পিতৃত্বের দাবি
-মুনমুন রাহা
” দেখ তোমার ঐ মালিটার তাকানো আমার একদম ভাল লাগে না । কেমন করে যেন আমার তিন্নির দিকে তাকায়। তুমি ওকে বিদায় করার ব্যাবস্থা কর।”
” তোমার এই সবাই কে সন্দেহ করাটা বন্ধ কর তাহলেই দেখবে সব ঠিক আছে। “
” বিশ্বাস কর এবার আমার মনের ভুল নয় গো । প্রতিবার কি ভুল হয়? আর তুমি জান না তিন্নি আমাদের কত ধৈর্য্যর ফল ?”
এটা অবশ্য ঠিকই বলেছে অনামিকা। তমাল আর অনামিকার বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তিন্নি আসে ওদের জীবনে । এর আগে অনামিকার পাঁচ বার মিসক্যারেজ হয়। শেষের দিকে তো অনামিকা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারের এই সন্তান হারনো তার আর তমালের জীবনের গতিটা যেন থামিয়ে দিয়েছিল। তিন্নির ছোট দুটো হাত ধরেই তারা ফিরেছিল জীবনের ছন্দে ।
তমালের বাগানের বড় সখ । অফিসের চাপে সেই ভাবে নজর দিতে পারছে না গাছ গুলোতে তাই একটা মালি খুঁজছিল । পেয়েও গেল । নাম চরণ দাস । তার সাথে আবার কদিনের মধ্যেই বেশ ভাল আলাপ হয়ে যায় চার বছরের তিন্নির। প্রথম প্রথম অনামিকা কিছু বলে নি কিন্তু আজকাল তার নানা রকম সন্দেহ হচ্ছে মনে।
তমাল অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসে । এসে দেখে চরণ তিন্নির ঘরে বাইরের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে । তমাল গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে সে । জিজ্ঞেস করতে বলে সাদা গোলাপ গাছে ফুল এসেছে তিন্নি দেখবে বলেছিল তাই সে খুঁজছিল তাকে । কথাটা কেমন বিশ্বাস হয় না তমালের। তবু তখন কিছু বলে না সে । আরো একদিন তমাল লক্ষ করল সকাল বেলা চরণ কি যেন কথা বলছে তিন্নির সাথে । পরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে মালি কাকু তাকে জিজ্ঞেস করছিল তিন্নি তার সাথে তার বাড়ি যাবে কিনা ?
না আর রিস্ক নিতে পারে না তমাল। আজকাল কত কিছুই তো হচ্ছে ।
তার বাগানের ফুলের থেকে তার ফুলের মত মেয়ে তিন্নি তার কাছে অনেক বেশি দামী । তাই সেদিনই চরণ দাসকে একমাসের মাইনে সহ বিদায় দেয় সে । যাওয়ার আগে চরণ দাস তার সাথে দেখা করতে চায় । বলে —
” বাবু আমি তো মালি তাই একটা কথা বলি। পরের বাগানের ফুল দিয়ে কখনও নিজের বাগান সাজানো যায় না । আর সাজালেও সে ফুল বেশিদিন থাকে না ।”
” কি বলতে চাও তুমি ? “
আর দাঁড়ায় নি চরণ দাস। চরণ দাসের কথা গুলো যেন হঠাৎই তমাল কে পিছিয়ে নিয়ে যায় চার বছর আগে তিন্নির জন্মের সময়। বহুদিন ধরে ভুলে থাকা কথা গুলো মনে পড়ে যায় তমালের।
যখন অনামিকার শরীরে নয় মাস ধরে তাদের সন্তান বেড়ে ওঠে তখন তমাল আর অনামিকা দুজনেই অনেক স্বপ্ন দেখেছিল সেই সন্তান কে নিয়ে । আগের পাঁচ বারের মতো ভগবান তাদের সন্তান কে কেড়ে নেয়নি। তারপর সঠিক দিনে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই অনামিকা ভর্তি হয় নার্সিংহোমে । তমাল অধীর আগ্রহে তখন অপেক্ষারত তাদের সন্তানের জন্য।
ওটি থেকে ডাক্তার এসে খবর দেয় তাদের এক কন্যা সন্তান হয়েছিল বটে কিন্ত বেশিক্ষণ সে থাকে নি এই পৃথিবীতে । এদিকে অনামিকার যা অবস্থা এই খবর হয়তো তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে ।
তমালের তখন নিজেরই পাগলের মতো অবস্থা । এক তো ভগবানের নিষ্ঠুর পরিহাস অপরদিকে অনামিকার জীবন । যখন কি করবে কোন দিকে দিশা পাচ্ছে না তখন হঠাৎই অসিত বলে একটি ছেলে আসে তার কাছে । বলে সে নাকি সব কিছুই জানে তার ব্যাপারে এবং আরও বলে একটি বাচ্চা আছে যার বাবা নেই । মা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে । এখন অসিত তাকে তমালের হাতে তুলে দিতে পারে কিছু অর্থের বিনিময়। ডাক্তারবাবু অবশ্য সবটাই জানতেন । কারণ তিনিও কিছু অর্থ দাবী করেন ।
সব কিছু সামলে আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা টা তাদের আদরের তিন্নি । তারপর সব কিছুই যেন চাপা পরে যায় তিন্নির ভালবাসার কাছে । ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো দিয়ে যখন তমালের হাতের আঙুল গুলো চেপে ধরত ছোট্ট তিন্নি,তখন তমালের মনে হত এ তার ছাড়া আর কারো সন্তান হতেই পারে না ।
তিন্নির যত আবদার তার বাবার কাছে । মেয়েরও সব আবদার মাথায় করে রাখে তমাল । ছোট্ট পায়ে হামা দিতে দিতে, টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন কেটে গেছে চারটে বছর। এই এত বছর পর চরণের কথায় তমালের মনে পরে পুরোন কথা গুলো । কিন্ত চরণ কেন বলল এমন কথা কে জানে!
