জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[ উনচল্লিশ ]
বিন্দে কল্পনা করতে পারেনি, তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অখিল এইভাবে গালাগালি দিয়ে তাকে সপাটে চড় মারবে! আসলে অখিলকে এতটা রাগতে সে কোনদিন দেখেনি। তাই কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই তার কাছে অন্যায় আব্দার করতে এসেছিল। চুল্লুর নেশায় সেই থাপ্পড়ের ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না বিন্দের। ধপাস করে উল্টে পড়ে যায়। অখিল আর মুহূর্ত দেরি না করে তার ঘর থেকে সাইকেলটা বার করে দ্রুত চলে যায় দিঘিরপাড় বাজারে। কুঞ্জ ডাক্তারের চেম্বারে। রুইদাস পাড়ার কেউ ভাবতে পারেনি, অখিল তার সাইকেলে চাপিয়ে কুঞ্জ ডাক্তাবাবুকে নিয়ে আসবে। ততক্ষণে লোকে জটলা পাকাচ্ছে অখিল কেন বিন্দেকে মেরে পালাল? তার কাছে টাকা ধার চেয়েছে, সে ইচ্ছে করে দেবে, না হলে দেবে না। তাই বলে তাকে মারতে হবে? এটা অখিল অন্যায় কাজ করেছে। এর বিচার করে ওর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে আহত বিন্দের ডাক্তার দেখাবার জন্যে। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে সোজা অখিল বিন্দের বাড়ি চলে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মুক্তি নেই। বাপের বাড়ি চলে গেছে। আবার ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে মুক্তির বাপেরবাড়ি যায়।
ডাক্তারবাবু বলেছে, তিনদিন নিয়মমত ওষুধপত্র যা লিখে দিয়েছে দোকান থেকে কিনে সব খাওয়াতে হবে। কোন ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না। খরচার ভয়ে যা ওষুধ দেওয়া হয় সবটা না কিনে ভুল করে মানুষ। এখানে তা করলে চলবে না। তাহলে ক্ষতে সেপটিক হয়ে যেতে পারে। আবার অখিল ডাক্তারবাবুকে তার সাইকেলে চাপিয়ে ডাক্তারখানায় পৌঁছে দেয়। মোহনের ওষুধ দোকান থেকে সবকটা ওষুধ কিনে মুক্তির মায়ের হাতে দিয়ে যেমন যেমন ডাক্তারবাবু
বলেছে, তেমন ভাবে খাওয়াতে বলে বাড়ি চলে যায়। পাড়ার লোক অখিলের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে তার উপর যত শাস্তির খাঁড়া চাপাতে সরব হয়েছিল, সব নীরব হয়ে যায়। কেউ বলে, ছেলেটা বাইরে শক্ত হলে কি হবে, ভেতরটা খুব নরম। কেউ বলে, আমরা অখিলকে দোষী বলছি, বিন্দেকে সে মেরেছিল বলে। আর বিন্দে যে তার বউকে খুন করতে গেছিল, সে কথা তো কেউ উচ্চবাচ্য করলো না? এ তো তোমাদের একচোখো বিচার হল। দেখবে, এমন কানা বিচার সমাজে চললে, একটা সময় এমন বিচার কেউ মানবে না। উল্টে অবিবেচক বিচারকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করবে আজকালকার বিচারবুদ্ধিধরা যুবকরা। পাড়ায় একে একে শিক্ষিত ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার চেতনায় তাদের ঠিক বেঠিক ভাবার ক্ষমতা বাড়ছে। সেই হিসেবে বিচারওয়ালাদের এবার ভাবতে হবে, কেমন বিচার তারা করবে-না-করবে। তাই বলে তোমরা ভেব না আমি অখিলের হয়ে ‘গাওনা’ গাইছি। বিন্দেকে মেরে অখিল ঠিক করেনি এটা মানছি। কিন্তু চিন্তাভাবনা তো সবায়ের সব সময় ঠিক থাকে না। বউ মেরে হাতে রক্ত মেখে কেউ যদি কারোর সামনে এসে তার কাজের সাওটা গেয়ে অর্থাৎ সমর্থন করে টাকা চাইতে আসে, তখন অখিল কেন, যেকোন সুস্থ মনের মানুষেরই মাথা গরম হয়ে যেতে পারে। অখিলের বেলায় সেটাই হয়েছে। সেই দিক দিয়ে ভাবলে অখিল ভুল কিছু করেনি। সে অপরাধীকে থাপ্পড় মেরেছে। খুন করার চেষ্টা তো করেনি? সেটা সকলকে ভাবতে হবে। হুট করে একটা বিচার করে দিলে চলে না।
অখিল, বিন্দের বউকে চিকিৎসার সব খরচ দিয়ে এতটা উপকার করল। তবু শালা নেশাড়ু বিন্দে তার উপকারের দাম তো দিলই না উল্টে সে দিনরাত তাকে গালাগাল দিয়ে যায়। কেন সে তাকে মেরে উল্টে ফেলে দিল তার বিচার চায়। কেউ তার বিচার করে না। অখিল শালা পয়সার জোরে বিচার কিনে নিয়েছে। সেই থেকে বিন্দে অখিলের শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু শুধু মার খাওয়ার জন্যে এই শত্রুতা তা কিন্তু নয়। সেটা বিন্দে কোনদিন বাইরে আওড়ায় না। ওর বউ মুক্তি তারপর থেকে প্রায় এক বছর হয়ে গেল বিন্দের সঙ্গে ঘর করতে আসে না। বিন্দের ধারণা, মুক্তিকে এই বুদ্ধি দিয়েছে ওই শালা অখিল-টা। শ্বশুরবাড়ির উঠোনে গিয়ে নেশার ঘোরে কথাগুলো চেল্লায় বিন্দে। তখন মুক্তির মা মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে গেলে পালায় সে।
এই বিন্দের জিগরি দোস্ত এখন নোচে। সংসার করার যোগ্য না হয়েও মোহে পড়ে আরতিকে বিয়ে করলে যা হবার তাই হতে শুরু হল তার সংসারে। আরতির মন কিছুতেই সে আদায় করতে পারেনি। আরতি যে তাকে অপছন্দ করে তা আরতির মুখ থেকে শুনে সে বিগড়োতে শুরু করে। শুরু করে মদকে সঙ্গী করতে। সেখান থেকেই বিন্দে তার দোসর হয়ে যায়। সেদিন বেলা ন’টা ট’টা হবে। অখিল কারিগরদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। আর ঘটনাটা ঘটবে তো ঘটবে সেই অখিলের সামনেই। হঠাৎ অখিল দেখতে পায় আরতি চেল্লামেল্লি করতে করতে তার বাপের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। তার উল্টো দিক দিয়ে আসছে অখিল। হঠাৎ আরতি এসে তার পিছনে লুকিয়ে অখিলের জামাটা মুঠো মেরে ধরে বলে,“অখিলদা