
গল্প- অপেক্ষা
অপেক্ষা
-অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ
“আমার একটা ভালো শাড়ি দিতে হবে। সেই সঙ্গে দুজোড়া বালা। সামনেই দূর্গা পুজো। মনে থাকে যেন আমার স– ব চাই। অনেক দিন থেকে বলে যাচ্ছো,দেবে দেবে।এবছর কিন্তু চাই “এমনি করে প্রতি বছর মল্লিকার আবদার মেটাতে মেটাতে রোহন হিমসিম।রোহন যখন প্রথম বউ নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়িসুদ্ধ সবাই বলেছিল,কি লক্ষ্মী বউ এনেছিস। ঘর আলো করে রাখবে।
দুটিতে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বাড়ির কারোর আপত্তি ছিল না। আপত্তি করেই বা লাভ কি! এখন নাকি ভালো মেয়ে পাওয়া যায় না। যা দিন কাল। আর ঘটকদের তো তেমন দেখায় যায় না। তাই রোহন যখন নতুনবউ নিয়ে এল। সবাই কত খুশি।কিন্তু তারপর শুধু চাই আর চাই। রোহনের যতই কষ্ট হোক, সে ভালোবাসার মানুষকে বিমুখ করবে না। তাই দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছে। তাতেও মল্লিকার কিছু এসে যায় না। বিয়ে যখন করেছে, সমস্ত দায়-দায়িত্ব স্বামীকেই নিতে হবে।
রোহনের একটা অটো রিকশা আছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা মেয়ে হলো। আরও খরচ।কোনো ক্রমে খেয়ে পরে চলে সংসার। তেমন ভাবে সঞ্চয় করতে পারে না কিছু। তাই বাড়িতে দিন রাত অশান্তি। মেয়ের খরচ, বউয়ের হাতখরচ মিটিয়ে মায়ের হাতে বেশী টাকা দিতে পারে না। মা সব বোঝে। ছেলের কষ্ট। তাই কিছুই বলে না।তবু বউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। একদিন বলেই দিল, এভাবে থাকতে পারব না। শিল্পীর মা রোজ কত দামী দামী শাড়ি পরে আসে। নতুন নতুন গয়না পরে । আর আমি সেই একই শাড়ি গয়না। হাতে দামী ফোন। ভাল্লাগে না এভাবে থাকতে। আমার বুঝি ইচ্ছে হয় না, রোজ নতুন নতুন শাড়ি গয়না পরতে? মেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়াবে না। এতে নাকি মান থাকবে না। তাই কেজি স্কুলে ভর্তি করেছে। মেয়েকে নিয়ে রোজ স্কুলে গিয়ে বসে থাকে। সারাবেলা আড্ডা দিয়ে ছুটির পর বাড়ি ফেরে বউ। আজকাল এটাই বাড়ির বউয়ের ডিউটি। বাড়ির কাজের জন্য তো শাশুড়ি মা আছে। রোহনের মা ভাত বেড়ে, নাতনি বৌমাকে খাইয়ে তারপর নিজে খায়।
রোহনের খুব মন খারাপ লাগে, মায়ের কষ্ট দেখে। তবু কিচ্ছু বলতে পারে না বউকে সে খুব ভালোবাসে। নিজের যতই কষ্ট হোক, ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেবে না। তাই আরও রোজকার করতে হবে। নইলে বউয়ের চাহিদা মিটবে না। আরও একটা পার্টটাইম কাজ খুঁজতে লাগলো।একদিন রোহনের বউ বেশ সাজুগুজু করে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেল । কিন্তু আর ফিরল না।প্রতিদিনের মতো ছুটি হলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত মল্লিকা । স্কুল থেকে ফোন এল, “আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান। বাড়ি থেকে এখনো কেউ আনতে আসে নি”।
রোহন অটোরিকশা চালাতে চালাতে ফোনটা ধরে ছিল। হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি। হাতটা কেঁপে উঠল। তবে কোথায় গেল মল্লিকা? মেয়েকে এখনো স্কুল থেকে আনে নি। নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বউকে একটা ফোন করল। ফোনের সুইচ অফ। আরও চিন্তায় প্যাসেঞ্জারদের মাঝরাস্তায় থামিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলল স্কুলে। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর মল্লিকার খোঁজ পেল না। মল্লিকার বাপেরবড়ি, যেখানে যত আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খোঁজ নিল। কোথাও নেই মল্লিকা। পাড়ায় কানাঘুষো হতে লাগলো, এ বউ নিশ্চয় পালিয়েছে। রোহন বিশ্বাস করে নি। বিপদ বুঝে রোহন থানায় ডাইরি করল। ছোট্ট মেয়েটা মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। রোহনের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না চোখে।
অবশেষে একটা ফোন এল।মল্লিকার ফোন।” আমি আর ফিরব না। নিজের মেয়ে নিজের কাছে রাখো। আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। আমি, তোমার বন্ধু রোহিতের কাছে আছি। এর সাথেই থাকব। যে বউয়ের আবদার মেটাতে পারে না। মেয়ের পড়ার খরচ যোগাতে হিমসিম খায়। তার কাছে আর ফিরব না।বাই।”ফোনটা কেটে দিল।রোহন বিশ্বাস করতে পারছে না প্রাণের চেয়ে প্রিয়মানুষ, নিজের প্রাণের বন্ধুর সাথে চলে গেল!অস্থির হয়ে বারবার রিং করতে লাগলো। আবারও ফোনের সুইচ অফ। আর ফোন আসে না। দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকমাস। মেয়ে এখন পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে যায়। রোহন আরও পরিশ্রম করে। অনেক টাকা রোজকার করতে হবে। দুজোড়া বালা গড়তে হবে মল্লিকার জন্য। মেয়েকে জড়িয়ে আদর করে হাসতে হাসতে বলে, তোর মা ঠিক ফিরে আসবে। দুজোড়া সোনার বালা চেয়েছিল। আমি দিতে পারিনি। তাই অভিমানে চলে গেল। দূর্গাপুজোয় ঠিক ফিরে আসবে।
ওই শোনা যায় আগমনী সুর পাড়ার ক্লাব প্রাঙ্গণে।সামনেই মহালয়া। রোহন অপেক্ষায়।

