাতিতে চর্মকার রুইদাস। ভাগাড়ে গরু পড়লে তোমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ সেই গরুর চামড়া আহরণ করে। ওই মানুষজনের, বলা যায় প্রায় সব্বাই ভাগাভাগি করে সেই চামড়া নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওই গরুর পেটে যে এই দুর্লভ গোরোচনা বস্তুটা থাকে তা তাদের অজানা। তোমাদের মধ্যে বিরল দু-একজন আছে যারা এর হালহকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তুমি এখন সেই বিরল মানুষদের মধ্যে একজন হয়ে গেলে। এই মানুষরা কিন্তু ভাগাড়ে গিয়ে ওই চামড়ার জন্যে ঝুলপেটাপেটি করে না। চামড়া শিকারীরা চামড়া নিয়ে চলে গেলে চুপিসাড়ে তারপর সে নিজের কাজ সারার জন্যে লেগে পড়ে। তবে সবসময় যে সে সফল হয় তা কিন্তু নয়। সব গরুর মধ্যে জিনিসটা থাকে না। কপালে থাকলে তবে তার দেখা মেলে। মিললে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। এক একটা গুলির দাম হাজার হাজার টাকা! এবার একটা গরুর মধ্যে অনেকগুলো করে গোরোচনা থাকে। এখানে একটাই হতাশার দিক হল, তোমাকে অনবরত এ-গরু সে-গরুর মধ্যে খুঁজে বেড়াতে হবে। ওই অন্ধকারে হাঁচানোর মত আর কি।”
সাধুবাবার কথায় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল বাবলা। কিন্তু তার পরে পরেই আবার মনটা দমে গেল! দমে গেল এইজন্যে যে তাদের এই মালদা এলাকায় গরুর কোন ভাগাড় প্রায় নেই বললেই চলে। মুসলিম আধিক্যের এলাকায় কোন গরু বৃদ্ধ হয়ে মরার আগেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমানদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বা মুসলমানরা জানতে পারলে নিজেরাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিনে নিয়ে চলে যায়। ফলে এলাকা ভাগাড়শূন্য হয়ে গেছে বলা যায়। তবু তাকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়তে হবে। তার জন্যে শুধু মালদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে তাকে আরও দূরে বহু দূরে যেতে হলে সে যাবে। ওর চোখমুখে ফুটে উঠল একটা কিছু করার অভিব্যক্তি! সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,“বুঝতে পারছি এই কাজ নিতান্ত মামুলি কাজ নয়। প্রচুর মেহনত করতে হবে আমাকে। তার পরেও আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব কি না জানি না। তাই আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যাতে এই কাজে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারি।”
দিদিমাকে হাজার-দুই টাকা দিয়ে বাবলা বলল,“তুমি সাবধানে থাকবে দিদা। আমি মাসখানেক বাড়ি থাকব না। বিশেষ জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি। দরকার হলে আরও দু-তিন মাস হয়ে যেতে পারে আমার ফিরতে ফিরতে। মামা-মামী কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবে, কিছু বলে যায়নি। বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে বলে বাবলা চলে গেছে। তা আমাকে নিয়ে তোদের চিন্তা করতে হবে না। খেতে পরতেও দিতে হবে না। বাবলা সব ব্যবস্থা করে গেছে। ভাল কাজেই যাচ্ছি দিদা। তুমি চিন্তা করবে না। কাজ সারা হয়ে গেলে সময়মত ঠিক ফিরে আসব।”
মালদা থেকে ট্রেনে চড়ে একদম ভোরে ধূপগুড়ি স্টেশনে নামল বাবলা। এখানেই এই ট্রেনটার যাত্রার অন্তিম স্টেশন। এইসব এলাকা সম্বন্ধে ওর কিছুই জানা নেই। ট্রেন থেকে নামার আগে বাথরুমের কাজটা সেরে পরিষ্কার হয়ে নেয়। নতুন জায়গা, কোথায় কি আছে তার জানা নেই। স্টেশনে এদিক ওদিকে ঘুরেঘারে কিছুটা সময় কাটিয়ে দেয়। সূর্যের আলো একটু ভাল করে ফুটে উঠতে গোটা স্টেশন চত্বর জমজমিয়ে উঠতে লাগল। খিদে পেয়েছে। এবার সকালের টিফিনটা সেরে নেবার জন্যে একটা স্টলের সামনে বেঞ্চে এসে বসল। দোকানদারকে কচুরি-আলুদমের অর্ডার করল। চারটে কচুরি খেয়েও যেন খিদেকে বশে আনতে পারলো না। আরও চারটের অর্ডার করে এবার আলুরদমের বদলে চারটে ল্যাংচা দিতে বলল। তারপর পরপর দু’কাপ চা খেল। এবার যেন পেটের আন্দোলনকে থামানো গেল। বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পয়সা দেবার জন্যে পকেটে হাত ঢোকালো। আবার কি মনে করে হাত বার করে বলল, “ডাবল ডিমের ওমলেট দাও তো দাদা।”
ওমলেটের প্লেটটা বাবলার হাতে ধরিয়ে প্রশ্নমুখো হয়ে বাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল দোকানদারটা। বাবলা বুঝতে পারে সেটা। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিছু বলবে আমাকে দাদা?”
