কাছের মানুষ
– মুনমুন রাহা
সূর্য দেব আজ যেন তার সমস্ত তেজ নিয়ে উপস্থিত হয়ে গেছেন সকাল সকাল। মাথার উপরের ছাতাটা কোন কাজই করছে না। শরীরের চামরাটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য অন্তরার কেবলমাত্র শরীরটাই নয় জ্বলছে তার বুকের ভিতরটাও। রোজ রোজ আর অপমান সহ্য হচ্ছে না তার। মাত্র তিন মাসের বিবাহিত জীবনেই হাঁপিয়ে গেছে সে। যদিও সমস্যাটা তার স্বামীর সাথে নয়। তার শাশুড়িমা অলোকা দেবীর সাথে । বিয়ের পর থেকে হাজার চেষ্টা করেও ভদ্রমহিলার মন পায় না অন্তরা । অথচ উঠতে বসতে অন্তরার কাজের , রূপের, গুনের , চাকরির কেবল দোষ ত্রুটি ধরে যান ভদ্রমহিলা । মাঝে মাঝে মনে হয় কৃষ্ণা বৌদির দেখানো পথ অবলম্বন করতে। কৃষ্ণ বৌদি এই পাড়াতেই থাকে। স্বভাবটা ভারি মিষ্টি। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। কৃষ্ণা বৌদি প্রায়ই যায় অন্তরাদের বাড়ি । একদিন বাড়িতে কেউ নেই দেখে অন্তরাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে , নতুন বৌ মুখ কালো করে ঘুরছে কেন? অন্তরাও সেদিন কৃষ্ণা বৌদিকে তার সমস্যার কথা বলে । সব শুনে সেদিনই কৃষ্ণা বৌদি বলে , অন্তরার স্বামী বিতানকে সব কিছু জানিয়ে মানে মানে অন্তরার আলাদা সংসার পাতাই ভাল।
কথাটা শুনে আলাদা সংসার পাতার যে লোভ হয় নি অন্তরার তা নয়। কিন্ত ঐ যে বাবা মায়ের শিক্ষাটা মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মনে হল যাক বয়স্ক বিধবা মানুষটার জীবনে ছেলে বিতান ছাড়া আছে কে! দেখা যাক আর একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে । কিন্ত এখন মনে হচ্ছে অনেক হয়েছে , রোজ রোজ অশান্তির থেকে আলাদা থাকাই ভাল। অভিমান , আর কষ্ট গুলো বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকেছে। এমন সময় চেনা ডাকটা কানে এল,
” অন্তরা , এই অন্তরা । ”
হ্যাঁ ঠিক, কৃষ্ণা বৌদির গলা। গেট থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকছে। অন্তরা কাছে যেতে জিজ্ঞেস করল ,
” কি গো আজ এত সকাল সকাল চাকরিতে যাচ্ছ যে ! ”
ম্লান হেসে অন্তরা বলে ,
” এই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি , অফিসে গিয়ে তো একটু শান্তিতে থাকতে পারব। বাড়িতে তো তার উপায় নেই। ”
কৃষ্ণা বৌদি জোর করে হাত ধরে নিয়ে যায় ঘরে । তারপর বলে ,
” চুপ করে বোস । মুখ দেখেই বুঝেছি কিচ্ছু খাসনি। আমি খিচুড়ি করেছি চুপচাপ খেয়ে তারপর যাবি অফিসে। ”
অন্তরার আপত্তিতে কোন কর্ণপাত না করে কৃষ্ণা বৌদি একবাটি খিচুড়ি এনে দেয়। তারপর নরম সুরে বলে ,
” আজ আবার কি হল রে ?”
