Site icon আলাপী মন

গল্প- জ্বালা

জ্বালা
মুনমুন রাহা

 

 

                              কলেজের দেরি হয়ে গেছে দেখে ঝটপট পা চালায় সৃজনী। গ্রামের খালের পোলের উপর দাঁড়ানো প্রতীক ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে একটু থমকে যায় সৃজনী। এই এক উৎপাত শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে । রাস্তাঘাটে যেখানেই দেখা হয় এই প্রতীক সৃজনীকে তার ভালোবাসা জানায়। কতবার সৃজনী বুঝিয়েছে এই ভালোবাসা এক তরফা। কিন্ত কে শোনে কার কথা! তার উপর আবার প্রতীক হল এখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে। তাই বেশি কিছু বলতেও পারে না সৃজনী। যতটা পারে এড়িয়ে চলে।  সৃজনী কিছুদিন হল ঐ শিবতলার পথটা ছেড়ে এই পথ দিয়ে কলেজে যায় কেবলমাত্র এই প্রতীকের পাল্লায় পড়বে না বলে। কিন্ত আজ এখানেও ধাওয়া করেছে প্রতীক।

            সৃজনী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগোলো পোলের দিকে। পোলের মাঝামাঝি আসতেই প্রতীক বাইক নিয়ে একদম সৃজনীর গায়ের কাছে চলে আসে তারপর  বলে – ” কি সুন্দরী , আমার কাছে ধরা দেবে না বলে এই রাস্তা নিয়েছ তো! কিন্ত সোনা আমার কাছ থেকে যে পালানো এত সহজ নয়! আমার যে চোখ চারদিকে আছে। দেখ আমি তোমাকে ভালোবাসি বিয়ে করব । এই সোজা কথাটা কেন ঢুকছে না তোমার মাথায়? ভালো কথা অনেক দিন বলছি, এবার মটকা গরম হলে কিন্ত বিয়ের আগেই সব কিছু করব শুধু বিয়েটা করব না। “

কথা বলতে বলতে প্রতীক বাইক থেকে নেমে সৃজনীর হাতটা চেপে ধরছে। প্রতীকের চটুল কথায় তার বন্ধুরা হায়নার মতো হাসছে পিছন থেকে। যেন কোন মুখরোচোক ঘটনার সাক্ষী থাকবে বলে প্রাণ আনচান করছে তাদের। সৃজনী নিজের হাতটা ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে- “দেখো প্রতীকদা আমি তো তোমায় কতবার বলেছি, আমি কল্যাণকে ভালবাসি। কেন বারবার তুমি এক কথা বল বলতো ?”
-শালী বড্ড তেল বেড়েছে তোর, ভালো কথায় কিছু হবে না।

    এই কথা বলে প্রতীক সৃজনীর ওড়নাটা ধরে টান দেয়। সৃজনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেষে না পেরে প্রতীককে এক ধাক্কা মারে আর গালে একটা সজোরে চড় কষায়। প্রতীক আর তার বন্ধুরা বোধহয় এতটা আশা করেনি। তাই মুহুর্তের জন্য একটু বিচলিত হয়ে পড়ে এই সুযোগে সৃজনী ছুটে পালায়। প্রতীকরা কি ভেবে আর পিছু নিল না সৃজনীর।

                কলেজের ক্লাসগুলোর একটাতেও মন দিতে পারে না সৃজনী । ক্লাস শেষ হতে কল্যাণের সাথে দেখা করতে যায় গঙ্গার ঘাটে। কল্যাণকে সব কথা বলতে, কল্যাণ বলে- “তুমি ঠিক করো নি সৃজা। ওরা অনেক পাওয়ারফুল লোক। এইভাবে ওদের সাথে ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হল না সৃজা।”

   – ছিঃ কল্যাণ, তুমি একথা বলছ! তাহলে আমি কি করতাম নিজকে ওদের হাতে সমর্পণ করতাম?

