গল্প- অপরাহ্নের আলো

অপরাহ্নের আলো
-সুমিতা দাশগুপ্ত

বিকেল বেলায় দোতলার বারান্দায় বসে অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ দেখতে বড্ড ভালো লাগে ইন্দিরার। রোজ তাই এই সময়টায় বারান্দায় এসে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। আজ‌ও হাতদুটো কোলের উপর রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন , আকাশে ভাসা টুকরো টুকরো মেঘগুলো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় কেমন সুন্দর নিজেদের রাঙিয়ে নিচ্ছে নানা রঙে।মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, মানুষের জীবনটাও বোধহয় অনেকটা এইরকমই। প্রথম জীবনের নানা রঙের দিনগুলো, যখন বার্ধক্যের ছোঁয়ায় ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠতে থাকে ,তখন নিজেকেই চেষ্টা করে বাইরের রঙে রাঙিয়ে, জীবনকে উজ্জ্বল করে নিতে হয়, ন‌ইলে মনকেমনের আঁধারে ডুবে যায় দিনযাপন। সেই আঁধার সাঁতরে পার হ‌ওয়া যে কী পীড়াদায়ক, ভুক্তভোগী মাত্রের‌ই জানা। আশেপাশে কম মানুষকে তো আর দেখছেন না। বিদেশের মানুষজন যে এতো হবি নিয়ে মাতামাতি করে সে কি আর এমনি!
উদার আকাশে হারিয়ে যেতে যেতে এইসব নানা দার্শনিক চিন্তায় ডুবে ছিলেন ইন্দিরা।

“এই নাও , তোমার চা।” পাশে রাখা বেতের টেবিলে ঠক্ করে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বললে মিনতি।

“দাদুকে চা দিয়েছিস?”

“হুঁ, কী একটা ব‌ই পড়তেছে তাই ঘরে বসেই চা খাবে বললো।”

“আর আমার সুতো?”

“এনেছি রে বাবা এনেছি, ন‌ইলে আমার কপালে দুঃখু আছে সে কী আর আমি জানি নে, ও,ভালো কতা, লেস বোনার সুতোর দাম কিন্তু পাঁচ ট্যাকা করে বেড়ে গেচে , বলে রাকলুম।”

” আচ্ছা বেশ, কী আর করা যাবে।”

“সে তুমি বোজো গে যাও। সারাদিন ধরে কষ্ট করে আঙ্গুল ব্যাতা করে বোনো আর একে তাকে বিলিয়ে দাও ,তাও যদি সবাই এর মম্মো বুজতো “

আরে আমি তো লেশ বুনতে ভালোবাসি রে , আর ভালোবেসেই ওদের দিই। তোকেও তো দিয়েছি, তুইও তো খুশি হয়েই নিলি”

“আমার কতা বাদ দাও, তোমার ঐ ছোট জা সেদিন কী বললে মনে নেই! কতো বড়ো একখানা টেবিল ঢাকা দিলে, আর মুকের ওপর বলে কিনা, কী লাভ হয় বলতো দিদি, এইসব কষ্ট করে বুনে ,সব‌ই তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মেশিনে বোনা ওইসব লেসগুলোর ফিনিশ আরও কতো সুন্দর!ছেলে নাকি বিদেশ থেকে পাইট্যেচে, সেই দেমাকেই মলো। ইচ্ছে করছিলো দিই বেশ করে দুকতা শুনিয়ে, তুমি আবার কী বলবে তাই চুপ মেরে গেলাম।”

“আচ্ছা বেশ আর দেব না ওকে, আর শোন্ এই সুতোটা আনালাম বিন্দি দিদিভাই এর জন্যে। ওর মা ফোন করেছিলো, দিদিভাইদের স্কুলে কুরুশ দিয়ে কী সব যেন করতে শেখাবে, তাই আগেভাগেই কুরুশ বোনা শেখাতে ওকে নিয়ে আসবে, মালবিকা।”

“ওমা ,তা-ই!সে তো শুনিচি মেমসাহেব দিদিমণিদের ইস্কুল! সেখানেও এইসব শেখাবে?”

