গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা

সোনার সিঁড়িতে পা
-সুনির্মল বসু

 

 

তখন আশ্বিন মাস। পশ্চিমবাংলা জুড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন চলেছে। সকালবেলায় ঘাসের উপর শিশিরের শব্দ, মাঠে মাঠে কাশফুল, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ভেলা, দীঘির জলে শাপলা শালুক, নদীতে ভেসে যাচ্ছে গায়নার নৌকো। উদাসী প্রকৃতি। বাতাসে বাজছে উৎসবের সুর।

তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পপতি। দেশে-বিদেশে তাঁর অনেকগুলি শিল্প কারখানা। ভদ্রলোকের নাম, জেনাথন হকিন্স। স্ত্রী ইভা হকিন্সকে নিয়ে তিনি কলকাতার পূজো দেখতে এলেন।

গুগল ঘেঁটে তিনি ইতিমধ্যেই পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের খবরা-খবর নিয়েছেন।

মধুসূদন পাল, রাখাল পাল, রমেশ পাল, শম্ভু পালদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ভালো লেগেছে সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর।

অবশেষে তিনি অনিল পালের দেবী মূর্তি দেখতে এলেন। তরুণ শিল্পী। কাজে অভিনবত্ব আছে।

সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি এত কষ্ট করে মূর্তি বানান, যখন এগুলি নদীর জলে বিসর্জন হয়, আপনার কষ্ট হয় না।
অনিল পাল বললেন, কষ্টের কি আছে? আমি টাকা পাই, মূর্তি বেচি, এর বেশি আর কি!
সাহেবের স্ত্রী ইভা প্রশ্ন করলেন, সত্যি বলছেন?
অনিল পাল বললেন, একবার খুব কষ্ট হয়েছিল।
হকিন্স সাহেব বললেন, কেন?
অনিল পাল বললেন, ক্যালকাটা ফায়ার ব্রিগেডে প্রতিমা বানিয়েছিলাম। সেটা এমন সুন্দর হয়েছিল,
আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সেই ঠাকুর দেখতে যেতাম। তারপর যেদিন আউট্রাম ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল, সেদিন দূরে গাছের আড়াল থেকে
সেই দৃশ্য দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস,
কেউ আমাকে সেদিন দেখে ফেলেনি।
হকিন্স সাহেব বললেন, তাহলে আপনি যে বললেন, আপনি টাকার বিনিময়ে প্রতিমা তৈরি করেন, এর বেশি কিছু নয়।
ইভা হকিন্স বললেন, আসলে, টাকার জন্য নয়, শিল্পকে ভালোবেসে আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন।
অনিল পাল ধরা পড়ে গিয়েছেন, এমন মুখের ভাব করে চুপ করে মাথা নিচু করলেন।

সেই থেকে হকিন্স পরিবারের সঙ্গে অনিল পালের একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।

ও দেশের মানুষ যে শিল্প সৃষ্টিকে এত মর্যাদা দেন, তিনি এবং তাঁর পরলোকগত বাবা শিল্পী কার্তিক পাল কখনো সে কথা জানতেন না।

মিসেস ইভা হকিন্স কিছু ছোটখাটো মূর্তি নিয়ে লন্ডন ফিরে গিয়েছিলেন।

অনিল পাল ভালো ইংরেজি জানেন না। তবুও হকিন্স সাহেবের প্রশংসার কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুপার্ব, ওয়ান্ডারফুল, বিউটিফুল, ইত্যাদি।

ইভা হকিন্স অনিল পালের জন্য দেশে ফেরার আগে
অনেকগুলি উপহার দিয়ে যান।

তারপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

মৃৎশিল্পী অনিল পাল কলকাতা বিখ্যাত হয়েছেন। বিদেশেও তাঁর বানানো প্রতিমা বিশেষ সমাদর পেয়েছে।

একদিন বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী জয়া আর একমাত্র ছেলে বিশ্বরূপ অথৈ জলে পড়ল।

গঙ্গা মাটির দাম বেড়েছে, সব সময় চাহিদা মতো পাওয়া যায় না, মাসে একবার বা দুবার মাটি আসে।
আগের বছর বর্ষার জন্য অনেকগুলো প্রতিমা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।

জয়া অবশ্য সংসারটা বাঁচাবার জন্য লক্ষ্মীর পট, মনসার পট বানিয়ে বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়েছেন।

এভাবে দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তাই বিশ্বরূপ সেদিন মাকে বলেছে, আমি এবার থেকে সোনার দোকানে কাজ নেব। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না।

জয়া দেবী বলেছেন, বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে অন্য কাজ নিবি, তা হয় না।

শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মা ছেলের লড়াই চলেছে।

একদিন সকালে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নেমেই, হকিন্স সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ইভা সোজাসুজি উবের ট্যাক্সি করে পটুয়া পাড়ায় এসে হাজির হয়েছেন।

অনেক বছর বাদে আবার তিনি কলকাতায় এলেন।
অনিল পালের মূর্তি গড়ার কারখানার সামনে এসে,
তিনি প্রশ্ন করবেন, হয়ার ইজ মিস্টার পল?
বিশ্বরূপ কমার্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছে। সে বলল, হি ইজ নো মোর।
ও,আই সি। আই মিস হিম। হি ওয়াজ মাই গ্রেট ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ সাহেব দম্পতিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসালো। জয়া দেবী ওদের জন্য চা বানালেন।

বিশ্বরূপ ‌ জানালো, বাবা মারা যাবার পর ওদের বর্তমান আর্থিক দারিদ্রের কথা।

সাহেব প্রশ্ন করলেন, হোয়ার ইজ দ্য প্রবলেম?
বিশ্বরূপ বোঝালো, কাজের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। প্রতিমা সাজাবার জিনিসপত্র অত্যন্ত অগ্নিমূল্য।
প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিমা বিক্রি না হওয়ায়, ক্রমাগত ব্যবসায়িক ধাক্কার কথা।

জেনাথন সাহেব সব শুনলেন। বললেন, আই শুড ডু সামথিং ফর মাই বিলাভেড ফ্রেন্ড।
বিশ্বরূপ এবং জয়া দেবীর জন্য পাসপোর্ট ভিসা করা হলো।
সাহেব ওদের নিজের দেশে নিয়ে গেলেন।

আজকের জনপ্রিয় দৈনিকে সুদূর ইংল্যান্ডে বিশ্বরূপ পালের গড়া মূর্তির প্রশংসা বেরিয়েছে।

জয়া দেবী জেনাথন সাহেবকে বলছিলেন, আপনারা না থাকলে, আজ আমরা এই সুদিন দেখতে পেতাম না।
সাহেব বললেন, আমি কোনো বন্ধুকৃত্য করিনি, আমি শিল্পকে হেরে যেতে দিই নি, আমি চেয়েছিলাম, শিল্পীর মৃত্যুর পরেও, শিল্প যেন বেঁচে থাকে।

আজ বিদেশ জুড়ে শিল্পী বিশ্বরূপ পালের চতুর্দিকে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বরূপ সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, অল দিজ আর ফর ইয়োর কাইন্ডনেস।
সাহেব বললেন, নো মাই সন। অ্যাবসলিউটলি,নট।
দ্য পাওয়ার অব ক্রিয়েশন ইজ এবাব অল।

গভীর কৃতজ্ঞতায় বিশ্বরূপ মাথা নিচু করলো।

সাহেব আর মেম সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সাফল্যের খুশিতে কেঁদে ফেললো।

Loading

One thought on “গল্প- সোনার সিঁড়িতে পা

Leave A Comment