আমাকে বাঁচাও। ওই মাতালটা আমাকে মারতে আসছে ! ওই দেখো, আসছে! অখিল সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নোচে একটা কঞ্চিবাড়ির মত গাছের ডাল উঁচিয়ে এদিকে দৌড়ে আসছে। অখিল তাকে থামায়! সঙ্গে সঙ্গে নোচে বলে,“তুই সরে যা অখিল। আমার কাজে বাধা দিবি না। ওই মাগিকে আজ আমি উচিৎ শিক্ষা দেবো। আমাকে গালাগালি দেওয়া?” সঙ্গে সঙ্গে আরতি বলে, “মাতালটা সারা রাত কোথায় উল্টে পড়েছিল কে জানে। নেশা ছুটে গেলে বাড়ি এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। আমাকে বিছানায় যেতে হবে। আদর করবে! যত কথা বলে, মুখ দিয়ে ভকভক্ করে চুল্লুর বিকট গন্ধ ঠিকরে এসে আমার নাকে জ্বালা ধরিয়ে দিতে থাকে! রান্না করছি। বলতে একবালতি জল উনুনে ঢেলে দিল! আর ওই বাড়িটা আনতে গেল আমাকে পেটাবে বলে। ভয়ে আমি পালিয়ে আসি ও বাড়ি থেকে।” বলে অখিলের পা জড়িয়ে ধরে আরতি। তারপর বলে, “আমি ওর ঘর করবো না অখিলদা। তুমি আমাকে তোমার কারখানার কাজ দেবে? তোমার কাজ করে আমার একার পেট আমি চালিয়ে নেব। আমি কিছুতেই ওর ঘরে যাব না।” আরতির কথা শুনে অখিল তীক্ষ্ণ চোখে নোচে মাতালের দিকে তাকাতে সে বিষহীন সাপের মত ফনা নামিয়ে হাতের ছড়িটা রাস্তার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগোছালো পদচালনায় বাড়িমুখো হয়। যেতে যেতে বিড়বিড় করে অখিলকে দেখে নেবে, সেই প্রতিজ্ঞা করে আর তার বাপ-বাপান্ত করতে থাকে।
সনাতন সেইসময় নিজের কাজে পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে শুনতে পায় কোন মেয়ের আকুতিমিনতির স্বর! পা পা করে এগিয়ে গিয়ে দেখে তাদের পাড়ার মেয়ে আরতি। নোচের বউ! অখিলের কাছে কাজ ভিক্ষে চাইছে। আরতির প্রতি দরদে উচাটন হয়ে ওঠে সনাতনের নরম হৃদয়। আহা রে, দু’পয়সা রোজগার করে পেটে খাবার জন্যে কেমন প্রার্থনা করছে একজন যুবতী মেয়ে। যে মেয়ের একটা কুলাঙ্গার স্বামী বর্তমান। অন্যকিছু না ভেবে সনাতন বলে, “তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে তোমার অন্য কারিগরের মত ওকেও কাজে লাগাও না, অখিলদা?”
পাড়ার বুঝদার এবং ভাল ছেলে হিসেবে সনাতনকে সবাই মানে। ওর থেকে বয়সে ছোট হলে কি হবে, অখিলও তার কথাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সেই ছেলে আরতির হয়ে সুপারিশ করছে বলে অখিল মেয়েটার প্রতি আগ্রহ দেখায়। ওই মদখোর স্বামী, নোচের মুখচেয়ে কিছুতেই নয়। আরতিকে বলে, “তুই তো এখন কাজ শিখিসনি। আমার কাজ করবি কেমন করে। ঠিক আছে, আপাতত সহজ কাজ কিছু তোকে দেবো’খন। মন দিয়ে যদি করতে পারিস তাহলে মন্ডলপাড়ার রেখা বউয়ের কাছে তোকে পাঠাব। ওর কাছ থেকে কাজ শিখে নিবি।” তার মতামতকে গুরুত্ব দেবার জন্যে অখিলদার দিকে সন্তুষ্টির হাসি হেসে সনাতন নিজের কাজে চলে যায়।
মাস-দুই পরে নোচে, আরতির দাদুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বউ আরতিকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে আসে। নোচের কথায় আরতির দাদু গলে জল হয়ে গিয়ে জোর করে নাতনিকে শ্বশুর ঘরে পাঠায়। মা কিন্তু নিমরাজি ছিল। দাদু পাত্তা দেয়নি আরতির মায়ের মতামতে। বাধ্য হয়ে আরতি অখিলের শোলার কাজগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়। যেদিন যায় সেদিন বউকে কিছু বলেনি নোচে। দু’দিন পরেও নোচে যখন আরতির মন গলাতে পারল না, আবার ক্ষেপে যায় বোয়ের উপর! অখিলের সব অর্ডারি শোলার কাজ ভেঙে দুমড়ে বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে বলে, “ঢেমনা মাগী, নতুন নাঙ ধরেছো? ওই শোলাওলা তোমার নতুন নাঙ হয়েছে না? এই ঘুচিয়ে দিলাম তোর নতুন পিরিত। কি করতে পারে তোর ওই অখিল নাঙ এবার আমি দেখব। পয়সাওলা নাঙ, তাই নিজের বিয়ে করা স্বামীকে তোর আর পছন্দ হচ্ছে না, তাই না?”
এই শোলার কাজ তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অবলম্বন কি না এই মাতালটা নিমেষে শেষ করে দিল! আর কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, আরতি। সেও মাতালটার ব্যবহারের যাবতীয় জিনিস লন্ডভন্ড করে বাইরের কাদামাটিতে লেপটে দিয়ে চিৎকার করে গালাগালি দিতে দিতে সনাতনদের বাড়ির দিকে ছুট মারে! সনাতন তখন বাড়িতেই ছিল। সনাতনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তাদের উঠোনে এসে থাবড়ে বসে। ধড়ফড়ানি বুকে বলতে থাকে, “সনাতনদা, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ওই মাতালটা অখিলদার সব শোলার গয়নাগাটি নষ্ট করে দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এখন আমি কেমন করে অখিলদার সামনে মুখ দেখাব? এমনিতেই কাজ জানি না বলে আমাকে কাজে নিতে চাইছিল না। তুমি বলাতে কাজ দিল। এখন আমার কি হবে দাদা! জানোয়ারটা আমার সব শেষ করে দিল। তুমি দাদা অখিলদাকে একটু বুঝিয়ে বলবে? ওর অনেক ক্ষতি করে দিল জন্তুটা। ওই ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা তো আমার নেই। আর কাজও আমাকে দেবে না। ওর ঘর আমি আর করব না। তাহলে কি করে আমি বাঁচব, দাদা। এখন গলায় কলসি-দড়ি ছাড়া আর তো অন্য সমাধান আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। অখিলদা যেন আমাকে ভুল না বোঝে। আমাকে না দোষি সাব্যস্ত করে!”
