পূর্বাশ্রম
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)
লেখা রান্না করতে করতে ছুটে গিয়ে ল্যান্ডফোনটা ধরল , ‘হ্যালো কেমন আছিস’? ওপারের গলাটা লেখা চিনতে পারল না। তুই তো অনেকেই বলতে পারে, সম্বোধন টা কি করবে ভাবছিল ‘ঠিক চিনতে পারছি না তো’! ‘হুম না চেনার। ই কথা’। কিন্তু বচনভঙ্গিটা যেন বড় চেনা চেনা লাগছিল লেখার ।কে হতে পারে ? ‘বর আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দারুণ সংসার করছিস তাই তো ?এখনো চিনতে পারলি না আমি কুশল রে কুশাল’ ’কুশল’?’ তুই এতদিন পর আমার নাম্বার কোথায় পেলি’? ‘কোথায় থাকিস তুই এখন? কাকিমা কাকু কেমন আছে’? ‘ওরে বাবারে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে’? দাঁড়া, এক এক করে উত্তর দিচ্ছি কিন্তু ফোনে সব শুনে নিবি? একবার বাড়িতে আসতে বলবি না? নাকি তোর পতিদেবের আপত্তি আছে ,ছেলে বন্ধুকে বাড়িতে আসতে দিতে’! ‘ নারে সে মানুষটা অমন নয় আমার সব বন্ধুদের সাথে ওর আলাপ আছে’ । ‘তবে একদিন আসি তোর বাড়িতে কেমন? কিরে তোর আপত্তি আছ নাকি? ‘ একেবারেই না ,সেই ছোট্টবেলার বন্ধু তুই তোকে সত্যিই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!’ ‘তাহলে আজ রাখি রে, দেখা হচ্ছে তাড়াতাড়ি ‘ ।’ আমার ঠিকানাটা লিখবি না?’ ‘ আরে এতদিন পর যখন ল্যান্ড ফোন নাম্বারটা জোগাড় করতে পেরেছি তখন ঠিকানাটাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাব রে, বা পেয়ে গেছি ধর” ” কবে আসতে চাস বল ?” ‘তুই যেদিন ডাকবি !’ ‘এই রবিবার নয় এর পরের রবিবার চলে আসিস’। ‘ বেশ তবে তাই কথা রইল আজ রাখি রে ভালো থাকিস ‘।
ছোটবেলার বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে এসে দেখে রান্নাটা তলা থেকে ধরে গেছে। কি করবে এখন ছেলেমেয়েরা যে সন্ধ্যেবেলা কাশ্মীরি আলুর দম দিয়ে লুচি খাবে বলে খুশি খুশি মনে আছে ।বর ও খুব খুশি। মা ঠাকুমার ছোটবেলা শেখানোর টিপসগুলো কাজে লাগালো লেখা। হ্যাঁ ঠিকই তো অনেকটা সামলে নেওয়া গেছে। একটু টেস্ট করে দেখলো ভালোই হয়েছে খেতে। নুন মিষ্টি ঝাল একদম ঠিকঠাক। নিজের রান্নার তারিফ নিজেই করল মনে মনে।
হাতের ইঙ্গিতে খাবার দুর্দান্ত হয়েছে বোঝালো লেখার মেয়ে ঈশিতা। ছেলে বলল ‘মা আর দুটো লুচি দাও তো ‘বাহ! তাহলে তো রান্না করাটা স্বার্থক। ভালো হয়েছে। রান্নার লোক আছে কিন্তু ছেলে মেয়েদের জন্য এসব রান্না সে নিজে করতেই ভালোবাসে । আর নিজে হাতে লুচি ভেজে খাওয়াতে ভালবাসে ছেলেমেয়েদের । কোনো কোনো সন্ধ্যেবেলা তারা এরকম লুচি আলুর দম বা অন্য কোন পদ খায়। বর বলল ‘ গ্র্যান্ড হোটেলের কুক করে দিমু’। সবাই হেসে উঠলো। কাল রবিবার। কালকে চারজন কোথাও বেরাবে না ঠিক করেছে। ইচ্ছে করে কোনো কোনো রবিবার কোথাও বেরোয় না কেউই। একসাথে থাকাটা এনজয় করে। কাল তেমনি একটা রবিবার। তাইতো কালকে আসতে বলেনি সে কুশল কে। কিন্তু কুশালের আসার কথাটা কি এখনই বলবে? এক সপ্তাহ দেরি আছে তো পরে বললেই হবে। ‘মা ম্যাটটা লাগিয়ে দাও তো, বড্ড মশা হয়েছে’ ‘দেখিস তোর আবার শ্বাসকষ্ট না হয়! তোর তো আবার এগুলো সহ্য হয় না।’ ‘ না মা একটুখানি লাগাও আমি বন্ধ করে দেব ডিনারটা তেমন জমবে না, অনেকগুলো লুচি খেয়ে ফেলেছে কিনা সবাই মিলে। যাইহোক এত বড় রাত্রি কিছু তো খেতেই হবে। অল্প সল্প খেয়ে তারা ঘুমোতে গেল।
