Site icon আলাপী মন

গল্প- পুরনো আবাস

পুরনো আবাস
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

শান্তিনিকেতনে আমি বহুবার গেছি তবু কেন কে জানে শান্তিনিকেতন আমাকে অহরহ ডাক পাঠায়। সংসারের পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো আমার, সবসময় সেই ডাকে সাড়া দেবার সুযোগ ঘটে না বটে, তবু অহরহ মনে মনে আমি ‘সেথায় মরি ঘুরে।’
সদা ব্যস্ত সংসারী মানুষজনের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। পৌষ মেলা,বসন্ত উৎসব, সোনাঝুরির হাট, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা, উত্তরায়ণ,সব‌ই তো হয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার, তবে? তবে আবার কেন?
কেন যে সেকথা বোঝাই কাকে, কী করেই বা বোঝাই ,তাছাড়া আমার সবাইকে সব কিছু বোঝানোর দায়টাই বা কী! আমি বরং একা একাই পথ হাঁটি না হয়।
যারা কেবল উৎসবের শান্তিনিকেতন দেখেই সন্তুষ্ট ,তারা থাক না নিজ মনে, আমার যে আর‌ও কতো কিছু দেখবার, অনুভব করবার বাকি রয়ে গেছে!
আমি দেখতে চাই দূরের মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে আসা কালবোশেখীর রুদ্ররূপ, পেতে চাই ঘন বর্ষায় কেতকী ফুলের গন্ধ, লেবুফলের গন্ধমাখা‌ ভোর, উন্মুখ হয়ে থাকি, কবে কখন, শীতের হাওয়া, নাচন লাগাবে আমলকীর ঐ ডালে ডালে ! শুকনো‌ পাতা খসে পড়ার খসস্ শব্দ মনে ভরে নিয়ে নিঝুম দুপুরে, হলদে পাখির পালক খুঁজতে যদি চলেই যাই খোয়াই এর শীর্ণ নদীটির পাশে,
‘তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার !’
একা একা পথ চলি। আশ্রম গেটের সামনে থমকে থেমে মনে‌ মনে দেখি, সাঁঝবেলাতে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি পিছনে রেখে ঐ বুঝি তিনি হেঁটে আসছেন শালবীথির রাঙামাটির পথটি ধরে।
আসেন না নিশ্চয়‌ই। তবুও ভাবলাম‌ই বা, অসুবিধে কোথায়!
আসন্ন সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি, তারার আলোয় একলা দাঁড়িয়ে থাকা তালাবন্ধ বাড়িগুলোর সামনে।একসময়ে কতো না আনন্দে দিনযাপন ছিলো বাসিন্দাদের। আজ পরিত্যক্ত বাড়িগুলির গেটে পাথরের ফলকে লেখা, আদরের নামটিও অস্পষ্ট, কেবল আগাছা ভরা বাগানের এক কোণে বৃদ্ধ কাঁঠাল গাছের মোটা পাতায়, শিশির ঝরে টুপটাপ। কেন এতো অবহেলা! উত্তরাধিকারীরা কী সবাই ভয়ঙ্কর রকমের কর্মব্যস্ত! হবেও বা! এই যে সামনের ‘গেহ’ নামের পেল্লায় দোতলা বাড়িটা, কবে থেকে একলাটি বসে আছে ।শুনি নাকি সেই বাড়ির অন্দরে ব‌ই আর ছবির মেলা। কারুর‌ই বোধহয় আর সাধ জাগে না সেগুলি আর একবার উলটে পালটে দেখতে!
এবার নিজেই নিজেকে জোর ধমক লাগাই।
অন্যের ব্যপারে নাক গলানোর স্বভাবটা আর গেল না! তাঁদের সুবিধে অসুবিধের কথা কী জানো হে! ধমক খেয়ে মনের দুর্বল অংশটা গুটিয়ে যায়, তাও মিনমিন করতেই থাকে…
এসব কথা কী কাউকে বলবার!

