পার্সেল রহস্য
লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
মহালয়ার সকাল টা এমন করে শুরু হবে আমাদের এপার্টমেন্টে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অঞ্চলের পৌরমাতার উদ্দ্যোগে ভোর সাড়ে চারটা থেকে ই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনছি।আহা কী অপূর্ব লাগে! নাকে যেন সোজা ধূপ ধুনোর আঘ্রাণ ঢুকে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার শিউলি ফুল কুড়ানোর দিন গুলো। আরো একটা জিনিষ বড্ড মনে শিউলি ফুল দিয়ে হাতে মেহেন্দি করার শখ টা। তাই সকল আলস্য ছেড়ে ফেলে বিছানা ত্যাগ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যাই।গঙ্গা বাড়ির পাশে হলেও স্নান করতে যাই না আমি কোনোদিনই।আসলে গঙ্গা স্নান করার পরে ভিজে কাপড় ছাড়ার পদ্ধতি গুলো আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তি কর। কিন্তু আমাদের এপার্টমেন্টের তলাপাত্র জেঠিমা প্রতিবছর মহালয়ার দিন গঙ্গা স্নানে ছোটেন নিজের স্বামীকে নিয়ে।জেঠু গিয়ে পূর্বপুরুষ দের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে আর জেঠিমা গঙ্গা স্নান।
কিন্তু আজ সকালে মাইকের মহালয়া কানে আসার আগেই তলপাত্র জেঠিমা বাজখাঁই গলা আমার কানে এলো। আমার ফ্ল্যাট ফার্স্ট ফ্লোরে।তাই গ্ৰাউন্ড ফ্লোরের কথা বার্তা বেশ স্পষ্ট কানে আসে।
জেঠিমা বলছেন , দাঁড়াও দাঁড়াও একদম না। একদম হাত লাগাবে না।কিসের না কিসের প্যাকেট কে জানে?
জেঠু বিরক্ত হয়ে বলছেন,ধ্যাত একটা পবিত্র কাজে বের হচ্ছি। এখন এইসব ফালতু ঝামেলা।
_ সে কথা বললে তো হবে না কর্তা মশাই।বাড়ি যখন প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখন ভাবা উচিত ছিল। হাজার লোকের বাস হবে।তার সঙ্গে ফ্রী তে আসবে হাজার উৎপাত।
_ধূর বাপু তুমি চুপ করো না। স্কুটার টা কি করে বের করবো সেই কথা টা পারলে একটু ভাবো।
_ ও আজ তোমার স্কুটার বের করা যাবে না এখন।এমন ভাবে প্যাকেট টা পড়ে আছে সামনের চাকার নিচে যে গাড়ির স্ট্যান্ড খুললেই চাকা টা প্যাকেটের উপর উঠে পড়বে।প্যাকেটের ওপর চাকা পড়লেই প্যাকেট টা ফাটবে।আর ফাটলেই ওর ভিতর থেকে কিসব বেরিয়ে আসবে কে জানে?
