Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (২১)

জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

 

[একচল্লিশ]

একাশি শতাংশ নম্বর নিয়ে হায়ারসেকেন্ডারী পাশ করল সনাতন। ইচ্ছা ছিল বিপ্লবদার মত কলেজের পড়া শেষ করে এম.এ.করবে। ইংরেজী অনার্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করতো। বিরানব্বুই নম্বর পেয়েছে ইংরেজীতে। ডায়মন্ড হারবার কলেজে সহজেই চান্স পেতে পারে। কিন্তু এই এগিয়ে যাবার ভাবনাকে পিছু টেনে ধরল তার অভাবী সংসার। বাবার হার্টের ব্যামো ধরা পড়ল। বাবার যাবতীয় শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ। কড়া দাওয়াই ডাক্তারের, “বাবাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তো গতরে খাটা কাজ বন্ধ করতে হবে। টুকটাক চলাফেরা বা বসে থাকা কাজ করা যেতে পারে।” সেইমত বাজারের জুতো-ব্যাগ সারাইয়ের ফুটের দোকানে দু’বেলা কোনোমতে গিয়ে বসে। বসলে কি হবে আগের মত চটপটিয়ে গোছানো কাজ করতে পারে না। সেইজন্যে খদ্দেরও আস্তে আস্তে অন্য দোকানে চলে যেতে থাকে। দোকান থেকে আয়ে বাবার হাত খরচাটা হয়তো কোন রকমে চলে যায়। কিন্তু সংসার? সংসার তাদের চলবে কেমন করে? প্রশ্নটা এসে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল সনাতনের ঘাড়ে! ঘাড় থেকে এই ভারি পাথর সরিয়ে তার আর কলেজে পড়ার স্বপ্ন বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারল না।
সনাতন ঠিক করল প্রাইভেট টিউশনির ব্যাচ বাড়িয়ে দেবে। তাদের জাত কারবার চামড়া বা বেতের কাজে কোনদিন তেমনভাবে রপ্ত করা তার হয়ে ওঠেনি। আসলে ওগুলোতে ওর মন টানতো না। বাবাও সে জন্যে তার উপর কোনদিন জোর খাটায়নি। বাবা মায়ের কাছে বলতো, “ছেলে যে কাজ করলে খুশি হবে সেই কাজ সে করুক। তারা রুইদাস বলে রুইদাসদের জাত কারবারে ঢুকতে হবে তার কোন মানে নেই।” তাই চাপ না থাকায় এই কাজে সে মাথা গলায়নি। অবশ্য ঢাক বাজানোর কাজটা সে ভাল করে রপ্ত করতে পেরেছিল। এখনো ওটার প্রতি তার অনিহা জন্মায়নি। ভগবানের প্রতি নিবেদিত এই বাজনার সুর-তাল-লয়। একে অবজ্ঞা করা তার সধ্যের বাইরে। তবে বাবা সঙ্গে না থাকলে সে কেমন করে রোজগারের জন্যে ঢাক হাতে নেবে! ঢাকের সঙ্গী যদি তার বাবা, রতন রুইদাস হয় তো তার ইচ্ছাশক্তি তখন প্রবল হয়ে যায়। আর এই বাজনার কাজ তো সম্বচ্ছর হয় না। মরসুমী পেশা এটা। এখন সর্বক্ষণের রোজগারের পথ একমাত্র তার সামনে খোলা রইল এই টিউশনি।
মেয়েদের ব্যাচটাকে কোনো ডিস্টার্ব করতে চায় না সে। তবে সকালে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে আর একটা ব্যাচ বাড়ায়। ঠিক করল যদি ছাত্রছাত্রী বাড়ে তো সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত আরও দুটো ব্যাচ খুলে দেবে। তবে সন্ধ্যের ব্যাচ দুটোতে কোন মেয়েকে সে পড়াবে না। মেয়েদের রাতের অন্ধকারে আসা যাওয়া করার ঝুঁকি সে নিতে পারবে না। ঠিকও হবে না। অমঙ্গল কখনো বলে আসে না। সুযোগ বুঝে শিকারের উপর হামলে পড়ে। পাড়া গাঁয়ে যেমন গাছপালা-প্রকৃতির দাপটে এবং বিজলি আলোর অভাবে কালো-অন্ধকারের আধিক্য বেশি। তেমনি কালো-মনের মানুষেরও অভাব নেই। সংসারের চাকা গড়াতে গেলে এ ছাড়া তার সামনে আর বিকল্প কিছু রইল না বলেই এই সিদ্ধান্ত।
বাবার অসুস্থতার কথা জেনে মেয়েদের ব্যাচের এক ছাত্রী, সুলতা বলে, “স্যার ডায়মন্ড হারবারে একজন বড় ডাক্তার আছে, আমার বাবার বন্ধু। বাবাকে বলবো, ওই ডাক্তার জ্যেঠুকে দেখাবার ব্যবস্থা করার জন্যে? বাবা বলে দিলে পয়সা লাগবে না। মনে হয় ওনার চিকিৎসায় আপনার বাবা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার বাবার অসুখের জন্যে আপনার মন খারাপ। তার জন্যে আমাদেরও মন কেমন করে।” মেয়েরা এমনিতেই স্পর্শকাতর হয়। তাই বলে তার মাস্টামশাইয়ের বাবার জন্যে তাদের মন কেমন করছে জেনে মনের মধ্যে এক গভীর তৃপ্তি বোধ কাজ করে যায়। সুলতার এই প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে শান্তচিত্তে সনাতন বলল, “আমাদের কুঞ্জ ডাক্তারবাবু দেখছেন। রোগ ধরতে পেরেছেন। সেইভাবে চিকিৎসা চলছে। বাবা এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছে। তুমি তোমার বাবাকে বলে রেখো, যদি প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই আমরা তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।” সনাতন মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলতে খুশি হয়। বলে, “ঠিক আছে স্যার। আগে থেকে আমি বাবাকে বলে রাখবো’খন।”
পরদিন পড়ানোর দিন ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখহাত ধুয়ে ঘরের দাবায় বসে সনাতন মায়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে। সেই সময় হঠাৎ সুন্দরী দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির, কোনকিছুর ভূমিকা না করে একটা সাদা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে সনাতনের মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “জ্যেঠিমা, এতে অশ্বগন্ধা গাছের শেকড় আছে। মা বলেছে, খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিতে। তাহলে জ্যেঠা তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে। রোজ খাওয়াবে কিন্তু জ্যেঠিমা। একদম ভুল যেন না হয়। তোমাদের খল-নোড়া নেই না? ঠিক আছে, আমাদের বাড়িতে একস্ট্রা একটা পড়ে আছে। মা’কে বলে নিয়ে আসি গে। চলি।” বলে পিঠটান দেবার সময় সনাতন ডাকে, “সুন্দরী শোন। দাঁড়া দু’দন্ড! অত ছটফট করছিস কেন? তুই জানলি কেমন করে যে এতে বাবা সেরে উঠবে?”
স্যার একথা বলা মাত্র শক্ত ডাঙ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুন্দরী। তারপর মাথা নীচু করে তার স্বভাববিরুদ্ধ ঢঙে, শান্তভাবে বলল, “মা’কে বললাম, স্যারের বাবার হার্টের প্রবলেম হয়েছে। কোন ওষুধ তোমার জানা আছে মা? দাও না, দিয়ে আসি। স্যারের মুখ দেখে মনে হ’ল, স্যারের মনটা খুব খারাপ। মা তখন এটা দিল। আমাদের শরীর খারাপ হলে মা এইসব গাছগাছড়া, শেকড়-বাকড়ের ওষুধ দেয়। অসুখ সেরেও যায়। মা এসব জানে। তাই মাকে বললাম, মা দিয়ে দিল।” বলে আবার সনাতনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “জ্যেঠিমা, আমি আসছি। যেমন বললাম সেইভাবে জ্যেঠাকে খাইয়ে দিও কিন্তু।” আবার সেই ছটফট করে ওঠে, চলে যাবার জন্যে। সনাতন ফিরে তাকে ডাকে, “চলে যাচ্ছিস যে সুন্দরী? আমার কথা তো শেষ হয়নি। তুই কি খুব ব্যস্ত আছিস? পড়াশোনা করছিস নিশ্চয়ই? তাই এত ব্যস্ততা তোর? নাকি এমনি এমনি এখান থেকে পালাতে চাইছিস? সে তো তুই যাবি। থাকার জন্যে তো আসিসনি জানি।” একটু থেমে আবার সুন্দরীকে ঠাট্টা করে রাগিয়ে দেবার জন্যে বলল, “তা তুই শুধুমুধু পড়া ক্ষতি করে ছুটে এখানে আসতে গেলি কেন? বললে তো আমি বা মা তোর মায়ের কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে আসতে পারতাম। ওঁ-হুঁ। আমার মনে হয় শুধু ওষুধ দিতে তুই আসিসনি। ওষুধ দিতে আসার ছুতোয় আমার মায়ের সঙ্গে দেখাও করতে এসেছিস। কি, তাই কি না বল, সুন্দরী? চুপ করে থাকিস না, বল আমি ভুল বললাম কি না?”
