দুঃখী মানুষের ফুটো নৌকো
-সুনির্মল বসু
ওকে কেউ ডাকে, বসন্ত। আবার কেউ কেউ ডাকে, বিলাস। দুটি ডাকেই ও সাড়া দেয়। ওর আসল নাম, বসন্ত বিলাস সামন্ত।
গরীব বাড়ির ছেলে বসন্ত। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণে পড়াশুনো বেশি দূর করতে পারে নি। বাবা নিবারণবাবু চাষবাস করে জীবন চালাতেন। বয়স বেড়েছে। দেশে করোনা এলো, লকডাউন হোল। ওর বউ এলোকেশী কর্তাকে এর পর আর বাইরে বেরোতে দিতেন না।
ইদানীং বসন্ত জমিজারাত দেখাশোনা করছে। সেবারে মাঠে ভালো ফসল হবার সম্ভাবনা ছিল। আমফান ঝড়ে জমিজমা ঘরবাড়ি সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
বসন্ত ভাবে, আগেকার মানুষদের এত সবকিছু দেখতে হয়নি। এই প্রজন্মের মানুষকে এক জীবনে কত কিছু দেখতে হলো।
কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। একদিন তাই ট্রেনে উঠে বসল বসন্ত। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গ্রেস সিনেমা ছাড়িয়ে রাস্তার দুদিকে ব্যান্ড পার্টির দোকান
দেখতে পেলো।
একসময় আড় বাঁশী বাজাতো ও।
মিউজিকের প্রতি ওর একটা আলাদা টান আছে বরাবর।
সামনে রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকান। বিয়ে বাড়ি অন্নপ্রাশন, উৎসবে অনুষ্ঠানে অর্ডার পেলে, এখানকার ব্যান্ড পার্টি সে বাড়িতে বাজাতে যায়।
বসন্ত সকালে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। এখন দুপুর দেড়টা বাজে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। অভিরুচিতে ঢুকে ও চারটে কচুরি খেয়ে নিল। তারপর রাজ ব্যান্ড পার্টির দোকানে ঢুকলো।
দোকানের মালিক সানাইয়া চায়না বিহারের ছাপরা জেলার মানুষ। কলকাতায় অনেকদিন আছেন।
ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেনা। বললেন,
কি চাই আপনার?
বসন্ত বলল, আমাকে একটা কাজ দিন।
বাজনায় ইন্টারেস্ট আছে?
অল্প সল্প আছে।
বাড়ি কোথায়?
ধপধপি, ডায়মন্ড হারবার।
দেখুন, আপনি কেমন বাজান, আমার কোন আইডিয়া নেই। আমার টিম যখন বাজাবে, আমাদের ব্যান্ড মাস্টার যখন ড্রাম বাজাবে, আপনি পিঠে করে ওই ড্রাম বয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি বাজাতে পারব না?
নিশ্চয়ই পারবেন। তার আগে আপনাকে কাজটা তো শিখতে হবে। রাজি হলে বলুন?
বাড়িতে যখন হাঁড়ি চড়ছে না। এক কথায় বসন্ত সেদিন রাজি হয়ে যায়।
বেতনপত্র ঠিক হয়ে যায়। পরদিন সে কাজে জয়েন করে। সেদিন রাতেই কলাবাগান বস্তিতে একটা বিয়ে বাড়িতে ওদের ডাক পড়ে। আগের দিনে
ওকে কারুকার্য করা পোশাক, মাথায় টুপি, এবং পায়ে পরবার জন্য একজোড়া জুতো দেওয়া হয়েছিল।
নতুন ড্রেস পরে আয়নায় বসন্ত নিজেকে দেখলো। কী ভালো যে লাগছে নিজেকে দেখতে। ও মনে মনে বলল, শালা, অক্ষয় কুমার, না অজয় দেবগন!
