যখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র ছিলাম
-সুনির্মল বসু
আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগেকার কথা বলছি, অথচ আজ মনে হয়, এইতো সেদিন, আমি আজও যেন বন্ধুদের ভিড়ে পড়াশোনা নিয়ে হইহই করে মেতে আছি। মাননীয় অধ্যাপকদের বক্তব্য শুনছি, কলেজের সোশালের আয়োজন নিয়ে মেতে আছি, ক্যান্টিনে চল্লিশ পয়সার ঘুগনি আর চা খাচ্ছি।
কী সব স্বপ্নের দিন। মাঝে মাঝে দিনগুলোর গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে।
আটষট্টি সালে নঙ্গী স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করবার পর, বঙ্গবাসী কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। মাইনে ন টাকা। মেজ মামা বিমলেন্দু ঘোষ এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। উনি আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেন। অধ্যাপক জানকী বল্লভ চৌধুরী আমাকে ভর্তি করে নেন। পরে ক্লাসে উনি আমাদের শাক্তপদাবলী পড়াতেন।
সত্তর খানা সিঁড়ি ভেঙে পাঁচ তলায় আমাদের বাংলা অনার্সের ক্লাস হত। আমার গর্ব হত এই ভেবে, এই ঘরে বসে ক্লাস করে গিয়েছেন প্রথিতযশা গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী।
বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত কবি ও সমালোচক অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। স্যার আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী পড়াতেন। প্রথম দিন ক্লাসে এসে বলেছিলেন, এবার তোদের উপর অষ্টবজ্র সম্মীলন হবে। কলকাতা কাঁপানো আট জন দিকপাল বাংলার অধ্যাপক আমাদের অনার্সের ক্লাস নিতেন। ততদিনে জগদীশবাবুর কবি মানসী প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে কবি ও কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
আকাশে মেঘ করলে,স্যারের পড়ানো সেদিন অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেত। জানালা দিয়ে আমরা সেদিন উদাস কলকাতা শহরের আকাশ দেখতাম।
অধ্যাপক গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় আমাদের অন্নদামঙ্গল পড়াতেন। অসম্ভব সুদর্শন তিনি। পড়াতেন ছবির মতো। আজও যেন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।
অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আমাদের মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতেন। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠস্বর তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন। তাঁর জোরালো বক্তব্য একদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিশেষ মর্যাদা পেত।
আমাদের কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। তিনি পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের শিক্ষা মন্ত্রী হন। আমরা অবশ্য ওনার কাছে পড়ার সুযোগ পাই নি। অনেক পরে আমরা ছাত্র হিসেবে কলেজে এসেছিলাম।
রাজসিংহ উপন্যাস পড়াতেন অধ্যাপক
পৃথ্বীশ নিয়োগী। তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ কোনদিন ভুলতে পারবোনা। উপন্যাসের নায়ক বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের নায়ক রাজসিংহ না ঔরঙ্গজেব, বিশ্লেষণ করে দেখা।
প্রবন্ধ পড়াতে আসতেন অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র নাথ সাহা। স্যার খুব খেটে পড়াতেন। অনেকে তাঁর কথাগুলো ভারী বলে ,মনোযোগ দিয়ে শুনতো না।
পরে বুঝেছি, তাঁর কথা গুলিতে জীবনের গভীর অনুভব ব্যক্ত হোত। তাঁর কথা না শোনাটা মূর্খামি।
ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন ডক্টর অরুণ বসু। চেহারা দেখলে রাগী রাগী মনে হলেও, নরম গলায় সহজ করে পড়িয়ে যেতেন তিনি। স্যার নামকরা গীতিকার। ভাস্কর বসু নামে অজস্র ভালো গান তিনি লিখেছেন।
নামী শিল্পীরা প্রায় অনেকেই তাঁর লেখা গান
গেয়েছেন।
আমাকে একদিন ডেকে বললেন, তুই কোথায় থাকিস রে,
আমি বললাম, বাটানগর।
স্যার বললেন, ওখানে আমার এক বান্ধবী আছেন,
কুমকুম চৌধুরী। ওর হাজবেন্ড বাটা কোম্পানির ফ্যাক্টরি ম্যানেজার। নাম, ভবতোষ সেন চৌধুরী।