“আমি জানি না যাও…” বলে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে দাবা থেকে নেমে উঠোন ফুঁড়ে দৌড়ে পালালো, সুন্দরী !
সনাতনের কথায় মেয়েটা যে লজ্জা পেয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে মা বলল, “কেন মিছিমিছি মেয়েটার পেছনে লাগতে গেলি? সে কোথায় তোদের উপকার করতে এল। বাহবা দিবি তাকে। না, উল্টে ক্ষেপিয়ে দিলি। এবার দেখবি পড়ার সময় বাদে অন্য সময় তুই বাড়ি থাকলে ও আর এ’মুখো হবে না। বড়ই ছটফটে হাসিখুশি মেয়ে। ওর মনটা কত সরল একবার ভেবে দেখ। তোর আরও ছাত্রী আছে। সুন্দরীর মত তো মনের হয় কেউ না। দেখতেও কেমন মিষ্টি মিষ্টি। আর কোনদিন ওকে ক্ষেপাবি না বলে দিলাম।”
সুন্দরীর কথা মত রোজ সকালে অশ্বগন্ধা শেকড় খলে বেটে এক চামচ করে খাওয়ায় সনাতনের মা। খল-নোড়াটা পরদিন সনাতনের মা নিজেই সুন্দরীর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছে, বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। মায়ের সাথে যখন স্যারের মা কথা বলছে, সেইসময় সুন্দরী এসে বলে, “জেঠিমা, আমি গেছিলাম খলটা নিয়ে। তোমাদের বাড়ি উঁকি মেরে দেখি তুমি নেই। স্যার বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। স্যার যদি দেখতে পায়, সেই ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আবার যদি দাঁড় করিয়ে কিসব প্রশ্ন করে? তাই।”
-তা স্যারের দেখে তোর ভয় কিসের। স্যার কি বাঘ-ভাল্লুক! কেন পড়ার সময় স্যার তোদের বকাঝকা করে বুঝি? সেইজন্যে ভয় পাস। কিন্তু তোদের স্যার তো শান্তশিষ্ট মানুষ। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সনাতনের মা বলল।
সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী বলল, “না না জ্যেঠিমা। স্যার পড়ানোর সময় একদম বকাঝকা করে না। খুব সুন্দর করে বোঝায় আমাদের। এত ভাল করে বোঝায় যে বাড়িতে এসে আর সেই বিষয়টা পড়ার দরকার হয় না। স্যারের মত মানুষ হয় না।”
-তাহলে স্যারের দেখে ভয় পাস কেন, সেটা বল?
-জানি না যাও। বলে সেখান থেকে পোঁও দৌড় দিল সুন্দরী ! সনাতনের মা, পুষ্প সুন্দরীর চপলতায় মনে মনে তৃপ্তি বোধ করে। ভাবে, মেয়েটাকে তাদের ঘরের বউ করলে মন্দ হয় না। মেয়েটার বুক ফাটে। মেয়ে হয়ে পুষ্প খুব ভাল করে তা বুঝতে পারে। তবু মুখে কাউকে বলার সাহস পায় না বেচারাটা। শরীরী ভাষায় তার ইঙ্গিত দিয়ে যায়, তার স্যারকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তার ছেলে বুঝেছে কিনা কে জানে। বুঝলে তো ভাল। মনের মত একটা বউমা তার ঘরে তুলতে পারে।
বিকেলে সনাতন বাবার সঙ্গে দোকানে আছে। সে দেখেছে, একটা লোক ভ্যান রিক্সায় করে ওই শাকপাতা, শেকড়-জরিবুটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। ও মনে মনে ঠিক করে, ওই লোকটাকে দেখতে পেলে ধরবে তাকে। কিন্তু ক’দিন হয়ে গেল শেকড়ওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাজারে সে আসছে না নিশ্চয়ই। তাহলে দেখা তো হতোই। হঠাৎ একদিন তাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে কিছু না বলে উঠে গিয়ে লোকটাকে ধরে, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বলবেন আমাকে। ভীষণ প্রয়োজন আমার।” লোকটা বলল, বলুন না কি দরকার। আমার জানা থাকলে বলবো না কেন? আমাদের চারপাশে প্রকৃতির মধ্যেই কত ওষধী গুণ লুকিয়ে রয়েছে। আমরা যদি তাকে কাজে লাগাই তো ওই হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিলাসী চিকিৎসা ব্যবস্থার ফাঁদে পড়তে হয় না। শেকড়-বাকড়, গাছপালার উপকারিতা মানুষকে জানানোর জন্যেই তো আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আপনি দ্বিধা না করে বলতে পারেন।” লোকটার কথায় উদ্দীপিত হয়ে সনাতন বলল,“আপনি একটু বলবেন, অশ্বগন্ধা গাছের শিকড় মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কতটা কাজ করে? আমার বাবার হার্টের সমস্যা হয়েছে। এ্যালোপ্যাথি ডাক্তার দেখেছেন। এখন একটু নিয়ন্ত্রণে আছে। সে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের এক পরিচিত মানুষ বাবাকে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খলে বেটে রোজ সকালে খালি পেটে এক চামচ করে খেতে বলেছে। ওটা কি খাওয়া যেতে পারে? এ’ব্যাপারে আমরা তো অনভিজ্ঞ। যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি। আপনি তো এই নিয়ে সবসময় কাজ করছেন। সেইজন্যে ক’দিন ভ’র আপনাকে খুঁজছিলাম। আজকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলাম।” সনাতনের কথায় উৎসাহিত হয়ে লোকটা বলল,“যিনি এটা খেতে দিয়েছেন তিনি একদম নবিশ মানুষ নন। যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন শক্ত অসুখে সাহস করে এই অশ্বগন্ধার শেকড় খেতে দিতে পারতেন না। একদম ঠিক ঠিক ওষুধ চেলেছেন তিনি। একটা তথ্য আপনাকে দিচ্ছি, প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা ও কমলা-লাল রঙের ফল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশেষত জীবনীশক্তি, ধৈর্য, দৃঢ়তা, আয়ুবৃদ্ধি, হৃদয়ঘটিত সমস্যার নিরাময়ের জন্যে এই অশ্বগন্ধা গাছকে ব্যবহার করার কথা বলা হয়ে আসছে। এমনকি বর্তমানে ভারত সহ বিশ্বের কিছু দেশে এই অশ্বগন্ধা গাছের শিকড়, পাতা, বীজ এমনকি ফল বিভিন্ন ওষুধের সক্রিয় উপাদান রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের কাজে লাগছে। তাই বলছি, এর গুণের অন্ত নেই। আপনি নিশ্চিন্তে এটা আপনার বাবাকে খাইয়ে যেতে পারেন।” লোকটার কথা শুনে সনাতন একাধারে যেমন অবাক হয়ে গেল, সুন্দরীর মায়ের যোগ্যতা দেখে তেমনি এটা খাওয়ানোর জন্যে মনে মনে যে উদ্বেগ ছিল তা নিরসন হল। ভাবলো এমন একজন গুণী মানুষ নীরবে তার চিকিৎসার কাজ করে চলেছে, অথচ কেউ তা জানে না। এতদিন যদি সেটা জানা যেত তো অসুখবিসুখে ওই মহিলার হাত ধরে তাদের মত গরিব সমাজ কত না উপকৃত হত।
নিত্যদিনের মত ভোরে উঠে পুষ্প তাদের মাটির ঘরের দাবা, দাবার সঙ্গে কানাচে গোবর মাটি দিয়ে নেতা দিতে শুরু করে। হঠাৎ বিষ্ময়ের সঙ্গে সে লক্ষ্য করে দাবার কোনায় দেয়ালে রোজকারের মত আড় করে ঠেকনা দিয়ে রাখা তাদের বাটনা বাটা শীল-নোড়া দুটো দেয়াল থেকে সরে এসে সিধে হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন ওগুলো খুব সন্তর্পনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে! কিছুক্ষণ সেদিকে ঠায় তাকিয়ে আছে পুষ্প! মনে হল, আবার সামান্য একটু এগিয়ে এল! এবার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। চেঁচিয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল, “ও সনাতন, ওঠ ওঠ বাবা। এখানে কি কান্ডটা হচ্ছে দেখবি আয় বাবা! ও সনাতন উঠলি? দেখবি আয় না রে বাবা, শীল-নোড়া কেমন দাবায় হাঁটাহাঁটি করছে!” এত ডাকাডাকিতেও ছেলেটা ঘুমে কাদা। ওর বাপও তাই! কি ব্যাপার বুঝতে পারছে না পুষ্প! সনাতনের বাবাকে জোর করে ডাকছে না, লোকটার বুকের ব্যামো বলে। হঠাৎ চমকে ওঠা এই ব্যামোর পক্ষে ক্ষতিকর তাই। ডাক্তার বলেছে- চমকানো, ধমকানো, চেঁচামেচি এই
