কুটুম্ব
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
তনিমা দেবী খুব যত্ন করে তার বেয়াই আর বেয়ানে -এর জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন। তনিমা দেবীর মেয়ে তৃপ্তির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হয়ে গেল। কিন্তু এই প্রথম তৃপ্তির শ্বশুর, শাশুড়ি আসছে তৃপ্তির বাপের বাড়িতে।
আসলে তৃপ্তির বিয়ের দেখাশোনা, পাকা কথা সবই হয়েছিল ওর পিসতুতো বোন রাজন্যার বাড়ি কলকাতা থেকেই। তৃপ্তির শ্বশুর শাশুড়ির মনে হয়েছিল গোপাল মাঠ বড্ড দূরে। যদিও রাজন্যা বারবার বলেছিল, আন্টি কলকাতা থেকে দূর্গাপুর মাত্র তিন ঘন্টার রাস্তা। সিটি সেন্টার থেকে আধ ঘন্টাও লাগবে না গোপাল মাঠ পৌঁছাতে।
আপনি আর আঙ্কেল নিজে গিয়ে একবার দেখে আসুন তৃপ্তি কেমন ঘরের মেয়ে।
রাজন্যার কথা শুনে তৃপ্তির শাশুড়ি লীনা দেবী বলেছিলেন, তোমার মুখে তো শুনেছি তোমার মামার তেমন অবস্থা নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি তৃপ্তিকে আমাদের সবার ভীষণ পছন্দ। এটাই বড় কথা। তৃপ্তির বাবার কি আছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তাছাড়া অমিতের বাবাকে তো জানোই তুমি। উনি হচ্ছেন একজন জন দরদি কাউন্সিলর। গরিব মানুষের প্রতি ওনার একটা আলাদা অনুভুতি কাজ করে সবসময়।
রাজন্যার মুখ থেকে লীনা দেবীর এই কথাগুলো শুনে তৃপ্তি ও তার মা বাবা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে তৃপ্তির শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যন্ত ভদ্র ও নিরহংকারী।
তৃপ্তির বিয়েতে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা গায়ে হলুদের তত্ব দেখে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের একেবারে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। তৃপ্তির পিসি মানে রাজন্যার মা বলেছিল, ভাগ্যিস তৃপ্তি আমাদের রাজুর বাড়িতে থেকে রবীন্দ্র ভারতীতে ক্লাস করতে যেত। তাই তো এমন বড়লোক, শিক্ষিত, রুচিশীল শ্বশুরবাড়ি পেল।
তৃপ্তির বর অমিত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বেশ নম্র ভদ্র ও দায়িত্ববান ছেলে। তৃপ্তির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এর দিকে সজাগ দৃষ্টি। এই পাঁচ বছরে নিজে হয়তো খুব বেশি শ্বশুর বাড়িতে রাত কাটায়নি। কিন্তু তৃপ্তি যখনই গোপাল মাঠ আসতে চেয়েছে তখনই গাড়ী করে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
বিয়ের পর কনসিভ করতে তৃপ্তির বেশ সমস্যা হচ্ছিল। অনেক গাইনোকলজিস্ট দেখানোর পর সে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় অন্তঃস্বত্তা হয়। তৃপ্তির বাবা মা-এর একান্ত অনুরোধে অমিত ও তার মা বাবা তৃপ্তিকে রাখতে এসেছে গোপাল মাঠে।
শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা ভদ্রস্থ মাপের রেস্টুরেন্টে সকালের টিফিনটা সেরে নিয়েছে ওরা। তৃপ্তি যদিও একবার ওর শাশুড়িকে বলেছিল, মা এখন তো সবে আটটা। আর দু’ ঘন্টা র মধ্যে তো বাড়ি পৌঁছে যাব। বাড়িতে গিয়ে না হয় মায়ের হাতে লুচি তরকারি খাব।
লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে মিষ্টি করে বলেছিল, জানো তো তোমার বাপি নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। গোপাল মাঠে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলে বেশি দেরি হয়ে যাবে। তাই এখানেই খেয়ে নেওয়া ভালো।
প্রাতঃরাশ খেয়ে হালকা মিউজিক চালিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল অমিত। দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করার পরই চোখে পড়ল একটা ডাবওয়ালা। অমিতের বাবা চন্দ্রশেখর বাবু গাড়ী থেকে নেমে চারজনের জন্য চারটা ডাব কিনে আনলেন।
ডাবটা হাতে নিয়েই তৃপ্তির চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর বাবার মুখটা। ডাবের জল খেতে বড্ড ভালোবাসে। তবুও দাম দিয়ে ডাব কিনে খেতে চায় না। গরমে ক্লান্ত হয়ে সবজি বাজার থেকে ফিরে এসে নুন চিনির শরবত খাবে রোজ দিন। তবু টাকা খরচ করে ডাব কিনবে না।
তৃপ্তি এক চুমুক ডাবের জল খেয়ে অমিতের উদ্দেশ্যে বলে, অ্যাই আরো দু’টো ডাব কিনে নাও না বাড়ির জন্য। এখানে তা’ও চল্লিশ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গোপাল মাঠে আরো দাম।
লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে, তাই বুঝি। তোমার বাপের বাড়ির ওদিকে ডাবের খুব দাম। এই অমিত দুটো বড় দেখে ডাব কিনে নে তোর শ্বশুর শাশুড়ির জন্য।
জাতীয় সড়ক-এর বুকে ছুটে চলেছে অমিতের দামী চার চাকা। স্বামীর পাশে বসে হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে তৃপ্তি ভাবে, সত্যি সে ভীষন লাকি। অমিতের মতো দায়িত্ববান স্বামী, মামনি আর বাপির মতো উদারমনষ্ক শ্বশুর, শাশুড়ি পেয়ে। কত সহজে ওনারা আমার অত্যন্ত ছাপোষা মা- বাবাকে আপন করে নিয়েছেন। আমার বাবা যে একটা সামান্য গুমটি দোকান আছে। তার জন্য কিন্তু ওনাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বছরে কখনো শুনিনি কোনো অসম্মান জনক বাক্য। বরং প্রতি বছর পুজোতে মামনি নিজে গিয়ে আমার মা বাবার জন্য দামি জামা কাপড় কিনে উপহার হিসেবে পাঠায়। প্যাকেটের উপর সুন্দর করে লিখে দেন, ‘আমার দাদা দিদির জন্য ছোট্ট উপহার এই বোনের বাড়ির তরফ থেকে।’
এইসব আন্তরিক কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি তৃপ্তি যেন টের পায় নি।
অমিতের গলার স্বর শুনে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো তৃপ্তি।
কি গো এসে গিয়েছি তো? এবার তো নামো।
লাজুক হাসি দিয়ে তৃপ্তি নামল খুব সাবধানে। লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দেখো বৌমা সাবধানে। বাপের বাড়ি এসে বেশি ছোটাছুটি করতে যেও না যেন।
তনিমা দেবী তাড়াতাড়ি দুটো চেয়ার এনে উঠানে পেতে দিল। চেয়ারের উপর বিছিয়ে দিয়েছে পুরানো শাড়ির পাড় থেকে তোলা সুতো দিয়ে নিজের হাতে বোনা আসন।একটা নড়বড়ে টুলের ওপর এনে রাখল শরবতের গেলাসগুলো।
