গল্প

গল্প- মানুষ মানুষের জন্য

মানুষ মানুষের জন্য
-সুনির্মল বসু

সেদিন কলেজের ছুটি ছিল। তাই অন্য একটা কাজ নিয়ে সুধাময় সান্যাল সীমান্ত শহর বনগাঁয় গিয়েছিলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। খিদেও পেয়েছিল খুব। ব্যাগের মধ্যে কিছু শুকনো মুড়ি ছিল। খেয়ে জল খেয়ে কোথাও একটু বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন।

তাঁকে এই অঞ্চলের পথের কুকুরগুলোও চেনে। তারা এসে ঘিরে ধরেছিল। তিনি স্টল থেকে বিস্কুট কিনে ওদের খেতে দিলেন।

তারপর স্টেশনে এসে পেতে রাখা টানা বেঞ্চিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন।

মাথার কাছে ব্যাগ ছিল। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা পয়সা ছিল। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম থেকে উঠতেই, স্টেশনের উলঙ্গ বাচ্চাগুলো এসে বলল- জেঠু, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো, আমরা তোমার ব্যাগ পাহারা দিয়েছি।

সুধাময় বাবু ওদের খুব পরিচিত। ওই বাচ্চাদেরও তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেন।

বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে ওদের বিশাল জমিদারি ছিল একসময়। সুধাময় সব গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন।

ওর স্ত্রী মালবিকা একজন স্কুল শিক্ষিকা। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় ওদের একটা পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিন্তু সে দীর্ঘায়ু হয়নি।

বাচ্চাটা মারা যাবার পর, মালবিকা স্বামীকে বলেছিলেন, এবার আমাদের একটা বাচ্চা এডাপ্ট নিতে হবে।

সুধাময় বলেছিলেন, একটা বাচ্চা ভাবছো কেন, আমি একশো বাচ্চা এডাপ্ট নিতে চাই।

মালবিকা একথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।

সুধাময় বলেছিলেন, আমি আমাদের জমিতে ছোটদের জন্য একটা স্কুল বানাবো।

ওনাদের বাড়ির মূল ফটকের পাশে পুরুষানুক্রমে রয়েছে একটি শিব মন্দির। প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যে এখানে ভক্তদের সমাগম ঘটে।

স্কুল করবার কথা জানাজানি হতে, ভক্তদের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশেষ গুঞ্জন শুরু হলো।

একজন এসে বললেন, স্কুল বসালে, মুসলমান বাড়ির বাচ্চারা এখানে পড়তে আসবে, পাশে শিব মন্দির, এটা করা মনে হয় উচিত হবে না।

একদল এসে বলল- এ হলো গণ্ডমূর্খ গ্রাম। শুধু শুধু এদের পড়াবার জন্য চেষ্টা করলে, কোন লাভ হবেনা। ওরা কি বড় হয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।

সুধাময় শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে ছোটদের জন্য স্কুল গড়তে গেলে, চারিদিক থেকে তার উপর চাপ আসবে।

তিনি বললেন, আমি তো ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে। কিন্তু মুসলমান বাড়ির ছেলেরা এখানে পড়তে আসলে আমার কোন অসুবিধা নেই। ওরা এক সময় আমাদের প্রজা ছিল। সুখে দুঃখে বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে রয়েছি। কেউ জাতপাতের প্রশ্ন তোলেনি। বিপদে-আপদে ওরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে।

অন্য একজন রগচটা তরুণ এসে বলল, দাদা, কাজটা তুমি মোটেই ভালো করছ না। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে।

বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর উপর নানারকম চাপ এসেছিল। তিনি গ্রাহ্য করেন নি।

মনে মনে বলেছিলেন, একটাই তো জীবন। খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে চলে যাবো। কিছু নিয়ে আসিনি, সঙ্গে করে কিছু নিয়েও যাবো না।

সুধাময় ততদিনে শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি হাতে পেয়ে গিয়েছেন। কর্তা গিন্নীর উপার্জনের সিংহভাগ এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ব্যয় হয়।

স্কুলের জন্য কম্পিউটার কিনেছেন, নিজে ভাঙ্গা কম্পিউটার নিয়ে বাড়িতে নিজের ‌কাজ করেন।

মালবিকা স্কুলের নাম দিয়েছেন, সহজ পাঠ। দূর দূর গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে প্রতিদিন পড়তে আসে। বই খাতা পত্র সবই পেয়ে যায়।