ব্যান্ড মাস্টার ওস্তাদ ওকে বলল, পিছন ঘুরে দাঁড়া,
আমি তোর পিঠে ড্রাম বেঁধে দিই।
বসন্তের চাকরির জীবন শুরু হয়ে যায়। এইতো সেদিন হাতিবাগানে একটা বিয়ে বাড়িতে ওরা বাজিয়েছিল, ক্যায়সে বনি,ক্যায়সে বনি, ফুলুরি বিনা চাটনি ক্যায়সে বনি। সবাই প্রশংসা করছিল,
ব্যান্ড মাস্টারের।
বসন্ত তো কিছু বাজায়নি। ও শুধু ড্রামটা বয়ে নিয়ে গেছে। ওর মনে অনেক স্বপ্ন, একদিন ও এই কলকাতা শহরে বড় বড় বিয়ে বাড়িতে নিজেই ড্রাম বাজাবে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে কলকাতায় বাসা ভাড়া নিল ও। রাতবিরেতে ডিউটি পড়ে। বাড়ি ফেরা যায় না।
তাছাড়া, যখন সকালে কাজ থাকে না, তখন ও ওস্তাদের কাছ থেকে ড্রাম বাজানো শেখে, প্র্যাকটিস করে। এরই মধ্যে অনেকগুলি গান ও তুলে নিয়েছে।
দেবানন্দের গাইড ছবির গান, দিন ঢল যায়ে, রাত না আয়ে, তু তো না আয়ে, তেরি ইয়াদ সতা।
আবার রাজেশ খান্নার গান ওর খুব প্রিয়। নতুন করে গানটা তুলেছে, জিন্দেগি এক সফর হায় সুহানা,ইহা কাল কেয়া হো, কিস্ নে জানা।
ওদের দলে ট্রাম্পেট বাজায় চমন লাল। ঝাড়খণ্ডের গোইলকেরায় বাড়ি। স্যাক্সোফোন বাজায় দুর্জয় সিং। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে বাড়ি। ফুলুট বাজায় রাজমোহন। ছত্রিশ গড়ের মানুষ।
বসন্ত স্বপ্ন দ্যাখে, একদিন ওদের মতো বাজিয়ে শহর মাত করে দেবে ও। বাসায় ফিরে নিজের হাতে
রান্না করে খায় বসন্ত। রাতে তিনটে রুটি করে। মোড়ের দোকান থেকে তরকা কিনে আনে। পেটটা ভরে যায় কোনরকম।
একদিন পাশের গলির একটি মেয়ে ওকে দেখে হেসে ফেলে। বলে, সেদিন চিৎপুরে বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলুম, তুমি পিঠে করে ড্রাম নিয়ে যাচ্ছিলে,
আর একটা লোক গান বাজাচ্ছিল।
কোন্ গানটা?
মেরা জুতা হায় জাপানি, পাতলুন হিন্দুস্তানি। তারপর মেয়েটি প্রশ্ন করল, তুমি নিজে কেন বাজাও না গো!
বাজাবো, বাজাবো। সময় আসুক। এরপর বসন্ত প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কি?
আমার নাম কুসুম।
সুন্দর নাম তো! আমি এই গলিতে থাকি, এসো একদিন।
সেদিন রাতে মানিক তলায় একটা প্রোগ্রাম করে ফিরছিল বসন্ত। পথে কুসুমের সঙ্গে দেখা। ও প্যারামাউন্ট হল থেকে সিনেমা দেখে ফিরছিল।
খুব সুন্দর সেজেছে কুসুম। ওকে দেখে খুব ভালো লাগলো বসন্তর।
কোথায় গেছিলে?
সিনেমায়।
একা!
হ্যাঁ,
একা সিনেমায় যেতে ভালো লাগে?
কেন তুমি যাবে?
বললে যেতে পারি।
সামনের রোববার চলো।
যাবো। তুমি আমায় ডেকে নিয়ে যেও।
ঠিক আছে। ওই কথা থাকলো।
রোববার ইভিনিং শোতে ওরা সিনেমায় গেল।
পান্না সিনেমার রাস্তায় ফুচকা খেলো।
এরপর একদিন বসন্ত ওকে ভালোবাসার কথা জানালো। কুসুম বলল, আমার বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে কথা বলো।
বসন্ত একদিন ও বাড়িতে গিয়ে ওর মায়ের অনুমতি নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে কুসুমকে বিয়ে করল। বসন্ত বিয়ের কথা বাড়িতে জানিয়েছিল। শুনে বাড়ির লোক সবাই রেগে গিয়েছিল। কেউ আসে নি।
মা বলেছিল, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিল!