লীনা দেবী হাত নেড়ে বলল, দিদি ব্যস্ত হবেন না। তিন চার ঘন্টা তো বসেই এলাম। এখন বরং একটু দাঁড়িয়ে থাকি। পা টা ছাড়ুক একটু।
তৃপ্তির বাবা তার সারল্য মাখা হাসি দিয়ে বলল, সেই ভালো দিদি। চলুন আমরা বরং একটু হেঁটে স্কুল বাড়ির দিকটা দিয়ে। জানেন তো ওখানে গাছ গাছালি প্রচুর। গরমের দিনে ওই জায়গাটা ছেড়ে ঘরে আসতেই মন চায় না।
চন্দ্রশেখর বাবু বললেন, সেই ভালো। এই তো প্রথমবার এলাম। তল্লাটটা বরং ঘুরে দেখি।
তৃপ্তির বাবা বেয়ান, বেয়াই, জামাই সবাইকে নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করাতে গেলেন। নড়বড়ে টুলটার ওপর পরে রইলো শরবত-এর গেলাসগুলো।অতিথিদের কাছে শরবত-এর গেলাসগুলো কোনো সমাদরই পেল না।
তৃপ্তি বরং ওর মায়ের হাতে ডাব দুটো দিয়ে বলল, মা তোমার আর বাবার জন্য নিয়ে এসেছে তোমার জামাই। খুব টেস্টি জলটা। আমরা সবাই তো খেলাম।
ওওওও তাই বোধহয় আর কেউ শরবত এর গেলাসগুলো ছুঁয়ে দেখল না। এতক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।
যাক গে। ও তৃপ্তি তুই আমার সঙ্গে একবার রান্নাঘরে আয় মা। দেখ তো সব জোগাড় ঠিকঠাক আছে কিনা।
রান্না ঘরে ঢুকে তৃপ্তি তো অবাক হয়ে যায়। দেরাদুন রাইসের গন্ধে ভরে উঠেছে টালির ছোট্ট রান্নাঘরটা। একে একে তনিমা ঢাকা খুলে দেখাতে লাগল কি কি সে বানিয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।
তৃপ্তি বলে, ও মা এত কেন রান্না করতে গিয়েছ। মাটনটাই তো ঠিক ছিল। আবার গলদা চিংড়ি করার কি খুব দরকার ছিল।
হ্যাঁ গো মা বাবার তো পকেটের খুব চাপ হয়ে গেছে। যে মানুষটা নিজেদের জন্য সচারাচর গলদা চিংড়ি কেনে না শুধু মাত্র দামের জন্য।সেই মানুষ একসঙ্গে খাসী আর গলদা কিনে এনেছে।
দেখ তৃপ্তি যতই হোক তোর শ্বশুরবাড়ির লোকরা বড়লোক। বড়লোকদের পাতে কি কুচো চিংড়ি দেওয়া যায়? না ওনাদের পাতে রেশনের চালের মোটা ভাত দেওয়া যায়?যারা যেমন মানুষ তাদের কে তো তেমন আপ্যায়ন করতে হবে তাই না।
তৃপ্তি ওর মোবাইলটা অন করে দেখলো বেলা একটা বাজতে চলেছে। তনিমার উদ্দেশ্যে বলে, মা বাপির দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ওরা এখনই এসে পড়বে। চল আমরা পাকা ঘরের বারান্দায় জল, জায়গা করে ফেলি।
মিনিট দশেকের মধ্যেই তৃপ্তির বাবা অমিতের মা বাবাকে না ফিরে এল। এসেই বললেন- তনিমা বেয়াই বেয়ানরা একটু দূর্গাপুর ব্যারেজ দেখতে যাবে বলছেন। তাই বলছি এখন আর খাবার বেড়ে কাজ নেই।
লীনা দেবী মিষ্টি হেসে বললেন, যেতে আসতে যেটুকু সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না। আমরা দূর্গাপুর থেকে ফিরে এসে কব্জি ডুবিয়ে খাব দিদির হাতের টেস্টি সব রান্না।আর হ্যাঁ, তৃপ্তির সঙ্গে আপনারও খেয়ে নিন কিন্তু। না হলে কিন্তু সবার খেতেই দেরি হয়ে যাবে। তখন আবার হজমের সমস্যা হবে।
তৃপ্তি বলে, মামনি বাপি তো একটার মধ্যে খাবার খান বাড়িতে। দেরি হলে বাপির তো কষ্ট হবে।