সুধাময় বাবু বরাবর একটু অন্যরকম।

নিজেদের জমিদারি একদিন যেমন সকলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন, এভাবেই শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে,
আজ সহজপাঠ শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ওই অঞ্চলের মানুষ বলে, উনি মানুষ নন। বিলকুল দেবতা আছেন।

প্রতিপক্ষেরা বলে, লোকটাকে কিছুতেই দমানো গেলো না।

একটা কাজ শেষ হয়েছে। আবার একটা কাজ শুরু করছেন তিনি। শিক্ষার আলো জ্বেলে দিতে হবে তাঁকে। বয়স বাড়ছে। সময় কমে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান আজও তিনি।

মানুষকে ভালোবাসার কথা তিনি মুখে কখনো বলেননি, করে দেখিয়েছেন।

গতকাল রাতে সন্ধের টিভির খবরে জানা গিয়েছে আগামী ২৬শে জানুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হবে, তাঁর রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবার ডাক এসেছে।

সেদিন কলকাতায় সুধাময় বাবুর সঙ্গে একটি সাহিত্যের বাসরে আমার দেখা হয়েছিল। ওনার কাজের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। এত বড় মনের মানুষ সংসারে সচরাচর চোখে পড়ে না।

আমি ওনার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। বললাম- ও দাদা, কি করে পারলে, এত মনের জোর তুমি কোথায় পাও?

উনি হেসে বললেন- রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না, কিছু করতে হবে না, শুধু শিকড়টা ছুঁয়ে থাকবি। আমার একটা ছেলে যেদিন মারা গেল, সেদিন আমি আমার গিন্নীকে একশো ছেলের দায়িত্ব নেব বলেছিলাম। আজ সহজ পাঠ শিশু নিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে। ভালো আছি ভাই। এর চেয়ে বেশি কখনো তো কিছু চাইনি। লিও টলস্টয় এর গল্প মনে পড়ে, একটা মানুষের কতটুকু জমি দরকার।
‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাস এ ম্যান রিকোয়ার্ড?’

ফিরে এলাম।

মনে মনে বললাম, ভালোবাসার মানুষ থাকলে, ভালোবাসার বাড়ি হয়। মনে ভালোবাসা থাকলে, ছোটদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেবার ইচ্ছে জাগে। সহজ পাঠ শিশু নিকেতন তৈরি হয়।

দাদা তুমি পেরেছো, দাদা, তোমার মতো করে ভাবতে পারলে, দেশে শত শত হাজার হাজার দীপাবলীর রাতের মতো কত আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দেওয়া যেত।

সংসারের ক্ষেত্রে এমন পবিত্র আলোর মতো মনের মানুষ দেখতে পেলে, গভীর আবেগে হৃদয়ে ভালোবাসার ঢেউ ওঠে।

আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। শুধু মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ভাবনার গভীর ডুবে যাই। দু’চোখ জলে ভরে যায়।

পৃথিবীতে অনেক কিছুই মনের মতো নয় হয়তো, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, এত আলো জ্বালিয়ে দেন, তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।

আমি কখনো ঈশ্বরকে দেখিনি। এদেরকে দেখলে মনে হয়, আমি ঈশ্বরকে দেখতে চাই না।
ছোটখাটো চেহারার মানুষগুলোকে তখন আকাশের সমান লম্বা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! আমি ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি।

এদের জন্য বড় শ্রদ্ধা জাগে মনে। কত কত দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, চোখের সামনে বারবার একই দৃশ্য ঘুরেফিরে আসে।

তখন মনে হয়, জীবন আমার ভালবাসায় ভরে গেছে। ঈশ্বর আমাকে ঈশ্বর প্রতিম মানুষ দেখিয়েছেন।

চোখে জল আসে। ঘুরেফিরে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আপনারা এত ভালো কেন বলুন তো?

মনে মনে আমি ওনাকে বললাম, তোমাকে আনত প্রণাম, দাদা।

সেই সঙ্গে মনে হল, আমার এই দীর্ঘ জীবনে চলার পথে অন্তত দু-একজন ঈশ্বর ঈশ্বরীর দেখা পেয়েছি।

যাওয়া আসার পথের ধারে কত মনিমানিক্য পড়ে থাকে, দেখার চোখ থাকলে, জীবনের কোনো বাঁকে ঠিক একদিন ঈশ্বর এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page