
গল্প- নিরঞ্জন
নিরঞ্জন
-শচী দুলাল পাল
বিজয়া দশমীর রাত্রি,বিসর্জনের পথে মা দূর্গা। আবালবৃদ্ধবনিতার শোভাযাত্রা চলেছে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে গঙ্গার ঘাটে। ব্যান্ড পার্টি, আলোক সজ্জায় ধুনুচি হাতে যুবক যুবতীরা নৃত্য করছে। কেউ ভাং, কেউবা কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে মদ মিশ্রিত পানীয় খেয়েছে। রাস্তার দুপাশে জনতার সারি। ঘরদোর ছেড়ে সবাই আজ রাস্তায়। অর্ঘ্য নামে একটি মেধাবী ছেলে সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করছিলো। হঠাৎ নাচের দল থেকে কয়েকজন বন্ধু অর্ঘ্যকে হাত ধরে টেনে নাচের দলে ঢুকিয়ে নিলো। সে নাচ জানেনা, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের সাথে পা মিলাতে লাগলো।
সেই নাচের দলে ছিল ভীরা নামে একটি ছেলে- তার সহপাঠী। ভীরা হিংসুটে ও দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। অর্ঘের উন্নতিতে তার জ্বলন হতো। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে যথারীতি মা’কে বিসর্জনের জন্য প্রতিমার জলে ভাসানের উদ্যোগ চলছে । অর্ঘ্য তীরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎ দেখলো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীরা। ভীরা তাকে এক ধাক্কা দিতেই জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। ভীরা তাকে বাঁচাবার ছল করে কিছু একটা দিয়ে তাকে আঘাত করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সবাই চোখের সামনে দেখলো একটা ছেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারালো। বিসর্জনের যাত্রীরা কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলো না। কে নিজের জীবন বিপন্ন করে ডুবন্তকে বাঁচাতে যাবে? তারা সবাই ধরে নিলো বিসর্জনের রাতে অর্ঘ্য ভেসে গিয়ে মরে গেছে।
জলের স্রোতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভাসতে ভাসতে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো দূরে, বহূদুরে। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুতগতিতে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো। অর্ঘ্য নামে একটি যুবক প্রতিমা বিসর্জন করতে গিয়ে ভেসে গেছে। অর্ঘ্যের মা-বাবা ও পরিবারের বুক ফাটা আর্তনাদে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো।
কোনো এক গঙ্গা তীরে বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। বেশ ছায়া সুশীতল গাছ গাছালীতে ভরা এই স্থানটি। গঙ্গাধারে পর্ণকুটিরে জোনাই নামে একটি বছর পনেরোর কিশোরী তার মা বাবার সাথে থাকে। অন্যদিন বেশ বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। আজ অজানা কারণে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পুব আকাশে সূর্য উদয় হচ্ছে। তার রক্তিম রশ্মিতে জল লালে লাল। গঙ্গা তীরে গিয়ে নির্মল বাতাসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ দেখলো প্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর কি একটা ভেসে আসছে। রক্তাক্ত দেহ। ভাসতে ভাসতে দেহটি এক্কেবারে তার সামনে এসে থামলো। দূর থেকে মৃতদেহ মনে হলেও সামনে এলে সে অনুভব করলো দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ছটফট করছে। জোনাই দেখলো বিসর্জিত দূর্গাকাঠামোর টুকরোর উপর ভাসমান যুবকটির প্রাণ আছে। সে যুবকটিকে জল থেকে তুলে নিজের যথাশক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় তুললো। পেটে চাপ দিয়ে জল বার করলো।ধীরে ধীরে ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। অবসন্ন শরীর। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জলে সাঁতার, মাছ ধরা, নিজের এক টুকরো বাগানে কাজ করা শক্তিশালী জোনাই নিজের শরীরে ভর নিয়ে যুবকটিকে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে নিয়ে এলো। গরম দুধ খেতে দিলো। সেবা পথ্য দিয়ে শরীরে প্রাণসঞ্চার করলো। যুবকটি চোখ মেলে চেয়ে দেখলো সেবারতা এক কিশোরীর হাত তার কপালে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে অবসন্ন দূর্বল শরীরে অক্ষম হয়ে পড়ে গেলো। জোনাই যুবকটিকে বলল- তুমি দূর্বল। মাথায় চোট লেগে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তোমাকে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? তোমাকে এক দেবীপ্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর গঙ্গা জল থেকে উদ্ধার করেছি।
ছেলেটি তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। বলল- আমি কিছু মনে করতে পারছি না?
হাসপাতালে দিন কয়েক থেকে যুবকটি সুস্থ হলে জোনাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। জোনাই-এর বাপ দিনমজুর। সবদিন কাজ থাকে না। চুল্লু খেয়ে ঘুমায়। মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজে। ঝিয়ের কাজ করে।
গরীবের সংসার। বাপটা একদিন চুল্লু খেয়ে মেয়ের উপর চড়াও হলো- আর কতদিন গলগ্রহটাকে পুষবি? ওর মাথার ঠিক নেই। নিজের নাম ঠিকানা বলতে পারছে না।
-না পারুক। একদিন না একদিন সে নিজেকে চিনতে পারবে।
-তাতে তোর কি লাভ?
