
গল্প- শারদোৎসব
শারদোৎসব
সুমিতা দাশগুপ্ত
আকাশ জোড়া পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের অঝোরধারার বর্ষণে পৃথিবী যখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ,মনখারাপি আবহ আর কাটতেই চায় না,ঠিক সেইসময়েই সহসা একদিন মেঘ ছেঁড়া আলো এসে উদ্ভাসিত করে তুললো আমাদের সাধের পৃথিবীখানাকে। নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো শরৎকাল,গ্রামে গঞ্জে,মাঠে ঘাটে,নদীর ধারে আগমনী গান গেয়ে উঠলো গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। নিঝুমরাতের নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে, আকাশ থেকে তারার বাণী বহন করে যেন শিশির ঝরলো টুপটাপ।ঘুম ভাঙলো শেফালির। শিউলি গন্ধ মাখানো ভোরে,জেগে উঠলো মানুষ, মনে পড়ে গেল মেলাই কাজ পড়ে আছে,গড়িমসির সময় নেই আর। শারদোৎসব আসন্ন !
পাড়ায় পাড়ায় , বড়ো মাঠে পড়ে থাকা স্তূপাকৃতি বাঁশের দল, গা ঝাড়া দিয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠলো, জলদি করো,জলদি করো, প্যান্ডেল বাঁধতে হবে ! সময় তো আর বেশী নেই, মা দুগগা এলেন বলে!
আসলে পুজো মানেই তো ফিরে আসা, ফিরে আসা নিজেরই কাছে, নিজের মাঝে, পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো অনুষঙ্গের অপ্রতিরোধ্য টানে। এই পুজোর সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে কত হারিয়ে যাওয়া দিন, মানুষজন,ঘর বাড়ি, আর ছেলেবেলা।
আমাদের ছেলেবেলার অনেক ক’টা দিন কেটেছে বিহারে, বাবার কর্মস্থলে।
বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে তাঁকে, আকছার ছোটবড়ো নানা জায়গায় বদলি হতে হতো। বসবাসের জন্য অবশ্য রেল কোম্পানির কোয়ার্টারের সুবিধে মিলতো, ছোট, বড়ো মাঝারি, বাগানওয়ালা, বাগানবিহীন ইত্যাদি নানা কিসিমের কত রকমের যে বাড়ি ঘর দোর! নতুন জায়গায়,নতুন বন্ধুবান্ধব, তাদের অন্য ধরনের আচার ব্যবহার, জনবসতি। তবে একটি জিনিসই কেবল অপরিবর্তিত থাকতো। যখন যেখানেই থাকি না কেন, যথাসময়ে পুজোর গন্ধটা ঠিক মনের দুয়ারে কড়া নাড়তোই। জায়গা ভেদে মাতৃমুখের আদলে হয়তো কিঞ্চিৎ হেরফের হতো, আঞ্চলিক কারিগরের হাতে, তবে তাতে বিশেষ কিছু এসে যেতো না। মা,তো মা-ই হন। আয়তনেত্রের ওই করুণাঘন মায়াদৃষ্টির তো আর বদল হয় না!
আমরা যখন একটু বড়ো হয়ে উঠছি, সেইসময় বাবা বদলি হলেন বিহারের একটি সদর শহরে। কোয়ার্টারখানাও একটু অন্য ধরনের । বড়ো বড়ো পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো পেল্লায় উঁচু ছাদওয়ালা , আগাগোড়া কাচের দরজা জানলা, কাঠের সানশেড, সামনে লম্বাচওড়া বিস্তৃত একখানা বারান্দা। তিন চার ধাপ সিঁড়ি নামলেই,বাড়ির চারপাশে অনেকটা করে বাগান করার জায়গা।
ওগুলোতে নাকি এককালে সাহেবসুবোদের কোয়ার্টার ছিলো। স্বাধীনতার পরে এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে দেশীয় সাহেবদের সেইসব কোয়ারর্টারে থাকতে দেওয়া হতো। এটি ছিল সেই জাতেরই একখানা বাড়ি।
সাহেবরা চিরকালের শৌখিন জাত। তাঁদের সময়ে, তাঁরা নিশ্চয়ই কোয়ার্টার সংলগ্ন বিস্তৃত ওই জায়গাটিতে ফুল ফলের বাগান তৈরী করেছিলেন, তবে আমরা যখন ওই বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলাম, তখন আর সেই সবের চিহ্ণমাত্রও ছিল না।অনাদরে অবহেলায়,কবেই সেইসব বাগান বিলুপ্ত।এখন তার শুকনো মরুভূমিসদৃশ আকার । আগের বাসিন্দারা বোধহয় ঘোরতর বৃক্ষবিরোধী ছিলেন।ওদিকে আমাদের বাবা আবার চিরকালের বাগানবিলাসী, গাছপালার সঙ্গে তাঁর অগাধ মৈত্রী। লতাপাতারা তাঁকে দেখলেই ডেকে কথা কয়। অতএব রতনে রতন চিনে নিল। কোয়ার্টারের সামনে ,পাশে , পিছনের বিস্তীর্ণ পোড়োজমি সদৃশ এলাকা,অচিরেই ফুলে ফলে বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ হয়ে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠলো।
দেখতে দেখতে দূরের পাঁচিলের সীমানা বরাবর,সারি সারি আম, পেয়ারা, সজনে গাছেরা মাথা তুলতে আরম্ভ করলো, হাওয়ায় তাদের ডালপালারা খুশিতে মাথা দোলায়। রুক্ষ লালচে মাটিতে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, এতদিনে কোয়ার্টারটাকে বেশ বাড়ি বাড়ি মনে হতে থাকলো।মাঝে মাঝে মায়ের আফশোশ ,কবে আবার বদলির হুকুম আসবে কে জানে! সব ছেড়েছুড়ে পাততাড়ি গুটোতে হবে!