মোটকথা কেবল‌ই দেখতে নয়, রূপ,রস, গন্ধ সমেত সমস্তটুকু নিজের মধ্যে ভরে নিতে আমার এই বারে বারে ফিরে আসা।
সন্ধ্যা গাঢ় হয়, আমি একলাটি পথ চলি।
চেনা টোটোওয়ালাটি কাছে এসে দাঁড়ায়। দিদিমণির ধাত তার বোঝা হয়ে গেছে।
” সাঁঝের বেলায় এখন আর কী দেখবেন! কাল সকাল সকাল তোয়ের হয়ে থাকবেন‌, যে-যে বাড়ি দেখতে চান সব দেখিয়ে দেব। সমস্ত বিখ্যাত লোকের বাড়ির হদিশ,আমার জানা। আজ রাতেই লিষ্টিটা করে রাখবেন।”

অভিভাবকের ভূমিকায় নিজেকে স্বনিযুক্ত করে টোটোওয়ালা চলে যায়।

লিষ্টি আর নতুন করে কী বানাবো,সে তো কবে থেকেই আমার মনের মধ্যে ‘তোয়ের’ হয়ে রয়েছে!
প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’তে কতকাল আগে পড়ে ফেলেছি , শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়ি তৈরির গল্প।
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে‌,পারুলডাঙায় জমি কেনা,পরে ধীরে ধীরে ছোট্ট একখানা বাড়িও হলো।বাড়ির নাম দেওয়া হ’লো ‘স্বাগত-বিদায়’…বুদ্ধদেবের শেষ বয়সে রচিত কাব্যগ্রন্থটির নামে, সেই বাড়ির নামকরণ।
শেষজীবনে প্রতিভা বসু , মহানগরীর কোলাহল এড়িয়ে, ওই বাড়িতেই থাকতে‌‌ চাইতেন,নিস্তব্ধ রাতের চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা বাড়িটি কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকতো।
পাশের সোনাঝুরি নামের বাড়িটি গায়িকা নীলিমা সেনের।
“আচ্ছা প্রতিভাদি সারাক্ষণ বারান্দায় বসে তুমি কী দেখো?”
“উপরে আকাশ দেখি ,আর নীচে দেখতে আসি কখন তুমি যাও।তোমার সুন্দর মুখখানা দেখে আমার আকাশ দেখার‌ই আনন্দ হয়।”—- এবারে ঠিক দেখে নেব সেইসব বাড়ি ঘর।

আগের বারে এসে দেখে গেছি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের দোতলা বাড়ি, ‘আনন্দধারা’। এখন সেখানে তাঁর ছোটবোনের সপরিবারে বসবাস। তাই সে বাড়িটির সর্বত্র যত্নের ছোঁয়া, শুধুই কী তাই! বাড়ি দেখতে গিয়ে এমন আন্তরিক অভ্যর্থনা কল্পনার‌ও অতীত ছিল। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা শিল্পীর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ণ দেখে, ফিরে আসার আগে, সামনে এসে বসলেন শিল্পীর ছোটবোন। দুইবোনের মুখশ্রীর মিল অবাক করা। গরম চায়ের পেয়ালা দিয়ে আপ্যায়ন শেষে বিদায়‌ নিয়ে ফিরে আসার আগে পরমাত্মীয়ের মতোই বললেন ‘আবার এসো।’ অভিভূত আমার মুখে বিশেষ কথা জোগায় না।ওই আন্তরিকতার জবাবে,ধন্যবাদ‌ও কী দেওয়া যায়!