   – না না আমি ঠিক তা বলতে চাইনি।

   -দেখ কল্যাণ তুমি তো বলেছিলে তোমার বাবা মাকে তুমি আমার কথা বলেছ। এবার তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাবস্থা কর। আমার মনে হয় এটাই এই সমস্যার সমাধান।

    -একদম চিন্তা করো না সৃজা।  আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি। কালই তোমার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলব বাবা-মাকে । বিয়ের কথা কালই পাকা করে আসুক ওরা।

               মনের ভারী ভাবটা একটু হাল্কা লাগছে সৃজনীর। যাক বিয়ের কথা যদি কালই হয়ে যায় তবে আর প্রতীক নিশ্চয়ই জ্বালাবে না । সারা রাস্তা সৃজনী স্বপ্ন বুনতে থাকে ওর বিয়ের। ভাবনা চিন্তার মাঝেই সৃজনী পৌঁছে যায় গ্রামের সরু রাস্তার ধারে। আচমকাই কতগুলো বাইক এসে পড়েছে। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় আর হেলমেটের জন্য ঠিক করে মুখ দেখা যাচ্ছে না কারও। হঠাৎই একটা বাইক আরোহী দ্রুত বেগে চলে যাওয়ার আগে একটা বোতল ছুঁড়ে মারল সৃজনীর মুখ লক্ষ্য করে।

                 আজ তিন দিন বাদে নার্সিংহোমের বিছানায় চোখ মেলে তাকালো সৃজনী। সেদিনের প্রচন্ড জ্বালার স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে পড়ছে না তার। সেদিন সৃজনীর মনে হয়েছিল কেউ একদলা আগুন ছুঁড়ে দিয়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল। চোখ খুলে দেখতে পেল সৃজনীর অসহায় বাবা মায়ের মুখ । আরও জানতে পারল কেউ বা কারা তার মুখের উপর অ্যাসিড ফেলে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ভগবানের অশেষ করুনা যে সৃজনীর চোখ দুটো কিছু হয় নি। ঠোঁটের উপর থেকে গলার কিছুটা অংশ ঝলসে গেছে।

              আজ প্রায় একমাস পর বাড়ি ফিরছে সৃজনী। এখনও ওষুধ চলছে। বাড়ি এসে দেখল বাবা মা বাড়ির সব আয়নাগুলো সরিয়ে দিয়েছে। কারণটা সৃজনীর অজানা নয়। প্রথম বার নিজের ঝলসে যাওয়া চেহারাটা দেখে নিজেই চিৎকার করে ওঠে সৃজনী। এই একমাস সাক্ষী হয়ে আছে সৃজনীর এমন অনেক লড়াইয়ের। অবশ্য লড়াইয়ে সৃজনীর পাশে সব সময় তার বাবা মা ছিল। কিন্ত আরও একজনকে আশা করেছিল সৃজনী । কল্যাণকে,  না তাকে দয়া করে বিয়ে করার জন্য নয় কেবল পরিচিতির খাতিরেই একবার দেখা করবে আশা করেছিল সৃজনী। কিন্ত কল্যাণ বোধহয় ভয় পেয়েছে, ভেবেছে দেখা করতে গেলে যদি সৃজনীর মতো আধ পোড়া মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়! তাই বোধহয় আর সাহস হয় নি তার সৃজনীকে নার্সিংহোমে দেখতে যাওয়ার।

               ক্রমে দিনগুলো পার হতে থাকে । লড়াইটাও কঠিন হতে হতে একপ্রকার গা-সওয়া হয়ে গেছে সৃজনীর। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। লোকের চোখে নিজেকে কুৎসিত করে দেখার লড়াই। আইনের কাছে নিজের হার মেনে নেওয়ার লড়াই। পুলিশ এসে বেশ কয়েকবার জেরা করে গেছিল সৃজনীকে। নার্সিংহোমে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না সৃজনীর তাই বাড়িতেই জিজ্ঞেসবাদ করে পুলিশ। সৃজনী জানায় তার সন্দেহের কথা। বলে , প্রতীক আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের ওকে বিরক্ত করার কথা। পুলিশ ‘দেখছি দেখছি’ করে কাটিয়ে দিল বেশ কিছুদিন। তারপর বলে, প্রতীকদের বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব তাই তাকে কেবল জিজ্ঞেসবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেইদিন নাকি প্রতীক এই গ্রামেই ছিল না। সৃজনী এখন রাস্তায় বেরলে মুখ ঢেকে বেরোয়। যেন নিজেকে আড়াল করতে চায় সবার থেকে।

            এইসব ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় ছমাস। সবার সবটা কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। সৃজনীর ঐ পোড়া মুখ দেখে গ্রামের লোক আর তেমন আতঙ্কিত হয় না। লোকের ঠুনকো সহানুভূতিগুলোও কেমন যেন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামে বেশ উৎসবের হাওয়া পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলের বিয়ে বলে কথা যে! প্রতীকের সাথে সৃজনীর বাল্য বন্ধু তমশার বিয়ে হচ্ছে। কথাটা শোনার পর সৃজনীর বাবা মা সৃজনীকে তার মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে চায় না তারা।