অখিল ক্ষমা করে দিয়েছিল আরতিকে। ক্ষমা করেনি বিন্দে, নোচেকে। আর সেই থেকে নোচে-বিন্দে তার জাতশত্রু হয়ে দাঁড়াল। অথচ তাদের উপকারের জন্যে সে কাজ করতে গেছিল। এতসব অনাচার দেখেও চোখে ঠুলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ার মুরুব্বি-বিচারকরা! নোচে-বিন্দের মত কাজ কারবার কত অতীত থেকে যে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে চলে আসছে তা কে জানে। কারোর হুঁশ নেই, বৃহত্তর সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমাজেরও পরিবর্তনের ডাক দেওয়া দরকার। নিজেরা নিজেদের মধ্যে বেলেল্লাপনা, নোংরামো, নারী-পীড়ন- সবকিছু বিনা প্রশ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে আটচালা কোন দোষ দেখে না। আবার এই ছেলেমেয়েরা যদি অন্য জাতের কোন ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে তো তার মত জঘন্য অপরাধ নাকি আর হতে পারে না। রুইদাসদের মাথাদের বিচারে সেটাই বলে। কিন্তু এই বলা তো বন্ধ করার সময় এসেছে। সনাতনের সঙ্গে এমনকিছু সামাজিক একচোখোমিকে নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করে অখিল। অখিল বলে, “আচ্ছা সনাতন ভাই, তুই বল। একটা অকাল-স্বামীহারা যুবতী মেয়ে। অরক্ষণীয়া হয়ে দিন কাটাচ্ছে। চরম বিপদগ্রস্থ সে। তার পাশে যদি আমি গিয়ে দাঁড়াই তাতে আমাদের পাড়ার মানুষের মাথা খারাপ হবার কারণ কি? তাছাড়া, ভীষ্ম মন্ডলের বউ, রেখা-বউ তো আমার কাজের গুরুত্বপূর্ণ কারিগর। তার হাতের কাজের পটুতায় বড়বাজারে আমার এত সুনাম হয়েছে। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকবে না? তুই আমার চেয়ে ছোট। ভায়ের মতো। তবু তোকে আর একটু খুলে বলতে আমার দ্বিধা নেই। কাজের সুবাদে যাতায়াত। ভীষ্ম বেঁচে থাকতেও কাজ নিয়ে আমি ওদের বাড়ি যেতাম। তখন মেয়েটার প্রতি আমার কোন টান জন্মায়নি। পরস্ত্রীর প্রতি লোভ করা আমার নীতিতে বাধে। মেয়েদের নিয়েই তো আমার যাবতীয় কাজ। ব্যবসা আমার লক্ষ্মী। এই লক্ষ্মীর সহচারিনী ওরা। ওখানে বাঁকা দৃষ্টি ফেলা মানে তো নিজের পায়ে কাড়ুল মারা। সেটা আমি কোনদিন হতে দিতে পারি না। দিইও নি। কিন্তু ভীষ্ম মারা যাবার পর তার বউটার অসহায় জীবন আমাকে ধাক্কা মারে। কে ওর জীবন যৌবনের রক্ষকর্তা হবে। জীবনের সবটাইতো ওর বাকি পড়ে রইল। ধূমকেতুর মত ক’টা দিন ভীষ্ম ওর জীবনে এল, আবার বিলীন হয়ে গেল। তাই তার বিপদে পাশে দাঁড়াবার জন্যে কাজে-অকাজে ওদের বাড়ি একটু বেশি যাতায়াত করতে শুরু করি। তখনও কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসা বাসা বাঁধতে পারেনি। হঠাৎ একদিন রেখা বউয়ের শাশুড়ি আমাকে মেয়েটার দায়িত্ব নিতে বলে। অকল্পনীয় এক প্রস্তাবে আমার সত্ত্বার ভেতরে কে যেন এসে আন্দোলন শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণের জন্যে যেন মনে হল, আমি আমার মধ্যে নেই। তখনকার মত অবশ্য নিজেকে সামলে নিই। কিন্তু সেই দিন থেকেই রেখা বউকে নিয়ে আমার ভেতরের ভাবনা অন্য খাতে বইতে শুরু করে। কখন যেন ধীরে ধীরে ওকে ভালবেসে ফেলতে থাকি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এখনও পর্যন্ত কিন্তু রেখা বউয়ের মনের হদিশ আমার ধরাছোঁয়ার বইরে। মনে হয় যেন একটা পলকা কাঁটা তার আমার দু’জনের মাঝখানে অবস্থান করছে। তবে আমি বিশ্বাস করি সেই কাঁটা সরিয়ে দিতে বেশি বেগ পেতে হবে না।”
সনাতন ছেলেটা কম কথা বলে। সেটা অখিল কেন, পাড়ার সবাই জানে।
তাই তার কাছ থেকে এত কথার উত্তরে অনেক কথা অখিল আশা করে না। খানিক চুপ থেকে সনাতন শুধু বলল, “অখিলদা, জাত ধর্ম বর্ণর নিক্তি-কাঠিতে ভালোবাসা কোনদিন মাপা যায় না। এ তো অন্তরের সঙ্গে অন্তরের বোঝাপড়ার ব্যাপার। অন্তরের আবার জাত ধর্ম বর্ণ-ফর্ণ কিছু আছে নাকি ! আমার তো জানা নেই। যারা এই ভাবনার বাইরে অন্যকিছু ভাবে, সে তো মধ্যযুগীয় ভাবনা। এ ভাবনা বর্তমান ধ্যানধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। জানাই যখন যাচ্ছে যে এ খাপে ওই খাপ মিলবে না, তখন অমন চর্চায় কি লাভ। তুমিই বলো না অখিলদা?”