তৃপ্তির কথাটা জাস্ট হাওয়াতে উড়িয়ে দিয়ে লীনা দেবী বললেন, একদিন অনিয়ম করলে তোমার বাপির কিছু হবে না। তাছাড়া তো ঘন্টা খানেক-এর তো মামলা।
অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা বলল, তৃপ্তি চল আমরা সবাই এক মুঠো করে খেয়ে নিই। তোর তো এইসময় অনিয়ম করা উচিত হবে না।
তৃপ্তির বাবা বলল, বুঝলে তৃপ্তির মা আগে জামাই বাবাজীবন, বেয়াই আর বেয়ানের পাতে মাংস, চিংড়ি পড়ুক। ওনারা খাওয়ার পর যদি কিছু বেঁচে থাকে তখন না হয় রাতে আমরা খাব। এই বেলা ডাল, আলু চচ্চড়ি দিয়ে খেয়ে নিই আমরা।
খাওয়া দাওয়ার সেরে বিছানায় শুয়ে বারবার তৃপ্তি জানালার দিকে উঁকি মারতে লাগল।বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। ঘড়িতে যখন সাড়ে তিনটে তখন অমিতদের গাড়িটা এসে থামলো তৃপ্তিদের বাড়ির সামনের রাস্তায়।
তনিমা, তৃপ্তির বাবা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, সরি সরি খুব দেরি হয়ে গেল আমাদের ফিরতে।
তনিমা বলে ,হ্যাঁ দিদি বড্ড অবেলা হয়ে গেল যে। চলুন একটু করে খেয়ে নেবেন কিছু।
লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না দিদি আপনাদেরকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা সিটি সেন্টার থেকে লাঞ্চ করেই ফিরছি। আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। বুঝতেই তো পারছেন বেশি দেরি করা যাবে না। অমিত নিজেই তো ড্রাইভ করবে।
লীনা দেবী কিছুক্ষণ তৃপ্তিকে এটা ওটা প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়ে তারপর রওনা দিলেন। অমিত যাওয়ার সময় তৃপ্তিকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গেল। তৃপ্তির হাতের ওপর আলতো নিজের হাতটা ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে জানান দিল ওর আবেগকে।
অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হ্যাঁ রে তৃপ্তি তোর শ্বশুর, শাশুড়ি আমাদের ঘরের এক গ্লাস জল পযর্ন্ত মুখে তুলল না।
তৃপ্তি একটা তিতো হাসি দিয়ে বলল, ছাড় না মা। ওনারা তো মাটন, চিংড়ি রোজ খাচ্ছে। বরং আজ আমরা তিনজনে জমিয়ে রাতে খাওয়া দাওয়া করব।
তনিমা দেবী হালকা ধমকের সুরে বলল, একি অসভ্যের মতো কথা তৃপ্তি। ওনাদের জন্য খাবারের আয়োজন করলাম। আর ওনারাই কিছু না খেয়ে চলে গেলেন।
তৃপ্তি বলে, মা গরিব ঘরের মেয়েকে বড়লোকরা নিজেদের পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পুত্রবধূর মা বাবাকে নিজেদের সম গোত্রীয় ভাবতে পারে না কিছুতেই। দোষ কি কখনও বড়লোকদের হয় না। দোষ তো আমাদের মতো গরীবদের।যারা বড়লোকদের সঙ্গে কুটুম্বিতা করতে ছুটি। এই জন্যই তো বলে আত্মীয়তা করতে সমানে সমানে।
তনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তৃপ্তি কতবড় কঠিন কথাটা তুই কি অবলীলায় বললি রে মা। গরিবরা চিরকালই বড়লোকদের দয়ার পাত্র হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না।