রুম নাম্বার ২০৫
– মুনমুন রাহা
অন্ধকারের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে । কামরার বেশির ভাগ মানুষই নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুম নেই কেবল মিতুলের চোখে। মনটা কেমন ভারি ভারি লাগছে । বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর থেকে। মিতুলের সেই কবেকার ইচ্ছে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবে । বিয়ের আগে হবু বর অরিত্রকে সে নিজের ইচ্ছা জানিয়েছিল , অরিত্র তখন সম্মতি ও দিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর । এক তো অরিত্র অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছে না। আর দুই নম্বর হল অরিত্রর মা। তিনি ছেলের বিয়ের জন্য জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করে বলে এসেছেন একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বৌ আগে জগন্নাথের শ্রী চরণে মাথা ঠেকিয়ে আসবে। আর কি করার মিতুলরা তাই সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে পুরী চলছে হানিমুনে। বন্ধুদের এই নিয়ে খিল্লির শেষ নেই। এই তো কালকেই পৌষালি বলছিল ,
“মিতুরে, তুই ও শেষে দীপুদার প্রেমে পড়লি? দীপুদা অর্থাত বাঙালির প্রিয় তিনটি জায়গা, দীঘা , পুরী , দার্জিলিং।”
যদিও অরিত্র বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুইজারল্যান্ড যাবে। তবু যেন সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে না যাওয়ার দুঃখটা কিছুতেই মিতুলের পিছু ছাড়ছে না।
পুরী তে পা দিয়ে মিতুলের মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। পুরীতে মিতুল আগেও এসেছে তবে অরিত্রর সাথে জগন্নাথ দর্শন , সি বিচে হাতে হাত রেখে হাঁটা , বিশাল সমুদ্রতে অরিত্রর সাথে হারিয়ে যাওয়া , বড় কোন ঢেউ আসলে অরিত্রর মিতুল কে আগলে রাখা এসব কিছুই মিতুলের কাছে চেনা পুরীকে অচেনা স্বপ্ন নগর করে তুলেছে । কেবল হোটেল রুমে মিতুলের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর। সমুদ্রের বেশ কাছে। পাঁচ তারা হোটেলটার সুইমিং পুল , বার , রেস্টুরেন্ট সব কিছুই বেশ বিলাস বহুল। মিতুলরা রুমটাও পেয়েছে সি ফেসিং। হোটেলটা পুরো ভর্তি তারপরও এত কম নোটিশে মিতুলরা যে এমন একটা ঘর পাবে তা আশা করে নি মিতুল। তাই প্রথম দিন রুম টা দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছিল মনটা। কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে মিতুলের। মনে হয় কেউ যেন আছে যাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। সবসময় কেউ যেন তার সাথে সাথে সর্বক্ষন ঘুরছে। বিশেষ করে অরিত্র আর মিতুলের একান্ত হওয়ার মূহুর্ত গুলোতে যেন বেশি বেশি করে অচেনা অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মিতুল।
প্রথম দিন রাতে অরিত্র নব বিবাহিতা স্ত্রী মিতুল কে কাছে টেনে নেয় । মিতুলও অরিত্রর স্পর্শে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। অরিত্র মিতুলের উন্মুক্ত পিঠে , কোমরে , গলায় নিজের ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগে । মিতুলও অরিত্রর আদরের উষ্ণতায় ক্রমে বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনই মিতুলের মনে হয় তার গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ থাকায় প্রথমে মনে হয় অরিত্রর নিঃশ্বাস হয়তো। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হয় অরিত্রর মুখ মিতুলের কোমোর বেয়ে নীচে নামছে তবে তো অরিত্রর নিঃশ্বাস মিতুলের ঘাড়ে পরা সম্ভব নয়! ভয় পেয়ে যায় মিতুল ছিটকে ওঠে অরিত্রর কাছ থেকে। অরিত্র অবাক হয় মিতুলের ব্যাবহারে। মিতুল অরিত্রকে তার অসস্তির কথা বললে অরিত্র বিশ্বাস করে না। বলে এ নিশ্চয়ই মিতুলের মনের ভুল। তেমন কিছু হলে অরিত্রও নিশ্চয়ই অনুভব করত। সে রাতে অরিত্র মিতুলর মিলন পর্ব অসমাপ্ত রয়ে যায়। ভীত মিতুল কে বুকে টেনে নিয়ে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে। মিতুল কিন্তু অরিত্রর বুকের মাঝে চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারে কেউ যেন তাদের খাটের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতি কেন অরিত্রর হচ্ছে না কে জানে? কেটে গেল আরও দুটো দিন। এই অনুভূতি পিছু ছাড়ল না মিতুলের।
খুব ভোরে মিতুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আধ ফোটা আলোয় রাতের ভীবিষিকা ম্লান হয়ে আসে। মিতুল মনকে বোঝায় অরিত্র ঠিকই বলেছে , এসব অবাস্তব অনুভূতি মিতুলের মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়।