_ তলাপাত্র জেঠু একটু ঝুঁকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট টা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন ,বুঝলে গিন্নী প্যাকেট টা কিন্তু বেশ পরিস্কার দেখছি। হাত দিয়ে ই সরিয়ে দিই ।
_রীতিমতো চিৎকার করে উঠে জেঠিমা বলে, খবরদার না। দিনকাল একদম ভালো না।তার থেকে বরং তুমি আমাদের সেক্রেটারি দিবাকর বাবু একটা ফোন করো।বলো নীচে নেমে আসতে একবার।
অগ্যতা তলাপাত্র জেঠু বাধ্য স্বামীর মতো সেক্রেটারি দিবাকর বাবু কে ফোন লাগালেন। ইতিমধ্যে মাইকে মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।প্রতিটা ফ্ল্যাটে ই আলো জ্বলে উঠেছে।বার দুয়েক চেষ্টা করার পর দিবাকর বাবুর সঙ্গে তলাপাত্র জেঠু যোগাযোগ করতে পারলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দিবাকর বাবু এপার্টমেন্টের ক্যাশিয়ার ও প্রেসিডেন্ট কে সঙ্গে নিয়ে গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এলেন।
ক্যাশিয়ার তমাল কুন্ডু এসেই বললেন,এই সব ফালতু ঝামেলার জন্য ই আমি মেনগেটে তালা চাবির বদলে সিকিউরিটি রাখার কথা বলে আসছি এতবছর ধরে। কিন্তু তলাপাত্র জেঠুর আপত্তি ই সবচেয়ে বেশি। এবার বুঝুন ঠেলা।
রজত বাবু বললেন,আহা তমাল এখন থাক ঐ সব বিষয়। তার চেয়ে ভালো নয় কি প্যাকেট টা কোথা থেকে এলো,কে এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি, সাইকেলের মাঝে ফেলে গেল তা নিয়ে ভাবা দরকার।
তলাপাত্র জেঠিমা হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,দেখো তমাল তুমি রাগ করো না। তোমরা ইয়ং ছেলেদের দেখনদারি টা বড্ড বেশি। তোমাদের এখন রোজগার পাতি ভালো। কিন্তু তোমার জেঠু তো রিটায়ার্ড লোক। আমাদের কলসীর জল গড়িয়ে খেতে হয়। তাই আমাদের কাছে সিকিউরিটি রাখাটা কিছুটা বিলাসিতা মনে হয়। তুমি যখন তখন তোমার জেঠু কে আক্রমণ করো সিকিউরিটি র ব্যাপার নিয়ে।এ আমার একদম ভালো লাগে না।
তমাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু প্রেসিডেন্ট রজত বাবু চোখ টিপে ব্যাপার টা ক্লোজ করার রিকোয়েস্ট করে।আসলে এমন পুন্য ভোর বেলায় ঝগড়া অশান্তি সমীচীন নয়।
রজত বাবু এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট টা দেখলেন।প্যাকেট টা যশোদা বস্ত্রালয়ের । মুখ টা বেশ টিপে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আঁটা।বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ভয়ের কিছু বলে মনে হচ্ছে না।আর তাছাড়া আমাদের এপার্টমেন্টের লোকজন সবাই ছাপোষা ভদ্রলোক। এখানে বিষ্ফোরক টোরক আসার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আমি বলছিলাম, আপনারা তো সবাই উপস্থিত আছেন।তাই আমি সবার সামনেই প্যাকেট টা খুলতে চাই।কারোর কোনো অবজেকশন নেই তো?
তমাল বলে, দাঁড়ান দাঁড়ান রজত দা।আমি মোবাইল এ ভিডিও টা চালু করি।পরে বিল্ডিং এর সকলের সামনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে।
ধীরে ধীরে প্যাকেট টা তলাপাত্র জেঠুর সামনের চাকার মুখ থেকে হাতে তুললেন রজত বাবু। হালকা নাচিয়ে বললেন ওজন এক কিলোর নীচেই হবে মনে হচ্ছে।
দিবাকর বাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,রজত দা আর দেরি করো না।মা দুর্গার নাম নিয়ে খুলে ফেলুন।
রজত বাবু প্যাকেটের মুখের রাবার ব্যান্ড টা খুলে ফেললেন। তারপর দেখলেন ভিতরে একটা কাগজের প্যাকেট। তাতে লেখা আছে অন লাইন শপিং ব্যান্ডের নাম। কিন্তু নাম, ঠিকানার জায়গা টা নীল রঙের কালি দিয়ে কেটে দেওয়া আছে। কিছুতেই পড়ে উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
তলাপাত্র জেঠিমা চোখ গুলো বড় বড় করে বলেন,এ আবার কি কান্ড!কেউ নতুন জিনিস এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি ঘোড়ার মাঝে ফেলে রাখে?