-লাভ ক্ষতি আমি কিছু বুঝিনা। একজন মুমূর্ষুকে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করেছি তাই নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি ওকে আমাদের ঘরেই রাখবো। ওকে এখনি ছেড়ে দিলে ক্ষিদে তৃষ্ণায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
-আমরাই বা কোথা থেকে যোগাবো তার ভরণপোষণ?
-আমার খাবারের আর্ধেক আমি ছেলেটিকে খাওয়াবো।
-তার মানে তুই ছেলেটিকে এখানেই রাখবি? সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। লোকে কি বলবে?
-যে যাই বলুক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না তার পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারছে ততদিন আমি তাকে দেখবো। সংসার চালাতে তোমাদের যদি কষ্ট হয় আমি কাজ করব। উপার্জন করব।
মা রান্না করতে করতে এসে বললো- তোদের বাপ বেটির সব কথা শুনেছি। ঠিক আছে কাল থেকে তুই কাজে লাগ। সামনের উর্বর জমিটায় সবজি লাগা। গতর খেটে উপার্জন কর।
সবজি বেচে দু’ টাকা আয়ও হবে। আমিও না হয় দু’বাড়ি বেশি ঠিকে ঝির কাজ করব।
এভাবেই থাকতে লাগলো ছেলেটি। তারা নাম দিল দূর্গাপদ।
কয়েক বছর এভাবে কাটলো। জোনাই এখন অষ্টাদশী। দূর্গাপদ শহরে এক প্রোমোটারের অধীনে নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কর্মীর কাজ করে। জোনাইএর মা’কে সে মা বলে। বেতনের সব টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। একদিন তাদের অবস্থা সচ্ছল হলো। কাজকর্মে নিষ্টা, সততা, সরলতা দেখে প্রমোটার তাকে সুপারভাইজার পদে প্রমোশন দিলেন। দূর্গাপদ এখন উচ্চ আয়ের প্রমোটারের শ্রেষ্ঠ সেবক হলো। বেতনের টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করে দিল।
জোনাই, দূর্গাপদ একে অপরকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারা দিনান্তে প্রায়ই গঙ্গাতীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে গঙ্গার অপূর্ব শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা দুজনে নিজেদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।
একদিন খবরের কাগজের চপ ভাজা সহযোগে ঠোঙায় ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বহুবছর আগে এক ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেখে জোনাই চমকে উঠলো। “অর্ঘ্য নামে এক যুবক দূর্গা বিসর্জনের রাতে হুগলির ঘাট থেকে জলে ভেসে গেছে। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি সন্ধান পেলে নীচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাধিত হবো।”
ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গেলে জোনাই ঠোঙাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখে দিল।
সে ভাবতে লাগলো এ তো সাধারণ ছেলে নয়। যদি সে এখনই তার পরিবারের হাতে তুলে দেয় দূর্গাপদকে তাহলে সে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশংকায় তার দিন কাটতে লাগলো।
সারারাত তার ঘুম আসে না। একদিন মধ্যরাতে জোনাই দূর্গাপদর রুমে গিয়ে
ইতস্তত করতে করতে দূর্গাপদর কপালে এক গভীর চুম্বন করলো। দূর্গাপদ প্রথম নারী স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখলো জোনাই তার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-এ কি!জোনাই তুমি কাঁদছো কেন?
কি হয়েছে?
জোনাই দূর্গাপদকে জড়িয়ে ধরে বললো- আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-সে তো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কথাটা এতদিন মুখফুটে বলতে পারিনি।
-কথা দাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না!
-তিন সত্যি করে বলছি আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় তোমায় স্থান দিয়েছি। সে স্থান চিরস্থায়ী থাকবে।
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি অবসান হলো দূরে কোথাও ভোরের পূজার ঘন্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হলো।
আজ বিজয়া দশমী। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। গঙ্গাতীরে উপচে পড়া ভীড়।
দূর্গাপদ – জোনাই সুন্দর পোশাকে বিসর্জন দেখতে গেছে। তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে দূর্গা মায়ের বিসর্জন দেখছে। হঠাৎ পা পিছলে দুজনেই মায়ের কাঠামোর উপর পড়ে গেলো। শক্ত কাঠামোয় দূর্গাপদর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। কে বা কারা যেন তাদের ডাঙায় নিয়ে এলো। জোনাই বললো- তোমার নাম “অর্ঘ্য”।
সাথে সাথে দুর্গাপদর পূর্বস্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
হ্যাঁ। আমি অর্ঘ্য। আমিই দূর্গাপদ। তুমি আমার বাকদত্তা স্ত্রী।
এসো বিসর্জনের এই পুণ্য লগ্নে তোমাকে বরণ করি। অর্ঘ্য তার রক্তাক্ত কপালের রক্ত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো।
ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হলো।
জোনাই মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটিতে ফোন কল করে বললো- এই নাও তোমার নিজের মা বাবার সাথে কথা বলো।
অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসলো।
-মা! আমি তোমার ছেলে অর্ঘ্য বলছি। আমি বেঁচে আছি মা। আজ রাতেই আমি আমার সদ্য পরিণীতা নববধূকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসছি। তোমরা বরণডালা সাজিয়ে রেখো।

