গল্প

গল্প- মহুলের মা

মহুলের মা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী


সুবলা দেবী বেশ বিরক্তি সহকারে বলল, হ্যাঁ রে অভয় তুই যে এতো বড় স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিস তা আজ টের পেলাম।
মলি, মলয় বলতো বটে, মা বড়দা আর আগের মতো নেই। সবসময় বৌদির কথাতেই সায় দেয়। সেদিন বরং আমিই বকে ছিলাম ওদের দুজনকে। এখন তো দেখছি ওরাই ঠিক চিনেছে বড় বৌকে।
অভয়ের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। তবুও সে শান্ত স্বরে বলল- মা মহুল যেমন তোমার নাতনি ঠিক তেমনি আমার আর হৈমন্তীর মেয়ে। তাই মহুলের জীবনের ব্যাপারে হৈমন্তীর মতামত খুব দামী অন্ততঃ আমার কাছে।
সুবলা দেবীর রাগের আগুনে খানিকটা ঘি-এর মতো যোগ হলো অভয়ের কথাগুলো। দাউ দাউ করে যজ্ঞের শিখার মতো জ্বলে উঠে বললেন, তুমি তো বাবা অফিস আর ঘর করো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাকে থাকতে হয়।
এর মধ্যেই তোমার বউ-এর কীর্তি পাড়াতে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
হৈমন্তী কিচেনে খাবার রেডি করার জন্য দোতলা থেকে নেমে আসতেই সুবলা দেবীর মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামিয়ে বলল- মা আপনার তো তাহলে খুব নিন্দা মন্দ হচ্ছে পাড়াতে। তাহলে কিন্তু আজ থেকে আর পাড়া বেড়ানোটা বন্ধ করুন।
সুবলা দেবী মুখটা গম্ভীর করে বলল- তোমার মতো মুর্খ মেয়েমানুষ আমি তো এই প্রথম দেখলাম। নিজে সাধ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনো। তুমি আবার এম এ পাশ দিয়েছো!
সুবলা দেবীর এই একটা অস্ত্র আছে। যখন নিজে আর যুক্তি তর্কে পেরে ওঠে না তখন হৈমন্তীকে ধরাশায়ী করতে হৈমন্তীর শিক্ষা, বংশ এইসব নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে।
হৈমন্তী ও তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রয়োগ করে খুব মিষ্টি ও সংযত ভাবে।
-মা ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে ছিলাম। তাই তো উচ্চ শিক্ষার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন আপনারা। না হলে আমাকে কি আর মানুষ ভাবতেন? আপনাদের উচ্চ বনেদী বংশ। আপনারা ছিলেন গাঁয়ের বড়লোক। আর সেখানে আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাত্র। আপনাদের উদার মানসিকতা। তাই তো আপনার স্বামী আমাকে আপনাদের ঘরের বউ করে এনেছিলেন। মনে আছে মা উনি আমাকে কি দিয়ে মুখ দেখেছিলেন? উনি ওনার বই আলমারির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বড় বৌমা এখন মরেও সুখ আমার। এতকাল শুধু ভাবতাম আমি মরে গেলে আমার বইগুলোর কি হবে? আমার সহধর্মিণী পুরানো খাতা-বই বিক্রির দোকানে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে টাকাগুলো বগলদাবা করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে বই-এর খালি আলমারিটার মধ্যে ওনার মহামূল্য শাড়ি কাপড় রাখতে রাখতে বলবেন, কতবার বলেছিলাম একটা আলমারিতে আমার আর হচ্ছে না। আরেকটা আলমারি কিনে দাও। সে তো দিলে না। অগত্যা তোমার সাধের বই আলমারিটাই আমাকে বুদ্ধি করে কাজে লাগাতে হলো।
শ্বশুর মশাই এর এমন বুদ্ধি দীপ্ত রসিকতা শুনে সেদিন নতুন বউ এর ‘বউ বউ’ লজ্জা ভুলে বেশ হা হা আওয়াজ তুলে হেসেছিল হৈমন্তী।
হৈমন্তীর বিয়ের বছর দশেক পর মারা গিয়েছিলেন সুবলা দেবীর স্বামী। স্বামীর বিয়োগে সুবলা দেবী যত না ভেঙে পড়ে ছিলে তার থেকে অনেক বেশি ভিতর ভিতর ভেঙে গিয়েছিল হৈমন্তী।
নতুন এই ঠিকানায় তার তো একমাত্র মনের সঙ্গী ছিল তার শ্বশুর মশাই। বিকাল বেলা হলেই অভয়ের বাবা গল্পের বই বের করে হৈমন্তীকে ডাক দিতেন। বলতেন, বৌমা আমার চোখের জোড় তো আগের মতো নেই। তাই টানা অনেকক্ষণ ধরে বই পড়তে পারি না। তার চেয়ে ভালো এখন থেকে তুমি বই পড়বে আর আমি শুনবো।