অন্তরার চোখ বেয়ে জল হয়ে নেমে এল গলার কাছে জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অন্তরা বলে ,
” কৃষ্ণা বৌদি তুমি তো জান , বিয়ের পর থেকে আমি কম কিছু সহ্য করি নি। ভালবেসে বিয়ে করেছি বলে আমাকে উঠতে বসতে কম কথা শোনায় না আমার শাশুড়ি । আমাদের হানিমুনে যাওয়া নিয়েও কত কাণ্ড করল , আমারা যেই অফিসের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলাম সেই তার শরীর খারাপ। আমি তো প্রথমে সত্যিই ভেবেছিলাম। কিন্ত ঐ যে সত্যি কথা চাপা থাকে না । তাই তোমার কাছেই গল্প করল, যে এটা তার আমাদের একসাথে না ঘুরতে যেতে দেওয়ার প্ল্যান। আর ভাগ্যিস তুমি আমাকে বললে সে কথা ! না হলে তো আমার শাশুড়ি মায়ের স্বরূপ জানতেই পারতাম না।
শুধু তাই আমাকে দিয়ে ইচ্ছা করে ঘরের যাবতীয় কাজ করান , যাতে আমার অফিসের দেরি হয়ে যায়। চাকরিটা না থাকে। তুমি তো সবই জানো। তোমাকেই তো বলে এসব ।
আজ কি বলছে জানো, বলে আমার নাকি চরিত্রের ঠিক নেই। আমি অফিসে যাই ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে। আজ আমিও মাথার ঠিক রাখতে পারে নি কৃষ্ণা বৌদি । শুনিয়ে দিয়েছি দুকথা। কতদিন আর মুখ বুজে থাকব বলো তো ! আমার এমনই কপাল বাপের বাড়িতেও বলতে পারি না সব কিছু। এক তো নিজে দেখে বিয়ে করেছি তার উপর বাবা মাকে আর নিজের সমস্যার মধ্যে জড়াতে চাই না। ওদেরও তো বয়স হচ্ছে। ”
কৃষ্ণা বৌদি অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,
” আমি তো আগেই বলেছিলাম আলাদা সংসার পাত। বিতান কে বল হয় তোকে অথবা মাকে রাখুক তার জীবনে। ”
” আসলে বিতান ওর মাকে বড্ড ভালবাসে গো তাই , মানে ওর কথা ভেবেই এতদিন কিছু বলি নি। কিন্ত আজ তোমার কথা মানতেই ইচ্ছা করছে। দেখি অফিস থেকে ফিরে আসি, বিতানকে বলব সব কিছু। সত্যিই এবার মুক্তি চাই। আজ তো রাগ করে শুধু ডাল ভাত রান্না করে চলে এসেছি ।”
” বেশ করেছিস। আমি তো তোকে অনেকদিন বলেছি বেরিয়ে আয় । শোন অন্তরা তুই আমার বড় কাছের মানুষ, তোকে বড় ভালবাসি বলেই বলছি , তোর শাশুড়ি আমার কাছে তোর নামে কম নিন্দা করে নি রে । তোকে তো আমি বলেছি সবই । তোদের নাকি বংশ খারাপ, তোর বাবা মা নমস্কারীতে কম দামী জিনিসপত্র দিয়েছে। বিতানের সাথে তোকে মানায় না এমন কতো কিছু। আমার তোর নামে এসব শুনতে ভাল লাগে না। তাই বলছি , তিনটে মাস তো সহ্য করলি এবার নিজের মতো করে সংসার কর। ”
অন্তরা নিজের কাজে বেরিয়ে যায়। কিন্ত অফিসে গিয়ে থেকে শরীরটা খুব একটা ভাল লাগছে না। সে ঠিক করল বাড়ি চলে যাবে। মনের ভিতরটাও কেমন যেন একটা খচখচ করছে। রাগের মাথায় শুধু ডাল ভাত রান্না করাটা কেমন যেন একটা অপরাধ বোধে ভোগাচ্ছে । হাজার হোক একটা বয়স্ক মানুষ দুপুর বেলা খাবে তো ! তার বাবা মায়ের শিক্ষা , নিজের কর্তব্য নিজের কাছে। সাতপাঁচ ভেবে অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলো অন্তরা।
বাড়িতে গিয়ে বেল দেওয়ার দরকার বা ইচ্ছা কোনটাই হল না। তার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে । অন্তরা ভিতরে ঢুকেই বুঝল কেউ এসেছে যার সাথে তার শাশুড়ি অন্তরার নামেই কিছু বলছেন বেশ জোর গলাতে।
” ভাগ্যিস তুমি আছো । তাই তো জানতে পারলাম আমার বৌয়ের কৃতি কলাপ। ছিঃ ছিঃ ভালোবাসার বিয়ে, এখনও বছর গড়াল না এর মধ্যেই অন্য পুরুষের সাথে লটঘট! আমার ছেলেটার কথা একবার ভাবল না !”