নিত্যানন্দ-দিবাকর, নোচে-বিন্দেরা যদি পাড়ার আটচালাকে শিখন্ডী রেখে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করতো তাহলে আজই তাদের বুঝিয়ে দিত কত ধানে কত চাল। কি শারীরিক ক্ষমতায় বা আর্থিক ক্ষমতায়। তারপর তো লোকবলের ব্যাপারটা আছেই। এখনকার ছেলেপিলেরা আর সেকেলেদের একদমই পাত্তা দিতে চায় না। কান পাতলে সেই হৃদয়-কথা শুনতে পাওয়া যায়।
একটু আগোছালো পোষাকেই রেখা শোলার কাজ করতে বসে যায়। তাদের ঘরে তো এখন আর কোন পুরুষ মানুষ রইল না। বাইরে থেকে কারোর আসারও কথা না। হঠাৎ ঠিকাদারবাবুকে দেখে চমকে ওঠে রেখা! ধরফড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে গোছগাছ করে ভদ্রসদ্র হতে। অত তাড়াতাড়ি সে আর হবার। শাড়ী জড়িয়ে মড়িয়ে যেন একাকার হয়ে আছে। রেখার মত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অখিলও। পাশের ঘরে দরজার সোজাসুজি বসে ভীষ্মর মা। দুই কপোত-কপোতির বেসামাল অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে বুড়ি। এমনিতেই বুড়িরা একটু ঠোঁটকাটা হয়। তারই সাজুজ্য মেনে বুড়ি বলে,“আর লুকোচাপা খেলা খেলে কি হবে বৌমা। যা ভবিতব্য তা তো মিলে গেল। ধীরে সুস্থে তোমার কাপড় সামলাও। অত হুড়োহুড়িতে মাকড়শার জালের মতো নিজে আরও জড়িয়ে পড়বে। অখিলবাবা যা দেখার না চাইতেই তা দেখে ফেলেছে।” বলে ঘরের বাইরে চলে যায় বুড়ি। শাশুড়ির কথায় লজ্জায় আরও রক্তিম হয়ে যায় রেখা বউয়ের চোখমুখ। ওখান থেকে দৌড়ে শাশুড়ির ঘরে চলে এসে চাপা গলায় বলে,“তুমি-না মা, একদম যাচ্ছেতাই। তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। যাও তো ঠিকাদারবাবু কি ভাবলো কে জানে!”
বাড়িতে হঠাৎ ঢোকার মুহূর্ত কয়েকের জন্যে যেটুকু দেখার দেখতে পেয়েছে অখিল। তারপর লজ্জায় সেই যে পাশ ফিরে দাঁড়িয়েছে, রেখা বউ ওঘরে চলে যাবার পরও সেইভাবে ছিল। রেখা বউ ফিটফাট হয়ে এসে ডাকতে তবে সামনে ঘুরে দাঁড়ায়। দু’জনে সামনাসামনি হতেই রেখা বউ মুচকি একটা হাসি ছুড়ে দেয় অখিলের দিকে। সেই হাসি পরম আদরে নিজের হাসিতে মিলিয়ে দেয় অখিল। রেখা বলে,“কিছু মনে করবেন না ঠিকাদারবাবু। আপনি আসবেন বুঝতে পারিনি। কোলকাতায় যাবার কথা তো আজ? গেলেন না যে? এরকমভাবে কাজে অবহেলা করলে কি করে হবে। মহাজন যদি অর্ডার বাতিল করে দেয়?”
-আমার অর্ডার বাতিল করলে মহাজনেরই লোকসান হবে। আমার নয়। কত মহাজন হাত বাড়িয়ে আছে, আমার মাল নেবার জন্যে। সেটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমার রেখা বউয়ের জন্যে। যদি চলে যেতাম তাহলে কি এমন মায়াবী প্রকৃতির সঙ্গে আমি একাকার হতে পারতাম! প্রেমময়ের অসীম কৃপা না থাকলে এই অমূল্য দর্শন সম্ভব নয় রেখা বউ। আমি যে আজীবন এই প্রকৃতিতে নিজেকে সমর্পণ করতে চাই, প্রিয়া.. তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব। তুচ্ছ হয়ে যাবে আমার যাবতীয় পার্থিব চলনবলন, ইচ্ছা অনিচ্ছা। সব। সবকিছু- এমন লোকসান আমি প্রাণ থাকতে হতে দিতে চাই না রেখা বউ। আর তা থেকে রক্ষা করার চাবিকাঠি যে একমাত্র তোমারই হাতে।”
-এ কি কথা বলছেন, ঠিকাদারবাবু! আমার মত পাপীতাপী তুচ্ছ মেয়েমানুষকে এমন লোভ দেখাবেন না বাবু। অলক্ষুণে স্বামীখাকি আমি। এ আমার জন্মান্তরের পাপের সাজা। যদি আমার ‘বেয়নে’ এমন অঘটন না ঘটবে তাহলে আমার বিয়ের আগেও তো লতার ছোবলে মরতে পারতো সে? তা তো হল না! আমাদের বিয়ে হল আর মরণ তাকে কেড়ে নিল! আমার পাপের ফল ছাড়া এমনটা হবার কথা নয়। আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিন ঠিকাদারবাবু! ভুলে যান এই অপয়া মেয়েমানুষকে। বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে রেখা বউ!