সান রাইস দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় । মিতুল দেখে অরিত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিতুল আর তাকে ডাকে না। ঠিক করে একই যাবে সান রাইস দেখতে। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলে মিতুলের মনের অলৌকিক অনুভূতি গুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। মনে হতে থাকে যেন দুটো অদৃশ্য চোখ তার উপর দৃষ্টিপাত করে চলেছে অনবরত। মিতুল কোন রকমে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। সে প্রথমে যায় হোটেলের রিসেপশনে। সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। একজন বয়স্ক লোক আর দুজন স্টাফ। মিতুল বয়স্ক লোকটির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর তাকে জানায় মিতুল রুম চেঞ্জ করতে চায়। এবং সেটা আজই দরকার হলে এখনই । মিতুলের গলার স্বরে এতটাই উত্কন্ঠা ছিল যে বয়স্ক লোকটি মাথা তুলে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে ,
“কেন ম্যাডাম এত তাড়া কিসের? রুমে কিছু অসুবিধা হলে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সমাধান করার। ”
মিতুল বলতে গিয়েও থেমে যায় যদি অরিত্রর মতো এই লোকটিও অবিশ্বাস করে ! মিতুল বলে,
” আমি বললাম তো আমি ঐ রুমে থাকব না । আমাকে রুম পাল্টে দিতেই হবে। ”
মিতুলের আচরণে ভদ্রলোক খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর কি যেন ভেবে বলেন,
” কোন রুম ?”
” ২০৫ ”
কথাটা শুনে ভদ্রলোক কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
” ঠিক আছে ম্যাডাম আমি দেখছি কি করা যায়। তবে যদি এখানে অন্য রুম না পান তবে অন্য কোন হোটেলের ব্যবস্থা করুন।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই হোটেলের মালিক এসে উপস্থিত হলো। মিতুল আর ভদ্রলোকের কথা কানে যেতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলল,
” কি যা তা বলেছেন অমল বাবু? আর ম্যাডাম আপনাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দি আমাদের পক্ষে এখন অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। হোটেল ভর্তি। আপনারা চাইলে অন্য হোটেলে যেতেই পারেন তবে আপনাদের পাঁচ দিনের অ্যডভান্স কিন্তু ফেরত পাবেন না।”
মিতুল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চলে এলো সমুদ্রের ধারে। সূর্য দেব ততক্ষণে আকাশে উঁকি দিয়েছেন। মিতুলের আর সান রাইস দেখা হলো না । তবু সে হোটেলে ফিরল না। সকালের নরম আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মনে অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে পড়ছে বয়স্ক ভদ্রলোকের ২০৫ রুম নাম্বার শুনে আঁতকে ওঠার কথা। ম্যানেজারের কথা চাপা দেওয়ার প্রয়াস। মিতুল এখন নিশ্চিত এই অনুভূতি তার মনের ভুল নয় কিছু নিশ্চয়ই আছে ঐ রুমে। কিন্তু কি আছে রুম নাম্বার ২০৫ এ !
” কি রে , খুব চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে? ”
হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে যেতে মিতুল মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় এক জটাজুটো ধারীকে যার পরনে কেবল কৌপিন, গলায় রকমারি পাথরের মালা চোখ গুলো টকটকে লাল, কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। তিনি আবার বললেন,
” ভেবে কিছু হবে না। জানতে হবে ! তোকেই জানতে হবে কি চায় সে ! আমি তোকে শুধু সাহায্য করতে পারি।”
মিতুলের বুঝতে বাকি রইলো না সাধু কি সম্পর্কে কথা বলছেন। মিতুল হাত জোড় করে বলল,
” দয়া করুন বাবা । আমি আর এইসব সইতে পারছি না অজানা আতঙ্কের সাথে অজানা অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত । আমার এই অস্বস্তি এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করছে না। এমন কি আমার স্বামী ও নয়। ”
” কেউ বিশ্বাস করবে না রে । যে জীবন দিয়ে অনুভব করে বিশ্বাস কেবল তার জন্মায়। এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা তাবিজ দিচ্ছি এটা গলায় পরবি আর একটা পাথরের মালা দেব সেটা হাতে নিবি। তারপর সেই অশরীরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি। তবে মনে রাখিস তখন যেন আর কেউ না থাকে তোর সাথে। তাকে রাত বারোটার পরেই ডাকা ভালো। ভয় পাবি না । আমার বিশ্বাস সে তোর সাথে কথা বলার জন্যেই তোর পিছু ধরেছে। ক্ষতি করার হলে এতদিন করে দিত। ”
এই বলে সাধু মালা আর তাবিজ মিতুলের হাতে দিয়ে যেযন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই চলে গেল। ভোরের নরম আলো কেটে উজ্জ্বল রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। মিতুল ধীর পায়ে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা হল । হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিল সাধুর দেওয়া সেই তাবিজ আর মালা।