-আসলে কি জানো তো ভাই, তোমার মত খরিদ্দার আমি এতদিন কারবার করছি, একটাও পাইনি। একসঙ্গে এত খাবার কেউ অর্ডার করে না। তোমার খুব খিদে পেয়েছিল বুঝি? হাসি হাসি মুখে দোকানদারটা জিজ্ঞেস করল বাবালাকে।
সাধারণভাবে বাবলাও কোনদিন একসঙ্গে ‘আক্যুটের’ মত এত খাবার খায় না। নতুন এলাকা। কোথায় কি আছে কিছুই জানে না। সেটা জানতে গেলে এখানকার কারোর সঙ্গে তো তাকে আলাপ করতেই হবে। তা আচমকা কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ পাত্তা দেবে না। উল্টে তাকে সন্দেহ করে বসলে উল্টো বিপত্তি হতে পারে। তাই দোকানদারের তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এমন অস্বাভাবিক আচরণ সে পরিকল্পনা মতই করেছে। এবার সে অতি সহজেই স্থানীয় এই দোকানদার ছেলেটার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারবে। দোকানদারের হাসি মুখের রেশ মিলিয়ে যাবার আগেই বাবলা বলল, “হ্যাঁ দাদা। সেই আগের দিন দুপুরে ভাত খেয়েছি। নানান কারণে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি। খুব খিদে পেয়েছিল। তাই।”
-কোথা থেকে আসছো তুমি? দেখে মনে হচ্ছে তো তুমি এখানকার ছেলে নও। কোথায় যাবে? জায়গাটা যদি না জানা থাকে বলো, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমি এখানকারই ছেলে।
এবার বাবলা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো আশেপাশে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে কি না ! কেউ নেই দেখে বলল,“তোমার নাম কি দাদা বলবে? আমার নাম বাবলা রুইদাস। মালদার হরিশচন্দ্রপুরে এক গ্রামে আমার বাড়ি।”
অতশত দিক না চিন্তা করেই সরল মনে দোকানদার বলল,“আমি নিত্যানন্দ বৈরাগী।” ধূপগুড়ির বৈরাগী পাড়ায় আমার বাড়ি। আমাদের গোটা গ্রামেই বৈরগীদের বাস। আমরা সব কৃষ্ণ ভক্ত। এখানকার গৌরাঙ্গ মঠ খুব নামকরা। আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের হিন্দুরা এই মঠে আসে। নাম সংকীর্তনে অংশ নেয়। সকালে গ্রাম পরিক্রমা করে। তা তুমি কোথায় যাবে?”
