মুক্ত গদ্য

মুক্ত গদ্য- মনে মনে

মনে মনে

-সুমিতা দাশগুপ্ত

আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ , তুমুল ব‌ষ্টি নেমেছে। দ্বিপ্রাহরিক অলস অবসরের নিরালা বেলায়, ভাতঘুমে মগ্ন সবাই, কেবল আমার চোখেই ঘুম নেই। কী করে থাকবে! আমার যে চক্ষু জুড়ে কেবল‌ই তৃষ্ণা।বহু যুগের ওপার হতে অজস্র প্রাণের সম্ভার নিয়ে, “আবার এসেছে আষাঢ় ,আকাশ ছেয়ে।” ঝরঝর শব্দে বেজে ওঠা আষাঢ়ের সুর তাল ছন্দ,এখন‌ই শুনে না নিলে ,আর কবে! আর কখন!
দোতলার বারান্দায় বসে, প্রবল ছাটে ভিজে যাওয়া আমি, একটুও নড়ি নে – সেই ছেলেবেলার মতোই বৃষ্টি- ফোঁটা হাতের তালুতে ধরার নেশায় বুঁদ হয়ে বসেই র‌ই।

কে জানে কবেকার কোন পুণ্যের ফলে , মহানগরীর ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গ এক উপনগরীর বাসিন্দা হয়েও,অজস্র গাছগাছালি ভরা, নিরিবিলি একটি পাড়ায় ঠাঁই মিলেছে আমার।
সন তারিখের হিসেব অতশত মনে রাখিনি, তবে ওই যে কবে যেন,জনবিষ্ফোরণে হাঁসফাঁস, কলকাতা মহানগরীকে একটু স্বস্তি দিতে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নগরপরিকল্পকরা শহরের পুর্বপ্রান্তের জলাজমি ভরাট করে উঁচু রাস্তা বানিয়ে, পাশ বরাবর সুন্দর খাল কেটে এলাকার সৌন্দর্যায়ন সেরে,জায়গাটির ভোল বদলে ফেললেন,আর সেইখানে পাশাপাশি অনেক ক’টি প্লট বানিয়ে বেশ কিছু মানুষজনের আপন বাসা বানিয়ে ফেলার সুযোগ করে দিলেন, সেইখানটিতে আমাদেরও একটুকু ঠাঁই মিলে গেল। ওমা! কি ভাগ্যি! সঙ্গে জুটলো চমৎকার একখানা প্রশস্ত দক্ষিণের বারান্দা!
অলস অবসরে,বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটিতে বসলেই নজরে আসে উদার উন্মুক্ত নীল আকাশের ইশারা। এইখানটিতে এসে বসলেই আমার কেন যেন মনে পড়ে যায় আশাপূর্ণা দেবীর গল্পের নায়িকা, ‘সুবর্ণলতার’ কথা। জীবনে বেচারি বেশি কিছু তো চায় নি, শুধু চেয়েছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে, মাথার উপরের একটুকরো নীল আকাশ দেখতে দেখতে, খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে। সামান্য সেই চাওয়াটুকুও পূর্ণ হয় নি তার , তীব্র ক্ষোভে ছটফটিয়ে মরেই গেল বেচারি! আর আমার‌ জন্যে কিনা এতোবড়ো একখানা সৌভাগ্যি অপেক্ষা করে ছিলো!
এসব কথা বলিই বা কাকে! বাড়ির সকলেই
সদা ব্যস্ত। তারা ভাবে সাধারণত ফ্ল্যাট বাড়িতে, ছোট, বড়ো যা হোক একখানা বারান্দা তো থাকবেই, আগেভাগে প্ল্যান দেখেই তো বাড়ি নেওয়া, তাহলে বারান্দা নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে!
কী যে‌ আছে,সেই কথাটাই তো মোবাইলে নিবদ্ধদৃষ্টির আধুনিক কর্মব্যস্ত মানুষজন, না নিজেরা বোঝে ,না আমি তাদের বুঝিয়ে উঠতে পারি।
তা বেশ, নাই বা বুঝুক বেবাক লোক, একান্তে আমার গোপন সম্পদ হয়েই থাকুক না হয় সেটি! চোখের সামনে থাকলেও‌ ,স্রেফ বারান্দায় বসে বসেই, এমন নয়নাভিরাম পান্নারঙা সবুজের ঐশ্বর্য দেখতে পাওয়া কী এতোই সহজ! দেখার চোখ চাই, অনুভবের মন লাগে। কে না জানে “সবার তরে নহে সবাই।”

এই পাড়ায় ষড়‌ঋতুর অনায়াস আনাগোনা। প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতি তার নিজস্ব রঙ রূপ মেলে ধরে ,পরিপূর্ণ মহিমায়, অকৃপণ দাক্ষিণ্যে। অকাতরে বিলিয়ে দেয় তার রূপ রস গন্ধ।