রাত বারোটা। মিতুল দেখল অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কদিন মিতুল কিছুতেই অরিত্রর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। যতবার মিতুল অরিত্রর কাছে আসার চেষ্টা করেছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে মিতুলর কাছে আর মিতুলও ছিটকে সরে এসেছে অরিত্রর কাছ থেকে। মিতুল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ঘড়িতে ১২-৩০ । মিতুল উঠে বসল। অদৃশ্য অশরীরীর সাথে বোঝাপড়া করার সময় এসে গেছে। সে যে ঘরেই আছে তা মিতুল জানে তার অনুভূতি দিয়ে। মিতুল হাতে সাধুর দেওয়া মালাটা নিল আর গলায় পড়ল তাবিজটা তারপর চলে গেল বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ধীর গলায় বলতে লাগলো ,
” তুমি কে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। জানতে চাই কেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ঘুরছো তুমি? ”
একবার , দুবার কোন উত্তর নেই। মিতুল আবার বলল তার কথা গুলো। তিনবারের বার সাড়া পেল মিতুল। সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসলো। মিতুল চোখ খুলে দেখল একটা আবছা ছায়া। যেন কোন মানুষ কে সে অনেক গুলো কুয়াশার পর্দার ভিতর থেকে দেখছে। তারপর শোনা গেল তার রক্ত হিম করা ফ্যাঁসফ্যাঁসে এক গলার আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে কথা গুলো আসছে।
” আমি এসেছি তোমার ডাকে। তুমি ঠিক বলেছ আমি তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আছি। তবে তার উদ্দেশ্য তোমার ক্ষতি নয়। আমার মুক্তি। ”
মিতুলর ভয়ে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবু সে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে। বলে,
” বেশ, বল আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?”
” আমি নীলা। ছয় মাস আগেও এই হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিলাম। নতুন কাজ ভালোই লাগছিলো আমার। মন দিয়ে নিজের কাজ করতাম। কত নতুন মানুষর সাথে পরিচয় হতো রোজ। বেশ কাটছিল দিন গুলো। তবে দিন গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠল আকাশের সাথে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর। আকাশ এই হোটেলের ম্যানেজার। আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস ক্রমে মজবুত হল । অন্তত আমার কাছে । আকাশ আমাকে আরও কাছে পেতে চাইল। আমি আপত্তি করিনি। কয়েকদিন পরেই যার সাথে বিয়ে তাকে আপন করে নিতে আমার দ্বিধা বোধ কাজ করে নি। আকাশ আর আমি মাঝেমাঝে মিলিত হতে লাগলাম। বিয়ে তে আকাশ আপত্তি করে নি কিন্তু দেরি করছিল। আমি তাড়া দিতে লাগলাম। আমার আর এই ভাবে মেলামেশা ভালো লাগছিল না। আমি সংসার বাঁধতে চাইছিলাম। একদিন আমি জানতাম পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ছুটলাম আকাশের কাছে। বললাম আর দেরি নয় আমাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে যে আসছে তার জন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে নেওয়া দরকার। আমাকে অবাক করে আকাশ বলল ,
” বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? এ বাচ্চা যে আমার তার প্রমাণ কি? আমি মানি না। আর তুমি ভাবলে কি ভাবে যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? তোমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ে কে আমি কখনও বিয়ে করব না। যে মেয়ে আমার সাথে শুতে পারে সে তো অন্য পুরুষের সাথে ও শুতে পারে! ” তারপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসে আকাশ বলল,
” তাই ভালো কথা বলছি এইসব বাচ্চার ঝামেলা হটাও। কালই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করো। তারপর আমাদের সম্পর্ক যেমন চলছিল চলবে। আর ঢাক ঢাক গুর গুর নয় সোজাসুজি সওদা। তুমি আমাকে শরীর দেবে বদলে আমি তোমাকে কর্ম ক্ষেত্রে উপরে উঠতে সাহায্য করবো। ”
আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার সন্তানকে কিছুতেই মারব না। ঠিক করলাম আকাশ কে এর উচিত শিক্ষা দেব। দুদিন পর আকাশকে ফোন করে বললাম তাকে আমি সাতদিন সময় দিলাম। সে যদি আমাকে অস্বীকার করে তবে আমি মালিক পক্ষের সাথে এই নিয়ে কথা বলব। বলব কিভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকাশ আমাকে ব্যবহার করেছে । আরও বললাম দরকার হলে পুলিশের কাছেও যাব। বাচ্চা হওয়ার পর ডি এন এ টেষ্ট করলেই পুলিশ বুঝতে পারবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না। কেটে গেল দুটো দিন। আমি কদিন হোটেল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। আকাশের সাথেও তাই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। এদিকে আমার বাড়িতে সব কিছু জানতে পেরে যায়। সমাজের ভয়ে বাড়ির লোক আমাকে চাপ দিতে থাকে বাচ্চা