চরণ বাড়ি ফিরতে তার বৌ তুলসী জিজ্ঞেস করে—-
“কি গো আর কত দিন পর আনবে আমাদের কমলি কে ? “
” একটু অপেক্ষা কর , আনব ,আমাদের কমলি আমাদের কাছেই ফিরবে । কাউকে দেব না । আমার যত অভাবই হোক কমলি আর বিমলির বাবা তাদের মুখে ঠিক খাবার তুলে দিতে পারবে ।”
আজ সকাল থেকে তিন্নির কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না । সকালে সে বাগানে খেলতে গিয়েছিল সেই থেকে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না । অনামিকার অবস্থা ভাল নয় বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । নার্সিংহোমে ভর্তি করে তমাল চলল চরণের কাছে । তার মন বলছিল চরণের তিন্নিকে লুকিয়ে দেখা , তার বাড়ি যাওয়ার কথা বলা এবং শেষ দিনের তাকে দেওয়া উপদেশ এমনি এমনি নয়। পুলিশকে খবর দেয় সে । পুলিশ ও যাচ্ছে তার সাথে ।
” আমি বাবার কাছে যাব “
” কেন মা তোমার এখনে ভাল লাগছে না? এই দেখ তোমার বোন বিমলি। ও আর তুমি যে যমজ। দেখ তোমাদের এক রকম দেখতে না ! “
“এতক্ষন তো থাকলাম মালি কাকু এবার আমার বাবার জন্য মন কেমন করছে । অফিস থেকে এসে আমায় খুঁজবে তো ?”
” তোমার মা তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে খাও মা। “
না কিছুই খায় নি মেয়ে টা । বাবার কাছে যাবে এই বায়না করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে । তুলসী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দাই চম্পা বলেছিল তার পেটে দুটি প্রান বাড়ছে। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ব্যাথা উঠলে চম্পা কে খবর দেয় চরণ । কিন্ত চম্পা তুলসীর অবস্থা দেখে পরামর্শ দেয় ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার জন্য। বস্তির ছেলে অসিতের সাহায্যে তুলসী যায় নার্সিংহোমে । যদিও খরচটা বেশি কিন্ত চিকিৎসা ভাল। সেখানে তুলসী আর তার এক মেয়ে বাঁচলেও আর একটা মেয়ে কে বাঁচাতে পারে না ডাক্তারা ।
কিন্ত সব ভুল ভেঙে যায় তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে। তিন্নি কে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না এ তারই মেয়ে। অবিকল বিমলির মুখ বসানো । তখনই ঠিক করে তিন্নি মানে তাদের কমলি কে নিয়ে আসবে তার কাছে । ঘর তার ভাঙা হলেও রাজকন্যা যে তার।
সেই মতোই আজ তিন্নিকে নিয়ে আসে সে । কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তার মেয়ের কাছে বাবা যে অন্য কেউ। বাবা হয়ে চরণ মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারছে না । আর এটাও ঠিক তমালদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে সে বুঝেছে তমাল ঠিক কতটা ভালবাসে তিন্নিকে । বাবা হয়ে আর এক বাবার কাছ থেকে তার মেয়ে কে কেড়ে নিতে পারবে না সে । তুলসীকেও বোঝায় সে ।
বাইরে পুলিশের ডাকে বেরিয়ে আসে চরণ । দেখে পুলিশের সাথে তমালকে । তমাল তিন্নি খোঁজে ততক্ষণ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরে গিয়ে দেখতে পায় তিন্নির যমজ বোন বিমলি কে । কিছু আর বুঝতে বাকি থাকে না তমালের।
তমাল পুলিশের কাছ থেকে কমপ্লেন তুলে নেয়। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় চরণের কাছে । এও জানায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে ঠিক কি বলে অসিত। অনুরোধ করে তিন্নিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
চরণ বলে —-
“নিয়ে যাও বাবু তোমার মেয়ে কে । ওর নরম মনে এত কথা বলে কষ্ট দিতে হবে না । আর তাছাড়াও ও তোমাকে বড় ভালবাসে ।তুমি বাবা যে !”
“না চরণ ও আজ থেকে শুধু আমার মেয়ে নয় তোমারও মেয়ে। আমরা দুজনেই ওর বাবা হতে পারি না ? “
অনামিকাও আজ জানে সবটা । তমাল বাবু আর অনামিকার কাছে ভালোই আছে তিন্নি ।মাঝে মাঝে অবশ্য তার মালি কাকুও আসে ওর সাথে দেখা করতে ।