
গল্প- চিরদিনের
চিরদিনের
-শিলাবৃষ্টি
একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষটার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছেনা। দুই ছেলে, দুই বৌমা প্রথম প্রথম তৎপর হয়ে খোঁজার চেষ্টা করলেও আবার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে! প্রতিভা দেবী আর কত বলবেন! ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো! পেপারে দেওয়া হয়েছে,এখন সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কি!
চল্লিশ বছর এক ছাদের তলায় দুজনে কাটিয়েছেন, কিন্তু এই বয়সে এসে এরকম ভাবে একা ফেলে চলে গেলেন অনাদি বাবু!
আসলে কিছুদিন ধরেই একটু অন্যমনস্ক ছিলেন তিনি। প্রতিভা দেবী অনেকবার প্রশ্ন করেছেন। একটাই উত্তর দিয়েছেন মাঝে মাঝে- আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করেনা। তুমিও ছেলেদের দলে ভিড়ে গেছ!
আসলে পুরোনো ধ্যান ধারণা ছেলেরা বউরা মানতে চায় না। প্রতিভা দেবীও অশান্তি এড়াতে ছেলেদের কথায় সাপোর্ট করতেন বেশী। গুম হয়ে যেতেন অনাদি বাবু। হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় সেই যে হাঁটতে গেলেন। আর বাড়ি ফিরলেন না।
কত খোঁজাখোঁজি করেও কোনো ফল হয়নি।
কত স্মৃতি আজ ভিড় করে আসে প্রতিভা দেবীর মনে। রাতে ঘুম আসেনা। তাহলে কি! না না আর কিছু ভাবতে চান না তিনি।
সকালে অফিস বেরোনোর সময় ছেলেদের কাছে
বলতে যান প্রতিভা- কিরে তোরা কিছুই আর করবি না? তোদের বাবা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল?
-দেখো মা! আমরা কি চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধু এই করবো! বড় ছেলের উত্তর।
ছোট ছেলে বলে- দেখো মা, কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে আমরা কি করতে পারি!
চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে যান প্রতিভা।
সংসারে কত জিনিস ফুরিয়ে গেছে! একে তাকে দিয়ে কত আনাবেন? চলে যাওয়ার পরে প্রতি মুহূর্তে মানুষটার অভাব তিনি বুঝতে পারছেন!
সেদিন অনেক রাত তখন… আজকাল ঘুম আসতে চায় না। একতলার বড় ঘরটাই তাঁদের।ছেলেরা উপরে থাকে।
হঠাৎ জানালায় কার যেন ছায়া!
-কে কে? কে ওখানে?
ফিসফিসিয়ে বলে- চুপ! দরজা খোলো।
এসেছে, এসেছে সে। ছুটে যান প্রতিভা দেবী।
দরজা খুলে ঘরে নিয়ে আসেন স্বামীকে।
-কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে এতদিন?”
-আবার চলে যাবো এখনি।
-না আর যাবে না তুমি. বড় খোকা….
অনাদি প্রতিভার মুখ চেপে ধরেন- ওদের ডেকো না। আমার অনুপস্থিতিতে ওদের কারো কিছু যায় আসে না গিন্নী! আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তাই তোমাকে নিতে এসেছি! চলো। কটা শাড়ি নিয়ে নাও ব্যাগে!
-কি বলছো এ সব? না আমি যাবো না। আমি চলে গেলে এদের….
-কিসসু হবে না এদের। রান্নার অসুবিধে হবে? রান্নার লোক রাখবে। নাতি নাতনিদের জন্য আয়া রাখবে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রতিভা।
-হ্যাঁ গো গিন্নী। একটু ভেবে দেখো। ওদের মানুষ করার জন্য নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য কি না করেছি আমরা। আজ প্রচুর পয়সা রোজগার করছে ওরা। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সবই তো রেখে যাচ্ছি। চলো না প্রতিভা আমরা যে কটা দিন বাঁচবো, একটু নিজেদের মতো করে বাঁচি।
-কিন্তু
-কোনো কিন্তু নয়। তুমি তো দেখলে এ কদিন। আমার জন্য কোনো মাথা ব্যথা আছে ওদের?
-কোথায় যাবো?
-আমার এক ছাত্রের একটা বাড়ি খালি পড়ে ছিল
এই শহরেই। সেই নীলেন্দ্র! মনে আছে তোমার? আমাকে এখনো এত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে যে বলার নয়! সে আমেরিকায় থাকে পরিবার নিয়ে।
আমার সিদ্ধান্ত তাকে বলেছিলাম একদিন। সে বলেছে যতদিন খুশী আমি যেন তার বাড়িটায় বাস করি। তাহলে সে নিশ্চিন্ত হবে। কেয়ার টেকার থাকে সারাদিন। চলো গিন্নি, আমরা যেমন খুশী তেমন ভাবে বাঁচি।
….
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনাদি আর প্রতিভা বেরিয়ে আসে সদর দরজা খুলে। দুজনেই
একবার পেছন ফিরে তাকায় নিজের বাড়িটার দিকে। পূব আকাশে রক্তিম আভা দেখা দেয়। অনাদি প্রতিভার হাতটা নিজের ডান হাত দিয়ে ধরে নেয়। তারপর গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