অলোকা দেবীর বোধহয় চোখের জল মুছতে সময় নিলেন। এরমধ্যেই শোনা গেল আর একটা খুব পরিচিত গলার আওয়াজ।
” আর কি বলব মাসিমা , সে দৃশ্যের কথা আমি মুখে আনতে পারব না আপনার সামনে । বলেছিলাম না বংশটাই খারাপ। আমার তো অনেক পরিচিত লোকজন আছে ওখানে তাই যখন শুনলাম বিতান বিয়ে করেছে ঐ উত্তর পাড়ার দিকে তখনই খোঁজ করে খবর এনেছি। ঐ মেয়ের চরিত্র বিয়ের আগেও ভাল ছিল না। আর ওর বাবা এক নম্বরের কৃপন। বললাম না আপনাকে নমস্কারীর শাড়ি গুলো কেমন যেন পুরোন পুরোন। পরে তো আপনার বৌমাই আমাকে বলেছে , শাড়ি গুলো সব চৈত্র সেল থেকে কেনা। দেখুন মাসিমা , আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসি আপনার সম্পর্কে কুকথা শুনতে মন চায় না। কিন্ত বাবাঃ , আপনার বৌমা তো আপনার সম্পর্কে নিন্দে করা ছাড়া কিছু জানে না। আমি তো বলি এমন বৌ থাকার থেকে না থাকা ভাল। দূর করে দিন তো ছেলের জীবন থেকে ।
যাকগে , একটু খিচুড়ি এনেছিলাম আপনার জন্য। আপনার বৌমা কি রান্না করেছে তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে যাই। আপনি যে আমার বড় কাছের মানুষ। খাবেন কিন্ত। ”
” আর মা রান্না! আজ তাকে দুটো সত্যি কথা বলেছি না! ঐ যে তার চরিত্র তুলে কথা বলেছি বলে তেজ করে সে ডাল ভাত রান্না করে গেছে। সবই আমার পোড়া কপাল। ভাগ্যিস তুমি ছিলে মা। ”
অন্তরা এতক্ষন সবটাই খুব অবাক হয়ে শুনছিল । তার এত কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি এসব কি বলছে । নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তার । আর সহ্য হল না ,এবার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। বলে ,
” আরে বাবা , এইটুকুই! আরও কিছু কথা কৃষ্ণা বৌদিকে জিজ্ঞেস করো মা ! আজকে যে আমি কিছু রান্না করি নি তোমার খাওয়ার অসুবিধা হবে , কৃষ্ণা বৌদি কেমন করে জানল ? বল , বল কৃষ্ণা বৌদি কি করে জানলে ? বলবে না ? তাহলে আমিই বলি , কারণ সেটা আমার কাছ থেকে জেনেছে। আমাকে সকালে ডেকে ভালবেসে খিচুড়ি খাইয়ে জেনেছে সংসারে কি হল , তারপর তোমার নামে কত নিন্দে করল আমার সাথে মিলে । আবার এও পরামর্শ দিল যে আমার উচিত এবার বিতান কে নিয়ে আলাদা থাকা । হ্যাঁ , আমিও তোমার মতোই ভরসার মানুষ মনে করে সংসারের সব কথা বলি যে কৃষ্ণা বৌদিকে।
আমার চরিত্র তুলে কথা বলেছিলে বলে খুব রাগ হয়েছিল সকালে তোমার উপর। সেটা শুনে কৃষ্ণা বৌদিতো আকাশ থেকে পড়ল। কিন্ত এখন বুঝতে পারছি আমার নামে চরিত্রহীনের আপবাদটা কে দিয়েছে। আচ্ছা কৃষ্ণা বৌদি , তুমি কবে আমাকে কার সাথে দেখেছ গো । আমাকে একটু বলতো ! আর কি করতে দেখেছো সেটাও বল ।”
কৃষ্ণা বৌদির তখন পালাই পালাই অবস্থা একবার ঢোক গিলে বলে ,
” কে জানে হয়তো ভুল দেখেছিলাম। আমার চোখের কি ঠিক আছে !”