আমার বাবা বাটা কর্মী। বাড়ি এসে বাবাকে বললাম, ভবতোষ সেন চৌধুরীর কথা। বাবা বললেন, উনি বি এস চৌধুরী। ফ্যাক্টরি ম্যানেজার।
আমাদের নাটক পড়াতেন অধ্যাপক নলিনী রঞ্জন চক্রবর্তী। আমি তাঁর পরম ভক্ত ছিলাম। তিনি আমাদের নীলদর্পণ নাটক পড়াতেন। বাংলা নিয়ে পড়া আমার সার্থক হয়েছে, আমি স্যারের অসম্ভব ভালো নাটকের ক্লাস দিনের পর দিন শুনেছি। স্যারের উঁচু লম্বা চেহারা, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি,
অসম্ভব সুন্দর উচ্চারণ ভুলতে পারিনা। একটা সংলাপ শিশির ভাদুড়ী কিভাবে বলতেন, অহীন্দ্র চৌধুরী কিভাবে বলবেন, নির্মলেন্দু লাহিড়ী কিভাবে বলবেন, তিনি সেভাবে দেখাতেন। বাড়িতে এসে কোনদিন পড়বার দরকার হয়নি। ক্লাসেই পড়া তৈরি হয়ে যেত। একদিন এসে বললেন, আমার দাঁতের গোড়ায় ব্যথা। আজ তোরা বল্, আমি শুনি। আমরা বলতেই, তিনি নিজস্ব ঢঙে প্রতিদিনকার মত অসম্ভব সুন্দর পড়িয়ে গেলেন। স্যারের কাছে যে,
আমাদের আজন্ম ঋণ। ভুলতে পারিনা। যদি ভুলে যাই, তাহলে যে পাপ হয়ে যাবে। সাত হাত ভাগ্য আমার, এমন মানুষের পায়ের কাছে বসে বাংলা পড়েছি।
অনার্সের পাশাপাশি ইংরেজির ক্লাসে পেয়েছিলাম অধ্যাপক এস ব্যানার্জি, অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী, অধ্যাপক অশোক ঘোষ, অধ্যাপক এস মজুমদারকে। অধ্যাপক এস ব্যানার্জি আমাদের চার্লস ল্যাম্ব পড়াতেন। জুলিয়াস সিজার পড়াতেন অধ্যাপক এস মজুমদার। অধ্যাপক অশোক ঘোষ পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। অধ্যাপক ভবানী শংকর সেন চৌধুরী আব্রাহাম লিংকন পড়াতেন। উনি পড়া ধরতেন।
পড়া না পারলে, কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হত। সমস্যা হল, আশ পাশের বাড়ির ছাদ থেকে মহিলারা আমাদের করুণ অবস্থা দেখে হাসতেন।
কলেজে পেছনের বেঞ্চে বসলে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেত। আমাদের তখন কাঁচা বয়স। দুপুর সাড়ে বারোটায় আকাশবাণী থেকে রবীন্দ্র সংগীত বাজানো হতো। আমাদের বন্ধুরা অনেকেই পাশের বাড়ির দিদি স্থানীয়দের দেখলে বলতো, দিদি, কাইন্ডলি একটু রেডিওটা চালিয়ে দিন না। এইভাবে কতদিন আমরা চিত্রলেখা চৌধুরী, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, রাজেশ্বরী দত্তর গান শুনেছি।
কী সব মুগ্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ানোর দিন। সেদিন আমরা সত্তর দশকের তরুণ। আজকাল কোমরের ব্যথা, পেটের গন্ডগোল, অম্বল চোয়া ঢেকুর নিয়ে অবস্থা বড় করুণ।
আশ্চর্যভাবে একদিন জানা গেল, স্যার নেতাজির ভক্ত। আমাদের ক্লাশের দুলাল দা স্যার ক্লাসে ঢুকলেই বলত, আজ কাগজে লিখেছে,শৌলমারীর সাধুই নেতাজী।
স্যার তখন সারা পিরিয়ড জুড়ে নেতাজির আলোচনায় মেতে যেতেন। আমাদের আর কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হতো না।
প্রেসিডেন্সি কলেজ আর হেয়ার স্কুলের মাঝখানে একটা বিশাল মাঠ। সেখানে ফুটবল খেলা হোত। ক্রিকেট খেলা নিয়ে কোন দিনই আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
কিন্তু ফুটবল খেলার ব্যাপারে আমি ছিলাম অতিরিক্ত উৎসাহী। বর্ষার দিনে দাপিয়ে ওই মাঠে ফুটবল খেলেছি। বাঁ পায়ের জোর ছিল। খেলার শেষে গা-হাত-পা ধুয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে জোর দার খাওয়া দাওয়া হোত। পরদিন বসুমতী কাগজে খেলার পাতায় আমাদের নাম ছাপা হলে, নিজেদের মনে হতো, কী একজন তালেবর হয়ে উঠেছি।
কিংবদন্তী ইংরেজীর অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী ততদিনে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে কলেজে আসতেন। আমাদের করিডোরে ঘুরতে দেখলেই বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে। আজ যখন স্যারের নামে রাজকুমার চক্রবর্তী সরণি দিয়ে হাঁটি, তখন সে দিনে খুব কাছে থেকে দেখা স্যারের কথা গুলো মনে বাজে। স্যারের কাছে পড়তে পারিনি, কিন্তু তাঁর পরামর্শ, খুব কাছাকাছি থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ তো পেয়েছি। এসবের মূল্য যে অনেক।