রেখা বউয়ের কথায় হঠাৎ যেন কেমন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে অখিল! তার ভালোবাসাকে না পাবার আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলে,“তা হলে আর এ জীবন কার জন্যে বাঁচিয়ে রাখা, রেখা বউ! একে আহুতি দেওয়াই সঠিক বিচার হবে। তুমিও যখন তা চাইছো তবে তাই হোক।”
কোন অঘটন ঘটে যাবার আগেই রেখা দৌড়ে ওঘরে গিয়ে যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের শারীরিক ব্যবধানকে উপেক্ষা করে প্রাণপণে অখিলকে জড়িয়ে একাকার হয়ে বলে, “এ কাজ তুমি করতে যেও না অখিল! দ্বিতীয়বার আবার আমাকে আপনজনের মৃত্যুর দায়ভার চাপিও না। তোমার কাছে আমি তোমার জীবন ভিক্ষা চাইছি। বিনিময়ে তোমার যা মনের ইচ্ছে তাই হবে। তুমি যা বলবে তাই করব। যা বলবে না করব না। শুধু আমার এই ক্ষতিটুকু হতে দিও না।”
[ চল্লিশ ]
আশাতিরিক্ত ভাল ফল করে সরিষা সারদা মন্দির থেকে বেসিক ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরল অলোকা। তার এই সাফল্যের পেছনে প্রধান অবদান যে বিপ্লবদার। এ অবদান জীবনে সে ভুলতে পারবে না। অলোকা ভাবে, বিপ্লবদা যদি তার জীবনে না আসতো তো এই ট্রেনিংটা নেওয়া তো হোত না। ট্রেনিং পিরিয়ডে যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রোজেক্ট তৈরীর ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে তার ঋণ সে কোনদিন শোধ করতে পারবে না। এক কথায় এই মানুষটা অন্তরাল থেকে তাকে সাহায্য না করলে গর্ব করে বলার মত এই রেজাল্ট করা তার একার পক্ষে কোনদিন সম্ভব ছিল না। এই সত্যকে সে যদি স্বীকার না করে তো তা আপন ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছু হবে না। যত এই মানুষটার সঙ্গে সে মিশছে তত তার প্রতি একটা অমোঘ টান মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এ তার জন্মান্তরের আপনজন। এখন অলোকার মনে হয় এই বিপ্লবদা ছাড়া তার জীবনে কোনদিন পূর্ণতা আসতে পারে না। সে সবসময় প্রস্তুত তার সর্বস্ব এই মানুষটাকে উজাড় করে দিতে। কিন্তু বিপ্লবদা কি তাকে সেই চোখে দেখে? কি জানি! এমনি বোঝা যায় সে যা চায় সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবদা তার নিজের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। অথচ মুখ ফুটে পরিষ্কার করে কেন যে বলে না, অলোকা আমি তোমাকে ভালোবাসি! কথায় বলে, ‘মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। এ তো দেখছি তার উল্টো। অলোকা তো লজ্জাহীনভাবে তা যে কোন সময় প্রকাশ করতে পারে। এই মানুষটার সামনে প্রকাশিত হওয়াটায় কোন সঙ্কোচ বোধ তার মধ্যে নেই। কিন্তু গ্রাহকের আধার কতটা প্রস্তুত সেটাই তো খোলসা হল না তার কাছে।
সারদা মন্দির থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসার পর বিপ্লবদাকে বলেছিল অলোকা, “এবার তো তার হাতে অঢেল সময়। পুনরায় ডিগ্রীকোর্সে ভর্তি হওয়া যায় তো বিপ্লবদা? আমার পুরোনো ইচ্ছেটা তাহলে পূর্ণ করতে পারি। তোমার কি মত?”
-বেসিক পড়ার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতার সুযোগ নেওয়া। এবার তুমি যদি সেই সুযোগ না নিয়ে আবার লেখাপড়ায় জড়িয়ে পড়ো তাহলে এত কষ্ট করে এটা পড়ার কোন যে মূল্য থাকে না অলোকা। আমার তো আশা তুমি প্রথম সুযোগেই চাকরিটা পেয়ে যাবে। তোমার প্রতি এতটা আমার আস্থা! এখন আমাদের কাজ, সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। সুযোগ এলে, সফল হলে তো আবার তোমাকে কলেজে পড়া ছাড়তে হবে। এবার তুমি বলো, কোন কাজটা তাহলে সঠিক হবে। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেসিক ট্রেনিং করা না থাকলে কোন প্রার্থীকে প্রাইমারী স্কুলের জন্যে টিচারের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে না। এই নিয়ে বছর খানেক হয়ে গেল কেস চলছে। নন- বেসিকের যারা সরকারের আগের নোটিফিকেশন মত দরখাস্ত করেছিল তারা সরকারের এই সম্প্রতি নোটিফিকেশনের বিরুদ্ধে কেস করেছে। তাদের যুক্তি, সরকারের আগের বিজ্ঞাপনে কোন ট্রেনিংয়ের কথা বলা ছিল না। এই কেসের বিরুদ্ধে সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নতুন বিজ্ঞাপনের পক্ষে সাওয়াল করেছে। খুব সম্ভবত সামনের হেয়ারিংয়ে কেসটার ফাইনাল ডিসিশান দেবে কোর্ট। যা শোনা যাচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষেই রায় যাবে। তাই যদি হয় তো আমাদের আর ফিরে তাকাতে হবে না। কেন বলো তো? কারণটা এর গভীরে লুকিয়ে আছে। গভর্নমেন্টের রেকর্ড মত যা ভ্যাকান্সি আছে, তার থেকে কম ক্যান্ডিডেট আছে বেসিক ট্রেনিং পাশ করা। তারপর তোমার Rank তো অনেক উপরের দিকে। এ অবস্থায় তোমাকে আটকায় কে? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিপ্লব বলল।