              পরবর্তী ঘটনাটা যেন ঘটে গেল আকস্মাৎ। বিয়ের আগের দিন প্রতীক সন্ধ্যার পর বাইক নিয়ে বেরোয় নিজস্ব কিছু কাজে। কিন্ত সেই সরু গলির মুখটাতে আসতেই মুখের উপর বোতল বন্দি আগুন এসে পড়ল। অ্যাসিড। ঝলসে যাওয়ার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায় প্রতীক। সবাই তাকে নিয়ে ছুটল নার্সিংহোমে। চোখ দুটোই বোধহয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

           সৃজনীর মা বাইরে ছিলেন, খবরটা শুনে ঘর আসে সৃজনীর বাবাকে খবরটা দিতে। কিন্ত এসে তাকে পায় না। হয়তো বাজারে গেছে। কিন্ত ঘরে পেল সৃজনীকে। তার হাতের কিছু কিছু জায়গা পুড়েছে । তাতেই মলম লাগাচ্ছিল সে। সৃজনীর মায়ের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। এসে দরজাটা বন্ধ করে মেয়েকে চেপে ধরে।

-কেন, কেন সৃজা এসব করতে গেলি? কি পেলি? এখন যদি পুলিশ এসে ঝামেলা করে? তখন আমারা কি বলব? তাছাড়াও তমশা তোর ছোট বেলার বন্ধু,  তার কথাটাও একবার ভাবলি না রে? আইন নিজের হাতে নেওয়াটা যে ঠিক নয় রে মা।

     সৃজনী তার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ঠোঁটটা শক্ত করে চেপে নিল একবার তারপর বলে- “হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বুঝেছ, আমিই প্রতীকের মুখটা অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি। ওদের মতো বাবার ক্ষমতায় বলীয়ান জানোয়ারগুলো আইনের ফাঁক গলে ঠিক বেরিয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই এই কাজ করলাম। তবে কি জানতো মা এদিকে ভালোই হয়েছে পুলিশ ওকে সাজা দেয়নি। ওর কি আর শাস্তি হতো বল? জেল হেফাজত! কিন্ত তাতে ও বুঝতো না আমার জ্বালাটা, আমার সেদিনের পুড়ে যাওয়ার মর্মটা। কিন্ত আজ ও বুঝেছে। মা এই জ্বালা বড় বেদনা দেয়। শরীরের পুড়ে ঝলসে যাওয়া অংশগুলো হয়তো ডাক্তারের চিকিৎসায় ক্রমে সেরে ওঠে কিন্ত মনটা জ্বলতে থাকে জ্বলতেই থাকে। এই সমাজ মনের আগুনটাকে কিছুতেই নিভতে দেয় না। তবে আজ অনেকদিন পর আমার মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনে একটু হলেও জল পরেছে। আর হ্যাঁ মা, কি বলছিলে তমশার কথা ভাবতে? মা, আমি ওকে বাঁচিয়ে দিলাম গো । ঐ রকম একটা জানোয়ারের হাতে সারা জীবন বাঁধা পড়ার থেকে।”

    -সব বুঝলাম, কিন্ত পুলিশ! কি বলব পুলিশ কে?
– কেন মা , তোমরা তো আমাকে গ্রামের কত লোকের মাঝখান দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে মাসির বাড়ি রেখে এসেছ ! আমি তো ওখানেই ছিলাম। তাই না? যেমন সেদিন প্রতীক বাড়ি ছিল না। আর পুলিশ অবিশ্বাস করলে গ্রামের লোকেরা বলবে তারা আমাকে মাসির বাড়ি যেতে দেখেছে কিনা? এখন আমি আসি মা। তবে এবার ফিরে এসে আবার নতুন করে জীবনটা সাজানোর চেষ্টা করব। আর তার শুরু করব আমার পড়াশোনা দিয়ে। আবার আমি কলেজে যাব। জানি লোকের চোখ, লোকের মুখ অনেক কিছু দেখবে, বলবে। কিন্ত আজ আর তাতে আমার খুব একটা কিছু যায় আসে না। আমি বাঁচাব আমার মতো, আমার শর্তে।

Exit mobile version