রোগের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। সেদিক থেকে সাবধান থাকতে বলেছে। অগত্যা পুষ্প পাশের বাড়ির লোকজনকে বলে। দৌড়ে যায় সুন্দরীর মায়ের কাছে, এই অবাক করা কান্ডর কথা জানাতে।
এবার একে একে লোকমুখে পাড়াময় হয়ে যায়। সুন্দরী, তার মা-বাবাও ছুটে আসে সনাতনদের বাড়ি। দেখে, সত্যি সত্যি বারান্দায় শীল-নোড়া দেয়াল থেকে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পেছনে কোন ঠেকনা দেওয়া নেই! পাড়ার মানুষরা এবার উজিয়ে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অবিশ্বাস্য এই সংবাদটা পাড়ার গন্ডি টপকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর হয়ে যায়। নামতে থাকে মানুষের ঢল ! উপচে পড়তে থাকে সনাতনদের বাড়ি, উঠোন, রাস্তাঘাট ! গিজগিজে হয়ে যায় লোকের ভিড়ে। সুন্দরীরা যখন আসে তখন সবে এক-দুই করে মানুষের জটলা শুরু হচ্ছে। অবস্থা দেখে সুন্দরী নিজেই তার সনাতন স্যারের শোবার ঘরে ঢুকে যায়। কোনকিছু না ভেবেই স্যারের পায়ের দিকে হাত ছুঁয়ে ঠেলা মারে। এক ঠেলাতেই ঘুম ছুটে যায় সনাতনের। এমন নরম মোলায়েম হাতের ছোঁয়া তো ও জীবনে অনুভব করেনি! হৃদয়ে কাঁপ ধরানো এই হাত কার! চোখ খুলতেই আর এক চমক তাকে গ্রাস করে। সুন্দরী! সে ডাকে কেন? মনে হল এই মায়াবী পরশ কেবল তার পা কেন তার সর্বাঙ্গ অনুভবে একাকার হওয়ার তো উপযুক্ত। সে সুখ ভাল করে আত্মস্থ করার ফুরসৎ কেড়ে নিল তার ঘরের বাইরের কোলাহল ! বিস্ময়মাখা দু’চোখ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “বাইরে কি হয়েছে, সুন্দরী? বাবার কি কোন কিছু?” সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী তার কথা থামিয়ে বলে, “না না স্যার। জ্যেঠু ঠিক আছে। তুমি ওঠ। বাইরে অন্য এক অঘটন ঘটে গেছে! দেখবে আসো। একদম দেরি করবে না।”
সুন্দরীর কথায় মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরের কান্ড দেখে যারপরনাই হতভম্ব সনাতন! একটা শীল-নোড়া দেয়ালে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। সেটা সোজা হয়ে গেছে, কোন ঠেকা না দিয়েও একই ভাবে আছে। এই দৃশ্য দেখতে এতো মানুষ! অলৌকিক ঘটনা বলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে! বলছে, ভগবান শিব আর মা দূর্গা জাগ্রত হয়ে তাদের বাড়ি অধিষ্ঠান করেছে। ওগুলো নাকি আবার খুব সুক্ষ্মভাবে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, মানে হাঁটছে! একটা অবিশ্বাস্য অবাস্তব ঘটনা কেমনভাবে মানুষের মনে ভগবায়ন হয়ে যায় ভেবে বিস্ময়ে বিমুঢ় সনাতন! কিন্তু এত মানুষের ভাবনার বিরুদ্ধে সে একা কেমন করে বিপরীত মত প্রকাশ করতে পারে! পারবে না। ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে এই হাজার হাজার মানবকন্ঠ ! শুধু হাতে কলমে পরীক্ষার জন্যে একটা কাস্তে নিয়ে এসে ওই শীল-নোড়ার একদম গা ঘেঁষে স্পষ্ট আঁক কেটে দিল সে। প্রমাণ করাতে চায় যে এই পাথর যুগলের চলন ক্ষমতা কোনদিন ছিল না, এখন নেই এবং ভবিষ্যতে থাকবেও না। কিন্তু সে যা ভাবলো, বাস্তবে ঘটল তার বিপরীত ঘটনা। মানুষ হই হই করে চেঁচিয়ে উঠল, কাস্তে দিয়ে তার ওই দাগ কাটার বিরুদ্ধে। কেন ছেলেটা পাকামো করে লোহা দিয়ে আঁক কাটতে গেল? এবার তো বাবা শিব রুষ্ট হয়ে প্রলয় কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে তাদের পাড়া-গাঁ। বাবা বটুকনাথকে ঠান্ডা না করতে পারলে ঘোর অমানিশা নেমে আসবে তাদের জীবনে। সেই ভাবনায় মানুষ একের পর এক ঘটি দিয়ে ওই শীল-নোড়ার মাথায় জল ঢালতে শুরু করে। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে বরফের টুকরো নিয়ে এসে তার মাথায় চড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সুন্দরী? তার কান্ড আবার চোখে পড়ার মত। সে সমানে সেই জল কাপড়ে ছুপে ছুপে বালতিতে ভরে বাইরে ফেলতে থাকে। না হলে যে বাড়িময় জলে চান হয়ে যাবে। ক্ষতি হয়ে যাবে তার স্যারেদের মাটির ঘরদোর। সনাতন দেখলো এই মেয়েটাকে না আটকালে তো সারাক্ষণ বরফজল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঠান্ডা লেগে অসুখে পড়ে যাবে! উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “আপনাদের হাতে পায়ে ধরে আমি আমার কৃতকর্মের জন্যে বাবা বটুকনাথ এবং মা গৌরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে মাথা খুঁড়ছি। সেইসঙ্গে আপনাদের কাছে করোজোড়ে আবেদন করছি আর এভাবে ঠাকুরের মাথা ঠান্ডা করার দাওয়াই হিসেবে জল-বরফ ঢালবেন না। আমার কাস্তে দিয়ে কাটা আঁক আমি মুছে দিচ্ছি ফুল, চালকলা দিয়ে।” এতক্ষণে সনাতনের আবেদনে কাজ হয়। শান্ত হয় জনতা।
প্রথম দিন তো জনতার ঢলে পাড়ার জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের আর দোষ কি। সনাতন পরখ করল মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে আর একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ কিভাবে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। প্রবল ভিড়ের প্রাবল্যকে কাজে লাগিয়ে সেই সন্ধানী দল বাঁশ-দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলল তাদের উঠোন, বারান্দা। এবার থেকে শিব-পার্বতীকে দেখতে গেলে টিকিট কাটতে হবে। পাঁচ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখার সুযোগ পাবে জাগ্রত শিব- দূর্গাকে। কৈলাশ থেকে স্বয়ং ভগবান শিব তাদের পৃথিবীতে এসেছে। এই পূণ্যতীর্থকে স্পর্শ করতে গেলে এই সামান্য দক্ষিণা তো মানুষকে দিতে হবে। না হলে ভগবানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে কেমন করে। অতিথি ভগবানকে যত্ন না করলে ভগবান রুষ্ট হয়ে এই স্থান ত্যাগ করবে। এটা নিশ্চয়ই কারোর কাম্য নয়। হুজুগে মানুষও এক বাক্যে এই যুক্তি মেনে নিয়ে টিকিট কেটে ভগবান দর্শন করে চলেছে। ভিড়ের লাগাম পরানো যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে সনাতনদের তো প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা লাটে উঠে গেল।
বাড়িতে রান্নাবান্না সব বন্ধ। সুন্দরী তাদের বাড়ি থেকে রান্না খাবার বয়ে নিয়ে দু’বেলা খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছে। মেয়েটা কেন যে তাদের জন্যে এতটা করে চলেছে কে জানে! তার সঙ্গে মেয়েটার সম্পর্ক তো শিক্ষক-ছাত্রীর। হঠাৎ যেন কোথা থেকে উল্কার মত ছুটে এসে জড়িয়ে পড়ল তাদের দৈনন্দিন জীবনচক্রের মধ্যে। এই কর্মকান্ড কি তাদের শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক থেকে উত্তরণ ঘটবার পূর্বাভাষ! ভেবে কুল পায় না সনাতন। যদি কোনভাবে সেই উত্তরণ ভবিতব্য হয় তো সনাতন তার বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