রবিবারের সকালটা একটু মেঘলা। মেঘলা দিন বড্ড ভালোবাসে লেখা খুব মিষ্টি মিষ্টি লাগে এই ওয়েদারটাকে তার। বৃষ্টি পড়ছে না তবে রোদের তেজ একেবারেই নেই । একসঙ্গে থাকা রবিবার গুলো তারা খুব আনন্দে কাটায় একসঙ্গে জল খাবার খায়। একেক রবিবার একেক জনের পছন্দের খাবার হয়। এই রবিবার মেয়ে ইশিকার পছন্দের খাবার হয়েছে। ঘরোয়া করে ধোসা তৈরি করেছে লেখা। আজকে রান্নার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে নিজেদের মতন করে কাটাবে বলে দুপুরবেলা মুড়িঘন্ট আছে মেয়ের পছন্দের। আর ফ্রাইড রাইস নয়, ভাতটাকে একটু বিশেষ কায়দায় ভেজে নিয়েছে। খাবারটা মেয়ে খেতে খুব ভালোবাসে । দুপুরে খেতে বসে লেখা বলল ‘তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই আমি সামনের রবিবার আমার এক বন্ধুকে আসতে বলে দিয়েছি ’।‘আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কি আছে তোমার বন্ধুরা তো মাঝে মধ্যেই আসে। ‘এ বন্ধুটা পুরুষ কিন্তু !’ ‘কেন তোমার কোনো পুরুষ বন্ধু আগে বাড়িতে আসেনি বুঝি’ ? আমাদের তো বন্ধু বান্ধবীদের জন্য দরজা খোলা। আমরা তো এসব নিয়ে কখনো কোন আলাদা করে কথা বলি না। বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার বন্ধুর?’ ’কুশল’ ‘ও বাবা এর নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না! কি স্মৃতিরতলে তলিয়ে গেছিল নাকি?’ না গো, এ আমার স্কুল বেলার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি তারপর ওর বাবার বদলি হলো প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ ছিল পরে কেমন করে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কেটে গেল। তারপরেই এত বছর পর কালকে হঠাৎ ফোন করলো। জানিনা কিভাবে নাম্বার পেয়েছে তবে ছোটবেলার বন্ধু তো আসবে শুনে ভালো লাগছে গো ‘। ‘কোন বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি ? ‘ধুর্ তুমি না সবসময় ইয়ার্কি কর’ ‘ না তাই বলছিলাম আরকি। মুখটা যেন কেমন রা রাঙ্গা রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে’ ‘ মা, তোমার বয়ফ্রেন্ড না কি গো? ছেলে ফুট কাটলো। ‘মারবো ‘ ‘দেখো বাবা তাহলে তো বেশ হয় মায়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ হবে’ মেয়ে বলে উঠলো ।’এই তোরা কি আরম্ভ করেছিস রে? আমি কিন্তু না করে দেব আসতে’। ‘আমরা একটা নতুন আনন্দ করবো রবিবার দিন ,কবে যে দিনটা আসবে মা তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করব কি মজা কি মজা! ঈশিতা বলছে। ’মারবো কিন্তু একদম ইয়ার্কি মারবি না’। ‘তোমার বন্ধুকে খুব গম্ভীর প্রকৃতির নাকি’?‘ না রে ও ভীষণ আলাপি। খুব মজা করতে ভালোবাসে অবশ্য এতদিন পরে সে কেমন হয়েছে সেটা ঠিক বলতে পারবো না’।
একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। একি কুশলের সঙ্গে লেখার মেয়ে নামছে। কি করে হলো? ও আচ্ছা, আমি একটা ছোট্ট কাগজের মোবাইল নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম সেখান থেকে দুষ্টু মেয়েটা যোগাযোগ করেছে আর কোথাও থেকে ঠিক ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরেছে। ‘কি রে? চিনতে পারছিস দেখ তো ভালো করে’ ’হ্যাঁ রে, তোর মুখটা তো একই রকম আছে। শুধু বয়সের ছাপটা পড়েছে !’ ’বলছিস আমাকে তো সবাই এখনো ইয়াং বলে, এই যে তোর মেয়ে বলল একটু আগে বাহ তুমি কি ইয়াং আছো গো?’ তুমি মায়ের বয়সী মনে হচ্ছে না আমার মা টা বুড়ি গেলো’ । ‘ব্যাস আমার মেয়ের পাকামো শুরু হয়ে গেছে’। ‘আরে নারে ওর সঙ্গ টা খুব এনজয় করতে করতে এলাম যেটুকু সময় একসঙ্গে এলাম। খুব ভালো মেয়ে তোর। আরে বাবা দরজা দাঁড়িয়ে সব কথা বলবি নাকি ভিতরে যাব’? ‘ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসি, হ্যাঁ আমার আবার কোথাও থেকে এসে স্নান না করলে হয় না আমি টুক করে স্নান করে আসি ’ কি সুন্দর একটা গন্ধ বের হচ্ছে ‘কুশল মামা তুমি কি সাবান মেখেছো গো ’?সেই ছোট্টবেলা থেকে এখনো ছেলেটা একই সাবান ব্যবহার করে, এই গন্ধটা খুব ভালবাসতো লেখা। মা-বাবাকে বলতো ওই সাবানটায় কিনে এনে দিতে। মাঝেমধ্যে চুপচাপ নিজের জমানো পয়সা থেকে কুশল সাবানটা কিনে দিত লেখাকে। হঠাৎ করে ছোট্টবেলাটা মনে উঁকি দিল লেখার । ‘পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়’? ‘হ্যাঁ এবার একটু চট করে খেয়ে নে, জল খাবারটা খেয়ে তাড়াতাড়ি চল আমরা আড্ডা মারবো’। ‘রান্নার লোক রান্না করছে? তুই আমাকে রান্না করে খাওয়াবি না’? ‘হ্যাঁ রে খাওয়াবো’। কয়েকটা পদ আমি রান্না করবো। তোর প্রিয় খাবার গুলো এখন ও আমার মনে আছে। ’। ‘তোর বর কোথায় ’?‘ওর কথা আর বলিস না! তোর পছন্দের জিনিসগুলো জেনে নিয়ে ছুটেছে বাজারে’। ‘বাবা তোর বড তো বিশাল উদার লোক রে’। ‘তা বলতে পারিস এই ব্যাপারে আমি খুব লাকি রে ওকে পেয়ে সত্যিই আমি খুশি’। হালকা একটা বিষাদ কি উঁকি দিল কুশালের মুখে? ঠিক বুঝতে পারল না লেখা। ‘এই বাজারটা ধরো, এসে গেছি আরে কুশল বাবু এসে গেছেন ’ ‘আবার বাবু টাবু কেন নাম ধরে বলো, আর আপনি নয় তুই তুমি যা খুশি বলো ’। বেশতো! তুমি বলেই না হয় বললাম তুই এ নামার মত জায়গাতে এখনো পৌঁছাযইনি ,কখনো যদি পৌঁছাই তখন তুই বলব। আমার বউটি দেখছি খুব খুশি খুশি, পুরনো বন্ধুকে পেয়ে’।
‘চল চল তোর বাগানটা দেখে আসি বাহ!খুব সুন্দর ফুল ফুটিয়েছিস তো! বেগুন গুলোর সাইজ তো হেবি নিয়ে যাব যাওয়ার সময় দুখানা। জানিস তো আমি বেগুন পোড়া খেতে খুব ভালবাসি । মনে পড়ে আমরা কেমন বাগানের ফসল নিয়ে প্রতিযোগিতা করতাম। কার বেগুন গাছে কত বেশি বেগুন আসে কারটা কত বড় হয়! জৈব সার, ইউরিয়া ,নানা রকম সার কম্পিটিশন করে দিতাম দুজনে বল!‘তুই এখনো বাগান করিস’? ‘নারে!কোথায় বাগান করবো? আমার তো দু কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাট আর আমি তো ঘুরে ঘুরে বেড়াই’। ‘কাকিমা কাকু কোথায় আছেন ’?‘ মা বাবা ফ্ল্যাটে থাকতে চাননা। তারা আমাদের দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। ওখানে বাগান নিয়ে ফুল নিয়ে গাছ নিয়ে বেশ ভালো আছেন। কাকু কাকিমা মানে তোর মা বাবা কেমন আছেন? ‘ওরাও ভালোই আছেন। কখনো আমার কাছে এসে কিছুদিন থাকেন, কখনো ভাইয়ের কাছে থাকেন। আবার বেশিরভাগ সময় নিজেদের মতো নিজেদের বাড়িতেই কাটান।’ ওই বাড়িতে ওরা আছে রে যে বাড়িতে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি ’। ‘ও নাইস! ওই বাড়িটা এখনো আছে নারে? আমি তাহলে যাব আমাদের বাড়িটা তো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, এখন ওখানে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী কিনেছেন বাড়িটা অনেক বড় করেছেন বাড়িটাকে বিশাল টাকা ওয়ালা লোক রে !মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমরা টাকা নয় টাকওয়ালা লোকেদের টাকা ওয়ালা লোক বলতাম’। ইশিকা বলল , ‘মা তোমরা তো বেশ মজা করতে তো! । ‘তোর ছেলেটা একটু কম কথা বলে তাই না?’। ‘ হ্যাঁরে ও একটু শান্ত’ । ‘তোর বরটা আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল কেন রে’? ‘ওইটাই তো মুশকিল রে !বাড়িতে থাকলেও অফিসের কাজ করতে থাকে ওই জন্যই তো কিছু কিছু রবিবার আমরা ঠিক করি , একদম নিজেদের মত করে কাটাবো। ওকে অফিসের কাজ করতে দিই না সেদিন। এই আগের রবিবারেই আমরা চারজন ওইভাবে কাটিয়েছি। এর পরেরটা আবার কাটাব’। ‘ও এটা আমি এসে নষ্ট করে দিলাম না তো? নারে এটা একটা নতুন সুন্দর অভিজ্ঞতা হল। খুব ভালো লাগছে রে আচ্ছা তোর বউয়ের কথা বল । তোর পরিবারের কথা বল । ফোনে তো কিছুই বললি না সেসব’। ‘থাকলে তো বলব! ‘আমি আর ঐসব বন্ধনের মধ্যে নেই ’ ‘আর মানে? কোন সময় বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলি নাকি’? ‘হয়তো বা পড়েছিলাম’। কি বলতে চাইছে কুশল ?লেখার মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে। ‘চল তোর বরের সাথে একটু গল্প করি, আরে বাবা তুই তো বিশাল রান্না বিশারদ হয়েছিস রে, রান্নার লোককে বাড়ি চলে যেতে বললি, আমি তোর রান্না খাবো বলে। আরে এত রান্না করলি কখন তুই তো গল্প করছিলি? ও আচ্ছা তোর মেয়ে বরকে নিয়ে যখন গল্প করছিলাম সেই ফাঁকে টুকটুক করে করে ফেলেছিস খুব ভালো হয়েছে রে খেতে, কাকিমার রান্নার কথা মনে মনে পড়ছে। তোদের বাড়ি গিয়ে যখন তখন ডিনার লাঞ্চ করে ফেলতাম। তোদের বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম’। ‘ মা তোমরা মারামারি করতে না’? ‘হ্যাঁরে মারামারি করতাম খেলতাম ,নাটক করতাম । বেশ ছিলাম। ’ ঈশিকা আরিশান একটু বেরালো, তারা তাদের কুশল মামার জন্য গিফট কিনতে যাচ্ছে ।
লেখা, কুশল কে টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছে। লেখার বর একটু বেরিয়েছে। কুশল লেখার আলমারির বইগুলো দেখছে। শরৎ রচনাবলীর র দিকে চোখ পড়লো। সেই কবেকার সেই ছোট্টবেলা খেলা করছিল দুজনে খেলতে খেলতে কোন খেয়ালে লেখা হঠাৎ একটা সাদা পুতির মালা পরিয়ে দিল কুশলকে। লেখা পালিয়ে যাচ্ছিল ,কুশল ওর হাতটা চেপে ধরলো, হঠাৎ বলে বসলো,ললিতা যাস না,তুই অর্ধেক করেছিস আমি পুরোটা করে দিলাম বলে মালাটা লেখাকে পরিয়ে দিল। ললিতা! কুশল কি নিজেকে শেখর ভাবছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো লেখা। । তখন তো দুজনেই বইয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে শরৎ রচনাবলী পড়তো। পরিণীতা গল্পের শেখর ললিতাকে নিয়ে আলোচনা করতো। মালাটা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল লেখা। উচ্চমাধ্যমিকের পর কুশলের বাবা বদলী হওয়ায় কুশলরা দূরে চলে গিয়েছিল । প্রথম কিছু দিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কুশলের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ঘটনাটা। লেখা ব্যাপারটাকে অত গভীর ভাবে নেয় নি। তবুও তার মনে একটু প্রভাব ছিল ঘটনাটার।
