যতো দোষ, নন্দঘোষ
– সুমিতা দাশগুপ্ত
সত্যি কথা বলতে কী, এই বিশ্বসংসারটি এক আজব জায়গা, এখানে প্রতিটি মানুষের একখানা করে বেচারি মানুষ লাগে, যার ঘাড়ে অনায়াসেই নিজের ছোটখাটো সমস্ত অপকর্ম, ত্রুটি বিচ্যুতির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও বিবেক দংশনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, আরো অবাক করা কান্ডটি কি জানেন? রাজা গজা থেকে সংসারী মানুষ প্রত্যেকের কপালেই কিভাবে যেন একখানা করে নিরীহ, বেচারি ভালোমানুষ জুটেও যায়, যদিও সেই বেচারি মানুষটি কিন্তু বোকা নয় মোটেও, বরং উল্টোটাই, বুদ্ধিমান তো বটেই উপরন্তু সহনশীল এবং শান্তিপ্রিয়, সব বুঝেও মুখটি বুজে সবকিছু মেনে নেয়, নইলে জগৎসংসারই বা চলে কী করে!
সেই পুরাকালে ছিল, বেচারি নন্দবাবু,মানে নন্দঘোষ, বালকৃষ্ণের যাবতীয় দুষ্টুমির দায় মাথায় নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর আমাদের সংসারে রয়েছি আমি। সত্যি কথা বলতে কী,আজকাল আমার নিজের মনেই একখানা দৃঢ় বিশ্বাস পাকাপাকি ভাবে জন্ম নিতে শুরু করেছে, এই জগৎসংসারে যেথায় যতো অনাসৃষ্টি কান্ড ঘটে চলেছে —ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে, ইউনিভার্সিটির অর্থসঙ্কট, আন্দোলনরত চাকুরিপ্রার্থীর হাতে পুলিশি কামড় থেকে পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপকদের লিষ্টিতে বঙ্গসন্তানদের অপ্রতুলতা, এইসব কিছুর জন্য এই আমাকেই কোনও না কোনওভাবে দায়ী করা গেলেও যেতে পারে।
এই যেমন একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন, আজ সকাল থেকে বৌদি গজগজ করেই চলেছে, ছেলের স্কুলবাসটা মিস হয়েছে বলে। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছে এর জন্য আমিই নাকি দায়ী। জুতোজোড়া পরাতে যদি দেরী না করতাম, অথবা বাসদাদাদের সঙ্গে দুমিনিট খেজুরে আলাপ করে, তাদের যদি একটু আটকে রাখতাম, তাহলে তো আর… কৈফিয়ৎ হিসেবে বলা যেতেই পারতো বাচ্চাটাকে যদি, আর একটু আগে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া যেত…. সে কথা বলে কার সাধ্যি।
ওদিকে বাবা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, এই তো বাচ্চাটা কিছুদিন আগেই জ্বর থেকে উঠলো, কোন আক্কেলে এই সাতসকালে তাকে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যদি,আবার জ্বর আসে, যদি ফাইন্যাল পরীক্ষাটা দিতে না পারে … যদির বন্যায় ভাসতে ভাসতে বলা গেল না, এখন তাড়াতাড়ি না গেলে যে আজকের ক্লাশ টেষ্টটা মিস্ হয়ে যায়!
অফিস যাবার আগে খাবার টেবিলে বসে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো মায়ের গজগজানি ভেসে আসে ,ফুলের প্যাকেটে বেলপাতা মিসিং। ফুলওয়ালি যা দেয়,অন্ধের মতো তাইই হাতে নিয়ে চলে আসার আগে, আমারই কী উচিৎ ছিল না…ইত্যাদি ,ইত্যাদি ।
ওদিকে পাড়ার ইস্ত্রিওয়ালা বৌয়ের কামিজ ইস্ত্রি করে দিয়ে যায়নি, সকাল থেকে চাপা গজগজানি হাওয়ায় ভাসে, কারুর অর্থাৎ আমার যদি একটুও সহানুভূতি থাকত, তাহলে অনায়াসেই,দু পা এগিয়ে গিয়ে….,যেন আলমারি ঠাসা বাকি পোশাকগুলির,সবকটাই, অস্পৃশ্য,অশুচি।
বাবার নতুন চশমার ডেলিভারি দেবার ডেট তো কবেই পেরিয়ে গেছে, দাদার না হয় অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়, কেন আমার কী একটুও আক্কেল নেই? একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে চশমাটা নিয়ে আসা যায় না? লোকে মনে করাবে তবে আনব!
হায়রে ,যদি বলা যেত, সে কাজটা তো দাদাও করতে পারতো, তাছাড়া বৌদির না হয়, ছেলেপুলেদের স্কুল থেকে তুলে এনে বাড়ি ফেরার তাড়া, আমার স্ত্রী, তাঁদের আদরের নতুন বৌমাটিও তো আছেন, একদিন অফিসফেরত কী চশমার দোকানে ঢুঁ মারা যায় না! কিন্তু বোবার শত্রু নেই, এই নীতি মেনে চুপ থাকাই শ্রেয়।
ঐ শুনুন আমার নবতিপর ঠাকুমা চেঁচাচ্ছে…
জপ করতে করতে তাঁর নাকি চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, জেগে উঠে দেখে থালায় নাড়ু কম! কার কাজ সেকথা বুঝতে কি কারুর বাকি আছে! ছোট্টবেলা থেকেই সেই একইরকম রয়ে গেলাম, ইত্যাদি,ইত্যাদি, ভুলে যায় সেই বয়সটি আমি কবেই পেরিয়ে এসেছি, তবে হ্যাঁ ,আজ কিঞ্চিৎ দায় আমারও রয়েছে, আমিই ভাইঝিটাকে নাড়ু চুরি করতে হেল্প করেছি। বেশ করেছি , ঠিক কিনা আপনারাই বলুন!