বাঙালি জীবনের প্রধান এবং সবচাইতে বড়ো শারদীয়া উৎসবের পালা ফুরোতে না ফুরোতেই, চলে আসে কুয়াশার ঘোমটা টানা হেমন্তকাল। খাস কলকাতায়, কোলাহল মুখর মহানগরীর আনাচে কানাচে, গরীব ঘরের পল্লীবধূটির মতো এতোই কুন্ঠিত চরণে তার আনাগোনা, যে‌ ক’জনে তার খোঁজ রাখে সন্দেহ। এখানে কিন্তু সে বেশ স্বচ্ছন্দ, হিমের চাদর গায়ে, দিব্যি জানান দিয়ে সে আসে!‌ ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ভোরের বেলায় ঘাসের আগায় ছড়িয়ে দেয় হীরের কুচি সকালবেলার নবীন সূর্য খেলা করবে বলে। সন্ধ্যার কুয়াশায় পথ দেখাতে মিটমিট করে জ্বালে তারার আলোর প্রদীপখানি।
যদিও খুব‌ই ক্ষণস্থায়ী তার অবস্থানকাল, তবু সে আসে।
তার বিদায়ের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে না আসতেই শীতের হাওয়ায় নাচন লাগে। উড়িয়ে দেবার মাতন জাগিয়ে শীত সঙ্গে নিয়ে আসে পাতা খসাবার মরসুম।
একটা একটা করে পাতা ঝরে,ঝরতেই থাকে অহোরাত্র। শীর্ণ ডালপালা নিয়ে, বৃক্ষদল রিক্ত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের দাক্ষিণ্যের আশায়। কিছুদিনের মধ্যেই শুকনো ডালপালায়, কচিপাতারা লাজুক শিশুটির মতো উঁকিঝুঁকি দেয়।বসন্তের আগমনী ঘোষণা করে কোকিলের কুহুতান।

এইসব যে নেহাৎই কাব্যকথা, অথবা রচনা ব‌ইয়ের পাঠ্যবস্তু, নয় সেকথাটি বেশ বোঝা হয়ে যায় রসিকজনের।

এখানে জারুলে,কৃষ্ণচূড়ায়, বকুলে, কদমে গলা জড়াজড়ি ভাব। পেল্লায় বট আর নিমের নজরদারিতে বেঁচে বর্তে থাকে কাঠবিড়ালি, কাক কোকিল, ঘুঘু ,চড়াই পাখির দল।
কালবৈশাখীর ঝড় কেশর ফুলিয়ে তেড়ে ‌ এলে,কৃষ্ণচূড়ার ছেঁড়া পাপড়ি যেমন রেড কার্পেট অভ্যর্থনা জানায়,ঠিক তেমনই কদমকেশর শোনায় বর্ষার আগমনী‌ গান। আর সামনের বিশাল বটগাছে সাঁঝের আঁধারে আশ্রয় নেওয়া বকের দল, ডালে ডালে কী চমৎকার যে থোকা থোকা ফুলের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারে,‌ স্বচক্ষে না দেখলে কোনদিন জানাই হতো না।
আজ এই আষাঢ়ের ধারাবর্ষণে পল্লবে পল্লবে শিহরণ দেখতে দেখতে মনে বড়ো সাধ যায়, ভেজা মাটিতে করতল বিছিয়ে বসতে, অনুভব করতে মৃত্তিকার গভীর থেকে উঠে আসা “লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকার” ডানা মেলার অশ্রুত ধ্বনি।
জানতে বড়ো ইচ্ছা করে‌ মাতা বসুমতীর কোলে ঠাঁই পেয়ে এখন কেমন আছো সীতাদেবী ! মায়ের স্নিগ্ধ পরশে কি জুড়োলো তোমার মর্ত্যভূমির তীব্র অপমানের বহ্ণিজ্বালা!
ভাবতে সাধ হয়, এই ধারাবর্ষণেই বুঝি থাকে মায়ের হাতের পরশ। কতকাল হয়ে গেল , আমিও তো আর পাইনে আমার বৃদ্ধা মায়ের শিরা ওঠা হাতের ছোঁয়াটুকু ! আর ওই যে তরুণী মেয়েটা, এই তো সেদিন একমাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল,তারপর উড়ে গিয়ে ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে বসেছে পৃথিবীর অপর গোলার্ধে, তার পরশটুকুই বা মেলে ক‌ই!
বড্ডো মনকেমনের উথাল পাথাল ঢেউ আজ আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায়।
আচমকা কেজো পৃথিবীর তীব্রস্বর বেজে ওঠে —
“একী, এই ভরদুপুরে বসে বসে বৃষ্টিতে ভেজে কেউ! জ্বরজারি হলে—-”

সত্যিই তো। ঘরে ফিরে এসে দুয়ার এঁটে বসি, ওদিকে ভুবন জুড়ে তখন প্রকৃতি মায়ের লীলাখেলা।
আমি তাহলে এখন কী করি!
আমার যতটুকু সম্বল তার‌ই আশ্রয়
নিই তবে —কলম‌ হাতে তুলে নিয়ে লিখে রাখি মনের কথা..
“ভিজছে শহর, ভিজছে পাড়া
ভিজছে কানাগলি,
মনখারাপের গল্পগুলো
তোমায় তখন বলি!”

Loading

One Comment

Leave A Comment

You cannot copy content of this page