“তবেই বোঝ্, নে এবারে তোর দুঃখু ঘুচলো তো। যা গিয়ে কাজে মন দে ,আর শোন্ কাল বিকেলে রুটি করার দরকার নেই।ওরাও আসবে , সকলের জন্য লুচি মাংস, বেশী করে বানাবি,তুইও বাড়ির জন্য নিয়ে যাস্।”

“সে হবেখন, আর শোনো এরপর আমার জন্য একখানা টি,ভির ঢাকনা বানিয়ে দিও তো।”

“ওমনি বায়না শুরু হলো ,যা তো এখন কাজে মন দে।”

তা এটুকু বায়না সে করতেই পারে। বহুদিন ধরেই রয়েছে এই বাড়িতে, ইন্দিরা আর অমলেশের সংসারে, তাঁদের স্বঘোষিত অভিভাবক আর সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে। এখন ও-ই বোধহয় এই নিঃসন্তান দম্পতিটির সবচাইতে কাছের মানুষ-রক্তের সম্পর্কের অন্যান্য পরিজনদের চাইতেও বেশি। তারা মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেয় না তা নয় তবে তাদের আর সময় কোথায়! এই মিনতিই বলতে গেলে সর্বক্ষণের সাথী।

সকাল বেলা নিজের সংসার‌ কিছুটা সামলে ,সে চলে আসে এই বাড়িতে, দুপুর বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি যায়, আবার বিকেল হতেই চলে আসে, ইন্দিরার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ সেরে , ছাদের দরজা বন্ধ করা থেকে শুরু করে মশারি টাঙিয়ে, মায় টিপয়ে জলের গ্লাস, বোতল রেখে, রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। মোটকথা জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, এমনকি টুকটাক কাজে মিস্ত্রি ধরে আনা থেকে, ঠিকে কাজের লোকের উপরে ছড়ি ঘোরানো , সব কিছুই তার আওতায় পড়ে।

মিনতি, নীচে নেমে গেল। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে , ইন্দিরা আবার ডুবে যাচ্ছিলেন নিজের ভাবনায়।

তাঁদের একতলাটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বেশ কয়েকবছর আগে মালবিকারা ভাড়ায় এসেছিলো,বিন্দি তখন এইটুকু ,বোধহয় বছরখানেকের। দেখতে দেখতে বছর পাঁচেক কেটে গেলো। বিন্দি,এই বাড়িতেই বড়ো হলো, খিলখিল হাসিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে, উপর নীচে ছুটোছুটি করে বেড়াতো, সংসারটা বেশ ভরভরতি লাগতো, তারপর তো নিজেরা ফ্ল্যাট বানিয়ে চলে গেছে,ঘরদুয়ার আবার ফাঁকা।তবে যোগাযোগ আছে। এই তো মাসছয়েক আগে মালবিকার এন্-আর- আই দিদি আলোলিকা দেশে এসে দেখা করতে এসেছিল তাঁদের সঙ্গে, পারফিউম, ক্রিম,ব্যাগ, হ্যানা ত্যানা, আরও কতো উপহার নিয়ে। হঠাৎ একটা কথা মনে করে হাসি পেয়ে গেল। ইন্দিরা ওকেও খান দুই -তিন,হাতে বোনা বড়ো বড়ো লেশের ঢাকনা উপহার দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলো! দেশে ফিরে নিজের ঘরে , নানা কর্ণার টেবিলে সেগুলি পেতে সাজিয়ে গুছিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে।
ও, খুশি হয়েছে, ব্যাস্, ওইটুকুই ইন্দিরার আনন্দ, আর কী চাই!

পরদিন বিকেলবেলায় বিন্দিকে নিয়ে চলে এলো মালবিকা।বিন্দিকে হাতে ধরে কুরুশকাঠি ধরার কায়দা থেকে, আরম্ভ করে বোনার প্রাথমিক ধাপটুকু শিখিয়ে দিলেন ইন্দিরা। এরপর ক্লাশে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। তাছাড়া তিনি তো র‌ইলেন‌ই।

ইন্দিরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন, মালবিকা কেমন যেন একটু উশখুশ করছে।বেশ বুঝতে পারছিলেন ওর আরও কিছু বলার আছে। শেষটায় ইন্দিরাই আগ বাড়িয়ে বললেন
“নাও এবারে কী বলবে বলে ফেলো তো।

মালবিকা অবাক—

“কী করে বুঝলেন আমি কিছু বলবো?”

“ভুলে যাও কেন আমাদের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।”

মালবিকা এবারে অকপট হলো।
সঙ্গে আনা বড়োসড়ো ব্যাগ থেকে একগাদা লেশবোনার রেশমী সুতো আর ক্রচেট ডিজাইনের ব‌ই ইন্দিরার হাতে দিয়ে বললো
“দিদি পাঠিয়েছে আপনার জন্য।
এইসঙ্গে একখানা আবদার‌ও আছে।

“শুনি কী আবদার!”