অনেকদিন হয়ে গেল। দেখা হয়নি বিপ্লবদার সঙ্গে। কি করে যে দেখা করা যায়! মনটা উচাটন। তাদের পাড়াগাঁয়ের যা হালচাল, তার মত মেয়েদের হুটহাট অন্য পাড়ায় গিয়ে দেখা করার উপায় নেই। তারপর মেয়েটা যখন অলোকা, তো চব্বিশঘন্টা ঘুরে বেড়ানো পাড়ার অকেজোদের লাল চোখ তার উপর নিবদ্ধ হবেই হবে। আর অন্য পাড়া বলতে বিপ্লবদাদের পাল পাড়া হলে তো পরদিনই আটচালায় অশ্লীলতার দায়ে বিচারসভা বসে যাবে তাদের বিরুদ্ধে। একটা চিরকুট লিখে ঘোরাঘুরি করছে অলোকা। লক্ষ্য তার সনাতন। কখন ছেলেটাকে ঘরের বাইরে দেখবে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তো সনাতনদের বাড়ি গিয়ে চিরকুটটা তার হাতে ধরিয়ে বলা যায় না যে এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। তাকে খারাপ মেয়ে ভাববে সে। দুই ভাবনার সন্ধিক্ষণে সনাতনই প্রথম তাকে দেখতে পেয়ে বলে, “কেমন আছো, অলোকাদি। হ্যাঁ, সবসময় ঘরের ভেতর ভাল লাগে। একটু ঘোরাঘুরি করাও দরকার।” অলোকা দেখে, সনাতন বাজারের ওইদিক থেকে আসতে আসতে কথা বলছে। অলোকা ডাকে, “এদিকে একটু আয়-না ভাই। তোর সঙ্গে আমার কাজ আছে। তোকেই খুঁজছিলাম। তাই এই ঘোরাঘুরি।” সনাতন বলল, “বলো কি বলছো। হ্যাঁ, বিপ্লবদাকে দেখলাম মোহনের সেলুনে চুল কাটছে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। না। তোমাকে বলার মত তেমন কিছু বলেনি। আমিও ওখানে দাঁড়াই নি। একটা বিশেষ কাজে বাড়ি আসছিলাম তাই। আবার এক্ষুণি বাজারে যাব।” বলে মুচকি একটু হেসে নেয় সনাতন। ভাইটার কাছে একটু লজ্জা মত পায় অলোকা। বলে, “আবার যখন বাজারে যাবি, তখন আমার একটা কাজ করে দিবি ভাই?” বলে সনাতনের ‘হ্যাঁ-না’ উত্তরের অপেক্ষা না করে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা চিরকুটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এটা বিপ্লবদাকে দিয়ে দিস। চুল কাটছে মানে একটু পরে গেলেও মোহনের সেলুনেই পেয়ে যাবি ওকে।” বলে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে অলোকা। সনাতন চিরকুটটা হাতে ধরে কিঞ্চিৎ উদাস চিত্তে অলোকাদিকে পেছন থেকে দেখতে থাকে। ভাবে, অলোকাদি কত ভালোবাসে বিপ্লবদাকে। এই নিয়ে পাড়ায় কত-না ঝামেলা হয়েছে। তবু দিদির মন যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। থাকবে না বা কেন? বিপ্লবদাই তো ওর জীবনের একমাত্র ‘ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড।’ সেই কৃতজ্ঞতা বোধ যদি অলোকাদির মধ্যে না থাকতো তো এক নিতান্ত সত্যকে নির্মমতার সঙ্গে অবহেলা করা হত।
আর দেরি না করে সনাতন তাড়াতাড়ি তাদের বাড়ির দিকে গেল নিজের কাজ সামলাতে। তাড়াতাড়ি করে না বাজারে ফিরতে পারলে আবার বিপ্লবদার সঙ্গে তার দেখা না-ও হতে পারে। চুল-দাড়ি কাটা হয়ে গেলে ও সেখানে আড্ডা দেবার মানুষ নয়। কাজ থাকলে এদিক ওদিক কাজ সেরে বাড়ি চলে আসে। বই আর পড়াশোনা এদের দু’জনের অন্যতম প্রধান বন্ধু। কে যে এদের প্রধান বন্ধু- এরা পরস্পর দু’জন নাকি বই-লেখাপড়া সেটা বোঝা মুশকিল। সব যেন একাকার হয়ে আছে এদের মধ্যে।
“ছুতোটা মায়ের জন্যে ওষুধ কিনতে যাওয়া। দিঘিরপাড় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না তাই ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। কাল দুপুর দুটোর সময় আমি বাজারের বাসস্ট্যান্ডে থাকব।” বিপ্লবকে উদ্দেশ্য করে চিরকুটে তাই লিখেছে অলোকা। সেটা পড়ে একটা সন্তুষ্টি ভাব নিজের মনের মধ্যে জরিয়ে নিতে নিতে বাড়ির পথ ধরে বিপ্লব। এত কাছে থেকেও কতদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তার মনটাও অস্বস্তিতে থিতু হচ্ছিল না কিছুতেই। তারও কলেজ শেষ। বাবার কারবারের কাজ না থাকলেও কাছে-দূরে, বাইরে কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। ভালোই হল এই সুযোগে তার কলেজভূমে একটু ঘুরে আসা যাবে। তবে বাড়িতে অন্য কাজের কথা বলে যেতে হবে। বাড়ির লোকজন পছন্দ করে না, রুইদাস পাড়ার মেয়ে অলোকার সঙ্গে সে মেলামেশা করুক। এইসব জাত-ফাত নিয়ে এরা চর্চা করতে এত পছন্দ করে কেন কে জানে! ওর মত গুণবতী বুদ্ধিমতী নম্র স্বভাবের মেয়ে সারা পালপাড়া ঢুঁড়ে বেড়ালেও একটা খুঁজে দিতে পারবে কেউ? পারবে না। আপাতত মুখে কিছু বলছে না যে রুইদাসরা তাদের থেকে নীচু জাত। তার উপর পশুর চামড়া নিয়ে ওদের কাজ কারবার। তাই এই জাতের প্রতি ওদের এমন ঘেন্না। কিন্তু চলনে বলনে তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করছে না পালেরা। অলোকার সঙ্গে মেলামেশার বহর বেশি মনে হলে নিশ্চয়ই একদিন ভেতর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে মনের মূল প্রবৃত্তি! অলোকার বেসিক ট্রেনিংয়ের পড়ার সঙ্গে সে যে এত বেশিভাবে জড়িয়ে ছিল, তার বিন্দু বিসর্গও জানে না তার বাড়ি। বা পাড়াও। সেই সুযোগ সে করে দেয়নি। যা কিছু করেছে সবটাই এদের অন্তরালে রেখে। তিরাশি নম্বর বাসে দিঘিরপাড় থেকে উঠে দোস্তপুর চৌরাস্তার মোড়ে নামতে হয়। সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে ডায়মন্ড হারবারমুখী বাস ধরতে হবে। দোস্তপুর মোড়ে নেমে এত গাড়ির বহর দেখে একটু ইতস্তত বোধ করে অলোকা। তাই নিজে থেকেই সে বিপ্লবের বাঁহাতটা তার ডান হাত দিয়ে খাপটি মেরে ধরে ! অলোকার হাতের পেলব স্পর্শে সমস্ত শরীরে শিহরণ তুলে দেয় বিপ্লবের! ওকে নিজের জন না ভাবলে সে এটা করতো না। একটা তৃপ্তিবোধ তাকে যেন খুশি করে তোলে। রাস্তা পার হয়ে বাসের জন্যে ওপারে দাঁড়িয়ে তখনও হাত ছাড়েনি অলোকা। বিপ্লব একবার অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হাতের দিকে চায়। ইঙ্গিত বুঝে অলোকা বলে,“সারা জীবন আমি এই হাত ধরে বেঁচে থাকতে চাই। এ হাত আমার। ছেড়ে দেবার হাত নয় এটা। চলো গাড়ি আসছে। এবার হাত ছাড়ছি। অনুসরণ করছি তোমার। সেই সুযোগ তুমি আমায় দাও। জন্মান্তর!”