নষ্ট করতে। আমিও আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়। তাই অশান্তি তখন আমার নিত্য সঙ্গী। আমি সমাজ সহ পরিবারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত । চার দিনের দিন ফোনটা এল আকাশের কাছ থেকে। বলল নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। তবে তার বিয়ে নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমাকে একান্তে ডাকল সে। আকাশের কথা মতো রাত আটায় আমি গেলাম হোটেলে। আকাশ আমাকে প্রথমে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসতে দিল তারপর আমাকে কিছু একটা ড্রিঙ্ক দিল। সেটাতে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল। আমার কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল।
তারপর আকাশ বলল ,
” আমাকে ফাঁসাবি না ? এই বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাবি তো ! দেখ এবার না থাকবি তুই আর না থাকবে তোর বাচ্চা। ”
একটা লোহার রড সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিল। সেটা দিয়ে মারতে লাগলো। আমার পেটে , মাথায়, মুখে। আমি ককিয়ে উঠছিলাম কিন্তু বাধা দিতে পারছিলাম না। এক সময় আমার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আকাশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার লাশকে সামনে রেখে সে একটা সিগারেট ধরাল । হোটেলে তখন কিছু রুমের কাজ চলছে। আকাশ বোধ হয় কিছু মিস্ত্রীকে আগে থেকেই টাকা খাইয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে আমর লাশটা নিয়ে আসা হলো এই ২০৫ রুমে। এই ঘরে মেরামতের কাজ চলার জন্য ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না আমার লাশ লুকাতে। মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হলো আমার লাশ ও আমার ব্যাগ যা আমি সাথে এনেছিলাম। তারপর মিস্ত্রীরা সুন্দর করে ইট বালি সিমেন্টের প্রলেম ঢেলে দিলো তাতে। মুছে দিল আমার হত্যার সকল প্রমাণ। আমার পরিবারের কাছে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি পেল না । ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর বড় অমানবিক হয় মিতুল । তাই তো আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে মিলিত হতে দিইনি। আমি মুক্তি চাই। আকাশের শাস্তি চাই। ”
এতক্ষন কথা বলার পর এবার একটু থামলো নীলা। মিতুলের আর এই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভয় করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মিতুল বলল,
” না নীলা সব ছেলেরা এক রকম হয় না। আমার স্বামী অরিত্র খুব ভালো মানুষ। তবে তোমাকে আমি মুক্তি দিতে চাই। শাস্তিও দিতে চাই আকাশ কে। কিন্তু কি করে হবে ! আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কেন মানবে আমার কথা ? ”
” প্রমাণ আছে। প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। আমি এখানে আসার দিন ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আকাশ যদি বিয়ে নিয়ে কোন বাহানা করে অথবা আমাকে নোংরা প্রস্তাব দেয় তবে সেই ভিডিও আমি পুলিশ কে দেখাব। আমার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে আমার মার্ডার হওয়ার ভিডিওটা পেয়ে যাবে। ”
এই বলে আবাছা ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।
মিতুল কে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আকাশ কে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নীলা ঠিকই বলেছিল তার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে সব কিছু রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিতুল কিভাবে এই হত্যার কথা জানল সেই উত্তরটা পুলিশ কে দিতে পারেনি মিতুল। অরিত্র প্রথমে মিতুলের পুলিশ ডাকা নিয়ে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিতুলর কথা মতো সব প্রমাণ পাওয়া গেলে বেশ অবাক হয়ে যায় সে। তারপর মিতুলের মুখ থেকে নীলার সব কথা জেনে মিতুলের কাছে ক্ষমা চায় সে মিতুল কে অবিশ্বাস করার জন্য। নীলার সৎকারের ব্যবস্থা নীলার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে মিতুলরা আজ বেরিয়ে পড়ল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
গাড়ি তে যেতে যেতে অরিত্র বলে
“এই হানিমুনটাতো মাটি হলো এবার গিয়েই সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থা করব । ”
মিতুল বলে ,
” একটাই শর্ত, হোটেল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ করে নেবে। ”
” সে আর বলতে ! এবারে না হয় জগন্নাথের কৃপা ছিল। আর ভুল করি !”
অরিত্রর বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে মিতুল। এতদিন পরে মিতুলর মুখে প্রাণ খোলা হাসি দেখে হাসি খেলে যায় অরিত্রর ঠোঁটেও।