এবার বাবলা বুদ্ধি করে বলল,“শুনেছি ধূপগুড়িতে খুব জাগ্রত রাধাকৃষ্ণের গৌরাঙ্গ মঠ আছে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওই মঠটায় যাবো। তা ধূপগুড়ির ঠিক কোথায় তা আমার জানা ছিল না। এই তোমার কাছে জানলাম দাদা। খুব খুশি হলাম। ওই মঠেই আমি যাবো। যদি আমাকে বলে দাও কেমন করে যাবো।”
বাবলা বুঝে গেল এলাকাটা পুরোপুরি হিন্দুদের বাস। তার উপর বৈষ্ণবরা গরুর ভীষণ ভক্ত। ভগবতী জ্ঞানে গরুকে ওরা দেখে। কোন অবস্থাতেই ওরা নিতান্ত পয়সার লোভে বৃদ্ধ বা অশক্ত গরুকে মুসলিমদের হাতে সঁপে দেবে না। মারা গেলে এলাকার কোন ভাগাড়েই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে। কেউ কেউ আবার মৃত গরুকে কবরস্থও করে। তাতে অবশ্য সরকার থেকে জনসাধারণের কাছে আবেদন রাখা হয়েছে যে কোন গরু ছাগল বা ওই জাতীয় কোন জীবজন্তুকে কবর না দেওয়ার জন্যে। এর ফলে সমাজে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিগত বছরগুলোতে আমরা যে শকুন দেখতে পেতাম, আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না। তাদের প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবেই এই দশা বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত। তাতে অবশ্য অনেকটা কাজ হয়েছে। একদম গোঁড়া ভক্তরা ছাড়া অন্য উদার মানসিকতার মানুষরা গরুকে কবর দেয় না।
স্টেশনের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়েছে বাবলা। বেশ কয়েকদিন স্টেশন চত্বরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আর নিত্যানন্দর চা-টিফিন দোকানে এসে সময় কাটায়। অবশ্যই শুকনো মুখে নয়। নিয়মিতভাবে টিফিন করে চা খায় ওর দোকানে। তাতে নিত্যানন্দও বেশ খুশি। অগের থেকে অনেক খোলামেলা ভাবেই সে এখন বাবলার সঙ্গে কথাবার্তা বলে। বলা যেতে পারে বন্ধুর মত হয়ে গেছে। একদিন নিত্যানন্দ বলল, “বাবলা ভাই, সামনের সোমবার আমার দোকান বন্ধ থাকবে। বাড়িতে পুজো আছে। তুমি চলো আমার বাড়ি। ওই দিনটা তুমি আমাদের বাড়ি প্রসাদ পাবে এবং রাত্রের ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান দেখে পরদিন ফিরে আসবে। অবশ্য ভাববে না যে পরদিন আমি তোমাকে খাওয়াতে পারব না বলে চলে আসতে বলছি। ইচ্ছা করলে তুমি থাকতে পারো আমাদের বাড়ি। আমার বাড়ি মনে করে ‘অতিথি দেব ভব।’ মা তোমাকে হয়তো আসতেই দেবে না। দেখবে!”
নিত্যানন্দদার কথায় রাজি হয়ে যায় বাবলা। ও তো এটাই চাইছিল। এবং একদিন ওখানে থাকবেও। নিজের কাজ সারতে গেলে এলাকাটা তাকে দেখতেই হবে। বিশেষ করে কোথায় কোথায় ভাগাড় আছে তা তো তার জানা অত্যন্ত জরুরী।
তিন মাস ধুপগুড়ি স্টেশন আর বৈরাগী পাড়া ছিল বাবলার কর্মক্ষেত্র। এলাকায় খান তিনেক ভাগাড়ের সন্ধান করতে পেরেছে। পাঁচ পাঁচটা গরু এই তিন ভাগাড়ে পেয়েছে সে। আর ভাগাড় আছে মানেই চর্মকার থাকবে। তবে তারা কিন্তু তাদের মত বাঙালী চর্মকার নয়। অবাঙালী এরা। কয়েকজন আবার মুসলিম চর্মকার। শকুনের নিশানে তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ভাগাড়ে গরু পড়ার সংবাদ পেতে। গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়ে যায়। দূর থেকে দেখে লোকগুলো গরুর চামড়া কেটে নিয়ে চলে গেলে বাবলা তার বিশেষ কাজে নেমে পড়ে। পাঁচটা গরুর পেট কেটে দুটোতে সে সফল হয়। আর আনন্দে ছটফট করতে থাকে কতক্ষণে এগুলো নিয়ে সে সাধুবাবার কাছে হাজির হবে! বাড়ি ফেরার দিন বন্ধু নিত্যানন্দকে বলে যায় আবার সে আসবে। খুশি নিত্যানন্দ বন্ধুকে বিদায় জানায়। সেদিন আর ও বন্ধুর কাছ থেকে কোন টিফিনের দাম নেয় নি।