টানা তিনদিন এইভাবে মানুষের ঢল নামার পর আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে থাকে। সুবিধাবাদিদের আয়েও ভাটা পড়তে থাকে। এবার দূরদূরান্ত গ্রাম থেকে মানুষ আসছে। সেও অনেকটা হাল্কা হাল্কা। সনাতনরা সুযোগ খুঁজতে লাগল, কেমন করে মনুষ্য ভাবনার শিব-দূর্গা তাদের বাড়ি থেকে অন্য কোন জায়গায় নতুন ঠাকুরথান করে প্রতিষ্ঠা করা যায়। আটচালাকে বলেছিল, মা শীতলা মন্দিরের পশ্চিমের সরকারি জায়গায় শিব-দূর্গার মন্দিরটা যদি তৈরী করা যায়। খরচের অর্ধাংশটা যারা ঠাকুর দেখার টিকিট মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছে তাদের কাছ থেকে নেওয়া যায়। বাকিটা আটচালার তহবিল থেকে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে ওই আদায়কারিরা বেঁকে বসে। তারা সেই টাকা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। পাড়ার কোন উৎসবে আনন্দ করার জন্যে এটা খরচ করা হবে। নানান তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব ভেস্তে গেল। গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সনাতনরা। এগুলো এখান থেকে স্থানান্তর না করলে যে তারা স্বাধীনভাবে শান্তিতে নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারছে না।
অবশেষে এই সমস্যার একটা সমাধান সূত্র প্রস্তাবাকারে তাদের কাছে এল। দিঘিরপাড় বাজারের এক শিব ভক্তর মোড়ের বটগাছ তলায় খানিকটা জায়গা নিজের দখলে আছে। যদি রতন রুইদাস রাজি থাকে তাহলে ওই শিব- দুর্গা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে তার বিনিময়ে কোন টাকাপয়সা তারা রতনদের দিতে পারবে না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই। এমনিতেই এই মন্দির গড়তে তাদের কাছে যা টাকা আছে কুলোবে না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সাহায্য নিয়ে করতে হবে। দিঘড়ার নোদো হালদারের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেয়ে সনাতনরা যেন হালে পানি পায়। পত্রপাঠ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
অবশেষে নানান ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পর্ব সমাপন করার পর সনাতদের বাড়ি এতদিন পর দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়। দুপুরে বাড়ির সবাই মিলে ভাত খেতে খেতে সনাতন তার মা’কে বলল, “মা, তুমি যদি এইভাবে ভগবানকে না দেখতে পেতে তো জীবনে উপলব্ধি করতে পারতাম না মানুষকে কত সহজে একটা হুজুগের মধ্যে ফেলে বোকা বানানো যায়।” রতন এবং সনাতনের মা, পুষ্প ছেলের এই নাস্তিক ভাবনায় অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে! সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না সনাতনের। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে একটা খবরের কাগজ বার করে তার বাবা-মা’কে পড়ায়। সেই দিনের ভোরে তাদের এলাকায় একটা মৃদু ভূকম্প হয়। তারপর সনাতন বলে,“আমরা ঘুমের ঘোরে সেটা অনুভব করতে পারিনি। ওই ভূমি কম্পনেই আমাদের শীল- নোড়া দুটো সিধে হয়ে ওখানে নরম মাটির দাবায় থেবড়ে বসে যায়।” ভগবানের কৃপাকে অবজ্ঞা করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে মা, পুষ্প বলে, “এ তুই কি অলক্ষুণে কথা বলছিস খোকা! ছিঃ ছিঃ, অমন কথা দ্বিতীয়বার তোর কাছ থেকে যেন না শুনি! ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ এই কথাটা মানিস তো? যদি মেনে থাকিস তাহলে ভগবানকে অবিশ্বাস করিস না। আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর মঙ্গলময়। তিনি সকলের ভাল চান। অগতির গতি তিনি। তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া জীবের মুক্তি নেই রে খোকা। তাঁকে আরাধনা কর, তোর মঙ্গল হবে।”
সনাতন এক বলল, আর মা অন্য বুঝল। এখানেই বিশ্বাসের কাছে যুক্তি, বাস্তবতা কত অসহায়! তাই বলে সে মায়ের বিশ্বাসকে অসম্মান করতে চাইল না। কারোর ধারণাকে জোর করে পাল্টানো যায় না। যুক্তি দিয়ে বোঝালেও না। ভেতরের বোধ জাগ্রত হলে তবেই তা সম্ভব। তবে মা তাকে এইভাবে দুচ্ছা করার জন্যে মনে মনে সে আহত হয়। মা কোনদিন তাকে এইভাবে তিরস্কার করেনি। এখান থেকেই বোঝা যায় একটা ভাবনা, তা সঠিক বা বেঠিক হোক, সনাতনের কাছে মায়ের এই ভাবনা বেঠিকই। সেই ভাবনা কতটা গভীরে প্রোথিত হলে তবে নিজের আত্মজ, যে তার কাছে প্রাণাধিক বলে মনে করে,তাকেও হেলায় অবহেলা করতে পারে। অত সোজা না, এক লহমায় সেটাকে মনের ভেতর থেকে মুছে ফেলা। মা তখনও তার ওপর রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে সেখান থেকে। সে এখান থেকে চলে না গেলে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কাটবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে “সনাতন, সনাতন বাড়ি আছিস” বলে একজনের গলা শুনতে পায় সে। উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে, বিপ্লবদা! এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে সে অবাক হয়ে যায়। বিপ্লবদা হঠাৎ তাকে ডাকছে? মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বিপ্লবদার চোখ জবাফুলের মত লাল টকটকে। মুখটা ফোলা ফোলা। মনে হচ্ছে একটা বিশাল ঝড়ের থেকেও অধিক সাইক্লোন, তার জীবনের উপর আছড়ে পড়ে বেরিয়ে গেছে! সেই পরিস্থিতিতে একটা কথাই সনাতনের মুখ থেকে বার হতে পারলো,“বিপ্লবদা! তুমি! কি হয়েছে তোমার, বিপ্লবদা?”

[বিয়াল্লিশ]

অলোকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটা কেলো করে ছাড়ার জন্যে কোমর বাঁধছে অভয়-বরেণরা। ইদানিং অভয়-বরেণের সঙ্গে জোট বেঁধেছে নোচে, বিন্দে কেলেরা। নোচে-বিন্দে এই দলে ঢোকার মূল কারণ অখিল, সনাতনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনুষ্ঠানটা করছে বলে। সনাতনের উপর তাদের কোন রাগ নেই। কিন্তু ওদের প্রধান শত্রু অখিলকে ওরা এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অন্যতম সদস্য করার জন্যে বাধ্য হচ্ছে ঘুরিয়ে সনাতনদের বিরোধিতা করার। কেননা এর মধ্যে দিয়ে অখিল সুনাম কুড়িয়ে যাবে তা তারা হতে দেবে না। অভয়, বরেণের কাছে লোকমুখের খবর আছে, মাঝে মাঝে অলোকা, বেপাড়ার এবং বেজাতের ছেলে, বিপ্লবের সঙ্গে ডায়মন্ড হারবারে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। অলোকা তার সঙ্গে যেখানে সেখানে প্রেম করে বেড়ায়। এটা সময় থাকতে রুখে না দিলে মেয়েটা বেজাতের হাতে পড়ে যাবে। তাদের রুইদাসদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে বাইরের সমাজের কাছে। অথচ যেটা তাদের গর্ব, তারা স্বজাতের বাইরে কোন আত্মীয়তা করার প্রবল বিরোধী। দেখা যাচ্ছে হালে পাড়ার কয়েকটা তথাকথিত লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা তাদের গর্বের সমাজের মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে কসুর করছে না। এই অনাচার কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বরেণরা ওদের এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপনে রচনা করে চলেছে। এতসব কিছুই তাদের এই চার-পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে, অনুষ্ঠান চলাকালীন একমাত্র পরিকল্পনাটা প্রকাশ করা হবে। যদি আগে তা ফাঁস হয়ে যায় তো বিরোধীপক্ষ সচেতন হয়ে গিয়ে তাদের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে দিতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেমনভাবে যেন অভয়দের পরিকল্পনাটা পায়ে পায়ে বিপ্লবদের পাল পাড়ায় চাউর হয়ে যায়। বিপ্লবদের পাড়ার সাথে সাথে তার বাড়ির গার্জেনদেরও কানে চলে যায় অলোকার সঙ্গে বিপ্লবের মেলামেশার কথাটা!