বাবা তখন দার্শনিক , আনমনে গানের লাইন আওড়াতে আওড়াতে জলের ঝারি হাতে তুলে নেন…
“পরের জায়গা,পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই…”
বাবার গলার স্বর ক্রমশ মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায়।
আমাদের তখন অতোশতো গভীর তত্ত্ব বোঝবার, বয়সই নয়! ছুটির দিনে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই। গাছপালার সঙ্গে একধরনের সখ্যও জন্মায়।
উঁচু বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে, লাল ইট বাঁধানো রাস্তা এগিয়েছে মূল ফটকের দিকে।সেই পথের দুপাশে বেলিফুলের ঝাড়, বৈশাখের ভোরের হাওয়াকে গন্ধে বিভোর করে তোলে। রাতের ঘুমে হাসনুহানা, আর লেবুফুলের স্নিগ্ধ সুবাস শান্তির প্রলেপ দেয় ।ওদিকে বর্ষার জল পেয়ে,পাঁচিলের ধারে ধারে স্থলপদ্ম আর শিউলিগাছ তেজী হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। পুজো আসছে, মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে, তাদেরই তো চাই। তখনও বিহারপ্রদেশে,খুব কম বাড়ির বাগানেই তাদের দেখা মিলতো। বাবা, কলকাতার রথের মেলা থেকে চারা সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
ক্রমে পুজো এসে পড়ে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে চকচকে মসৃণ রাঁচি- হাজারিবাগ রোড। একটু দূরেই সেই রাস্তাটি বাঁক নিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে। সেই মোড়ের খাঁজে একখন্ড এবড়োখেবড়ো জমি্ সমান করে নিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়। ষষ্ঠির দিন সকালে প্রতিমা আসে।
আমাদের কাছাকাছি এলাকায় ওইটিই একমাত্র পুজো, অতএব অলিখিতভাবে ,ওটি আমাদেরই নিজস্ব পুজো। তাই উৎসাহ উদ্দীপনার আর অন্ত নেই।
সপ্তমীর সকালে ভোর হবার অপেক্ষা শুধু। স্নান সেরে, বাগান থেকে নতুন কেনা ছোট ছোট বাঁশের চুপড়ি ভরে শিউলি, স্থলপদ্মের রাশি নিয়ে দে ছুট, পুজোমন্ডপে ঠাকুরমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে তো! হরিণ গতিতে ভাই, আমার চাইতে অনেকটা এগিয়ে যায়,আমি পিছু পিছু ছুটতে থাকি।
অন্যান্য কিছু বাড়ি থেকেও পুজোর ফুল আসে , কিন্তু স্থলপদ্ম! উঁহু, সেটি আর হয় না। ঠাকুরমশায়ের হাতে ফুলের ডালাখানা ধরিয়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠে দুই ভাইবোনের।
যথাসময়ে পুজো আর অঞ্জলি শেষে,একটু করে প্রসাদ মেলে, আখের টুকরো- পেয়ারা কুচি। ভাঙা নাড়ু পেলে তো আর কথাই নেই আহ্লাদে আটখানা। আমাদের মধ্যে ততক্ষণে কার ক’খানা, জামা হলো, কে কবে কোনটা পড়বে, দূরের হিলকলোনির পাড়ার সিংহটার চোখটা কেমন যেন ট্যারা ,ওদের চাইতে আমাদের প্রতিমা হাজার গুণে ভালো ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে,ওদিকে মায়েদের ঘর গেরস্থালির কাহিনী… কোন ফাঁকে বেলা গড়ায়। ঘরে ফেরার সময় এসে পড়ে।
না ,তখনও এই দুনিয়ায় কর্পোরেট জগতের অঢেল দাক্ষিণ্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি পুজো প্যান্ডেলে, আমাদের ওই ছোট্ট বিহারী শহরে তো নয়ই, ফলে প্যান্ডেলে বসে ঢালাও খিচুড়ি খাবার গল্প তখনও দূর অস্ত্ , তবে যথাসময়ে প্যান্ডেলে উপস্থিত থাকলে শালপাতার দোনায় করে অল্প বিস্তর ভোগপ্রসাদও পাওয়া যেত বৈকি!
