ওরা দুজনে
-সুবিনয় হালদার
দেবা আর কান্তি বাল্য বন্ধু । একেবারে জোড়েরপায়রা । যেমন ডাকাবুকো তেমনি সাহস, পরিশ্রমীও বটে । দিন-খাটা দিন-আনা পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাই পড়াশোনার পাশাপাশি হাতখরচার পয়সা জোগাড় করতে দুজনেই বিভিন্ন সময়ে এর-ওর জনমজুরের কাজ করে দু-এক-পয়সা রোজগার করতো । তা থেকে মা-বাবার কাছে বেশীটা দিয়ে বাকিটা নিজেদের কাছে রাখতো । যে কাজটাতে তারা হাত দিতো একেবারে নিষ্ঠার সাথে শেষ করতো । এতটুকু ফাঁকি ছিলোনা তাতে । শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ইয়ার্কির ছলে তারা কঠিন কাজকে খুব সহজই শেষ করে দম নিতো, মনে হতো যেন কঠোর পরিশ্রমের কাজ তাদের কাছে বাঁহাতের খেল্ । সে মাটি কাটা অথবা মাটি কোপানো হোক, মাঠে তোলা-ভাঙা, রোয়া, ধান কাটা, ঝাড়া, বওয়া কিংবা গাছে ওঠা- যেকোনো কাজই- এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সবেতেই একেবারে সিদ্ধহস্ত । মাঝেমাঝে অবসর সময়ে খেলার মাঠে আসতো-, গামছার খুুঁটে মুড়ি বেঁধে নিয়ে কাঁচা পিঁয়াজ আর লঙ্কা চিবোতে চিবোতে । তাতে হাত গলিয়ে ভাগ বসাতে আমরাও কসুর করতামনা । টিভিতে খেলা সিনেমা দেখার খুব ঝোঁক ছিলো । সেই সময় গ্রামে হাতে গোণা দু-একটা বাড়িতে এ্যান্টেনা যুক্ত টিভি ছিলো, তাও আবার সাদাকালো-, ব্যাটারিচালিত । ফুটবল ক্রিকেট খেলা হলে তো কথাই নেই-, সব কাজ ফেলে আগেভাগে বাড়িতে এসে হাজির । গল্প আড্ডা ইয়ার্কি ফাজলামি হতো প্রচুর, আর যেদিন তেমন কাজকর্ম থাকতো-না সেদিন খেলার মাঠে খেলতে হাজির হয়ে যেতো তারা । খু্ব ভালো হা-ডু-ডু খেলতো-, ভালো ব্যাক খেলতো । অসম্ভব শক্তি হওয়ায় কাদামাঠে তাদের টপকে বল নিয়ে গোল করা প্রায় অসম্ভব ছিলো । খোরোকালে মাঠে ধান উঠে গেলে তাদেরকেই আমরা ক্রিকেট খেলার পিচ করে দিতে বলতাম এবং তারা করেও দিতো খুব সুন্দর ভাবে ।
সেই সময় তখনো গ্রামে বৈদ্যুতিকের আলো আসেনি । বিনোদন বলতে শীতকালে মাঠে ষোল মি.মি.’র স্ক্রিন প্রোজেক্টরে ওঠা সিনেমা আর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামে-গ্রামে ভি.ডি.ও. ! যার বেশীরভাগই চলতো জেনারেটরে ।
এমনি একদিন সকালবেলা দেখি দুজনে ধানকাটার কাজ করছে রাস্তার ধারে চেয়ারম্যানদের জমিতে । আমাকে দেখে বললো- কই-রে-ভাই- কোথায় যাচ্ছিস্ ? শোন-না-এদিকে, একটা কথা বলি । আজ বৈকালের পর একজায়গায় যাবি ?
কোথায়-?
ভি.ডি.ও. দেখতে হাটখোলায়- !
ওরে- বাব্বা- ; পাগল নাকি ?