বিপ্লবের বাবা, সমর পাল তখন বালী-মাটি আর এঁটেল মাটি মিশিয়ে তাতে পরিমাণ মত জল মিশিয়ে পা দিয়ে ধাসছে। ধেসে ধেসে একদম মাখনের মত মোলায়েম করে দিতে হবে এই মেশানো মাটি। মাটির অনুপাত কম বেশি হলে আবার কাজ হবে না। সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর আছে সমরের। এখানে একভাগ যদি বেলে মাটি দেওয়া হয় তো দু’ভাগ এঁটেল মাটি মেশালে তবেই এই মাটিকে বাগে এনে নিজের ইচ্ছেমত মাটির তৈজসপত্রের রূপদান করা যাবে। তৈরী হওয়া জিনিসটা তবেই শক্তপোক্ত এবং টেকসই হবে। বিশেষ করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, সরা, হাঁড়ি-কলসির ঢাকনা, খুরি, জল খাবার গ্লাস, তিজেল বানানোর জন্যে যত্ন করে মাটি তৈরী করতে হয়। এছাড়া নানারকমের মাটির খেলনা সহ আরও অনেককিছু মাটির জিনিস তৈরী করে এরা। এইভাবে মাটির ‘পাট’ করতে করতে ঘেমে একদম চান করে যাচ্ছে সমর পাল। তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আসলে এতেই ওরা অভ্যস্ত। এই নিয়েই এদের জীবন। এর বাইরে অন্য কোনকিছু ভাববার সময় ওদের কোথায়! এত কষ্টের মধ্যে এটাই সান্ত্বনা যে তার ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারছে। ইকনমিক্সে অনার্সে বি.এস.সি. তে ভাল মার্কস পাবার সুবাদে এম.এস.সি. তে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার এই কষ্টের তুষ্টি তো এখানেই। এত মেহনতের মধ্যে সন্তানের সাফল্য কখন যেন কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। খুশিতে মনটা ভরপুর হয়ে যায়। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পাঁচিলে ঘেরা বাড়ির প্রধান দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা ঢুকছে। এই এক পাগলা। আশপাশের সব বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার। দুপুরে খিদে পেলে যে কারোর বাড়ি ঢুকে যায়। লোকে খেতেও দেয়। কি আর করবে। বাড়িতে বুড়ি মা ছাড়া ওর কেউ নেই। মা এবাড়ি সেবাড়ি ফায়ফরমাস খেটে নিজের পেটের খিদে মিটিয়ে ছেলের জন্যে যা পারে জোগাড় করে রাখে ঘরে। যদি ভুল করে ঘরে চলে আসে তো সেটাই খাইয়ে দেয়। কখন বাড়িতে আসবে তার কোন ঠিক নেই। রুইদাস পাড়ার হেড়ো পাগলাকে আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মানুষ চেনে। তবে চুরিচামারির স্বভাব ওর নেই। তাই মানুষ বিশ্বাসও করে ওকে। কেউ কোন কাজ বললে সঙ্গে সঙ্গে কোন বাক্যব্যায় ছাড়াই সে সেটা করে দেয়। লোকও সন্তুষ্ট হয়ে তাকে খেতে দেয়। হেড়ো পাগলা ঢুকতেই সমর পাল বলল, “হেড়ো, এদিকে আয় তো? এই পাট-করা মাটি ‘চাকি’র কাছে নিয়ে যা তো। জামাটা খোল। আর লুঙ্গিটা ভাল করে এল্টে-পাক দিয়ে বেঁধে নে। নাহলে আবার কাদা জাবড়ে যাবে লুঙ্গিতে। এ’কটা বওয়া হয়ে গেলে ভাল করে কাদা হাতমুখ ধুয়ে চলে আসবি। এখানে খেয়ে যাবি। পালাবি না কিন্তু। তোর তো কোন বিশ্বাস নেই। হাত-পা ধুয়ে আবার অন্য কোথাও পালিয়ে গেলি! পাগলের খেয়াল।” ফ্যালফেলিয়ে হেসে হেড়ো বলে,“নাগো বাবু আজ খেয়েই যাব তোমাদের বাড়ি। শোনো না বাবু। একটা কথা কানে এসেছে তোমার ছেলে বিপ্লবদাদাকে নিয়ে। আমাদের পাড়ার ছেলেরা বলাবলি করছিল। আমি যেতেই তাড়িয়ে দেয় আমাকে। তবে যা শোনার তা শুনে নিয়েছি।” পাগলটার কথায় পাত্তা না দিয়ে সমর পাল বলল,“ওসব কথা এখন থাক। তুই বকর বকর করতে থাকলে থামবি না। আগে কাজটা সেরে খেয়েদেয়ে নে। তারপর তোর কথা শুনব।” বলে সমর আবার পা দিয়ে কাদামাটি দলতে থাকে। তৈরী মাটি হেড়ো পাগলা বয়ে চাকির পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে আর শেষের দিকে কিছু মাটি সমর পালের নির্দেশমত চাকির উপর পাটাতনে রাখে। সব বওয়া শেষ হলে হেড়ো বলে শেষের মাটিগুলো তোমার গাড়ির চাকার উপর রেখে দিয়েছি কাকা।” গাড়ির চাকা! সমর একটু অবাকমত হয়ে পরে বুঝতে পারে হেড়ো কোনটাকে গাড়ির চাকা বলছে। তারপর হেসে বলে, “ধুর পাগল, ওটা গাড়ির চাকা হতে যাবে কেন? ওটা গাড়ির চাকার মত দেখতে একটা চাকা। আগে ওটা কাঠের হত। এখন মেটালের হয়েছে। মাটিতে গর্ত করে বিশেষ কায়দায় ওটা বসাতে হবে। তার মাঝে একটা লোহার রড পোঁতা থাকে। তার মাথায় আবার চাকাটা বনবন করে ঘোরাবার জন্যে বিয়ারিং সেই রডে লাগানো থাকে। যে কাঠের পাটাতনে তুই কাদা রাখলি ওটা ওই চাকার উপর বসিয়ে ওই যে পাশে একটা বাঁশের লাঠি আছে ওটা দিয়ে ঘোরানো হয়। এরপর হাতের কায়দায় যে জিনিস বানাবার দরকার সেটা তৈরী হয়ে যাবে। সেটা হয়ে গেলে ওই যে পাশে বাঁশের পাতলা চেটো দেখতে পাচ্ছিস, ঘুরন্ত অবস্থায় কাদার ভেতর ওটা সেঁধিয়ে দিলে, তাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তৈরী হওয়া জিনিসটা। সে হাঁড়ি, কলসি, তিজেল, সরা যাই হোক না কেন। বুঝলি পাগল? এইভাবে মাটির জিনিস তৈরী করতে হয়। কম খাটনি এই কাজে? সেই তুলনায় পয়সা পাই না রে। এটাই আমাদের দুঃখ। তার উপর আজকাল স্টীল, এ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র বাজারে এসে আমাদের মালের চাহিদা তো একদম তলানিতে। বিক্রী নেই বললে চলে। ধুঁকছে কুমোরদের এই কারবার। সব পরিকাঠামো বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে আছে বলে এখনো টিম টিম করে চালিয়ে যাচ্ছি।”