অন্তরার শাশুড়ি অলোকা দেবী বেশ হতবাক। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না । অন্তরা আবার বলে ,
” আমার তো এটাও সন্দেহ হচ্ছে তোমার চোখের দৃষ্টির সাথে কানটাও মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা শোনে । আচ্ছা মা , তুমি কি আমাদের হানিমুনে যাওয়ার নাম শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। মানে নাটক করেছিলে!”
অলোকা দেবী রেগে আগুন। বলেন,
” কি যা তা বলছো ? আমাকে কি ভাব তুমি ? আমি কি মানুষ নয়? তোমরা দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে সদ্য বিয়ে করেছ বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করেছ আর আমি তাতে ব্যাগরা দেব ইচ্ছা করে! তোমার কথা যদি ছেড়েও দি , আমি আমার ছেলের ভাল লাগা খারাপ লাগার মূল্য দেব না? কত আশা করে ছেলেটা টিকিট কেটেছিল বেড়াতে যাবার আর আমি মিথ্যে অসুখের অভিনয় করে তাকে যেতে দেব না ? ”
অন্তরা হেসে বলে ,
” আমি বলছি না , এই যে আমার আর তোমার শুভাকাঙ্খী , কাছের মানুষ কৃষ্ণা বৌদি বলেছে । আরও বলেছে এসব কথা তুমিই বলেছ তাকে ! ”
” কৃষ্ণা , এসব বলেছি আমি ? কেন এরকম মিথ্যা বলেছো আমার নামে ? আমার তো এখন বৌমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বৌমার নামেও আমার কাছে মিথ্যে বলেছো। ”
কৃষ্ণা বৌদি নিজের পিঠ বাঁচাতে বলে ,
” দেখুন মাসিমা , আপনার আর অন্তরার ব্যাপারে আমাকে টানবেন না । আপনাদের সংসার আপনারাই বুঝুন। ”
বলে আর দাঁড়ায় না কৃষ্ণা হনহনিয়ে বেরিয়ে পরে সে। অলোকা দেবী এখনও বিস্মিত। বলে ,
” মানুষ এমনও হয় ! আমি তো অগাত বিশ্বাস করতাম কৃষ্ণাকে। তার মুখের হাসিতে আর ভাল ব্যবহারে তাকে আপন মনে করে সব কথাই বলতাম। আর তার এই ফল ! ”
অন্তরা বলে ,
” আমিও তো তাই করেছিলাম। কিন্ত আজ কৃষ্ণা বৌদির ভাল মুখোশের আড়ালে নোংরা চেহারাটা দেখলাম। অবশ্য ভুল আমরাও করেছি। নিজের ঘরের কথা বাইরের লোককে আপন মনে করে বলাটাও হয়তো ভুল হয়েছিল আমাদের। এবার থেকে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটাতে চেষ্টা করব । তাহলে আর কোন কৃষ্ণা বৌদি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না । ”
“আচ্ছা কৃষ্ণার এমন করে লাভ কি হল ” বলেন অলোকা দেবী,
” আসলে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের লাভের থেকে অন্যদের ক্ষতিতে বেশি সন্তুষ্ট হয়। এদের লোকের ঘরে আগুন লাগিয়েই আনন্দ। ”
” যাক , আমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে এটাই বড় কথা । তবে একটা শিক্ষা হল , সংসারে থাকতে গেলে হয়তো আবার মনোমালিন্য হবে । কিন্ত তা মেটানোর দায়িত্ব আমরা দুজনেই নেব , তাই না বৌমা ! ” বলেন অলোকা দেবী ।
অন্তরা হেসে বলে ,
” একদম ঠিক। আমাদের সমস্যা আজ থেকে শুধু আমাদেরই । দরকার নেই আর কোন কাছের মানুষের। ”