পরদিন সকাল সকাল টোটোওয়ালা এসে হাজির। তার অভিভাবকত্বে নিজেকে সঁপে দেবার আগে, নিজের ইচ্ছেটাও জানান দিয়ে রাখি।
প্রতিভা বসুর মতোই, লীলা মজুমদার‌ও চেয়েছিলেন শেষজীবনে এই শান্তিনিকেতনেই ঠাঁই নিতে। অনেক পরিশ্রমের পর তৈরী হলো তাঁর মনের মতো বাড়ি। তার বিস্তৃত বিবরণ নিজেই দিয়েছেন সম্ভবত পাকদন্ডী ব‌ইতে। বাড়ির নাম হলো
সু-র-ক-লি, স্বামী,পুত্র,কন্যা এবং নিজের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে।
গাছপালায় ঘেরা সেই বাড়ির জানলার পাশে লেখার টেবিল। খাতার পাতা রোদে মাখামাখি।সেইখানে বসে তিনি লিখে চলেছেন- হলদে পাখির পালক। সেই পূণ্যতীর্থ না দেখে কী ফেরা যায়!

টোটোওয়ালা হতাশ। সেই বাড়ি তো আর নেই গো। হাতবদলের পর সেটি এখন নিশ্চিহ্ণ। তবুও আমার হতাশা কাটাতে শুধু জায়গাটি দেখাতেই আমায় নিয়ে চলে সে। গাইড হ‌ওয়া কী চাড্ডিখানি কথা!!

আশাপূর্ণা দেবীর সাধের বাড়ি ‘উজ্জ্বয়িনী’র‌ও ওই এক‌ই হাল।আশাপূর্ণাদেবীর স্বামীর নাম ছিল কালিদাস গুপ্ত। শুনেছিলাম স্বয়ং নরেন্দ্র দেব নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাড়িটির, ওই নামটিই পছন্দ করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িটির কথা টোটোওয়ালার জানা নেই। শোনেই নি সেটির কথা। তাও চেষ্টা চালায় বেচারি। ইজ্জত কী স‌ওয়াল! কিন্তু সেই বাড়িটি সম্পর্কে কেউই কোন খবর জানাতে পারে না। কেউ যে আমাকে ভারতবর্ষের মানচিত্র খুঁজে দেখার পরামর্শ দেয় নি এই ঢের!
বাড়িটি না হয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, জমিটিও কি তাই ! আমার স্বনিযুক্ত গাইডটির অহমিকা চূর্ণ! সাধে কি আর শাস্ত্রে বলেছে ‘মা কুরু…’ ইত্যাদি ইত্যাদি, থাক সেকথা।
সারথিটি এতক্ষণ আমার‌ই ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।‌ আহত সম্মান পুনরুদ্ধারে, এবারে লাগামটি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, নিজেই হাল ধরলেন। নিত্য‌ই কতো ঝামেলাবাজ ট্যুরিষ্ট সামলান তিনি! আর এ-তো…..,আমিও চুপটি করে বসে থাকি,উটকো বায়না ধরি নে।
পিচের মসৃণ পথ বেয়ে চলতে চলতে আচমকাই, এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় নেমে যায় টোটো। দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে, কোথায় কে জানে! সহসাই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যান চালক ।
বাঁ ধারে খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অর্ঘ্য সেনের বাড়ি… ‘খোঁয়াড়’। বাইরে থেকে দেখে মোটেও খোঁয়াড়ের মতো ঠেকে না, হাট করে খোলা গেটের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় একফালি সবুজ জমি, ওপাশের কিনারা ঘেঁষে কিছু আটপৌরে ফুল গাছ। বাইরে দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। নীচ তলায় কারা যেন ঘরের কাজে ব্যস্ত। একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিত্যই এমন পাতিমার্কা লোকজন দেখে তারা ক্লান্ত।দোতলাটি বন্ধ‌ই। বাড়ির এমন নামকরণের কারণ ব্যখ্যা করতে পারতেন যিনি, তিনি দর্শকদের কাছে জবাবদিহি করার জন্য এই ধরাধামে আর বসে নেই।