“এত বকর বকর কার সঙ্গে করছো, বিপ্লবের বাপ?” বলে রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে দেখে হেড়ো পাগলা! অবাক হয়ে উঠোনে বেরিয়ে আসে বিপ্লবের মা সীতাদেবী। স্বামীকে বলে, “হ্যাঁগো, তুমি এই হেড়ো পাগলের সঙ্গে সেই তখন থেকে ফটর ফটর করছো? তোমাদের হাঁড়ি কলসি তৈরীর হাঁড়ির খবর বলার আর লোক পেলে না! তখন থেকে ভষ্মে ঘী ঢেলে চলেছো! বাব্বা, কেমন লোক গো তুমি। অন্য কোন সুস্থ মানুষকে বললে, সে মানুষটা বুঝতো আমাদের সুখ-দুঃখের কথা। ও গাল দিয়ে খাবার খাবে আর কান দিয়ে তোমার গপ্প বার করে দেবে। ওই পাগলের পেটে খাবার ছাড়া আর কোন কথা থাকে না কি? থেকেও বা লাভ কি। হেড়ো একটা মানুষ, সে আবার তোমার দুর্দশার সাক্ষী। নাও, অনেক হয়েছে। চানটান করে খেয়ে নও। এর পর চুলা জ্বালাতে হবে। তিন দিন ধরে রোদে শুকোচ্ছে কাঁচা মালগুলো। চুলার উপরের তাওয়াটা কাল দেখতে বলেছিলাম। সেটা দেখেছো? ফাটাফুটি নেই তো? মাটির অত মস্ত একটা তাওয়া। আগুনের তাপে কেটে গিয়ে থাকলে তার উপর এই মালগুলো চাপালে ভেঙে পড়ে যেতে পারে বা আগুন ফাটা দিয়ে বেরিয়ে মাল নষ্ট করে দিতে পারে। ইটভাটার মত মস্ত বড় চুলা। বাপ ঠাকুরদার আমলের জিনিস। তখন রমরমা কারবার ছিল, দরকার মত বানিয়েছিল তারা। এখন মালের টান নেই তো এতবড় চুলা করে লাভ কি। বলেছিলাম, ওটা ভেঙে অর্ধেক ছোট করে দাও। খামোখা এককাঁড়ি আগুন জ্বালাতে হয়। তাতে খরচাও বাড়ে। বড় বাফারা উঠোনে মস্ত একটা চুলা! লোক দেখে বাহবা দেবে, কত না বড় ব্যবসায়ী তুমি। কিন্তু এদিকে যে ঢপঢপে কলসি, সে এই সীতা ছাড়া আর কে জানবে। নাও, হয়েছে। এবার কাজগুলো সারো তো। আমাকে আবার খাইদাই সালটে আগের লটের পোড়ানো মালগুলোকে রঙ করতে বসতে হবে। আমার কাজ তো আর তোমরা করবে না। আমাকেই করতে হবে।” বলে সীতাদেবী গজগজ করতে করতে আবার রান্নাঘরে ব্যাস্ত হয়ে গেল।
এমনিতে কাজ-কারবারে চরম মন্দা। মনটা আজকাল ভাল থাকে না সমরের। তাই মনকে বোধ দেবার জন্যে যাকে সামনে পায় তার সামনে বকবক করে। শ্রোতা শুনলো বা বুঝলো কি না তাতে তার যায় আসে না। তার উপর বোয়ের এই ধমকানি মনকে আরও যেন দমিয়ে দেয়। হেড়োর সঙ্গে বকর বকর থামিয়ে হাতের কাজ সেরে গামছা নিয়ে পুকুরঘাটের দিকে ঝোঁক মারতে মারতে পেছন ফিরে হেড়োকে বলল,“কিরে, তুই চানে যাবি নাকি? যাবি তো আয়। পরিষ্কার হয়ে নে।” একথা বলতেই রান্না ঘর থেকে আবার সেই তীক্ষ্ণ নারী কন্ঠ, “ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি যাও তো, তোমার কাজ সেরে আসো। ও কি রোজ চান করার লোক! তাহলে গায়ে অত গন্ধ হয় না। বলারই বা কে আছে, এই কাজগুলো করার! কথায় বলে,‘পাগোলে কি না করে আর ছাগলে কি না খায়।” এবারও বোয়ের ঝাঁঝ একদম মেনে নিতে পারলো না, সমর। হেড়োকে চান করতে বলার কারণ, ও মাটি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। হাতে-পায়ে কাদা লেপটে আছে। শুধু হাত-পা, মুখ ধুলে ভাল পরিষ্কার হবে না। তাই চান করার কথা বলছিল। সমরের কথায় হেড়ো বলে, “নাগো কাকা, আমি চান করবুনি। চান করতে আমার ভাল্লাগেনে। তুমি যাও। আমি এই সামনের ঘাটে হাত-পা ধুয়ে আসি।”
খাওয়া-দাওয়া সেরে সীতাদেবী, চুলার উল্টোদিকে রং-ঘরের দিকে গেল। কিছু কালো রঙের ভাতের হাড়ির অর্ডার আছে। তারপর অন্য মালের চাকচিক্য আনার জন্যে বিভিন্ন রং করতে হয়। শৌখিন না হলে আবার খদ্দেরের চোখে আটকানো যায় না। দিনদিন সব রুচিও পাল্টাচ্ছে মানুষের। আগে বেশি বেশি অর্ডার থাকতো, তখন শুধু কালো মালেরই একচুলা মাল হত। সেসময় আর এখনকার মত কালো রংটা আলাদা করে লাগাতে হত না। চুলাকে কিছু সময় ঢেকে রাখলে যে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তাতেই মালের রং কালো হয়ে যেত বা দরকার হলে চুলার আগুনে খৈল পোড়ালে একদম মিশমিশে কালো রং হয়ে যেত। এতে তাদের তেমন কোন খরচই হত না। এখন সেই কালো রং হাতে বানাতে হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে কালো রং তৈরী করতে হয়। তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় মালের চাহিদা বা দাম তারা পাচ্ছে না। তাছাড়া আরও কিছু মাল আছে যেগুলো লাল, হলুদ আর সবুজ রঙের করতে হবে। সীতা, লাল রং বানাতে গিয়ে দেখে সিসা একদম তলানিতে পড়ে আছে। কয়েকটা মালে রং করলেই শেষ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বাবাকে হেঁকে বলল,“লাল রঙের জন্যে সিসা একদম ফুরিয়ে গেছে। পারলে আজ বিকেলে কিনে আনবে। তা না হলে কাল সকাল সকাল আনতে হবে। রঙের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে এটা না আনলে। মাল ডেলিভারীও দেওয়া যাবে না।” না, সবুজের জন্যে দস্তার কৌটোতে দস্তা আছে। আর আর্সেনিকের ডিবেতে কতটা আর্সেনিক আছে দেখে নিল। যা আর্সেনিক আছে তাতে হলুদ রং আরও কয়েকদিন করা যাবে।
একঘটি জল একটা মাটির ‘টাটি’ মানে ঢাকনা চাপা দিয়ে স্বামীর পাশে রেখে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেছিল সীতা। ভাত খাওয়ার পর জল খেয়ে একটা বিড়ি ধরাবে। তারপর ঘন্টা খানেক গড়িয়ে আবার কাজে লেগে যাবে। বিড়ি খাওয়াবে বলে হেড়োকে যেতে দেয়নি সমর। ভাত খেয়ে চলে যাচ্ছিল হেড়ো। সমর বলল, “দাঁড়া হেড়ো। একটু পরে যাবি। জল খেয়ে বিড়ি খাব। তাহলে ধোঁয়াটা পেটে সেঁটে যাবে না। পেটের ভেতর জলে ধাক্কা খেয়ে ও নিস্কর্মা হয়ে যাবে।” হেড়োর মুখে বিড়ির আগুন দিতে গিয়ে হঠাৎ সমরের মনে পড়ল, ও যেন ছেলের সম্বন্ধে তখন কি একটা বলছিল? ওকে থামিয়ে দিয়ে কাজে মন দিতে বলেছিল? মনে পড়েছে। কি কথা বলছিল জানতে হবে,“হ্যাঁরে হেড়ো, তখন বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি যেন তুই বলতে যাচ্ছিলিস? কি কথা এবার বল। শুনি। তোদের পাড়ার ছেলেরা বিপ্লবদাদাকে নিয়ে কি আলোচনা করছিল? একবার তো ওকে নিয়ে তোদের চ্যাংড়াগুলো কি না ঝামেলা পাকালো। আমরা রুখে দিতে থেমে গেল। আবার নতুন করে কোন ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে না কিরে?”