এমন প্রস্তাবে হৈমন্তী যেন মনে মনে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল সেদিন। তারপর দীর্ঘ দশটা বছরের ছয়টা মাস বাদ দিলে একশো চোদ্দো মাস বিকাল বেলার এই গল্পের আসর বসেছে হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়িতে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স্মরণজীৎ চক্রবর্তী, আশাপূর্না দেবী থেকে বানী বসু এমন নতুন পুরাতন লেখক লেখিকা কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ঝড় বয়ে যেতো সুবলা দেবীর তিনতলা বাড়িতে।
তবে সুবলা দেবী সাধারণত এড়িয়ে চলতো এই গল্পের আসরকে। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুরোধে এসে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন নি। কারণ পাড়ার মহিলাদের মুখরোচক টাটকা গল্পের আসর থেকে ডাক আসতে থাকে বারংবার।
এইসব পুরানো কথা উঠলে কিছুতেই হৈমন্তী নিজের আবেগকে সংযত রাখতে পারে না। আসলে একটা চাপা যন্ত্রণা বড্ড টনটন করে ওঠে বুকের ভিতরটা। তার বড় ইচ্ছে ছিল নিজের লেখাপড়াটাকে কোনো সামাজিক কাজে লাগানোর। তাই সে ভেবেছিল গাঁয়ের নীচু পাড়াতে গিয়ে একটা অবৈতনিক নাইট স্কুল খোলার। স্বামী শ্বশুরকে পাশে পেলেও শাশুড়ি, ননদ, দেওর কাউকেই পাশে পায় নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব নয়। তাই সে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে ছিল।
তাই হয়তো এই কারণেই মহুলের পাকা কথার দিন ভরা সভাতে ছেলের বাড়ির পাকা মাথাদের সামনে হৈমন্তী বলে ওঠে- আমি মেয়ের মা হয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই আপনাদের কাছে। আমার মেয়ে সরকারি অফিসের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য দিন রাত এক করে মেহনত করেছে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম জানে কেবলমাত্র চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পরও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে আশা করি না আমি। আর তখন যদি আপনারা ঘরের কাজকর্মের জন্য বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে কিন্তু সমস্ত চাপটা এসে পড়বে আমার মেয়ের ওপর। তাই জানতে চাইছিলাম আপনাদের ছেলে কি দৈনন্দিন জীবনের জরুরী কাজ কর্মগুলো যেমন ধরুন রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর মোছা জানে তো?
হৈমন্তীর এই প্রশ্নে পাত্রের ঠাকুমা, মা, কাকীমা, দাদু, বাবা, কাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো মাত্র।
পাত্রের দাদু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমার পরিবারে মেয়েদের গৃহকাজে সাহায্য করার জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের কাজেই পারদর্শী বেশি। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি অভয় বাবু, আপনার সহধর্মিণী কিন্তু ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আমাদের পরিবারের মেয়ে বউরা কিন্তু অনেক ভদ্র ও লাজুক। আজ আমরা আসি। বাড়িতে গিয়ে অর্ক দাদুভাই-এর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। তারপর জানাবো।
এরপর কেটে গেছে আরো দু তিনটে মাস। ভ্যাপসা গরমের জায়গা নিয়েছে ঠান্ডা আমেজ। আশ্বিন শেষ করে কার্তিক আগত। দু’ দুটো মল মাস পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে। সুবলা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল মহুলের বিয়েটা এই অগ্রহায়ণে হবে। কিন্তু হৈমন্তীর অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসাবাদের দৌলতে মহুলের বিয়েটাই ঝুলে গেল। পাত্রপক্ষ চুপচাপ দেখেই চলে গেল। সুবলা দেবী এইসব কথা ভাবে আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে হৈমন্তীর সেই দিনের বক্তব্যগুলো যত দিন যাচ্ছে চানাচুর তেলেভাজা সহযোগে পরিবেশন করতে থাকে।
অনেকেই অবশ্যই সুবলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার নাতনির বিয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। এমন মোটা টাকার মাইনের চাকরি যার।
আবার অনেকই বলে তাই বলে পাত্রকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম জানতে হবে তবেই মা বিয়ে দেবে। এমন আবদার থাকলে পাত্র পেতে তো বেগ পেতেই হবে। যতই হোক আজও আমাদের সমাজ পুরুষ তন্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন ডিনার টেবিলে অভয় বলে- হৈমন্তী তোমার ঐ অসম্ভব জেদটা এবার ছাড়ো। আমি আমাদের মুখার্জী ঘটককে আসতে বলেছি আগামী কাল।