বসন্ত কুসুমের সংসার চলছিল কোনমতে। অভাব ছিল, দারিদ্র ছিল। প্রথম প্রথম ভালবাসাও ছিল।
কতদিন হয়ে গেল, বসন্ত অনেকগুলো বাজনা শিখেছে।
মাঝে মাঝে সকালে বাজায়, সাজন রে ঝুট মত বোলো, খুদা কি পাশ জানা হায়। কিংবা,
কখনো বাজায়, মিঠুনদার গান, আই এম এ ডিসকো ড্যান্সার।
অনেকবার ও ওস্তাদকে বলেছে, আমাকে একটু ড্রাম বাজাতে দাও না, গুরু!
ওস্তাদ বলেছে, সে কিরে! তুই কবে আবার বাজনা শিখলি রে, সবাই শাল্লা এক লাফে আর্টিস্ট হতে চায়!
দুর্জয় সিং সেক্সোফোন বাজায়। একদিন বসন্তকে ডেকে বলল, তোকে বাজনা শেখাবো। কাল সকালে তোর বাসায় যাবো। একটু মাল খাবার অ্যারেঞ্জমেন্ট করিস্!
আমি ওসব খাই না।
দুর্জয় সিং হেসে ফেললো, মিউজিক লাইনের লোক, মাল খাস না! হে হে।
পরদিন এসে দুর্জয় কিন্তু দারুণ বাজালো। কুসুম ওর জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করেছিল।
দুর্জয় সিংকে দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল কুসুমের।
কত বড় বড় জায়গায় বাজায়। কত নতুন নতুন সুর তোলে। আর আমার বরটা আজ অবধি কিছু করতে পারলো না, শুধু ড্রাম বয়ে বেড়ালো।
অন্যদিকে, দুর্জয় সিংয়ের নজর পড়েছিল কুসুমের শরীরটার উপর। সকাল দুপুর নেই, যখন তখন ও বাড়ি ঢুকে পড়তো দুর্জয় সিং।
বসন্ত সব দেখছিল। ও বুঝতে পারছিল, ক্রমশ ও খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পায়ের তলায় জমি থাকছে না। বাড়তি উপার্জন নেই। নিত্যদিনের অভাবের সংসার।
শেষবারের মতো শেষ চেষ্টা হিসেবে ও কুসুমকে বোঝাতে গিয়েছিল,
এসব ঠিক হচ্ছে না কুসুম!
কোনটা?
লোকটাকে পাত্তা দিচ্ছ কেন?
সম্মান দিয়ে কথা বলো। উনি একজন শিল্পী।
আর আমি?
তুমি কিছু না, ফালতু, বুঝলে ফালতু!
দিনসাতেক বাদে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বসন্ত দেখলো, কুসুম ঘরে নেই।
শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হোল।
একদিন শহর মাতাল করে ড্রাম বাজাবো, স্বপ্ন ছিল বসন্তর। ভালোবাসা দিয়ে একটা সংসার গড়ে তুলবো, কত গভীর করে ভেবেছিল ও। না, ওসব কিছু না। পয়সা না থাকলে, যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে, জীবনের পরিণতি হয়তো এমনটাই হয়!
এবার সে কিভাবে মা-বাবার সামনে দাঁড়াবে? কি বলবে, বাড়ির মানুষদের, প্রতিবেশীদের?
পরদিন সে ব্যান্ড পার্টি অফিসে গেল। বলল, আমি আর কাজ করব না।
কেন রে, কি হলো?
শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার পাওনা গন্ডা দিয়ে দিন। আমি বাড়ি যাবো।
মাসের মাইনে নিয়ে বাসা বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে বসন্ত শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বসলো।
জানালার কাছে বসে দূরের আকাশ গাছপালা দেখছিল ও তখন। মনে মনে বলছিল, আমি একটা বাড়ি ছেড়ে, আর একটা বাড়িতে উঠেছিলাম। সারা জীবন আমি একটা ঘর খুঁজছিলাম। সারা জীবন মানুষ বাড়ি বানায়, বাড়ি খোঁজে, সত্যি সত্যিই ঘর পায় কজন!
ততক্ষণে ট্রেন তিনটে স্টেশন পেরিয়ে গিয়েছে।