
গল্প- একজোড়া চায়ের কাপ
একজোড়া চায়ের কাপ
সুনির্মল বসু
ওয়েলিংটন স্টীটে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বহু বছর ধরে চাকরি করছি। সাজানো সুন্দর অফিস। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। মাইনে কম। কিন্তু অফিসে ঠাট বাট আছে। নামে তাল-পুকুর, ঘটি ডোবে না।
পাঁচ বছর আগে বাটা কোম্পানি থেকে একজোড়া বুট জুতো কিনেছিলাম, বহু ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তার শুকতলা খুলে পড়েছে। চিফ অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার এ নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। সেদিন ছুটির পর চিনা পাড়ায় জুতো কিনতে গেলাম।
জুতোর দোকানের একটু আগে কাঁচের শোকেসের মধ্যে একজোড়া ভারী সুন্দর চায়ের কাপ ও প্লেট দেখতে পেলাম। কাপ এবং প্লেটের গায়ে নীল কারুকার্য করা ড্রাগনের ছবি। তিনশো কুড়ি টাকা দাম চাইলো। তিনশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। জুতো কেনা হলো না, সামনের মাসে মাইনে পেলে দেখা যাবে।
বাড়িতে কাপ দুটি দেখে আমার গিন্নী মিলি তো আনন্দে আটখানা। বাড়িতে অনেক কাপ প্লেট থাকলেও, বিশেষ অতিথিদের জন্য এই কাপ দুটি ব্যবহার করা হোত।
অফিসের বস মিস্টার বিভাস চৌধুরী অনেক দিন আমার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। এবার আমার ইচ্ছে হলো, ওনাকে একদিন বাড়িতে ডেকে চায়ের নেমন্তন্ন করে খাওয়াই। মিলিও এক কথায় রাজি।
পরের রোববার ওরা সস্ত্রীক এলেন। আমাদের ছোট্ট সাজানো ফ্ল্যাট। এই চায়ের কাপের জন্য আমার আজকে মান মর্যাদা বেড়ে গেল। চৌধুরী সাহেব এবং ওনার স্ত্রী বারবার কাপের প্রশংসা করলেন।
মিলি আরো সতর্ক। বিশেষ অতিথি ছাড়া ঐ কাপ কখনো বাইরে বের করত না। কেউ বাড়িতে এসে চলে গেলে, অল্প বয়সী কাজের মেয়ে তিলোত্তমা
কাপ দুটিকে ভালো করে মেজে ঘষে, কাঁচের আলমারিতে তুলে রাখতো।
তিলোত্তমা মাস ছয়েক ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মেয়েটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শুনেছি, রমেন বলে একটি যুবকের সে প্রেমে পড়েছে। রমেন বাপের পয়সায় মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় রেলা দিয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাত সাফাইয়ের কাজও করে। ওর বাবা ভবেশ বাবু বলেন, ছেলে আমার টেকনিকেলে কাজ করে। রাতে ডিউটি। যায় আর একটা ঘটি নিয়ে আসে, যায় আর একটা বাটি নিয়ে আসে। অবশ্য তাতে আমার কি। আমার অফিসের কলিগ শোভনাকে আমার খুব ভালো লাগে। ও আমাকে বিশেষ পছন্দ করে। মনে মনে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছিল। একদিন ও বাড়ি এলো। মিলি চিনা কাপে ওকে চা করে এনে দিল।
শোভনা কাপের প্রশংসা করতে দ্বিধা করলো না।
আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিলি অবশ্য এই সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানতো না।
যাবার সময় শোভনা টেবিলের পাশ গিয়ে বের হতে গিয়ে সামান্য ধাক্কায় একটি চায়ের কাপ ভেঙে গেল।
মিলির খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমারও। তবু যেহেতু ওর প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে, তাই আমি মেনে নিলেও, ও চলে যাবার পর মিলি বলল,
কিরকম চলাফেরা দেখেছো, এতদিনের ভালবাসার জিনিসটা টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।