একটু এগিয়েই ডান হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দোতলা বাড়ি— ‘একা এবং কয়েকজন’, একলাটি দুয়ার এঁটে নিশ্চুপ। বাইরে থেকেও কিচ্ছুটি দেখবার জো নেই। লোহার পাতে মোড়া পেল্লায় কপাটটি যেন বাড়িটিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এবার এগিয়ে আসেন আমার অভিভাবক, টোটো স্যার।
গেটের বাইরে থেকেই পেল্লায় একখানা বাঁজখাই হাঁক ছাড়তেই, চিচিং ফাঁক।কেয়ার টেকার তার চেনা মনিষ্যি কিনা।সেই সুবাদে গেটের ভিতরে লাল কাঁকুরে পথটিতে পা রাখার অনুমতি মেলে। পথটি সোজা এগিয়ে বাড়ির সদরের সিঁড়ি ছুঁয়ে দুপাশে চলে গেছে। ডানপাশে লন। লনের ওপাশে সুনীলের কালো পাথরের আবক্ষ মূর্তি। সামনে দোতলা বাড়িটি এখন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে, বাঁদিকে ছোট্ট পুকুরে হাঁস সাঁতার দেয়। দেখতে দেখতে মনে ধাঁধা লাগে ,ওই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন, মহা সোরগোল তুলে সশব্দে দোতলায় উঠে যাচ্ছেন সিঁড়ি বেয়ে!
টোটোওয়ালা সারাদিন আমায় ঘোরায়, হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারে সে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
দূর থেকেই দেখি রাণী চন্দের বড়ো সাধের ‘জিৎভূম,’ বুদ্ধদেব গুহর ‘রবিবার’, —এই‌ তো মাত্তর সেইদিন‌ও যেখানে জমাটি আড্ডাটি বসেছিলো।

শান্তিনিকেতনে বাংলা পড়াতে এসে জমি কিনে বসবাস শুরু করলেন কবি অশোকবিজয় রাহা। শান্তির নীড় ছোট্ট বাড়িখানার নাম দিলেন ‘সুরাহা’…স্ত্রী সুপ্রীতি আর অশোকবিজয় রাহার মিলিত রূপে বাড়ির নাম। কতশত জ্ঞানীগুণীজনের আনাগোনা।সদাহাস্যময়ী সুপ্রীতি তৎপর থাকতেন অতিথি সেবায়।
আজ বাড়িখানার হাতবদল হয়ে সেখানে উঠেছে আধুনিক কেতার দোতলা বাড়ি। গেটের বাইরে প্রস্তর ফলকে ‘সুরাহা’ নামটি অটুট রয়েছে এইটুকুই যা সান্ত্বনা।
শেষ বেলায় এসে দাঁড়াই ‘স্বাগত বিদায়’ এর বন্ধ গেটের সামনে। ওই তো বিশাল জমির ওপ্রান্তে দু কামরার ছোট্ট বাড়িখানা।
একসময়ের গুণীজনসম্মেলন ধন্য, সেই আবাস, আজ একাকী, নিশ্চুপ। বাগানভরা ফুলেরা কবেই বিদায় নিয়েছে, ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের দাপটে। কেবল গেটের ফলকের ‘স্বাগত বিদায়’ আর বারান্দার থামে উৎকীর্ণ, ‘চিঠি’ শব্দটি আজ‌ও অপেক্ষায়।
ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামে, আকাশে একফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যায়… বুঝি চুপিসাড়ে দেখে যায় এই অবেলায় আবার কে এলো !
পাশেই সোনাঝুরি। গায়িকা অনেকদিন আগেই বিদায় নিলেও বাড়িটি সযতনে রক্ষিত। কারা যেন আজ‌ও বসবাস করেন সেখানে।গেটের সামনে থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি লাল মোরামের‌ পথটিতে,গুটিকতক সাদা ফুল ঝরে পরে আছে। মনের মধ্যে সব কিছু ভরে নিয়ে ফিরে চলি।
অদেখা রয়ে গেল আর‌ও কতো শতো পূণ্যস্মৃতির ঠিকানা। ভারি মনে পথ চলি। আগামীকাল,কলকাতা ফেরার টিকিট। কিন্তু একেবারেই ফিরে যাওয়া কী যাবে!
নিজেকেই নিজে কথা দিই আবার আসিবো ফিরে, আসবোই।

Exit mobile version