গোরোচনার পাথরগুলো বাবলার কাছ থেকে পেয়ে খুশিতে টগবগ করতে থাকে সাধুবাবা। বলে,“কি জানিস তো বাবলা, মা আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিল, এই বাবলা ছেলেটাই পারবে তোর অভিষ্টকে সিদ্ধ করতে। তুই ওকে ভরসা করতে পারিস। ওকেই তুই সবকিছু খুলে বল। ছেলেটা তোর সঙ্গে বেইমানী করবে না। তা মায়ের আশীর্বাদ কি কখনো বিফলে যায়! বলে সাধুবাবা তার শোবার ঘরে দ্রুত চলে যায়।” অল্প সময় পরেই ফিরে এসে বাবলার হাতে একটা টাকার বান্ডিল দিয়ে বলে,“এতে দশ হাজার টাকা আছে। কাউকে এই টাকার কথা আর গোরোচনার কথা বলবি না। তুই এই জিনিসটা সংগ্রহের মধ্যেই নিজেকে নিবিষ্ট কর। আর দরকার নেই ওই জড়িবুটি বা কলমি শাকের কারবার করে। আমার সঙ্গে লেগেপড়ে থাক। দেখবি দিনে দিনে তোর ব্যাঙ্কের বই ভারি হয়ে উঠছে।
একসঙ্গে এতগুলো টাকা বাবলা তার জীবনের এই সময় সীমার মধ্যে দেখেনি। টাকাটা পেয়ে প্রথমে ভেতরে ভেতরে আবেগে কাঁপতে থাকে সে! ভাবে, সে এটা দিবাস্বপ্ন দেখছে না তো! সত্যি সত্যি এই জিনিসটা এত মূল্যবান! সাধুবাবা যদি এককথায় তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দেয় তো এর প্রকৃত দাম তাহলে কত? সাধুবাবা তো আর টাকার দানসত্র খুলে বসেনি। যে এমনি এমনি খুশি হয়ে তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দিল। অবশ্যই সে এর থেকে অনেক অনেক বেশি টাকা আয় করবে। আবার মনকে বোধ দিয়ে ভাবে, যাকগে। যার ধর্ম যার কাছে। তার আর অতি লোভ করে কাজ নেই। না চাইতেই সে যা পেয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। তার চোদ্দপুরুষ তো ভাবতে পারে না গরুর শরীরে কতকগুলো নুড়ি পাথরের এত দাম হতে পারে। এই কথাটা একমাত্র সে তার দিদাকে বলবে। দিদাকে কথাটা গোপন রাখতে বললে, মরে গেলেও দিদার মুখ থেকে সে কথাটা বার হবে না। কথা ফেচকাবার মানুষ দিদা নয়। আর তার দিদার মুখ চেয়ে সে ট্রেনে ওই কলমি শাকের ফেরি করা বন্ধ করবে না। সাধুবাবা যতই বলুক। তাতে দিদার মন খারাপ হতে পারে। কত মনপ্রাণ দিয়ে দিদা এগুলো সংগ্রহ করে দেয় নাতির কারবার করার জন্যে।
তাছাড়া এই কারবার থেকেই তো তার উত্থান। অসময়ের জীবন দিশারী। তাকে ত্যাগ করা মানে অকৃতজ্ঞর মত কাজ করা হয়ে যাবে। শেকড় জড়িবুটির কাজও সে করে যাবে। সবসময় তো আর গোরোচনার খোঁজে তাকে বার হতে হচ্ছে না। যখন বার হবে তখন এই কাজটা বন্ধ তো সে রাখছেই। তিনমাস তো সে কাজ করেনি। তারপর কি, হঠাৎ কারবারটা বন্ধ করে দিলে লোকে অন্যরকম কথা তাকে নিয়ে ভাবতে পারে। ভাল, মন্দ সবরকমের ভাবনা মানুষের বা হকার বন্ধুদের মধ্যে খেলে বেড়াবে। তখন সে একটা সমালোচনার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। সেই তুরুপের তাসটা সে কারোর হাতে তুলে দিতে চায় না।
গোরোচনার কর্মক্ষমতা নিয়ে যে কথাটা প্রথম দিন বলতে বলতে সাধু বাবা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে, পরে বলবে বলে অসম্পূর্ণ রেখে গেল সেটা তাকে জানতেই হবে। ওই যে, বলছিল তান্ত্রিক বশিকরণ করা। অবাধ্য স্ত্রী বা প্রেমিকাকে বশীভূত করা নাকি এটার মাধ্যমে সম্ভব! এ’ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হবে। সাধুবাবা কি সেই বিদ্যা তাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করবে? মনে হয় তো না। ওরা কথা দিলে কথা রাখার চেষ্টা করে। আর ‘না’ করলে?

ক্রমশ…

Loading

Leave A Comment