নিতান্ত যখন তার জীবনে আসে তখন নিতান্ত কে তার খুব ভালো লেগে যায়। ছোট্টবেলার কবে কি ঘটনা ঘটেছিল আস্তে আস্তে মন থেকে বোধহয় একটু একটু করে দূরে সরে যায় । অনেকটা আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ডের মতো। কিন্তু কুশল লেখাকে ভুলতে পারেনি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও দীর্ঘ আদর্শন হলেও সে লেখাকে ভোলেনি।দীর্ঘ অদর্শন ও বিনা পত্রালাপেও কুশলের মনে লেখার প্রতি ভালোবাসা সদা জাগরুক ছিল। । মনের কোণে কোথায় যেন প্রেমিকার ছবি হিসেবে, স্ত্রীর ছবি হিসাবে লেখার ছবিই আঁকা ছিল। না সে প্রেমও করতে পারেনি ,বিয়েও করতে পারেনি।মনের কোণে কোথাও আশা ছিল হয়তো পরিণীতার ললিতার মত তার লেখাও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কিন্তু লেখার বিয়ের খবর তার কাছে গোপন থাকেনি। কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। এই মালাটা সর্বক্ষণের সাথী ছিল তার । যেন মালাটাই তার জীবনসাথী। অদ্ভুত এক বন্ধন । বন্ধনে ধরা না দিয়েও বন্ধনে থাকা। কিন্তু না সে আর কোন বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না। কি সুন্দর একটা সংসার লেখার। তা দেখে তার মনে হল তার ভালোবাসার জন সুখে আছে এটাই তার জন্য পরম আনন্দের। শেষের কবিতার অমিত লাবণ্যকে মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, লেখার সঙ্গে তার যে ভালোবাসা সেতো দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, তার মন তাতে সাঁতার দেবে। না না আর তার মনও আর সেই দিঘিতে সাঁতার দেবে না। ভালবাসার ওইদিগিতে সাঁতার দিয়ে তার মন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার তার মন যেন বলছে,‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো ’। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি। সে তো পাহাড়ে, পাহাড়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় । জীবনধারণের জন্য বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু রোজগার করার প্রয়োজন সেটুকু করে নেয় আর বাকি সময়টা বাইক রাইড। । কখন ও বা চার চাকায় পাহাড়ে চলে যায় । বাইকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক বাইকারদের সঙ্গে তার বিশাল বন্ধুত্ব এসব নিয়ে বেশ আছে। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেতে ভালোই লাগে। কিন্তু মালাটা কেন সে যেন ছাড়তে পারে নি এতদিন? এ কোন অদৃশ্য বন্ধন । ‘এবার যে আমার যেতে হবে লেখা আজকের দিনটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি’। একটা দিন থেকে গেলে হতো না ’ ‘নারে আজ আমার যেতেই হবে কালকে আবার শুরু হবে ছুট, পাহাড়ের টানে বাইক রাইডে। চল তোকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঈশিকা, তুই যাবি আমাদের সাথে’? ‘না মা এটুকু সময় তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটু আনন্দে কাটাও ’ । গাড়ি করে স্টেশনের পর্যন্ত যাও এর মধ্যে তোমাদের গোপন কথাটা সেরে নাও’ । লেখার বর হাহা করে হেসে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো যাও যাও’। ‘ধুর তুমি না !