
গল্প- শাল মহুয়ার চিঠি
শাল মহুয়ার চিঠি
সুনির্মল বসু
অমল সকাল দশটায় ডালহৌসিতে অফিস গেছে। বুবন এখন স্কুলে। বাইরে চড়া রোদ্দুর। জানালার ওপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে বসন্ত বাউরী এসে বসেছে। মহুয়া খাওয়া দাওয়ার পর টেবিলের উপর পড়ে থাকা পুরোনো অ্যালবামের পাতা উল্টাতে শুরু করল।
অমলের সঙ্গে ওর বিয়ের ছবি। সাত বছর হল, ওদের বিয়ে হয়েছে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।
অমল খুব ভালোবাসে ওকে।
অ্যালবামের পাতায় হঠাৎ একটা ছবির দিকে চেয়ে
মহুয়া আনমনা হয়ে পড়ে।
মনে পড়ে, অনেক দিনের অনেক কথা। ছবিটা সজীবদার। ওদের পাশের বাড়ির ছেলে। ছেলেবেলার বন্ধু। সেই ছোট্টবেলায় কদবেল মাখা খেতে গিয়ে তুমুল ঝগড়া। কথা বন্ধ।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সজীবদা কলেজে গেল। তখন মহুয়া ক্লাস ইলেভেনে পড়ে।
নিউল্যান্ডে দুর্গাপুজোর মেলা বসেছিল। মায়ের বেনারসী শাড়ি পরে সেদিন ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিল মহুয়া।
সজীব ওর বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বটতলায় আড্ডা দিচ্ছিল। মহুয়াকে দেখে সামনে এগিয়ে এলো।
বলল, কবে কোন ছোটবেলায় সামান্য কারণে ঝগড়া হয়েছিল, তাই বলে এতদিনের সম্পর্ক সব ভুলে গেলি?
মহুয়া বলল, আমি তো কতবার কথা বলতে চেয়েছি তোমার সঙ্গে। তুমিই তো মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছো।
তোকে আজ দুর্দান্ত লাগছে রে!
হলুদ পাঞ্জাবিতে তোমাকেও ভালো লাগছে।
আয় না ভাব করে নিই।
সত্যি কথা বলবো?
তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পারার জন্য আমার ভারী কষ্ট হয়,সজীবদা।
ব্যাস, মিটে গেল। আমরা বন্ধু ছিলাম, বন্ধু আছি, বন্ধু থাকবো।
প্রমিস।
হ্যাঁ, প্রমিস।
ছুটির দিনে বিলের পাশ দিয়ে সরষে ক্ষেত ছাড়িয়ে কদম গাছের তলা দিয়ে ওরা ছাতিম বনের দিকে এগিয়ে যেত।
মহুয়া ভাবে, ছোটবেলায় ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়া, জোসনা রাতে লুকোচুরি খেলা, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে পড়ে আকাশে স্বাতী নক্ষত্রের পাশে অরুন্ধতীকে খোঁজা, কী সব মায়াময় দিন। কোন কোনদিন দীঘির পাড়ে সুপরি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জলের ঢেউ গোনা, কত কত স্মৃতি।
মহুয়া একদিন সজীবের হাত ধরে বলেছিল, আমরা সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে পারিনা?
মৌ, আমি বেকার। পড়াশোনা শেষ হয়নি।
আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। ফাইনাল পরীক্ষাটা হয়ে গেলে, তুমি একটা কাজ খোঁজো।
ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাবার পর, চাকরির জন্য দরোজায় দরোজায় গিয়েও, কিছুই কপালে জুটলো না সজীবের।
ততদিনে মহুয়া বিএ সেকেন্ড ইয়ার পড়ছে। হঠাৎ বাড়ি থেকে অমলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করা হলো।
লুকিয়ে দেখা করেছিল মহুয়া সজীবের সঙ্গে। বলেছিল, আমি কি করবো?
সজীব অসহায় ভাবে বলেছিল, আমার পায়ের তলায় কোন জমি নেই, মৌ।
মহুয়া কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল,আমি চলে যাচ্ছি।
আর কোনদিন তোমার কাছে আসবো না।
সজীব কিন্তু বিয়ের দিন মহুয়াদের বাড়ি উপস্থিত ছিল। শুধু তাই নয়, ছোটাছুটি, পরিবেশন সবকিছুতেই হাত লাগিয়েছিল।
মহুয়া অ্যালবামে তাকিয়ে দেখলো, সজীবদা নিমন্ত্রিতদের খাবার পরিবেশন করছে।
মহুয়ার মনে পড়ল, অমলের সঙ্গে এম্বাসেডর গাড়ি করে শ্বশুর বাড়ি যাবার সময়, কোথাও সেদিন সজীবদাকে দেখা যায়নি। অথচ, মহুয়ার খুব ইচ্ছে করছিল, একবার মানুষটাকে চোখের দেখা দেখে যাই।
বিয়ের পর বাপের বাড়ি প্রথম প্রথম যাওয়া-আসা ভালোই ছিল। বুবনের জন্মের পর থেকে আজকাল আর যাওয়া হয় না। মাস তিনেক আগে যখন বাড়ি গিয়েছিল, তখন ওর ছোড়দা বিকাশ বলেছিল, সজীব এখন একটা মার্কেন্টাইল ফার্মে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। কবিতা লেখে। বিয়ে করে নি। এ কথা জেনে সেদিন ভারী কষ্ট পেয়েছিল মহুয়া।
খুব ইচ্ছে করছিল সজীবদার সঙ্গে একবার কথা বলার। আবার মনের মধ্যে সংশয় জাগছিল, একজন বিবাহিতা নারী হিসেবে এই কাজটা কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে?
অ্যালবামটা মাথার বালিশের পাশে রেখে
ফোনটা তুলে মহুয়া সজীবদাকে রিং করলো,
হ্যালো!
কেমন আছো তুমি?
ভালো।
সত্যি বলছো?
নিজে বুঝতে পারিনা ঠিক।
বিয়ে করোনি কেন?
ইচ্ছে হয়নি।
তাই কি?
হ্যাঁ।
তুমি নাকি কবিতা লেখো?
কে বলেছে?
আমার ছোড়দা।
হু।
আমাকে তোমার কবিতা পড়াবে না?
পাঠিয়ে দেবো।
তুমি আসবে না?
না।
কেন?
আমি একটা ছায়া জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। আমার মনের চারদিকে একটা দূর্গ বানানো আছে। সেখানে আমি একলা, অথচ, আমার মন জুড়ে কত বড় একটা আকাশ, কত বড় একটা সমুদ্র, কত আলো,
রাতের আকাশে কত তারা। চাঁদের কত স্নিগ্ধ আলো।
আমাকে ভুলে যেতে পারলে?
একটুও ভুলিনি। তোমার কথা প্রতিদিন আমার প্রতিটি লেখাতে বলি।
তোমার লেখা শেষ কবিতার বইটার নাম কি?
শাল মহুয়ার চিঠি।
মহুয়া বলল, ও। তারপর ফোন কেটে দিল।
কিছু না পেয়ে একটা মানুষ এমন গভীরভাবে স্মৃতি আঁকড়ে ভালোবেসে যেতে পারে, একথা ভেবে মহুয়ার চোখে বর্ষা নামলো।
ততক্ষণে অমল বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বলল, চোখে জল কেন?
মহুয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল,মনে হয়, চোখে একটা পোকা পড়েছে।