ইতিহাসের ক্লাস নিতেন অধ্যাপক প্রেম বল্লভ সেন।
অসম্ভব পড়াশুনা ভদ্রলোকের। দুরন্ত পরিশ্রম করে ক্লাস নিতেন। ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক আশিস মুখোপাধ্যায়। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, তুই ফুটবল খেলিস, তোর চেহারাটা ফুটবল প্লেয়ার দের মতো।
পরবর্তীকালে আমাদের কলেজের ফুটবল কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি লিংক ম্যান পজিশনে খেলতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। খেলার পর ডিম পাউরুটি খাওয়া হোত।
অধ্যাপক অক্ষয় জীবন বসু বহুদিন আগে কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক। আমাদের প্রিন্সিপাল তাঁর ছাত্র। এক টাকা সন্মান দক্ষিণা নিয়ে তিনি সপ্তাহে একদিন প্রিন্সিপালের অনুরোধে কলেজে ক্লাস নিতে আসতেন। আমি যখন তাঁকে দেখেছিলাম, তখন অতিশয় বৃদ্ধ তিনি। অথচ, তাঁর ক্লাস করবার জন্য থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তিনি করিডোরে ঘোরাঘুরি পছন্দ করতেন না। বলতেন, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসো।
গরীব বাড়ির ছেলে আমি। একদিন ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সুদেব ঘোষ কে বাড়ির অবস্থার কথা বললাম। উনি হাফ ফ্রী করে দিয়েছিলেন।
আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বসু।একুশ নম্বর গ্যালারি রুমে তাঁর ছবির মত ওড টু দ্য নাইটেঙ্গেল কবিতার ক্লাসের কথা মনে পড়ে। ছবির মত পড়াতেন স্যার। মনে আছে, একদিন পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, এ ডাফট অব ভিন্টেজ। বলেছিলেন,
মাটির নিচে থাকা এক ধরনের মদ, তারপর বলেছিলেন, আমি অবশ্য কখনো খেয়ে দেখি নি।
স্যারের ক্লাস থাকলে, প্রেসিডেন্সি, সুরেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্ররা স্যারের ক্লাস শুনতে আসতো।
আমাদের কলেজের চত্বরে রেক্টর গিরিশ চন্দ্র বসুর
মূর্তির পাশে আমাদের প্রিন্সিপাল প্রশান্ত কুমার বসুর মূর্তি রয়েছে। কলেজে আজও গেলে, এখানে দাঁড়িয়ে নতমস্তক হই। কত যে ঋণী করে গেছেন,
এইসব নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদেরা। ভুলতে পারিনা।
বন্ধু-বান্ধবদের কথায় আসি।
আমি বাটানগরের ছেলে। ডানকুনির অশ্বিনী কুমার গুপ্ত আমার বঙ্গবাসী কলেজের প্রথম বন্ধু। বেলেঘাটার স্বপন সরকার, হাওড়ার তপন ঘোষ, বিরাটির অজয় কুমার বিশ্বাস, মহিষাদলের অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার সুভাষ দাস, আমরা খুব কাছাকাছি বন্ধু ছিলাম।
তপন পত্রিকা বের করত। সে সময় নিজেও ভালো কবিতা লিখতো। সজল কান্তি শ্যাম, আমার বন্ধু, আজো ভালো কবিতা লেখে।
একদিন অনার্স নিয়ে পাশ করলাম। কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। বঙ্গবাসী কলেজের স্মৃতি আজও টুকরো-টুকরো মনে ভাসে।
গায়ক অর্ঘ্য সেন, বিধায়ক অশোক দেব, মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা জহর গাঙ্গুলী, বিচারপতি সুধীর রঞ্জন দাস, অভিনেতা অসিত বরণ, সাংবাদিক বরুন সেনগুপ্ত, সাংবাদিক সুদেব রায় চৌধুরী, আরো কত খ্যাত কীর্তি মানুষ এই কলেজের ছাত্র।
আমার কলেজ আমার যৌবনের স্মৃতি। আমার কলেজ আমার গর্ব। কলেজের সামনে আজও গেলে, বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চোখে জল আসে।
সকালবেলায় রেডিওতে সুবীর সেন, শ্যামল মিত্র, কিংবা আরতি মুখার্জির গান শুনে, ছুটে নটা এক চল্লিশ এর ট্রেন ধরা, এবং অনার্সের ক্লাসে পৌঁছে যাওয়া।
আহা, সত্তরটা সিঁড়ি পেরিয়ে আবার যদি অনার্সের ওই ক্লাসের মুগ্ধ দিনগুলি ফিরে পেতাম।
নাট্যকার রতন কুমার ঘোষের আলোকিত যৌবন নাটকে খ্যাতিমান অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়লগ মনে পড়ে, যখন নায়িকা বলছেন, আমি তাহলে কি নিয়ে থাকবো?
বিষন্ন নায়ক বলছেন,আমার আলোকিত যৌবন। যা শুধু দেয়, কখনো হারায় না।
সত্যি বলছি, বঙ্গবাসী কলেজের এতোটুকু স্মৃতি আমি আজও হারাইনি, মৃত্যু পর্যন্ত এই সুখময় স্মৃতিটুকু বহন করে নিয়ে যাবো।
প্রিয় শিক্ষা মন্দিরকে লক্ষ কোটি প্রণাম।