মানুষ যখন ফানুস হয়ে যায়
–সুনির্মল বসু
আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক আছেন, সব সময় তিনি ভুল ইংরেজিতে কথা বলেন। অথচ, মাতৃভাষায় কথা বলায় তাঁর প্রবল বিরক্তি। প্রায়ই বলেন, বাংলা ভাষাটা আমার ঠিক আসে না। পথে দেখা হলে, জিজ্ঞাসা করেন, তারপর, সব ভালো তো। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে, এর পরেই বলেন, ঘড। আসলে, উনি যে গুড কে ঘড বলেন, এটা বুঝে নিতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল।
পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ভদ্রলোক ভালো মন্দ যাই ঘটুক, সব সময় ইংরেজিতে ঘড বলে থাকেন। ইংরেজরা এ দেশ থেকে বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন, ইংরেজিয়ানা যায়নি।
একটি খ্যাতনামা জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে আমার বাড়ি। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের স্ত্রীরা অনেকেই বলেন, আমাদের উনি ম্যানেজার হইছেন।
ম্যানেজার, সোল পুটিং ডিপার্টমেন্ট।
পাড়ার বখাটে ছেলেরা বলে, ম্যানেজার, কথাটার ব্যাসবাক্য সহ সমাস কি হবে বলো তো?
নিজেরাই উত্তর দেয়, এরপর। বলে, মানে নেই যার।
পূজোর কিছুদিন আগে ছাত্র পড়াতে অফিসার্স কলোনিতে গিয়েছি, কলিং বেল বাজলো।মিসেস চৌধুরী দরোজা খুলে দিলেন। আমি এ বাড়ীতে পারচেজিং ম্যানেজারের ছেলে বিক্রমকে পড়াই। শাড়ী বিক্রেতা কাঁধে প্রচুর শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস চৌধুরী গোটা পনেরো শাড়ি পছন্দমতো বেছে নিলেন। শাড়ি বিক্রেতা ভদ্রলোক তখনও বসে রয়েছেন।
মিসেস চৌধুরী বললেন, কি হলো, শাড়ি নিলাম তো, আপনি এখনো বসে রয়েছেন, ব্যাপারটা কি?
শাড়ি বিক্রেতা বললেন, মাইজি, আমি এই শাড়িগুলোর দাম চাইছি না, গতবছরের শাড়িগুলোর দাম যদি দেন!
মিসেস চৌধুরী খুব রেগে গেলেন। যখন তখন দাম চাইবে না, আমি কি তোমার টাকা দেবো না বলেছি?
এই সময়ের জন্য তৈল একটি অতি মূল্যবান বস্তু। আমার ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া বন্ধু জগন্ময় বাটা কোম্পানির এক ম্যানেজারের গাড়ি ধুয়ে এবং বাজার করে দিয়ে, বর্তমানে ম্যানেজার হয়েছে।
এখানে কর্মীদের সপ্তাহে বেতন। প্রোডাকশন বেশি হলে, খুশি হবার কথা।
কিন্তু আমার বন্ধুটি এই ঘটনায় রেগে যায়। কারণ, কর্মীদের একেক জনের সাপ্তাহিক বেতন কি হবে, সে অংকটা জগন্ময়ের জানা নেই।
আজকাল সুখ একটা দেখাবার বস্তু হয়ে গেছে। কোনো উৎসব উপলক্ষে এই জিনিসটা খুব চোখে পড়ে। গিন্নীকে পটের বিবি সাজিয়ে মোটরসাইকেলে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে ভেসে-যাওয়াতে কী প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়, আমরা দুজন কত সুখী!
বর্তমানের দুনিয়াদারিতে দেখনদারিটাই আসল। আমার ফ্ল্যাট দ্যাখো, আমার গাড়ি দ্যাখো, আমার অফিস দ্যাখো, আমার স্ট্যাটাস দ্যাখো। সবই ভালো, তবে বৃদ্ধাশ্রম গুলি ব্যাঙের ছাতার মতো চারদিকে এত গজিয়ে উঠছে কেন?
