আনন্দ পার্বণ
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
“শুধায়ো না কবে কোন গান,
কাহারে করিয়াছিনু দান—
পথের ধুলার পরে
পড়ে আছে তারই তরে
যে তাহারে দিতে পারে মান।
তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
জানি না তোমার নাম,
তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি। “