সন্ধ্যে হতে না হতেই,প্যান্ডেলের আলো জ্বলে ওঠে, গেটের আলো ছড়িয়ে পড়ে বাইরের ফাঁকা মাঠে। একে একে সবাই জড়ো হয়।অন্য পাড়ার লোকজনও কেউ কেউ আসেন প্রতিমা দর্শনে। তাঁদের দেখলেই আমরা ঠিক চিনে ফেলি , এঁরা আমাদের নন, অন্য পাড়ার ,নিজেদের মধ্যে কানাকানি চলে, গুরুজনদের ধমক খেয়ে চুপ করি।
শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় আরতি, বাজে ঢাক ঢোল,কাঁসর ঘন্টা।ধুনুচির ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসে মায়ের মুখ। ক্রমে রাত বাড়ে।
বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরি। শুনশান নির্জন পথ, মাথার উপরে একফালি চাঁদ, আকাশ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে, আমরা কেউ কথা বলি না , চুপচাপ পথ হাঁটি।
জীবনে তো কত পথ হাঁটা হলো, পাল্টে গেল বাড়িঘর,স্থান কাল পাত্র। দেখা হলো কতো ধরনের,পুজো, পুজোর আড়ম্বর, আয়োজন,সাজসজ্জা,মনোমুগ্ধকর অসামান্য সব শিল্পকর্ম।
তবু আজও জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে পুজো বলতেই মনের মাঝে ভেসে ওঠে সেই কতকাল আগে দেখা একটি মুখচ্ছবি,আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অর্চনা।
মন ফিরে চায়, সেদিনের সেই ছোট বিহারী শহরে। সেবারে উদ্যোক্তারা ঘোষণা করেছেন বেলাবেলি প্রতিমা বিসর্জনে রওনা হওয়া হবে, সকাল সকাল যেন বরণের কাজ সেরে ফেলা হয়।
মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোনও উপস্থিত। মা স্টেজে,আমরা নীচে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখছি, বিশেষ করে কাছাকাছি গাঁও থেকে,প্রতিমা দর্শনে আসা একদল মানুষকে। কমলারঙা সিঁদুরমাথায় ঘোমটা টানা মহিলারা, মলিন বেশে ছেলেপুলে, যুবক, বৃদ্ধের একটা ছোটখাটো সমাবেশ।হঠাৎ হৈ হৈ রব, পিছু ফিরে দেখি স্টেজে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, সবাই দ্রুত নেমে আসছে –কীভাবে যেন প্রতিমার পিছনের পাতলা কাপড়ে আগুন ধরে গেছে! আগুন ছড়িয়ে পড়লো বলে!
সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সহসা দুহাতে ভীড় ঠেলে সরিয়ে লাফিয়ে স্টেজে উঠে এলো এক দেহাতী তরুণ, ঝাঁপিয়ে উঠে পড়লো জ্বলন্ত আগুনের পাশে,প্যান্ডেলের বাঁশ ধরে। আগুনের হল্কা উপেক্ষা করে, হাত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে থাকলো জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরোগুলো যাতে, আগুন মায়ের অঙ্গস্পর্শ করতে না পারে! নিজের প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নেই ।
অবশেষে সে সফল হলো। আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারলো না,এড়ানো সম্ভব হলো বড়সড়ো বিপর্যয়।
এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঘিরে ধরলো তাকে,কেউ চায় তার পরিচর্যা করতে,আবার কেউ বা সাবাশি দিতে। তাঁর কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই,সে তখন মায়ের সামনে নতজানু হয়ে দরবিগলিত নয়নে অনন্যমনা হয়ে প্রার্থনা করে চলেছে, মা যেন ক্ষুদ্র মানুষের অপরাধ না নেন।
আজ এতগুলো বছর পার করে এসে, জীবনের অপরাহ্ণবেলাতেও প্রার্থনার সেই মুখচ্ছবিটি আমার মনে একই ভাবে সমুজ্জ্বল।


4 Comments
Anonymous
খুব সুন্দর…সব ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠলো🙏
Anonymous
কি সুন্দৱ লেখাটি লেখিকাৱ সাথে আমৱাও পৌছে যাই বিহাৱেৱ নাম না জানা শহৱটিতে
Anonymous
খুব সুন্দর
Anonymous
Ki shundor.Purano diner kotha mone korie deae.Ashadjaron Lekha.