“আপনি দিদিকে যে লেসের ছোট বড়ো নানারকমের ঢাকা বুনে দিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে দিদির এক বিদেশিনী বান্ধবীর খুব পছন্দ হয়েছে …”

“বুঝেছি তার‌ও গোটাকতক চাই, তাই তো! বেশ তো…”

” হ্যাঁ চাই তো বটেই, তবে তার চাহিদা আরও একটু বেশি।
এইসব জিনিসগুলো একসময়ে খুব পপুলার ছিলো,বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সেকথা তো জানেনই। তারপর মাঝে ফ্যাশন উঠে গিয়েছিলো। ইদানিংকালে আবার নতুন করে সে ফ্যাশান চালু হয়েছে, যাকে বলে “ইন-থিং”। পোশাক আশাকে লেসের কাজের খুব চাহিদা।
ওদিকে দিদির বান্ধবীটির একটা ছোটখাটো ফ্যাশান-স্টোর্স,আছে,ও চাইছিলো,যদি লেসের কিছু স্টক দোকানে রাখা যায়। তুমি যদি রাজি থাকো…”

“ও বাবা , সে তো অনেক বড়ো ব্যাপার , আমি শখের কারবারি, এইসব কি করে সামলাবো?”

“শোনো না , দিদির আরও একটু পরিকল্পনা রয়েছে। দিদি বলছিলো, আমাদের দেশে সেলাই করে সংসার চালায় এমন অনেক দুস্থ মহিলা আছেন, তাদের যদি তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দাও, হয়তো তোমার মতো এতো ভালো কাজ হবেনা তবু তাদের দিয়েই যদি নানা ডিজাইনের লেসের টেবিল ক্লথ, বেডকাভার তৈরি করানো যায়!!! মাল মেটিরিয়াল জোগান দেওয়া, থেকে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট ওদেশে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা,সব ওদের।”

“কী বলছো ! এই বয়সে কি এইসব সম্ভব, তাছাড়া এটা তো আমার মনের আনন্দের ব্যাপার , না না এটাকে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যেতে মন চায় না।”

” শোনো না, তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে, শুধু ওদের শিখিয়ে, ভুলভ্রান্তি শুধরিয়ে, নতুন নতুন ডিজাইনের কাজ করিয়ে নেবে। ইচ্ছে হলে তুমিও বুনবে, আগে যেমন নিজের জন্য বুনতে, ইচ্ছে না করলে নয়। ভেবে দেখো না এতে তোমার‌ও শখ মিটবে , কিছু গরীব মেয়েরাও কাজ পাবে। খুব কিছু মন্দ হবে কি?”

এইরকম আচমকা প্রস্তাব এলে চট্ করে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বিশেষ করে এই বয়সে এসে?
বেশ কিছুদিন দোনামনা করতে করতে অবশেষে রাজিই হয়ে গেলেন ইন্দিরা। ভাবছিলেন, সত্যিই যদি তাঁর শখটা আরও একটু বিস্তৃত করলে কয়েকজনের আর্থিক সাহায্য হয়, তাহলে মন্দ কী! কতো মানুষ তো কতো ভালো কাজ করেন,তাই তো এই দুঃসময়েও পৃথিবীটা চলে!

মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটা বেশ চালু হয়ে গেল।
মিনতির উৎসাহ‌ই সবচেয়ে বেশি। সে-ই, স্বনিযুক্ত ম্যানেজার। হম্বিতম্বি ছুটোছুটি করে ব্যাপারটা বেশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইন্দিরাও আজকাল মনের সুখে নিত্যনতুন ডিজাইন তুলিয়ে দেন মেয়েদের।সঙ্গে নিজের শখের বোনাও তো আছেই। মিনতিসহ অনেকক’টি মেয়ে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আজকাল দেশের মধ্যেও এই হাতে বোনা লেসের চাহিদা বাড়ছে।
খবরের কাগজের প্রতিবেদনে অনেকেই ব্যাপারটা এখন জেনে গেছেন। আত্মীয় স্বজনদের অভিনন্দনে মনে মনে হাসেন তিনি।
এবারে পুজোর সময়, বিদেশেই আলোলিকারা স্টল দিয়েছিলো, সেখানে তাঁদের হাতের কাজ বেশ সাড়া ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষ্টিমনস্ক বঙ্গসন্তানদের আগ্রহে হয়তো বা আগামী বছর বিদেশের প্লেনে চড়তে চলেছেন ইন্দিরা আর অমলেশ।
সূর্যাস্তের শোভায় মগ্ন থাকা ইন্দিরা ভাবেন তাঁর জীবনেও বুঝি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অপরাহ্ণের আলো।

সুমিতা দাশগুপ্ত।

Loading

Leave A Comment