জনৈক শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু
-সুনির্মল বসু
অনেকদিন আগেকার কথা।
তখন আমাদের আশ্চর্য এক শৈশব ছিল। মানুষের শৈশবে কত যে রহস্য থাকে, সামান্য জিনিসের মধ্যে অসামান্যতা খোঁজা, এই বয়সের একটা ধর্ম।
মফস্বলে একেবারে অজপাড়া গায়ে থাকি। পাড়ার পেছনের দিকে একজন বিখ্যাত সাঁতারু থাকেন। বরুণ বর্মন। পাশের নদীতে তিনি ক্রমান্বয়ে দশ বারো বার সাঁতরাতে পারেন। তাঁর ঘর ভর্তি অজস্র মেডেল। অনেক অনেক মানপত্র।
তাঁর ঘরে গেলে, তিনি খুব খুশি হন। স্মিত হাসেন।
আমরা তাঁকে নিয়ে গর্বিত হই। আমাদের পাড়ায় এমন একজন খ্যাতিমান মানুষ থাকেন, এটা আমাদের অহংকার করার মত ব্যাপার।
কিন্তু এই গল্প তাঁকে নিয়ে নয়। তাঁর বাড়ির অন্য এক অতিথিকে নিয়ে। ছুটির দিনে, কিংবা স্কুল থেকে ফিরে আমরা মাঝে মাঝে বরুণদার বাড়ি যাই।
একদিন শুনলাম, ওনার বাড়িতে ওনার এক আত্মীয় এসেছেন, যিনি একজন শিল্পী। শিল্পী সম্পর্কে মনে একটা শ্রদ্ধার ভাব বরাবরই ছিল। কিন্তু নিজের চোখে কখনো শিল্পী দেখা হয়নি।
একদিন শিল্পীকে দেখতে গেলাম।
তিনি সর্বক্ষণ ছবি আঁকেন। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, আমরা যে এক্সারসাইজ খাতা ব্যবহার করি,
সেই খাতার উপরে কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো নেতাজি, আবার কখনো কাজী নজরুল ইসলামের ছবি থাকে, তা তাঁর আঁকা।
ভদ্রলোকের ছোটখাটো চেহারা। পরনে পায়জামা ও বাঙালি শার্ট। হাতটা গোটানো। উদাস চেহারা। আমরা যে তাঁকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি, তাঁকে যে মনের গভীর থেকে এত শ্রদ্ধা করি, সেসব ব্যাপারে তাকিয়ে দেখার মত তাঁর সময় নেই। তিনি সদাসর্বদাই আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন। শিল্পী হিসেবে সবাই তাঁকে সম্মান করে। কিন্তু তাঁর বাড়ির চারদিকে প্রবল দারিদ্র্যের ছবি। ঘর দুয়ার প্রচন্ড আগোছালো।
বড় হয়ে স্কুল জীবনের সেই পুরনো খাতা গুলোর দিকে যখন তাকাই, তখন মনে হয়, ভদ্রলোক খুব যে ভালো ছবি আঁকতেন, তা আজ আর মনে হয়না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল, কিংবা নেতাজি, আরও অনেক সুন্দর করে আঁকা উচিত ছিল। এখন বুঝি, শুধুমাত্র প্রবল দারিদ্র্যের কারণে ভদ্রলোক যেকোনো উপায়ে ছবি এঁকে, জীবিকা নির্বাহ করবার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। আমরা তাকে চিরকুমার বলেই জানতাম। পরে জেনেছি, একটি মেয়েকে তিনি ভালোবাসতেন। দারিদ্র্যের কারণে মেয়েটি তাঁকে ছেড়ে চলে যায়।
নিদারুণ অভাব এবং প্রেমে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি পেটের দায়ে ছবি আঁকতেন।
এক রোববার তাঁর বাড়িতে গেলাম। তিনি তখন উঠোনে বসে জলরঙে প্রকৃতির ক্যানভাসে ছবি এঁকে চলেছেন। বিশাল শিমূল গাছ। অজস্র ফুলে ফুলে ভরে গেছে। রংবেরঙের নানা রকম পাখি এসে গাছের ডালে বসেছে। সবুজ পাতার আড়ালে রঙের উঁকি ঝুঁকি।আমরা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
তখন বসন্ত দিন। নীল আকাশ জুড়ে সাদা হালকা মেঘের ভেলা। আমরা গভীর বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়েছিলাম।
খানিক বাদে, ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
কি আঁকছেন,
তিনি বললেন, ভালোবাসার গাছ।
বললাম, এমন ছবি আঁকছেন কেন,
বললেন, যে ভালোবাসা পেয়েছে, সে ভালোবাসার গাছ কোনোদিন আঁকবে না,
বললাম, তাহলে আপনি যে আঁকছেন,
তিনি উত্তর দিলেন না।
অভাব এতটাই তাঁকে স্পর্শ করেছিল, তিনি প্রায়ই অনেককে বলতেন, বাটায় লোক নেওয়া হচ্ছে, আমাকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিন না, এইভাবে এত অভাব নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে গিয়েছি, একদিন ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। অভাবে দারিদ্র্যে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা গিয়েছেন।
ও বাড়ি গেলাম। সামান্য কিছু মানুষজন এসেছিলেন।
দৈনিক পত্রিকায় সংক্ষেপে এই খবর বেরিয়েছিল।
শিল্পীর মৃত্যু ঘিরে কোনো শোকসভা সেদিন হয়নি। অভাবে দারিদ্র্যে তিনি চলে গেলেন।
মনে পড়ছিল, একদিন আমাকে বলেছিলেন, এই পোড়া দেশে শিল্প সৃষ্টি করে, আমাদের মতো হতদরিদ্র মানুষদের পেট চলে না।
আমরা সেদিন তাঁকে সম্মান জানাতে পারিনি। বন্ধুরা মিলে তাঁর বাড়ির সামনে, শিমূল চারা এনে বসিয়েছি। নাম দিয়েছি, ভালোবাসার গাছ।
শিল্পী চলে গিয়েছেন অনেকদিন, তবুও আমাদের পাড়াটার বাইরের লোকের কাছে আজ পরিচিতি, শিল্পী পাড়া বলে।