আমি যাবই না তাহলে’। ‘ না না যাও ওনার ভালো লাগবে গাড়ি থেকে স্টেশন খুব বেশি কথা হলো না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নীরবতা বজায় রয়েছে । একটু দেরি আছে ট্রেন আসতে। দুজনে স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছে। ‘ চারিদিকে দৃশ্যগুলো দেখ ,তোর জন্য একটা উপহার আছে একটা ভালো উপহার আছে আর একটা অন্যরকম জিনিসও আছে বাক্সে। এখন খুলবি না। গিয়ে খুলিস। ট্রেন ছুটছে জানলা দিয়ে হাত দেখাতে দেখাতে চলে যাচ্ছে কুশল ক্রমাগত দূরে দূরে দূরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে । কৌতূহল খুব কৌতূহল হচ্ছে লেখার। বাড়ি গিয়েই দেখব। বাড়ি এসে চুপচাপ রেখে দিলে বাক্সটা। লুকিয়ে গভীর রাতে বর ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে আর মেয়ে নিজেদের ঘরে। বাক্সটা নিয়ে ধীরে ধীরে ডাইনিং রুমে এলো একটা খুব সুন্দর শোপিস দুটো পায়রার। সাদা তলায় লেখা ‘ভালো থাকিস’। আর এটা কি? একটা মালা, সাদা পুতির মালা। সেই মালাটা স্মৃতিতে ডুব দিল লেখা। হ্যাঁ, সেই মালাটাই মালাটা সে একদিন পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর বেশ কিছুদিন খুব লজ্জা পেতো কুশালের কাছাকাছি যেতে। তারপর ওরা দূরে চলে গেল। সঙ্গে একটা চিঠি।
লেখা,
হয়তো তোর মনের কোথাও আমি নেই, ছিলামও না ,তবুও যদি বিন্দুমাত্র থেকে থাকি সেটুকু বন্ধন থেকেও তোকে মুক্ত করলাম। আর হ্যাঁ আমিও বন্ধন থেকে মুক্ত হলাম, এই মালা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে সব সময় মনে হবে আমি যেন বাঁধা পড়ে আছি তোর কাছে। একটা দিনের জন্যেও মালাটাকে কাছছাড়া করিনি। কিন্তু এই বন্ধন থেকে আমি মুক্তি চাই রে!আমার ভালোবাসা ভালো আছে ,এইটাই আমার জন্য অনেক রে! মন একটা সুন্দর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আর কোন বন্ধন ,আর কোন পিছুটান আমি রাখতে চাই না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল, দেখা হয়ে গেছে । হারটা রেখে গেলাম, আর কোনদিন সেই দিনটারর কথা ভাববো না । আমি সন্ন্যাসী নই ,সন্নাস নেবো ও না,নিজের মত করে নিজের ছন্দে বাঁচবো। তবু এটা যেন অনেকটা পূর্বাশ্রমের মতোই । সন্যাসীরা একটা পর্যায়ে পৌঁছে পূর্বাশ্রমকে আর মনে রাখে না। পূর্বাশ্রমের কথা মনে করে না। আমি তেমন ই এই ঘটনাটাকে আমার জীবনের পূর্বাশ্রম মনে করব। আর পিছনে ফিরে তাকাবো না । তাই মালাটা আর কাছে রাখলাম না । এতদিন প্রাণের থেকে প্রিয় বলে যাকে আগলে রেখেছি ,আজ তা ফেরত দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস। আমি চললাম পাহাড়ে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবো, সমুদ্র সমুদ্রে ঘুরবো আমি আমার মত করে খুব ভালো থাকবো রে, আর এই বন্ধন মুক্তি আমাকে আরো ভালো রাখবে।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে লেখার। একদিকে মনে হচ্ছে সেও বন্ধন মুক্ত হলো,অবশ্য সে কি এই বন্ধনে কখন ও বাঁধা ছিল?সে তার বরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। সাজানো গোছানো সংসার আছে তার। কিন্তু তবুও ভিতরে একটা কষ্টের অনুভূতিও হচ্ছে। তবে কি তার ও অবচেতনে কোনো হালকা বন্ধন ছিল?মালাটা ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারলো না। বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে দিল। কুশল বন্ধনমুক্ত ।লেখাও বরকে খুবই ভালোবাসে, তবুও লেখার মনে বোধহয় একটা হালকা অদৃশ্য বন্ধন থেকে গেলো,নাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?