তলাপাত্র জেঠু বিরক্ত সহকারে বললেন,পয়সা বেশি হলে নতুন জিনিস ও মাটিতে গড়াগড়ি খায় দেখছি।যাক গে, ক্ষতিকারক যখন কিছু নেই তখন ভয়ের কিছু নেই।
বুঝলে দিবাকর তাহলে আমরা আর দেরি করবো না। তোমরা প্যাকেট টা খুলে দেখো।আমি আর গিন্নী বরং রওনা দিলাম।
তলাপাত্র জেঠু ওনার আমলের বাজাজ চৈতক কে স্টার্ট দিয়ে জেঠিমা কে পিছনে বসিয়ে গঙ্গা স্নানে ছুটলেন।
আমি আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে থেকে পুরো ব্যাপার টা লক্ষ্য করছিলাম। এবার মনে হলো একেবারে স্পটে যাই।হাউস কোর্ট টা গলিয়ে সিঁড়ির নিচে যেতেই তমাল আমাকে দেখে বলল,এই যে মৌমিতা দি এসে গেছে।ও দিদি প্যাকেট টা তুমি খুলে দেখ। মহিলাদের জিনিস যদি হয়।তাই আমরা কিন্তু কিন্তু করছিলাম।
আমি প্যাকেট টা হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর হাত দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাই কাঁচির জন্য ওদের কে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এলাম। কাঁচি দিয়ে প্যাকেট টা কাটতেই বেরিয়ে এলো একটা দারুন দেখতে একটা ড্রেস। ব্লাক আর গ্ৰীন এর কম্বিনেশনে র ফ্লোরাল প্রিন্ট।
দিবাকর বাবু হেসে বললেন, ওওওও এতো মেয়েদের পোশাক।
রজত বাবু বললেন, কেউ নিঃশ্চয় সিঁড়ি নীচে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।বিড়াল কিংবা ছুঁচো তে টানাটানি করে এমন রহস্য সৃষ্টি করলো মহালয়ার সকালে।আরে বাবা অন লাইন শপিং তো কোনো অন্যায় কাজ নয়।এই নিয়ে তো লুকোচুরির কিছু নেই।
তমাল বিজ্ঞের মতো বলল,সাধে কি আর বলে মেয়েছেলের বুদ্ধি।কথা টা বলেই ও বুঝতে পারে মুখ ফস্কে একটা বাজে কথা বলে ফেলেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও বলে ওঠে, মৌমিতা দি আমি আমাদের হুয়াটস গ্ৰুপে এই ড্রেস টার একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছি।আর লিখে দিচ্ছি,এই জিনিসটা যার তিনি যেন তোমার কাছ থেকে নিয়ে যায়।প্লিজ দিদি না করো না।
অগ্যতা আমি মালিক হীন পোশাক টা বাইরের ঘরের বুক সেলফের ওপর রেখে দিয়ে কিচেনে গেলাম। গ্যাসে লিকার চা বসিয়ে রাতের বেলায় ধুয়ে রাখা বাসন পত্র গুলো মুছে বাসন রাখার সেলফে তুলে রাখতে লাগলাম।
তারপর একটা কাঁচের গ্লাসে লিকার চা টা ঢেলে দুটো বিস্কুট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আর পার্সেল টা কার হতে পারে এই ভাবনা টা দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলা দিতে লাগলো আমার মনে।
মিনিট পনেরো পর ডোর বেল টা বেজে উঠলো।আমি দরজা খুলে দেখি তলাপাত্র জেঠিমার বৌমা রুচি।
মিষ্টি হাসি দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই বললো,দিদি ওই পার্সেল টা আমার। গতকাল দুপুরে ডেলিভারি বয় দিয়ে গিয়েছিল।এই বলেই ফোন টা খুলে ওর অর্ডার লিস্ট টা দেখলো।
আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে ড্রেস টা রুচির। কিন্তু ওর ড্রেস টা কিভাবে সিঁড়ি ঘরে এলো সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