-হ্যাঁ গো কাকা। ওরা আবার বিপ্লবদাদা আর অলোকাদিদিকে নিয়ে অনেক কথা বলছে। বলছে এরা দু’জনে নাকি এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। ওদের পেছনে লোক লাগিয়েছে। হাতে নাতে ধরবে বলে। ধরতে পারলে আটচালায় বিচার বসিয়ে বিপ্লবদাদাকে জরিমানা করবে আর অলোকাদিদিকে গ্রাম ছাড়া করে দেবে। এই কথাটাই তো তোমাকে বলতে এসেছিলুম গো কাকা। নিজের কানে শুনে আর চুপ করে থাকতে পারিনি, তাই।” বলে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে,“চলি কাকা। আমি তোমাকে খবরটা দিয়েছি, সেকথা তুমি যেন কাউকে বোলো না। তাহলে আমাদের পাড়ার ওই অভয়, বরেনরা মারবে আমাকে।” হেড়ো পাগলা এক এক সময় এমন কথা বলবে, মনে হবে ও একদম ভাল মানুষ। লোকে যে ওকে পাগল বলে, পুরোপুরি বাজে কথা বলে। আবার যখন মাথায় ছিট চাপবে তখন পাগলের থেকেও হদ্দ। তাই ওর কথায় সহজে কেউ আমল দেয় না। কিন্তু এখন ও যে কথাগুলো বলে গেল, মনে হচ্ছে তো ঠিক কথাই বলছে। তার ছেলে আর রুইদাস পাড়ার ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ইতিমধ্যে তো বাজার গরম হয়েছে। এমনিতে কাজ কারবারে গতি নেই। তাই মন মেজাজ ঠিক নেই। তার উপর এই ছেলেকে নিয়ে আবার যদি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয় তো মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমরের। ছেলের প্রতি রাগ চড়চড় করে চড়তে থাকে। কাজ নেই কম্ম নেই বসে বসে খাচ্ছে আর ফপরদালালি করে বেড়াচ্ছে। লেখাপড়ার নাম করে বেলেল্লাপনা করে চলেছে। মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি করছে। বেজাতের মেয়েকে বে-মারাবে না কি? এবার আর রাগটা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারল না সমর। এ’দাবা থেকে রং-ঘরের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবের মা’কে হাঁক দিল, “এদিকে এসো তো একবার! ওসব কাজ-মাজ রাখো। গুলি মারো তোমার কাজে। সব ফেলে এক্ষুনি এদিকে এসো।” ছেলের বাপের গলার ঢঙ শুনে সীতা বুঝতে পারে লোকটা ভীষণ রেগে গেছে। হেড়ো ছিট-পাগল কি এমন কথা ওনার কানে ঢুকিয়ে গেল যে ওই ঠান্ডা মানুষটা এত রেগে গেল? ঠান্ডা মানুষরা এমনিতে সহজে রাগে না। কিন্তু একবার রেগে গেলে সামলানো দায় হয়ে যায়। এতদিন ধরে ঘর করে সীতা বুঝে গেছে মানুষটার ধাত-ধরণ। সময় নষ্ট না করে সব কাজ ফেলে রেখে ওদিক থেকে এদিকে চলে আসে। বলে,“কি হয়েছে কি? হেড়ো কি কথা বলে গেল? হঠাৎ রেগে গেলে কেন? মাথা ঠান্ডা রাখো। তারপর বলো। রাগ মাথায় ঠিক কথা বলা যায় না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা তো চোখে সর্ষেফুল দেখব!”
-আর কি হবে মাথা ঠান্ডা করে। তোমার গুনধর বেটা সেই কাজ করলে তো তবে মাথা ঠান্ডা থাকবে? ওই লেখাপড়ার নাম করে মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার শিক্ষিত বেটা। লোকে এবার ফাঁদে ফেলার জন্যে পেছনে লেগে পড়েছে। তাও আবার ওই ছোট জাতের মেয়েটার সঙ্গে। কতোবার তো তুমি বলেছো, রুইদাসপাড়ার ওই মেয়েটার সঙ্গে তুই একদম যোগাযোগ রাখবি না। সে কথা শুনেছে?” বলে, মস্ত এক ধমক দেয় সমর। হঠাৎ ধমকানিতে চমকে ওঠে সীতা ! সীতার মাথায়ও রাগ চেপে বসে, “তা তোমার ছেলে, বাবা মায়ের কথা না শুনে যদি বাইরের কোনো মেয়ের পেছনে ঘোরে তা ঘরে বসে আমি কি সেটা দেখতে যাচ্ছি? লেখাপড়ার নাম করে কতো জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনা করছে। ভাল ফলও করছে। তা সেই ছেলেকে আমরা কিভাবে আটকাবো। পায়ে বেড়ি পরিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখবো? মুখে বলা ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে?”
-আছে, আছে। অনেককিছু করার আছে। তুমি তাকে শেষ বারের মত সাবধান করে দাও। ওই ছোটজাতের মেয়েটার সঙ্গে মেলামেশা যেন ও আর না করে। আমাদের কুম্ভকারদের মুখ না পোড়ায়। তাহলে কিন্তু ছেলে বলে আমি ওকে ছেড়ে কথা বলবো না। বাড়ি থেকে দূর করে দেব। ত্যাজ্যপুত্র করে দেব আমি। শিক্ষিতর এই শিক্ষার দাম! নিজের জাতের সম্মান যে ছেলে রাখতে অক্ষম, তাকে আমিও ঘরে পুষতে অক্ষম। বলে দিচ্ছি তোমাকে, বউ। পরে আমাকে দোষের ভাগি করতে পারবে না কিন্তু। সে কোথায়? কোথায় তোমার গুণধর বেটা। কোথায় গেছে? চুপ করে আছো কেন, বলো, সে কোথায়?”
-আমতলায় গেছে কি সব বই কিনতে।
-তার নিজের জন্যে বই না ওই রুইদাস-মুচির মেয়েটার জন্যে? সে খোঁজ তুমি নিয়েছো? নাও নি তাই তো? অন্ধ ভালবাসায় ছেলেকে ছেড়ে রেখেছো। লাটাইটা পর্যন্ত নিজের হাতে রাখো নি। লাটাই যখন হাতে নেই সে ঘুঁড়ি তো খেয়ালখুশি মত নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবেই। এ তো জানা কথা। তা লাটসাহেবের বাচ্চা ফিরবেন কখন ঘরে? সেটা কি বলে গেছেন! নাকি তাও তোমার জানা নেই? বলতে বলতে রক্তজবা রং নেয় সমরের দু’চোখ।
-বললো তো ফিরতে একটু বেলা হবে। এসে খাবে। তারপর পঁচিলের দরজার দিকে তাকায়। দেখে বিপ্লব ঢুকছে। তখন সীতাদেবী বলল, “ওই তো আসছে।” বলে সঙ্গে সঙ্গে অজানা কোন আশঙ্কায় সাবধানী হয়ে সীতা আবার স্বামীকে বলল, “বাইরে থেকে আসছে। রোদে-তাপে ওরও মাথা গরম হয়ে আছে। এখন তুমি কিছু বোলো না। তারপর দু’জনেই নিজেদের ঠিক রাখতে না পেরে যুদ্ধ যেন লাগিয়ে দিও না ! ও চানটান করে খাওয়া দাওয়া সেরে মাথা ঠান্ডা করে বসলে, তখন বোলো।”
এতটা তার মাথা গরম হয়ে আছে যে বোয়ের কথায় পাত্তা দিল না সমর। বিপ্লব সদর দরজা পার হয়ে উঠোনে ঢুকতেই চেল্লে উঠে ছেলেকে বলে, “কোথায় গেছিলিস? ওই রুইদাস মেয়েটার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলিস? তোর মা যে বলল, তুই বই কিনতে গেছিস, আমতলায়। তা কই, তোর হাতে তো কোন বই নেই? কার জন্যে বই কিনতে গেছিলিস? ওই মুচি মেয়েটার জন্যে? সে তো শুনলুম মাস্টারির চাকরি পেয়েছে। তার আবার বই কি হবে ? মেয়ে মানুষের সঙ্গে ফুর্তি মারাতে গেছিলিস,তাই তো? উত্তর দিচ্ছিস না যে আমার কথার। যা বলছি তাহলে সব সত্যি বলছি আমি, লোকে তাহলে ফালতু বলে যায়নি?” সে যে অলোকার সঙ্গে মেলামেশা করে তা বাবা-মা’র কাছে আর গোপন করতে চায় না বিপ্লব। যা সত্যি তা বলে দেওয়াই ভাল। তাতে যা হাবার হবে। সেই ভাবনায় সে বলল, “হ্যাঁ, অলোকার জন্যে টিচার্স ট্রেনিংয়ের একটা বই আনতে গেছিলাম। নতুন চাকরি। এই বইটা কাজে লাগবে তাই। এর জন্যে এত চেঁচামেচির কি আছে বাবা? আমি তো অন্যায় কোন কাজ করিনি।” সীতা ছেলের এই কাজকে একদম পছন্দ করে না। সন্তানের প্রতি স্নেহের বশে কিছুতেই ওই বেজাতের মেয়েকে সে মেনে নেবে না। তবু এই পরিস্থিতিতে তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরে বাপ-ছেলেকে সামলাতে হবে। অবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে এবার দু’পক্ষের সুর চড়তে শুরু করবে। তার আগে এদের থামিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে অনিষ্ট কিছু ঘটে যেতে পারে। বাপের রক্ত তো ছেলের মধ্যে বইছে। শান্ত ছেলেটা বাপের মত ক্ষেপে যদি যায় তো তাকেও সামলানো দায় হয়ে যাবে। সীতা তাড়াতাড়ি গিয়ে বিপ্লবের ডান হাতটা তার বাঁ-বগলে চেপে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, “যা, এখন আর কথায় কথা বাড়াতে হবে না। তুই আগে চান খাওয়া করে নে। তারপর যা কথা বলার বলবি।” আর স্বামীর দিকে তাকিলে বলে, “তুমি কি এখন থামবে? না, শুধু চেল্লাতেই থাকবে? তুমি তো পেট মোটা করে নিয়েছো। যে খায়নি তাকে তো খেতে দিতে হবে না কি?”