সুখটা ঠিক কোথায়, মনের শূন্যতা ওয়ালা মানুষগুলো সেটা ধরতেই পারছে না।
অনেক দিন আগের কথা। কলেজে পড়ি। পাড়ার ভবতোষ কাকু একটি পোস্ট কার্ড এনে বললেন,
আমি বলি, তুই লেখ্। আমি কাকুর ডিকটেশন লিখে চললাম। আর জায়গা নেই।
কাকু বললেন, পুনশ্চ,
এখানে ইলিশ মাছ সস্তা হইয়াছে।
পোস্টকার্ডের দাম উসুল করাই আঙ্কেলের লক্ষ্য।
একদিন সন্ধ্যায় কাকুর বাড়িতে প্রবল ঝগড়া। কাকু আর কাকিমার মধ্যে খন্ড যুদ্ধ চলছে। পরদিন কাকুর হাতে প্লাস্টার। বললাম, কি করে হলো?
কাকু বললেন, কুয়োতলায় সিলিপ কাইটা গেছিলাম।
আমার বন্ধু হেবো ভালো ইনফর্মার। ও এসে বলল, কাকিমার সঙ্গে কাকুর মহা সংগ্রাম কালে কাকিমার হাতপাখার প্রবল আঘাতে এই দূর্ঘটনা।
মনের শূন্যতা, মনের দেউলিয়াপনা আজকাল যেমন যত্রতত্র দেখা যায়, এমনটা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক মুখ পুস্তকে ছবি দেন। একদিন প্রশ্ন করায়, তিনি বললেন, আমার বাড়িতে আবার কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয় না, গিন্নির ইচ্ছায় সবকিছু হয়।
ও খুব লাইক কমেন্ট পছন্দ করে। আশ্চর্য হই, বাহাত্তর বছর বয়সে ভীমরতি!
দু কলম লেখার জন্য আজকাল মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় ডাক পড়ে। তবে অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেক জায়গায় সাহিত্য আলোচনা বা সাহিত্য পাঠ ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এত চিল চিৎকার।
মনে হয়, ভুল করে কোনো চিটে গুড়ের আড়তে বাইচান্স ঢুকে পড়েছি। চারদিকে নিজস্বী তোলা চলছে। কোলে মার্কেটে কিংবা মানিকতলার বাজারে এত চিল চিৎকার নেই।
সাহিত্য সাধনা কাহাকে বলে!
আমাদের এক দাদা স্থানীয় কবি আছেন, যিনি দীর্ঘ কবিতা পড়ে দর্শক মন্ডলীকে অনুষ্ঠান থেকে ফুটিয়ে দেন, আজকাল তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, আমি পিছনে গিয়ে লুকোই।
ডজন দুয়েক ছবি তোলার পর, তাঁর দাবি, আমার একখান ভালো ফটো তুলে দাও, ভাইটি!
জিজ্ঞাসা করি, এত ছবি তুলে কি করবেন?
দাদার সাফ জবাব, আমার ইস্তিরি বলে দেছেন, হ্যাঁগো, এই বয়সে তোমাকে তো নদের নিমাইয়ের মতো দেখতে, তুমি ছবি তুলে এনো, আমি মৌটুসীর মাকে দেখাবো।
এটা হল দেখনদারির যুগ। যে ছেলে বাবা মাকে চেনে না, ভাই বোনের সঙ্গে কোনো কালে সম্পর্ক রাখে নি, সে শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে রজনীগন্ধা ফুলের গোছা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ভাবা যায়। কী ডিউটিফুল জামাই!
বিয়ের পর মায়ের আঁচল ধরা ছেলে সেই যে লব কুশ করা বউকে নিয়ে লাপাতা হয়ে গেল, তারপর তাঁর আর দেখা নেই।
মুখ পুস্তকে তাঁর সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে সে
লিখলো, বউ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
সম্রাট শাহজাহান আজ বেঁচে থাকলে ,লজ্জিত হতেন। মমতাজের প্রতি এতদূর ভালোবাসা তিনি কি দেখাতে পেরেছিলেন?
একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটি বি,এ ক্লাসের ব্যাচ পড়াতাম। একটি মেয়ে পড়তে এলো। সবে মেঘনাদবধ কাব্য পড়াতে শুরু করেছি, মিনিট পনেরো হয়েছে, মেয়েটি বলল, আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, জামাইবাবুর সঙ্গে একটু মার্কেটে যেতে হবে, স্যার। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটল। মাসের শেষে ওর বাবা দেখা করতে এলেন।
মাষ্টারমশাই, ওকে কেমন বুঝলেন?
বললাম, ওকে তো পড়াবার অবকাশ পাই না। ও জামাইবাবুর সঙ্গে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়।
ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, আমার তো ওই এক মেয়ে। আমার আবার জামাই কোথায়?
মনের দেউলিয়া পনার কত ছবি। কত গভীর শূন্যতা মনের মধ্যে থাকলে, চারদিকে মানুষ নয়, ফানুস ঘোরে।
ট্রামে বাসে ট্রেনে, সর্বত্র দেখবেন, এখন শ্রোতা কম। বক্তা বেশি। প্রত্যেকেই এখন এডমন্ড বার্কের ভায়রা ভাই। এখানের মানুষ ডায়লগবাজিটা ভালো রপ্ত করেছেন।
অফিসে স্যুটেড-বুটেড মানুষজন দেখে, তার পদমর্যাদা আন্দাজ করা যায় না। সবাই নাকি অফিসারের চাকরি করেন। তাহলে, sub-ordinate কারা।
আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওদেশ থেকে এদেশে যারা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেন, গাছের ইলিশ মাছ আর পুকুরের আম এত খাইছি, এখনো মুখে সেই টেস লাইগ্যা আছে।
দূর্গা পূজার বিসর্জনের সময় কেপে কেঁপে নাচ আর ক্ষেপে ক্ষেপে গানের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতিক গরম মশালা পরিবেশন করা হয়। মুখোমুখি চারটে মাইকে চার রকম হিন্দি গান। কোনটার কথাই বোঝা যাবে না। এই না হলে পুজোর আনন্দ!
সরস্বতী পূজার সময় প্যান্ডেলের ঠাকুরের চেয়ে রাস্তার সরস্বতী দেখার জন্য তরুণ তুর্কিদের হামলে পড়া। সে ভারী দেখার মতো দৃশ্য!
আমাদের পাড়ার টোকনদা পড়াশুনোয় চতুর্থ শ্রেণীর সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন, ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারেননি। তিনি সব সময় ইংরেজী কাগজ বগলে নিয়ে ঘোরেন। রোববার সকালে দেখি, উনি শচীনের চায়ের দোকানে বসে আছেন। চোখ ইংরেজী কাগজের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, কাগজে কি লিখেছে টোকনদা?
তিনি উল্টো করে কাগজ ধরেছেন।
maruti suzuki র অ্যাড ছিল। বললেন, গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে। চাকা উল্টে গেছে।
আসলে, নিজের শূন্যতা ঢাকবার জন্য মানুষকে কত মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
একে বলে, দেউলিয়া মনের উদাস পণা।
শূন্যতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা আরকি!
আমাদের পাড়ার ভ্যাবলা যেদিন বিয়ে করতে গেল, সেদিন ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়েতে তোর কোনো ডিমান্ড আছে?
ভ্যাবলা বলেছিল, সারকেল ছাড়া বিয়ে করবু নি!
সমাজের পাঁজরে কবে যে এমন ক্যান্সার জন্মালো, আমরা প্রথমটা টের পাই নি। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের এই হৃদয়ের দীনতার ছবি প্রকটিত হচ্ছে।
এর শেষ কোথায়, আগামী দিন, আগামী সময় বলবে!