রুচি এই প্রথম বার আমার ফ্ল্যাটে এলো।তাই আমি ওর ডান হাত টা ধরে বললাম, প্রথমবার তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে আসলে।আগে তো সোফায় বসো। তারপর পার্সেল নিয়ে কথা বলছি।
রুচি হালকা হাসি দিয়ে সোফায় বসলো। তারপর বললো,কি আর করবো বলো দি। আমার শাশুড়ি কারোর ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া খুব একটা পছন্দ করে না।
তারপর একটু বিরতি নিয়ে বললো, ওনার ধারনা অন্যদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে আমি নাকি বিগড়ে যাবো।ভাবো একবার! আমি কি দুধ খাওয়ার বাচ্চা।
আসলে আমি তো গ্ৰামের মেয়ে। শাশুড়ি মা সবসময় বলে,যত কম শহরের হাওয়া গায়ে লাগাবে।ততই সব দিক থেকে ভালো থাকবে। শহরের আদব কায়দা শিখলেই বিপত্তি।খরচ বেড়ে যাবে আকাশ ছোঁয়া। ওনার শুধু সাশ্রয় এর চিন্তা।আমি আসার পর তো ঠিকে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে জানো। আমাকে বলা হল,বৌমা আমি তো এখন ও শক্ত সামর্থ আছি।তাই দুজনে মিলে মিশে সংসারের সব কাজ করে নেবো কেমন। কিন্তু দিদি মাস খানেক ও মিলেমিশে কাজ করতে পারলাম না আমরা। আমার শাশুড়ি মা সপ্তাহের ওয়ার্কিং দিন গুলোতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।যেমন ধরো মাথা ধরা কিংবা পেটে ব্যথায় ভুগবেন।
আমি বেশ বুঝতে পারছি তলাপাত্র জেঠিমা পাকা মাথার বুদ্ধি ধরেন সবসময়। কিন্তু রুচি ও যে খুব একটা বোকা মেয়ে তা কিন্তু নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পার্সেল টা তুমি সিঁড়ি ঘরে রেখেছিলে কেন রুচি?
রুচি বলে দিদি আমার কপাল টাই খারাপ যাচ্ছে আজকাল।না হলে কি এমন বিপত্তি ঘটত।
মানে?
আমার শাশুড়ি মাকে লুকিয়ে অনলাইনে এটা ওটা আমি কিনি মাঝে মধ্যে ই। ডেলিভারি বয়ের থেকে জিনিস নিয়ে সিঁড়ি ঘরের যে বড় লেটার বক্স টা আছে তার মাথায় তুলে রাখি।সময় সুযোগ বুঝে আমি অথবা বর যে কেউ এসে টুক করে পার্সেল টা নিয়ে চলে যাই।
আমি চোখ গুলো কপালে তুলে বললাম, ওওওওও,ব্যাপারটা নতুন নয় তাহলে। ঠিক আছে নিয়ে যাও পার্সেল টা তাড়াতাড়ি। তোমার শাশুড়ি যে কোনো মুহুর্তে চলে আসতে পারে।
পার্সেল টা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় রুচি আমার হাত টা ধরে বলে, প্লিজ মৌমিতা দি এই পার্সেল রহস্য এর কথা খুব বেশি কাউকে বলো না।
আমি রুচির হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। কমিটির তিন চার জন ছাড়া এই পার্সেল কার ছিল কেউ জানবে না।তবে এরপর থেকে সিঁড়ি ঘরে পার্সেল না রেখে সোজা নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবি। শাশুড়ি কিছু বললে বুদ্ধি দিয়ে উত্তর দিবি। লুকোচুরির পথের চেয়ে লড়াই এর পথ ভালো।লড়াই এর একটা পরিনতি থাকে। লুকোচুরি তে থাকে কেবলমাত্র ধোঁকা। ধোঁকার হাত ধরে যেমন ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না ঠিক তেমনি জীবনটা ও বিষময় হয়ে যায়।।
রহস্য বেশ জমেছে😄
অসাধারণ লাগলো
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