হৈমন্তীও গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- হ্যাঁ গো আমাদের সমাজের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেও পুরুষরা কিন্তু এখনও মধ্য যুগেই পড়ে আছে। নারী তুমি যতই বিদূষী হও, যত বড় পদেই আসীন হও না কেন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি ভুলে খুন্তি তুলে নিতেই হবে পরিশ্রান্ত হাতে।
রাতে শুয়ে শুয়েও এই বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্যে অভয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, কেমন আছেন অভয় বাবু? আমি অর্কর দাদু বলছি।
অভয় তাড়াতাড়ি বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে। হৈমন্তী চোখের ইশারায় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলে।
অর্কের দাদু বলেন, আমাদের বাড়ির মেয়ে, বৌমারা অর্ককে একটা বছর ধরে ঘষে মেজে প্রাত্যহিক ঘরোয়া কাজকর্ম শিখিয়ে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আমার দাদুভাই ডাক্তারির পাশাপাশি ভাত, ডাল রান্না করতে শিখে গেছে। সত্যি বলছি অভয় বাবু, সেদিন আপনার মিসেস এর কথা আমার প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌমারা বোঝালো যে পুরুষ মানুষ টুকটাক রান্না বান্না ঘরের কাজ না জানলে তাদের কি কি অসুবিধা হয়। সেদিন বুঝলাম আপনার মিসেস এর কথাগুলো ওর একার কথা নয়। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথা।
তাদের অসুবিধার লিস্ট শুনে তো আমরা পুরুষরা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এই বয়সে এসে রান্নাবান্না শেখা সম্ভব নয়। তাই অর্কর বাবা আর অর্ককে বললাম, তোদের তো এখনও শেখার বয়স আছে। তোরা ই না হয় রান্না শিখে দেখিয়ে দে পুরুষ মানুষও বাইরে ও ঘর দুটোই সামলে নিতে পারে। কথাগুলো শেষ করে হো হো করে হাসি দিয়ে মোবাইলটা ভরিয়ে তুললেন।
হাসি থামিয়ে বললেন- তাহলে আপনারা কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে মহুল ও অর্কর বিয়ের দিনটা ঠিক করতে?
অভয় কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। হৈমন্তীর ঠেলা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। শান্ত ভাবে বলে, মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে দিনটা জানাচ্ছি।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই অভয় হৈমন্তীর হাত দুটো নিজের কোলের কাছে টেনে এনে বলে, প্রথাগত আচার আচরণের বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক সাহস লাগে। আমার তো সে সাহস কোনোদিন হলো না। কিন্তু তুমি চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও সেই সাহসটুকু দেখিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত জীবনটা কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত ও শান্তি পূর্ণ করে তুলতে পেরেছো।
হৈমন্তী জিতে যাওয়ার আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেলে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি বলেই তো সমাজের চলার পথে এতো আবর্জনা জমে যাচ্ছে। নারীদের উন্নতি চাইছি কিন্তু উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে রাজি নই। যাক গে সমগ্র সমাজ পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমার নেই। কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে তো পরিবর্তনের হাওয়া আনতে পেরেছি।
এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে মা’কে জানিও অর্কের দাদুর কথাগুলো। অভয় এল.ই.ডি. টিউবটা বন্ধ করে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভয় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও হৈমন্তী সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। মনের মধ্যে উঠে আসতে লাগল মহুলের মা হওয়ার পর থেকেই মেয়ের জন্য আজ অবধি কত লড়াই না সে করেছে।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page