সে তো যমের দুয়ার- ; তাও আবার সন্ধ্যেবেলায়, ওখানে আমি মরে গেলেও যাবোনা ! তোরা যাচ্ছিস্ যা তবে আমি বলি কী- যাসনা ভাই !
হাটখোলা জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশী পায়ে হাঁটা পথ । দুটো গ্রাম টপকে মেঠো রাস্তা ধরে যেতে হবে । রাস্তার দু-ধারে শুধু ধান-জলা আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ, খেজুর গাছ । কোথাও আবার দূরে তালগাছের সারি । সে গুলো পেরিয়ে মাঝে একটা খুব বড় ঘন বাঁশ বন পরবে, তার মধ্যে দিয়ে পথ । দিনের বেলায় আমি কয়েকবার সাইকেল নিয়ে সিনিয়র দাদাদের সাথে গিয়েছি ক্রিকেট খেলতে । প্রথমবারের অভিজ্ঞতা- উফ্ কী-আর বলবো- ; সে যেন এক ভয়ানক ব্যাপার ! বাঁশ বন শুরু হওয়ার বেশ কিছুটা আগে আলি আর কেষ্টদা বললো- ভাই, সাইকেল থামা । নেমে পর । একটু হেঁটে হেঁটে যাই চল্ । অনেকক্ষণ হলো সাইকেল চালিয়ে এসেছি-, কোমর’টা একেবারে ধরে গেছে ; একটু ছাড়িয়ে নেওয়া যাক্ ! সবাই কিন্তু পাশাপাশি একেবারে সারিবদ্ধভাবে যাবো- যাতে করে প্রত্যেকে একে অপরের সংস্পর্শে থাকি আর দেখতেও ভালো লাগবে । কী বলিস ভাই ? আমি বললাম- সে ঠিক আছে- কিন্তু কতক্ষণ- ? ওরা বললো- এই মিনিট দশ-কুড়ি-! ভাই- এই-ভাই- রাগ করিসনা, সবার- ভালোর জন্য বলছি ! সাইকেল থাকতে এ্যাতোক্ষন হাঁটবো-? আমি বললাম, কেন- ? কীসের জন্যে বলছো জানিনা কিন্তু– ; আর কিন্তু করিসনা ভাই- যেমনটা বললো- সে রকম সব এগোতে থাক্- গোঁসাই’খুড়ো, ইন্দ্রদা একটু যেন কেমন সুরে বললো ! মনে যেন একটা খটকা লাগলো ! সামান্য কিছুক্ষণ উদাস মনে মুখটা গোমড়া করে সবার সাথে হেঁটে চলেছি, চারপাশে ডাঙা জমি আর বিভিন্ন গাছপালায় ভরা ! একটু পরে একটা জোড়া বট-অশ্বত্থ গাছে মোড়া ভাঙা মন্দির তলা, বেশ বড় এলাকা জুড়ে, তার পাশ থেকে রাস্তা’টা চলে গেছে । কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব ! চলতে-চলতে ডানপাশে দেখি বেশ বড়-ধরনে একটা পুকুর, তার বেশীরভাগই কচুরিপানাতে ভরা । পুকুরের রাস্তার দিকের অংশে পুরানো শানবাঁধানো ঘাটের ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে ! মনে হলো যেন বহুপুরোনো কোনো জমিদারদের সময়কার । চারিদিকে আম জাম কাঁঠাল খিড়িসগাছে ভরা জঙ্গলের ফাঁক থেকে আবছা চোখে পরে একটা বড় বাড়ির ভাঙাচোরা অংশ, এর ঠিক পরেই বাঁদিকে রাস্তা ঘুরে গিয়ে দেখি একেবারে অন্ধকার- শুধু বাঁশগাছ আর বাঁশগাছ-! এতোটাই ঘন আর দীর্ঘ যে সূর্যের আলোও ঠিকঠাক প্রবেশ করেনা ! একটু আগে হেঁটে আসা নিয়ে কথাবার্তা এবার সব যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ! নন্দ বললো- কী-রে- কেমন লাগছে ? আমি’তো একেবারে ভয়ে কাঁটা ; আমার গায়ের লোমকূপ গুলো সব খাড়া হয়ে উঠেছে ! মুখে কে যেন কুলুপ এঁটে দিয়েছে ! সকাল নটা