বোয়ের কথায় পাত্তাই দিল না সমর। আবার চেঁচিয়ে ছেলের কথার পিঠে কথা চড়ালো,“অন্যায় তুই করিসনি মানে? জন্ম তোর কুমোরের ঘরে। জন্মসূত্রে জাতে তুই ‘কুম্ভকার’। নিজের জাতকুল জলাঞ্জলী দিয়ে একটা ছোট জাতের মেয়ের সঙ্গে লটরফটর করছিস। আবার নিজের হয়ে ‘সাওটা’ গাইছিস? তুই কি ভেবে রেখেছিস ওই ছোটলোক মেয়েটার মাস্টারির পয়সার লোভে বিয়ে মারিয়ে সেই পয়সা আমার ঘরে তুলবি? সে গুড়ে বালি। ছিঃ ছিঃ আমার বেটা হয়ে এই কাজ করতে তোর এতটুকু লজ্জাবোধ হল না! লেখাপড়ার ভেতর যে এত বেলেল্লাপনা লুকিয়ে আছে তা যদি জানতুম তাহলে কোনদিন তোকে পড়াশোনা করাতে পাঠাতাম ভেবেছিস? ওই কুমোর-চাকি ঘোরানোর কাজেই লাগিয়ে দিতাম। কাল থেকে ব্যবসার কাজে লেগে পড়বি। বাড়িতে হুদমো একটা বেটা থাকতে আমি বুড়ো বাপ কেন এত খাটতে যাব। খেটে পয়সা রোজগার করব আর তুমি লাটসাহেব, সেই পয়সায় বেজাতীয় প্রেম মারিয়ে বেড়াবে! তা আর হবে না। তোকে আর এম.এ. পড়া করতে হবে না। আমি আর খরচা জোগাতে পারব না। ঢের হয়েছে। এবার বাপ পিতেমহের জাত
কারবার তোকেই দেখতে হবে। একবারও তো খোঁজ খবর নিস না যে, কারবার কেমন চলছে না চলছে। চিন্তাও হয় না। বাড়ির অবস্থা দেখেও মনে প্রশ্ন জাগে না যে, আগে বাড়ির উঠোনে এতো এতো মাল ঢাঁই হয়ে থাকতো। এখন তার অর্ধেকও থাকে না। মনেও ভাবনা আসে না যে, বাবার কারবারটা কি তাহলে লোকসানে যাচ্ছে? শুধু চুপি চুপি মাকে পটিয়ে টাকা হাতিয়ে মেয়ে নিয়ে ফুসুর ফুসুর করে বেড়ানো! তোর এই অপকর্মের জন্যে আমি কেন পাড়ার গন্যিমান্যিদের কাছে মাথা হেট করতে যাব। কেন? সেই কৈফিয়ৎ দিয়ে তবে তুই ঘরে ঢুকবি। না’হলে যে পথ দিয়ে এসেছিস সেই পথে বেরিয়ে যাবি বাড়ি থেকে। এই আমার শেষ কথা বলে দিলাম।” বলে থরথর করে কাঁপতে থাকে সমর পাল।
বাবার কথায় ছেলে একদম চুপ! কোন কথাই বলছে না। সীতা এতে আরও ভয় পেয়ে যায়। সেই থেকে নিজের বগলদাবায় যে ছেলের হাত চেপে ধরে আছে আর ছাড়ছে না। কিন্তু ছেলের শরীরের স্পর্শে বুঝতে পারছে ওর গা যেন জ্বরের মত গরম হচ্ছে আর সেটা একে একে বাড়ছে। সীতার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে ভেতরে ভেতরে বিপ্লব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাপের খেতে দেওয়া কাঁসার ঘটির অবশিষ্ট পড়ে থাকা জল ছুটে নিয়ে এসে ছেলের পায়ে ঢালতে থাকে। চরম রেগে যাওয়া মানুষের পায়ে সমানে জল ঢালতে থাকলে মাথার রাগ নাকি পা টেনে নিয়ে ধরিত্রির বুকে চালান করে দেয়। এবার দেখল, ছেলের গা-গরম এখন আর আগের মত তীব্র নেই। সত্যি সত্যি ধরিত্রি টেনে নিচ্ছে সেই অশুভ তেজগুলো! তারপর বলে,“আয় বাবা, ঘরে আয়। বাবা, গুরুজন মানুষ। এখন ওনার মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলছে, কাকে বলছে তা উনি নিজেই বুঝতে পারছে না।”
একটা নির্মল ভালবাসা যে এইভাবে বিধ্বস্ত, অপদস্ত হবে এবং তা নিজের বাবার দিক থেকে ধেয়ে আসবে কল্পনা করতে পারেনি বিপ্লব! তার এত বছরের জীবনে কোনদিন বাবাকে এমন রেগে যেতে দেখেনি সে। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে বাবা এইভাবে রেগে গেল! তাও কিছুতেই থামতে চাইছে না। মা যত থামতে বলে ততই বেগে রাগ তুলে যায়! এইসব মানুষের কাছে মনুষ্যত্বের থেকে ঠুনকো জাত-বেজাতের প্রশ্ন এতটাই বড়ো! একটা অন্তজ শ্রেণীর মেয়ে। চরম প্রতিকুলতার মধ্যে থেকে এতবড় সাফল্যের মুখ দেখলো। তারপরেও তার জাত-ভাবনা তাকে এইভাবে পেছনে টেনে ধরবে! কিছুতেই সামনে এগিয়ে যেতে দেবে না? আর যারা এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, তাদেরও সমূলে উৎপাটন করে ছাড়বে? মনুষ্য সমাজের মধ্যে মিশে থাকা এইসব অমানুষ তো নরকের কীটের থেকেও জঘন্য। এই কীটের অধম মানুষের কথায় মুখ লাগাতেও তার ঘেন্না হচ্ছে। আর কোন কথা না বলে, জোর করে মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাপের কথা মত যে পথ দিয়ে সে এসেছিল সেই পথেই দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লব। পেছন পেছন তার মা, সীতাদেবী ছুটতে ছুটতে বলে, “খোকা কোথায় যাচ্ছিস দাঁড়া। এই অভুক্ত পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নেই। বাড়ির অকল্যাণ হয়। খোকা দাঁড়া! উদ্ভ্রান্তর মত সেই দৌড়ে সীতাদেবী আর নিজেকে সামাল দিতে না পেরে সদর দরজায় হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

ক্রমশ… 

Exit mobile version