কলেজে পড়তে আসার সুবাদে ডায়মন্ড হারবার শহর বিপ্লবের হাতের তালুর মত চেনা। অলোকার মায়ের জন্যে ওষুধ কেনার পর ডায়মন্ড হারবার গার্লস স্কুল ডানদিকে রেখে নুনগোলা এলাকা পেরিয়ে ওরা চলে যায় নদীর কিনারায়। নদী এখানে একটা বড় বাঁক নিয়ে সাগর অভিমুখে রওনা দিয়েছে। বাঁধানো নদীবাঁধে বিভিন্ন গাছ লাগানো আছে। গাছের শেকড়গুলো বাঁধের পাড়কে শক্তপোক্ত ধরে রাখার জন্যে। বিশেষ করে বট, অশত্থ, পাকুড়, দেবদারু আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারিগুলো পরিবেশকে যেন মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। প্রত্যেক গাছের ঠিক নীচে সুন্দর সুন্দর সিমেন্টের বাঁধানো বসার চাতাল। চেয়ারের মত দেখতে তার কাঠামো। অলোকা এই প্রথম এমন মনপাগল করা জায়গার সঙ্গে পরিচিত হল। অগণিত হাত মেলে ধরে একটা বট তার শীতল ছায়া বিতরণ করে চলেছে অকৃপণভাবে। গাছের তলায় বসার জায়গায় অলোকা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে বসতে বলল বিপ্লবকে। বলল, “এই ব্যবস্থা কি তাদের মত ভালোবাসার জনেদের জন্যে করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ! মনে হচ্ছে তো তাই। মানে বৃহত্তর সমাজ আমাদের এই নির্মল পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে আমরা ভুল কাজ কিছু করছি না। সংকীর্ণ স্বল্প-জানা ঈর্ষাধারি একদল মানুষ যাই ভাবুক না কেন।” বলে এবার অলোকা বিপ্লবের একটা হাত নিজের কোলের আঁচলের উপর রেখে তার উপর দিকটা পরম ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে। নিজের অন্তরের সুখানুভূতির সঙ্গে বিপ্লব তাকে প্রশ্রয় দিতে থাকে। কখন যেন দখিনা ঠান্ডা মোলায়েম বাতাসে স্নান করতে করতে চোখ বুজে আসে বিপ্লবের। হঠাৎ একটা চমক তাকে যেন জাগিয়ে তোলে। দেখে, অলোকার মোহময় দুটো ঠোঁটের ওম তার হাতে বিলি কাটছে! বিগলিত চিত্তে বিপ্লব বলল, “এত ভালোবাসার দায় আমি বহন করতে পারব তো অলোকা? আমি এর যোগ্য কি না তা তো আমার জানা নেই। আমাকে এইভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসার রজ্জুতে বেঁধে নিজের কাছে রাখতে চাইছো। আমিও সেই বাঁধন মুক্ত হতে চাই না। কিন্তু আমাদের দু’জনের সমাজ যদি দু’জনের মধ্যে দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলতে আগ্রাসী হয়! তখন কিভাবে আমরা সেই বাধা টপকাতে পারব তা তো আমার জানা হয়ে ওঠেনি অলোকা।”
বিপ্লবের কথায় অলোকা কোন অজানা বিচ্ছেদ ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এবার তার ঠোঁট দিয়ে ভালবাসার ওমের স্পর্শর পরিবর্তে চোখ দিয়ে সদ্যভুমিষ্ঠ প্রেমের বারি বিপ্লবের হাতের উপরিভাগকে স্নান করিয়ে দিতে লাগল। বিপ্লবও আর পুরুষালী চিত্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। টপটপ করে তার চোখ বেয়ে গাল টপকে ভূমির পারে নত হতে থাকল।
“মুখ তোলো অলোকা। এই নাও রুমাল। চোখমুখ মুছে নাও।” ধরে যাওয়া গলায় বিপ্লব বললে, হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে প্রথমে বিপ্লবের ভেজা হাতটা মুছতে যায় অলোকা। আটকে দেয় বিপ্লব। বলে,“এ আমার পরম ভালোবাসার অমূল্য দান। একে হেলায় নিঃশেষ হতে দিতে আমি পারি না। এর স্থান আমার সত্ত্বায়। সত্ত্বার মধ্যে আমি একে লীন করে দিতে চাই।” বলে সেই ভেজা হাতটা বিপ্লব তার মুখময় আলতো করে বুলিয়ে বুলিয়ে হৃদয় মাঝে স্থান করে দিল। বলল, “এবার ফেরা যাক আলোকা। বিকেল গড়ানের দিকে। যেতে যেতে পশ্চিমের সূর্য রক্তিম হয়ে আসবে। অন্ধকার নামলে তোমার বাড়ির লোক চিন্তায় পড়ে যাবে। খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। সেই পরিস্থিতি আমাদের কাম্য নয়। তার আগেই আমাদের ফিরতে হবে।”
কোর্টে সরকারের জিৎ হবার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক নেবার কথা বলে। শর্ত, প্রত্যেক প্রার্থীকে বেসিক ট্রেনিং কোর্স পাশ করতে হবে। যথারীতি অলোকা দরখাস্ত করে এবং প্রথম সুযোগেই মাস্টারির চাকরিটা পেয়ে যায়। রুইদাস পাড়ার ইতিহাস রচনা করে ফেলল অলোকা এই মাস্টারির কাজটা পেয়ে। গর্বে বুকের ছাতি বেড়ে গেল রুইদাস পাড়ার। সনাতন এই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইল না। সচেতনভাবে সে আটচালায় একটা অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা করল। সেখানে পাড়ার সব বাসিন্দাকে আসার আমন্ত্রণ জানানো হল। উদ্দেশ্য অলোকা রুইদাসকে সম্মান জানানো। সে রুইদাস পাড়াকে সম্মানিত করেছে। অতএব রুইদাস পাড়াও তাকে সম্মানিত করতে চায়। সনাতনের ইচ্ছা হচ্ছিল এই আনন্দানুষ্ঠানে বিপ্লবদাকে আমন্ত্রণ জানানোর। কিন্তু বেপাড়ার একটা ছেলেকে কোন যুক্তিতে এখানে ডাকা হবে সেই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। অলোকার একদম পছন্দ ছিল না তাকে নিয়ে এইসব প্রচার-ট্রচার করা হোক। কিন্তু সনাতন, অখিলরা সেকথা শুনবে না। তাদের গর্বের ধনকে তারা মানুষের সামনে তুলে ধরবেই। বাধ্য হয়েই ওদের কথায় অলোকাদি নিমরাজি হয়। তবে অলোকাদির প্রবল আপত্তি আছে বিপ্লবদাকে ডাকার ব্যাপারে। পাড়ার ওইসব মন্দ ছেলেগুলো যদি তাকে দেখে হুল্লোড় শুরু করে তো অসম্মানের আর অবশিষ্ট থাকবে না। অলোকার এই অনুষ্ঠানের বিরোধী হবার আর একটা কারণ ছিল, বিপ্লবদা। যে মানুষটার বিশাল অবদানের বিনিময়ে তার এই সাফল্য সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় কেমন করে? এ তো শিবহীন যজ্ঞ হয়ে যাবে। তবু অলোকা বিপ্লবদার ব্যাপারে এতটা কঠোর। সনাতনকে বলে, “বিপ্লবদাকে যদি তোরা আসতে বলিস তাহলে ওখানে আমাকে পাবি না। এটা আমি বলে দিলাম।”
