গল্প

গল্প- জেন জি

জেন জি

লোপামুদ্রা ব্যানার্জি

ও বাবা এতদিন বাদে বুঝি বুড়ি জেঠিমাকে মনে পড়ল! গত বছরের চরকের মেলায় এসেছিলি মেয়েকে নিয়ে। তারপর একটা বছর পর মনে পড়ল?

কৃষ্ণা কোলাপুরি চপ্পলগুলো দরজার বাইরে খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকেই ওর জেঠিমার পদ স্পর্শ করল। তারপর পায়ের ধুলোটা যত্ন ভরে মাথায় বুলিয়ে নিয়ে বলল, ও জেঠিমা তোমার কাছে আসতে তো মাঝে মধ্যেই বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু সংসারের কাজের চাপে হয়ে ওঠে না।

কৃষ্ণার জেঠিমা মালতি দেবী ইতিমধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন লেবুর শরবত করার জন্য। কাঁচের একটা সুদৃশ্য গ্লাসে আধ গ্লাস নরমাল জল আর আধ গ্লাস চিলড ওয়াটার দিয়ে নুন চিনিটা ভালো করে গুলে একটা মাঝারি মাপের পাতি লেবুর অর্ধেক কেটে বীজ গুলো ছুরির ডাগা দিয়ে ফেলে গ্লাসের জলে রসটা চিপতে চিপতে বলল, হ্যাঁ রে কৃষ্ণা তোদের তো মাত্র তিনটে লোকের সংসার। তাতেই দম ফেলার সময় পাস না তোরা। আর আমাদের ছিল ত্রিশটা লোকের সংসার। তার মধ্যেই সংসার সামলেও স্কুলের চাকরিটাও বজায় রাখতে হয়েছে হাসি মুখে।

কৃষ্ণা সোফায় বসে শরবতের গ্লাসে কিছুটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বলে,

হ্যাঁ গো জেঠিমা তোমরা কি করে পারতে?

মালতি দেবী কিচেনের দরজাটা বন্ধ করে এসে কৃষ্ণার পাশে বসল। তারপর কৃষ্ণার থুতনিতে হাত বাড়িয়ে চুমু খেয়ে বলল, দেখ কৃষ্ণা আমাদের কাল আর তোদের কালের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা ছেলে মানুষ করেছি অতি সাধারণ ভাবে। মোটা ভাত মোটা কাপড় আর বই খাতার জোগানটা দিতে পারলেই মোটামুটি কর্তব্য পালন করা হয়ে যেত। ছেলে মেয়েদেরও তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। তারই মধ্যে কেউ একটু বায়না করলেই বাবা জেঠু দাদুর ভয় দেখালেই সবাই চুপ হয়ে যেত।

তা যা বলেছো জেঠিমা। আর এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলে মেয়েদের বায়না তে বাড়ির গার্জেন রা ভয়ে ভীত। এই তো আগের বছর জন্মদিনে আমার মেয়ের সে কি বায়না! তার সব বন্ধুদের কাছে দামী দামী মোবাইল আছে। তাকেও দিতে হবে। বোতাম টেপা মোবাইল নিয়ে আর টিউশন কলেজে যাওয়া যাচ্ছে না।

মালতি দেবী চোখ গুলো কপালে সামান্য তুলে বলে, বলিস কি রে? তারপর কি করলি তুই?

কি আর করব! অগত্যা বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন দিতেই হলো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না!

তারপর শোনো এখন আবার কেবল কানেকশন থাকলেই হবে না। নেট ফ্লিক্স, অ্যামাজন আরো কত সব এ্যাপ বেরিয়েছে। সেইসব সাবসক্রিপশন না হলে চলবে না।

বলিস কি রে? এতসব নিয়ে মেতে থাকলে লেখাপড়া করে কখন?

আর লেখাপড়া। ও তো চোখে দেখতে পাওয়া যায় না।

সে কি রে! তাহলে রেজাল্ট কেমন করছে?

ওখানেই তো আশ্চর্য হয়ে যাই। রেজাল্ট তো যথেষ্ট ভালো করে। আসলে ওর যত লেখাপড়া শুরু হয় আমরা রাতে শুয়ে পড়লে। সারারাত পড়াশোনা। ভোর বেলায় শুতে যাওয়া।ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলে, ডোন্ট ওরি ম্মামা। কিছু একটা তো করেই নেবো।

হ্যাঁ রে কৃষ্ণা এরা কোন প্রজন্ম? এরা তো স্বাভাবিকতা থেকে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

তবে শোন তোকে বলি এই গত সপ্তাহের ঘটনা। আমি পেনশন তুলে ফিরছি। বিরাটী স্টেশনে নেমে অটো ধরবো বলে রেল লাইনটা পার হচ্ছি। আমার পাশে পাশে দুটি অল্প বয়সী মেয়েও হাঁটছিল। ওদের মধ্যেই একটি মেয়ে কোল্ড-ড্রিঙ্কস খেয়ে বোতলটা রেল লাইনেই ছুঁড়ে ফেলল। আর একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, অ্যাই অসভ্য রেল লাইনের ওপর কেউ বোতল ছোঁড়ে? তোর কি কোনো বোধ বুদ্ধি নেই?

তখন যে মেয়েটি বোতল টা ফেলেছিল সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় হাসতে হাসতে, না আমার বোধ বুদ্ধি নেই।কারন আমি পশ্চিমবঙ্গ বাসী।

কৃষ্ণা ওই মেয়েটির প্রত্যুত্তর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই কিছু ক্ষনের জন্য।প্রথমেই ভাবি নিজের রাজ্য সম্বন্ধে কি ধারণা হয়েছে আমাদের ভাবি উত্তরাধিকারীদের। তারপর ভাবি এরা হচ্ছে জেন জি। কত সহজে বাস্তব কে মেনে নিতে শিখছে এরা।

একদম ঠিক বলেছো জেঠিমা। তাই এই প্রজন্মকে নিয়ে গেল গেল রব না তুলে বরং কবি গুরুর কথায় বলতে হয়, ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’

সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page