দশটায় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে— আমি ভাবতেই পারছিনা ! এমন সময় সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করতে না করতেই দেখি চারিদিকে কড়মড় – মড়মড় শব্দ আর তার সাথে-সাথে ডাকপাখি, বাদুর, বক ও অন্যান্য পাখিদের সমবেত কলরব আর ডানা ঝাপটানো- যেন আভাস দেয় একটা মায়াবী ভয়ার্ত পরিবেশ ! কেষ্ট’দা বললো- বুঝলি এবার কেন হেঁটে যাচ্ছি ? ওই বাঁশ বনের রাস্তা পার হয়ে সাইকেলে চেপে যখন হাটখোলা গ্রামে প্রবেশ করি তখন আমাদের খেলা শুরু হওয়ার জন্য মাইকে ডাকাডাকি চলছে ।
এমন এক জায়গায় ওরা দুজনে নাকি সন্ধ্যার পর ভি.ডি.ও. দেখতে যাবে- ; কল্পনা করা যায় ! কথামত যথারীতি সন্ধ্যার পর দেবা আর কান্তি হাটখোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো- বারবার নিষেধ করা স্বত্ত্বেও ! প্রথম গ্রামের মাঝামাঝি এসে একটা দোকানে হুড়ুমভাজা কিনে চিবোতে চিবোতে আবার হাঁটা লাগালো । দ্বিতীয় গ্রামের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে একটু বসে চা বিস্কুট খেতে-খেতে গল্পে-গল্পে ওরা যে হাটখোলায় ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে যেইনা বলেছে- ; ওমনি ওখানে উপস্থিত দু-চারজন মানুষ আঁৎকে উঠলো ! সবাই অবাক হয়ে বলে- বলো-কী-তোমরা ? বয়স্ক দোকানদার বললো- দ্যাখো ছেলে বাড়ি ফিরে যাও ; তোমাদের ভালোর জন্যেই বলছি- । দেখুন কাকা, আমরা দুজনে যখন যেটা করবো ভাবি তখন সেটা করেই ছাড়ি, তোমার কত হলো বলো ? দাম মিটিয়ে ওরা দুজনে যখন উঠে দাঁড়ালো তখন চা দোকানের রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শেষ হয়ে “চাষী ভাইদের বলছি” আসর শুরু হয়েছে অর্থাৎ আটটা শোয়া’আটা হবে । চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে ওরা দুজনে পুনরায় হাঁটা শুরু করলো । জনপ্রাণী-হীন মেঠো রাস্তায় ওরা শুধু দুজন হেঁটে চলেছে ! দূরের তালগাছ গুলো অন্ধকারে রণপা’র মতো দাঁড়িয়ে এক একটা যমরাজ-বর্গ এবং বাদায় কিছু কাটা কিছু শুয়ে পরা দাঁড়িয়ে থাকা ধানগাছ সব জনসাধারণ আর আলের ধারে-ধারে বাবলাগাছ খেজুর গাছ গুলো যেন সব যমদূতদের পর্যায়ক্রমিক শ্রেণী ! হাঁটতে হাঁটতে ভাঙা মন্দিরতলার কাছে আসতেই ওরা নাকি শুনতে পেল কারা যেন কথাবার্তা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ! ওরা ভাবলো ওদের মতো অন্য কেউ হয়তো ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছে ! তারপর যখন ওই পুকুরটার কাছে এলো তখন ওদের মনে হলো শানের ঘাট হতে কেউ বা কারা যেন বাগানের ভিতর পড়ো বাড়িটার দিকে চলাফেরা করছে ! ওরা ভাবলো নেশাখোররা কেউ হবে হয়তো ! তারপর সেই বাঁশ বন- যেখানে পৌঁছে ওরা আর পথ দেখতে পাচ্ছেনা ! তবুও ওরা এক-পা দু-পা অনুমান করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকলো শিস বাজিয়ে গান করতে করতে ! কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর হঠাৎ ওদের মনে হলো এইরে সেই ভাঙা মন্দিরতলাতে আবার এসে গেছি- ; এটা কিরকম হলো ? এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করছে এমন সময় কান্তি দেখে ভাঙা মন্দির-তলা থেকে একজন বেড়িয়ে রাস্তায় উঠছে ! দেবার হাতটা ধরে বললো- চল্ বন্ধু, ওই লোকটার পিছুপিছু যাই তাহলে মনে হয় ঠিক রাস্তা পাবো ! সামনের মূর্তিটা যখন শানের ঘাটের কাছে তখন ভিতরের ওই পোড়ো বাড়ি হতে আরো একজন বেড়িয়ে এসে তার সাথে যোগ দিলো ; তারপর ওরা দুজনে এগিয়ে চললো বাঁশবনের রাস্তায় হাটখোলার দিকে । ওরাও দুজনে যথারীতি ওদেরকে অনুসরণ করতে থাকলো, দুজনের থেকে দুজনার দূরত্ব মেরেকেটে ন’দশ মিটার হবে কিন্তু এতোটাই অন্ধকারের ঘনত্ব যে কেউ কাউকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছেনা ! কান্তি গলাটা একটু খেঁকরে নিয়ে বললো- ও-দাদা, একটু দাঁড়ান-না, কোনো উত্তর নেই ! তখন দেবা শিস দিয়ে একটা টোন্ করলো তার সাথে-সাথেই সামনে হতে ঠিক একই টোনে প্রতুত্তোর ভেসে এলো ! কান্তি তখন শিস দিয়ে বলার চেষ্টা করলো- ভি.ডি.ও. দেখতে যাচ্ছেন ? শিসের মাধ্যমে উত্তর এলো- হ্যাঁ ! বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর হটাৎ সামনের ওই দুজনকে এরা আর ঠাহর করতে পারেনা ! আশ্চর্য- ; দেবা বললো- যা অন্ধকার ঘোড়ার ডিম দেখতে পাবি ? যেমন যাচ্ছি তেমন চলতে থাক্ ! ওইভাবে বেশ অনেকক্ষণ চলার পর দেখে ওরা দুজনে একটা বাদা বনের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ! অনেক দূরে লাইটের একটা আভা খুব ক্ষীণ দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওখানে যাবে কিভাবে ? অগত্যা আবার পিছনের দিকে হাঁটা লাগালো ! এরকম করে বাঁশবনটা প্রায় চড়কি-পাক খেলো ঘন্টার পর ঘণ্টা ! ওদেরই অজান্তে ওরা অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে কখন যে বাঁশবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে টেরও পায়নি । গ্রামের একজন লোক ফাঁকের দিকে লন্ঠন হাতে বের হয়েছিলো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হঠাৎ ওরা দুজন দেখতে পায় । তখন ওদের দুজনকে দেখে তো সেই লোকটার আত্মারাম খাঁচা ! ওরা জিগ্যেস করলো দাদা এখানে ভি.ডি.ও. টা কোথায় হচ্ছে ? লোকটা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো- তোমরা কারা- ; কোথা থেকে আসছো ? ভি.ডি.ও. তো মনে হয় প্রায় শেষের পথে ! এখন তো ভোর হতে চললো । ওরা দুজনে সব ঘটনা সবিস্তারে বললো ওই লোকটাকে । শুনে তো লোকটা অবাক ; তারপর বললো- তোমরা আজ খুব জোর বেঁচে গেছো, মনে হয় তোমাদের রাস খুব ভারী, সাহসও প্রচণ্ড ! তা-নাহলে কেউ এই রাস্তায় রাতে আসে ?