বিপ্লবের জীবনের যদি প্রথম সাফল্য আসে তো সেটা হল অলোকার চাকরি পাওয়া। চাকরিটা অলোকার। কিন্তু গর্ব তার। নিজের অবশিষ্ট প্রেরণার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে সে অলোকার এই সাফল্য ছুঁতে পারার পেছনে। তাই গর্বের সঙ্গে খুশি এবং সন্তুষ্টির অংশীদার তো সে হবেই। তার আরও ভাল লাগছে, ওই পেছিয়ে পড়া একটা সমাজ আজ তার সাফল্যকে সম্মান দিতে অনুষ্ঠান করতে চলেছে। এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির জন্যে কেউ ডাকলো কি না-ডাকলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। ডাকলে সে যাবেও না। ওপাড়ার সব লোক যে কতটা সংকীর্ণমনা, তা সে খুব ভাল করে জানে। বরং বলা যায় বেশিরভাগ মানুষের মানসিকতা এখনও সেই মধ্যযুগীয় স্তরে দাঁড়িয়ে আছে। অলোকা, সনাতন বা অখিলরা তো গোবরে পদ্মফুলের মত জ্বলজ্বল করছে। ওই জনা-কয়েকের মুখের আয়নার সামনে সিংহভাগকে আনতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে রুইদাসদের।
রুইদাস পাড়া এখন যেন উৎসব মেজাজে মশগুল। পাড়ার মেয়ের এতবড় একটা সাফল্যকে বাহবা দেবার জন্যে আটচালায় অনুষ্ঠান হবে। সেই উপলক্ষ্যে আবার অন্যপাড়ার গন্যমান্য কয়েকজন মানুষকে ডাকা হয়েছে। চলছে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করার তোড়জোড়। তাই নিয়ে সনাতনরা এখন অত্যন্ত ব্যস্ত। পাড়ার বয়জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে চলছে গুরুত্বপূর্ণ সব আলাপ আলোচনা। কিঞ্চিত মিষ্টিমুখেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে, আটচালার তহবিল থেকে। মিষ্টিমুখের প্রস্তাবটা আসে পাড়ার মুরুব্বিসম মানুষদের কাছ থেকেই। সনাতন, অখিল অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিল, আটচালার ফান্ড মানে তো সরকারি টাকা। অন্যরা যদি এই টাকা খরচ নিয়ে কোন মন্তব্য করে তো অস্বস্তির আর শেষ থাকবে না। তাই অখিল বলছিল,“বড়রা যখন বড় মুখ করে বলেছে তখন মিষ্টিমুখ করা হবে। তবে সবাই যদি রাজি থাকে তো আমি ওই খরচের ভারটা নিতে পারি। তাহলে
সনাতনের ওই আশঙ্কাটা আর থাকবে না।” অখিলের প্রস্তাব উপেক্ষা না করেও নন্দকাকা বলল,“অখিলের বুকের পাটা আছে বলে এতটা সাহস দেখাতে পারল। কিন্তু অখিলকে অবজ্ঞা না করেই বলছি, আমরা, পাড়ার বয়স্করা আনন্দ করে একটা প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাবকে তোমরা সম্মান দেবে না? আমার তো মনে হয় না, আমাদের কথা বললে পাড়ার কেউ সেই কাজে আপত্তি তুলবে। সারা জীবন তো জীবন-পাত করে পাড়ার ভালোর জন্যে কাজ করে এলাম। এবার বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোর একটা সুযোগ এসেছে। সময়ও এসেছে বলতে পারো। সেটাকে এলেবেলে করে দিতে পারি না আমরা। তোমরা কি বলো, সনাতন-অখিল? দরকার হলে আটচালা কমিটি থেকে এই খরচের কথাটা পাশ করিয়ে দিচ্ছি ! আমি, রতন, দিবাকর, সুবোধ কাকারা কেউই অরাজি হবে না এমন সুন্দর একটা প্রস্তাবে।” নন্দকাকার প্রস্তাবে একশো শতাংশ সায় দিয়ে সনাতন বলল, “ওই দিক থেকে আমাদের কোন সংশয় নেই কাকা। কিন্ত আমরা জানি, পাড়ার একটা দল আছে যারা সবসময় অন্যের খুঁত ধরবার জন্যে মুখিয়ে থাকে। কোন ভালো কাজেও সাথে না থেকে তাকে ব্যাগড়া দিতে পিছপা হয় না। এটা তাদের স্বভাব। চলতি সংস্কারকে হাতিয়ার করে ভাল কাজে এগিয়ে যাবার পথকে বেড়াল লেলিয়ে কেটে দেবার স্বভাব তাদের জন্মগত! যতই তাদের বোঝানো হোক তারা স্বভাব পাল্টাবে না। তারা কারা তা আমরা জানি কাকা। চোখ খুলে রাখলে তোমরাও দেখতে পাবে তাদের চাঁদপানা মুখগুলো। সেইজন্যেই বলছিলাম আরকি।”
সনাতনের কথায় আরও জেদ চেপে যায় নন্দকাকার ! চোখমুখ খিঁচিয়ে রেগেমেগে বলে, “কোন্ বেটার সাহস আছে, আসুক আমাদের সামনে। ওই পেছনে থেকে মানুষকে উসকে দিলে চলবে না। মুখোমুখি হতে হবে তাদের। তারপর দেখব, সাহসীদের বুকের পাটা কতটা।” তারপর কি একটু ভেবে নন্দকাকা সনাতনের দিকে তাকিয়ে বলল,“সনাতন, তুমি বা জানলে কিরে যে একদল বিরোধিতা করবে আমাদের কাজে? নিশ্চিত না হয়ে আবার কারোর নামে বদনাম করাটাও তো ঠিক হবে না। কি বলো ষ?”
-হ্যাঁ কাকা, সেটা তো ঠিক। তবে সঠিক খবরটাই আমাদের কাছে আছে। ওরা গুলতানি পাকাচ্ছে, আমাদের অনুষ্ঠানটাকে গুলিয়ে দেবার জন্যে। দেখবে, ইদানিং ওরা চার-পাঁচজন সমসময় একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে। পাড়ার আর কারোর সাথে ওরা মেশে না। সনাতন বলল।
ঠিক সেইসময় ওই দলটা আটচালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। নন্দকাকা দেখতে পায় ওই দলটাকে। বলে,“ওরা না?” সঙ্গে সঙ্গে গলা হাঁকিয়ে বলে, “এই শোন শোন, তোরা এদিকে আয় একবার, পালাবি না কিন্তু। আয় এদিকে।”
ক্রমশ….