একটি চায়ের কাপ ভেঙ্গে যাবার পর, শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগলো। অফিসের ইঞ্জিনিয়ার সুজিত মল্লিককে শোভনা ভালোবেসে ফেললো।
অফিস থেকে ফেরার পথে বাসের জানালায় বসে আমি ভাবছিলাম, একটা কাপের ভেঙ্গে যাওয়া এবং শোভনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা। নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।
এখন থেকে অন্য কাপে সকাল সন্ধ্যায় আমি চা খাই। সেদিন অফিস থেকে ফিরছি, ফ্ল্যাটের সামনে কেউ একজন মুখে সিটি বাজালো। তিলোত্তমা তাড়াতাড়ি করে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে চা খেতে গিয়ে দ্বিতীয় কাপটার দেখা পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, তিলোত্তমা তার হাতসাফাই প্রেমিকের জন্য কাপটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
পার্কে ওরা যখন কথা বলছিল, থানার ডিউটি অফিসার রমেনকে তাড়া করে। ওর নামে নানা এলিগেশন আছে। রমেন গলিপথে পালিয়ে যায়। এমনকি তিলোত্তমাও চটি খুলে দৌড়ায়।
বেজায় মন খারাপ হয়ে যায় আমার। কতদিনের শখের কাপ। শুনেছি, কাপটা ওখানে পড়েই ছিল।
বীথির মা দেখেছেন।
দুই ভদ্রলোক পার্কে এসেছিলেন। ওরা দুজনেই কাপটা ওদের বলে দাবি করেছেন। একজন বললেন, আমি গড়িয়াহাট থেকে একজোড়া কাপ কিনেছিলাম, একটা বাড়িতে রয়েছে, অন্যটা এটি। অন্যজন বললেন, গুল মারবেন না তো, দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিট থেকে বড়দিনের দিন আমি এই কাপ কিনেছিলাম।
এরিয়ার টাফ রংবাজ হাত কাটা শ্যামল এসে বলল- কাপ তোদেরও না, তোদের বাপেদের না, এ কাপ হল আমার। তে’ মাথার মোড়ে বসে আমি এই কাপে চা খাবো, আর আমার ফিয়াসে বুলবুলির সঙ্গে প্রেম করবো।
শ্যামল কাপটা নিয়ে চলে গেল। ওর অপনেন্ট পার্টি তখন গলির মোড়ে পেটো চার্জ শুরু করেছে। শ্যামল পথ চলতি রামনিধি বাবুকে কাপটা দিয়ে দিল। দ্রুত রিভলবার বের করে বিপক্ষ দলের ল্যাংড়া হাবুকে তাড়া করলো।
পরদিন সকালে রামনিধি বাবু আমাদের বাড়িতে মিলির কাছে এলেন। বললেন, এই কাপটা শ্যামল আমাকে কালকে রাখতে দিয়েছিল। মারামারির জন্য আর ফেরত নিতে পারে নি। বৌমা, কাপটা তুমি রেখে দাও।
কাপের প্রতি খুব বিরক্ত এখন আমি।
বললাম, আপনি নিয়ে যান, ওই কাপ আমাদের চাই না।
রামনিধি বাবু বললেন, আমি তো শচীনের দোকানে গিয়ে চা খাই। বৌমা আমাকে চা দেয় না। এই কাপ নিয়ে আমি কি করবো।
কথাটা সত্যি, ভাবতে লাগলাম, তিলোত্তমা কাপটা চুরি করে ওর হাত সাফাই প্রেমিক রমেনকে দিয়েছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে রমেন এবং তিলোত্তমা পালালে, দুই ভদ্রলোক এই কাপের দাবিদার হয়ে যান। যদিও তারা এই কাপের মালিক নন। মানুষের লোভ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
গায়ের জোরে শ্যামল কাপটা কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ও কাপটা ব্যবহার করতে পারেনি। রামনিধি বাবু কাপটা পেলেন। কিন্তু তাঁকে শচীনের দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়, বৌমা চা দেয় না।
আমি হেসে মিলিকে বললাম, ভাগ্যিস, অফিস ফেরত আমি সেদিন কাপ জোড়া এনেছিলাম, নইলে মানুষের এত বিচিত্র চরিত্র দেখতে পেতাম না।
অতিরিক্ত খুশিতে আমি মৌজ করে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, মিলি বলল, এখন সিগারেট ধরিও না। এই কাপে এখনই তোমাকে চা করে দিচ্ছি।

