প্রতিশোধ
– শিলাবৃষ্টি
অণু ছোটবেলার সেই অপমান এখনো ভুলতে পারেনি। প্রায় সাত আট বছর কেটে গেছে, তবু যেন সেই দিনটার ছবি চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় সে। বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে অনেক আমগাছ, আর প্রতিটা গাছে শয়ে শয়ে কাঁচাপাকা আম ঝুলে ছিল, মাঝখানে পুকুরে পড়ে কত নষ্টও হয়ে গেছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা আর অণু আম পাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আর ঠিক তার পরের দিন রবিবার দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে, তখন চুপিচুপি ওরা বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে পেছনের ছোট গেট টপকিয়ে ঢুকে পড়ে। কয়েকজন গাছে উঠে আম পেড়ে ফেলছিল মাটিতে, আর বাকিরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে পলিপ্যাকে ভরছিল। প্রত্যেকে পলি প্যাক নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু অণু ভুলে গিয়েছিল। তাই সে গাছে বসে বসেই আম খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলছিল গাছের পাশের একটা ঝোপে। আর নীচু গলায় বলছিল ‘আমার তোলা আম কেউ নিবিনা কিন্ত’ বন্ধুরা মেনে নেয় তার কথা।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কাশির আওয়াজ পেয়ে সবাই সচকিত হয়ে গাছ থেকে নেমে একে একে দ্রুত আম বাগান থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু অণু গাছ থেকে নেমে ঝোপের ভেতর তার ফেলা আমগুলো খুঁজতে থাকে। তার বেরনো আর হয়না, দুহাতে কোনরকমে আমগুলো আঁকড়ে ধরে উঠতে যাবে, পেছন থেকে বিনোদকাকার বাড়িতে কাজ করে যে লোকটা মানে গনেশ নামের ছেলেটা তাকে আচমকা ধরে ফেলে, আতঙ্কে অণুর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। গনেশের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেও পারেনা। সে টানতে টানতে বিনোদকাকার ঘরে নিয়ে যায় তাকে। বিনোদকাকার সবে তখন দিবানিদ্রা ভেঙেছে। হাই তুলে জিজ্ঞেস করে- এ আবার কে?
গণেশ বলে- চোর বাবু, চোর। এই বাগানের আমটা কলাটা চুরি করে নিয়ে যায়, নারকেল পড়লেই হলো, সব নিয়ে পালায়। আজ তকে তকে ছিলাম, আম গাছ থেকে নামতেই পাকড়াও করে এনেছি… বিনোদকাকা শুনে রেগে বলে- বেশ করেছিস, একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে এখন রেখে দে।
সেদিন কান্নাকাটি করেও ছাড়া পায়নি অণু। সন্ধ্যাবেলায় যা ঘটলো ওই দশ বছর বয়েসেও সেই অপমান হজম করতে পারেনি সে।
গ্রামের মাঝখানে একটা পুরোনো রাধামাধবের মন্দির আছে। সন্ধেবেলায় গ্রামের অনেক মানুষ বিশেষত মুরুব্বিরা মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দিরে গিয়ে বসে, কথাবার্তা বলে, তাস খেলে, চা খায়..
বিনোদকাকার সেই গণেশ দরজা খুলে অণুকে নিয়ে বিনোদকাকার পেছনে পেছনে সেই নাট মন্দিরে আসে। সবে আরতি শেষ হয়েছে, সবাই জড়ো হয়েছে। এমন সময় বিনোদকাকা মুখ খোলে- দেখো গো তোমরা সবাই চোর দেখো
সবাই অবাক হয়ে অণুর দিকে তাকায়।
-যারা চোর দেখনি কোনদিন দেখে নাও আজ। এই মেয়েটা আমার বাড়ির বাগানের ফলমুল রোজ চুরি করে, আজ গনেশ ধরেছে চোরকে।
সবাই এটা ওটা বলতে থাকে। গুঞ্জন শোনা যায়। এই রকম সময়ে অণুর জ্যেঠু এসে পৌঁছায়। সব শুনে ঠাস করে অণুর দুগালে দুটো চড় মারে। তারপরের কথা আর ভাবতে চায়না অণু। শুধু কানে এখনো শুনতে পায় তার নিজের বলা শেষ কথাগুলোই- কাকা মনে রাখবে তুমি, একমাঘে শীত যায়না। এ কথা আমি মায়ের কাছে শিখেছি, এ মিথ্যে হবেনা দেখো।
বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সবাই সেদিন হেসে ফেলেছিল।এই ঘটনার পরে শীত এসেছে আর গেছে প্রায় সাতবার।
……..
কলেজে যাওয়ার সময় খেতে বসেছে অণু রান্নাঘরে, কানে এলো লক্ষ্মীমাসী মাকে বলছে- বিনোদ ঘোষ লোকটার স্বভাব আর পাল্টাবে না!
মা বললো- কেন রে লক্ষ্মী কি হয়েছে?
-কেন আবার! ঘরে বউ ছেলে মেয়ে থাকতে বুড়োটা আবার বিধবা ওই রাধার উপর কৃপা করেছে। রাধার ঘরে তো আর কেউই নেই। বিনোদের পরিবার পুরী গেছে পরশু আর সেও মওকা পেয়ে রাধার ঘরে মউজ করছে।
-সে কি রে!
-হ্যাঁ, গো হ্যাঁ…
পুরোনো অপমানটার শোধ এবারে হয়তো নেওয়া যাবে! অণু সব প্ল্যান তৈরী করে সারাদিন ধরে। তারপর গ্রামের অনেক মানুষকে জড়ো করে সেদিন রাত্রি বারোটাতে রাধার বাড়ির মেন দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে অনবরত। রাধা দরজা খুলতে বাধ্য হয়। সবাই ঘরে ঢুকে অণুর কথা মেলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বিনোদকে দেখতে পায়না। অবশেষে খিড়কির বাথরুম থেকে বিনোদ ঘোষকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অণু। সবার কাছে প্রমাণ হয়ে যায় বিনোদ ঘোষের চরিত্র।
হা হা করে হাসতে হাসতে অণু বলে- সাত
বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে কাকা। একটা বাচ্চা মেয়ে একদিন তোমার বাগানের কটা আম পেড়েছিল বলে তুমি কি করেছিলে? সেদিন আমি বলেছিলাম- এক মাঘে শীত যায়না! মনে পড়ছে? আমিই সেই অনুপমা! যাকে ঘরে আটকে রেখে তুমি মজা দেখেছ! যাকে নাটমন্দিরে এনে সকলের কাছে অপমান করেছ! যাকে মার খাইয়েছ! আজ তোমার কীর্তি সকলের সামনে এনে আমার অপমানের শোধ নিতে পারলাম।
সকলে ছি ছি করতে করতে বাড়ি চলে গেল। অণু আজ শান্ত হতে পারলো। আর
রাধা অপমানে লজ্জায় বিনোদকে বের করে দিয়ে দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিল। টাকার দম্ভে ফুলে ওঠা বিনোদ ঘোষ স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হবে সে কোনদিন!
অসাধারণ লাগলো।